কুসুমপুরের স্মৃতি : মলয় রায়চৌধুরী

আম্রপালী : লোকে ভাবে আমি হলিউড-টলিউড-বলিউডের অভিনেত্রী । কতো ইডিয়ট ভেবে দেখুন একবার। আমি খাঁটি বিহারি ; বৈশালী আমার জন্যেই বিখ্যাত । তবে ইতিহাসের সেই বৈশালীর নাম এখন হাজিপুর, লিচুর জন্যে বিখ্যাত । গঙ্গার ওপারে রাজ্যবিস্তার করতে রাজগির থেকে রাজধানী সরিয়ে পাটলিপুত্রে নিয়ে এসেছিলেন অজাতশত্রু। পাটলিপুত্র আজকের পাটনা। পাটনা থেকে লিচ্ছবী গণপ্রজাতন্ত্র দখল করেছিলেন অজাতশত্রু, কেবল আমার জন্য, কারণ আমি ট্রয়ের হেলেনের চেয়েও সুন্দরী। ইতিহাস রয়ে গেছে, বদল হয়নি ভূগোলের। সেই হাজিপুর, সেই মগধ, সেই পাটনা, সেই বক্সর  আজও জীবিত। সেই কবে রাজগির থেকে গঙ্গা পেরিয়ে বৈশালী এসেছিলেন বিম্বিসার নামে বিহারি রাজা । আমার তখন জগত্‍ জোড়া খ্যাতি। সেই সময় পেরিয়ে গেছে বহুদিন। আর্যাবর্তের ষোলো মহাজনপদে গণতন্ত্রের একটা  লিচ্ছবীদের রাজধানী এই বৈশালী। যে বিম্বিসারের সুশাসনের কথা মহাজনপদে মুখে মুখে ঘুরত সেই বিম্বিসারকে মৃত্যু পর্যন্ত কাটাতে হয়েছিল জেলে। অজাতশত্রুও আমাকে পেতে চেয়েছিল । বাপ-ব্যাটা আমার প্রেমে পাগল । অজাতশত্রু টের পেয়ে গিয়েছিল যে ওর বাপ আমার কাছে লুকিয়ে-লুকিয়ে আসতো । তাই বাপকে জেলে পুরে দিলে । লিচ্ছবীরা ছিল বিহারি খোট্টা ।  ভারতের আম গবেষকরা আমাকে প্রসিদ্ধ করার জন্যে দশোহরি আর নিলম–এই দুটো আমের মধ্যে সংকরায়ণের মাধ্যমে এক নতুন আম উদ্ভাবন করেছেন আর সেই আমের নাম রেখেছেন আম্রপালী।যখন চুষবেন, আমার বিহারি গায়ের সুগন্ধ পাবেন, এতোকাল পরেও ।

আলেকজান্ডার : সত্য লালুকাস, কী বিচিত্র তোমার দেশ !

লালুকাস : স্যার, আমি লালুকাস নই, আমি লালুমস্তান , জরাসন্ধের বংশধর, যাকে ভীম চোট্টামি করে মেরে ফেলেছিল । আমি এমএবিএল, ইংরেজি জানি না ; আমার মেয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম সান্মানিক স্নাতক, ইংরেজি জানে না । আমার ছোটো ছেলে তেজুমস্তান ক্লাস টেন ফেল, উপমুখ্যমন্ত্রী হয়েছিল, সাত কোটি টাকার মালিক। আপনাদের মতন যুদ্ধ-টুদ্ধ না করেই আমি তিন হাজার কোটি টাকা কামিয়েছি ; শত্রুপক্ষ তাই আমাকে জেলে পুরেছিল, জেল মানে দিল্লির পাঁচতারা হাসপাতাল, কেননা আমি অসুস্থ হবার ভান করতে ওস্তাদ ।

আলেকজাণ্ডার : শুনেছি আপনার বড়ো ছেলে পাগল, তাকেও মন্ত্রী করেছিলেন । সে কখনও কৃষ্ণ সেজে বাঁশি বাজায়, কখনও বা শিব সেজে সারাগায়ে ছাই মেখে থাকে । প্রচুর যৌতুক নিয়ে তার বিয়ে দিলেন জিনস-টপে ইংরেজি বলিয়ে কনভেন্টে পড়া মেয়ের সঙ্গে । পাগলটা বউকে বিনা পোশাকের রাধা বা পার্বতী সাজিয়ে, ফুলের মালা পরিয়ে, গান গাইতো আর  পেটাতো । এখন ডিভোর্সের মামলা চলছে ।

লালুকাস : পাগল তো তুঘলকও ছিল । দক্ষ রাজনেতা হতে গেলে একটু-আধটু পাগলামি জরুরি । আমি তো জুলিয়াস সিজারের মতন চুল ছাঁটাই বলে লোকে আমাকেও বলে শেয়ানা পাগল ।

শের শাহ সুরি : এই লালুকাস লোকটা আর ওর শালা-স্যাঙাত মিলে আমার তৈরি পাটনা রাজধানীকে আবার পাটুলিগ্রাম করে তুলেছিল, বসবাসের অযোগ্য । ফুটপাথে গরু পুষেছে, দেয়ালে-দেয়ালে ঘুঁটে ঠোকা । রাস্তার ধারে নর্দমায় লোকে হাগছে-মুতছে । এই কী আমার পাটনা ?

সম্রাট অশোক : খ্রিস্টপূর্ব তিন অব্দে আমার রাজত্বকালে কাঠের পাঁচিলের বদলে পাথরের পাঁচিল বসিয়েছিলুম শহরটার চারিধারে । সে সময় পাটলিপুত্র ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম জনাকীর্ণ একটি শহর। ভেবে দেখুন, গিজগিজ করছে বিহারি মানুষে, যারা আজকাল চাকরি পায় না বলে পাঞ্জাব-হরিয়ানায় ক্ষেতে কাজ করতে যায় । বিভিন্ন শাসনামলে নানা নামে পরিচিত ছিল এই শহর, যেমন—পাটালিগ্রাম, পালিবোথরা, কুসুমপুর, পুষ্পপুরা, আজিমাবাদ আর এখনকার পাটনা, যাকে বলা হয় প্রাচীন পাটলিপুত্রের নতুন রূপ। আমার হেঁসেলে প্রথম রান্না হয়েছিল মটরশুঁটি, তেজপাতা, রশুন–তিনটে একসঙ্গে বেটে তরকারি, পরোটা দিয়ে খেতুম, যুদ্ধের সময়ে টিফিনবাক্সে ভরে নিয়ে যেতুম ।

চাণক্য : মৌর্য সাম্রাজ্যের রাজা চন্দ্রগুপ্ত সত্যিই বিহারি খোট্টা ছিল । আমি যদি ওকে গাইড না করতুম তাহলে ও এরকম একটা সাম্রাজ্য গড়তে পারতো না ।  শক্তিশালী নন্দ রাজবংশকে উৎখাত করে পাটালিপুত্রে মৌর্য শাসন কায়েম করার প্যাঁচ আমিই তো শিখিয়েছিলুম ওকে । এই বংশই পরবর্তীতে ভারতীয় ইতিহাসে শক্তিশালী মৌর্য সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত হয়।  চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যেরই দ্বিতীয় পুরুষ হলেন বিন্দুসার আর তৃতীয় প্রজন্মে আরেক প্রতাপশালী শাসক সম্রাট অশোক।  লালুকাস সেই সিংহাসনে বসিয়ে দিলো নিজের বউ রাবড়িভৌজিকে ।

রাবড়িভৌজি : আমি চাইনি বসতে । আমার বরকে বসতে দেয়া হয়নি বলে আমি বসলুম । তবে আপনি যেমন চন্দ্রগুপ্তকে আড়াল থেকে চালাতেন, আমার বরও তেমন করেই চালাতো । কিন্তু ওর বুদ্ধি তো আর আপনার মতন নয়, তাই গোলমাল করে ধরা পড়ে গেল ।

চাণক্য : নন্দ রাজবংশের শেষ রাজা ধনানন্দের দরবারে আমাকে অপমান করা হয়েছিল। আর সেই অপমানের বদলা নিতে ধনানন্দকে ক্ষমতাচ্যুত করার ছক কষি আমি । খুঁজতে থাকি একজন যোগ্য শিষ্য, যাকে দীক্ষা দিয়ে ধনানন্দকে পরাভূত করা যাবে। আমার দেখা হয় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সাথে। দীর্ঘদিন চন্দ্রগুপ্তের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর আমাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে । আরো কয়েকজন আঞ্চলিক শাসকদের সাথে মিলে জোট গড়ে তুলি । একে তো ধনানন্দকে তার প্রজারা পছন্দ করতো না, তার ওপর আমার  রণকৌশলের সামনে টিকতেই পারলো না নন্দবাহিনী। আর এরই সাথে নন্দবংশের পতন ঘটিয়ে চন্দ্রগুপ্তকে সম্রাট করে নতুন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করি ।  এই সাম্রাজ্য বিস্তৃতি লাভ করতে করতে পশ্চিমে সিন্ধু নদী থেকে পূর্বে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছিল । 

রাবড়িভৌজি : একজন বিহারির এতো বড়ো সাম্রাজ্য আর আমাদের বিহারকে ওরা দুটো টুকরোয় বাঁটোয়ারা করে ফেললো ; আমার বর এখন অন্য টুকরো ঝাড়খণ্ডের মামলায় ফেঁসে গেছে । ওখানের পাগলাগারদ তো বিখ্যাত।

চাণক্য : আমি নিজে বিহারি নই ; আমি তক্ষশীলার পাকিস্তানি । আলেকজান্ডার ভারতবর্ষ আক্রমণ করে বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করার সময় আমি আলেকজান্ডারের সৈন্যবাহিনীর রণকৌশল গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছিলুম। গ্রিকদের হাত থেকে পুরো উত্তর ভারত যখন মুক্ত করে নিচ্ছিল চন্দ্রগুপ্ত, তখন আড়ালে বসে কলকাঠি নাড়ছিলুম আমি । সরাসরি গ্রিকদের তাড়ানো সম্ভব নয় জেনে আমি একজন একজন করে আলেকজান্ডারের নিয়োগ করা  প্রাদেশিক শাসককে খুন করার পরামর্শ দিয়েছিলুম । ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের মৃত্যুর আগেই এখনকার আফগানিস্তানে গ্রিকদের দাপট কমে আসে। আর আলেকজান্ডার মারা যাবার দুই বছরের মধ্যে গ্রিকরা ভারতীয় উপমহাদেশ  ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। 

লালুকাস : তাই তো বলি ! আফগানগুলো  মতন অমন যুদ্ধপাগল কেন !

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য : আমার মায়ের নাম  মুরা।  ‘মুরা’ নাম থেকে আমার পদবি ‘মৌর্য’ । আমার মা মুরা ছিলেন শুদ্রাণী বা শুদ্র জাতের, এখন যাকে বলে শিডিউলড কাস্ট।সারা ভারতবর্ষ জুড়ে শিডিউলড কাস্টের সাম্রাজ্য, ভাবতে পারেন ! বিশাখাদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটক পড়ে দেখতে পারেন, আমার মা ছিলেন নন্দ রাজ্যের একজন রাণীর দাসী।  নন্দ রাজা আমার সুন্দরী মাকে ধর্ষণ করেছিল, যার ফলে মা গর্ভবতী হন আর আমার জন্ম হয়। লোকলজ্জার ভয়ে আমার  মা আর ওনার কোলের বাচ্চাকে রাজ্য থেকে তাড়ানো হয়েছিল।  তাই নন্দবংশকে ধ্বংস করার জন্যে আমি ছোটোবেলা থেকে নিজেকে তৈরি করেছিলুম । ভাগ্য ভালো যে চাণক্যকে পেয়ে গেলুম । উনি আপার কাস্ট হয়েও আমার মতন একজন বিহারি শিডিউলড কাস্টকে সম্রাট করে তুললেন । আমার মা ওনাকে গরম আর মিষ্টি ঠেকুয়া তৈরি করে খাওয়াতেন।

বিন্দুসার : বাবা চন্দ্রগুপ্তর সঙ্গে নানা বিষয়ে  মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও আমি বাবার মতোই গ্রিকদের অনুরাগী ছিলুম। বাবার মতোই গ্রিকদের সাথে সৌহার্দ্য বজায় রেখেছিলুম। সিরিয়ার অধিপতি এন্টিয়োকস আর মিশর-রাজ দ্বিতীয় টলেমি আমার রাজসভায়  ডায়োনিসাস আর ডেইমেকসকে রাজদূত করে পাঠিয়েছিলেন। আমি সিরিয়ার অধিপতির কাছে কিছু আঞ্জির , মিষ্টি মদ ও একজন দার্শনিক চেয়ে চিঠি লিখেছিলুম । আমার বিহারি রানিদের তৈরি ঠেকুয়া আর খাজা ওনাদের পাঠিয়েছিলুম ।   ঐ সময়ে গ্রিসে গ্রিক পণ্ডিত লোকের কেনা-বেচা নিষিদ্ধ ছিল, এই কারণে এন্টিয়োকস কোনো গ্রিক দার্শনিক পাঠাতে পারেন নি। তবে উনি মিষ্টি মদ আর আঞ্জির পাঠিয়েছিলেন। আমার ষোলোজন বউ ছিল আর ছেলে ছিল একশো একজন । আমি মারা যাবার পর আমার ছেলে অশোক অন্যা ভাইদের হারিয়ে আর খুন  করে সিংহাসন দখল করেছিল।জানেন তো বিহারিরা ক্ষমতা দখলের জন্যে খুনোখুনিতে ওস্তাদ ।

মহাকবি কালিদাস : আমার কবিতায় আমি শহরটাকে কুসুমপুর বলে উল্লেখ করেছি । আমার কবিতা কি লোকে সত্যিই পড়ে ? নাকি মাতৃভাষায় অনুবাদ করা হলে পড়ে ? যেমন ওরা সুররিয়ালিস্ট কবিদের পড়ে?

ফা হিয়েন : আমরা কুসুমপুরকে বলতুম কুসুমোপুলো । এখান থেকে ঠেকুয়া, খাজা আর মনেরের লাড্ডু নিয়ে গিয়েছিলুম ।  একে একে গঙ্গা উপত্যকায় বৌদ্ধ সংস্কৃতির বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছিলুম। সেগুলো হলো: বুদ্ধের জন্মভূমি কপিলাবস্তু; বুদ্ধগয়া, যেখানে বুদ্ধ দিব্যজ্ঞান লাভ করেন; সারনাথ, যেখানে বুদ্ধ তাঁর প্রথম ধর্মোপদেশ দিয়েছিলেন এবং কুশীনগর, যেখানে তিনি নির্বাণ লাভ করেন। আমি আমার ভ্রমণের অধিকাংশ সময়ই মগধ আর তার রাজধানি রাজগিরে কাটিয়েছিলুম । আমি সমুদ্রপথেই ভারত ত্যাগ করে শ্রীলঙ্কায় ঘুরে বেড়াবার পর চীনে ফিরে গিয়েছিলুম।  সমুদ্রে অনেক কষ্টকর পরিস্থিতি মোকাবিলা করে ৪১৪ খ্রিষ্টাব্দে  চীনে পৌঁছোই।

আর্যভট্ট : আমিও বিহারি, মনে রাখবেন । খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে  মগধের কুসুমপুরে জন্মেছিলুম । খ্রিস্টীয় ৪৯৯ খ্রিস্টাব্দে, ২৩ বছর বয়সে আমি জ্যোতির্বিদ্যায় একটা গবেষণাপত্র  আর “আর্যভট্যম” নামে গণিতের  বই লিখেছিলুম। আমি গ্রহগুলোর গতি আর গ্রহণের সময় গণনার প্রক্রিয়া প্রথম ব্যাখ্যা করেছিলুম। আমিই প্রথম ঘোষণা করেছিলুম যে পৃথিবী গোলাকার, এটি তার অক্ষের উপরে ঘোরে, সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে — কোপার্নিকাস তার হেলিওসেন্ট্রিক তত্ত্ব প্রকাশের এক হাজার বছর আগে ।  আমিই সর্বপ্রথম পৃথিবীর গতি আবিষ্কার করেছিলুম । আমার মা খুব ভালো ঠেকুয়া তৈরি করতে পারতেন । 

সম্রাট অশোক : খ্রিষ্টপূর্ব ২৬০-৬৩ নাগাদ আমি কলিঙ্গ রাজ্য জয় করেছিলুম। এই যুদ্ধে কলিঙ্গবাসী সর্বশক্তি দিয়ে আমার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার পরও হেরে গিয়েছিল।  এক লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল আর প্রায়  দেড়লক্ষ নরনারী বন্দী হয়।  যুদ্ধের এই বীভৎসতা আমাকে বিষাদগ্রস্থ করে তোলে। পরে আমি যুদ্ধের পথ ছেড়ে অহিংসার পথে সাম্রাজ্য পরিচালনের নীতি গ্রহণ করি।  ক্রমে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হই । উপগুপ্ত নামের এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর কাছে দীক্ষা নিয়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করি।  গুরু উপগুপ্তকে সাথে নিয়ে কপিলাবস্তু, লুম্বিনী, কুশীনগর, বুদ্ধগয়া, সারনাথসহ নানা জায়গা ভ্রমণ করি আর বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার করি।  নানা জায়গায় স্তূপ, স্তম্ভ এবং পাহাড়ের গায়ে বুদ্ধের বাণী লিপিবদ্ধ করে রাখার ব্যবস্থা করি । জনকল্যাণের জন্য আমি বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। জলকষ্ট দূরীকরণের জন্য সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় জলাশয় তৈরি করাই ।  এই অহিংস নীতির কারণে, আমার সঙ্গে প্রতিবেশী রাজ্য এবং গ্রিকদের সাথে বিশেষ সখ্যতা গড়ে উঠে। আমি সিরিয়া, মিশর, এপিরাস, সিংহল, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, নেপাল ইত্যাদি দেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলুম। খ্রিষ্টপূর্ব  ২৩২ অব্দে আমি পাকিস্তানের তক্ষশীলায় মারা যাই ।

পরভেজ মুশররফ : তবে ? আপনি পাকিস্তানে এসে মারা গেলেন আর বিহার থেকে মুসলমানরা পাকিস্তানে আসার বদলে চলে গেলো বাংলাদেশে । এখন ভুগছে ব্যাটারা । তখনকার বিহারি আর দেশভাগের বিহারিদের মধ্যে কতো তফাত ! 

আজিম-উশ- শান : আমি আওরঙ্গজেবের নাতি, প্রথম বাহাদুর শাহ-এর ছেলে, আমার মা হিন্দু ছিল । পাটলিপুত্র শহরটার নাম রেখেছিলুম আজিমাবাদ। তখন মোগলপুর, শাহগঞ্জ, দিওয়ান, নুনমুহিয়াঁ নামে অনেক মহল্লা এই শহরে ছিল। দিল্লির মতন আমিও পূর্বে পুরাব-দরজা আর শহরের পশ্চিমে পশ্চিম দরজা বানিয়েছিলুম। ইংরেজরা সেগুলো ভেঙে ফেলল, কেননা ওগুলো মোগলদের তৈরি। পরে মনসুরগঞ্জ আর মারুফগঞ্জের মতো এলাকায় আমার দরবারের লোকেরা সংসার পেতেছিল । এখন এতো ঘিঞ্জি-বস্তি যে দেখলেই বমি পায় । সবাই খোট্টা হয়ে গেছে । মোগল দরবারের লোকেরা কিনা খোট্টা, ভেবে দেখুন, কতো অধঃপতন হয়েছে দেশটার । এখানকার উর্দু ভাষার কবিরা নিজের নামের সঙ্গে ‘আজিমাবাদী’ যোগ করে, জোশ মলিহাবাদী, শাহির লুধিয়ানভি, ফিরাক গোরখপুরি, মজরুহ সুলতানপুরীর মতন । যাহোক, এটুকুও কম নয়। আমার দাদুর নাম এখন সব জায়গা থেকে ছাঁটাই হচ্ছে। আজিমাবাদ অন্তত কবিদের নামে বজায় আছে ।

সংগীতা বিজলানি : জনাব আজিম-উশ-শান, পাকিস্তানের সঙ্গে ইনডিয়ার ক্রিকেট খেলা হলে আপনি কোন দেশকে সাপোর্ট করেন ?

আজিম-উশ-শান : বিজলানিখাতুন, এরকম গুস্তাখ প্রশ্ন করার সাহস হয় কী করে ! আপনার বিরাদরি কী ? আপনি বিহারি ? আশরাফ গোষ্ঠীর ? পাঠান, সাইদ, শেখ, মল্লিক না মির্জা?  পশতুন পাঠান ? নসলি পশতুন না দিওয়ানি পশতুন ? ভূমিহার বা রাজপুত থেকে ধর্মান্তরিত ? চৌহান পাঠান ? খানজাদা ভুমিহার ? মির্জা ? মুঘলদের বংশধর ? নাকি আজলাফ?  আনসারি তাঁতি ? নাকি তুরুক পাসি ? আমরা নিচু জাতে বিয়ে করি না আর দিই না । 

হায়াত বক্সি বেগম : আপনিও ওনাকে অপমান করতে পারেন না আজিম-উশ-শান । উনি আমার শহরের বাসিন্দা আজহারউদ্দিনের প্রাক্তন প্রেমিকা , যে শহর থেকে আমার মন্ত্রী মীর মুহম্মদ সায়িদ লুকিয়ে কোহিনুর হিরে নিয়ে গিয়ে শাহজাহানকে দিয়েছিল । আমি তিন প্রজন্মের রাজ্যভার সামলেছি, আমার বাবা মুহম্মদ কুলি কুতুব শাহ, আমার খুড়তুতো ভাই মুহম্মদ কুতুব শাহ, যার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল, আর আমার ছেলে আবদুল্লা কুতুব শাহ । রাজ্য চালানোয় আমার স্বামীর আগ্রহ ছিল না, আর আমার ছেলে ছিল একেবারে অযোগ্য ও ভীতু । আপনারা নুরজাহানকে নিয়ে মাতামাতি করেন কেন জানি না । আমি ওনার চেয়ে সুন্দরী আর রাজ্যও চালিয়েছি কঠিন পরিস্হিতিতে ।

ফররুখশায়ার : আজিম-উশ-শান ছিলেন আমার আব্বাহুজুর । ১৭১২ সালে আমার চাচা জাহান্দার শাহ আমার আব্বাহুজুর আজিম-উশ-শানকে হারিয়ে  মুঘল সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসে পড়েছিল ।  আব্বাহুজুরের  মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে আমি আর বাংলার সুবাদার হুসেন আলী খান আর ওর ভাই  এলাহাবাদের সুবেদার আবদুল্লাহ খান এর সাথে যোগ দিই। ওরা পাটনা, মানে আজিমাবাদ থেকে এলাহাবাদ পৌঁছলে জাহান্দার শাহের সামরিক জেনারেল সৈয়দ আবদুল গাফফর খান গর্দেজির ১২,০০০ সৈন্যের সাথে আবদুল্লাহ খানের সাথে সংঘর্ষ হয় আর আবদুল্লাহ এলাহাবাদ দুর্গে ফিরে যায়। তবে, তার মৃত্যুর কথা জানতে পেরে গার্দেজির সেনাবাহিনী পালিয়ে যায়। সইয়দভাইরা আমাকে বন্দি করে অন্ধ করে দিয়েছিল যাতে আমি সিংহাসনে বসার অধিকার হারাই । আব্বার সঙ্গে পাটনায় থাকার সময়ে প্রচুর ঠেকুয়া আর খাজা খেতুম, আমাদের রসোইতে ফিবছর ছটের সময়ে তৈরি হতো ।

বিসমিল আজিমাবাদী : আমি বিসমিল আজিমাবাদী, বিহারের পাটনায় জন্মেছিলুম, উর্দুতে কবিতা লিখতুম। আমার আসল নাম সৈয়দ শাহ মুহম্মদ হাসান । আমার দাদামশায় শাহ মোবারক কাকভী আজিমাবাদী আর  মামা খান বাহাদুর সৈয়দ শাহ মুহিউদ্দিন ওরফে শাহ কামাল দুজনেই কবি ছিলেন আর এলাহাবাদের বিখ্যাত কবি ওয়াহিদ এলাহাবাদীর শিষ্য ছিলেন। ১৯২২ সালে  “সরফরোশি কি তামান্না” নামে  কবিতাটা আমিই  লিখেছিলুম। কবিতাটা আমি ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যৌথগান হিসেবে লিখেছিলুম ।  শহীদ ভগত সিং আর চন্দ্রশেখর আজাদ প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধারা কবিতাটা গাইতেন । শুনুন গানটা আরেকবার, জানি আপনারা ভুলে গেছেন স্বাধীনতাযোদ্ধাদের :

সরফরোশী কী তমন্না অব হমারে দিল মেঁ হ্যায়

দেখনা হ্যায় জোর কিতনা বাজু-এ-কাতিল মেঁ হ্যায়

.

করতা নহী কিঁউ দুসরা কুছ বাতচীত,

দেখতা হুঁ ম্যাঁয় ওয়া চুপ তেরি মহফিল মেঁ হ্যায়

অ্যায় শহীদ-এ-মুল্ক-ও-মিল্লত, ম্যাঁয় তেরে উপর নিসার,

অব তেরী হিম্মত কা চর্চা গ্যার কী মহফিল মেঁ হ্যায়

সরফরোশী কী তমন্না অব হমারে দিল মেঁ হ্যায়

.

ওয়াক্ত আনে পর বতা দেঙ্গে তুঝে, অ্যায় আসমান,

হম অভী সে ক্যা বতায়েঁ ক্যা বিসমিলে দিল মেঁ হ্যায়

খেঁচ কর লাঈ হ্যায় সব কী কৎল হোনে কী উমীদ,

আশিকোঁ কা আজ জমগট কুচা-এ-কাতিল মেঁ হ্যায়

সরফরোশী কী তমন্না অব হমারে দিল মেঁ হ্যায়

.

হ্যায় লিয়ে হথিয়ার দুশম্ন তাক মেঁ বৈঠা উধর,

ঔর হম তৈয়ার হ্যায় সীনা লিয়ে আপনা ইধর

খুন সে খেলেঙ্গে হোলী গর বতন মুশকিল মেঁ হ্যায়,

সরফরোশী কী তমন্না অব হমারে দিল মেঁ হ্যায়

.

হাথ, জিন মেঁ হো জুনুন, কটনে নহী তলবার সে,

সর জো উঠ জাতে হ্যায় ওয়াহ নহীঁ ললকার সে

ঔর ভড়কেগা জী শোলা সা হমারে দিল মেঁ হ্যায়,

সরফরোশী কী তমন্না অব হমারে দিল মেঁ হ্যায়

.

হম তো হর সে হী থে নিকলে বাঁধকর সর পর কফন,

জাঁ হথেলী পর লিয়ে লো বঢ় চলে হ্যায় ইয়ে কদম

জিন্দেগী তো অপনী মেহমাঁ মৌত কী মহফিল মেঁ হ্যায়,

সরফরোশী কী তমন্না অব হমারে দিল মেঁ হ্যায়

.

য়ুঁ খড়া মক্তল মেঁ কাতিল কহ রহা হ্যায় বার-বার,

ক্যা তমন্না-এ-শহাদত ভী কিসী কে দিল মেঁ হ্যায়?

দিল মেঁ তুফানোঁ কী টোলী ঔর নসোঁ মেঁ ইনকিলাব,

হোশ দুশমন কে উড়া দেঙ্গে হমেঁ রোকো ন আজ

দূর রহ পায়ে জো হমসে দম কহাঁ মঞ্জিল মেঁ হ্যায়,

.

জিস্ম ভী ক্যা হিস্ম হ্যায় জিসমেঁ ন হো খুন-এ-জুনুন

ক্যা লড়ে তুফান সে জো কশতী-এ-সাহিল মেঁ হ্যায়

সরফরোশী কী তমন্না অব হমারে দিল মেঁ হ্যায়

দেখনা হ্যায় জোর কিতনা বাজু-এ-কাতিল মেঁ হ্যায় 

শাদ আজীমাবাদী : আমার আসল নাম সৈয়দ আলী মোহাম্মদ, জন্মেছি পাটনায় । তিনি জীবনের প্রথম দিকে উর্দু, ফার্সি এবং আরবি শিখেছিলুম। এরপরেই ইসলাম ও অন্যান্য ধর্ম সম্পর্কে আমার নিজস্ব ব্যাখ্যা আমাকে উদার মানবতাবাদী করে তুলেছিল। লোকে আমাকে সুফি কবি বলে মনে করে ।  ব্রিটিশ সরকার আমাকে খান বাহাদুর উপাধি দিয়েছিল, তার সঙ্গে মাসিক এক হাজার টাকা উপবৃত্তি । 

সোহায়েল আজিমাবাদী : আমার আসল নাম মোজিবুর রহমান । পাটনায় জন্মেছি । বামপন্হী । আমি উর্দু, হিন্দি, ইংরেজিতে কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ লিখি । আজিমাবাদী হিসেবে গর্ববোধ করি । ছাতুর পরোটা খেতে আমার ভালো লাগে । 

আম্রপালী : আরও শুনুন হায়াত বক্সি বেগম । আমি ছিলুম সে সময়ের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী এবং নর্তকী, যার রূপে পাগল ছিলো পুরো দুনিয়া। আর এই রূপই আমার জন্য কাল হয়ে ওঠে যার কারণে  ইতিহাসে আমি এমন একজন নারী যাকে রাষ্ট্রীয় আদেশে পতিতা বানানো হয়েছিলো। মাহানামন নামে একজন লোক শিশুকালে আমাকে আম গাছের নীচে খুঁজে পায়। আমার আসল বাবা-মা কে, তা ইতিহাস ঘেঁটেও  জানা যায়নি। যেহেতু আমাকে আম গাছের নীচে পাওয়া গিয়েছিল তাই আমার নাম আম্রপালী। কৈশোরে পা দিতেই আমাকে নিয়ে হইচই পড়ে যায়। আমার রূপে চারপাশের পুরুষেরা পাগল হয়ে যেতো। দেশ বিদেশের রাজপুত্র, রাজা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ আমার জন্য পাগলপ্রায়। নানা জায়গায় এ নিয়ে ঝগড়া বিবাদের খবরও আসতো । সবাই আমাকে একনজর দেখতে চাইতো, বিয়ে করতে চাইতো। এ নিয়ে আমার পালক মা-বাবা খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন। তাঁরা তখন বৈশালীতে সব গণ্যমান্য ব্যক্তিকে এর একটি সমাধান বের করার জন্য বলেন, কারণ সবাই আমাকে বিয়ে করতে চাইতো। তখন বৈশালীর  ক্ষমতাবান ধনবান লোকেরা মিলে  আলোচনার পর  সিদ্ধান্ত নেয় যে আমাকে কেউ বিয়ে করতে পারবে না। কারণ আমার যা রূপ, তা একা কারোর হতে পারে না। আমি হবো সবার, হবো একজন নগরবধু, অর্থাৎ পতিতা !  ইতিহাসে এভাবে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে কাউকে পতিতা বানানো হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত কোনো দেশেই নেই । আমি সেই সভায় পাঁচটা শর্ত রেখেছিলুম, যা সবাই মেনে নিয়েছিল । প্রথম,নগরের সবচেয়ে সুন্দর জায়গায় আমার বাড়ি হবে ; দ্বিতীয়, আমার মূল্য হবে প্রতি রাতের জন্য পাঁচশো স্বর্ণমুদ্রা ; তৃতীয়, একবারে মাত্র একজন আমার বাড়িতে ঢুকতে  পারবে ; চতুর্থ, শক্র বা কোনো অপরাধীর সন্ধানে প্রয়োজনে সপ্তাহে সর্বোচ্চ একবার আমার বাড়িতে প্রবেশ করা যাবে ; আর পঞ্চম, আমার বাড়িতে কে আসলো বা গেলো এ নিয়ে কোনও অনুসন্ধান করা চলবে না। এভাবে দিনে দিনে আমি বিপুল ধন-সম্পদের মালিক হয়ে উঠি। এদিকে আমার রূপের কথাও দেশ বিদেশে আরও বেশি করে ছড়াতে থাকে। যারাই আমার ঘরে আসতো সঙ্গে আনতো ঠেকুয়া, লিট্টি-চোখা, শিলাওয়ের খাজা আর মুগের ডালের লাড্ডু ।

বাংলাদেশী খোট্টা : ইন্ডিয়া আর পাকিস্তানের ক্রিকেট ম্যাচ হলে আমরা পাকিস্তানকে সাপোর্ট করি ; বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের ক্রিকেট ম্যাচেও পাকিস্তানকে সাপোর্ট করি, যদিও পাকিস্তান আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে । বিভিন্ন পাকিস্তান সরকারের বহু প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও প্রায় তিন লাখ বিহারী চল্লিশ বছর ধরে বাংলাদেশে রাষ্ট্রহীন হয়ে পচছি । ছেষট্টিটা  ত্রাণ শিবির গেছে বিহারি মুসলমানদের শহুরে বস্তিতে , যেখানে প্রতিটি পরিবার একটা ছয়  বাই ছয় বর্গফুট  ঘরে থাকে । যানজট, আবাসন পরিস্থিতি, স্যানিটেশন ও পানীয় জলের অভাবে  অহরহ স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। দারিদ্র্য, হতাশা আর সামাজিক অবনতি শিবিরগুলোকে অপরাধের  প্রজনন কেন্দ্র করে তুলেছে। আমরা বিহারি নই, খোট্টা নই । অথচ পাকিস্তানি এজেন্টদের হুকুমে হিন্দুদের নামের তালিকা করে, তাদেরকে হত্যা করে, কোথাও কোথাও হিন্দুদের বাড়িতে হলুদ রঙ দিয়ে ‘হিন্দু’ লিখে চিহ্নিত করে, আমরা ওদের কতো হেল্প করেছিলুম । 

জেনারেল পারভেজ মুশারফ : পূর্ব পাকিস্তানে গিয়েছিলে কেন ? আমি পশ্চিম পাকিস্তানে এসে মিলিটারি জেনারাল আর রাষ্ট্রপতি হয়েছি, যদিও লোকে আমাকে বলে মোহাজির । যারা উর্দু বলে তারা মোহাজির । তোমরা এখন বাংলা পড়তে-লিখতে বাধ্য । যেমন কর্ম তেমন ফল । তোমরা তো পাঠান, পাঞ্জাবি, বালুচ, সিন্ধি নও ; তাহলে বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দাওনি কেন ? উলটে রাজাকরগিরি করেছ !       

লালুকাস : বাংলাদেশি খোট্টাবেরাদর । আপনারা থেকে গেলেই তো পারতেন । আমার চেলা শাহাবুদ্দিন আর ওর ফ্যামিলির কেউই যায়নি । এখন বিহারের একটা জেলার ওরা সুলতান । আপনারা লুকিয়ে চুরিয়ে আপনাদের জ্ঞাতির বাড়িতে এসে ওঠেন অথচ কিছুদিন পরে তারাই পুলিশে খবর দিয়ে আপনাদের বানিয়ে দেয় সন্ত্রাসবাদী । না গেলে খোট্টা হয়েই থাকতেন ।

শাহাবুদ্দিন : ঠিকই বলেছেন লালুজি । আমি বৈশালী জনপদের সুলতান নামে পরিচিত, বিহারের সুলতানও বলতে পারেন । ১৯৯৯ সালে সিপিআই (এমএল) নেতা চন্দ্রশেখর প্রসাদ ওরফে ছোটলাল গুপ্তকে অপহরণ ও হত্যাসহ একাধিক মামলায় এবং ডাবল-হত্যার মামলায় তিহার জেলে যাবজ্জীবন কাটাচ্ছি । জেলে আছি বটে, কিন্তু আমার সাম্রাজ্য বজায় আছে । শুনে অবাক হবেন, সিপিআই (এমএল) আজ আমার পার্টি আরজেডির সাথে জোট গঠন করে বিধানসভা নির্বাচনে প্রবেশ করেছে। বাস্তবে, ২০০৪ সালে কারাগারে বন্দী হওয়ার আগে আমি প্রায় দেড় দশক ধরে সিওয়ানে সন্ত্রাসবাদের রাজত্বের সবচেয়ে দৃশ্যমান প্রতীকগুলির মধ্যে ছিলুম অন্যতম । চন্দবাবুর চার ছেলের মধ্যে তিনটেই আমার শিকার হয়েছিল। ওর দুই ছেলে গিরিশ রাজ (২০) এবং সতীশ রাজ (২৫) আমার গুপ্তচরদের হাতে প্রতাপপুরে খুন হওয়ার আগে অ্যাসিড ভিজিয়েছিলুম, আর ওর তৃতীয় ছেলে রাজীব রওশন যে ডাবল-খুনের মামলায় একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী ছিল, তাকে সিওয়ানে খুন করিয়েছিলুম ।মনোজ কুমার পাপ্পু পর্ব পুলিশকে হতবাক করেছিল। আমাকে আর মনোজকে গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ আমার হাভেলিতে অভিযান চালায়। বিহার পুলিশের পাশাপাশি উত্তরপ্রদেশ পুলিশের দলও মোতায়েন করা হয়েছিল। পুলিশ বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল আর আমার সমর্থকদের সঙ্গে লড়াইতে দু’জন লোক মারা গিয়েছিল। পুলিশের  বেশ কয়েকটা গাড়ি পুড়ে যাওয়ার সময় আরও দশ জন মারা গিয়েছিল। পুলিশ আমার হাভেলি থেকে তিনটে একে -৪৭ রাইফেল পেয়েছিল। তবে তারা আমাকে পাকড়াও করতে পারেনি। আমি গোপন পথে কেটে পড়েছিলুম। পুলিশ আমার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করেছে।  লালুজি তো বলেন, আমি নাকি অজাতশত্রুর বংশধর । বৈশালী জনপদ এখন আমার সাম্রাজ্য । আমাদের পরিবারের কারোর বাংলাদেশী খোট্টা হবার শখ জাগেনি ।

ফরিদ ছিপায়াতুল্লাহ : শুধু পহেলা বৈশাখ নয়, শুধু মঙ্গল শোভাযাত্রা নয়, শুধু পান্তা ইলিশ খাওয়া নয়, আপনি আরাম করে নামাজ পড়ার জন্য যে লুঙ্গিটা পরেন ওটাও বিজাতীয়, এই যে বাংলা ভাষায় কথা বলছেন এটাও বিজাতীয়। এগুলো বর্জন করলে আপনার পরিচয় পরিবর্তিত হয়ে যায়। আপনি যদি মনে করে থাকেন বিশুদ্ধ মুসলিম হবার জন্য স্বভূমিজাত এইসব চিহ্নাদি বর্জন ফরজ, তাহলে আরবভূমির বাইরের কোনও অঞ্চলের মুসলিমই বিশুদ্ধ মুসলিম হতে পারবে না কোনদিনও। ইসলাম একটি বৈশ্বিক ধর্ম। প্রত্যেক মহাদেশে এই ধর্মের অনুসারী আছে। প্রত্যেক অঞ্চলের মুসলিম জনসমাজের সংস্কৃতিতে সেই অঞ্চলের নিজস্ব কিছু অনুষঙ্গ অবধারিতভাবে যুক্ত হয়ে যায়। এগুলো অস্বীকার করা কূপমন্ডুকতা ছাড়া কিছু নয়। ইসলামের মৌলিক পাঁচ ভিত্তি, যার ওপর ইসলামের মূল কাঠামো দাঁড় করানো, সেগুলোর কোনটাই এই ভাষা, কাপড়, খাদ্য ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট নয়– কালিমা, নামাজ, রোজা, হজ,যাকাত। আপনি নতুন করে কোন ধর্মের রীতি নীতি চালু করতে চান? 

উদয়ী : হর্ষঙ্ক রাজারা রাজগিরকে  রাজধানী করেছিলেন ; লোকগুলো সত্যিই খোট্টা ছিল । রাজধানী হবে নদীর ধারে, যাতে যাতায়াতের সুবিধা হয়,  নৌকোয় চেপে তাড়াতাড়ি শত্রুদের আক্রমণ করা যায় । আমি তাই পাটুলিপুত্রে  রেললাইনের ওই পারে কুমহারারে নিজের রাজধানি নিয়ে এলুম আর দুর্গও তৈরি করলুম । আজকাল  ট্যুরিস্টরা ধ্বংসাবশেষ দেখতে আসে । আমার বাবা অজাতশত্রু খোট্টাকে খোট্টাই থেকে গিয়েছিলেন, রাজগির থেকে পাটনায় রাজধানি তুলে আনার কথা ভাবেননি । আমার পরে  অনিরুদ্ধ, মুণ্ড আর নাগদশক  পরপর সিংহাসনে বসার সুযোগ পেয়েছিল।  নাগদশক ছিল আমাদের বংশের শেষ রাজা । লালুকাস আর ওর স্যাঙাতদের বউরা এখন শাড়ি-ব্লাউজ খুলে সাতসকালে নদীতে ছট উৎসব করে । 

শের শাহ সুরি : আরে তোমাদের পাটলিপুত্র তো এমন ভাঙাচোরা অবস্হায় পৌঁছে গিয়েছিল যে আমিই পাটনা নাম দিয়ে নতুন করে সাজিয়ে তুলে আমার রাজধানি করেছিলুম ; নয়তো লোকে ভুলেই যেতো । শহরটার ভাঙাচোরা অবস্হার কথা লিখে গেছেন হিউয়েন সাঙ । নন্দ, মৌর্য, সুঙ্গ আর গুপ্ত থেকে শুরু করে পালদের সময় পর্যন্ত উত্তর-মধ্য ভারতীয় রাজবংশের শাসকদের প্রশাসনিক কেন্দ্র আর রাজধানী হিসেবে পাটলীপুত্রের গুরুত্ব ছিল। গৌতম বুদ্ধের সময়ে এটা পাটলীগ্রাম নামে পরিচিত ছিল, তাও জানি । গৌতম বুদ্ধ এইখানে তাঁর জীবনের শেষ সময় কাটিয়েছিলেন। এখানেই দু’টো গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো– প্রথমটা গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর সময় আর দ্বিতীয়টা সম্রাট অশোক এর রাজত্বকালে। 

অজাতশত্রু : জানি, জানি, জনাব । আপনার বারো বছরের নাতি ফিরোজ শাহ শুরি সিংহাসনে বসার কিছু দিনের মধ্যেই আপনার ভাইপো মুহাম্মদ মুবারিজ খান তাকে গুমখুন করেছিল । মুহাম্মদ মুবারিজ খান মুহাম্মদ শাহ আদিল নাম নিয়ে সিংহাসনে বসে পড়ে । শাহ আদিল আপনাকে বদনাম করার জন্য পাটনা শহরকে নষ্ট করে দিচ্ছিল । ভাগ্যিস আপনি মারা গেলেন আর হুমায়ুন ফিরে এলো ।

আওরঙজেব : দ্যাট ইজ দ ওয়ে ওয়ান শুড বিকাম আ কিঙ । কিন্তু যতোদূর জানি আপনারা বিহারি নন। তাহলে এরকম হলো কেন ?

শের শাহ সুরি : আমি পুশতুন বিহারি, এখানের সাসারামের গোরে শুয়ে আছি । যে পুশতুনরা আমার সঙ্গে এসেছিল তারা এখন সবজিবাগ, দিলদারগঞ্জ, ফুলবাড়িশরিফ, সাসারাম আর পাটনাসাহেবে থাকে, পাক্কা বিহারি হয়ে গেছে । আমার পাঁচ বছরের শাসনকালে (১৫৪০-১৫৪৫) ১৭৮ রতি ওজনের রুপোর মুদ্রা ‘রুপিয়া’ নামে প্রচলন করেছিলুম । আর এই পাঁচ বছরের  রাজত্বে  নাগরিক আর সামরিক প্রশাসনের এক নতুন ধারার সূচনা ঘটিয়েছিুম ।  সোনার মোহর আর তামার পয়সা চালু করি । কাগজের রুপিয়া চালু করে ছিল ব্যাঙ্ক অফ হিন্দুস্তান (১৭৭০-১৮৩২), ওয়ারেন হেষ্টিংসের প্রতিষ্ঠা করা সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অব বেঙ্গল অ্যান্ড বিহার (১৭৭৩-৭৫) আর বেঙ্গল ব্যাঙ্ক (১৭৮৪-৯১) । আমিই গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড তৈরি করেছিলুম। মোগলরা এতোকাল আল-হিন্দে রাজত্ব করেও সাম্রাজ্য জুড়ে রাস্তা বেছাবার কথা ভাবেনি। যদি ভাবতো তাহলে শাহজাহান আর আওরঙজেবের শাসন করতে অসুবিধে হতো না । 

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খলজি  : পাটনা তো রাজধানি ছিল না। আমি দু’হাজার ঘোড়সওয়ার নিয়ে নালান্দা আক্রমণ করার পর কাছেই দরবার বসিয়েছিলুম, তখন নাম ছিল বিহার, কেননা জায়গাটায় অনেক বৌদ্ধ বিহার ছিল । আমার সেনাবাহিনীর হাতে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগে এই নালন্দা ছিল এশিয়া মহাদেশে সবচেয়ে বিখ্যাত জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র – সুদূর চীন, জাপান, কোরিয়া, মঙ্গোলিয়া থেকেও ছাত্ররা এখানে পড়তে আসতেন।বিশ্বের প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় এটা, আর ইতালির বোলোনিয়াতে যখন ইউরোপের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, নালন্দার বয়স তখনই সাড়ে ছশো বছর। আমার সেনারা ঠেকুয়া খেতে ভালোবাসতো বলে রাজগির যাবার পথে একটা রেলস্টেশনের নাম বখতিয়ারপুর । 

পারভেজ শাহ : আমি ছিলুম সম্রাট জাহাঙ্গীরের  চাকর । আজিমাবাদের ‘পাথর কি মসজিদ’ আমি তৈরি করিয়েছিলুম, যা আজও দাঁড়িয়ে আছে। নুনমুহিয়ান পাড়াটা প্রতিষ্ঠা করেছিল মুন্নী মিয়াঁ । ওনার সমাধি এখনও তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য রয়েছে। আমাদের পরিবারের কেউই পাকিস্তানে পালায়নি ।

লালুকাস : ইখতিয়ার মিয়াঁ, আপনি নালান্দা ধ্বংস করেছিলেন ? যাক আমরা নতুন প্রোজেক্ট তৈরি করে আবার একটা বিশ্ববিদ্যালয় বসাচ্ছি ।

পাণিনি : আমি পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি অঞ্চলের আটকের কাছে শালাতুর গ্রামে জন্মেছিলুম । 

মেনান্দার : সত্য লালুকাস কী বিচিত্র তোমার দেশ !

লালুকাস : আমি লালুকাস নই ; আমি জরাসন্ধের বংশধর । ভোটের জন্যে আমি মুসলিম চিন্তাভাবনা আর শিক্ষার  গুরুত্বপূর্ণ আসন  বিহার-শারিফকে হাতের মুঠোয় করেছি । বখতিয়ার খলজির দৌলতে এটা একসময় বিহারের মুসলিম শাসকদের রাজধানী ছিল। তুর্কি আর পশতুন হানাদাররা প্রায়ই পরিত্যক্ত বৌদ্ধ বিহারগুলোকে সামরিক সেনানিবাস হিসাবে ব্যবহার করত ।  বিহার ছিল শহরের নাম, যা মধ্যযুগে মগধ অঞ্চলে মুসলিম সেনবাহিনীর সদর দফতর ছিল। পরে সদর দফতর শেরশাহ সুরি বিহার থেকে পাটানা , এখনকার পাটনায়,  নিয়ে আসেন । তখন পুরো মগধ অঞ্চলকে বিহার বলা হত। বিহার শরীফ আর আশেপাশের  মুসলিম জনগণের শিরাতে তুর্কি আর আফগান রক্তের একটা ভাল মিশেল রয়েছে, বিশেষত মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্ত শ্রেণির মধ্যে, এমনকি নিম্নবিত্তদের মধ্যেও। তবে তারা এখন খেঁকুরে, রোগাটে, কালো হয়ে গেছে । বলতে পারেন খাঁটি খোট্টা ।

রাবড়িভৌজি : আপনার সঙ্গে যে পুশতুন সেনারা এসেছিল, তারা আর পুশতু বলতে পারে না, শাহজাহানের তৈরি উর্দু ভাষাও বলতে পারে না । মুর্শিদাবাদ আর লখনউয়ের শিয়া নবাবদের বংশধররাও পাত্রি পায় না।  সবাই পাটনাইয়া বুলিতে কথা বলে । ওরা তাঁতি, কসাই আর ছোটো জাতের মুসলমানদের বিয়ে করতে চায় না । কিন্তু কী আর করবে বলুন । পাত্রি তো নেই, তাই ওদেরই বিয়ে করতে বাধ্য হয়, কিংবা নিজেদের মধ্যে বিয়ে করে । আপনার মতন ঢ্যাঙা আর হয় না কেউ, সকলেই বাঁটকুল আর ভীষণ গরিব । আমার হাজবেন্ডের দলের সুবিধে হয় ওদের ভুল বুঝিয়ে ভোট টানতে । ওদের ঠেকুয়া খাওয়াই, শিলাওয়ের খাজা আর মনেরের লাড্ডু খাওয়াই ।

আম্রপালী : আরও শুনুন রাবড়িভৌজি । গৌতম বুদ্ধ তার কয়েকশো সঙ্গি নিয়ে বৈশালী রাজ্যে এলেন। একদিন আমার বাড়ির বারান্দা থেকে এক তরুণ সন্ন্যাসীকে দেখে আমার মন প্রণয়ে আপ্লুত হয়ে গেলো। আমি ভেবেছিলুম দেশ বিদেশের রাজারা আমার পায়ের কাছে এসে বসে থাকে আর এতো সামান্য একজন মানুষ। সেই সন্ন্যাসীকে  বর্ষাকালে চার মাস আমার কাছে রাখার জন্য গৌতম বুদ্ধকে অনুরোধ করি । ভেবেছিলুম উনি কখনোই রাজি হবেন না, কারণ একজন সন্ন্যাসী এমন একজন পতিতার কাছে থাকবে তা হতেই পারে না। কিন্তু গৌতম বুদ্ধ  তাকে রাখতে রাজি হলেন এবং এও বললেন যে আমি এই সন্ন্যাসী শ্রমণের  চোখে কোনও কামনা-বাসনা দেখছি না । সে চারমাস থাকলেও সে চিরকুমার হয়েই ফিরে আসবে এ-ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ! 

অজাতশত্রু : রাবড়িভৌজি, আরে, আমি হলুম খাঁটি বিহারি, তা ভুলে যান কেন ? পালি সাহিত্যে জাতকের গল্পে লিখে দিয়েছে, অজাতশত্রু নিষ্ঠুর প্রকৃতির রাজা ছিলেন। নিষ্ঠুর না হলে কেউ রাজা হয় ? আইভান দি টেরিবলের জীবনী পড়ুন। ৩৭ বছর রাশিয়ার শাসন ক্ষমতায় ছিলেন জার চতুর্থ ইভান। নৃশংসতার জন্য ‘আইভান দ্য টেরিবল’ নামেও তিনি পরিচিত। একদিকে যেমন তিনি দেশের সীমানা সম্প্রসারিত করতে পেরেছিলেন, অন্যদিকে তার খামখেয়ালিপনা, নৃশংসতা রাজ্যবাসীকে সারাক্ষণ উদ্বেগে রাখতো। তার নিষ্ঠুরতা থেকে অন্তঃসত্ত্বা পুত্রবধূও রেহাই পায়নি, এমনকি তিনি ক্রোধের বশবর্তী হয়ে নিজের ছেলেকেও খুন করতে দ্বিধা করেননি। মানুষের ওপর অত্যাচার করতে পছন্দ করতেন। এসব কারণে মানুষজন যেন পালিয়ে যেতে না পারে, সে জন্য শহরের চারপাশে দেয়াল তৈরির আদেশ দিয়েছিলেন। চীনের   কিং রাজবংশের প্রথম সম্রাট কিং শি হুয়ানের কথা ভাবুন ।  দ্বিমত পোষণকারী পন্ডিতদের খুন করার জন্য এবং তার সমালোচনামূলক সকল বই পোড়ানোর আদেশের জন্য উনি বদনাম । 

রাবড়িভৌজি : স্যার,  নন্দ, মৌর্য, সুঙ্গ আর গুপ্ত থেকে শুরু করে পালদের সময় ছাড়িয়ে আজ পর্যন্ত যতো শাসক এসেছে তাদের বংশধররা সবাই খোট্টা বিহারি হয়ে গেছে, এমনকি বেজন্মা হলেও । লিট্টি-চোখা খাওয়া ওদের সংস্কৃতির অংশ । ওদের বাড়ির বউরা কতো রকমের ঠেকুয়া বানাতো ।

লালুকাস : আরে মিয়াঁ শের শাহ, বিহারিদের দুষছেন কেন ? আমাকে যখন ল্যাঙ মেরে সরিয়ে দিলে আমি তখন আমার বউ রাবড়িকে মুখ্যমন্ত্রী করে দিয়েছিলুম । কেউ ট্যাঁ-ফোঁ করেনি, যখন কিনা আমার বউ গোরুর দুধ দোয়া আর ঘুঁটে ঠোকা ছাড়া কিছুই জানতো না । সিংহাসনে বসার ট্রিক আছে, আর আপনিও সেই ট্রিকগুলো অ্যাপলাই করেছিলেন । হুমায়ুনকে ইরানে ভাগিয়ে নিজে সম্রাট হয়ে গেলেন ।

অজাতশত্রু : পালি ভাষায় আমার নাম অজাতসত্তু বলে-বলে এই লালুকাস আর ওর ছেলে তেজস্বীকাস আমাকে সাত্তুখোর বিহারি বলে চালাচ্ছে। মিটিঙ-মিছিলে ওরা বলে বেড়ায় যে আমি রাবড়িভৌজির তৈরি লিট্টি-চোখা খেতে ভালোবাসতুম । আমি বিহারি ঠিকই ; আমার বাপও তো বিহারি, যাকে লোকে বলে খোট্টা । আমাদের পুরো হর্ষঙ্ক পরিবারই বিহারি । লোকে যা ইচ্ছে গল্প বানায় । সম্রাট নিরোকে বদনাম করার জন্যে ইউরোপের ইতিহাসে লিখে দিয়েছে যে রোম যখন পুড়ছিল তখন উনি বেহালা বাজাচ্ছিলেন । আরে, ইডিয়ট, বেহালা আবিষ্কার হয়েছে নিরোর অনেক পরে, ষোলো শতকে । বউকে সিংহাসনে বসিয়ে বেচারা লালুকাস জেল খাটছে !

বিম্বিসার : লালুকাসেরই বংশের মানুষ আমার ছেলেটা । ওর স্যাঙাত দেবদত্তের পরামর্শে আমাকে বন্দি করে রাখলো, তারপর মেরে ফেললো । ভাগ্যিস ও জানে না যে আম্রপালীর পেটে যে বাচ্চা এসেছে সেটা আমার।

অজাতশত্রু : বাবা, তুমি তো বিয়ে করতে রাজ্যের এলাকা বাড়াবার ধান্দায় ।  বিভিন্ন রাজ্যের রাজকুমারী আর অভিজাত মহিলাদের বিয়ের মাধ্যমে  কূটনৈতিক সুসম্পর্ক তৈরি করতে ।  কোশল রাজ মহাকোশলের মেয়ে কোশল দেবীকে বিয়ে করে দুই রাজ্যের মধ্যে দীর্ঘদিনের বৈরিতার অবসান ঘটালে । বিয়ের যৌতুক হিসেবে  কাশীর অধিকার পেলে ;   বৈশালীর লিচ্ছবি মহাজনপদের প্রধান চেতকের মেয়ে চেল্লনাকে বিয়ে করলে ।  তোমার তৃতীয়া বউ ক্ষেমা ছিলেন মদ্র দেশের রাজকন্যা। তারপর বিদের রাজকন্যা বাসবিকে বিয়ে করলে। এরকম বিয়ে করে-করে রাজ্যের এলাকা বাড়ানো আমার কাছে অ্যাকসেপ্টেবল ছিল না । আমি হলুম অজাত শত্রু, বিহারি খোট্টা । অতোগুলো বিয়ে করে কতো বাচ্চা পয়দা করেছিলে, তাই বন্দি করা ছাড়া উপায় ছিল না; কে আবার সিংহাসনের দাবিদার হতো আর ভাইয়ে-ভাইয়ে খুনোখুনি করতে হতো অওরঙজেবের মতন ।

আওরঙ্গজেব : একেবারে হক কথা বলেছেন অজাতশত্রুদাদু । তবে মনে রাখবেন, ব্রিটিশরা আমার সম্পর্কে নানা রকমের গুল মেরে গল্প লিখে গেছে । আমি বিয়ে করে রাজ্য বাড়াইনি । 

অজাতশত্রু : আমি বিয়ে করে রাজ্যের সীমা বাড়াইনি, যুদ্ধ করে আর ষড়যন্ত্র করে বাড়িয়েছি । গঙ্গা নদীর তীরবর্তী  বন্দর এলাকার অর্ধেক অংশ আমার অধিকারে আর বাকি  অংশ মজফফরপুর মহজনপদের অধিকারে ছিল। কাছের পাহাড়ে যে পারফিউম-পাথরের টিলা ছিল তা  নিয়ে পাটনা আর  মজফফরপুরের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। বেশ কয়েক বার আমার আগেই হাজিপুরের লোকেরা পুরো স্টক নিয়ে নিজের দেশে চলে গেলে আমি ঠিক করি যে এর বদলা নিতেই হবে । মন্ত্রী বস্সকারকে গৌতম বুদ্ধের কাছে পাঠিয়ে হাজিপুরিদের হারাবার তরকিব বাতলাতে বলেছিলুম। কিন্তু গৌতম বুদ্ধ মত দেন যে,  হাজিপুরিরা যতদিন সম্মিলিত ভাবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে আলোচনা করে একত্রিত ভাবে মতগ্রহণ করবেন, নিজের দেশের আইন ও জৈষ্ঠ্যদের উপদেশ মেনে চলবেন, নারীদের বিরুদ্ধে কোন হিংসামূলক অপরাধে জড়িত থাকবেন না, ধর্মস্থান ও অর্হতদের সম্মান করবেন, ততদিন কোনও বৈদেশিক শক্তি তাঁদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এই উপদেশের ফলে আমি সামরিক শক্তি প্রয়োগ করার বদলে ওদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করে সফল হই,  আর আমার সেনা মজফফরপুর দখল করে নিয়েছিল।মুজফফরপুর নামটা অবশ্য ব্রিটিশের দেয়া, ওদের আমিন মুজফফর খানের নামে ।

কোশল রাজ প্রসেনজিৎ : অজাতশত্রুর অ্যাক্টিভিটিতে আমি খুব চটে গিয়েছিলুম । বিম্বিসারের বন্দীত্ব আর মৃত্যুর ঘটনায় আমি আমার দেয়া  উপহার হিসেবে  কাশী রাজ্য  নিজের অধীনে ফেরত নিয়েছিলুম । অজাতশত্রু আমার  বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল বটে,  প্রথম যুদ্ধে জিতে গেলেও পরের যুদ্ধে ওকে হারিয়ে নাস্তানাবুদ করে দিয়েছিলুম । কিন্তু যেহেতু আমি গৌতম বুদ্ধের মতাদর্শে বিশ্বাসী, তাই ওকে ছেড়ে দিয়ে আমার মেয়ে বজিরার সঙ্গে বিয়ে দিই আর  যৌতুক হিসেবে কাশী রাজ্য ফিরিয়ে দিই।  

জালালুদ্দিন মোহম্মদ আকবর : জনাব বিম্বিসার, আমিও আপনার ট্রিকটা অ্যাপলাই করতুম । রাজপুত মেয়েদের বিয়ে করতুম আর ওদের সঙ্গে যুদ্ধ এড়াতুম, কেননা ওরাই ইনডিয়ায় সেসময়ে ছিল যুদ্ধ এক্সপার্ট । আমি দীন-ই-ইলাহি শুরু করতে চেয়েছিলুম ; আমার পরিবারের সদস্যরা তার অনুমতি দিল না ।

দশরথ মৌর্য্য :  আমিও বিহারি খোট্টা, ছিলুম চতুর্থ মৌর্য্য সম্রাট । দুঃখের বিষয় আমার রাজত্বকালে মৌর্য্য সাম্রাজ্যের পতন শুরু হলো আর বিভিন্ন এলাকা কেন্দ্রীয় শাসন ভেঙে বেরিয়ে যেতে লাগলো। আমি কিন্তু আমার দাদু আর পূর্বসূরী অশোকের সামাজিক ও ধর্মীয় নীতি বজায় রেখেছিলুম । আমার বাবার নাম কুণাল ওরফে সুযশস । লোকে বলে আমি নাকি লালুমস্তানের মতন অকাজের ঢেঁকি । তবে ঠেকুয়া, খাজা আর মুগের ডালের লাড্ডু আমার প্রজারা খেতে ভালোবাসতো । দাদু মারা যাবার পর  পঞ্চাশ বছর আমি, সম্প্রতি, শালিশুক, দেববর্মণ, শতধনবান আর বৃহদ্রথ আমরা ছয় জন রাজত্ব করেছিলুম। শেষ সম্রাট বৃহদ্রথ নিজের প্রধান সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গের হাতে খুন হবার পর, মৌর্য্য সাম্রাজ্যের পতন আর শুঙ্গ সাম্রাজ্য আরম্ভ হয়েছিল । বিহারিরা এরকমই হয়। কখন যে পেছন থেকে কে ছুরি মারবে তা টের পাবেন না ।

দশরথ মাঝি : আমার নামও দশরথ আর আমি দশরথ মৌর্য্যর চেয়ে বেশি বিখ্যাত । লোকে আমাকে বলে মাউন্টেইন ম্যান ।  আমি বিহারের একজন গরিব শ্রমিক । গয়া জেলার  গেহলৌর নামক গ্রামে জন্মেছিলুম। আমি  একা শুধুমাত্র একটা হাতুড়ি আর ও ছেনি দিয়ে  পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে পাথর কেটে ১১০ মিটার দীর্ঘ, ৯.১ মিটার প্রস্থ আর ৭.৬ মিটার গভীর রাস্তা তৈরি করেছিলুম। বাইশ বছর পরিশ্রমের পর, আমার বানানো সড়কের ফলে আতরি আর ওয়াজিগঞ্জ ব্লকের দূরত্ব ৫৫ কিমি থেকে কমে মাত্র ১৫ কিমিতে পরিণত হয় । আমার বউয়ের কথা খুব মনে পড়ে । ও এতো ভালো ঠেকুয়া তৈরি করতো যে তার স্বাদ আজও আমার জিভে লেগে আছে।

মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক : একটা কথা বলি তোমাদের । আমি ছিলুম উসমানীয় সামরিক কর্মকর্তা, বিপ্লবী রাজনীতিক, লেখক আর তুরষ্কের প্রথম রাষ্ট্রপতি। আমি আধুনিক তুর্কি প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা। আমাকে আধুনিক তুরষ্কের জনক বলা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আমি একজন সামরিক কর্মকর্তা ছিলুম ।  প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানীয় সাম্রাজ্য হেরে যাবার পর তুরস্কের স্বাধীনতা যুদ্ধে আমি তুর্কি জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলুম । আঙ্কারায়  অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলুম আর তার মাধ্যমে আমি মিত্রশক্তির পাঠানো বাহিনীকে হারিয়ে দিই । আমার সামরিক অভিযানের ফলে তুরস্ক স্বাধীনতা লাভ করে। আমি এরপর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আর সাংস্কৃতিক সংস্কার কার্যক্রম শুরু করি। সাবেক উসমানীয় সাম্রাজ্যকে একটা আধুনিক, পশ্চিমা আর ধর্মনিরপেক্ষ জাতিরাষ্ট্রে রূপান্তর এই সংস্কারের উদ্দেশ্য ছিল। আমার সংস্কার আন্দোলনের মূলনীতির ওপর আধুনিক তুরস্ক প্রতিষ্ঠিত। জালালুদস্দিন মোহম্মদ আকবর যেমন সবাইকে নিয়ে চলতে চেয়েছিলেন, আমিও তাই চেয়েছিলুম । কিন্তু এখন দেখেশুনে মনে হচ্ছে যেমন আকবরের পথে দেশ চলেনি, তেমনি আমার দেখানো পথ থেকে তুরস্ক সরে এসেছে, আরও সরে যাচ্ছে ।

শেখ মুজিবুর রহমান : কী আর বলি আতাতুর্ক সাহেব । শর্ষিনার পীর আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ এক ধর্ম সভা ডেকে ফতোয়া দিয়েছিলেন আমার বিরুদ্ধে যে, আমাকে ভোট দিলে ইসলাম থাকবে না, ধর্ম শেষ হয়ে যাবে।  সেই সাথে বরগুনার পীর সাহেব, শিবপুরের পীর সাহেব, রহমতপুরের শাহ সাহেব সকলেই আমার বিরুদ্ধে নেমে পড়লেন আর যত রকম ফতোয়া দেওয়া যায়, তা দিতে কৃপণতা করলেন না। দুই-চার জন ছাড়া প্রায় সকল মওলানা, মৌলভী সাহেবরা আর তাদের তালবেলেমরা নেমে পড়ল আমার বিরুদ্ধে । তবু আমি আপনার মতন স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি করতে পারলাম । আপনার দেশ যেমন সরে যাচ্ছে, তেমনই আমার দেশও আমার আদর্শ থেকে সরে যাচ্ছে।

বিম্বিসার : আমার ছেলে প্রথম যৌবনে কিচ্ছু মানতো না, বুড়ো হয়ে ও পালটে যেতে লাগলো । একদিক থেকে ভালো বলতে হবে ।

 শিশুনাগ : অজাতশত্রু যেমন নিজের বাপকে খুন করে সিংহাসনে বসেছিল, আমিও ওর বংশের রাজা নাগদাসকে খুন করে সিংহাসনে বসেছি মিস্টার আকবর, আপনাদের ফ্যামিলি হেড বাবর কোনো নিয়ম তৈরি করে যাননি বলে বংশের ছেলেরা নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি করে মরেছে, নিজের ভাইকে অন্ধ করে দিয়েছে । আমাদের ফ্যামিলিতে নিয়ম করে দিয়েছিলুম  যে, সব ছেলেই পারাপারি করে রাজত্ব করবে ।

বাংলাদেশি খোট্টা : আমাদের সুখ-সুবিধা দেখার কেউ নেই, অথচ রোহিঙ্গিয়া শরণার্থীদের জন্য ‘ভাসান চর’ তৈরী হয়ে গেছে । প্রায় এক লাখ শরণার্থীদের জন্য ঘর তৈরী হয়ে গেছে ।  বন্যা প্রতিরোধের জন্য বাঁধ, বাড়ি, হাসপাতাল, মসজিদ সবই তৈরি করা হয়েছে ভাসান চরে। বঙ্গোপসাগরের কোলে  এই দ্বীপটা মায়ানমার থেকে আসা শরণার্থীদের আশ্রয় দেবার জন্য গড়ে উঠেছে। ভাসান চরে ১০টি মুদির দোকান, চায়ের স্টল, সবজি ও মাছের দোকান সহ একটি বাজারের ব্যবস্থাও রয়েছে। সৌর বিদ্যুৎ এবং জল সরবরাহের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। আমাদেরও কয়েকটা দ্বীপ দিতে পারতো । বাংলাদেশে এসে আমরা ঠেকুয়া মিস করি, বিহারের জল-হাওয়া মিস করি ।

আওরঙজেব : আই ডোন্ট অ্যাগ্রি উইথ ইয়োর কনসেপ্ট মিস্টার শিশুনাগ । আমি আমার ভাইগুলোকে সাইডলাইন করেছিলুম, আব্বাহুজুরকেও কেল্লায় বন্দি করে রেখেছিলুম, ছেলেদেরও পাত্তা দিইনি । নব্বুই বছর অব্দি আরামসে রাজত্ব করেছি আর সাম্রাজ্যের সীমা বাড়িয়েছি । শুধু ওই শিবাজীকে কব্জা করতে পারিনি বলে সারা জীবন দুঃখে ভুগেছি ।

রাবড়িভৌজি : দুঃখ করবেন না আওরঙজেবভাইয়া । আপনি তো নেশা করেন না । আমি আপনাকে দুবেলা গোরুর দুধ খাও্য়াবো । খাঁটি দুধ, জার্সি গাইয়ের । ঘুঁটে বেচে আমি সাত কোটি টাকা জমিয়েছি যা আপনি যুদ্ধ করে রোজগার করতে পারেননি  । আমার বর দুধ বেচে তিন হাজার কোটি টাকা রোজগার করেছে । আপনি তো আমার হাতের ঠেকুয়া খাবেন না, নয়তো পুঁটলি বেঁধে দিতুম । আপনার দাঁত আছে তো ? না সবগুলো পড়ে গেছে ?

জব চার্ণক : ১৬৬৮ সালে যখন আমি পাটনার আফিম গুদামের কর্তা ছিলুম তখন লীলা নামের পনেরো বছরের একজন বিহারি বিধবা মেয়েকে বিয়ে করেছিলুম । বিশ্বাস না হয় তো  ডব্লু ডব্লু হান্টার, যিনি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের সদস্য ছিলেন আর সেই সময়ের ইতিহাস লিখেছিলেন, তা পড়ে দেখতে পারেন । আমি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মেয়েটাকে উদ্ধার করেছিলুম, যখন ওকে সতীদাহের জন্য ওর বুড়ো স্বামীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় পাঠানো হচ্ছিল। ওকে আমি হিন্দু মতে বিয়ে করেছিলুম ; আমাদের দুই ছেলে আর দুই মেয়ে হয়েছিল । উনিশ শতকের বাঙালি মণীষীরা তার অনেক পরে বিধবা বিয়ের আন্দোলন করেছিলেন । আমার বউ খুব ভালো ঠেকুয়া বানাতে পারতো । আমি ওর হাতের লিট্টি-চোখা খেতে ভালোবাসতুম । ডি এল রিচার্ডসনও ওনার বইতে ঘটনাটার কথা লিখেছেন । সময় পেলে পড়ে দেখবেন ।

মেগাস্হিনিস : সত্য লালুকাস, কী বিচিত্র তোমার দেশ !

কলিম খান : অনেকে বলবেন, আল্লাহ তায়ালা কেবল মুমিন-মুসলিমদেরকেই খলিফা বানিয়েছেন, কাফেরদেরকে খলিফা বানাননি। আসলে এ কথাটা ঠিক নয়। আল্লাহ তায়ালা মুমিন-মুসলিম-কাফের-মুশরিক সবাইকে সাধারণভাবে খলিফা বানিয়েছেন। 

রাবড়িভৌজি : স্যার কলিম খান, আপনি সেক্যুলার মানুষ, তা জানি । আপনার স্ত্রী খ্রিস্টধর্মী । আপনার কাছেই শুনেছি,  আমেরিকাতে আইনবলে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় চার্চের নাক গলানো নিষিদ্ধ , আর মানুষকে তার ইচ্ছেমত যে কোনও ধর্ম মেনে চলার ও প্রচার করার অধিকার দেওয়া হয়েছে, কিন্তু উল্টোদিকে আবার রাষ্ট্রের হাতেও চার্চের কাজকর্মে নাক গলানোর অধিকার দেওয়া হয়নি । কিন্তু ফ্রান্সে আইন করে চার্চের প্রচুর সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া হয়েছে, আর রাষ্ট্র যাতে চার্চের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সে ব্যবস্থা রাখা হয়েচে । একই চেষ্টা তুর্কিতে করেছিলেন কামাল আতাতুর্ক, কিন্তু সাময়িক সাফল্যের পরে তা ভেস্তে যায় । ‘সমাজতান্ত্রিক’ দেশ চিনে  সেক্যুলারাইজেশনের ধরনটা আরেকটু কড়া । রাষ্ট্র সেখানে যদিও ব্যক্তির ধর্মবিশ্বাসের অধিকারকে স্বীকার করে, কিন্তু আবার  ধর্মের সংগঠন ও প্রচারের কর্মকাণ্ডকে  নিয়ন্ত্রণও করে, আর স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ধর্মের অসারতার কথা প্রচার করে সাধারণকে এ বিষয়ে সচেতন রাখে । ভারতে আবার ‘সেক্যুলার’ কথাটার আসল পশ্চিমী অর্থকে একটু পাল্টে নিয়ে ‘সব ধর্মের প্রতি সমান মর্যাদা’ গোছের এক নরমসরম ধোঁয়াটে অর্থ খাড়া করা হয়েছে । ভারতের দুই  প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তান আর বাংলাদেশ এমনিতে চলে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ আইনে, আর সেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকারও স্বীকৃত, কিন্তু  তাদের সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম বলে ঘোষণা করে তাকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে ।

কলিম খান : রাবড়িভৌজি, ধর্মনিরপেক্ষ ভাবনা ও সমতার আদর্শ না থাকলে মজবুত রাষ্ট্র নির্মাণ কখনও সম্ভব নয়। এই আদর্শ ছাড়া যদি কখনও রাষ্ট্র নির্মাণ হয়, তবে তার ভিত্তি দুর্বল হতে বাধ্য, এবং তা হয় ক্ষণিকের সাফল্য। সেটাই হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে। দেশভাগের যন্ত্রণা প্রায় প্রত্যেক বাঙালিকে কষ্ট দিয়েছিল। সেই যন্ত্রণার পরিসর সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানে দ্বিগুণ হয়েছিল ভাষা-সংস্কৃতির উপর রাষ্ট্রের নির্মম আক্রমণে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্যেই নিহিত ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন। শেখ মুজিব ও তাঁর সহযোদ্ধারা সেই স্বপ্নের নির্মাণ করেছেন রাষ্ট্র গঠনের পরিচ্ছন্ন মৌলিক ভাবনা ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের উপর ভিত্তি করে। এর সঙ্গে যুক্ত করতে পেরেছিলেন দীর্ঘ কাল ধরে চলে আসা বাঙালির সামাজিক পরম্পরা, মূল্যবোধ ও পারস্পরিক বিশ্বাসকে। এই জন্যই শেখ মুজিব সফল এবং বিশ্বজনীন এক রাজনৈতিক চিন্তাবিদ। তিনি বিশ্বাস করতেন, জোর করে চাপিয়ে দেওয়া ভাষা, সংস্কৃতি ও সংবিধান অন্য ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ— যাঁদের ভিন্ন সংস্কৃতি, রুচি ও ভিন্ন ব্যবহারিক যাপন— তাঁরা কখনও মেনে নেন না।

ভারতীরাণী বসু : আমার বাড়ি স্বরূপকাঠি । বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে সাতাশে এপ্রিল আমি কাঠালিয়া থানার মহিষকান্দি গ্রামে যাই আত্মরক্ষার জন্য। তখন চারদিকে সব বিচ্ছিন্ন অবস্থা। হিন্দু বাড়ি বিভিন্ন স্থানে লুট হচ্ছে, হত্যা চলছে। ওখানে পৌছানোর পরপরই স্থানীয় কিছু লোক হিন্দু বাড়ি লুট শুরু করে দেয়। কুড়ি-পঁচিশ জনের   বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে সকালে, দুপুরে, রাতে, ভোরে যখন তখন বল্লম, দা আর অন্য ধারালো অস্ত্র নিয়ে হিন্দু বাড়ি আক্রমণ করে সব লুট করে ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। আমি স্বরুপকাঠিতে ফিরে আসি ৫ই মে। সেদিন ছিলো হাটবার। ঐ দিনই সমস্ত এলাকা লুট করে নেয় দুষ্কৃতিরা। ৬ই মে সকালে পাক সেনা প্রথম স্বরূপকাঠিতে যায়। ওখানকার পীর শর্ষিনার বাড়িতে গিয়ে পাক বাহিনী ওঠে। ওখান থেকে থানায় আসার পথে শর্ষিনার পুল থেকে থানা পর্যন্ত (সাহাপারা) সমগ্র হিন্দু বাড়ী প্রথমে লুট করে জ্বালিয়ে দিয়েছে। ওখান থেকে পাক বাহিনীর একটা দল অলঘারকাঠির দিকে গিয়ে ঘর বাড়ী জ্বালানো ও সেই সাথে মানুষ হত্যাও শুরু করে। আর একটা দল স্বরূপকাঠি এসে শুধু হিন্দু বাড়ি বেছে বেছে সকল হিন্দু বাড়ি লুট করে পুড়িয়ে দেয়। কালী প্রতিমার উপর অসংখ্য গুলি চালিয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে। বহুজনকে হত্যা করে। নারী নির্যাতন করে। তারপর পাক বাহিনী ফিরে যায়।

শেখ মুজিবুর রহমান : তাই ওদের তাড়িয়েছিলুম । 

আম্রপালী : আরও শুনুন ভারতীরাণী বসু । চার মাস শেষ হলে গৌতম বুদ্ধ তার সঙ্গীদের নিয়ে চলে যাবেন। এদি‌কে তরুণ শ্রমণের কোনও খবর নেই। তবে কি আমার রূপের কাছেই হেরে গেলো শ্রমণ ? সেদিন সবাইকে অবাক করে দিয়ে তরুণ শ্রমণ ফিরে গেলো বুদ্ধের কাছে ।  আমিও তাকে অনুসরণ করলুম । তরুণ শ্রমণকে প্রলুব্ধ করতে কোনও চেষ্টা বাকি রাখিনি আমি। কিন্তু এই প্রথম কোনও পুরুষকে বশ করতে ব্যর্থ হলুম আমি, যে কিনা বৈশালীর নগরবধূ আম্রপালী।  সর্বস্ব ত্যাগ করে বুদ্ধের চরণে আশ্রয় চাই আমি । তারপর সবকিছু দান করে  বাকি জীবন গৌতম বুদ্ধের চরণেই কাটিয়ে দিয়েছিলুম। বৌদ্ধগাথায় লেখা আছে যে আমি বিম্বিসারের ছেলে বিমল-কোণ্ডনের মা । 

সুকন্যা বন্দ্যোপাধ্যায় : 

দেশটা চলেছে যুদ্ধে!

পায়ে প্লাস্টার, ন্যাজে নামাবলী,

কাস্তে ও হাতে জোর গলাগলি,

টিকি, ফেজ, দাড়ি, বাইকের রেলি —

কোভিড হেসে কয়, গুড ডে !

দেশটা চলেছে যুদ্ধে।

‘কারিয়াকর্তা’ খেলছেন গেম,

‘গোদুগ্ধে আছে নিকষিত হেম’

চোখ মটকায় দিশি ইভিএম,

“জ্যান্ত চাই না, ভূত দে”!

দেশটা চলেছে যুদ্ধে !

দেশটা চলল যুদ্ধে,

টেকো চেল্লায় ‘সুনার বাংলা’ !

বুথে মুড়ি-বোঁদে সাঁটায় হ্যাংলা,

বোম পড়ে ! আঁট দরজা জানলা !

ভোট পড়ে গেল পদ্মে !

দেশটা চলেছে যুদ্ধে,

চোরে-বেনিয়ায় ঘোর চেঁচামেচি,

অতিষ্ঠপ্রাণ যত প্যাঁচাপেঁচি,

মহামারী হাসে—‘আসল নিয়েছি,

এইবারে তবে সুদ দে’ !

দেশটা চলল যুদ্ধে।

বাহাদুর শাহ জাফর : ইংরেজরা আমাকে ১৮৫৮ সালে বর্মায় নিয়ে যাবার সময়ে পাটনার গঙ্গায় বজরা থামিয়ে ওদের গুলজারবাগের আফিম গুদামে আমাকে আর আমার প্রধান বেগম জিনতমহলকে দিনকতক রেখেছিল, সেখানে বস্তার পর বস্তা আফিম । আমার বাকি তিন বেগম, বাইশটা ছেলে আর বত্রিশটা মেয়ে কে কোথায় আছে জানি না ।  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর পাটনার গুলজারবাগের  এই আফিম কারখানাতেই ১৭১৭ সালে  শাহ আলম সম্রাট হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছিল । বাবরের বংশধরদের কী দুর্দশা ! 

শাহ আলম : আমি সম্রাট ছিলুম শুধু নামেই ।  আমার  দিওয়ান সেতাব রায় কূটকৌশল  করে ইংরেজদের সাফল্যের পথ সহজ করে দিয়েছিল।  মীর কাসিমের গোলন্দাজ বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা মর্কা আর আরাটোন দুইজনই আর্মেনিয়ান খ্রিস্টান ছিল। তারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিশ্বস্ততার পরিচয় দেয়নি। রণকৌশল ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে ইংরেজদের শ্রেষ্ঠত্ব ছিল। মীর কাসিমের অনিয়ন্ত্রিত সৈন্যরা স্বভাবতই সুনিয়ন্ত্রিত ইংরেজ সৈন্যদের সাথে ভালো দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি। সর্বোপরি বিশ্বাসঘাতকতা চারদিক থেকে মীর কাসিমকে ঘিরে ধরেছিল। তাই পলাশীর মতো বক্সারের যুদ্ধেও বিশ্বাসঘাতকতার জয় হয় । তবে পাটনার লিট্টি-চোখা খেতে আমার ভালো লাগতো ।

মেগাস্হিনিস : সত্য লালুকাস, কী বিচিত্র তোমার দেশ ! আমি পাটলিপুত্র গ্রামের পুরুষদের এক হাজার যুবতী গ্রিস থেকে আনিয়ে উপহার দেবার ব্যবস্হা করেছিলুম । তাদের ছেলে-মেয়েদের বংশধররা আজ কে কোথায় ?

লালুকাস  : আমি লালুকাস নই । আমি লালুমস্তান । জরাসন্ধের বংশধর, খাঁটি খোট্টা । উনি ছিলেন মগধের রাজা। হিন্দু মহাকাব্য মহাভারত অনুযায়ী  বৃহদ্রথ রাজবংশধর। ওনার বাবা বৃহদ্রথ এই খোট্টা রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। জরাসন্ধ একজন মহাবীর ও মহারথী হিসেবে মহাভারতে চিহ্নিত । উনি বহু রাজাকে রাজগিরের জেলে আটক করে রেখেছিলেন,  যাদের  বলি দেবার প্ল্যান করেছিলেন। আমার মতন ওনারও প্রবল পরাক্রমের জন্য আর্যাবর্তের বহু নেতা পছন্দ করে না । বলে, খোট্টা কোথাকার ।

সৈয়দ ইব্রাহিম মল্লিক বিয়া : আমি একজন সুফি-যোদ্ধা । আমিও বিহারি খোট্টা, আমার ফ্যামিলির সদস্যরাও তাই । জন্মেছিলুম আফগানিস্তানের গজনির কাছে। আব্বাসীয়দের হাতে অত্যাচার থেকে বাঁচতে আমার পূর্বপুরুষরা বাগদাদ থেকে এই অঞ্চলে পাড়ি জমান। ভারতে আসার পর সুলতান তুগলুকের সেনাবাহিনীতে জেনারেল হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলুম। বেশ কয়েকটা সফল লড়ায়ের  পরে আমি সুলতানের কাছ থেকে মল্লিক বিয়ার উপাধি পেয়েছিলুম আর বিহার জেলার গভর্নর নিযুক্ত হই।  পরিবারের সাথে বিহার শরীফে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিলুম । আমাকে গুমখুন করার  আগে পর্যন্ত এই অঞ্চলে রাজত্ব করেছি। আমার মাজার  বিহার শরীফের ‘পীর পাহাড়ি’ নামে পরিচিত একটি পাহাড়ের ওপরে । আমার বংশধররা এখন বিহারসরিফ, গয়া, জহানাবাদ, নওয়াদা, আওরঙ্গবাদ, পাটনা, মুঙ্গের, জামুই, শেখপুরা, নালন্দা সহ পুরো অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদের পদবি মল্লিক । আমাদের পরিবারের কেউই পাকিস্তানে পালায়নি ।

দেমেত্রিওস : শুঙ্গ সম্রাট পুষ্যমিত্র শুঙ্গের শাসনকালে আমি গ্রিক সেনা নিয়ে  মগধ আক্রমণ করে পাঞ্চাল অঞ্চল, সাকেত আর মথুরা নগরী আর সব শেষে পাটলিপুত্র নগরী অধিকার করে নিয়েছিলুম ।  অবশ্য কলিঙ্গ রাজ খারবেল ওনার রাজত্বের অষ্টম বছরে রাজগির আক্রমণ করলে আমি আটকে-পড়া সৈন্যদের  ছেড়ে মথুরায় চলে গিয়েছিলুম। কথাগুলো এইজন্যে বলছি যে আমার বহু গ্রিক সেনা বিহারি হয়ে গিয়েছিল।  যাদের আপনারা রাজপুত বলেন তারা আসলে গ্রিকদের বংশধর ।

রাবড়িভৌজি : সে আপনি যাই বলুন স্যার । তারা সবাই আজ খোট্টা, গ্রিক ভাষা জানে না । নিজেদের ক্ষত্রিয় হিসেবে ঢাক পিটলেও, ভোজপুরি, মগহি, পাটনাইয়া বুলিতে কথা বলে । ওদের পরিবারের মানুষরা যে আপনাদের জন্যেই ফরসা তা ওরা জানে না । শিলাওয়ের খাজা ওরাই পাটলিপুত্রে এনেছিল ।

খোট্টা সাংবাদিক : ( বুম হাতে )

খোড়ো চাল। জীর্ণ মুলিবাঁশের বেড়ায় বিবর্ণ গামছা। রুখু দাওয়ায় ঘোমটা টানা নামহীন অবয়ব।

“বলুন, এখন আপনার ঠিক কি মনে হচ্ছে, বলুন? ঠিক কতটা কষ্ট হচ্ছে আপনার?”

ভাঙাচোরা মুখের গৃহস্বামী —বুকের শীর্ণ পাঁজরে হাত বোলাতে বোলাতে, কাঁপা গলায় :

“খুব কষ্ট হচ্ছ্যা, খুব। আমার একটাই মাইয়া, ধষষিতা হয়্যা খুন হয়্যা গ্যালো, সরকার দুই লাখ ক্ষতিপূরণ দিছে—

হায় উপরওয়ালা, ক্যানো আমায় আরো দুই তিনটা মাইয়া দিলা না, তাইলে সামনের বছরে পাকা ভিটা হইত, ছেল্যাটার একখানা মটরবাইকের শখ — কিন্যা দিতাম, আর গেল শুখার জন্যি মহাজনের যে দেনাটা শুধতে পারি নাই, সেইটা মিটত ! কষ্ট কি কম বাবু !”

বিম্বিসার : আমি বৌদ্ধ ও জৈন জীবনবোধের প্রতি অনুরক্ত ছিলুম ঠিকই, কিন্তু কোনও বিশেষ ধর্মের অনুসারী ছিলুম না । জৈন আর বৌদ্ধ বই পড়লে জানতে পারবেন যে, গৌতম বুদ্ধ আর মহাবীর-এর সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। আমি ছিলুম ওনাদের পৃষ্ঠপোষক ।  গৌতম বুদ্ধের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ বৌদ্ধ ভিক্ষু দেবদত্তের ওসকানিতে অজাতশত্রু আমাকে আর আমার অমাত্যদের খুন করার চেষ্টা করেছিল। বুদ্ধের মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলুম বলে,  এই ঘটনা সত্ত্বেও অজাতশত্রুকে  ক্ষমা করে দিয়েছিলুম। কিন্তু ও দেবদত্তের প্ররোচনায় আমাকে আর আমার উপদেষ্টামণ্ডলীকে গৃহবন্দী করে নিজেকে মগধের সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করে দিলে।  গৃহবন্দী অবস্থায় আমি মারা যাই। এই সময় দেবদত্তের প্ররোচনায় অজাতশত্রু গৌতম বুদ্ধকে হত্যার চেষ্টা করেছিল। যাই হোক, আমি মারা যাবার পরর অনুশোচনায়  অজাতশত্রু মনের শান্তির আশায় বিভিন্ন  দার্শনিকের শরণাপন্ন হয়েছিল বটে কিন্তু তাঁদের উপদেশে শান্তিলাভে ব্যর্থ হয়ে রাজবৈদ্য জীবকের উপদেশে গৌতম বুদ্ধের শরণাপন্ন হলে বুদ্ধ ওকে জীবনবোধ সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা শোনান । অজাতশত্রুর রাজসভার লোকেদের বংশধররা যে খোট্টা তা বিহারের মানুষগুলোর কাজকর্ম দেখলেই টের পাবেন ।

খুদা বক্স খান:  আমি একজন বিবলিওফাইল, বিরল পাণ্ডুলিপিগুলির সংগ্রহকারী; প্রথমদিকে ১৮৮০ সালে একটা প্রাইভেট লাইব্রেরি খুলেছিলুম যা পরে ১৮৯১ সালে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দিই । আমার বাবা মোহাম্মদ বখশের কাছ থেকে ১৪০০ টা বিরল পাণ্ডুলিপি পেয়েছিলুম ;  পরে এটা বিশ্বের ফারসি, আরবি আর উর্দু পাণ্ডুলিপিগুলির সংগ্রহগুলির একটি হিসাবে তৈরি করতে ২৬০০ পাণ্ডুলিপি  যোগ করেছি। ১৯৬৯ সালে ভারত সরকার এই গ্রন্থাগারটিকে জাতীয় গুরুত্বের একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে ঘোষণা করেছিল। আমার সমৃদ্ধ সংগ্রহ দেখে মুগ্ধ হয়ে এক সময় ব্রিটিশ গ্রন্থাগার আমার সংগ্রহ কিনতে মোটা দাম দিতে চেয়েছিল। আমি বলেছিলুম যে , “আমি একজন গরীব মানুষ। যে অর্থ অফার করা হয়েছে তা রাজার ভাগ্যে জোটে। তবে আমার বাবা এবং আমি আমাদের জীবন এই সংগ্রহে উৎসর্গ করেছি ; আমি কীভাবে অর্থের জন্য তা দিতে পারি? ” আমার বংশধররা খোট্টা থাকতেই ভালোবাসে । তারা মাগধী, মৈথিলি, অঙ্গিকা, ভোজপুরি, উর্দু ইত্যাদি বিহারি ভাষা ও তার নানা উপভাষায় কথা বলে ।

বাংলাদেশি খোট্টা : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ২০০৮ সালের  আদেশ অনুযায়ী, বিহারিদের জাতীয় ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার কথা থাকলেও তা হয়নি৷ বেশিরভাগ বিহারি বাংলাদেশি পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য যোগ্য নয়৷ কারণে তারা অস্থায়ী ক্যাম্পে বাস করে৷ বাংলাদেশের নিয়মানুযায়ী, পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য আবদেনকারীকে তার স্থায়ী ঠিকানা সরবরাহ করতে হয়৷ আমরা পাঁচ দশক ধরে অমানবিক জীবনযাপন করছি, নূন্যতম সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছি৷ আমাদের সন্তানদের মধ্যে কেবল পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পায়৷ আমরা আমাদের মৌলিক চাহিদা পূরণে সক্ষমতা অর্জন করতে চাই, আমরা আমাদের সন্তানদের স্কুলে যেতে দেখতে চাই৷ আমাদের অনেকে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানকে আর্থিক সহায়তা করেছি, সে কথা সত্যি ৷ ফলে আমাদের এখনো বাংলাদেশের বিপক্ষের মানুষ বলেই বিবেচনা করা হয়৷ আমরা ক্যাম্পগুলোতে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস না করে সমাজে অন্তর্ভুক্ত হতে চাই৷ আমাদের বাংলাদেশ-বিরোধী বলে যে তকমা দেয়া হয় তা থেকেও বেরিয়ে আসতে চাই আমরা৷ আমরা বিহারি নই, খোট্টা নই । কিন্তু আমরা ঠেকুয়া, খাজা, মুগের ডালার লাড্ডু বড্ডো মিস করি ।

আবদুল বারি : আমি বিহারের কংগ্রেস দলের নেতা । ১৯৪৭ সালের ২৮ শে মার্চ ভারতের স্বাধীনতার ঠিক আগে আমাকে খুন করা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে পাটনায় দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে, মহাত্মা গান্ধীর অনুরোধে আমি জামশেদপুর থেকে মোটর গাড়িতে করে পাটনা আসছিলুম, ফতুহা রেল ক্রসিংয়ের কাছে মোটর গাড়ি দাঁড়াতেই আমাকে গুলি করে খুন করা হয়। আমার এই ভয়াবহ হত্যার পরে গান্ধীজি আমার দেশের বাড়ি কোয়েলওয়ারে এসেছিলেন আর শোকসন্তপ্ত পরিবারের সাথে দেখা করেছিলেন।  পরিবারের অবহেলিত দারিদ্র্যের করুণ হালত দেখে গান্ধীজি অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছিলেন । আমার দাফনের জন্য পরিবারের কাছে কোনও টাকা ছিল না। আমার হত্যাকারী কখনও শাস্তি পায়নি কারণ বিহার প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সভাপতি এবং মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থীর পক্ষে ক্ষমতার লড়াইয়ে আমারই সহকর্মী আমাকে খুন করিয়ে নিজে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে গিয়েছিল । তবু আমার পরিবারের কেউই পাকিস্তানে যায়নি ।

মহাবীর : আমার নাম মহাবীর, আমি একজন তীর্থঙ্কর । মনে রাখবেন, আমি আদপে বিহারি । খ্রিস্টপূর্ব ৫৯৯ অব্দে বীর নির্বাণ সম্বৎ অনুসারে চৈত্র মাসের শুক্লা ত্রয়োদশী তিথিতে কাশ্যপ গোত্রীয়  ক্ষত্রিয় রাজবংশে জন্মেছিলুম। আমার বাবা  ছিলেন ইক্ষ্বাকু রাজবংশের রাজা সিদ্ধার্থ ও মাতা ছিলেন রানি ত্রিশলা,বৈশালীর রাজা চেতকের বোন। প্রথাগত মত অনুসারে, প্রাচীন শহর ক্ষত্রিয় কুন্দ লাচ্চুয়ারের কুন্দলপুরক আমার জন্মস্থান । এখন এই জায়গাটা বিহারের জামুই জেলার সিকান্দ্রা মহকুমায় পড়ে । জৈন বিশ্বাস অনুসারে, আমার জন্মের পর ইন্দ্র জম্বুদ্বীপ নামক বিশ্বকেন্দ্রের অক্ষ মেরু পর্বতে তার তৈলার্পণ ও অভিষেক অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলেন আর তার নামকরণ করা হয়েছিল ‘বর্ধমান’। অধিকাংশ আধুনিক ইতিহাসবিদই মনে করেন, আমার জন্ম হয়েছিল কুন্দগ্রামে। এই স্থানটি এখন ভারতের বিহার রাজ্যের মুজফফরপুর জেলার বাসোকুন্দ নামে পরিচিত।বিহার যে এই অবস্হায় পৌঁছোবে তা আমি কখনও অনুমান করিনি ।

পুষ্যমিত্র শুঙ্গ : আরে ভাইয়া, আমি আসল বিহারি খোট্টা, একজন বিহারির সব গুণ পাওয়া যাবে আমার চরিত্রে । আমি শুঙ্গ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট ছিলুম । ব্রাহ্মণ সম্রাট । বাণভট্টের লেখা হর্ষচরিত বই অনুযায়ী আমি ১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মৌর্য্য রাজবংশের নবম সম্রাট বৃহদ্রথের প্রধান সেনাপতি ছিলুম । সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজে শক্তি প্রদর্শনের সময় বৃহদ্রথকে খুন করে মৌর্য্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটাই আর শুঙ্গ রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করি। পতঞ্জলির ‘মহাভাষ্য’  আর পাণিনির ‘অষ্টাধ্যায়ী’  পড়ে দেখতে পারেন । তাঁরা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে পুষ্যমিত্র শুঙ্গকে ভারদ্বাজ গোত্রভুক্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে, আবার হরিবংশ পুরাণে তাকে কাশ্যপগোত্রীয় ব্রাহ্মণ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আসলে আমি ‘দ্বৈয়মুষ্যায়ন’  বা দুই গোত্র বিশিষ্ট ব্রাহ্মণ । আমার বাবা আর মা  ভারদ্বাজ আর কাশ্যপ দুই ভিন্ন গোত্রের ছিলেন বলে আমি দুই গোত্রের বিহারি বামুন । বুঝতেই পারছেন, মিক্সড ম্যারেজ আরম্ভ করেছিলেন আমার মা-বাবা, তাঁদের লাভ ম্যারেজ ছিল।আমার পর যে ব্রাহ্মণ শাসক রাজত্ব করেছিলেন তাঁর নাম জওহারলাল নেহেরু ; তাঁর মেয়ে আর মেয়ের ছেলেরা মিক্সড ম্যারেজ করেছিল  ।

জগৎ শেঠ : আপনারা ভুলে যাচ্ছেন, পাক্কা বিহারি বলতে আমাদের পরিবারকে বোঝায় । আমরা ছিলুম পাটলিপুত্রের সুদখোর মহাজন । পয়সাঅলা লোকেরা তাদের টাকাকড়ি-সোনাদানা আমাদের কাছে জমা রাখতো । অজাতশত্রুর সময় থেকে আমরা সুদখোরের কাজ করি ।   বাংলার  ধনী ব্যাংকার হয়ে উঠি । আমাদের পরিবারের ফতেহ চাঁদকে আঠারো শতকের প্রথমার্ধে ‘জগৎ শেঠ’ বা বিশ্বের ব্যাংকার উপাধি দেয়া হয়েছিল। আমাদের পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মানিক চাঁদ। উনি আঠারো শতকের প্রথম দিকে পাটনা থেকে ঢাকা গিয়ে সেখানে সুদখোরি আর বন্ধকি কারবার আরম্ভ করেন। বাংলার দিউয়ান মুর্শিদকুলী খান তাঁর রাজধানী মুর্শিদাবাদে নিয়ে গেলে, মানিক চাঁদ তার সাথে নতুন রাজধানীতে চলে আসেন। মুর্শিদাবাদে উনি ছিলেন নওয়াবের খুবই প্রিয়ভাজন আর পরে নওয়াবের ব্যাংকার ও অর্থনৈতিক উপদেষ্টার পদ লাভ করেন। ১৭১২ সালে দিল্লির সিংহাসনে বসার পর পর সম্রাট ফররুখসিয়ার ‘নগর শেঠ’ বানগরের ব্যাংকার উপাধি দিয়ে মানিক চাঁদকে সম্মানিত করেছিলেন। ১৭১৪ সালে মানিক চাঁদের মৃত্যুর পর তাঁর দত্তক নেয়া ছেলে ও উত্তরাধিকারী ফতেহ চাঁদের নেতৃত্বে পরিবারটি বিপুল ধনসম্পত্তি করে ফেলেছিল। ১৭২৩ সালে সম্রাট মাহমুদ শাহ ফতেহ চাঁদকে ‘জগৎ শেঠ’ উপাধি প্রদান করলে আমাদের ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান দেশে এক অনন্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়। এর সদর দফতর ছিল মুর্শিদাবাদে এবং ঢাকা, পাটনা ও দিল্লিসহ বাংলার গুরুত্বপূর্ণ শহর ও বাংলার বাইরে এই ব্যাঙ্কের শাখা ছিল। আমাদের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কারবার, যেমন টাকা ধার করা,  ঋণ পরিশোধ, সোনারুপার বেচা-কেনা আর অন্যা লেনদেন চলতো । মুগল সাম্রাজ্যে সবচেয়ে ধনবান ছিলুম আমরা ; মুর্শিদাবাদ সরকারের ওপর আমাদের পরিবারের ছিল প্রচন্ড প্রভাব। আমরা বেশিরভাগ জমিদারের পক্ষে নিরাপত্তা জামিনদার হতুম আর ব্যবসায়ীদের ঋণ দিতুম। রাজ্যের কোথায় কি ঘটছে তা আমরা অন্যদের চেয়ে বেশি জানতুম । মোগল আর নবাবদের হেঁসেলে আমের আচার দিয়ে মাখা ছাতুর পরোটা তৈরি করতে আর খেতে আমরাই শিখিয়েছিলুম ।

সক্রেটিস : সত্য লালুকাস, কী বিচিত্র তোমার দেশ !

রাবড়িভৌজি : বিহারের অতীতের মগধ জনপদে তথা আজকের পাটনা শহরের উত্তর দিকে গঙ্গার কাছে সতীর ডান উরু পড়েছিল। দেবী এখানে সর্বানন্দকরী । শিব হলেন ব্যোমকেশ। সতী  পাটনদেবী নামেও পরিচিতা।  দেবীর নামেই পাটনার নামকরণ হয়েছে। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, বিশ্বাস করা হয় যে দেবী সতীর ডান উরুটি মগধে পড়েছিল এবং কথিত আছে যে সতীর দেহের অংশ পুরোনো পাটনা শহরের মহারাজগঞ্জ এবং চৌক উভয় অঞ্চলে পড়েছিল। এই জায়গাগুলিতে বড়ি পাটনদেবী মন্দির আর ছোটি পাটনদেবী মন্দির তৈরি হয়েছিল। তন্ত্র চারুমণীর মতে, পাটনার বড়ো পাটনদেবী মন্দিরের ছোট ছোট মূর্তিগুলো হলেন দেবী মহাকালী, মহালক্ষ্মী আর মহাসরস্বতী। হিন্দু পুরাণে এই দেবী পুত্রকাকে রক্ষা করেছিলেন, যিনি পটলিপুত্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। পাটনার বড়ো পাটনদেবী মন্দিরের কাছে একটি পুকুরে   পাথরের মূর্তি পাওয়া গেছে। এই মূর্তি মূল মন্দিরের পূর্ব বারান্দায় রাখা হয়েছে যেখানে এই পাথরকে নিয়মিত পুজো করা হয় । আমার স্বামী, ছেলে, মেয়ে বিপদে পড়লেই পুজো দিতে যাই । 

পিথাগোরাস : সত্য লালুকাস, কী বিচিত্র তোমার দেশ !