কফিহাউসে চেঙ্গিজদা, ল্যাঙড়াদা, গুলপিসি…

.

চেঙ্গিজ খান : যাক তোরা সব আগেই এসে বসে আছিস দেখছি । জানিস তো, আমিই মহান খান, কিন্তু এই ল্যাঙড়া তৈমুরের মতন খান নই । আসলে আমার নাম ছিঙ্গিস খাং ছিল, ইংরেজ ব্যাটারা নিজেদের উপনিবেশগুলোতে খানের ছড়াছড়ি দেখে আমাকেও খান বানিয়ে দিয়েছে । আমি তো কাফের, নাস্তিক, তোদের মতন আস্তিকান্তরিত নই । তবু আমাকে মোঙ্গোলরা জাতির পিতা মনে করে । সবাইক খবর দিয়েছিস তো যে আজকে কফিহাউসে জব্বর আড্ডা হবে ? তুই তো শুনেছি নিউমোনিয়া আর প্লেগে ভুগে হেগে-হেগে মরেছিলিস! রাশিয়ানরা কবর খুঁড়ে তোর কঙ্কাল যাচাই করে দেখেছিল যে তুই সত্যিই ল্যাঙড়া ছিলিস আর ডান হাতের কব্জি কাটা ছিল ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : হায় মাওলা, কী করলা, তুমি মালাউন ? কী করব, তখন আমার সত্তর বছর বয়স, শীতকালের চিন, জানোই তো, আর টানতে পারিনি । তবে আমি কিন্তু কখনও খান পদবি ব্যবহার করিনি। হ্যাঁ, যতোজনকে পেরেছি, জানিয়েছি । ঋষিমুনিরা বলেছেন ম্লেচ্ছদের আড্ডায় আসবেন না ; আর বর্মায় সামরিক শাসন চলছে, তাই বাহাদুর শাহ জাফর হয়তো দেরি করে আসবেন । জাহাঙ্গির আর নুর জাহান আসবেন না ; পাকিস্তান সরকার ওনাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, কেননা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা নেই আর আই এস আই ক্লিয়ারেন্স দেয়নি । অন্য সবাই আসবে বলেছে।

চেঙ্গিজ খান : তবে না তো কী ! প্রথমে আস্তিকান্তরিত হয়েছিল আমার নাতি । একজনমাত্র ঈশ্বরের ধর্ম নেয়  জোচি খানের ছেলে বারকি খান। জোচি  আমার বড় ছেলে। বাগদাদে হালাকু খানের অত্যাচারের খবর পেয়ে খাপ্পা হয়ে গিয়েছিল বারকি খান। ও এই বিষয়ে রাগ দেখিয়ে তখনকার মোঙ্গল সম্রাট উলু খাকান খান ই খানান কুবলাই খানের কাছে চিঠি লেখে।কুবলাই খান হালাকুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায়  বারকি খান রাজনৈতিক কূটচাল হিসেবে মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে দিয়েছিল।  কুতুজের পক্ষে হালাকুকে থামানো সম্ভব হত না যদি না  ও নিজের সমস্ত দৌলত, তাকত আর বুদ্ধি কাজে লাগাতো।   টেরেক নদীতীরের   যুদ্ধে হালাকুর বাহিনীকে আক্রমণ করেছিল বারকি খান আর ওর ভাইপো নোগাই খান। হেরে গিয়ে হালাকু খান পরের পাঁচ বছরে আর সিরিয়া-মিশরের দিকে হাত বাড়াতে সাহস পায় নি। আমি নাস্তিক ছিলুম, তারপর নাতিরা নানা আস্তিকতায় আস্তিকান্তরিত হয়ে আমাকে বিখ্যাত করে দিয়েছে ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : আমি তো আর খাঁটি মোঙ্গোল নই, আমি উজবেক, তুর্কি, মোঙ্গোল, চাঘতাই, ইরানি মেশানো । অটোমানের সম্রাট বায়োজিদকে  বন্দি করে রেখে সবচেয়ে আনন্দ পেয়েছিলুম । টোটাল কতো লোককে মেরেছিলুম জানো ? একশো সত্তর লাখ, আর গোলাম বানিয়েছিলুম তার চেয়ে বেশি । তবু পৃথিবীতে মানুষ কমল না ;পয়দা হয়েই চলেছে ।

চেঙ্গিজ খান : তোর কফিন খুলে নাকি সোভিয়েত রাশিয়া একটা চিরকুট পেয়েছিল । তাতে লেখা ছিল, যারা এই কফিন খুলবে তারা সেই দিনই ভয়ঙ্কর বিপদে পড়বে ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : হ্যাঁ, সেই দিনই হিটলার ওদের আক্রমণ করেছিল ।

চেঙ্গিজ খান : তোতলা তুগলক পাগলা তুগলক, মোটা তুগলক, ঢ্যাঙা তুগলক, রাগি তুগলক, খোকা তুগলক, ফিরোজাবাদি তুগলক, দিল্লিওয়ালা তুগলককে আসতে বলেছিস ?

তোতলা তুগলক : এই তো আমি গাজি মালিক সুলতান গিয়াসুদ্দিন তুগলক শাহ । আআমরা আআপনার পেপেছনের টেবিবিলেই ববসে আআছি দাআআআদা । ককখনও দেদেখিনি তো আআপনাকে । ভাআআবছিলুম পপটি পলিটিককককসের লোলললকলসকর বুবুবুঝি । ভোভোভোটের গ্যাঁজানিনি চচচচলছে ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : যাক এসেছিস, আমিও তোদের চিনতে পারিনি । বংশধরদেরও  সঙ্গে এনে ভালো করেছিস। ওদের সম্পর্কে লোকেরা এমন সব কথা বলে বেড়ায় ! তোরা চেয়ার টেনে এই টেবিল ঘিরে বোস।

পাগলা তুগলক : গুড মর্নিঙ এভরিবডি ; আমিও আছি এখানে, সুলতান মোহম্মদ আদিল বিন তুগলক শাহ । কে কী বলে বেড়ায়, হারামিদের পাঠিয়ে দেবো দেবগিরিতে, তখন টেরটি পাবে মজা। আমি এই মোঙ্গোলদের মোটেই পছন্দ করতুম না । নেহাৎ আব্বাহুজুর বললেন, তাই এলুম ।

তোতলা তুগলক : গুগুগুরুরুরুজজজনননদেদের সাসাসামনে মুমুখ ফসসসসকে বাবাবাজে ককককথা ববববলিসনি । ওওওনাদের ককককথাগুলো ভালো ককককরে শোন । সসসসমাধির ভেতরে শুয়ে গগগগরমকালে গরররররম লাগগগগবে না, শীতকাকাকালে শীশীশীত কককককরবে না ।

ফিরোজ শাহ তুগলক : আমি মোটা তুগলক, এসেছি । 

ল্যাঙড়া তৈমুর : আমি তো এই মোটা তুগলক মারা যাবার পর  দিল্লি আক্রমণ করেছিলুম, স্পষ্ট মনে আছে । আমার আল-হিন্দ আক্রমণ তুগলকদের পতনেকে আরও তাড়াতাড়ি এনে দিয়েছিল । আমার ভয়ে  সুলতান নাসিরুদ্দিন মামুদ দিল্লী ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল, স্পষ্ট মনে আছে । আমার আক্রমণ দিল্লি সুলতানির ফোঁপরামিকে  তুলে ধরেছিল । ফলে দিল্লি সুলতানির মর্যাদা আর পতিপত্তি মাটিতে মিশিয়ে যায় । প্রচুর সোনা-মণি-মুক্ত লুঠ করে আমি দিল্লির অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছিলুম । কিন্তু আমি আল-হিন্দে তুর্কি মোগল ইরানি উজবেক আফগানদের মতন সাম্রাজ্য বসাবার  চেষ্টা করিনি । লোকে আমাকে ভয় আর ত্রাসের প্রতীক একজন লুণ্ঠনকারী মনে করে, সেটাই যথেষ্ট, সাম্রাজ্য বসানো বোকামি ।

তুগলক খান ইবন ফতেহ খান ইবন ফিরোজ শাহ সুলতান গিয়াস উদ দিন তুগলক শাহ : আমি ঢ্যাঙা তুগলকও এসেছি ।

সুলতান আবু বকর শাহ আবু বকর খান ইবন জাফর খান ইবন ফতেহ খান ইবন ফিরোজ শাহ: আমি রাগি তুগলক, এসেছি ।

মোহাম্মদ শাহ ইবন ফিরোজ শাহ সুলতান মোহাম্মদ শাহ : আমি খোকা তুগলক, এসেছি ।

হুমায়ূন খান সুলতান আলাউদ্দিন সিকান্দার শাহ : আমি শেষ তুগলক, এসেছি ।

মুহাম্মদ শাহ ইবন মুহাম্মদ শাহ সুলতান নাসির উদ দিন মুহাম্মদ শাহ তুগলক : ও শেষ তুগলক নয়, গুল মারছে, মোটে কয়েক মাসের জন্য সুলতান হয়েছিল ।

নুসরাত খান ইবনে ফাতেহ খান ইবনে ফিরোজ শাহ সুলতান নাসিরুদ্দিন নুসরাত শাহ তুগলক: তুইও তো শুধু ফিরোজাবাদের সুলতান ছিলিস । আমি দিল্লির সুলতান ছিলুম । আমরা দুজনে ফিফটি-ফিফটি সুলতান ছিলুম ।

চেঙ্গিজ খান : ঠিক বলেছিস তোতলা । আজকালকার ছেলেপিলেগুলোর বিশেষ জ্ঞান নেই । সব ব্যাপারে মাথা গলায় ।

তোতলা তুগলক : তৈমুরেরররর ককককথা শুনলি তোতততোরা । এএএবারে মুমুমুউখ বন্ধ ককককরে গপ্পোপোপোপো শোশোশোশোন । অবশ্য একটা কথা বলে নিই । আমার ছেলেটাই আমাকে খুন করে সুলতান হয়েছিল ।

কফিহাউসের যক্ষ : রাজা-রাজড়াদের ফ্যামিলিতে অমন একটু-আধটু হয় । আমি তো সারাদিন দেখি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকরা কলমের খোঁচায় কাকে-কাকে মারবেন তার প্যাঁচ কষেন । 

পাগলা তুগলক :  শাশ্বত মানবপ্রকৃতি বলে অবশ্যই একটা কিছু আছে।  এটাই মূলত ভিত্তি: মোটামুটি সুস্থির একটা মানবপ্রকৃতি যদি না-থাকে তবে সত্যিকারের বৈজ্ঞানিক উপলব্ধিতে পৌঁছানো আদৌ সম্ভব নয়। প্রতিটি সংস্কৃতিতেই আংশিক ও গুরুতর রকম খন্ডিত অভিজ্ঞতাগুচ্ছের ওপর নির্ভর করেও মানুষ কীভাবে তাদের মাতৃভাষা কেবল শিখতেই সক্ষম হন না, খুবই সৃজনশীলভাবে সেই ভাষা ব্যবহারও করতে পারেন?  এর একটাই মাত্র ব্যাখ্যা হতে পারে: মনের ভিত্তিস্বরূপ একটা জৈব-শারীরিক কাঠামো অবশ্যই বিদ্যমান, যা মানবপ্রজাতির সদস্য হিসেবে এবং সেইসাথে ব্যক্তিসত্তা হিসেবে, আমাদের বহুরূপ ব্যক্তিক অভিজ্ঞতাগুচ্ছ থেকে একটি সুসমন্বিত ভাষায় পৌঁছাতে সক্ষম করে তোলে। আমাদের সামাজিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও ব্যক্তিক আচরণ পরিচালনাকারী এই বিপুল অনুপুঙ্খ-পরিকল্পনা বা সহজাত-বিন্যাস-নীতির সমগ্রককেই আমি মানবপ্রকৃতি বলে আখ্যায়িত করি ।অর্থাৎ, জৈবিকসূত্রে প্রাপ্ত অপরিবর্তনীয় একটা কিছু আছে, যেটা আমাদের মানসিক সামর্থ্য দিয়ে যা-কিছু করি না কেন তার ভিত্তিমূল হিসেবে কাজ করে । মনে রাখবেন, বিয়ের আগে আমার মা হিন্দু, মানে কাফের ছিলেন ।

চেঙ্গিজ খান : বুঝলি, ল্যাঙড়া, বুঝলি তোতলা, আমি হলুম নির্ভেজাল খান ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : কী চেঙ্গিজদা, এসেই নিজের গুণগান আরম্ভ করে দিলে ? আমিও কম যাই না । আমার জীবনী পড়ে দ্যাখো, যদিও নিজে লিখিনি, আমি তো মুকখু ছিলুম, কিন্তু বুদ্ধিমান মানুষদের আমি পছন্দ করতুম।  আমার সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল এখনকার তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক, কুয়েত, ইরান থেকে মধ্য এশিয়ার অধিকাংশ অংশ, যার মধ্যে রয়েছে কাজাখস্তান, আফগানিস্তান, রাশিয়া, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজিস্তান, পাকিস্তান, ভারতবর্ষ এমনকি চীনের কাশগর পর্যন্ত । আমি সব জায়গা থেকে মাল লুটে নিজের দেশে নিয়ে যেতুম । লক্ষ-লক্ষ মানুষকে কচুকাটা করেছিল আমার সেনারা । বাগদাদের সবাইকে নিশ্চিহ্ণ করে দিয়েছিলুম আর দিল্লিতে এক লাখ মানুষের মাথা কেটে পাহাড় তৈরি করিয়েছিলুম ।

চেঙ্গিজ খান : তুই যে লোভী ছিলিস তা জানি । তার ওপর আবার নাস্তিকরা যে দেশেরই হোক, তাদের ফিনিশ করে দিতিস, বুক ফুলিয়ে তা বলে বেড়াতো তোর চেলারা । আমি মালাউন বলে ওই সব বিশ্বাস-অবিশ্বাসের হ্যাঙ্গাম ছিল না । আমি আফগানিস্তানে কতো লোককে মেরেছিলুম, বাড়িঘর মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিলুম, যাকে এখন বামিয়ান অঞ্চল বলে । কিন্তু বামিয়ানের  বুদ্ধমূর্তি ভাঙিনি।

ল্যাঙড়া তৈমুর : আমিও বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি ভাঙিনি, যদিও আমি মূর্তিপুজোর ঘোর বিরোধী অথচ যেসব দেশের লোক আমাকে ভালোবাসে, সেখানেই আমার মূর্তি খাড়া করে দিয়েছে । বুজকাশি খেলাটা এখন বেশ পপুলার বটে,  কিন্তু ওটা আমিই আরম্ভ করেছিলুম । বুজকাশি  বা কোক-বোরু যাকে উজবেকরা বলে কোকবারি, মাথা-কাটা ছাগল, বাছুর বা ভেড়ার বডি নিয়ে মধ্য এশিয়ার  ঘোড়সওয়ারদের খেলা, এখন আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, কিরগিজস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কাজাখস্তান, পাকিস্তানের পাঠান এলাকায়  খেলা হয়। জানো তো, খেলোয়াড়রা তাদের ঘোড়াগুলো দৌড় করায় আর ধড়টা তুলতে চেষ্টা করে। আমার সময়ে শত্রুপক্ষের মানুষের ধড় নিয়ে খেলতুম ।

চেঙ্গিজ খান : আরে তুই আমার ধারে-কাছে লাগিস না । তুই ভেড়া চুরি করতে গিয়ে পায়ে তির লেগে খোঁড়া হয়ে গিয়েছিলি । তোর জীবনীলেখকরা সবাই আস্তিকান্তরিত বলে তোর সম্পর্কে বাড়িয়ে-চাড়িয়ে লিখে গেছে । যেমন ওই জালালুদ্দিনের পিসি, গুলবদন বেগম, ওর হুমায়ুনের জীবনী লিখতে বসে তোকে বাবরের পূর্বপুরুষ বাতলেছে, ওদের পরিবারের সব কেচ্ছা চেপে গেছে । বাবর নিজেও নাম কেনার জন্যে নিজেকে তোর বংশধর বাতলেছে ; ওরা তো চাঘতাই, গুরকানি । গুরকানি মানে ঘরজামাই । জানিস কি, মঙ্গোলিয়ার বেশির ভাগ লোক বৌদ্ধ  আর তাদের অনেকেই যাযাবর । আমিও যাযাবর ছিলুম । আমার বউরা পঞ্চাশ একশো কোশ দূরে-দূরে চামড়ার তাঁবু খাটিয়ে সংসার পাততো । ঘোড়া হাঁকিয়ে যেতুম একবউ থেকে আরেক বউয়ের তাঁবুতে ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : আমি প্রচুর বৌদ্ধও মেরেছি । আমার পরে যারা বৌদ্ধ এলাকায় গেছে তারাও বৌদ্ধদের ফিনিশ করেছে । বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি কামান দেগে ভাঙার চেষ্টা করেছিল নাদির শাহ আর আওরঙজেব, কিন্তু ভাঙতে পারেনি । আফগান রাজা আব্দুর রহমান খান মূর্তির মুখ লোক লাগিয়ে ভেঙে দিয়েছিল । পরে তালিবানরা উড়িয়ে দিয়েছে বোমা মেরে । মজার ব্যাপার কী জানো ? আমি যে লাখ-লাখ কাফের-নাস্তিকদের দাস বানিয়ে তাড়িয়ে এনেছিলুম, তাদের আস্তিকান্তরিত করার পর তাদের নাতি আর নাতির নাতিরাই গোঁড়া তালিবানি আস্তিক হয়ে নাস্তিকদের ফিনিশ করছে ; ব্যাটারা জানেই না যে ওদের দাদু আর তার দাদুকে দাস বানিয়ে এনেছিলুম ।

কফিহাউসের যক্ষ : আপনারা তো স্নান করতেন না । আপনাদের মাথায় উকুন আর গায়ে কি চামউকুন হতো?

চেঙ্গিজ খান : হতো হতো । সাধারণত যুদ্ধে বেরোবার সময়ে একজন বউকে সঙ্গে নিয়ে যেতুম । তাছাড়া, অনেকগুলো বউ ছিল, যুদ্ধ সেরে ফিরে, তাদের দিয়ে বাছাতুম । শক্তিশালী মোঙ্গোল পুরুষদের জন্য যেমন নিয়ম  ছিল, আমার অনেক স্ত্রী আর রাখেল ছিল। আমি  যে সাম্রাজ্য   জয় করতুম সেখান থেকে বউ আর রাখেল পেতুম, এই মেয়েরা সাধারণত রাজকন্যা বা রানী হতো, যাদের  বন্দী করা হয়েছিল বা উপহার হিসাবে আমাকে দেয়া হয়েছিল । সবসুদ্দু কতোজন বউ আর রাখেল ছিল বলতে পারব না । তবে, আমার সাতজন প্রধান বউ ছিল, বুঝলি । বোরতে, ইয়েসুজেন, ইয়েসুই, খুলান, মোগে, জুয়েরবিয়েসু আর ইবাকা বেকি । আমার প্রথম বউ বোরতেকে মেরকিটরা তুলে নিয়ে গিয়েছিল । আমি বোরতেকে ছাড়িয়ে এনেছিলুম আর তারপর ঠিক করি সারা জগত জুড়ে যুদ্ধ করব আর যখনই পাবো অন্যের বউকে তুলে আনবো । তারপর থেকে প্রতিটি বউ আর রাখেলের তাঁবুতে আমি পালোয়ান পাহারাদার মোতায়েন করা আরম্ভ করেছিলুম । লোকে আজও বলে চেঙ্গিস খান ছিলেন আপাদমস্তক একজন ধর্ম নিরপেক্ষ মানুষ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : খোজা পাহারাদার ?

চেঙ্গিজ খান : আরে, না রে । খোজা তো তুর্কির সুলতানরা রাখতো । খোজারা ক্ষমতাশীল মানুষের হয়ে দাস হিসেবে কাজ করে , আমার তাদের দরকার হয়নি। তুর্কির সুলতানরা হারেমের পাহারাদারের  কাজে খোজাদের রাখতো । এছাড়াও কর্মচারী, যোদ্ধা, গৃহস্থালির কাজ, সংগীতশিল্পী, সরকারি কাজকর্ম, ব্যক্তিগত রক্ষী ও চাকর হিসেবে খোজাদের ব্যবহার করা হতো। সুলতানরা ভাবতো খোজারা বেগমদের কাজে লাগবে না । বেগমরা কি অতো বোকা নাকি । হারেমে অতো বউ আর রাখেল রাখলে তাদের অরগ্যাজম যোগাবার কাজটা তো খোজারাই করতো। 

ল্যাঙড়া তৈমুর : আমিও খোজা রাখিনি । কী দরকার ! বউ, দাসী-বাঁদি আর রাখেলদেরও তো সাধ আহ্লাদ আছে ।

চেঙ্গিজ খান : ভালো করতিস ।

কফিহাউসের যক্ষ : ভাগ্যিস আপনাদের দেশে জামাই ষষ্ঠীর ব্যাপার ছিল না । 

ল্যাঙড়া তৈমুর : আমি মাথায় হেলমেট পরতুম । এতো লড়াই করতে হতো যে চুলকোবার সময় পেতুম না। চামউকুন থেকে রেহাই পাবার জন্যে দেশে ফিরে গায়ে ঘোড়ার চর্বি মাখতুম । আমার তেত্রিশজন বউ আর রক্ষিতা ছিল  । আমিও কোনও রাজ্য জিতলে সেখানকার রানি আর রাজকন্যাকে বিয়ে করে আনতুম কিংবা রক্ষিতা করতুম । আমার প্রধান বউরা ছিল তুরমিশ আগা, ওলজায় তুরখান আগা, সরায় মুলক খানুম, ইসলাম আগা, উলুস আগা, দিলশাদ আগা, তউমান আগা, চুলপান আগা, তুকাল খানুম, তোলুন আগা, মেংলি আগা, তোঘে তুরখান আগা, তুঘদি বে আগা, সুলতান আরে আগা, মালিকানশা আগা, খন্দ মালিক আগা, সুলতান আগা । রক্ষিতা বা উপপত্নী ছিল দৌলত তারখান আগা, বুরহান আগা, জানি বেগ আগা, তিনি বেগ আগা, দুরসুলতান আগা, মুনদুজ আগা, বখত সুলতান আগা, নওরুজ আগা, জাহান বখত আগা, নিগার আগা, রুহপরওয়ার আগা, দেলবেগ আগা, দিলশাদ আগা, মুরাদ বেগ আগা, পিরুজবখত আগা, খোশকেলদি আগা, দিলখোশ আগা, বরাতবে আগা, সেভিঞ্চ মালিক আগা, আরজু বে আগা, ইয়াদগার সুলতান আগা, খুদাদাদ আগা, বখত নিগার আগা, কুতলু বে আগা আর আরেকজন নিগার আগা । সবাইকে মনে রেখেছি, তোমার মতন ভুলে যাইনি । রোজ রাতে ওরা লটারি করে ঠিক করতো কে আমার সঙ্গে শোবে ।

চেঙ্গিজ খান : খোঁড়া হয়ে অতো বউ কেমন করে রাখতিস ? তোদের আস্তিকদের তো চারটে মোটে বউ অ্যালাউড।  আমি নাস্তিক মানুষ অমন নিয়ম-কানুনের হ্যাপা ছিল না । তোদের চারটে ছাড়া বাদবাকি সবাই মুত্তা ! আজকাল শুনি পট্রোডলারের জোরে সেক্স-স্টার্ভড বুড়োরা আল-হিন্দের হায়দ্রাবাদ থেকে মুত্তা কিনে নিয়ে যায় । নিজামের অনেক রাখেল বাঁদি দাসী ছিলো তো, এখন গরিব হয়ে কীই বা করবে, তাদের মেয়েদের মুত্তা করে পাঠায় !

কফিহাউসের যক্ষ : মুত্তা কী ব্যাপার স্যার ?

ল্যাঙড়া তৈমুর : মুত্তা মানে যে বউ নিকা করা নয় । শব্দটা আরবি ।  । আরবি ‘মুত্তা’ শব্দের মানে হলো আনন্দ। ফূর্তির জন্য এই বিয়ে। আল-হিন্দে সেই কবে থেকে বাদশা, সুলতান আর নবাবদের মধ্যে মুত্তা প্রথা চলে আসছে অথচ তুমি জানো না ? কেমন তুমি কফিহাউসের যক্ষ ! অবশ্য মুত্তার নিয়মনীতি  শিয়াদের মধ্যেই বেশি প্রচলিত ছিল। মোগলরা যদিও সুন্নি, তবে চারের বেশি বেগম ছিল তাদেরও। সেই বাবরের আমল থেকেই। বাবরকে বলেছি আসতে, ওদের কাছেই ডিটেইলড স্টোরি শুনতে পাবে । বাবরের বেগমের সংখ্যা দশ । এদের মধ্যে ছয়জনই ছিল ‘মুত্তা’ বেগম। হুমায়ুনের নিকা আর মুত্তা মিলিয়ে বেগম সংখ্যা নয়। আকবরের আট।

চেঙ্গিজ খান : তাই তো তোকে বলি, আমি একজন আলাদা বিশ্বজয়ী খান । আমিও একটা মজার কথা বলি তোকে। মিশরের লোকেরা মনে করে ওরা খাঁটি আস্তিক । ওরা যে প্রাচীন ফ্যারাও রাজত্বের মানুষ, গ্রিক, ইতালিয়, আরব, ইরানি, তুর্কিদের মিশেল, তা ভুলে যায় । কতোরকমের নাস্তিকতার ইতিহাস বয়ে বেড়াচ্ছে ভুলে যায় । এখন তো নাস্তিক ফ্যারাওদের মমি আর পিরামিড দেখিয়ে ভালো রোজগারপাতি করছে ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : জানি তো, চারজন বউ রাখতে হয় আর বাদবাকি মুত্তা । বুঝলে দাদা, মুত্তা হলেও, ওরা গর্ভবতী হয়ে যেতো । সে এক ফ্যাচাঙ । মুত্তাদের বাচ্চা হওয়া নিষেধ । আমি  তৈমুর বিন তারাগাই বারলাস বলে কেউ বড়ো একটা আপত্তি করতো না ।

কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র : কিছু মনে করবেন না  ; আমিও আফগানিস্তানের জামাই, গুরকানি । ল্যাঙড়ামিয়াঁ ইনভাইট করেছিল আসার জন্য । আমি আপনাদের মতোই বদনাম। আমার ছেলে দুর্যোধনের কাজকর্মের জন্যে লোকে আমাকে দোষ দেয় । সৎ ভাই পান্ডু যাবার পর দিল্লিতে রাজত্ব করতুম । কিন্তু আমি সত্যিকারের  জন্মান্ধ, ধর্মান্ধ নই । কান্দাহারের রাজকুমারী গান্ধারীকে বিয়ে করেছিলুম । আমার একশো ছেলে আর এক মেয়ে । এছাড়া এক বৈশ্য দাসীর সঙ্গে শুয়েছিলুম বলে তার পেটে যুযুৎসু নামে আমার  এক ছেলে জন্মেছিল । আমি আফগানিস্তান আক্রমণ করে  রাজকন্যা গান্ধারীকে বিয়ে করেছিলুম । আমি জন্মান্ধ ছিলুম বলে গান্ধারী নিজের চোখ ঢেকে রাখত। গান্ধারী যখন প্রেগন্যান্ট তখন আমার সেবা করত ওই বৈশ্য চাকরানি ।  তার ছোঁয়ায় আমার সেক্স করার ইচ্ছে চাগিয়ে ওঠেছিল আর তাকে  জড়িয়ে ধরে সেক্স করি । আমি তো অন্ধ । চাকরানি  হেল্প করেছিল। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যুযুৎসু ছাড়া  অন্য সব ছেলেরা পটল তুলেছিল । আমার একশো  ছেলে আমার দোষেই  গুণ্ডামি-জোরজুলুম করে বেড়াতো । শুনেছি তাদের বংশধররা পশ্চিমবাংলা নামে একটা এলাকায় সেই একই বজ্জাতি চালিয়ে যাচ্ছে । ভোট আসলেই তারা বোমা-বন্দুক ছোরা-ছুরি নিয়ে যে যার ঘর থেকে পিলপিল করে বেরিয়ে আসে।

চেঙ্গিজ খান : কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র, জন্মান্ধ হলে ক্ষতি নেই । ধর্মান্ধ হলে সর্বনাশ । আমি ধর্মান্ধ ছিলুম না, প্রচুর যুদ্ধ করেছি জীবনে । এই ল্যাঙড়া তৈমুর ধর্মান্ধ ছিল বলেই জন্মান্ধ । আমাদের ধর্ম ছিল আকাশ । যে মানুষই আকাশের তলায় থাকে সে আমাদের ধর্মাবলম্বী বলে মনে করি । তাই কারোর ধর্ম পালটাবার দরকার হয়নি কখনও ।

কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র :  বৈশ্যা চাকরানি সৌবালির ছেলে যুযুৎসু আমার অন্য ছেলেদের মতন বজ্জাত ছিল না । ন্যায়পরায়ণ আর ধর্মনিষ্ঠ বলে ও কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে দুর্যোধনের পক্ষ ছেড়ে পাণ্ডবপক্ষে চলে গিয়েছিল ।  পাণ্ডবরা অভিমন্যুর ছেলে পরীক্ষিৎ-কে সিংহাসনে বসায় আর যুযুৎসু’র ওপর রাজ্যের ভার দিয়ে চার ভাই ওদের বউকে নিয়ে মহাপ্রস্থানে চলে গিয়েছিল । মহাপ্রস্হানের রাস্তাটা  এখন চিনের দখলে, কে জানে কেমন আছে ওরা সবাই। 

ঢ্যাঙা তুগলক : আমদের ধর্মে অন্ধ হলে রাজা হওয়া নিষিদ্ধ । কাউকে টাইট দিতে হলে প্রথমেই তাকে অন্ধ করে দেবার রেওয়াজ ।

গজনির মামুদ : ল্যাঙড়ামিয়াঁ ডেকেছিলেন বলে আমিও এলুম । আমার নাম ইয়ামিনউদ্দৌলা আবুল কাসিম মাহমুদ ইবনে সবুক্তগিন,  সাধারণভাবে মাহমুদ গজনভি, বা সুলতান মাহমুদ আর মাহমুদে জাবুলি নামে লোকে এক ডাকে চেনে । আমার আব্বাহুজুর আবু মনসুর সবুক্তগিন ছিলেন তুর্কিদের সামরিক দাস ; নিজের চেষ্টায় সুলতান হয়েছিলুম ।  আমি ছিলুম  গজনভি সাম্রাজ্যের  শাসক । গান্ধার নামটা আমিই লোপাট করে দিয়েছি । হাঃ হাঃ । তালিবানরা ছবি আঁকা অ্যালাউ করে না, অথচ আফগানিস্তান আমার ছবি দিয়ে ডাকটিকিট বের করেছে । অ্যানিওয়ে, আই ফিল ইলেটেড । 

খোকা তুগলক : মুলতানের গপ্পোটা বলো না আঙ্কেল, পিলিজ ।

গজনির মামুদ : মুলতানে রাজা জয়পাল আর তার ছেলে আনন্দ পাল আমার সঙ্গে যুদ্ধ করলেও আমার দুর্বার গতির সৈন্যদলের কাছে ওদের সৈন্যদল খড়কুটোর মতো ভেসে যায়। ওই রাজপুতদের হাতি-বাহিনীর সৈন্যদল মূলত আমাদের ঘোড়ায় চড়া সৈন্যদের গতির কাছেই হেরে যায়, কারণ আমাদের সৈন্যদলের অপ্রতিরোধ্য গতি।  জয়পালের কাছ থেকে ২,৫০,০০০ দিনার আর ৫০টা হাতি আদায় করেছিলুম, বুঝলেন । সোমনাথ মন্দিরে আক্রমণের কারণে এখনো মুসলিমদের কাছে আমি একজন ইসলাম প্রচারক বীর যোদ্ধা, ইনটারনেটে সার্চ করলে জানতে পারবেন । পাকিস্তানের জাতীয় পাঠ্যক্রমে আমার ভারত আক্রমণকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে পড়ানো হয়, ওদের তো নিজেদের ইতিহাস নেই । কীই বা করতুম, বলুন ? আমাকে শেখানো হয়েছিল যে নাস্তিক মূর্তিপূজকদের বিনাশ করলে জান্নাতুল ফিরদৌসে যাবো। এখন অবশ্য আমি রয়েছি জাহান্নমে, সেখানে শয়তান আমাকে ঘুমোতে দেয় না, কানে বাজপাখির পালক দিয়ে সুড়সিড়ি দেয় ।

কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র : থ্যাঙ্কইউ জনাব চেঙ্গিজ । আমি চলি । রকেটের জন্যে বলে রেখেছি ইসরোকে । পৃথিবীর চারিধারে এতো মরা-রকেটের জঞ্জাল পাক খাচ্ছে যে স্বর্গে যাতায়াতও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে । আফগানিস্তান থেকে করিৎকর্মা যুবক-যুবতীরা ইউরোপে পালাচ্ছে, আপনিও কেটে পড়তে পারতেন ।

গজনির মামুদ : গেলে তো ভালোই হতো ; বুড়ো হয়ে গেছি, আর পারি না । একটু দাঁড়ান  মহারাজা ধৃতরাষ্ট্রদেব  । আমাকে প্যারাশুট-ক্যাপসুলে গজনিতে ড্রপ করে দেবেন । ওখানেই আমার কবর, সোমনাথ মন্দির থেকে এনে চন্দনকাঠের দরোজা বসিয়েছিলুম সমাধিতে ঢোকার জন্য, তালিবানরা পালটে সাধারণ দরোজা লাগিয়ে দিয়েছে, কাফেরদের দরোজা নাকি চলবে না, দরোজাটা নাস্তিক । ঠিক সময়ে না পৌঁছোলে তালিবানরা সমাধিতে তালা মেরে দিতে পারে । জানেন তো, কিছুদিন আগে গজনিতে ভীষণ ভূমিকম্প হয়েছিল। যার ফলে আমার কবর ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছিল । আল-হিন্দের লোকেরা বলছিল পাপের শাস্তি।  আমার পর আর আগেও তো কতোজন আল-হিন্দে লুটপাট করতে এসেছিল । নয়কি ? বলুন !

কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র : হ্যাঁ, অনেকে এসেছিল, নিয়েও গেছে ঘোড়ার পিঠে, খচ্চরের পিঠে, হাতির পিঠে, মানুষের পিঠে, তাই তো পথটার নাম হিন্দু কুশ, মানে হিন্দুর কাটা মাথা । আপনি তো সতেরোবার সোমনাথ মন্দিরে হামলা করেছিলেন, দুই মন সোনা আর মণিমুক্ত নিয়ে গিয়েছিলেন । তবু আপনার দেশে, আই মিন আমার শশুরবাড়ির দেশে, গাঁয়ের মানুষ মাটির বাড়িতে থাকে কেন, কেমন যেন গরিব-গরিব মনে হয় ?

গজনির মামুদ : আসলে আমাদের দেশটা তখন ইরানের ভেতরে ছিল । সব মালকড়ি ওরাই মেরে দিয়েছে । নাদির শাহ ময়ূর সিংহাসন নিয়ে গেল কতো সোনাদানার সঙ্গে, এমনই আকখুটে যে সামলে রাখতে পারেনি। সব মণিমুক্ত খুলে-খুলে বেচে দিয়েছে । আমরা অন্য দেশ দখল করতে শিখেছিলুম গ্রিকদের থেকে । জানেন তো গ্রিকো-ইন্ডিয়ান হেলেনীয় রাজ্য ছিল, এখনকার  আফগানিস্তান জুড়ে,  আর ভারতীয় উপমহাদেশের পাঞ্জাবের সীমান্তবর্তী কিছু অঞ্চল, মানে এখনকার পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চল  পর্যন্ত,  যা যিশুর জন্মের পর, শেষ দুই শতাব্দী জুড়ে  ত্রিশেরও বেশি  গ্রিক  রাজার শাসনে ছিল । তাছাড়া নাস্তিক বা কাফেরদের দেশ বলতে আপনাদের এই একটাই দেশ ছিল আক্রমণ করার মতন । আফ্রিকার নাস্তিকদের আমরা হাজার বছর আগেই আস্তিকান্তরিত করেছিলুম ; যে কটা ট্রাইব বেঁচে ছিল তাদের খ্রিস্টান্তরিত করে ফেললে ইউরোপের ক্যাথলিকরা ।

কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র : আমি  তারও আগের রাজাধিরাজ । তবে আপনাদের দেশের লোকজন আর মেয়েদের দেখে সত্যিই মনে হয় যে গ্রিকরা নিজেদের বীর্য বিলিয়ে গেছে আপনাদের দেশে । ওদের মতন যেমন যুদ্ধবাজ আপনারা, তেমনই সুন্দরী আপনাদের মেয়ে-বউরা । আমরা অমন সুন্দর দেখতে ছিলুম না ; রাজা রবি বর্মা নামে একজন আঁকিয়ে আমাদের সুন্দর-সুন্দরী তৈরি করে দিয়ে গেছে ।

চেঙ্গিজ খান : রাজা রবি বর্মা কে ? আমি তো ওনার রাজ্যে লুটপাট চালাতে যাইনি । কোথায় ওনার দেশ ?

কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র : রাজা রবি বর্মা ওরফে  কিলিমানোর কইল থাম্পুরান ছিলেন আল-হিন্দের বিখ্যাত  চিত্রশিল্পী। আল-হিন্দের ইতিহাসের নানাক্ষেত্রে বিচরণের জন্য তাঁকে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পী হিসেবে গণ্য করা হয়। আল-হিন্দের ইতিহাস ধরে রেখে উনি ইউরোপীয় ধাঁচে ছবি এঁকে ভারতীয় চিত্রশিল্প জগতে এক অভূতপূর্ব রদবদল এনেছিলেন। এছাড়া উনি লিথোগ্রাফিতে অনেক দক্ষ ছিলেন  যা তাঁকে আরো বেশি সুপরিচিত করে তোলে। তাঁর আঁকা ছবি দেখে  পরে অনেকেই  অনুপ্রাণিত হয়েছিল। এছাড়া হিন্দু দেব-দেবী আর পুরাণের ওপর ওনার সৃষ্টিকর্মগুলো ওনাকে আরো বেশি বিখ্যাত করেছে।  রাজা রবি বর্মা ত্রিবাঙ্কোরের রাজ ঘরানার সদস্য ছিলেন। এখন ওনার ছবির দাম ময়ূর সিংহাসনের দামের কাছাকাছি । আল-হিন্দের নানা ভাষার ক্যালেণ্ডারে আপনি ওনার আঁকা সুন্দরীদের দেখতে পাবেন । তবে কেউ-কেউ গোলমালও করে দিচ্ছে আজকাল । শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে জার্সি গাই বা হলস্টিন ফ্রিজিয়ান গোরু এঁকে ফেলছে ।

চেঙ্গিজ খান : রাজা রবি বর্মার নাম আর ওনার দেশের নাম শুনিনি আগে । আমি যদিও নাস্তিক মালাউন, আমাদের দ্বিতীয়বার জন্ম হয় না বলেই শুনেছি মা-বাবার কাছে , নয়তো আরেকবার জন্ম নিয়ে ওনাকে দিয়ে ছবি আঁকিয়ে আমার চোখ দুটো বড়ো আর নাকটা উঁচু করিয়ে নিতুম । তখনকার দিনে প্লাসটিক সার্জারি থাকলে দারুন হতো, কী বলেন ! আমি বেঁচে থাকতে কাউকে আমার ছবি আঁকতে দিইনি, কয়েনের ওপরেও নয়, মূর্তি গড়তে দিইনি। এখন মোঙ্গোলিয়া জুড়ে আমার মূর্তি বসানো হয়েছে । কোনো মানে হয়? নাক চেপটা, ছোটো চোখ, মোঙ্গোল চেহারার মূর্তি বানিয়ে আমার নামের লেবেল লাগানো হয়েছে । জাস্ট ডিসগাস্টিঙ ।

গজনির মামুদ : আমাদের দেশে গ্রিসের মিনানডার নামে একজন রাজা ছিল, সে নিজে বৌদ্ধধর্ম  নিয়ে সবাইকে বৌদ্ধ করে তুলেছিল । অনেকে মিনানডারকে  মেনান্দ্রোস নামে চেনে,  যিনি পালি বইগুলোতে মিলিন্দ নামে পরিচিত, উনি যিশুখ্রিস্ট  জন্মাবার একশো পঞ্চাশ বছর আগে রাজত্ব করতেন ; পারোপামিসাদাই, আরাখোশিয়া আর পাঞ্জাব এলাকা শাসন করেন। তাঁর রাজ্য পশ্চিমে কাবুল নদী উপত্যকা থেকে পুবদিকে রাবি নদী পর্য্যন্ত আর উত্তরে সোয়াট নদী উপত্যকা থেকে দক্ষিণে আরাখোশিয়া পর্য্যন্ত ছড়ানো ছিল । পূর্বদিকে গাঙ্গেয় নদী উপত্যকা বরাবর পাটলিপুত্র পর্য্যন্ত সেনা অভিযান করেছিলেন । গ্রিক রক্ত আমাদের শিরায় ঢুকে মাথা গোলমাল করে দিয়েছে। তাই যুদ্ধ, নেশাখুরি আর মাগিবাজি করার জন্য আজও আমার দেশের পাবলিক ছোঁক-ছোঁক করে। অবশ্য এই ব্যাপারে ইরান, তুর্কি, রাশিয়া, আমেরিকা, আরব হেল্প করেছে নানা সময়ে । এখন পাকিস্তান হেল্প করে। 

কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র : আপনার শহর তো মুইজউদ্দিন মুহাম্মাদ ঘোরি দখল করে নিয়েছিল, ওনার আব্বাকে খুনের বদলা নেবার জন্যে । তারপর আল-হিন্দে জমিয়ে বসে গেল । আহমেদশাহ আবদালিও আটবার এসে লুটপাট চালিয়েছিল । ওরাও অনেক মালকড়ি নিয়ে গিয়েছিল, তবু আপনার লোকেরা আজও আফিম চাষ করে রোজগারপাতি করে কেন ?

গজনির মামুদ : ঠিকই বলেছেন আপনি । মুইজউদ্দিন গজনি শহর দখল করে নেয়। আসলে উত্তর ভারতে অভিযানের জন্য এই শহরকে স্প্রিঙবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করেছিল। এ সময়ে পশ্চিম এশিয়ায় বৃহত্তর খোরাসানের আধিপত্য নিয়ে খোয়ারিজমীয় সাম্রাজ্যের সাথে প্রতিযোগীতায় ও ওর ভাই গিয়াসউদ্দিনকে সাহায্য করেছিল। তারপর হামিদ লোদি রাজবংশের কাছ থেকে মুইজউদ্দিন মুলতান জয় করে নিলো । হামিদ লোদি পশতু ছিল, তবে ইসমাইলি শিয়াদের সাথে ওর সংযোগের কারণে মুরতাদ বা নাস্তিক হবার অভিযোগ উঠতো।  এছাড়া ও  লাহোরের গজনভি রাজ্যকে নিজের অধিকারে নিয়ে আসে। তা ছিল ওর সর্বশেষ পারস্যায়িত প্রতিপক্ষ।  গিয়াসউদ্দিন মারা যাবার পর মুইজউদ্দিন ঘুরি ওদের সাম্রাজ্যের শাসক ছিল । তার কবজার এলাকাগুলোর মধ্যে ছিল আফগানিস্তান, ইরান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান, পাকিস্তান, আর আল-হিন্দ। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো যে ব্যাটারা বেশিদিন টেকেনি ।

কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র : এতো কাণ্ড করার পরও আফিম চাষ, চরস বিক্রি, বউদের ওপর কড়াকড়ি কেন?

গজনির মামুদ : কী আর বলব,  মহারাজা ধৃতরাষ্ট্রদেব  । আফিম খাইয়ে পাবলিককে ভুলিয়ে রাখলে শান্তিতে শাসন করা যায় । জনাব মার্কস বলেছেন ধর্ম হলো আফিম, তা এই কারণেই । মুহাম্মদ ঘোরি আমার চেয়েও কট্টর ছিল। বৌদ্ধধর্মকে হাপিশ করার জন্যে সবাইকে আস্তিকান্তরিত করে ফেললে । আল-হিন্দে নিয়ে এলো আফিম । বাঙালিরা আলুপোস্তর তরকারি আর সর্ষেপোস্তর এতো ভক্ত অথচ তা যে আপনার শশুরবাড়ির লোকেদের অবদান তা ভুলে যায় । আমাদের পোস্তগাছের চাষ করতে শিখিয়েছিল গ্রিকরা । আলেকজাণ্ডার যতো দেশ জয় করেছিল সব দেশে পোস্তদানা দিয়ে গেছে । যাকগে চলুন, গ্যাঁজানোও আফিমের মতন নেশা । দেখছেন তো কফিহাউসে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গ্যাঁজাচ্ছে ছেলে-মেয়েরা ।

কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র : চলুন । আমি জন্মান্ধ আর আপনি ধর্মান্ধ । আজকাল তো ধর্মান্ধের সংখ্যা দিন-কে-দিন বেড়েই চলেছে ।  বিরোধিদের নিকেশ করার যে-কোনও উপায়কেই ধর্মান্ধতা বলতে হবে, বুঝলেন  গজনিমিয়াঁ ।  আমার ছেলেরা নিজেদের খুড়তুতো ভাইদের মনে করলো বিরোধী আর হিংসেতে নিজেদের মধ্যে দাঙ্গা বাধিয়ে ফেলেছিল। একই ব্যাপার করেছিল পাক সার জমিন সাদ বাদ গাইয়েরা । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টুকুতে ওই গাইয়েদের খুনিরা প্ল্যান করে বাংলাদেশের জ্ঞানী-গুণী আর মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের খুন করেছিল ।  স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে ওই গানের খুনিবাহিনী যখন বুঝতে শুরু করল যে তাদের পক্ষে যুদ্ধে জেতা সম্ভব নয়, তখন তারা নতুন দেশটাকে সাংস্কৃতিক, সামাজিক আর শিক্ষাগত দিক থেকে দুর্বল আর পঙ্গু করে দেয়ার জন্য প্যাঁচ কষতে থাকে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী শীতের রাতে পাক সার জমিন সাদ বাদ গাইয়েরা তাদের দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর আর আল শামস খুনিদের মদতে দেশের শ্রেষ্ঠ লোকেদের  বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মম নির্যাতনের পর খুন করে। বন্দী অবস্থায় বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন জায়গায় খুন  করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের ক্ষত-বিক্ষত আর বিকৃত লাশ রায়েরবাজার আর মিরপুরে পাওয়া গিয়েছিল। অনেকের লাশ শনাক্তও করা যায়নি, পাওয়াও যায়নি বহু লাশ। 

গজনির মামুদ : আসলে পাক-সাদ-বাদের উর্দু বলিয়েরা মনে করতো, এখনও করে,যে, বাঙালিরা নিম্নশ্রেণীর মানুষ। ওদের গ্রস ডোমেস্টিক প্রডাক্ট তো বাঙালিদের তুলনায় তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে । আমারিকার আর চিনের কাছে ফিবছর ভিক্ষা চায় বেচারারা । আপনাদের দেশভাগের সময়ে পাকিস্তানিরা ভাবতো যে কলমা পড়িয়ে নুনুর খোসা ছাড়িয়ে দিলেই মানুষ মুসলমান হয়ে যায় । ধর্ম অতো সহজ ব্যাপার নাকি । আজকাল তো কাওয়ালি-গায়কদের রঙচঙে পোশাক পরে আস্তিকান্তরিতরা ধর্মের উপদেশ বিলোয় । যাউকগিয়া, চলুন ।

শেষ তুগলক : রাজাকর আবার কী ?

ল্যাঙড়া তৈমুর :  আল-হিন্দে, রাজাকার হলো একটা বাংলা গালি যা প্রধানত দেশদ্রোহীদের দেওয়া হয় । আল বদর হলো  বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে যারা সহায়তা করতো, সেই আধা-সামরিক বাহিনী। তাদের দলটাকে গড়া হয়েছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রকে অখণ্ড রাখার উদ্দেশ্যে জনমত গঠন করার জন্য। পূর্বাঞ্চলীয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল নিয়াজীর পৃষ্ঠপোষকতায় এই বাহিনী গঠিত হয়েছিল। ইসলামিক ইতিহাসের বদর যুদ্ধকে আদর্শ করে এই বাহিনী গঠিত হলেও এদের আসল কাজ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া । সাবেক পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম জামায়াতে ইসলামীর প্রচারযন্ত্র দৈনিক সংগ্রাম এর মাধ্যমে দেশপ্রেমীদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ ও যুদ্ধের ডাক দিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠন করে, সে বাহিনীর আমীরের পদ নিয়ে নিলে, সেসময়ের ছাত্রসংঘের নেতা, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, আবদুল কাদের মোল্লার নেতৃত্বে আল শামস আর আল বদর বাহিনী গঠন করেছিল।  সাবেক পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রসংঘের আমীর আর পরে বাংলাদেশের মন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী আল বদর আর আল শামস বাহিনীর আমীরের পদ নিয়েছিল,  আর সারা বাংলাদেশে প্রচারণা, সামরিক বাহিনীর সাথে যোগাযোগের দায়িত্ব পালন করেছিল। ঢাকা নগর ছাত্রসংঘের আমীর আর পরবর্তীকালে বাংলাদেশের মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদও এসব বাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছিল। আবদুল কাদের মোল্লা সামরিক জিজ্ঞাসাবাদ আর মুক্তিযোদ্ধাদের আঙুল কাটার দায়িত্বে  ছিল। 

চেঙ্গিজ খান : ছি ছি ছি ছি । নিজের লোকেদের মেরে ফেলার প্যাঁচ কষেছিল ব্যাটারা ?  আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির নাম শুনেছি বটে । লোকটা তো   ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর  লেফট্যানেন্ট জেনারেল। পূর্ব পাকিস্তানে  শেষ গভর্নর আর সামরিক আইন প্রশাসক এবং  পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক হাই কমান্ডের সর্বশেষ কমান্ডার। নিয়াজি আর রিয়ার এডমিরাল মুহাম্মদ শরীফ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধর সময়ে পূর্বাঞ্চলে সেনাদের দায়িত্বে ছিল। আত্মসমর্পণের জন্য ওকে পাকিস্তানে “বাংলার শেয়াল” বলা হয়। ওর সামরিক পদক আর সম্মানও কেড়ে নেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে নিয়াজি ওর পাঁচ ডিভিশন সেনা নিয়ে মুক্তি বাহিনী আর ভারতীয় সেনাবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। যুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত থাকার জন্য ওকে অভিযুক্ত করা হয়। ব্যাটা আছে এখন কোথায় ? মুখ লুকিয়ে বাড়িতে বসে থাকে বোধহয় ? 

গজনির মামুদ : নিয়াজি তো গো হারান হেরে আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেছিল ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : দলিলটা তোর কাছে আছে ? আচ্ছা, পড়ে শোনা তো ।

গজনির মামুদ : পড়ছি, শোনো । “পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ, লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানের সকল সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণে সম্মত হলো। পাকিস্তানের সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী সহ সব আধা-সামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষেত্রে এই আত্মসমর্পণ প্রযোজ্য হবে। এই বাহিনীগুলো যে যেখানে আছে, সেখান থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কর্তৃত্বাধীন নিয়মিত সবচেয়ে নিকটস্থ সেনাদের কাছে অস্ত্র সমর্পণ ও আত্মসমর্পণ করবে। এই দলিল স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড লেফটেন্যান্ট-জেনারেল অরোরার নির্দেশের অধীন হবে। নির্দেশ না মানলে তা আত্মসমর্পণের শর্তের লঙ্ঘন বলে গণ্য হবে এবং তার প্রেক্ষিতে যুদ্ধের স্বীকৃত আইন ও রীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আত্মসমর্পণের শর্তাবলীর অর্থ অথবা ব্যাখ্যা নিয়ে কোনো সংশয় দেখা দিলে, লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত। লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আত্মসমর্পণকারী সেনাদের জেনেভা কনভেনশনের বিধি অনুযায়ী প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান দেওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করছেন এবং আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি সামরিক ও আধা-সামরিক ব্যক্তিদের নিরাপত্তা ও সুবিধার অঙ্গীকার করছেন। লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার অধীন বাহিনীগুলোর মাধ্যমে বিদেশি নাগরিক, সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও জন্মসূত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যক্তিদের সুরক্ষা দেওয়া হবে।”

চেঙ্গিজ খান : ধর্মের কল নাড়াতে গিয়েছিল ব্যাটারা, পড়েছে মুখ থুবড়ে । পাকিস্তানিদেরও দোষ । কেন গিয়েছিলি বাঙালিদের চটাতে । নিজেদের বিশুদ্ধ আর বাঙালিদের অশুদ্ধ ভাবতো । আরে তোদের গায়েও তো গ্রিক, তুর্কি, মোগোল, উজবেক, আফগান, ইরানি,  রক্তের মিশেল ; অনেকের পূর্বপুরুষ ছিল আল-হিন্দের নাস্তিক।

পাগলা তুগলক : হ্যাঁ, জনাবেআলা । পূর্ব পাকিস্তান আর নেই । এখন এলাকাটাকে আমরা বলি বাংলাদেশ । পাকিদের একটা গানও ছিল । আল-হিন্দের কিছু মানুষ মনে-মনে দুঃখ পায়, বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে গেছে বলে । পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের অবস্হা খুবই খারাপ ।  পাকিস্তানের করাচি আর তার আশপাশেই আটকে থাকা বাঙালিদের বাস। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই তারা সেখানে বসতি গড়েছিল। এরপর বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেলে, ওদের নাগরিকত্ব আটকে দেয় পাকিস্তান । করাচিতে ওদের জন্য তৈরি করা হয়েছে ক্যাম্প। সেখানে জঘন্য পরিস্থিতিতে বহু বাঙালি বাস করছে। আটকে-পড়া বাঙালিদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়টা প্রথম রিপোর্ট করে পাকিস্তানের সামা টিভি। তাতে জানানো হয় দেশটার নাগরিকত্ব যাচাইকরণ প্রোগ্রামের সংসদীয় কমিটি পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে আটকে পড়া বাঙালিদের বৈধ করার প্রস্তাব দিয়েছে। তবে বাঙালিদের বৈধ করার বিষয়টা সহজ নয়। কারণ এ জন্য পাকিস্তানের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করতে হবে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, পাকিস্তানে প্রায় তিরিশ লাখ বাঙালি আটকে থাকলেও তাদের মধ্যে পনেরো লাখ করাচি আর তার আশপাশে রয়েছে। বহু বছর সামরিক শাসনে থাকায় আটকে থাকা বাঙালিরা রাজনীতির শিকার হয়েছে। তাদের বেশ কয়েকবার নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা উঠলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। এ জন্য সেখানকার বাঙালিদের মধ্যে অসন্তোষও রয়েছে। করাচিতে প্রায় দেড়শো বাঙালি বস্তি রয়েছে। 

তোতলা তুগলক : আআআবার মুমুমুকে মুমুকে তততকককো ! বারন করেছি না ?

গজনির মামুদ : জানি, পাকিরা গানটাকে বলে কওমি তরানা । হুমায়ুন আজাদের উপন্যাসে পড়েছিলুম কবরের আরামে শুয়ে ।

কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র : কওমি তরানাটা বুঝতে পারি না, তবে গানটা আল-হিন্দের জলন্ধর শহরের কবি হাফিজ জলন্ধরির লেখা !  জনাব গজনির মামুদ, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ নামে একজন শায়র ধর্মান্ধদের নিয়ে লিখে গেছেন, শোনাচ্ছি আপনাকে :

যেমন রক্তের মধ্যে জন্ম নেয় সোনালি অসুখ

তারপর ফুটে ওঠে ত্বকে মাংসে বীভৎস ক্ষরতা।

জাতির শরীরে আজ তেম্নি দ্যাখো দুরারোগ্য ব্যাধি

ধর্মান্ধ পিশাচ আর পরকাল ব্যবসায়ি রূপে

ক্রমশঃ উঠছে ফুটে ক্ষয়রোগ, রোগেরপ্রকোপ

একদার অন্ধকারে ধর্ম এনে দিয়েছিল আলো,

আজ তার কংকালের হাড় আর পচা মাংসগুলো

ফেরি কোরে ফেরে কিছু স্বার্থাণ্বেষী ফাউল মানুষ-

সৃষ্টির অজানা অংশ পূর্ণ করে গালগল্প দিয়ে।

আফিম তবুও ভালো, ধর্ম সে তো হেমলক বিষ।

ধর্মান্ধের ধর্ম নেই, আছে লোভ, ঘৃণ্য চতুরতা,

মানুষের পৃথিবীকে শত খণ্ডে বিভক্ত করেছে

তারা টিকিয়ে রেখেছে শ্রেণীভেদ ঈশ্বরের নামে।

ঈশ্বরের নামে তারা অনাচার করেছে জায়েজ।

হা অন্ধতা! হা মুর্খামি! কতদূর কোথায় ঈশ্বর!

অজানা শক্তির নামে হত্যাযজ্ঞ কতো রক্তপাত,

কত যে নির্মম ঝড় বয়ে গেল হাজার বছরে!

কোন্ সেই বেহেস্তের হুর আর তহুরা শরাব?

অন্তহীন যৌনাচারে নিমজ্জিত অনন্ত সময়?

যার লোভে মানুষও হয়ে যায় পশুর অধম।

আর কোন দোজখ বা আছে এর চেয়ে ভয়াবহ

ক্ষুধার আগুন সে কি হাবিয়ার চেয়ে খুব কম?

সে কি রৌরবের চেয়ে নম্র কোন নরম আগুন?

ইহকাল ভুলে যারা পরকালে মত্ত হয়ে আছে

চলে যাক সব পরপারে বেহেস্তে তাদের

আমরা থাকবো এই পৃথিবীর মাটি জলে নীলে,

দ্বন্দ্বময় সভ্যতার গতিশীল স্রোতের ধারায়

আগামীর স্বপ্নে মুগ্ধ বুনে যাবো সমতার বীজ

গজনির মামুদ : দারুন লিখেছে । পাক সাদ বাদ আমিও বুঝি না । আমার ভাষা তো তুর্কি আর ফারসি, আল-হিন্দে অনেকে ফারসি জানতো। আপনাদের আল-হিন্দের পতৌদির নবাবও আফগানিস্তান থেকে এসেছিল । ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহায্যে  পাতৌদি রাজ্যটা গড়া হয়েছিল । মারাঠা সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ইংরেজদের যুদ্ধে ব্রিটিশদের সাহায্য করেছিল  বারাক উপজাতির আফগান  পশতুন । উনি হন প্রথম নবাব  ।  তাঁদের পূর্বপুরুষরা লোদি রাজবংশের সময়ে  আফগানিস্তান থেকে আল-হিন্দে চলে এসেছিল । অষ্টম নবাব ইফতিখার আলী খান পাতৌদি ইংল্যান্ড আর আল-হিন্দ দুদেশের হয়ে ক্রিকেট খেলতো । ওনার ছেলে শেষ নবাবও ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ছিল । এখন ওরা নবাব নয়, তবুও নিজেদের নবাব বলে বলে নবাবি করে, অঢেল পারিবারিক সম্পত্তির মালিক তো, তাই । মাঝে নিজেদের প্রাসাদকে হোটেল করেছিল, কিন্তু কে-ই বা যাবে অমন জায়গায় থাকতে, উদয়পুর-যোধপুর ছেড়ে ! চলুন, যাওয়া যাক এবার ।

রাগি তুগলক : সব ধর্মের কেন্দ্রেই কতকগুলি স্বকীয় প্রত্যয় বর্তমান, এবং প্রত্যেক বিশেষ বিশেষ ধর্মের অনুরাগীরা দাবি করে থাকেন যে তাদের ধর্মের স্বকীয় প্রত্যয়গুলি অপ্ৰতর্ক, অনপেক্ষ, সর্বজনীন এবং স্বয়ংসিদ্ধ। এই দাবির সমর্থনে কোন যুক্তি প্রমাণ মেলে না; যখন কেউ কেউ যুক্তি খাড়া করবার চেষ্টা করেন, তখন বিশ্লেষণ করলেই চোখে পড়ে তা যুক্তি নয়, যুক্ত্যাভাস মাত্র। তথ্যসংগ্রহ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, আবিষ্কার উদ্ভাবনের সূত্রে বিশ্বজগৎ এবং তার উপাদান ও পৃথিবীর অধিবাসী এবং তাদের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান গত তিন চার হাজার বছরের মধ্যে অনেক পরিবর্ধিত এবং পরিশ্রুত হয়েছে। কিন্তু এই বিশ্বজগতের আড়ালে তার স্রষ্টা, শাসক বা নিয়ামক হিসেবে ঈশ্বর আল্লা বা যিহােবা নামে যাকে বিভিন্ন ধর্মে কল্পনা করা হয়েছে তার সম্পর্কে ধর্মবিশ্বাসীদের প্রধান নির্ভর আপ্তবাক্য। শুধু বিনাবিচারে ঈশ্বর, আল্লা বা যিহােবর অস্তিত্ব মেনে নেওয়াই যথেষ্ট নয় ; তারই সঙ্গে ধার্মিকরা দাবি করেন যে বেদ অভ্রান্ত, বা ভগবদগীতা কৃষ্ণরূপী ঈশ্বরের নিজস্ব বাণী, বা যিহােবা মােজেসকে অথবা আল্লা মহম্মদকে বেছে নিয়েছিলেন তাঁর নির্দেশ প্রচারের জন্য, বা যীশু ঈশ্বরের একমাত্র পুত্র, বা চৈতন্য, রামকৃষ্ণ প্রমুখ ব্যক্তি এক-একজন অবতার-পুরুষ ইত্যাদি, ইত্যাদি। এমনকি ঈশ্বর, আল্লা অথবা যিহােবা জাতীয় কাউকে যিনি আত্মসমর্থনে টানেন নি, সেই বুদ্ধ এমন পূর্ণজ্ঞান অর্জন করেছেন বলে দাবি করা হয়ে থাকে যে জ্ঞান প্রশ্নাতীত এবং প্রমাণাতীত।

তোতলা তুগলক : তুতুতুইও গ্যাগ্যাগ্যান দিদিদিচ্ছিস ! 

ল্যাঙড়া তৈমুর : যথার্থ বলেছ জনাব রাগি তুগলক । আমি ধর্মান্ধ ছিলুম না । আক্রমণ করার জন্যে কারণ দরকার তো ? ধর্মকেই কারণ বানিয়েছিলুম । গজনির মামুদটা কিন্তু পাক্কা ধর্মান্ধ ছিল, যদিও আওরঙজেবের মতন জিজিয়া চাপিয়ে দেয়নি। আবদালিটা আবার হাজার-হাজার শিখ কোতল করে ওদের স্বর্ণমন্দির ভেঙে দিয়েছিল। চিনের উইঘুরদের ধর্ম পালটে দিয়েছিল । আসলে আবদালির দুটো কানের লতি কেটে দিয়েছিল নাদির শাহ । বেচারা কানকাটা । এখন চিন ওদের ধরে-ধরে আবার পুরোনো অবস্হায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে । যাকগে, হালাকু আবার কে ?

ঢ্যাঙা তুগলক : আল-হিন্দেও মসজিদ হাপিশ করে রামমন্দির  হচ্ছে । এখনকার পৃথিবীতে আদর্শগত  শূন্যতা বিরাজ করছে এবং পুরোনো পরিত্যক্ত সব সংস্কার-বিশ্বাসের ও ধর্মের পুনরুজ্জীবন ঘটছে। জনগণের জন্য মার্ক্সবাদ, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রকে অন্তঃসারশূন্য করে ফেলা হয়েছে। ফলে এগুলো আর আদর্শ হিসেবে কার্যকর নেই। এ জন্যই সৃষ্টি হয়েছে আদর্শগত শূন্যতা। আদর্শের অবলম্বন ছাড়া চলমান অপব্যবস্থা, দুর্নীতি, জুলুম-জবরদস্তি ও অসামাজিক কার্যকলাপের মধ্যে মানুষ অসহায় বোধ করছে। আদর্শগত শূন্যতার দিকে দৃষ্টি না দিয়ে কেবল ধর্মের পুনরুজ্জীবন দেখে  অনেকে উদ্বেগের সঙ্গে বলে আসছেন, ইতিহাসের চাকা পেছন দিকে ঘুরছে।

তোতলা তুগলক : নানানাও, এ ব্যাটাতাতাতার মুমুমুমুখে ককককথা ফুফুফুফুটছে ; রারারাজ্য সাসাসাসামলাতে পাপাপারে না !

চেঙ্গিজ খান : আরে ল্যাঙড়া, হালাকু জানিস না ? কেমন আস্তিক তুই ? হালাকু খান আমার ছেলে তোলুইয়ের ছেলে। ওর মা সোরগাগতানি বেকি ছিল একজন প্রভাবশালী কেরাইত শাহজাদি। সোরগাগতানি ছিল একজন নেস্টরিয়ান খ্রিষ্টান। হালাকু খানের বউ দকুজ খাতুন আর ওর ঘনিষ্ট বন্ধু  সেনাপতি কিতবুকাও খ্রিষ্টান ছিল। মারা যাবার আগে হালাকু খান বৌদ্ধ হয়ে গিয়েছিল । বেশ কয়েকটা বৌদ্ধ মন্দির তৈরি করিয়েছিল । হালাকু খানের  তিনটে ছেলে,  আবাকা খান, তাকুদার আর তারাকাই। আবাকা খান  ইরানের দ্বিতীয় ইলখান ছিল। এরপর তাকুদার  ইলখান হয়েছিল। তারাকাইয়ের ছেলে বাইদু তারপর ইলখান হয়েছিল । হালাকু খানের ছেলের বউ আবশ খাতুনও শিরাজ শাসনের দায়িত্ব পেয়েছিল । তাহলে বুঝতেই পারছিস যে খান মানেই একই ধরণের আস্তিকান্তরিত মানুষ নয় । আর কুবলাই খান হল  তলুই আর সরগাগতানি বেকির দ্বিতীয় ছেলে, মানে আমার নাতি । চীনের ইউয়ান রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেছিল আর প্রথম সম্রাট হিসাবে অনেককাল  চীন শাসন করেছিল। কুবলাই খানেরই ভাই হালাকু খান, পারস্য জয় করে  সেখানে ইলখানাত নামে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। বুঝলি তো ? খান মানেই আস্তিকান্তরিত নয় ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : আর বাবর ?

চেঙ্গিজ খান : মির্জা জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর । বাবরকে ইনভাইট করেছিস, অথচ বাবরকে চিনিস না ? তোকে সাবধান করে দিচ্ছি, বাবর কিন্তু হোমোসেস্কসুয়াল। নিজের অটোবায়োগ্রাফিতে সেকথা লিখে গেছে । চাঘতাই তুর্কি ভাষায় লেখা । নাতি আকবরের সময় চাঘাতাই তুর্কি ভাষা পড়বার লোক বেশি না থাকায় ও এই বইয়ের ফার্সি অনুবাদ করিয়েছিল।  আবদুর রহিম খান-এ খানান সেই কাজ  করে । এখনকার কফিহাউসের কবি-লেখকদের অটোবায়োগ্রাফিতে অমন স্বীকার করার সাহস নেই । বাবর  নামেই লোকে ওকে বেশি চেনে । বড্ডো গোঁড়া । কাফের, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান আর শিয়াদেরও ঘেন্না করে । জন্মেছিল উজবেকিস্তানে, আসলে উজবেক, অথচ গুলবদন বেগম বাবরকে বানিয়ে দিয়েছে তোর মোঙ্গোল বংশধর। লোকটা  আল-হিন্দ উপমহাদেশে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট। ও নাকি মায়ের দিক থেকে আমার বংশধর । ওর বাপের নাম মির্জা ওমর সাঈখ বেগ  । পানিপথের  যুদ্ধে দিল্লীর লোদি রাজবংশের সুলতান ইবরাহিম লোদিকে হারিয়ে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল । তার আগে বাবর লাহোর আক্রমণ করে শহরটাকে ফিনিশ করে দিয়েছিল । লোদি ব্যটা জানতে পারেনি ওরই কাকা বাবরকে ইনভাইট করেছিল আল-হিন্দ আক্রমণ করার জন্যে । বাবরের কাছে বন্দুক আর কামান ছিল ; লোদিকে চারিধার থেকে ঘিরে ওর সৈন্যদের কচুকাটা করে ফেললে, ইব্রাহিম লোদির মাথা আলাদা করে দিলে ধড় থেকে । বাবরের হুকুমে লোদির সব সেনার মুণ্ডু ধড় থেকে আলাদা করে মুণ্ডুর পাহাড় তৈরি করে ফেলেছিল।ও সেসব ঘটা করে লিখেছে নিজের আত্মজীবনীতে । 

ল্যাঙড়া তৈমুর : লোকটার এলেম আছে, বলতে হবে ।

চেঙ্গিজ খান :ফতেপুর সিক্রি আক্রমণ করে ও অটোবায়োগ্রাফিতে লিখেছে, ” শত্রুকে পরাজিত করার পর আমরা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করলাম এবং ব্যপকভাবে হত্যা করতে থাকলাম। আমাদের শিবির থেকে প্রায় দুই ক্রোশ দূরে ছিল তাদের শিবির। সেখানে পৌঁছে আমি, মুহাম্মদি ও আরও কয়েকজন সেনাপতিকে হুকুম দিলাম তাদের হত্যা করতে, কেটে দু’খানা করতে, যাতে তারা আবার একত্রিত হবার সুযোগ না পায়।”  বাবর হুকুম দিলে, কাছাকাছি একটা পাহাড়ের কাছে সমস্ত নরমুন্ডকে জড়ো করে  স্তম্ভ তৈরী করতে। অটোবায়োগ্রাফিতে নিজেই লিখেছে, সেই টিলার ওপর কাটা মুন্ডের একটি মিনার বানাতে হুকুম দিলাম। বিধর্মী  ও ধর্মত্যাগীদের অসংখ্য মৃত দেহ পথে ঘাটে ছড়িয়ে ছিল। এমন কি দূর দেশ আলোয়ার, মেওয়াট আর বায়না যাবার পথেও বহু মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেল।” ইব্রাহিম লোদি হেরে গেল বলে ওকে ধর্মত্যাগী বলা উচিত হয়নি । জিতে গিয়ে বাবর অনেক লোককে ভয় দেখিয়ে আস্তিকান্তরিত করেছিল — তাদের বংশধররা এখন নিজেদের মনে করে খাঁটি আস্তিক । ইতিহাসের খেলা দেখলে ভিরমি খাবি রে ।

কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র : আমাদের সময়কার যুদ্ধে এই ধরণের ব্যাপার-স্যাপার করা হতো না । আমরা নোটিস দিয়ে শুধু দিনের বেলা যুদ্ধ করতুম । 

চেঙ্গিজ খান : বাবর মারা যাবার পর ওর ছেলে  মির্জা হুমায়ুন সিংহাসন বসলো । আসলে  পানিপথের যুদ্ধে বাবর প্রথম কামানের ব্যবহার করে জিতে গিয়েছিল।  কিন্তু অন্য দেশে গিয়ে সিংহাসন বসবার কী দরকার, তুই বল আমাকে । আমি তো প্রধান মোঙ্গোল রাজনৈতিক-সামরিক নেতা ছিলুম । ইতিহাসও আমাকে একজন বিখ্যাত সেনাধ্যক্ষ আর সেনাপতি বলে। আমি আমার মোঙ্গোল গোষ্ঠীগুলোকে এককাট্টা করে মোঙ্গোল সাম্রাজ্যের  গোড়াপত্তন করেছিলুম। সেটাই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো সম্রাজ্য। জন্মেছিলুম ফালতু বোরজিগিন বংশে। তবে সাধারণ গোত্রপতি থেকে নিজের ক্যারদানিতে বিশাল সেনাবাহিনী তৈরি করেছিলুম। কিছু লোক লিখেছে যে আমি অতি নির্মম আর রক্তপিপাসু ছিলুম ।  মোঙ্গোলিয়ায় কিন্তু তোর চেয়ে বেশি মানুষ আমাকে বিশিষ্ট ব্যক্তি মনে করে, আমাকে মোঙ্গোল জাতির পিতা ঘোষণা করেছে ।

কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র : একবার যদি দাগ ইতিহাসে লেগে যায়, তা আর ছাড়ে না । দেখছেন তো আমাকে।

চেঙ্গিজ খান : বাবর মরেছিল ইব্রাহিম লোদির মায়ের দেয়া বিষে । একজন বাঙালি কবি নাকি লিখেছে যে অসুস্হ হুমায়ুনের খাটের চারিধারে, নিরম্বু পাক খেয়ে মরেছিল  বাবর ।

কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র : কবিরা অমন বানিয়ে-বানিয়ে লেখে, উনি গুলবদন বেগমের হুমায়ুননামা না পড়ে কবিতাটা লিখেছিলেন, সরকারি-বেসরকারি ইনামও পেয়েছেন । দেখছেন তো আমাকে । আমার সম্পর্কে কতো কি বানিয়ে লিখে গেছে ব্যাসদেব নামের এক কবি । যাকগে, আমি চলি ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : চেঙ্গিজদা তুমি আর তোমার সেনারা যে দেশ দখল করতে সেখানে ধর্ষণ চালাতে । তুমি তো অনেকগুলো বিয়ে করেছিলে, তবু আশ মেটেনি ? সিকন্দর, মানে আলেকজাণ্ডার, তোমার চেয়ে বেশি দেশ দখল করেছিল, কিন্তু ওরা তো অমন পাইকারি ধর্ষণ চালায়নি ।

চেঙ্গিজ খান : করেছে, করেছে । আমি মনে করি কোনো দেশ দখল করার প্রধান অস্ত্র হলো ধর্ষণ । তুই ল্যাঙড়া বলে কম ধর্ষণ করেছিস, জানি । ওই যে, যখন পাকিস্তানিদের থেকে পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে বাংলাদেশ হলো, তখন টিক্কা খানের সেনারা আর রাজাকর, আল বদর, আল শামস, নিশ্চয়ই  যে মেয়েকে সামনে পেয়েছে, তাকে ধর্ষণ করেছে । চল্লিশ বছর বয়সে আমি  মোঙ্গোল জাতির পত্তন ঘটানোর পর বিশ্বজয়ে বের হই। প্রথমেই জিন রাজবংশকে  হারাই । চীন থেকে আমি যুদ্ধবিদ্যা কূটনীতির মৌলিক কিছু শিক্ষা নিয়ে দখল করি পশ্চিম জিয়া, উত্তর চীনের জিন রাজবংশ, পারস্যের খোয়ারিজমীয় সম্রাজ্য আর ইউরেশিয়ার কিছু অংশ। অন্য দেশগুলোর  এখনকার নাম হল গণচীন, মোঙ্গোলিয়া, রাশিয়া, আজারবাইজান, আর্মেনিয়া, জর্জিয়া, ইরাক, ইরান, তুরস্ক, কাজাখস্তান, কিরগিজিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, আফগানিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, দক্ষিণ কোরিয়া, উত্তর কোরিয়া আর কুয়েত। আমি মারা যাওয়ার পর আমার ছেলে আর নাতিপুতিরা দেড়শো বছর  ধরে মোঙ্গোল সম্রাজ্যে রাজত্ব করেছিল। আমরা ধর্ষণ চালাতুম বলে তুই এইসব দেশে আমার মতন কুতকুতে চোখের মানুষ দেখতে পাবি । 

ল্যাঙড়া তৈমুর : কুতকুতে চোখের মেয়েরা সুন্দরী হয় । 

চেঙ্গিজ খান : কফিহাউসে যে-ই আসে, দেখি নিজের ঢোলক পেটায় । কিন্তু আস্তিকান্তরিতের ঢোল পেটাসনি । জানিস আমরা মনে করতুম আকাশের চেয়ে বড়ো কিছু নেই । বব মাস্তান পলাশীতে জেতার পর আল-হিন্দে ওর স্যাঙাত ম্যাকোলে আর পাদ্রিরা এসে খোলনলচে পালটে দিলে । মূলধারার ইংরেজি ভাষার শিক্ষায়  “উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত শিক্ষার প্রান্তিককরণ” আর প্রথাগত ভারতীয় চিন্তাধারার থেকে সরে যেতে শিক্ষাবিদদের উৎসাহ দেওয়া হলো, আর তাদের মধ্যে “আত্ম-অবজ্ঞার চেতনা” প্ররোচিত করা হলো। বব মাস্তানের লোকেরা  ভারতীয় ঐতিহ্যকে উপড়ে ফেলেছে, আর সেখানে গেড়েছে একটা বিদেশী ব্যবস্থা যা আল-হিন্দে কেউ চাইতো না । এছাড়াও, বব মাস্তানের কারণে বিদেশী চিন্তা পদ্ধতি আল-হিন্দের চিন্তা পদ্ধতিগুলোর চেয়ে অগ্রাধিকার পেয়েছিল। আমি কিন্তু এসব কিছুই করিনি । 

ল্যাঙড়া তৈমুর : নিজের ভালোমানুষীর ঢোল পেটাচ্ছো । আসতে দাও বাদবাকিদের ।

চেঙ্গিজ খান : তুইও পেটা । আমি তো বারণ করিনি । কিন্তু এটা মানতে হবে যে তুই মূর্খ ছিলিস । আমি সারা জীবন নিজেদের ধর্ম শামানে বিশ্বাসী করেছি । শামানরা আকাশ দেবতায় বিশ্বাসী ছিলো।  যখন ঐক্যবদ্ধ মোঙ্গোলিয়ার নেতা নির্বাচিত হই তখন শামান ধর্মের প্রধান পুরোহিত কুকচু ঘোষণা করেছিল যে আকাশের দেবতাদের পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী ছিঙ্গিস খাং পুরো পৃথিবী শাসন করার জন্যে এসেছে। বুঝলি ?

ল্যাঙড়া তৈমুর : কফিহাউসে অনেকে জানে না আমার নাম তৈমুর বিন তারাগাই বারলাস, আর ল্যাঙড়া ল্যাঙড়া বলে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করে । তোমার বংশধররা অক্কা পাবার পর আমি পশ্চিম আর মধ্য এশিয়ার বিশাল এলাকা  দখলে এনে তৈমুরীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলুম। লোকে বলত আমি অপরাজেয় সমরবিদ । আমার কারণেই তৈমুরীয় রাজবংশ প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। । যুদ্ধ করতে বেরিয়ে  অকেজো পা নিয়ে ঘোড়া হাঁকিয়েছি ।  আমার সাম্রাজ্য ছড়ানো ছিল এখনকার তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক, কুয়েত, ইরান থেকে মধ্য এশিয়ার অধিকাংশ অংশ যার মধ্যে রয়েছে কাজাখস্তান, আফগানিস্তান, রাশিয়া, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজিস্তান, পাকিস্তান, ভারতবর্ষ এমনকি চীনের কাশগর পর্যন্ত। তুমি আমাকে বলছ মূর্খ, আমি কিন্তু আত্মজীবনী  রচনা করিয়েছিলুম, ‘তুজুক ই তৈমুরী’ নামে।

চেঙ্গিজ খান : আমি ওসব আত্মজীবনী-টিবনি লেখাইনি ; দরকার হয়নি । ওই তো, বাবর এসে পড়েছে। আল-হিন্দ দখলের আগে ও ভেড়ার চামড়ার শায়া আর বুকে ঘোড়ার চামড়ার মেরজাই পরতো। এখন আল-হিন্দের সিংহাসনে বসে চেহারার খোলতাই হয়েছে দেখছি, সোনার গয়না, মুকুট পরে থাকে । আয় বাবর, বোস, বোস, এই যে ইনি তোর পূর্বপুরুষ ল্যাঙড়া তৈমুর, তোর নামই শোনেনি ।

মির্জা জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর : আরে চেঙ্গিজদাদু, আপনাকে তো জানি ; তৈমুরদাদুকে কে না জানে, আমি তো ওনার বংশধর ! কিন্তু এনারা কে আপনার টেবিলে, চিনতে পারলুম না।

কফিহাউসের যক্ষ : আমি এখানকার বেয়ারা, কফির অর্ডার নিই । বলতে পারেন, আমি কফিহাউসের মেঘ । কর্তব্যে অসাবধানতায় প্রভুর অভিশাপে যক্ষকে কফিহাউসে নির্বাসিত হতে হয়েছে। তাই ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে । এখানে বসে আষাঢ়ের প্রথম দিন নববর্ষায় আমাকে দেখে আমার মাধ্যমে অলকাপুরীর রম্যপ্রাসাদে ওর বিরহী প্রিয়ার উদ্দেশ্যে বার্তা পাঠাবে বলে মনস্থির করেছে। বিরহের আতিশায্যে ও ব্যাটা জড় আর জীবের ভেদাভেদজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। ও জানিয়েছে, কোন কোন নগর, নদী আর পর্বত পেরিয়ে আমাকে অলকায় পৌঁছতে হবে। ওর বর্ণনায় আল-হিন্দের  এক অসামান্য ভৌগোলিক বিবরণ ফুটে উঠেছে, অথচ সুবে-বাংলার বর্ণনা নেই বলে এখানে এসেছি । এরপর আমি কুবেরপুরী অলকা আর ওর বিরহী প্রিয়ার রূপলাবণ্য দেখবো । ও আমাকে অনুরোধ করেছে ওর প্রিয়তমার কাছে ওর কুশল সংবাদ পৌঁছে দিতে ।

মালিক অম্বর : আমি একজন হাবশি যোদ্ধা । আমার নাম মালিক অম্বর । আমি যা-কিছু তৈরি করিয়েছিলুম, সবই আওরঙজেব নিজের নামে করিয়ে নিয়েছে । মোগলদের তো আমি ঢুকতেই দিইনি আমার এলাকায় । আমি মরলুম আর ওরা আমার ছেলেকে ভুলভাল বুঝিয়ে সেঁদিয়ে এলো ।

চেঙ্গিজ খান : ভাগ্যিস তুমি মালিক অম্বর । আরেকজন ছিল মালিক কাফুর । সে লজ্জায় আসবে না । আলাউদ্দিন খলজির সেনাপতি নুসরাত খান মালিক কাফুরকে দাস বাজার থেকে কিনে এনে সুলতানকে উপহার দিয়েছিল । মালিক কাফুর ছিল খোজা। হোমোসেক্সুয়াল সুলতান মালিক কাফুরকে রোজ উপভোগ করতো। সেই তালে কাফুর প্রোমোশান পেয়ে গেল সেনাপতির পদে । আলাউদ্দিন মারা গেলে তার ছেলে শিহাবউদ্দিন ওমরকে তার জায়গায় এক মাস বসিয়ে তার মাকে বিয়ে করে নিয়েছিল কাফুর, লেজিটিমেসি পাবার জন্য । নুনু তো ছিল না। ওই নাম কা ওয়াস্তে বিয়ে ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : ওগুলো পটি পলিটিকস । পলিটিশিয়ানরা অমন করে । ডোন্ট টেক ইট আদারওয়াইজ । এই যে আরেকজন আসছেন।

ইমাদ-উল-মুলক : তৈমুরদাদু, আপনি ইনভাইট করেছিলেন, এলুম, যদিও, পাবলিক আমাকে বলে মুরতাদ নাস্তিক।  আমি তৃতীয় গাজী উদ্দিন খান ফিরোজ জং বা নিজাম শাহাবুদ্দিন মুহম্মদ ফিরোজ খান সিদ্দিকী বায়াফান্দি, আমার লোকেদের কাছে আমি  ইমাদ-উল-মুলক নামে পরিচিত ।  আসামের সুবেদার ছিলুম, জানেন তো । আমাকে পাবলিক মনে করে  একজন প্রকৃত মোগল শাসক  । আমি দ্বিতীয় গাজী উদ্দিন খান ফিরোজ জংয়ের ছেলে আর নিজাম রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নিজাম উল মুলক আসফ জাহের নাতি । পাবলিক বলে আমি নাকি বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব । আমি মোগল সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীরকে খুন করেছিলুম ঠিকই আর  সম্রাট আহমদ শাহ বাহাদুরকে জেলে পুরে অন্ধ করে দিয়েছিলুম । সম্রাটের  পরিবারের সদস্যদের নির্যাতনের জন্য আমি সুপরিচিত। ইসলামী পন্ডিতরা আর দুররানী সম্রাট আহমদ শাহ আবদালি আমাকে মুরতাদ ঘোষণা করেছিল । তাতে কী ! আমার আব্বা মারা যাবার পরে নবাব সাফদার জঙ্গ আমাকে মীর বখশি, বা কর্মীদের মাইনে দেবার কর্তার  পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছিল আর আমির উল-উমারা, মানে প্রতিভাবানদের অন্যতম, আর ইমাদ উল-মুলক উপাধি দিয়েছিল । আবদালি ব্যাটা ভুলে যায় যে নাদির শাহ ওর কানের লতি কেটে নিয়েছিল ।

খোকা তুগলক : জনাবেআলা,  মুরতাদ মানে কী ?

তোতলা তুগলক : এইটুটূটূটূকু জাজাজানিস না ?

ল্যাঙড়া তৈমুর : মুরতাদ শব্দের শাব্দিক অর্থ হল—- বিমুখ হয়েছে বা ফিরে গিয়েছে এমন। এর মূল মর্ম হল একটিমাত্র ঈশ্বরে বিশ্বাস ত্যাগ করা বা সেই বিশ্বাসের কোনও মৌলিক  বিধানকে মানতে অস্বীকার করা, কিংবা তার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করা,  অথবা সেই বিশ্বাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ের অবমাননা করা, যা অন্তরের ভক্তিশূন্যতা ও শ্রদ্ধাহীনতার ইঙ্গিত দেয় । 

কফিহাউসের যক্ষ : আমি বহুকাল যাবত কবি-লেখকদের কফি খাইয়ে আসছি । কাউকে অবমাননা করি না । আমার কিন্তু ক্লিওপেট্রাকে পছন্দ, যদিও উনি অনেক ভগবানে বিশ্বাস করতেন ; আমি তো ওনাকেই ভগবান বলে বিশ্বাস করি । ওনার বাবা মারা যাবার পর উনি দুই ভাই ত্রয়োদশ টলেমি ও চতুর্দশ টলেমির সঙ্গে মিলেমিশে রাজ্য শাসন করতেন।  মিশরীয় ঐতিহ্য অনুসারে উনি তাদের বিয়েও করেছিলেন।  একসময় ক্লিওপেট্রা মিশরের একক শাসক  হন। ফারাও হিসেবে উনি রোমের শাসক  সিজারের সাথে লিভটুগেদার সম্পর্ক গড়েছিলেন, যা মিশরের সিংহাসনে তাঁকে আরও শক্তিশালী করেছিলো। পরবর্তীতে জুলিয়াস সিজারের নামানুসারে ক্লিওপেট্রা তাঁর বড় ছেলের নাম রেখেছিলেন সিজারিয়ান। আমিও সিজারিয়ান হয়ে জন্মেছিলুম স্যার ।

চেঙ্গিজ খান : শুনেছি বটে ওই সুন্দরীর কথা । আমার আগেই উনি মারা গিয়েছিলেন, নয়তো বিয়ে করে মোঙ্গোলিয়ায় এনে আমার সাম্রাজ্যের রানি করতুম । ক্লিওপেট্রা ছিল মুরতাদ, আমিও মুরতাদ, তুমিও মুরতাদ। এই তালে এক রাউণ্ড কফি হয়ে যাক ।

ইমাদ-উল-মুলক : আমি মোটেই মুরতাদ নই । রাজা-মহারাজ-সম্রাটরা যা করে আমিও সেই কাজই করেছি । আহমদ শাহ আবদালির হাতে অনেক সৈন্যসামন্ত ছিল বলে যা ইচ্ছে প্রচার করেছে আর করিয়েছে । ইচ্ছে করলে আমিও দুররানির বিরুদ্ধে একটা বই লিখিয়ে ফেলতে পারতুম । ও তো  শিখ গণহত্যায় কুখ্যাত হয়ে আছে, অমৃতসরে শিখদের পবিত্র স্বর্ণ মন্দিরে হামলা করে সেটা ধ্বংস করে দিয়েছিল । তা ছাড়া  হাজার হাজার শিখকে খুন করে ভেবেছে কয়ামতের দিন ওকে জবাবদিহি করতে হবে না । নিশ্চয়ই জাহান্নমে বসে বিড়ি ফুঁকছে এখন । মেজাজ খারাপ হয়ে গেল এসে । আর কি গ্যাঁজাবো কফিহাউসে বসে ! তার চেয়ে মানে-মানে কেটে পড়ি । 

ল্যাঙড়া তৈমুর : হ্যাঁ, যা তুই এখান থেকে ।

স্লাভয় জিজেক : আমি একজন দার্শনিক । সাম্যবাদী দার্শনিক । আজকাল আমিই সবচেয়ে বেশি পপুলার । প্যাঁচালো যুক্তি দিই বলে ছাত্রছাত্রীরা ডক্টরেট করার বিষয় পেয়ে যায় । 

নোবিলিআত্মন : আমি খ্রিস্টান্তরিকতার প্রচারক । ইনফিডেল বা হিদেনদের খ্রিস্টান্তরিত করার জন্য ইটালি থেকে  অনেক হ্যাপা সহ্য করে এদেশে এসেছি। পর্তুগিজরা নাস্তিক ইনফিডেল কাফেরদের ঠিক মতো খ্রিস্টান্তরিত করতে পারছে না বলে আমি ন্যাড়া মাথায় টিকি রেখে গেরুয়া আলখাল্লা পরে, হাতে বেতের লাঠি আর কমণ্ডুলুতে জল নিয়ে হিন্দু সেজেছি । রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, চারটে বেদ সবই লুকিয়ে পড়েছি আর সেগুলো থেকে তর্ক দিয়ে ইনফিডেলদের প্রভূ যিশুর আশ্রয়ে নিয়ে আসি। জয় মা তারা, ব্রহ্মময়ী মাগো….!

ভাস্কো দা গামা : আমার নাম ভাস্কো দা গামা : আমি পর্তুগিজ । আমি আল-হিন্দ আবিষ্কার করেছিলুম, যদিও মোগলদের পরে, ইউরোপীয়দের বলবেন না যেন প্লিজ । ওরা জানে আমিই আবিষ্কারক ।  নোবিলিআত্মন যে পর্তুগিজদের কথা বলছে তাদের দেশ থাকে তাড়িয়ে এখানে পাঠানো হয়েছে। ওরা জেল খাটছিল, রেহাই পাবার জন্যে এখানে এসেছে, আটবছর সেনায় থাকতে হবে । অন্যরা ছুতোর, চামার, ভিস্তিঅলা, চাকর, চাকরানির পেটে জন্মানো অভিজাতের বেজন্মা ছেলে, উন্নতি করার জন্য এসেছে । যদি ফিরতে চায় তাহলে জাহাজে খাবার দেয়া হয় বটে কিন্তু জল দেয়া হয় না । তাই কেউ ফিরতে চায় না । ক্রীতদাসী কিনে তাদের বাচ্চার বাপ হয়ে আস্তিকান্তরিতের সংখ্যা বাড়ায় । গরুর মাংস খেলে হিন্দুদের আর শুয়োরের মাংস খেলে মুসলমানদের ধর্ম চলে যায় বলে পর্তুগিজ ছোকরা-গুণ্ডাদের বলা হয়েছে রাতের অন্ধকারে গিয়ে জোর করে খাইয়ে দিতে আর চেঁচামেচি করে পাড়া মাথায় তুলতে। এইভাবে আমরা খ্রিস্টান্তরিতের সংখ্যা অনেক বাড়িয়ে তুলেছি । দেখেছেন তো পুরো গোয়ার পাবলিক এখন ক্যাথলিক ধর্মের আস্তিকতম আস্তিক।

নোবিলিআত্মন : সেনর ভাস্কো, আপনাদের কুকীর্তি এখন সবাই জানে ।

ভাস্কো দা গামা : কোন কুকীর্তির কথা বলছেন ? নাস্তিকদের খ্রিস্টান্তরিত করার জন্য একটু আধটু জোর খাটাতেই হয় । এখন যারা ভোটাভুটির সময়ে পার্টি করে, তারাও তো জুলুমবাজি করে লোকেদের দলে টানে, মেরে-টেরেও ফেলে পাঁচ-দশজনকে।

নোবিলিআত্মন : আপনারা এদেশে এসে গোয়ায় ইনকুইজিশন চাপিয়ে দিয়েছিলেন । হিন্দুদের জীবন একেবারে নরক হয়ে গিয়েছিল–  খ্রিস্টান মিশনারিরা হিন্দুদের নির্দিষ্ট করে গণহত্যা চালাত। পর্তুগিজ মিশনারিরা হিন্দুদের ‘অসভ্য’ ও ‘মূর্খ’ বলত, যারা নাকি রাক্ষসের মত দেখতে কালো মূর্তির পূজা করে ; পর্তুগিজরা হিন্দুদের ধর্ম ত্যাগ করানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল আর জোর করে খ্রিস্টধর্ম চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। গোয়ায় একটা ইনকুইজিশন দপ্তরও গড়ে তোলা হয়েছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল যতটা সম্ভব, তত বেশি হিন্দুদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা। আমি পোপের দেশের মানুষ,অথচ  তা করিনি । ইংরেজ, ফরাসি, ডাচরাও তা করেনি ।

ভাস্কো দা গামা : এদেশে আমরা অনেক কিছু দিয়েছি । ইনকুইজিশনের পাদ্রি আলফোনসোর নামে আম আমরাই দিয়েছি, যা রপ্তানি করে আল-হিন্দে অনেক টাকা আসে ।

মাও জে দং : আমার নাম মাও জে দং । আমি চিনের চেয়ারম্যান । আমি মানুষকে নাস্তিকতম নাস্তিক বানাই, সাকৃতিক বিপ্লব আর লম্বা লাফের সাহায্যে । আপাতত উইঘুর আর তিব্বতিদের নাস্তিকান্তরিত করে তুলছি । উইঘুরদের আস্তিকান্তরিত করেছিল কান-কাটা আহমেদ শাহ আবদালি আর তিব্বতিদের আস্তিকান্তরিত করেছিল অতীশ দীপঙ্কর । তাদের সুসভ্য আধুনিক করার কাজ চলছে ।

বাবর : অমন কাজ করছেন কেন ? আমি তো পেঁদিয়ে আস্তিকান্তরিত করেছি । নইলে কচুকাটা । অবশ্য এই ব্যাপারে বিখ্যাত মানুষ হলো ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খলজি । ইউনিভারসিটিসুদ্দু মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছিল ।

মাও জে দং : নাস্তিক্যবাদ বা নিরীশ্বরবাদ বা নাস্তিকতাবাদ একটা দর্শনের নাম যাতে ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয় না এবং সম্পূর্ণ ভৌত এবং প্রাকৃতিক উপায়ে প্রকৃতির ব্যাখ্যা দেয়া হয়। মূলত আস্তিক্যবাদ এর বর্জনকেই নাস্তিক্যবাদ বলা যায়। নাস্তিক্যবাদ বিশ্বাস নয় বরং অবিশ্বাস এবং যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। বিশ্বাসকে খণ্ডন নয় বরং বিশ্বাসের অনুপস্থিতিই এখানে মুখ্য। শব্দটি সেই সকল মানুষকে নির্দেশ করে যারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই বলে মনে করে এবং প্রচলিত ধর্মগুলোর প্রতি বিশ্বাসকে ভ্রান্ত বলে তারা স্বীকার করে। দিনদিন মুক্ত চিন্তা, সংশয়বাদী চিন্তাধারা আর ধর্মগুলো সমালোচনা বৃদ্ধির সাথে সাথে নাস্তিক্যবাদেরও প্রসার ঘটছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে সর্বপ্রথম কিছু মানুষ নিজেদের নাস্তিক বলে পরিচয় দেয়়। পশ্চিমের দেশগুলোতে নাস্তিকদের সাধারণ ভাবে ধর্মহীন বা পারলৌকিক বিষয় সমূহে অবিশ্বাসী হিসেবে গণ্য করা হয়। কিছু নাস্তিক ব্যক্তিগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা,  ধর্মের দর্শন, যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ , প্রকৃতিবাদ, বস্তুবাদ ইত্যাদি দর্শনে বিশ্বাস করে। নাস্তিকরা মুলত কোনো বিশেষ মতাদর্শের অনুসারী নয় এবং তারা সকলে বিশেষ কোন আচার অনুষ্ঠানও পালন করে না। অর্থাৎ ব্যক্তিগতভাবে যে কেউ, যেকোনো মতাদর্শের সমর্থক হতে পারে, নাস্তিকদের মিল শুধুমাত্র এক জায়গাতেই, আর তা হল ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব কে অবিশ্বাস করা। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে আমাদের দেশ চালায় কমিউনিস্ট পার্টি । এখন আর কোনো দেশ সন্দেহ করে না যে আমাদের রাজনৈতিক আর আর্থিক কাঠামোই পৃথিবীতে সর্বশ্রেষ্ঠ। 

বাবর : ঠিক বুঝলুম না, শ্রেষ্ঠ কাঠামো তো জালালুদ্দিন আকবর তৈরি করেছিল ।

মাও জে দং : গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের রাজনীতি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোখানা একক কম্যুনিস্ট পার্টি অব চায়না দ্বারা পরিচালিত হয়, যার নেতৃত্বে রয়েছে দলের সাধারণ সম্পাদক। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ভেতরে রাজ্যক্ষমতা থাকে কম্যুনিস্ট পার্টি, মন্ত্রি পরিষদ আর তাদের প্রাদেশিক ও স্থানীয় প্রতিনিধিদের হাতে। এখন সারাজীবনের জন্যে বাছাই করা হয়েছে শি জিন পিঙকে । সবচেয়ে শুরুতে ছিলুম আমি । কয়েক দশকে আমেরিকা আমাদের পেছনের সারিতে চলে যাবে ।

চেঙ্গিজ খান : সেদিন খবরের কাগজে পড়ছিলুম, উইঘুর মিয়াঁ-বন্দিদের মুক্তির দাবিতে কবিতা লেখার অপরাধে  প্রখ্যাত হুই মুসলিম কবি কুই চুই হাউজিন  কে গ্রেফতার করেছেন আপনারা ?

মাও জে দং : ফালতু বিতর্ক । আমরা কেবল সাংস্কৃতিক বিপ্লবের জন্য এই পদক্ষেপগুলো নিয়েছি ।  জিনজিয়াং প্রদেশের কোনো পুরনো মসজিদ সারাই-টারাই না করে সেই টাকায় পড়াশুনা করানো হয় । নতুন মসজিদ তৈরির খরচ স্কুল খোলায় খরচ করা হয় । আধুনিক স্হাপত্যের আদলে সংস্কার করার পরিকল্পনা  করলে অবশ্য পুরনো মসজিদ সংস্কারের অনুমোদন দেয়া হয় । প্রকাশ্যে ধর্মীয় চেঁচামেচি অনুৎসাহিত করা হয় । নামাজের জন্য মসজিদ নয়, বরং নামাজ  ঘরে পড়ার জন্যে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে।  উইঘুর যুবকদের হান মেয়েদের বিয়ে করতে অর্থের অনুদান দেয়া হচ্ছে, কেননা হান মেয়েরা সুন্দরী।   হান ছেলেদের সঙ্গে উইঘুর মেয়েদের  বিয়ে দেয়া হচ্ছে যাতে তারা কমিউনিস্ট চিনের সত্যিকার অধিবাসী হতে পারে । হান ভাষা ইংরেজি ভাষাকে সরিয়ে দেবে কয়েক দশকের মধ্যেই ।

চেঙ্গিজ খান : হ্যাঁ, একথা মানতে হবে যে চিনেরা সুন্দরী হয় ।

মাও জে দং :উইঘুর শহর আর গ্রামের মাদরাসা ও হিফজখানায় আধুনিক শিক্ষা দেয়া হচ্ছে । শিশু-কিশোররা যাতে ধর্মীয় জ্ঞানে সময় নষ্ট না করে তার ব্যবস্হা নেয়া হচ্ছে । তাই আঠারো বছরের নিচে, শিশু-কিশোরদের জন্য ধর্মীয় শিক্ষায় অযথা সময় নষ্ট বন্ধ করা হয়েছে। উইঘুরদের বলা হয়েছে আহমেদ শাহ আবদালির চাপানো তুর্কি ভাষা ও আরবি বর্ণমালা ব্যবহার না করে হান ভাষা শিখতে, যাতে চাকরির সুবিধা হয় । কমপিউটারে হান ভাষা দরকার হয় । আমি মনে করি ধর্মের বাড়াবাড়ি সব দেশে বন্ধ করা উচিত । সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজম স্পষ্টতই ধর্মপালনকে নিরুৎসাহিত করে। মার্কস বা লেলিন কখনই ধর্মপালনকে সমর্থন করেননি। ধর্মপালন ভালো নাকি খারাপ, এটা একটা আলাদা বিতর্ক। তবে ধর্মপালন কমিউনিস্ট আদর্শের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। কার্ল মার্কস মনে করতেন, ধর্ম হচ্ছে ‘ক্লাস ডিভাইডেড সোসাইটি’ বা শ্রেণি বিভক্ত সমাজের একটি চেহারা। মার্কস ধর্মকে কর্তৃত্ববাদী শ্রেণির ‘আইডিয়োলজিক্যাল ওয়েপন’ বা ‘মতাদর্শগত অস্ত্র’ বলেছেন । ধর্ম গরিব-দুঃখী ও শোষিতদের ভুল পথে চালিত করে। ধর্ম তাদের বিশ্বাস করতে শেখায় যে, ইহকালের দুর্ভোগ হচ্ছে নিয়তি আর এর উত্তম প্রতিদান তারা পরকালে পাবে। নির্যাতিতদের এমন মনোভাব কর্তৃত্ববাদীদের অবস্থান আরো সুদৃঢ় করে দেয়। আমাদের দেশে ধর্মের ভড়ং নিষিদ্ধ করা হয়েছে ।

পাগলা তুগলক : স্যার, একটা কথা বলি । আল-হিন্দে মার্ক্সবাদীরাই মার্ক্সবাদের সবচেয়ে বড়ো অপপ্রচারকারী হয়ে দেখা দিয়েছে ; তারা সেই ১৮-১৯ শতকেই আটকে আছে ; তার কারণ তারা মার্ক্সের নয়, লেনিনের আর আপনার ভক্ত । আর স্তালিন যা পেয়েছিলেন লেনিনের কাছ থেকে সেই অর্থনৈতিক মতাদর্শ কমিউনিস্ট দেশগুলোয় কমিনটার্নের মাধ্যমে চাউর করতে চেয়েছিলেন । ট্রটস্কিদের সব কমিউনিস্ট দেশেই খুন করা হয়েছে । মার্ক্স তো খুনোখুনির কথা বলে যাননি যা কাচিনের জঙ্গলে স্তালিন করেছিলেন, আপনি করেছিলেন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নামে, পলপট করেছিলেন দেশের খোলনলচে পালটে ফেলার জন্যে । মার্ক্স বলেছিলেন ডিকটেটরশিপ অফ দি প্রলেতারিয়েতের কথা, কিন্তু তথাকথিত কমিউনিস্ট দেশগুলোয় দেখা দিল এক-একজন মানুষ একনায়ক, যেন প্রলেতারিয়েত বলতে তাকেই বোঝায়, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তারা ডিকটেটরি করে গেছে ; কুর্সিতে বসে থাকার জন্য নাগরিকদের পেছনে এমন গোয়েন্দা লাগিয়েছিল যে কেউ ভয়ে ট্যাঁ-ফোঁ করতো না ।  প্রমোদ দাশগুপ্ত এই প্রক্রিয়ার শেকড় পশ্চিমবাংলায় পুঁতে গিয়েছিলেন, আর বামপন্হীরা আসন ছাড়ার পর সেই শেকড় থেকে নতুন-নতুন ঝোপঝাড় গজিয়ে চলেছে ।  

তোতলা তুগলক : তোতোতোতোর এই স্বভাভাভাব গেগেগেগেল না । 

মাও জে দং : যা জানো না, সেই বিষয়ে কথা বোলো না । তোমার কাজ কফি খাওয়ানো, সেই কাজই করো।

রাগি তুগলক : এখন তো মার্ক্সবাদ শুনলেই পশ্চিমবাংলার পেটমোটা নাড়ুগোপাল টাইপের নেতাদের মুখ ভেসে ওঠে, গ্রামে তিনতলা আধুনিক বাড়ি, শহরে ছেলের জন্যে নার্সিং হোম, মেয়ের জন্যে ইশকুল করে দিয়েছেন জনগণের গ্যাঁড়ানো টাকায় ; সেই সঙ্গে সাঁইবাড়ি হত্যা, মরিচঝাঁপি গণহত্যা, আনন্দমার্গীদের জ্যান্ত পোড়ানো, নানুর গণহত্যা, নন্দীগ্রাম গণহত্যা আর আরও নানান কেলোর কীর্তি । কিংবা সেই সব গালফুলো নেউলে লেখকদের মুখ ভেসে ওঠে যারা রাতারাতি জার্সি পালটে বামপন্হী শাসকদের লেজ ধরে পুরস্কার বা কুর্সি  হাতিয়ে ফালতু বইকেও বেস্টসেলার করে ফেলেছিল । অথচ মার্ক্সবাদ বলতে যা বোঝায় তার সঙ্গে সংসদীয় গণতন্ত্রের কবলে আটক এই লোকগুলোর রাজনৈতিক কাজকারবারের কোনো সম্পর্ক ছিল  না । সেই কারণেই সম্প্রতি মার্ক্সের দ্বিজন্মশতবার্ষিকীতে, যতোটা বিশ্বকর্মা বা শেতলা পুজো নিয়ে হইচই হলো, মার্ক্সকে নিয়ে বিশেষ তক্কাতক্কি দেখা গেল না । পশ্চিমবাংলার বাঙালির মন থেকে মার্ক্সকে মুছে ফেলতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে সেই লোকগুলো যারা নিজেদের মার্ক্সবাদী বলে চালাবার চেষ্টা করেছে, যেমন বামপন্হী দলগুলো, যেমন নকশালপন্হী নেতারা, যেমন জঙ্গলে বিপ্লব করার জন্য লুকিয়ে থাকা মাওবাদীরা । 

তোতলা তুগলক : এএএএবার ববববক্তিমে দেয়া ববববন্ধ ককককর দিদিদিকিনি ।

মাও জে দং : মাওবাদী নকশাল নেতারা আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল । তবে চারু মজুমদার আসেননি। নকশাল আন্দোলন নিঃসন্দেহে সফল হয়েছিল, কেননা তা নিয়ে অনেক গল্প-উপন্যাস-কবিতা লেখা হয়েছে।  অরুন্ধতী রায়ের বুকার পুরস্কার জয়ী “গড অব স্মল থিংস্” উপন্যাসে একটি চরিত্র নকশাল আন্দোলনে যোগ দেয়। মহাশ্বেতা দেবী তাঁর ‘’’হাজার চুরাশির মা’’’ উপন্যাসে নকশাল আন্দোলন নিয়ে লিখেছেন।  এ উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে  ফিল্ম হয়েছে, নাম ছিল “হাজার চুরাশি কি মা”। সমরেশ মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কিন্নর রায় এবং আরও অনেকের উপন্যাসে নকশাল আন্দোলনের কথা রয়েছে। তাছাড়াও মানব চক্রবর্তীর “কুশ” উপন্যাসে নকশাল আন্দোলনের কথা আছে। নকশাল আন্দোলনের প্রভাবে ছোটগল্প, নাটক, গণসংগীত রচিত হয়েছিল যা বাংলার চিন্তাশীল মানুষকে প্রভাবিত করেছিল । রাহুল পুরকায়স্হ নকশাল কবিতার সংকলন সম্পাদনা করেছেন । সাফল্যের জন্যে আর কী চাই! 

শেষ তুগলক : জানি না চারু মজুমদার কেমন করে অনুমান করেছিলেন যে পশ্চিমবাংলায় শিক্ষিত কিশোর-তরুণদের বিপ্লব হলে তা বহুত্ববাদী গোঁড়া-ধর্ম, কট্টর মৌলবাদ, জাতিপ্রথা ও বিচিত্র-বিশ্বাস, ভাষা এবং সংস্কৃতিতে জড়িয়ে থাকা সারা ভারতের জনজীবনে ছড়িয়ে পড়বে ; আপনার  চিনের স্প্রিং থাণ্ডার শুনে অনেকের মতো উনিও রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন, যদিও তার আগেই আপনারা ভারতের আকসাই চিন আর তিব্বত দখল করে নিয়েছিলেন । মাঝখান থেকে উনি পশ্চিমবাংলার কিশোর-তরুণদের ক্রিমি লেয়ারকে লোপাট করতে এমন সাহায্য করলেন যে বাঙালি মধ্যবিত্তের একটা পুরো প্রজন্ম নষ্ট হয়ে গেল । আর পশ্চিমবাংলার পিছিয়ে পড়ার সেটাই প্রধান কারণ । মার্ক্সের চালু করা বামপন্হীদের প্রিয় অভিধা অর্থাৎ প্রলেতারিয়েত আর বুর্জোয়ার মাঝে একটা বিরাট মধ্যবিত্ত বাফার শ্রেণি সব দেশেই গড়ে উঠেছে, যাদের আবির্ভাবের কথা মার্ক্স অনুমান করতে পারেননি, আর তারা বেশিরভাগই, যাকে বলে সার্ভিস ইনডাসট্রি, তা থেকে মোটা টাকা রোজগার করে, নিজেদের শ্রমিক বলে মনে করে না। এদের, যাদের বলা হয় মিলেনিয়াম জেনারেশন, তারা মার্ক্স পড়েনি, পড়ার আগ্রহও নেই। 

তোতলা তুগলক : এএএএরা বাবাবাবারন ককককরলেও শোশোশোনে না ; ততততক্কো ককককররররবেই ।

মাও জে দং : বাঙালিদের কথা আমায় বোলো না । ওরা নিজেদের কমরেড জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেয়নি। জ্যোতি বসু কেরলের লোক হলে, হতে পারতেন । চিনের দিকে তাকিয়ে দ্যাখো, তাহলেই টের পাবে কেন জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী হওয়া উচিত ছিল । কেতাবি মার্কসবাদে দেশ চলে না । মার্কসবাদ হলো তরল পদার্থ, পাত্র অনুযায়ী বদলাতে হয় । যেমন কেরলের মোপলারা ধর্ম নিয়ে মেতে রইলো ; ফলে বিদ্রোহ চলে গেল বিপথে।

চেঙ্গিজ খান : মোপলারা কারা কমরেড ?

মাও জে দং: মালাবারের ওয়ালুভানাদ আর এরনাদ তালুক জুড়ে দশ লক্ষ মোপলা চাষি সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছিল । ব্রিটিশ সেনাদের যুদ্ধে মোপলারা  জংগলে আশ্রয় নিয়েছিল । ১৮৮৫ সাল নাগাদ দ্বিতীয় মোপলা বিদ্রোহ হয় যা দমন করতে ব্রিটিশ সরকার তিন হাজার সৈন্য আর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করে।  তাদের দমন করা হয় ‘পিটুনি কর’ বসিয়ে ও দ্বীপান্তর পাঠিয়ে। ১৮৯৪ সালে তৃতীয় মোপলা বিদ্রোহ এবং ১৮৯৬ তে চতুর্থ মোপলা বিদ্রোহ ঘটে। সবকটি বিদ্রোহই  দমন করা হয়। চতুর্থ মোপলা বিদ্রোহে  শাসকগোষ্ঠী জমিদারদের বর্ধিত খাজনা ও মহাজনদের সুদ নিয়ন্ত্রণের করে । অতীতে আরব দেশ থেকে দক্ষিণ ভারতের মালাবার অঞ্চলে মোপলারা বসতি গড়েছিল । তাদের জীবিকা ছিল প্রধানত কৃষিকাজ। জমিদারদের কাছে বর্গাভিত্তিক চাষাবাদ করতো মোপলারা । দুর্ভাগ্যবশত তারা কমিউনিজমকে নিজেদের ধর্মবিরোধী মনে করেছিল ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : কমরেড মাও জে দং, আজিজুল হক কারাগারে আঠেরো বছর বন্দি ছিলেন । তাঁর জীবন কি ব্যর্থ গেল ? উনি বলেছেন, কারাগারে ১৮ বছর বইটা  জেলখানায় বসেই মূলত লিখেছি। লেখাটি যখন পুলিশের মহাফেজখানায় যাবার অপেক্ষায় আমার বিছানার নিচে পড়েছিলো  তখুনি আজকাল পত্রিকার সম্পাদক অশোক দাশগুপ্তের অসাধারণ মেধা আর একঝাঁক করিৎকর্মা সাংবাদিকের সহায়তায় তা জেলখানার ২৪ ফুট দেয়াল টপকে বাইরে বেরিয়ে আসে। খবরের কাগজে ছাপা হতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে ৭০ দশকের জেলখানার ছবি জেলবন্দী ছাড়া অন্য মানুষদের বোঝানো প্রায় অসম্ভব। একদিকে অকথ্য দৈহিক নির্যাতন অন্যদিকে তারই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানসিক নির্যাতন। একইি দিনে সকালে লাঠির বাড়িতে ঘুম ভেঙ্গেছে দুপুরে পচাগলা খাবার, রাতে বিশেষ বিভাগের কর্তাদের মানসিক নির্যাতন। এর সঙ্গেই নিজের কমরেডদের খুন হয়ে যেতে দেখা। সেই দুঃসহ অবস্থার মধ্যে দিয়েই এগিয়েছে আমার জেলখানায় ১৮ বছরের প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি পৃষ্ঠা। এই বইটিতে আমি চেষ্টা করেছি জেলখানায় রাজনৈতিক বন্দীদের ওপর নির্যাতনের এক প্রমাণ তুলে ধরতে। কারাগারে ১৮ বছর নিয়ে আমাকে বিস্তর আলোচনা সমালোচনা শুনতে হয়েছে। বইয়ের ভূমিকার একটা কথাই ফিরিয়ে বলি, তা হলো এই বইয়ের কাহিনী যে ইতিহাসের তাতে কুশিলব অনেকেই। এই বিশাল সেতু বন্ধনে লেখক হিসেবে আমার ভূমিকা একেবারে কাঠবিড়ালীর। রামলক্ষণ-সীতা আর হনুমানরা ইচ্ছে মতো দাপাদাপি করুন। ইচ্ছে হলে রাক্ষস খোক্কসদের নিমন্ত্রণ করে আনুন। আমি কেবল এক বরফশীতল সময়কেই আমার বইটিতে তুলে ধরতে চেয়েছি।

মাও জে দং : আমি ঠিক বলতে পারব না । শি জিন পিঙ যদি কফিহাউসের আড্ডায় আসে, ওকে জিগ্যেস করতে পারো । আমাদের একটাই দল ছিল, সেটাই আছে এখনও । 

ল্যাঙড়া তৈমুর : ওনাদের বহুরৈখিকতা সম্পর্কে বলুন তাহলে ।

ফিরোজাবাদি তুগলক : চারু মজুমদার চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মাও জে দং এর অনুসারী ছিলেন। তিনি মনে করতেন ভারতের কৃষক আর গরিব মানুষদের মাও জে দং এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে, শ্রেণিশত্রুদের চিহ্নিত করে, তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করা দরকার । তার কারণ তারাই সর্বহারা কৃষক শ্রমিকদের শোষণ করে। তিনি নকশালবাড়ি আন্দোলনকে সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁর লেখার মাধ্যমে। তাঁর বিখ্যাত রচনা হল ‘’’হিস্টরিক এইট ডকুমেন্টস্’’’ বা আট দলিল যা নকশাল মতাদর্শের ভিত্তি।  বিশিষ্ট বামপন্থী বুদ্ধিজীবী সরোজ দত্ত শ্রেণিশত্রু খতমের রাজনীতির পক্ষে একাধিক প্রবন্ধ  নকশালদের মুখপত্র ‘দেশব্রতী’ পত্রিকায় লিখেছিলেন । নকশালপন্থীরা পরবর্তীতে সিপিআই(এম) থেকে বেরিয়ে ‘’’অল ইন্ডিয়া কমিটি অব কমিউনিস্ট রেভুলশনারী’’’(এ আই সি সি সি আর) গঠন করে। ১৯৬৯ সালে এ আই সি সি সি আর থেকে জন্ম নেয় কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)। আসলে সবকয়টা নকশালবাদী দলেরই উদ্ভব হয়েছে সিপিআই(এম এল) থেকে । তবে “মাওবাদী কমিউনিস্ট সেন্টার্” নামে একটা ভিন্ন মতাদর্শের দল ছিল। তাদের উদ্ভব হয়েছিল “দক্ষিণদেশ গ্রুপ” নামে এক সংগঠন থেকে। পরবর্তীতে তারা “পিপলস ওয়ার গ্রুপ” এর সাথে যুক্ত হয়ে “কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া”(মাওবাদী) গঠন করে। এছাড়া ভিন্ন মতাদর্শের আর একটি দল হল “অন্ধ্র রেভুলশনারী কমিউনিস্টস্” এবং তারা “টি. নাগি রেড্ডি”-র “মাস লাইন” মতবাদের অনুসারী ছিল। 

তোতলা তুগলক : কোকোকোথ্থেকে জাজাজানলি ?

দিল্লিওয়ালা তুগলক : বাকিটা আমি বলছি । ১৯৭০ সালের দিকে এ আন্দোলন অন্তর্দ্বন্দের কারণে কয়েকটি বিরোধী অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৯৮০ সালের দিকে প্রায় ৩০ টি নকশালবাদী দল সক্রিয় ছিল আর তাদের জনবল ছিল প্রায় ত্রিশ হাজার । এছাড়া অর্ন্তকোন্দলের কারণে আন্দোলনে ছেদ পড়ে। দলের একটি বড় অংশ চারু মজুমদারের নির্দেশিত পথের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। ১৯৭১ সালে সিপিআই(এম-এল) ভেঙে দু টুকরো হয়ে যায়। চারু মজুমদারের দল থেকে সত্যনারায়ণ সিং বেরিয়ে যান। ১৯৭২ সালে চারু মজুমদার পুলিশের হাতে ধরা পড়েন এবং আলীপুর জেলে মারা যান । তাত্ত্বিক নেতা সরোজ দত্তকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেলে তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি, সম্ভবত তাঁকে হত্যা করা হয়। পলিটব্যুরোর অন্যতম নেতা সুশীতল রায়চৌধুরী আত্মগোপন থাকা অবস্থায় মারা যান। প্রধান নেতৃবর্গের বড় অংশই জেল বন্দী হন। পরে নকশালপন্থী দল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী) বহু ধারা-উপধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। অনেক বছর পরে অন্যতম প্রধান নেতা কানু সান্যাল ২০১০ সালের ২৩শে মার্চ পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়ী থানার হাতিঘিষা গ্রামের নিজ বাড়িতে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। 

তোতলা তুগলক : তুতুতুতুইও জাজাজাজানিস ; তাতাতাতাহলে রারারাজ্য সাসাসাসামলাতে পাপাপারলি না কেকেকেন ?

চেঙ্গিজ খান : যাকগে, গম্ভীর আলোচনা বাদ দিন । বাবর, তুই তো খুব ধার্মিক মানুষ । এখনও নেশা-ভাঙ করিস ?

বাবর : আজ্ঞে চেঙ্গিজদাদু, সম্রাট হবার পর ভালো মদ খেয়েছি আর আফিম খেয়েছি । সমরকন্দের মতন মদ আর আফিম আর কোথাও পাওয়া যায় না । আমি উজবেকদের হাতে ওগুলো আনাই । তবে সমকাম ছেড়ে দিয়েছি। আপনি তো জানেন মাত্র বারো বছর বয়সে  প্রথম ক্ষমতা পেয়েছিলুম,  ফরগানার সিংহাসনে বসি । জায়গাটা এখন উজবেকিস্তান হয়ে গেছে । আমার কাকা অনবরত আমায় সিংহাসন থেকে ঢেকলে দেবার চেষ্টা করতেন আর আমার শত্রুও ছিল অনেক । একসময় আমাকে ঢেকলে ফেলে দিতে সফল হন। ফলে জীবনের বেশকিছু সময় আমাকে আশ্রয়হীন আর যাযাবর থাকতে হয়েছিল । এই সময় আমার সঙ্গে শুধুমাত্র  বন্ধু আর চাষিদের যোগাযোগ ছিল। তখনই মদ আর আফিমের নেশা আরম্ভ করি ; আফিম আর চরসের সঙ্গে গুড় মিশিয়ে মাজুন তৈরি করে খাই । মাজুন খেয়ে সমরকন্দের উজবেক শহরে আক্রমণ চালাই আর ফটাফট দখল করে নিই। কিন্তু সঙ্গীসাথিরা কেটে পড়লে আমি সমরকন্দ আর ফেরগনা দুটোই হারাই । তখন নেশার মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল। সারা দিনে চার-পাঁচটা মাজুনের মেঠাই খেতুম । আল-হিন্দে ভালো জিনিস কিছুই পাওয়া যায় না, একেবারে বাজে দেশ, নেহাত সিংহাসনটা সহজে পেয়ে গেলুম, নয়তো থাকার মতন জায়গা এটা নয় ।

তোতলা তুগলক : ও বাবাবাবাবা, এএএএ তোতোতো ড্রাগ অ্যাডিডিডিক্ট বাবাবাদশা !

মাও জে দং : কিছু বন্ধু বিশ্বাসঘাতকতা করবেই । মনে রাখবেন । এটা আমার অভিজ্ঞতা ।

চেঙ্গিজ খান : সমরকন্দ তো আমি ধ্বংস করে দিয়েছিলুম । আবার দাঁড়িয়ে গেছে ?

ল্যাঙড়া তৈমুর :  সমরকন্দকে আমার সাম্রাজ্যের রাজধানী বানিয়ে শহরটার আবার উন্নতি করেছিলুম। কিন্তু আমার আয়েসি বংশধরদের কারণে  সাম্রাজ্যের পতন শুরু হলে উজবেকরা শহরটা দখলে করে নিয়েছিল। উজবেক শাসকেরা  তাদের রাজধানী বোখারায় সরিয়ে নিলে সমরকন্দের গুরুত্ব কমে যায়। কী আর বলব ! আমার বউয়ের নামে বিবি খানম মসজিদ বানিয়েছিলুম দামী পাথর দিয়ে । নকশাটা  আল-হিন্দ থেকে নেয়া । আল-হিন্দ থেকে কারিগর আর পাথর খোদাইকারী নিয়ে গিয়ে মসজিদের গম্বুজের নকশা তৈরি  করিয়েছিলুম । আগে সমরকন্দের প্রায় সমস্ত বাসিন্দা ছিল জরাথ্রুস্টবাদী । এছাড়া অনেক নেস্টোরিয়ান এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীও শহরে বাস করত। সমরকান্দ দখলের পরে আমি শহরের বাসিন্দাদের আস্তিকান্তরিত করেছিলুম । 

চেঙ্গিজ খান : বাবরতুই তো কড়া মেজাজের আস্তিক । শিয়াদেরও পাত্তা দিস না কেন ? তুই নিজেই ‘তাজুক-ই-বাবুরি’তে  গর্ব করে লিখেছিস যে, যুদ্ধের পরে নাস্তিকদের মাথার খুলি দিয়ে মিনার তৈরি করতে ভালোবাসতিস । আমি কতো কি করেছি কিন্তু অমন কাজ করিনি রে । 

বাবর : শাহ ইসমাইলের পারস্য শিয়া মুসলিমদের একটা অভেদ্য দুর্গে পরিণত হয়েছিল, আর ও  নিজেকে সপ্তম শিয়া ঈমাম  মূসা আল কাজিমের বংশধর হিসেবে দাবি করতে আরম্ভ করেছিল । তথন ওর নামে কয়েন চালু করা হয়েছিল আর মসজিদে খুত্‌বা পড়ার সময়ে ওর নাম নিয়ে পড়া হত। তাই আমি চটে গিয়েছিলুম । আর ছোটোবেলা থেকে শিখেছিলুম যে অবিশ্বাসীদের বিশ্বাসী করে তুলতে হবে, নয়তো নিকেশ করতে হবে । 

খোকা তুগলক : খুতবা কী, জনাবেআলা ?

তোতলা তুগলক : এএএএটুকুও জাজাজাজানিস না ?

বাবর : খুতবা শব্দটা আরবি । খুতবা  হল মসজিদে মুসল্লিদের সামনে প্রদত্ত ধর্মীয় বক্তৃতা। জুমার নামাজ ও দুই ঈদের নামাজে খুতবা পড়া হয়। খুতবা প্রদানকারী ব্যক্তিকে বলা হয় খতিব। সাধারণত খুতবা আরবি ভাষায় পড়া হয়। তবে কিছু জায়গায় লোকাল ভাষায় খুতবা দেয়ার প্রচলন রয়েছে। আমাদের সময়ে শাসকের সার্বভৌমত্বের প্রকাশ হিসেবে খুতবায় তার নাম উচ্চারণ করা হত। 

চেঙ্গিজ খান : নিজেদের মধ্যে অমন ঘেন্নাঘিন্নির যুদ্ধ করে অতো সুন্দর সিরিয়া, ইরাক, লেবানন দেশগুলো পাঁপড়ের মতন গুঁড়িয়ে গেছে । মানুষ নিজের দেশ ছেড়ে ঝূঁকি নিয়ে সমুদ্র পার হয়ে গ্রিকদেশ হয়ে ইউরোপে চলে যাচ্ছে । ইউরোপের মানুষ তাদের চায় না কিন্তু উপায় নেই । নানা জাতির মানুষ ছিল সিরিয়ায়, সিরিয়ান আরব, গ্রীক, আর্মেনিয়ান, আসিরিয়ার, কুর্দি, কার্কাসিয়ান, মানডিয়ান্স আর তুর্কি সহ। ধর্মীয় গোষ্ঠীও ছিল অনেক, যেমন, সুন্নি, খ্রিস্টান, আলাউই, ডুরজ, ইসমাঈল, মান্দিয়া, শিয়া, সালাফি, ইয়াসীদ ও ইহুদিরা। অনেকে ছেলে-ছোকরা ইউরোপে পালাচ্ছে ।

নোবিলিআত্মন : বুঝেছি, আমরা যেমন প্রটেস্ট্যান্টদের নাস্তিক মনে করি । আমি কোনোরকম জোরজুলুম না করে আল-হিন্দের চার হাজার পরিবারকে খ্রিস্টান্তরিত করেছি । এবার টিকি কেটে মাথায় চুল গজিয়ে ফিরে যাচ্ছি ইটালিতে । আমাদের পারিবারিক নীতি অনুযায়ী মিলিটারিতে যোগ দেবো । শুনেছি মুসোলিনি নামে কেউ একজন আসতে চলেছে যে পুরো ইটালির মিলিটারিকে পালটে ফ্যাসিবাদি করে দেবে । আমার নাম আসলে রোবের্তো ডি নোবিলি, পবিত্র রোমান সম্রাট তৃতীয় অট্টোর আমি বংশধর । আসার সময়ে লিবিয়া, লেবানন, ইরাক, সিরিয়ে হয়ে এসেছিলুম । সিরিয়ার আলেপ্পো, দামাসকাস, এমেসা, হোমস, লাতাকিয়া, তারতুস, আসসুয়ায়দা, দেইর এজ-জোর, দারা, ইডলিব শহরগুলোর তুলনা হয় না । 

ল্যাঙড়া তৈমুর : ফ্যাসিবাদ আবার কী জিনিস ?

নোবিলিআত্মন :  মুলত রাষ্ট্রের সব মানুষকে একাত্ন করে  অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এই কাজে তারা নির্ভর করে  বিশেষ বাহিনী বা গোষ্ঠীর ওপর যারা আগে রাজনৈতিক মাঠে ততটা প্রভাবশালী ছিল না। যাদের এই কাজে সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা থাকে তারাই  রাষ্ট্র নেতৃতে অগ্রনী দায়িত্ব নেয়। সেই রাষ্ট্র তখন প্রাথমিকভাবে রাজনৈতিক অত্যাচার, যুদ্ধ ও সাম্রাজ্যবাদকে অনুমোদন দেয় । সেই রাষ্ট্রের মতে নতুনভাবে রাষ্ট্র গঠনের জন্য এগুলো মৌলিক বিষয়। ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ অনুযায়ী উচ্চবিত্ত বা প্রভাবশালী রাষ্ট্রের উচিত অন্য দুর্বল বা যাদের অর্থনীতি তেমনটা মজবুত নয় এমন রাষ্ট্র বা জাতিকে দখল করে স্থানচ্যুত করা।  ফ্যাসিবাদীরা নিজেদের জাতি ও সংস্কৃতিকে সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করে। বলতে পারেন নতুন ধরণের আস্তিকতা । করোনা ভাইরাস যেমন মানুষকে ভয় দেখিয়ে আস্তিক করে তুলছে, ফ্যাসিবাদ আর সাম্যবাদও তাই ।

ভাস্কো দা গামা : ওহে কফিহাউসে যক্ষ, আমরা ক্রীতদাসদের জব্বর গালাগালি দিতুম ।  তোমাদের এখানকার ভাষায় তেমন শব্দ নেই বুঝি ?

কফিহাউসের যক্ষ : আছে সেনর । ওই যে পিঠখোলা ব্লাউজ আর লাল শাড়ি পরে ফর্সা নারীরা বসে আছেন, দেখুন ওনাদের পিঠে লেখা আছে গুদ, বাঁড়া, ল্যাওড়া, বাঞ্চোৎ, বোকাচোদা…

মাও জেদং : না, না, সাম্যবাদ আর ফ্যাসিবাদ এক নয় ; আর করোনা ভাইরাস আমাদের অবদান নয় ।

স্লাভয় জিজেক : মাও জেদং-এর সঙ্গে আমি একমত নই । কমিউনিজমের মৃত্যু হয়েছে চিনে। মানুষ এমন কোনো প্রজাতি নয়, আর তার গুরুত্বপূর্ণ কোনো অবস্থান নেই। বাকি প্রাণীদের মধ্যে মানুষের শরীরে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ,  এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। তবে ভাইরাসের এই মহামারীর আকার ধারণের ক্ষেত্রে দায়ি চিন। সত্যতা গোপনের ফলেই  বড় চেহারা নিয়েছে করোনা সংক্রমণ । কমিউনিজমের মৃত্যু হয়েছে চিনে।

চেঙ্গিজ খান : করোনা আবার কী ব্যাপার ?

স্লাভয় জিজেক : পশুপাখির রোগ যা মানুষের দেহে আশ্রয় নিচ্ছে আর লক্ষ লক্ষ মানুষকে মেরে ফেলছে ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : পশুদের ধর্ষণ করে ?

নোবিলিআত্মন : না পশুপাখিদের মাংস খেয়ে । চারপায়ে চলাফেরা করে এমন সমস্ত প্রাণী খায় চিনের লোকেরা।

স্লাভয় জিজেক : কমিউনিজমের জয় হবে।

বাবর : মনে পড়েছে । হিউয়েন সাঙ একবার ঠাট্টা-ইয়ার্কি করে বলেছিল বটে যে আল-হিন্দের লোকেরা কতো বোকা। বাঁদর, হনুমান, কুকুর, বিড়াল, সাপ, কাঠবিড়ালি, বাদুড়, গুবরেপোকা, কাঁকড়াবিছে কিচ্ছু খায় না। আমি তখন বিশ্বাস করিনি ; হালাল করে কেমন করে । এখন তো যা শুনছি করোনাভাইরাসই সাম্যবাদ, সবাইকে সমান চোখে দেখছে।

নোবিলিআত্মন : আমার সঙ্গে ফা হিয়েনের দেখা হয়েছিল । উনি আল-হিন্দ থেকে শেয়াল, ভোঁদড়, চামচিকে, গাধার মাংস আর চামড়া কিনে নিয়ে যাচ্ছিলেন । বললেন, ওই মাংস খেলে তুরীয়ভাব আসে, অথচ আল-হিন্দের মানুষ এতো মূর্খ যে  খায় না । 

ল্যাঙড়া তৈমুর : আরে ! মোটু, তুই ? তাও আবার তোর অম্মিজানকেও সঙ্গে করে এনেছিস ?

ওয়াজেদ আলি শাহ : শুনলুম, কফিহাউসে আজ তোমাদের মতন দিগগজরা জড়ো হবে, তাই আর নিজেকে সামলাতে পারলুম না, চলে এলুম । অম্মিজানকে নিয়ে এলুম কারণ প্যারিসের গোরস্তানে উনি একা শুয়ে শুয়ে পাগল হয়ে যাবার যোগাড় । গান শোনাই, কতো দিন গাইনি…..কেউ টুসকি মেরে তাল দিও না কিন্তু….

বাবুল মোরা, নৈহর ছুটো যায়

বাবুল মোরা নৈহর ছুটো যায়

চার কহার মিল, মোরি ডোলিয়া সজাওয়ে

মোরা অপনা বেগানা ছুটো যায় ।

আঙ্গনা তো পর্বত ভয়ো অওর দেহরি ভয়ি বিদেশ

যায়ে বাবুল ঘর আপনো ম্যায় চলি পিয়া কে দেশ

বাবুল মোরা, নৈহর ছুটো যায়…

স্লাভয় জিজেক : একা কেন ? ওনার পাশে তো শুয়ে আছেন জিম মরিসন, এডিথ পিয়াফ, ফ্রেডেরিক শোপাঁ, বেঞ্জামিন ফ্র্যাংকলিনের নাতি, অসকার ওয়াইল্ড, মার্সেল প্রুস্ত, নেপোলিয়ানের অবৈধ ছেলে, আরও কতো বিখ্যাত লোক । তোমার মা মলিকা কিশওয়ার জনাব-ই আলিয়ার তো একা অনুভব করার কারণ নেই ।

ওয়াজেদ আলি শাহ : ব্রিটিশরা যখন আমার লখনউয়ের মসনদ কেড়ে নিয়েছিল তখন একটা বিহিত চাইবার জন্যে অম্মিজান গিয়েছিলেন কুইন ভিক্টোরোয়ার সঙ্গে দেখা করতে । ভাবলেন যে ভিক্টোরিয়াও তো ছেলের মা, ওনার কষ্ট নিশ্চয়ই বুঝবেন । দেখা করে টের পেলেন যে কুইন ভিক্টোরিয়ার কোনো ক্ষমতা নেই বিহিত করার, উনি কেবল নৌকা আর ইংরেজদের বাড়ির কথা আলোচনা করলেন । ব্রিটিশ পার্লামেন্টে দরখাস্ত দিয়েছিলেন অম্মি, তা নাকচ হয়ে গেল কেননা তা বড্ডো রাগ-দেখানো ভাষায় লেখা । তারপর ওরা বলল যে আমার অম্মি যদি ব্রিটিশ পাহারা চান তাহলে ওনাকে ব্রিটিশ নাগরিক হিসাবে ঘোষণা করতে হবে । 

বাবর : তারপর ?

ওয়াজেদ আলি শাহ : ইংরেজরা আরও চটে গেল যখন মহাবিদ্রোহ আরম্ভ হলো । অম্মিজান মন খারাপ করে ফেরার ব্যবস্হা করে ফেললেন, কিন্তু ওই তুষার-পড়া ঠাণ্ডায় ওনার শরীর এতো খারাপ হয়ে গেল যে প্যারিসে মারা গেলেন । ব্রিটিশরা শবদেহ গোর দেবার কোনো সন্মানজনক ব্যবস্হা করেনি ; যা করার করেছিল তুর্কি আর ইরানের সুলতানরা । আপনি যাদের নাম বললেন তাদের কবর অনেক সুন্দর । আমার অম্মির কবর আপনি খুঁজে পাবেন না ঝোপঝাড়ের মধ্যে । আমার ছোটো ভাই সিকন্দর হাশমত অম্মিজানের সঙ্গে গিয়েছিল, সে তো ইংল্যাণ্ডে মারা গেল, প্যারিসে নিয়ে গিয়ে অম্মিজানের পাশে তাকে কবর দেয়া হলো । সিকন্দর হাশমতের হিন্দু রাজপুত বিবির বাচ্চাটাও মারা গিয়েছিল, তাকে গোর দেয়া হয়েছিল কিলবার্নের গোরস্তানে । আমার ভাগ্য ভালো যে হিন্দুস্তানে মরেছি । সচিন তেন্দুলকর জিন্দাবাদ ।

চেঙ্গিজ খান : তোর বাঁ দিকের মাই বের-করা পোশাক পরার অভ্যাস আজো গেল না । তুই তো নিজের বিরাট একখানা নাম রেখেছিলিস । সেটাও কেড়ে নিয়েছে ফিরিঙ্গিরা ?

ওয়াজেদ আলি শাহ : চেঙ্গিজদাদু, আমার পুরো নাম আবদুল মুজাফর নাসিরুদ্দিন সিকান্দর জা, বাদশা-ই-আবদুল কাইজার-ই-জামান, সুলতান-ই-আলম ওয়াজিদ আলি শাহ বাদশা । সবই কেড়ে নিয়ে আমাকে আটকে নিয়েছে কলকাতার মেটিয়াবুরুজে, মানে গার্ডেনরিচে । আসলে ইংরেজরা ওদের দেনা না মিটিয়ে আমাকে কয়েদ করলো। পেনশন নিয়ে লখনউতে থাকলেই হতো ।  সাত হাজার সাঙ্গপাঙ্গ এনেছিলুম, কতোজন বিবি ছিল মনে নেই, রাখেলও ছিল অনেকগুলো, কেনাবাঁদি, গোখরো আর কেউটে সাপ, বাঁদর, ভাল্লুক, আঠারো হাজার পায়রা । আমার ‘দরিয়া-ই-তাশশুক’, কিংবা ‘বহার-এ ইশ্ক’ কেউ আর পড়ে না । কফিহাউসে এতো কবি জড়ো হয়, প্রেমের কবিতা লেখে অথচ জানেই না আমি প্রেমকে কতো গুরুত্ব দিয়েছি, যদিও প্রেম আমাকে দিয়েছে গনোরিয়া । হাবশি প্রেমিকা আজায়েব খানুমকে আমার খুবই পছন্দ হতো । কলকাতায় এসে পঞ্চাশটা বিবিকে তালাক দিয়েছি, কেননা খরচে পোষায় না ।

চেঙ্গিজ খান : আর তোর বেগম হজরতমহল ?

ওয়াজেদ আলি শাহ : হজরতমহল লখনউতে থেকে গেল, ব্রিটিশদের সঙ্গে লড়াই করল । এখন যোগী নামে একজন মুখ্যমন্ত্রী হয়েছে অওধে, হয়তো জানে না যে আমি যোগী-মেলা করতুম, যাতে সবাই গেরুয়া পোশাক পরে আসতো । শাসন করার জন্যে একটা ম্যানুয়াল লিখেছিলুম ‘দস্তুর-ই-ওয়াজিদি’ নামে । আমার ভাই সিকন্দর হাসমতের সম্মানে এক জলসার আয়োজন করেছিলুম। আমার লেখা নাটক ‘রাধা কানহাইয়া কা কিস্সা’ মঞ্চস্থ করেছিলুম। এই কিস্সাই  প্রথম আধুনিক উর্দু নাটক। কৃষ্ণ ছিল আমার রোল মডেল। যমুনাতীরে পূর্ণিমা রাতে গোপিনীদের সঙ্গে কৃষ্ণের লীলা আমার চিরকালীন অনুপ্রেরণা ছিল। জানেন তো কৃষ্ণের রাসলীলা থেকেই লখনউয়ে ‘রহস’-এর শুরু। আমার রহস আসলে অপেরা, যেখানে আমি ব্রজ অঞ্চলে কৃষ্ণের জীবন নিয়ে প্রচলিত নাচের সঙ্গে নিজের কত্থকের কম্পোজিশন মিলিয়েছিলুম। রহস নাটক হল নৃত্যনাট্য, যেখানে নির্দিষ্ট গল্প থাকত। লখনউয়ে নবাবির সময় আমি মোট চারটে জলসার আয়োজন করেছিলুম, আর মেটিয়াবুরুজে এসে অন্তত তেইশটা ।  মেটিয়াবুরুজে এসে নিয়মিত ‘রাধা কানহাইয়া কা কিস্সা’ মঞ্চস্থ করেছি,  আরও পরিণত। আল-হিন্দে আসার আগে ফিরিঙ্গিগুলো ঠোঁটে চুমু খেতে জানতো না, এতোই অশিক্ষিত লোকগুলো ।

ঢ্যাঙা তুগলক  : আচ্ছা, আপনার বিরিয়ানিতে আলু দেন কেন ? হায়দ্রাবাদের বিরিয়ানিতে তো দেয় না।

তোতলা তুগলক : বারন করলুম, এরা কথা শোনে না ।

ওয়াজিদ আলি শাহ : জানো না বুঝি ? আমার এক ব্যাটা বাবুর্চিকে হায়দ্রাবাদের নিজাম অনেক ঘুষ দিয়ে নিজের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল বিরিয়ানি খাবে বলে । ওরা হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি আরম্ভ করে দিলে । আমি তাই বাঙালি বিরিয়ানি চালু করে দিলুম । বাঙালিরা আলু খেতে ভালোবাসে । ব্যাস, বাংলার বিরিয়ানি মানে আস্ত একখানা আলু তোমার প্লেটে পড়বে । নিজাম আমার পোলাও, কোর্মা, জর্দালু, রোগনি রোটি, হালিম, রেজালা, শিরমল আর শাহি টুকরার রেসিপিও চুরি করে নিয়ে গেছে ।

মলিকা কিশওয়ার জনাব-ই আলিয়া : আসার সময়ে রাস্তায় খুব ভিড় দেখলুম । আজকে তো মহররম নয় ।

ভাস্কো দা গামা : সালমান খান নামে একজন ফিল্মস্টারের ফিল্ম রিলিজ হচ্ছে আজ, তাই ওয়াজিদ আলি শাহের বংশধররা  সালমান খানের পোস্টার নিয়ে নাচতে-নাচতে মিছিল করছে । সালমান খানের মা হিন্দু আর বাবা মুসলমান । প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডেও একই রকম ভিড়ের জমায়েত হয়েছে । ওখানে টিপু সুলতানের বংশধররা থাকে । এখন বেশ গরিব হয়ে গেছে বংশের লোকগুলো, কেউ-কেউ রিকশা চালায় । 

বাবর : ইব্রাহিম লোদি, যে পানিপতের যুদ্ধে আমার কাছে হেরে গিয়েছিল, তার বাবা সিকন্দর লোদির মা হিন্দু ছিল। মানে কাফের ছিল ।  ওর মা ছিল সিরহিন্দের একজন হিন্দু স্যাকরার মেয়ে । সিকন্দর লোদি সেই জন্যে ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভুগতো, আর হিন্দুদের ওপর অত্যাচার করত। অথচ গুলরুখি ছদ্মনামে সিকান্দার লোদি ফারসি কবিতা চর্চা করত ।

ওয়াজেদ আলি শাহ : আচ্ছা, আমি চলি । ফিরতে হবে সিবতানাবাদ ইমামবাড়ায় আমার গোরে। অম্মিজানকে  ফেরত গিয়ে গোরে আরাম করতে হবে । শুনে ভালো লাগলো যে মোগলদের আগে থেকেই নবাব-সুলতানরা হিন্দু মেয়ে বিয়ে করত । আমি সঙ্গে করে অনেক কাফের মেয়েকেও এনেছিলুম । যাদের এনেছিলুম, তাদের বংশধররা এখন খিদিরপুর, মেটেবুরুজ, গার্ডেনরিচ, বটতলা, বাধাবরতলায় রাজত্ব করে।  এখনকার নেতাদের কাছে ওদের খুব নাম ডাক । 

শাহজাহান : তোমার সঙ্গে কাদের এনেছো ?

বাবর : তোর বেগমকে আনতে পারতিস সঙ্গে করে ।

ওয়াজিদ আলি শাহ : জানো না বুঝি ? তোমরা তো অনেক আগে মারা গেছ তাই জানো না । আমার বেগম হজরতমহল আমি কলকাতায় নির্বাসিত হয়ে আসার  পর  অওধের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নিয়েছিল। মহাবিদ্রোহের সময় আমার বেগমও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। তবে শেষ পর্যন্ত হেরে গিয়ে  নেপালে আশ্রয় নিয়েছিল। কাঠমাণ্ডুতেই মারা গেল । আমার যাওয়া হয়নি । কলকাতা ছেড়ে ইংরেজরা আমাকে কোথ্থাও যেতে দিতে চায়নি । ওর কবর কাঠমান্ডুর একেবারে মাঝখানে জামে মসজিদের কাছে ।

মলিকা কিশওয়ার জনাব-ই আলিয়া : সিকন্দর লোদির মা হিন্দু ছিল ? তাও কোনো রাজকন্যা নয় । গরিব স্যাকরার মেয়ে ! কীক্কাণ্ড !

স্লাভয় জিজেক : আমিও যাই । একটা বিতর্কসভায় অংশ নিতে হবে । এদেশে তো বিনা পয়সায় ইনটারভিউ দিতে হয় ; বক্তৃতা দেবারও টাকা পাওয়া যায় না । লিটল ম্যাগাজিন ছাড়া কেউ আমার আলোচনা করে না ; শুধুমুদু কফিহাউসে বসে গ্যাঁজায় ।

শাহজাহান : আরে, ওয়াজিদ আলি শাহ, তুমি চললে ? আমি কফিহাউসে ঢোকার মুখে শুনলুম, তুমি এসেছো, তাই ওপরে উঠে এলুম । তোমার অবদান তো তুলনাহীন । মোগলরা তোমার কাছে খুবই তুচ্ছ । তোমার মেটিয়াবুরুজের দরবার যন্ত্রসংগীতেও তুলনাহীন। ‘তারিখ-ই-পরিখানা’-য় তুমি লিখেছ,  বিখ্যাত সেতারি কুতুব আলি খানের কাছে সেতার শিখেছিলে । সেনি ঘরানার ওস্তাদ বসত খান মেটিয়াবুরুজে রবাব নিয়ে এসেছিলেন । সুরশৃঙ্গারও তাঁরই আনা, শুনেছি তুমি এই যন্ত্রটাকে পপুলার করেছিলে।  বিখ্যাত বিনকার ও রবাবিয়া কাসিম আলি খান তোমার আসরে আসতেন। তোমার ডাকে কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়  সুরবাহার বাজিয়েছিলেন। তোমার দরবারেই  ওস্তাদ নিয়ামতুল্লা খান আধুনিক সরোদ সৃষ্টি করেন। এগারো বছর উনি তোমার  কাছে ছিলেন। তুমি তবলাকেও এ শহরে জনপ্রিয় করেছো। সানাই, এসরাজের সঙ্গেও জড়িয়ে তোমার নাম। ইউ আর গ্রেট ।

ভাস্কো দা গামা : আর এখন ওনার আর টিপুর বংশধররা বলিউডের গান-বাজনা করে, মাঝরাস্তায় নাচে।  ফিল্মের নায়কদের পোস্টার নিয়ে মিছিল করে । ওনাদের পোস্টার নিয়ে বেরোয় না কেউ ।

ওয়াজেদ আলি শাহ : শাহবুদ্দিন মুহাম্মদ শাহ জাহানদাদা, আপনি যা-যা করে গেছেন তা হাজার বছরের বেশি থাকবে। এখানকার মানুষ মোগলদের মনে রাখবে আপনার জন্যে । আপনি প্রেমিক হিসেবেই জগতজুড়ে খ্যাতি পাবেন।  আচ্ছা, আমি চলি, অম্মিজান, উঠে পড়ো । ওই দেখুন, আওরঙজেব ঢুকছে, নিশ্চয়ই শুনেছে আজকে চেঙ্গিজ খান, ল্যাঙড়া তৈমুর, বাবর সবাই কফিহাউসে জড়ো হবেন জবরদস্ত আড্ডা দেবার জন্য ।  যাকগে, আমি কেটে পড়ি । 

আওরঙজেব : কী রে ওয়াজিদ আলি শাহ, তুই চললি ? যা, যা । এখানে যাঁরা রয়েছেন তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন আমার নাম আল-সুলতান আল-আজম ওয়াল খাকান আল-মুকাররম আবুল মুজাফফর মুহি উদ-দিন মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব বাহাদুর আলমগীর, বাদশা গাজী, প্রথম আলমগীর । আমি গান-বাজনা একদম পছন্দ করি না, তাই ওয়াজিদ আলি শাহ কেটে পড়ছে । ব্যাটা সোজা জাহান্নমে যাবে । আব্বাহুজুর আবার প্রেমিক ? ইয়ার্কি মারার জায়গা পাসনি ওয়াজেদ আলি শাহ । নিজের ভাইদের খুন করা ওনার কাছেই শিখেছিলুম । উনি শাহরিয়ার চাচাকে খুন করেছিলেন । দশ হাজার পর্তুগিজকে কচুকাটা করেছিলেন আর বাদবাকি পর্তুগিজদের আস্তিকান্তরিত করেছিলেন ।

ওয়াজেদ আলি শাহ : আমার সম্পর্কে বলছেন ? জানি, জানি । এখন  হারিয়ে গিয়েছে মেটিয়াবুরুজের সেই গৌরব। আজকের মেটিয়াবুরুজ শুধুই এই শহরের কোণে পড়ে থাকা শিয়াদের থাকার জায়গা। গরিব দর্জিদের কাজের জায়গা। খিদিরপুর ডকের ঠিক পাশে হওয়ায় ক্রিমিনাল এলাকা হিসেবেই কুখ্যাত। এই শহরের অন্য অংশের বাসিন্দারাও ওই অঞ্চলে যাওয়ার কোনও কারণ খুঁজে পায় না। আর আমাকে ?  মনে রেখেছে  শুধু আওধি বিরিয়ানি আর  অসংখ্য বেগমের জন্য। অথচ এই মেটিয়াবুরুজের ভেতরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আমার তৈরি ইতিহাস। নবাবি আমলের কোনো স্থাপত্য বা তার ছিটেফোঁটা কোনো কিছুই আর রাস্তার দু’ধারে চোখে পড়বে না, যদিও মেটিয়াবুরুজকে বলা হতো দ্বিতীয় লখনউ । দূর থেকে ইমামবাড়ার বিশাল ফটক নজরে পড়বে।  ইরান থেকে শিল্পী আনিয়ে  ইমামবাড়া তৈরি করিয়েছিলুম। বিশাল ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলেই প্রথমেই খোলা চত্বর। তারপর খোলা বারান্দা পেরিয়ে ইমামবাড়ার মূল বিল্ডিঙ।বারান্দা পেরিয়ে নামাজঘরে প্রবেশ করলে বাঁ দিকে গ্রিলঘেরা একটি অংশে আমি শুয়ে আছি । মেঝেতে কালো পাথরে আমার কবর  । বাইরে দেয়ালে শ্বেত পাথরে খোদাই করে আমাদের বংশতালিকা টাঙানো। প্রতিবছর আমার মৃত্যুর দিনে অনুষ্ঠান হয়, তখন আমার বংশধররা আসে। 

ভাস্কো দা গামা : ওয়াজিদ আলি শাহ, আপনি শিয়া, তার ওপর হিন্দু দেবতা শ্রীকৃষ্ণের গুণগান করেন, তাই আওরঙজেব আপনাকে পছন্দ করেন না ; আপনাকে নাস্তিক মনে করেন ।

মালিক অম্বর : এই আওরঙজেব লোকটা আমার করা সবকিছু নিজের নামে করে নিয়েছে । খিড়কি শহর তৈরি করেছিলুম আমি,  অথচ এই লোকটা তার নাম অওরঙ্গাবাদ করে নিয়েছে । শহরে জলের ব্যবস্হা করেছিলুম আমি, তাও লোকটা নিজের নামে করে নিয়েছে ।

আওরঙজেব : তুই তো হাবশি, এতো হামবড়াই কেন রে ? পড়তিস ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খলজির পাল্লায়, ঠেলা বুঝতে পারতিস ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খলজি লোকটা কে ? বাবরও বলছিল একটু আগে।

আওরঙজেব : আরে, উনি আমার হিরো ।  তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজি নালন্দা মহাবিহার পুরো ধ্বংস করে দিয়েছিল ; এই ঘটনা আল-হিন্দে শুধু বৌদ্ধ ধর্মেকে শেষ করে দিয়েছিল।  আল-হিন্দকে দীর্ঘমেয়াদে অজ্ঞানতার অন্ধকারে ছুঁড়ে দেবার নীল নকশা বলা যায়। ইরানের ইতিহাসবিদ মিনহাজ  ‘তাবাকাত-ই-নাসিরি’ বইতে লিখেছেন যে, “হাজার হাজার বৌদ্ধ পুরোহিতকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল কিংবা মাথা কেটে ফেলা হয়; খিলজি এভাবে এই অঞ্চল থেকে বৌদ্ধধর্ম উৎপাটন করে ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে, মহাবিহারের লাইব্রেরিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে এত পরিমাণ বই ছিল যে তা পুড়তে তিন মাস সময় লেগেছিল”। নালান্দা ছাড়াও বিক্রমশীলা, জগদ্দল, ওদান্তপুর, তক্ষশীলা বৌদ্ধবিহার ছাড়া নদীয়া, গৌড়, লক্ষণাবতীও পুড়িয়ে ছারখার করেছিল। খিলজির সেনাবাহিনী এইসব প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়, স্থাপনা, মন্দির, লাইব্রেরি, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আশ্রম ধ্বংস করে পুরোপুরি ধুলোয় মিশিয়ে দেয়, আগুনে পুড়িয়ে দেয়। লোকাল হিন্দু, বৌদ্ধরা প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে হাজারে হাজারে পালিয়ে যায় নেপালে, তিব্বতে, আল-হিন্দের অন্যান্য জায়গায় যে যেমন পেরেছে। যারা পালাতে পারেনি তারা সবাই নির্মমভাবে হত্যার শিকার হয়েছিল বখতিয়ার বাহিনীর তরোয়ালের আঘাতে। 

তোতলা তুগলক : কিকিকিকিছুই বুবুবুবুঝি না ।

মালিক অম্বর : তাহলেই বুঝুন । এরকম একজন লোক ওনার হিরো ।

আওরঙজেব : তুই তো আস্তিক । তাহলে অবজেকশান নিচ্ছিস কেন ? জানিস কি দিল্লীর সাহায্য নিয়ে  বখতিয়ার খলজি তার সেনাবাহিনী বড় করে বাংলায় পৌঁছোয় । বাংলার সেই সময়ের বুড়ো শাসক লক্ষ্মণ সেনের রাজ্য আক্রমণ করে।  মাত্র আঠারো জন  অশ্বারোহী যোদ্ধা  ঘোড়া বিক্রেতার ছদ্মবেশে  লক্ষ্মণ সেনের রাজপ্রাসাদে ঢুকে পড়ে। ভোগ বিলাসে মত্ত থাকা লক্ষ্মণ সেন তখন সবে দুপুরের আহার করতে বসেছে, এই সময়ে অতর্কিত আক্রমণে সে কোন রকম বাধা না দিয়েই   পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যায়। ইতিমধ্যেই পৌঁছে যায় তার বাকি সৈন্যরা । গৌড়, লক্ষণাবতী দখল করে বখতিয়ারের সেনাবাহিনী মেতে ওঠে রক্তের হোলি খেলায়। প্রাসাদের  সব পুরুষদের খুন করে, শিশুদের আলাদা করা হয় দাস হিসেবে বেচার জন্য, আর প্রতিটি নারীকে গণধর্ষণ করে । বুঝলি, বোকা মালিক অম্বর,  ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খলজির জন্যেই লক্ষ-লক্ষ বাঙালি আস্তিকান্তরিত হয়েছিল । নইলে আজকের বাংলাদেশ রাষ্ট্র হতে পারতো না ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : একটু আগে  ধৃতরাষ্ট্রদেব শর্মা নামে একজন মহারাজা এসেছিলেন । তিনি জন্মান্ধ । আল-হিন্দে জন্মান্ধ হয়েও যদি মহারাজা হওয়া যায়, তাহলে মোগলরা সম্রাট হবার জন্যে প্রতিদ্বন্দ্বীদের অন্ধ করে দিত কেন ?

বাবর : ধর্মের নিয়ম, তোমার সময়ে বোধহয় ছিল না । হুমায়ুনকে বলেছিলুম, ভাইদের কোনো ক্ষতি করিসনি । তবু হুমায়ুন সৎভাই কামরান মির্জাকে অন্ধ করে দিয়েছিল । অনেক বউ ছিল কামরানের, গুলরুখ বেগম, মুহতারিমা খানুম, হাজারা বেগম, মিহর আফরোজ বেগা, দৌলত বখত আগাছা, মাহ চুচাক বেগম আর আবদুল্লাহ খান মুঘলের এক বোন; ছেলেপুলেও ছিল । কে জানে তাদের কী হলো শেষমেষ ।

চেঙ্গিজ খান : তুমি এদেশে না আসলে ছেলেটা অন্ধ হতো না, বউগুলোও বেওয়ারিশ হতো না ।

বাবর : আমার রক্তের দোষে শাহ আলমকেও অন্ধ করেছিল রোহিলার শাসক । ইংরেজ গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস, মোগল বাদশা শাহ আলমকে বাংলার রাজস্বের পরিমাণ দিতে অস্বীকার করেছিল। এই  অবমাননার চেয়েও বেশি অপমান করেছিল  রোহিলা শাসক গোলাম কাদির । লাল কেল্লার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই গোলাম কাদির শাহ আলমকে তার জায়গায় সিংহাসনে বসিয়ে দিয়েছিল আরেকজন রাজপুত্রকে। শাহ আলমের ছেলে আর নাতিসহ রাজকীয় রক্তের রাজকুমারীদের ছেঁড়া পোশাক পরে রোহিলার সেনাদের সামনে নাচতে বাধ্য করা হয়েছিল । সম্রাট শাহ আলমের হারেমের মেয়েদের ছিনতাই করা হয়েছিল, আর ধর্ষণ করা হয়েছিল । মালিকা-ই-জামানী, আগের সম্রাটের এক প্রবীণ বিধবা, তাকে গরম রোদে ল্যাঙটো করে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। রোহিলা ব্যাটা শাহ আলমের বুকে  চেপে বসে,দুটো  চোখ ছুরি দিয়ে উপড়ে অন্ধ করে দিয়েছিল । তবে এই কাজটা রোহিলার জন্য ছিল মৃত্যুদণ্ডের শামিল । মারাঠা সেনাপতি, মহাদজি সিন্ধিয়া  বিশাল বাহিনী দিল্লিতে নিয়ে গিয়েছিলেন ।  গোলাম কাদির পালাতে গিয়ে খুব শীঘ্রই  মথুরায় বন্দি হল। একটা খাঁচায় ঢুকিয়ে, তার কান, নাক, ঠোঁট আর পা কেটে ফেলা হয়েছিল । শেষে, শাহ আলম, যার রাজত্বকালে মোগলরা তাদের চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকার হারিয়েছিল, গোলাম কাদিরের চোখের মণিসুদ্দু  সর্বশেষ উপহার পেলো। 

জাঁ দুভাল : আপনাদের টেবিলে কোনও মহিলা নেই, তবুও এলুম ; হাবশিদের সম্পর্কে অবমাননাকর কথা বলছেন দেখে আর সইতে পারলুম না ।

চেঙ্গিজ খান : কিন্তু তুমি কে ? আগে তো চোখে পড়োনি ? 

শাহজাহান : উনি তো বিখ্যাত একজন প্রেমিকা, জানেন না ওনাকে ? শার্ল বোদলেয়ার ওনার চুল নিয়ে একখানা দারুন প্রেমের কবিতা লিখে গেছেন ।

বাবর : চুল নিয়ে ? কোথাকার চুল ?

শাহজাহান : আমি বালের কথা বলছি না সম্রাটদাদু । আমি মাথার চুলের কথা বলছি । তবে পুরন্দর ভাট নামে আল-হিন্দের এক বিখ্যাত কবি  বাল নিয়ে কবিতা লিখেছেন, যেমন .

 “এবে শোন শালা পুলিশ পুঙ্গব

আঁটি-বাঁধা কোঁকড়ার ঝাঁট

মোরা তোরে ডরাই থোড়াই

বলে কবি পুরন্দর ভাট”

বাবর : দারুন লিখেছে ।

শাহজাহান : বাল নিয়ে পুরন্দর ভাটের আরও কবিতা শোনাই, বাল নিয়ে, শুনুন—

. “ঘনাইছে মহাকাল

চুল,… বলো বাংলায়

হিন্দিতে হল বাল… ।

রান্নাঘরের ধনে

হিন্দিতে ধনিয়া

কত ধানে কত চাল

বোঝো ঢনঢনিয়া।”

বাবর : দারুন লিখেছে । শাহি তিজোরি খালি করে ইনাম দিয়ে দাও ।

ভাস্কো দা গামা : হাবশিদের বালও দারুণ হয় । যেমন ওদের মাথার চুল, তেমনই ওদের বাল । আরব কাস্টমাররা তো বালের জন্যে ওদের ধরে আনতে বলতো । তবে আপনি নাস্তিককে আস্তিকান্তরিত করার পরও তার বাল একই থাকে । পুরন্দর ভাট বোধহয় হাবশিদের আর মোগল বেগমদের বাল দেখার সুযোগ পাননি। আঠারো শতকে সারাহ বার্টম্যান নামে বাইশ বছরের এক হাবশি যুবতীকে আফরিকা থেকে কিনে ইউরোপে নিয়ে গিয়ে হটেনটট ভেনাস নাম দিয়ে এগজিবিশান করেছিল, তা জানেন কি ? চার ফিট লম্বা মেয়েটার পোঁদ তানপুরার চেয়েও অনেক উঁচু ছিল, কোঁচকানো বালে ঢাকা যোনিও বড়ো, আর মাইও বিশাল মাপের । ইউরোপীয়রা অমন পোঁদ, যোনি আর মাই আগে কখনও দ্যাখেনি । প্রায়-উলঙ্গ মেয়েটাকে দেখার জন্যে লাইন লেগে যেতো। হেনড্রিক সিজারস আর আলেকজান্ডার ডানলপ বার্টম্যানকে আফরিকা থেকে লন্ডনে নিয়ে আসে।   সারাহ বার্টম্যানকে , হেনড্রিক সিজারস আর আলেকজান্ডার ডানলপ অবৈধভাবে এনেছিল দুটো আফ্রিকান  ছেলের সঙ্গে, সম্ভবত কেপটাউনের দাস-বাজার থেকে । এগজিবিশান করে টাকা রোজগার করতো ওরা । তারপর ডানলপ পিক্যাডিলি সার্কাসের মিশরীয় হলে বার্টম্যানের এগজিবিশান করেছিল । ডানলপ ভেবেছিল যে লন্ডনবাসীদের অমন পোঁদ আর মাইয়ের আফ্রিকান যুবতীদের সাথে পরিচিতি না থাকায় এবং বার্টম্যানের  বড় বড় নিতম্বের কারণে ও অঢেল টাকা রোজগার   করতে পারবে, করেওছিল । লোকেরা মেয়েটাকে দেখতে যেতো মানুষ  হিসাবে নয়, বরং প্রাকৃতিক বিশ্বের এক অংশের অদ্ভুত যৌন উদাহরণ হিসেবে।

চেঙ্গিজ খান : সত্যি ?

ভাস্কো দা গামা : হ্যাঁ । ১৮১৫ সালে সারা বার্টম্যান মারা যায়, তবে তার বডির এগজিবিশান  অব্যাহত ছিল। তার মস্তিষ্ক, কঙ্কাল আর যৌনাঙ্গ ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত প্যারিসের যাদুঘরে প্রদর্শিত হতো । বেঁচে থাকতে তাকে ইউরোপে নানা জায়গায় -হাফ-উলঙ্গ প্যারেড করানো হয়েছিল, তার বিশাল পাছা দেখার জন্য জনতার ভিড় জমে যেতো । আজ তাকে বহু লোক ঔপনিবেশিক শোষণ আর বর্ণবাদ, কৃষ্ণাঙ্গদের উপহাস এবং পণ্যদ্রব্য উপস্থাপক হিসাবে দেখে । তার সঙ্গে অনেকে যৌন সম্পর্ক করে থাকবে, কেননা মেয়েটি সিফিলিসে মারা গিয়েছিল ।

শাহজাহান : জাঁ দুভালবেগম , তুমি চুলের কবিতাটা শোনাও । আমার দরবারে কতো কবি ছিল, কেউ কখনও বাল আর চুল নিয়ে কবিতা লেখেনি ।

চেঙ্গিজ খান : আরে, ওই তো ভাইপো আকবর, বালের শায়রি শুনছিলিস ! সঙ্গে ওই মেয়েটা কে ?

রূপমতি : আমার নাম রূপমতি । প্রেমিকের জন্যে আমি জীবন দিয়েছি । প্রেম নিয়ে কথা হচ্ছে দেখে আর জাঁ দুভালকে এই টেবিলে দেখে, এলুম ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : আচ্ছা, প্রেম নিয়ে এতো কথা হচ্ছে, কিন্তু ব্যাপারটা কী ? কী করে প্রেম দিয়ে ? তার সঙ্গে বালের আর চুলের কী সম্পর্ক ।  

জাঁ দুভাল : আমার প্রেমিক শার্ল বোদলেয়ারের প্রেম । উনি শায়র ছিলেন । আমার চুল নিয়ে কবিতা লিখেছেন ।

শাহজাহান : আমি শোনাচ্ছি শায়রিটা, খুবই উমদা, দিল খুশ হয়ে যাবে ।

“আমাকে তোমার চুলের দীর্ঘ, দীর্ঘ সুগন্ধ নিতে দাও, ঝর্ণার জলে পিপাসার্তের মতন আমার মুখকে সম্পূর্ণ ডুবে জেতে দাও, সুবাসিত রুমালের মতন হাতে নিয়ে খেলতে দাও, বাতাসে স্মৃতিকে উড়িয়ে দিতে দাও ।

আমি যাকিছু দেখি তা তুমি যদি জানতে — যাকিছু আমি অনুভব করি — তোমার চুলে যাকিছু আমি শুনতে পাই ! অন্য লোকেদের আত্মা সঙ্গীতের প্রভাবে যেমন ভ্রমণে বেরোয় তেমনই আমার আত্মা ভ্রমণে বেরোয় এই সুগন্ধে।তোমার চুলে রয়েছে একটি পুরো স্বপ্ন, পাল আর মাস্তুলসহ ; তাতে রয়েছে বিশাল সমুদ্র, যেখানে অগুনতি মৌসুমীবায়ু আমাকে বয়ে নিয়ে যায় মোহিনী আবহাওয়ায়, যেখানে আকাশ আরও নীল আর আরও নিগূঢ়, যেখানে বাতাবরণকে সুগন্ধিত করে তুলেছে ফল, পাতা, আর মানুষের ত্বক।

তোমার চুলের সাগরে, আমি দেখতে পাই দুঃখী গানে সমাহিত বন্দর, সব কয়টি দেশের কর্মঠ মানুষ সেখানে, যতো রকম হতে পারে ততো ধরণের জাহাজ, বিশাল আকাশের অলস শাশ্বত তাপের পৃষ্ঠভূমিতে তাদের স্হাপত্য দিয়ে দিগন্তকে তনূকৃত ও জটিল করে তুলেছে।

তোমার চুলের সোহাগস্পর্শে আমি কাউচে শুয়ে কাটানো দীর্ঘ ধীরুজ সময়কে ফিরে পাই, সুন্দর জাহাজের একটি ঘরে, বন্দরের অনির্ণেয় ঢেউয়ের দ্বারা ক্রমান্বয়ে দোল খাওয়া, তাজা জলের জালা আর ফুলের টবের মাঝে ।

আগুনের পাশে রাখা কম্বলের মতন তোমার চুলে, আমি আফিম আর চিনির সঙ্গে মেশানো তামাকের শ্বাস নিই ; তোমার চুলের রাত্রিতে, আমি দেখতে পাই অসীম ক্রান্তিবৃত্তের নীলাভ ঔজ্বল্য; তোমার চুলের ঢালের কিনারায়, আমি আলকাৎরা, মৃগনাভি আর নারিকেল তেলের গন্ধে মাতাল হয়ে যেতে থেকি ।

আমাকে একটু-একটু করে খেয়ে ফেলতে থাকে তোমার তন্দ্রাতুর কালো বিনুনি । যখন তোমার স্হিতিস্হাপক, দ্রোহী চুল আমি চিবোতে থাকি, আমার মনে হয় আমি স্মৃতিগুলো খেয়ে ফেলছি।”

বাবর : দারুন লিখেছে । আমিও চুল ভালোবাসতুম । যে বেগমের যতো চুল ততো সে চুলবুলি !

ল্যাঙড়া তৈমুর : কিন্তু প্রেম ব্যাপারটা খোলসা করলে না তো ?

জাঁ দুভাল : প্রেম হল ভালোবাসার সাথে সম্পর্কিত একটি উত্তেজনাপূর্ণ, যৌনতাপূর্ণ এবং রহস্যময় অনুভূতি। এটি হল কোন ব্যক্তির প্রতি যৌন আকর্ষণের সাথে সম্পর্কিত কোন আবেগীয় আকর্ষণ হতে উদ্বুদ্ধ একটি বহিঃপ্রকাশমূলক ও আনন্দঘন অনুভূতি। গ্রিক চারটি আকর্ষণের মধ্যে এটি আগেপ, ফিলিয়া কিংবা স্টরজ-এর তুলনায় ইরোসের সঙ্গে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। মনোবিজ্ঞানী চার্লস লিন্ডহোমের সংজ্ঞানুযায়ী প্রেম হল এক প্রবল আকর্ষণ যা কোন যৌন-আবেদনময় দৃষ্টিকোণ হতে কাউকে আদর্শ হিসেবে তুলে ধরে, এবং যাতে তা ভবিষ্যতে দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার মনোবাসনাও অন্তর্ভুক্ত থাকে। কোন সম্পর্কের ক্ষেত্রে এতে অপর ব্যক্তির প্রতি একইসাথে শক্তিশালী মানসিক এবং যৌন আকর্ষণ কাজ করে। প্রেমের সম্পর্কে যৌনতার তুলনায় ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি অধিক গুরুত্বের অধিকারী হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্পর্কসমূহের সূচনাপর্বে প্রেমের অনুভূতি অধিকতর দৃঢ়ভাবে কাজ করে। তখন এর সঙ্গে এমন এক অনিশ্চয়তা এবং দুশ্চিন্তা অনুভূত হয়  যে এ ভালোবাসা হয়তো আর কখনো ফিরে নাও আসতে পারে।

তোতলা তুগলক : বুবুবুবুঝতে পাপাপারলুম না কিকিকিকিছুই ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : ওহ, আমার তো এরকম হয়নি, তাই জানি না । রোজই তো আলাদা একটা মেয়ের সঙ্গে শুয়েছি। একজনের সঙ্গে দিনের পর দিন চালিয়ে যাওয়াটা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না, কেমন যেন রেশনকার্ড নিয়ে রেশন তোলার মতন একঘেয়ে । যৌনতা ব্যাপারটা খোলোসা করলে ভালো হতো, জাঁ দুভালবেগম ।

জাঁ দুভাল : যৌনসঙ্গম, মানে যৌনমিলন, সঙ্গম, মৈথুন, রতিক্রিয়া, রতিমিলন; যৌন সংসর্গ, যৌন সহবাস, সহবাস এটসেটরা হলো একটি জৈবিক প্রক্রিয়া যা দ্বারা মূলত যৌনআনন্দ বা প্রজনন বা উভয় ক্রিয়ার জন্য একজন পুরুষের উত্থিত শিশ্ন একজন নারীর যোনিপথে অনুপ্রবেশ করানো ও সঞ্চালনা করাকে বোঝায়। অন্যান্য অন্তর্ভেদী যৌনসঙ্গমের মধ্যে রয়েছে পায়ুসঙ্গম, মানে লিঙ্গ দ্বারা মলদ্বারে অনুপ্রবেশ, মুখমৈথুন, অঙ্গুলিসঞ্চালন , মানে আঙ্গুল দ্বারা যৌন অনুপ্রবেশ, যৌনখেলনা ব্যবহার দ্বারা অনুপ্রবেশ, মানে বন্ধনীযুক্ত কৃত্রিম শিশ্ন । এই সব কাজকারবার মানুষেরা দুই বা তার বেশিজনের মধ্যে শারীরিক ও মানসিক অন্তরঙ্গতা জনিত পরিতোষ লাভের জন্য এবং সাধারণত মানব বন্ধনে ভূমিকা রাখতে সম্পাদিত হয়ে থাকে। যৌনসঙ্গম বা অপরাপর যৌনকর্ম কীভাবে সংজ্ঞায়িত হয় তা নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে, যা যৌনস্বাস্থ্য বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গিগুলোর উপর প্রভাব রাখতে পারে। যদিও যৌনসঙ্গম, নির্দিষ্টভাবে মৈথুন বলতে সাধারণত শিশ্ন-জরায়ুজ অনুপ্রবেশ ও সন্তান উৎপাদনের সম্ভাব্যতাকে নির্দেশ করা হয়, এর দ্বারা সাধারণভাবে অন্তর্ভেদী মুখমৈথুন ও বিশেষত শিশ্ন-পায়ুজ সঙ্গমকেও নির্দেশ করা হয়। এটি সাধারণত যৌন অনুপ্রবেশকে নির্দেশ করে, যেখানে অননুপ্রবেশকারী যৌনতাকে “বহির্সঙ্গম” নামে নামকরণ করা হয়, কিন্তু অনুপ্রবেশকারী যৌনকর্মকে যৌনসঙ্গম হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। 

বাবর : আরে জাঁ দুভালবেগম ! পায়ুসঙ্গম তো আমি অনেক করতুম । অটোবায়োগ্রাফিতে লিখেছি ।

জাঁ দুভাল : আরও আছে, শুনুন । যৌনতা বা ইংরেজি ভাষায় সেক্স, প্রায়শই যৌনসঙ্গমের একটি সংক্ষিপ্ত ব্যবহৃত রূপ, যা দ্বারা যে কোন প্রকারের যৌনক্রিয়াকে বোঝানো হতে পারে। যেহেতু এসকল যৌনকর্মের সময়ে মানুষ যৌনবাহিত সংক্রমণের সংস্পর্শের ঝুঁকিতে থাকতে পারে, নিরাপদ যৌনচর্চার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে, যদিও অনাভেদী যৌনতায় সংক্রমণ ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যহারে হ্রাস পেয়ে থাকে।বিভিন্ন আইনি বিধিমালা যৌনসঙ্গমের সামাজিক অনুমতিপ্রদানের জন্য বিভিন্ন আইন ও রীতিনীতির মাধ্যমে বৈবাহিক রীতির প্রবর্তন, প্রচলন ও সমর্থন করেছে এবং বেশ কিছু যৌনকর্মের বিপরীতে নিষেধাজ্ঞামূলক আইনকে স্থান দিয়েছে, যেমন বিবাহপূর্ব ব্যভিচার ও বিবাহপরবর্তী পরকীয়া, পায়ুকাম, পশুকাম, ধর্ষণ, পতিতাবৃত্তি, অপ্রাপ্তবয়স্কের সঙ্গে যৌনচর্চা ও অজাচার। ধর্মীয় বিশ্বাসও যৌনসঙ্গমসহ অন্যান্য যৌনাচার বিষয়ক ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে অন্যতম ভূমিকা পালন করে, যেমন কুমারীত্ব বিষয়ক সিদ্ধান্ত, অথবা আইনি বা সরকারী নীতিমালা সম্পর্কিত বিষয়াবলি। বিভিন্ন ধর্মভেদে ও একই ধর্মের বিভিন্ন বর্গভেদে যৌনতা সম্পর্কিত ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য পরিলক্ষিত হলেও কিছু বিষয়ে অভিন্নতা রয়েছে, যেমন ব্যভিচারের নিষেধাজ্ঞা।   

পাগলা তুগলক : কারেক্ট, আই অ্যাগ্রি ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : একটু আগে ধৃতরাষ্ট্রদেব শর্মা নামে একজন জন্মান্ধ মহারাজা এসেছিলেন । ওনার যৌন অভিজ্ঞতা থেকে যা বুঝলুম, অন্ধ হলেও যৌনসঙ্গম করতে অসুবিধে হয় না । ওনার বউ গান্ধারী যখন প্রেগনেন্ট তখন  ওনার সেবা করত একজন চাকরানি।  তার ছোঁয়ায় ওনার সেক্স চাগিয়ে ওঠে আর সেই  চাকরানিকে জড়িয়ে ধরেন। তারপর গান্ধারীর অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে চাকরানির সঙ্গে সেক্স করেন। এই সেক্সের ফলে চাকরানিও গর্ভবতী হয়। চাকরানির গর্ভে মহারাজা ধৃতরাষ্ট্রদেব শর্মার ঔরসে যুযুৎসুর জন্ম হয়। মহারাজা ধৃতরাষ্ট্রদেব শর্মার এলেম ছিল বলতে হবে ; একরাতের কাজেই প্রেগনেন্ট করে দিলেন । এখনকার ছোঁড়াছুঁড়িরা আইভিএফ করে বাচ্চা পাবার জন্যে কত্তো খরচ করে ।

জাঁ দুভাল : ওনাদের সময়ে তো যৌনরোগের ভয় ছিল না ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : যাক বাবা, আমাদের সময়ে রোগবালাই ছিল না । তোমার ছিল নাকি ? 

জাঁ দুভাল : হ্যাঁ, আমার হয়েছিল বোদলেয়ারের সিফিলিস আর গনোরিয়া থেকে, ও একগাদা মেয়ের সঙ্গে শুতো । অথচ ও আমাকেই দোষ দিয়ে বলতো যে আমি অনেকের সঙ্গে শুয়ে ওকে রোগটা ধরিয়েছি ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : এখন আর চিন্তা কীসের : এখন তো দুজনেই মরে অমর হয়ে গেছো ।

জাঁ দুভাল : আজকাল অনেকে যৌনরোগ বাধিয়ে অমর হয়েছে । আজ্ঞে হ্যাঁ, অনেকেই যৌনরোগের জন্যে বিখ্যাত । এক নম্বর জেসিকা অ্যালবাএই সুন্দরী হলিউড তারকার জেনাইটাল হারপিস রয়েছে যা তাঁর শরীরে সংক্রামিত হয় পার্টনার ডেরেক জেটারের থেকে। মারায়া ক্যারি, স্কারলেট জোহানসন থেকে শুরু করে হলিউডের বহু বিখ্যাত মহিলার শরীরেই যৌনরোগ সংক্রামিত করেছেন ডেরেক। দুনম্বর ভিক্টোরিয়া বেকহ্যাম, ডেভিড বেকহ্যামের পত্নী ও আক্রান্ত হার্পিসে। শোনা যায় অতীতের রকস্টার ভিক্টোরিয়া অনুগামীদের সঙ্গে যৌন মেলামেশা করেই এই রোগ ডেকে এনেছেন শরীরে।তিন নম্বর পল গগ্যাঁ, অবাধ যৌন সংসর্গ করে শেষমেশ সিফিলিসে মারা গিয়েছিলেন মাস্টার পেইন্টার পল গগ্যাঁ।চার নম্বর প্যারিস হিলটন, সুন্দরীর লাগামছাড়া জীবন তাঁর শরীরে হার্পিস সংক্রমণের কারণ। এর জন্য হিলটনদের উইল থেকে বাদ পড়েছে তাঁর নাম। পাঁচ নম্বর রবিন উইলিয়ামসএই প্রয়াত হলিউড অভিনেতা অল্প বয়সে প্রোটেকশন ছাড়াই বহু যৌন সংসর্গ করতেন। ওঁর বিরুদ্ধে জেনাইটাল হার্পিস সংক্রমণের অভিযোগ আনেন এক মহিলা যার মীমাংসা হয় আদালতের বাইরে। ছয় নম্বর আর্থার অ্যাশ, টেনিস কিংবদন্তি আর্থার অ্যাশ মারা গিয়েছিলেন এইডসে। একবার অসুস্থতার সময়ে, চিকিৎসার গাফিলতিতে এইড্‌স সংক্রামিত রক্ত তাঁর শরীরে যায়। সাত নম্বর ম্যাজিক জনসন, চিকিৎসকের গাফিলতিতে, ইঞ্জেকশনের একই সিরিঞ্জ ব্যবহারের ফলে এই প্রতিভাবান বাস্কেটবল খেলোয়াড়ের শরীরে এইড্‌স সংক্রমণ হয়। এই নিয়েই  বার্সেলোনা অলিম্পিকে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। আট নম্বর প্যামেলা অ্যান্ডারসন, স্বামীর সঙ্গে সঙ্গমের ফলে তাঁর শরীরে বাসা বেঁধেছিল হেপাটাইটিস সি। বহু বছর ধরে তিনি লড়াই করছেন এই রোগের বিরুদ্ধে। নয় নম্বরে চার্লি শিন,  হলিউড তারকা চার্লি শিন নিজে  ঘোষণা করেছেন তিনি এইচআইভি পজিটিভ এবং তা যৌন সংসর্গের কারণেই।

চেঙ্গিজ খান : আমি যখন আক্রমণে বেরোতুম তখন রোজই নতুন একজনের সঙ্গে শুতুম , সঙ্গে যে বউ থাকতো সে আপত্তি করতো না । কিন্তু আমার প্রথম বউয়ের জন্যে আমার খুবই টান আর মায়া ছিল । একবার আমার শাসনের আওতায় যারা এসেছে তারা অন্য যে কোনও জায়গার তুলনায় আমার অধীনে অনেক বেশী নিরাপদ, প্রগতিশীল, আর স্বাধীন ছিল। পৃথিবীর অন্যতম দূরদর্শী নেতা হিসাবে আমি নিজের শাসনামলে একটা দেশ, একটা ভাষা, ধর্মীয় আর রাজনৈতিক স্বাধীনতা, পোস্ট অফিস/পোনি সার্ভিস, লিখিত আইন ব্যবস্থা, টোল রোডের নেটওয়ার্ক আর অন্য অনেক নতুন জিনিষের গোড়াপত্তন  করেছিলুম, বুঝলি ল্যাঙড়া । তুই তো শুধুই ভাঙচুর করে নাম কামালি ।

শাজাহান : কলম্বাস নামে একজন লোকের দলবল প্রথমে নিজের দেশে এনেছিল রোগগুলো । পনেরো শতকের শেষের দিকে সমুদ্রে অভিযান করে, তখন ওর নাবিকদের হাইতি দ্বীপে প্যাসিওলা হয়েছিল, যাকে এখন বলে ফিরিঙ্গিরোগ , উপদংশ, গর্মি,  বা সিফিলিস  রোগ । ওরা  সংক্রামিত হয়ে ফিরিঙ্গি রোগের জীবাণু ইউরোপে নিয়ে গেল । ফরাসী সম্রাট অষ্টম চার্লস  ইতালি আক্রমণ করলে  ইতালিতে এই রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে । ফরাসি সৈন্য আর  তাদের সহযাত্রীরা এই রোগের জীবাণু সমস্ত ইউরোপে নিয়ে গিয়েছিল । ইউরোপ থেকে তা পৌঁছে গেলো এশিয়া আর আফরিকার উপনিবেশে ।

নোবিলিআত্মন : জানি, জানি । ফরাসি মেয়েরা বড্ডো গায়ে পড়া । আমি ফরাসিদেশে গিয়ে ব্রহ্মচারী ছিলুম।

জাঁ দুভাল : শুনলেন তো ? আমি উঠি তাহলে । আপনারা ম্যাসোচিস্টিক আর মিসোজিনিক গল্পগাছা বজায় রাখুন।

রূপমতি : উঠছ কেন জাঁ দুভালবেগম ? তুমি আমার আর বাজ বাহাদুরের প্রেমের গল্প শুনে যাও। আমি ছিলুম কাফের হিন্দু,  আর বাজ বাহাদুর মুসলমান । আপনারা তো  লায়লা-মজনু, শিঁরি-ফরহাদ, প্যারিস-হেলেন, রোমিও-জুলিয়েট, ইউসুফ-জোলেখা, সাবিত্রী-সত্যবান, রাধা-কৃষ্ণ — ওনাদের প্রেমের কাহিনি শুনেছেন, তাই আমার জীবনের ট্র্যাজেডির কথাও শোনাতে চাই ।

চেঙ্গিজ খান : বলো, বলো । রূপমতিবেগম । কফি হাউসে চিকেন পকোড়া পেলে ভালো হতো।

রূপমতি : বাজ বাহাদুর ছিলেন মান্ডুর শেষ স্বাধীন শাসক, তিনি বরাবরই সংগীতের খুব ভক্ত ছিলেন। একবার শিকারে বের হওয়ার পর বাজ বাহাদুর আমাকে দেখতে পান, আমি তখন ছাগল-ভেড়া চরাচ্ছিলুম আর বন্ধুদের সাথে খেলতে-খেলতে গান গাইছিলুম । আমাকে দেখে আর গান শুনে উনি আমাকে তাঁর সাথে রাজধানীতে যেতে অনুরোধ করেন।   নর্মদা নদী দেখা যায় এমন এক প্রাসাদে আমি থাকতে রাজি, এই শর্তে মান্ডু যাই । এভাবেই মান্ডুতে রেওয়া কুন্ড তৈরি হয়েছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে এই মুসলিম রাজপুত্রের সঙ্গে আমার  প্রেম ব্যর্থ হয়ে যায়। আপনি জালালুদ্দিন মোহম্মদ আকবর, মান্ডু আক্রমণ করে আমাকে আর  বাজ বাহাদুরকে বন্দী করার সিদ্ধান্ত নেন। আপনি আকবর, মান্ডু দখল করার জন্য আদম খানকে পাঠান । বাহাদুর ওর ছোট সেনাবাহিনী নিয়ে  মোকাবেলা করতে গিয়েছিল। আপনার বিরাট  সেনাবাহিনীর সাথে কোনও তুলনাই হয় না, মান্ডু খুব সহজেই হেরে যায় । বাজ বাহাদুর সাহায্যের আশায় চিত্তোরগড়ে  আশ্রয় নেয়। 

চেঙ্গিজ খান : আমার প্রথম বউও ভেড়া, গোরু, ঘোড়া চরাতো । 

রূপমতি : আমার গল্পটা শুনুন, মাঝখানে কথা বললে রেশ কেটে যায় ।আদম খান লোকটা বজ্জাত।  মান্ডু আসার সাথে সাথে আমাকে দেখে ফাঁদে ফেলে আটক করার চেষ্টা করেছিল । ওর ফন্দি ছিল আমাকে তুলে নিজের হারেমে নিয়ে যাবে । কিডন্যাপিঙ এড়ানোর জন্য আমি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করি, আর এভাবেই আমাদের  প্রেম নষ্ট হয়ে যায় ।  সুলতান আমাকে হিন্দু আর মুসলমান দুই রীতিতেই বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের পর  বাজ বাহাদুর আর আমার  সুখের সংসার ভালোই চলছিলো। শিল্পপ্রেমী বাজ বাহাদুরের অন্য সুলতানদের সাথে ভালোই সম্পর্ক। তাই নির্ভাবনায় শিল্পসাধনায় আমাদের জীবন সুখেই কাটছিলো। আমার প্রশংসা ছড়িয়ে পড়লো সারা আল-হিন্দে। সম্রাট আকবর, আপনার কানেও গেল। আপনি বাজ বাহাদুর আর আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন দিল্লির দরবারে। বাজ বাহাদুর  আমন্ত্রণ রক্ষা করলেন। আমি গান গেয়ে শোনালুম । কয়েকদিন দিল্লিতে থেকে বাজ বাহাদুর আমাকে নিয়ে ফিরে এলো মান্ডু। কিন্তু আপনি আকবর, কিছুতেই ভুলতে পারেননি আমাকে আর আমার গান। আপনি ভাবলেন কোথাকার কোন এক ছোট-খাট সুলতান বাজ বাহাদুর, তার কাছে আমি কেন থাকবো ! আপনি সেনাপতি আদম খানকে হুকুম করলেন বাজ বাহাদুরকে মেরে আমাকে তুলে নিয়ে আসতে। আমি যখন খবর পেলুম বাজ বাহাদুর হেরে গেছেন , আর আদম খান আমাকে ধরতে আসছে, আমি বাধ্য হলুম আত্মহত্যা করতে।   

জাঁ দুভাল : সব পুরুষ একই রকম । বোদলেয়ার ছাড়া আরও অনেকের সঙ্গে মিশেছি তো, জানি । বোদলেয়ার মনে করতো আমার থেকে ওর সিফিলিস হয়েছে । আমার উল্টোটা মনে হয় । বোদলেয়ার থেকেই আমার সিফিলিস হয়েছে। আফিমের শরবত আর হ্যাশিশের ধোঁয়া টানার পর ওর তো আর হুঁশ থাকতো না । 

শাহজাহান : আমার আব্বাহুজুর  জাহাঙ্গীর অমন করতেন না । আমি তো ওনার হিন্দু রাজপুত বউ তাজ বিবি বিলকিস মাকানি-র ছেলে । শুনেছি যে দাদাহুজুর আমার আব্বাহুজুরকে আনারকলির সঙ্গে প্রেম করতে দেননি। কারণ আনারকলি ছিল একজন  চাকরানির মেয়ে, দাদাহুজুরও মেয়েটাকে চাইতেন । জন্মসুত্রে ওর নাম ছিল নাদিরা বেগম বা শার্ফ-উন-নিসা। আনারকলি কোনও এক বণিক বহরের সঙ্গে  ইরান থেকে  লাহোরে এসেছিল। দাদাহুজুর বলেছিলেন চাকরানির মেয়েকে রাজপুত্রের ভালোবাসা অবৈধ । তাই দাদাহুজুর দুটো ইটের দালানের মাঝ জীবন্ত কবর দিয়েছিলেন আনারকলিকে।  আনারকলির ঘটনা ইচ্ছে করে ‘আকবরনামা, ’তুজক-ই-জাহাঙ্গীরী’, ‘হুমায়ুননামা’ থেকে বাদ দেয়া হয়েছে, মোগল সন্মান রক্ষা করার ধান্দায় । অথচ হারেমের হাবশি ক্রিতদাসীদের সঙ্গে শুতে কারোরই আপত্তি হয়নি । 

জাঁ দুভাল : এরকমই হয় । আমার জীবনও অনেক কষ্ট। এখন ক্রাচে হাঁটাচলা করতে হয় । যাই হোক, আমি এবার উঠি । অনেক দূর যেতে হবে । বোদলেয়ার আমাকে বলতেন কালো ভেনাস, বিপজ্জনক সৌন্দর্য, যৌনতা আর রহস্য’র মিশেল । আমাকে অমর করে দিয়ে গেছেন শাহজাহানের মমতাজ মহলের মতন । ওই যে আরেকজন মহিলা এই টেবিলের দিকেই আসছেন, আপনাদের মিসোজিনিক আলোচনায় বিঘ্ন ঘটাতে ।

ভাগমতি : তোমার কথা শুনতে পেয়েছি জাঁ দুভালবেগম । না আমি পিতৃতন্ত্রে বাগড়া দিতে আসিনি । আমিও নিজের প্রেমের কাহিনি শোনাতে এসেছি ।

 ভাইপো আকবর :  আমার নাম জালালুদ্দিন মুহম্মদ আকবর, গুলবদন পিসির ভাইপো । ভুল করে নিউটাউন কফি হাউসে চলে গিয়েছিলুম । আজকে চেঙ্গিজদাদু, ল্যাঙড়াদাদু  আর দাদাহুজুর আড্ডা দিতে আসছেন শুনে এলুম । প্রেমের গল্প কানে এলো । কার প্রেম কার সঙ্গে ,আশা করি এই কাহিনির ভিলেন আমি নই । মোগল পরিবারে হিন্দু রাজপুত মেয়েদের বিয়ে করার চল আমিই তো আরম্ভ করেছিলুম । আর এখন তোরা আমাকে দোষ দিচ্ছিস যে আমি তোদের প্রেমে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছি । শ্যায়খুবাবা আসেনি ?

ফিরোজাবাদি তুগলক : আপনিই আকবর ? আপনার কথা অনেক শুনেছি জনাবেআলা ! আপনার মালাউন প্রেম তো বিখ্যাত। আপনার দরবারে পারসি-মোগল-রাজপুত, প্রত্যেকের সমান মর্যাদা ছিল। তবে নির্ভরতা ছিল বেশি মালাউন রাজপুতদের ওপর। কারণ দরবারের আমির-ওমরাহদের মধ্যে অনেকেই তো ইরানের । ইরানের সম্রাটের প্রতি আপনাদের একটা দুর্বলতা ছিল।  প্রভাবশালী ইরানি ও মোগল আমিররা  ষড়যন্ত্রে যোগ দিতে কতক্ষণ! অন্যদিকে রাজপুতদের নিয়ে সে ভয় ছিল না। তারা বিশ্বাসী,  বীর আর প্রভুভক্ত। যুদ্ধেও ওস্তাদ। আর যদি তারা ষড়যন্ত্র করেও, ইসলাম ধর্মাবলম্বী আমিরদের সমর্থন আদায় করা তাদের পক্ষে অসম্ভব। আপনি তাই সেনাবাহিনীর উঁচু পদে অনেক রাজপুতকে নিয়োগ করেছিলেন। মোগল সেনাবাহিনীতে রাজপুতদের এ দাপট দীর্ঘদিন বজায় ছিল। এর পেছনে কি যোধা বাঈয়ের কোনো প্রভাব ছিল জনাবেআলা ! যোধা বাঈ, মোগল হারেমের প্রথম রাজপুত বেগম। মোগল হারেমে হিন্দু আদব-কায়দা আর সংস্কৃতির শুরুয়াত তো ওনার হাত ধরেই। পরে রাজপুত বেগমদের সংখ্যা যত বেড়েছে, সংস্কৃতির মিশেলও ততই বেড়েছে। দেশীয় হিন্দু রাজাদের সঙ্গে সখ্যতার সময় সন্ধিপত্রে আপনি প্রথমেই যে শর্ত জুড়ে দিতেন তা হলো, রাজপুত রাজকন্যাদের ডোলি পাঠাতে হবে মোগল হারেমে। হেরে যাওয়া রাজাদের সেই সাহস কোথায় যে আপনার শর্ত অমান্য করে! অতএব আপনার হারেমে তখন অগুনতি রাজপুত বেগম। ইসলামি রীতি মেনে কলমা পড়ে  যেমন এদের নিকা করেছেন, তেমনি হিন্দু রীতি-রেওয়াজ মেনে সাতপাক, মালা বদল,  যাগযজ্ঞ—কিছুই বাদ যায়নি। রাজপুত বেগমদের মহলে পা রাখলে বোঝার কোনো উপায় ছিল না যে তা মোগল হারেমেরই অংশ । পুজোপাঠ থেকে পোশাক-আশাক, খাবারদাবার, তাদের সবকিছুতেই হিঁদুয়ানি বড় প্রবল। রাজপুত বেগম মহলে জাঁকজমকের সঙ্গে হোলির উৎসব হোতো আর আলোর দিওয়ালিও। বাদশারা সানন্দে যোগ দিতেন সেই উৎসবে। মোগল মিনিয়েচার ছবিগুলো সে কথাই বলে।

তোতলা তুগলক : কে তোতোতোকে ববববলেছে, ওওওপরপড়া হয়ে খখখবর বিলোতে ?

ভাইপো আকবর : এতো বড়ো সাম্রাজ্য চালাতে হলে বুদ্ধি খাটাতে হয়, বুঝেছো ? এ তো আর তোমার গণতন্ত্রের ভোটাভুটি নয় যে যখন যাকে ইচ্ছে নিজের সঙ্গে নিলুম আর হাজার-হাজার কোটি টাকা কামিয়ে তাকে জেলে পুরলুম বা তাড়িয়ে দিলুম । শ্যায়খুবাবা আসেনি ?

দিল্লিওয়ালা তুগলক : আপনি যমুনা তীরে বাগানঘেরা সুন্দর মহল তৈরি করিয়েছিলেন । নাম রেখেছিলেন সোহাগপুরা। স্বামী-সোহাগের স্মৃতি আঁকড়ে  বিধবা বেগম আর মুত্তারা শেষ জীবন কাটাবে এই মহলে,  তাই এমন নাম রেখেছিলেন বোধহয় । জাহাঙ্গিরের মা মরিয়ম-উজ-জামানি ছাড়া বাকিরা আপনি মারা যাবার  পর ছিলেন এই সোহাগপুরাতেই। মরিয়ম-উজ-জামানি, মানে যোধা বাই  ছিলেন ছেলের প্রাসাদে। তালাকের ঘোর বিরোধী ছিলেন আপনি। আপনি মারা যাবার পর হারেম সুন্দরীরা অন্য পুরুষের বাহুলগ্না হবে,  হিন্দুদের মতো এ ব্যাপারেও তীব্র আপত্তি ছিল আপনার। যাতে  রাজপুত বেগমরা নিশ্চিন্তে সেখানে হিন্দু বিধবাদের মতো সাত্ত্বিক জীবন কাটাতে পারেন ! যদিও একটা অংশে মোগল বেগম ও মুত্তাদের থাকার ব্যবস্থাও ছিল। আপনার পর অবশ্য এই নিয়ম আর বজায় থাকেনি। জাহাঙ্গির ওর ভাই দানিয়েলের মৃত্যুর পর তার হারেমের মেয়েদের বিয়ে করার অনুমতি দিয়েছিলেন আপনি । প্রশ্ন হলো তালাক কিংবা বেগমদের পুনর্বিবাহে কেন আপনার আপত্তি ! মালাউন সংস্কৃতির প্রভাবে বোধহয় ! মালাউন ধর্ম-সংস্কৃতির প্রতি বরাবর একটা কৌতূহল ছিল আপনার মনে। সেই কৌতূহল থেকেই রামায়ণ-মহাভারত অনুবাদের হুকুম দিয়েছিলেন। আগ্রহ ছিল সংস্কৃত ভাষার প্রতিও। মূল সংস্কৃত থেকে রামায়ণ অনুবাদের হুকুম দিয়েছিলেন  বাদাউনিকে। সময় লেগেছিল চার বছর। আর নকিব খাঁ করেছিলেন মহাভারতের অনুবাদ। সাহায্য করেছিলেন বাদাউনিও এবং কয়েকজন হিন্দু পণ্ডিত। এর আগে বাদাউনি ফার্সি ভাষায় গদ্যে-পদ্যে অনুবাদ করে ফেলেছিলেন সংস্কৃত বই ‘বত্রিশ সিংহাসন’।    বইটির অনুবাদ শেষ হলে নাম রাখা হয় ‘খিবদ্-আফজা’।

তোতলা তুগলক : অঅঅঅনেক কিকিকিকিছু জাজাজাজানিস দেদেদেখছি, তাতাতাহলে রারারাজ্য সাসাসামলাতে পাপাপারিসনি কেকেকেন ?

পাগলা তুগলক : মানবপ্রকৃতি ধারণাটা আমাদের সমাজে বিভিন্ন সময়ে কীরকম ভূমিকা পালন করেছে? আঠারো শতকের প্রাণীবিদ্যাসমূহের উদাহরণ টেনে বলা যায় নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক কালে বিশেষ বিশেষ জ্ঞানকান্ডের অভ্যন্তরে ক্রিয়াতৎপর বর্গ-ধারণাসমূহ এবং ‘প্রাণ’ বা ‘মানবপ্রকৃতি’র মতো ইতিহাসোর্ধ ধারণাগত মাইলফলকগুলোর মধ্যে পার্থক্য আছে । আমার মতে, ইতিহাসোর্ধ ধারণাগুলো বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকান্ডের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন সাধনে খুব সামান্যই ভূমিকা রেখেছে। আমার মতে, একজন ভাষাতাত্ত্বিক যা গবেষণার মাধ্যমে বাগধ্বনির রূপান্তরের নীতি আবিষ্কার করেছিলেন, কিংবা একজন ফ্রয়েড স্বপ্ন বিশেস্নষণের নীতি আবিষ্কার করেছিলেন, কিংবা একজন সাংস্কৃতিক নৃবৈজ্ঞানিক মিথ-এর কাঠামো আবিষ্কার করেছিলেন, সেটা প্রকৃতপক্ষে মানবপ্রকৃতি ছিল না। বলতে পারি, জ্ঞানের ইতিহাসে মানবপ্রকৃতি ধারণাটা বস্তুত ধর্মতত্ত্ব কিংবা প্রাণীবিদ্যা কিংবা ইতিহাসের সাপেক্ষে বা বিপরীতে একটি নির্দিষ্ট ধরনের ডিসকোর্সকে প্রতিষ্ঠিত করতে জ্ঞানকান্ডীয়  সূচকের ভূমিকা পালন করেছে ।

তোতলা তুগলক : এএএই পাপাপাগলাটা মামামাঝখানে অঅঅন্য ককককথা ববববলবেই । 

ভাস্কো দা গামা : লাহোরে আমি আনারকলির কবর দেখেছি । ওই ঘরেই এখন পাকিস্তানের পুরোনো নথিপত্রের মহাফেজখানা । উইলিয়াম ড্যালরিমপলও গবেষণার নথিপত্র যাচাই করার সময়ে দেখেছে আনারকলির কবর । 

শাহজাহান : ভাগমতিবেগম, এই প্রবীণ মহিলা কি তোমার সঙ্গে এসেছেন ?

ভাগমতি : না তো ! উনি নিজেই এসেছেন আপনাদের টেবিলে ।

শাহজাহান : আর এই ফিরিঙ্গি ?

ভাগমতি : উনিও আলাদা এসেছেন । আমার সঙ্গে নয় । আমি একাই এসেছি আপনাদের আমার জীবনের ঘটনা শোনাতে ।

পাগলা তুগলক : আধুনিক কালে শিল্প, সাহিত্য পাঠে এবং সিনেমা নাটকের বিশেষ চরিত্রের মনের অলি-গলিতে আলোকপাত করার জন্য যে কতগুলো শিল্প-সাহিত্যিক তত্ত্ব—যেমন সংগঠনবাদ, উত্তর সংগঠনবাদ, আধুনিকতাবাদ, উত্তর-আধুনিকতাবাদ, নিউ ক্রিটিসিজম, উপনিবেশবাদ ইত্যাদি সাহিত্য সমালোচনা—সমালোচকেরা ব্যবহার করে থাকেন তার মধ্যে সাইকো-এনালাইসিস একটা অপেক্ষাকৃত গূঢ় ও ক্যাথারসিস—আত্মবিশোধনমূলক তত্ত্ব। এই বিশেষ তত্ত্বটি বলে—যে টেক্সট লেখকের গোপন, আশা আকাঙ্ক্ষা তার উদ্বিগ্নতা, যা তার অজ্ঞান স্তরে জমা থাকে তা প্রকাশ করে দেয়। এটা আরো বলে যে একটা টেক্সট আর কিছু নয় লেখকের মনোজগতের ভাষা-বিবরণ ছাড়া। এর মাধ্যমে আমরা লেখকের বাল্যজীবনের ট্রমা, সেক্সচুয়াল কনফ্লিক্ট, অবসেশন ইত্যাদি জানতে পারি। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে এই মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো আসে সরাসরিভাবে নয়, পরোক্ষভাবে। দাবিয়ে রাখা আবেগগুলো ছদ্মনামে, লিটেরেরি টেকনিক যেমন প্রতীক, মেটাফর  ও মেটোনিমিতে  প্রকাশিত হয়। কখনো তা প্রকাশ পেতে পারে কনডেন্সেড  অবস্থায়, একটিমাত্র ছবিতে অথবা মিলেমিশে থাকায় বিশেষ অন্য একটি শব্দে বা ছবিতে।  সাইকো-এনালাইসিস তত্ত্ব দিয়ে একটি টেক্সট পাঠ করলে পাঠকের কাছে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে—সেটি হলো লেখক/চরিত্রের ডিজায়ার  বা তার অভাব।

তোতলা তুগলক : আআআবার সেসেসেই দিদিদিদিল্লির ববববদলে দৌলতাতাতাবাদ । ওফ, পারা গেল না ছেলেটাকে নিয়ে !

ঘসেটি বেগম : আমার নাম মেহের উন নিসা বেগম, আমি বাংলা, বিহার আর ওড়িশার নবাব আলীবর্দী খানের বড় মেয়ে। কফিহাউসে আজকে চেঙ্গিজদাদু , তৈমুরদাদু , বাবরদাদু আসবেন শুনে ওনাদের গল্প শুনতে এলুম । আমাকে এতো বদনাম দেয়া হয় কেন বুঝতে পারি না । অথচ আপনারা তিনজন তো হেন কাজ নেই যা করেননি । জগতশেঠ, উমিচাঁদ, কৃষ্ণচন্দ্র রায়রা দিব্বি পার পেয়ে গেলো । মহারাজা প্রতাপাদিত্যকে ধরিয়ে দিয়ে মানসিংহকে সাহায্য করার জন্য পুরস্কার হিসেবে ভবানন্দ মজুমদার সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে সন্মান লাভ করেছিল আর তার  ফরমান পেয়ে নদীয়া, সুলতানপুর, মারুপদহ,মহৎপুর,লেপা,কাশিমপুর, কয়েশা মমুন্দ্রা এরকম চোদ্দটা পরগনার অধিকার পেলো | মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের দেয়া চোদ্দটা পরগনার সনদসূত্রে নদীয়ার রাজা হলেন ভবানন্দ মজুমদার আর সেই সঙ্গেই নদীয়া রাজবংশের সূচনা করলেন | তাঁর বংশধররা ‘রাজা’ উপাধি ধারণ করে ফিরিঙ্গি শাসনের প্রতিষ্ঠাকাল পর্যন্ত নদীয়া শাসন করলেন | ভবানন্দের আসল নাম ছিল দূর্গাদাস সমাদ্দার, কিন্তু নদীয়া রাজপদে বসে ওনার নাম হলো ভবানন্দ মজুমদার ; তাঁর ছেলেরা রায় পদবি রাখলো |  মোগোলদের ধ্বংস করে বব মাস্তানের কোম্পানি জনে-জনে রাজা-মহারাজা খেতাব বিলোলো । তার বেলায় ? শুধু আমাকেই কেন দোষ দেয়া হয় ?

প্রতাপাদিত্য : আপনারা ডাকেননি, তবুও এসেছি । আমিই প্রতাপাদিত্য । মহারাজা প্রতাপাদিত্য,বাঙালি । নিজেকে মহারাজা বলেছি বলে আপনাদের আঁতে লেগেছে, জানি । কিন্তু আপনারা নিজেরা তো এদেশের মানুষের কাছে দুর্বোধ্য নাম নিয়েছেন, যেমন নাসিরুদ্দিন মুহম্মদ হুমায়ুন, আবুল মোজাফ্ফর সাহিব উদ্দীন মোহাম্মদ সাহিব-ই কিরান শাহজাহান বাদশা গাজি , আল-সুলতান আল-আজম ওয়াল খাকান আল-মুকাররম আবুল মুজাফফর মুহি উদ-দিন মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব  বাহাদুর আলমগীর বাদশা গাজী প্রথম আলমগীর, নুরুদ্দিন মহম্মদ জাহাঙ্গীর বাদশাহ গাজী, ইত্যাদি । 

ভাস্কো দা গামা: তোমার বক্তব্যটা কী ? ঘটনা জানতে চাই ।

প্রতাপাদিত্য : রাজনৈতিক শিক্ষার জন্য আমি কিছু সময়ের জন্য উত্তর ভারতে গিয়েছিলুম। সেইখানে থাকার সময় আমি জানতে পারি মহারাণা প্রতাপসিংহের সাহসের কথা। আমি নিজে চিতোর দর্শন করেও আসি, যা আমার মনের  স্বাধীনচেতা সত্ত্বাকে  আলোড়িত করেছিল। এছাড়া, বিভিন্ন রাজপুত পরিবারের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মোগল রীতি, আর খোশরোজের দিন হিন্দু নারীদের উপর অত্যাচারের কথা আমার মনে আপনাদের প্রতি বিতৃষ্ণার জন্ম দিয়েছিল। যশোরে ফেরার কিছুদিন পরে আমার বাবা মহারাজা বিক্রমাদিত্যে মারা যান, আর আমার অভিষেক অনুষ্ঠিত হয়। রাজগুরু পণ্ডিত কমলনয়ন তর্কপঞ্চাননের কাছে শাক্ত মন্ত্রে দীক্ষা নিই । 

ভাস্কো দা গামা : তাই মোগলরা তোমার ওপর চটে গিয়েছিল ? ঠিক যেমন পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ওপর চটা !

প্রতাপাদিত্য : তার আগে আমি ছিলুম বৈষ্ণব। শাক্ত হয়ে যশোরেশ্বরী মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করি।  উৎকলবিজয় আমার শাক্ত বিশ্বাসকে আরো সুদৃঢ় করে।   সেনাবাহিনীকে আরো শক্তিশালী আর পরাক্রমশালী করে তুলি। রাখাইনের মগ আর পর্তুগিজ  দস্যুদের অত্যাচার প্রতিরোধ করি । দুর্গ তৈরি করাই । রাজধানী ধুমঘাটের দুর্গ ছাড়াও  আরো তেরোটা প্রধান দুর্গ ছিল। এর বাইরেও আমার অসংখ্য দুর্গ ছিল, যার মধ্যে কলকাতার কাছেই সাতটা । আমার  নৌবহরও ছিল ; কোনো কোনো নৌকায় চৌষট্টি বা তার বেশি দাঁড় ছিল, আর অবশ্যই অনেক নৌকায় কামান থাকত। আমার সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন ধরণের সৈন্য ছিল, যেমন ঢালী, অশ্বারোহী, তীরন্দাজ, গোলন্দাজ, নৌসেনা, গুপ্তসৈন্য, রক্ষীসৈন্য, হস্তিসেনা।  আমার সেনাবাহিনীতে বাঙালি রায়বেঁশে, ঢালি ইত্যাদি সেনা ছাড়াও ছিল কুকি, পাঠান, পর্তুগিজ ইত্যাদি সেনা। কিন্তু  আমার বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র আর আমার শত্রুদের নানারকম সাহায্য করেছিলেন বহু বাঙালি। 

চেঙ্গিজ খান : ভালো কাজই তো করছিলে । তুমি তো মনে হয় কোনও অভিযোগ নিয়ে কফিহাউসের এই আড্ডায় এসেছো । যা বলতে চাও, বলে ফ্যালো ।

প্রতাপাদিত্য : আমি বহিরাগত মোগলদের বশ্যতা অস্বীকার করে যশোরের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলুম । নিজের নামে মুদ্রার প্রচলন করেছিলুম।  মোগলদের পক্ষে রাজা মানসিংহ ছিলেন বঙ্গদেশের দায়িত্বে । তিনি দাক্ষিণাত্য বিজয়ের জন্য শের খাঁকে রাজমহলে দায়িত্ব দিয়ে যান। সেই সময় আমার অমাত্য শঙ্কর চক্রবর্তী  সেখানে উপস্থিত হন। শের খাঁ শঙ্করকে বন্দী করে, যদিও শঙ্কর সহজেই সেখান থেকে পালিয়ে যায়।  ফলে আমি আক্রমণ করে মোগলদের প্রথমবারের মতো হারিয়ে দিই ।  এরপরে মানসিংহের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি হয়। যুদ্ধ বেশ কিছুদিন যাবত চলেছিল।  প্রথমে দু’দিন মানসিংহ হেরে গিয়েছিলেন।  শেষদিন জয়ী হয়ে মানসিংহ স্বাধীনতার চিহ্ন পতাকা ও মুদ্রা বিলুপ্ত করবার আদেশ দিয়েছিলেন। আসলে নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদার আমাকে মান সিংহের কাছে ধরিয়ে পুরস্কৃত হয়েছিলেন । শুনেছি, আমাকে খাঁচায় পুরে বন্দি করার পর, মোগল সেনাবাহিনী জিহাদ ও ‘মাল-এ-গনিমাত’ অনুযায়ী  নির্মমভাবে যশোরে  লুটপাট চালিয়েছিল। এমনকি মির্জা নাথনের মতো বুদ্ধিমান মানুষও তার নির্মম কৃতিত্ব নিয়ে গর্বিত। আমার ছেলে উদয়াদিত্য ওই মির্জাকে সোনা-মণিমুক্ত দিতে পারেনি বলে  যশোরের ওপর ভয়াবহ প্রতিশোধ নিয়েছিল। মির্জা হুমকি দিয়েছিল যে লুটপাট বলতে কী বোঝায়  তার অভিজ্ঞতা যশোরের মানুষ মনে রাখবে । মির্জা নাথন চার হাজার মহিলা, যুবতী ও বৃদ্ধকে বন্দী হিসাবে নিয়ে গিয়েছিল। কমিউনিস্ট শাসনের ৩৪ বছরে বাংলায় জাতীয়তাবাদী মনোভাব শুকিয়ে গেছে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, এখনকার বাঙালিরা আমাকে আর আইকন মনে করে না ।

চেঙ্গিজ খান : রাজা-বাদশাদের অমন খোচর থাকে । তাদের কাজের জন্য তাদের পুরস্কার না দিয়ে উপায় নেই।

প্রতাপাদিত্য : ব্যাপারটা মিটে গেলেও, জাহাঙ্গির কিছুকাল পরে ইসলাম খাঁর নেতৃত্বে আবার সৈন্য পাঠান ।  যমুনা আর ইছামতি নদীর সঙ্গমে আমার বাহিনীর সঙ্গে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। আমি আত্মসমর্পণ করেছিলুম। তবু ইসলাম খাঁ আমাকে শেকলে বেঁধে খাঁচায় ঢুকিয়ে রাখলো আর যশোর প্রদেশকে মোগল সম্রাজ্যের অন্তর্গত করে নিলো। আপনাদের তো যে যার কবর আছে । কেউ-কেউ তার ওপর মহলও খাড়া করেছেন । আমার আর আমার ছেলের শবদেহের কী হলো ? কোথায় আমাকে দাহ করা হয়? আমার দেহাবশেষ কি আমার বংশধরদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল ? নাকি আমার স্মৃতিও দারা শুকোহ’র মতন লোপাট করে দেয়া হয়েছে ?

ভাইপো আকবর : জাহাঙ্গির থাকলে হয়তো বলতে পারতো । ও  কফিহাউসে আসতে পারবে না, পাকিস্তানের মিলিটারি ক্লিয়ারেন্স পায়নি । ইসলাম খাঁ আসবে বলে মনে হয় না । গুলবদনপিসি, তুমি কিছু জানো ? শ্যায়খুবাবা আসেনি ?

গুলবদনপিসি : না রে ভাইপো । জাহাঙ্গীর ওর আত্মজীবনীতে ব্যাপারটা চেপে গেছে । আমি যতোটা জানি ঢাকায় বন্দী থাকবার কিছুদিন পরে আপনাকে খাঁচায় পুরে আগ্রায় পাঠানো হচ্ছিল । পথে কাশীতে আপনি মারা যান । বা হয়তো খাঁচার ভতরে মারা যাবার পর শবদেহ কাশীতে নিয়ে যাওয়া হয় । আপনার শবদাহ সেখানেই করা হয়ে থাকবে, বংশধরদের অনুপস্হতিতে । 

প্রতাপাদিত্য : আমার প্রতিষ্ঠিত যশোরেশ্বরী কালী দর্শনের নাম করে সেনাপতি মান সিংহ আমার দুর্গের নকশা নিয়ে যান। পরে আক্রমণ করে মোগলরা সেটি জয়লাভও করে। কালীর বিগ্রহের সঙ্গে আমাকে আর আমার  সেনাপতি ও পরামশর্দাতা শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়কে বন্দি করেন মান সিংহ।জমিদার বাড়ির মধ্যে অবস্থিত ছিল যশোরেশ্বরী কালী। সেই সময়ের     জমিদার  কালী মন্দিরের জন্য দুশো বিঘা জমি দান করেছিলেন। কিন্তু আজ প্রভাবশালী ভুমিদস্যুরা জাল দলিল তৈরি করে মায়ের মন্দিরের সব জমি দখল করে ভোগ করছে।আজ  মন্দিরের ইঁটের দেওয়াল খসে পড়ছে। যাকগে, থ্যাংকস । মোগলরা আমার ভালোই ট্রিটমেন্ট দিয়েছিল । নিজেদের ভাই-ভাতিজা চাচা-আব্বাকে যারা হেনস্হা করে, অন্ধ করে, খুন করে, তাদের কাছ থেকে এইটুকু জোটাও ভাগ্যের ব্যাপার ।  মধ্যযুগে বাংলার শাসক হিসাবে বহিরাগত বাদশা আর নবাবরা যতটা গুরুত্ব পেয়েছেন, দেশীয় বাঙালি রাজারা তার সিকির সিকিও পাননি। এর একটি কারণ যদি হিন্দু শাসকদের হাত থেকে মুসলমান শাসকদের হাতে ক্ষমতার দখল চলে যাওয়া হয়ে থাকে, আর একটি কারণ আমাদের ঐতিহাসিক ও শিক্ষাবিদরা। তাই মহারষ্ট্রের শিবাজীকে নিয়ে উচ্ছ্বাস দেখানো হলেও তাঁর প্রায় সমান রণকুশল আর অনেক বেশি প্রজাবৎসল হলেও বাংলার পাঠ্যপুস্তকে উল্লিখিত শুধু বাংলার বারো ভুঁইয়ার অন্যতম হিসাবে, যিনি মোগলের বশ্যতা স্বীকার করেননি। শিবাজীর চেয়ে অগ্রজ হওয়া সত্ত্বেও আমাকে  সম্মান জানাতে ব্যবহৃত হয় ‘বাংলার শিবাজী’ অভিধা, যেখানে বিপরীতটা হওয়াই সঙ্গত ছিল; কারণ আমার শৌর্যের খ্যাতি সারা ভারতে এতটাই ছড়ায়, যে সেই ক্ষমতার নেপথ্যে অলৌকিক দৈব আশীর্বাদের গল্পও জনশ্রুতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল, আর শিবাজীর জন্ম আমার জন্মের অনেক পরে ।

চেঙ্গিজ খান : বাঙালিদের কথা আর বোলো না । নিজেদের নায়কদের সন্মান জানাতে চায় না । এই একটু আগে মাও জে দং সেকথাই বলে গেলেন ।

প্রতাপাদিত্য : আমাকে নিয়ে উৎসবের  সূচনা করেছিলেন  রবীন্দ্রনাথের বড়ো বোন শ্রীমতী স্বর্ণকুমারী দেবীর ও শ্রী জানকীনাথ ঘোষালের মেয়ে শ্রীমতী সরলাদেবী চৌধুরানী।  প্রখ্যাত সাহিত্যিক শ্রী মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় দ্বারা পরিচালিত একটি সাহিত্য সভাকে সরলাদেবী দেশাত্মবোধক ও বীরত্বব্যঞ্জক রূপ দিয়ে ‘প্রতাপাদিত্য উৎসবের’ সূচনা করেছিলেন । আমার ঘোড়া কলেজ স্ট্রিটে অপেক্ষা করছে । চলি । আপনাদের কিছু শোনাবার জন্য একজন ফিরিঙ্গি দাঁড়িয়ে আছেন ।                   

অষ্টম এডোয়ার্ড : আমি দাঁড়িয়েই আমার জীবনে প্রেমের কথা বলি । আপনারা সবাই প্রেমের আলোচনা করছেন বটে কিন্তু কেউই আমার মতন রাজসিংহাসন ত্যাগ করেননি প্রেমিকার জন্যে । দুবার তালাকপ্রাপ্ত মেয়েকে জীবনসঙ্গী করায় সিংহাসন ছাড়তে হয়েছিল ! আমার নাম এডওয়ার্ড আলবার্ট ক্রিশ্চিয়ান জর্জ অ্যান্ড্রু প্যাট্রিক ডেভিড। আমি রাজা পঞ্চম জর্জের বড়ো ছেলে । ভালোবাসার মানুষের জন্য সিংহাসন ছেড়ে মাটিতে নেমে গিয়েছিলুম সাধারণ মানুষের মধ্যে । আমার প্রেমিকার নাম ওয়ালিস সিম্পসন। জন্ম মার্কিন পরিবারে।  ওয়ালিস আমাকে বিয়ে করেও রানি হতে পারেননি। পাননি কোনো সম্মানসূচক উপাধি। কারণ, ও দুবার তালাকপ্রাপ্ত। সেই সময়ে তালাক পাওয়া মেয়েদের আদালতে যাওয়ারই অধিকার ছিল না, আর আমাকে বিয়ে করে ব্রিটিশ রাজপরিবারে প্রবেশ করাটা তো অসম্ভব ছিল! দু’বার তালাকপ্রাপ্ত মেয়েকে এডওয়ার্ড বিয়ে করলে সরকার পদত্যাগ করবে, এমন হুমকি দেওয়া হলো।  

চেঙ্গিজ খান : কেন ? রাজারানি হবে, তাতে তালাকদেয়া মেয়ে হোক বা নাই হোক । তালাকদেয়া মেয়েদেরও তো বিয়ে করা যায় ।

অষ্টম এডোয়ার্ড :দুবার তালাকপ্রাপ্ত সাধারণ এক মার্কিন পরিবারের মেয়েকে ব্রিটিশ রাজার বিয়ে করার সিদ্ধান্তে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল  ইংল্যান্ডের চার্চ, যখন কিনা রাজা নিজেই চার্চের প্রধান !  ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্ট্যানলে বল্ডউইনও আমার প্রেমের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অবস্থান নেন। বল্ডউইন আমাকে তিনটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন—এক, ওয়ালিসকে বিয়ের চিন্তা বাদ দাও। দুই,  প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করা চলবে না। তিন, সিংহাসন ত্যাগ করো। চাপ সহ্য করতে না পেরে ওয়ালিস   ফ্রান্সে চলে গিয়েছিল । ও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আমার সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখবে না। কিন্তু জানতুম , সেটা ওর মনের কথা নয়। ওর মনের কথাটা বাস্তবে প্রতিফলিত করতেই বল্ডউইনকে  জানিয়ে দিই, আমি  তৃতীয় প্রস্তাবটিতে রাজি !  আমি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ‘অ্যাবডিকেশন-পত্র’  জমা দিই । পরদিন তা অনুমোদন করা হয়। মাত্র ৩২৬ দিনের মাথায় সিংহাসন ত্যাগ করে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে কম মেয়াদি রাজার তালিকায় নাম লিখিয়েছি।  ওয়ালি সিম্পসনকে বিয়ে করে প্যারিসে বসবাস শুরু করি । আমার মতন আর কেউ কি প্রেম করেছে পৃথিবীতে ? 

চেঙ্গিজ খান : আপনার পেছনে ওই মোটা সাহেব ভুতটা কে ? আপনার সঙ্গে এসেছেন ? আমি ভাবলুম ওয়াজিদ আলি শাহ পোশাক পালটে এলো !

অষ্টম এডোয়ার্ড : না, উনি উনস্টন চার্চিলের ভুত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ।

সাহেব ভুত : চলুন ইয়োর হাইনেস । এই কালো বোকা লোকগুলোর জমায়েতে কেন এসেছেন ? 

কফিহাউসের যক্ষ : এই চার্চিল লোকটা নিজে সরাসরি বাংলার মন্বন্তরের জন্য দায়ী । ও  একসময় বিদ্রূপ করে বলেছিল, দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী ভারতীয়রা, ওরা  খরগোশের মতো বাচ্চা বিয়োয় ;  তা ছাড়া খাদ্য সংকট এত তীব্র হলে মহাত্মা গান্ধী বেঁচে আছেন কীভাবে?

ল্যাঙড়া তৈমুর :  আরে এই প্রেতটা তো উইনস্টন চার্চিল । আমিও ভেবেছিলুম ওয়াজিদ আলি শাহ নতুন পোশাকে এলো । পঞ্চাশের  মন্বন্তরে যখন সুবে-বাংলার মানুষ বেঘোরে মরছিল এই লোকটা তখন  সাহায্যের জন্য হাত বাড়াবার বদলে গুটিয়ে নিয়েছিল।শুধু তাই নয়, অন্যেরা যেন দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সহায়তায় এগিয়ে না আসে সে বিষয়েও  ব্যবস্থা নিয়েছিল ।  চার্চিল নিজে সরাসরি বাংলার মন্বন্তরের জন্য দায়ী ছিল। একসময় বিদ্রূপ করে বলেছিল  খাদ্য সংকট এত তীব্র হলে মহাত্মা গান্ধী বেঁচে আছেন কীভাবে? । চার্চিলের আল-হিন্দের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা ছিল। আল-হিন্দে যখন ‘ভারত ছাড়ো’ বা ‘কুইট ইন্ডিয়া’ আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠছে তখন এ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। কয়েক জাহাজ খাদ্যশস্য পাঠানোর মাধ্যমে চার্চিল অনায়াসে ভয়াবহ এ দুর্ভিক্ষ প্রতিহত করতে পারত । বাংলার দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য খাদ্যশস্য পাঠানোর জন্য ভারতের দুই ভাইসরয়, চার্চিলের ভারত বিষয়ক সচিব এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত চার্চিলকে অনুরোধ জানিয়েছিল। কিন্তু, চার্চিল তাদের কথায় গা করেনি। আল-হিন্দে আগে এরকম দুর্ভিক্ষ ছিল না। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের সময়  ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। আর এর কারণ হলো— সে সময় এখান থেকে খাদ্যশস্য বৃটেনে রপ্তানি করা হতো কিংবা খাদ্যশস্যের বদলে চাষীদের নীল, পোস্ত বা পাট চাষে বাধ্য করা হতো।  ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’,  আদৌ কৃৃৃৃষির ব্যর্থতা জনিত খরা ছিল না, ছিল মনুষ্যসৃষ্ট আকাল। 

পাগলা তুগলক : জানা কথা ।

কফিহাউসের যক্ষ : কিন্তু স্যার, ১৯৫৩ সালে দ্বিতীয় রানী এলিজাবেথ ওনাকে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। একই সালে  সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারও পেয়েছিল উইনস্টন চার্চিল ।

ভাইপো আকবর : ওসব নাইট-ফাইট আর নোবেল পুরস্কার সব ফালতু । আমি নবরত্নদের নোবেল পুরস্কারের দশগুণ মাসোহারা দিতুম । চার্চিল লোকটা মোটেই নবরত্ন হবার মেটেরিয়াল নয়। ওর মূর্তিও শুনছি ভেঙে ফেলার উপায় খুঁজছে ব্রিটেনের পাবলিক ।  সুবে-বাংলা আর আসাম উপত্যকাই ছিল হাজার বছরের শস্যভাণ্ডার। বাংলার দুর্ভিক্ষ নিতান্তই ব্রিটিশ দুঃশাসন, অব্যবস্থাপনা, বিশেষ করে শেষের দিকে, উইনস্টন চার্চিলের আলহিন্দ-বিদ্বেষ আর যুদ্ধনীতির কারণে হয়েছিল । তাই আজ যেমন খোদ নিজের শহরেই ক্লাইভের বিশাল  মূর্তি অপসারণের দাবি উঠেছে; একই দাবি উঠেছে বাংলায় ইতিহাসের মর্মান্তিক দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের মরণোত্তর বিচারের, অন্তত ন্যায্য বিচারের জন্য ইতিহাসের নিরপেক্ষ পুনর্মূল্যায়নের। শ্যায়খুবাবা আসেনি ?

সাহেব ভুত : আমি উইনস্টন চার্চিল, আমার দেশের লোক কিনা আমার মূর্তি ভেঙে ফেলে দিতে চাইছে ।

ইরাকি ভুত : দুঃখ করবেন না চার্চিলমিয়াঁ, আমিও অনেককে না খেতে দিয়ে মেরেছি । আমি সাদ্দাম হোসেন আবদুল মাজিদ আল তিকরিতি, আমার মূর্তিও আমার দেশবাসী ফিরদৌস স্কোয়ারে টেনে ফেলে দিয়েছে, মূর্তির মুণ্ডু ভেঙে দিয়েছে । জানেন তো, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সর্বদা বিবাদমান বেশ কিছু জাতিগোষ্ঠী বাস করে। সবার মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রেখে দেশ পরিচালনা অনেক সময়ই সম্ভব হয়ে ওঠে না। দেশের অখন্ডতা বজায় রাখতে গিয়ে প্রায়ই শাসককে কঠোরভাবে সব বিদ্রোহ দমন করতে হয়। এসব বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে আমি যে পন্হা নিয়েছিলুম তাকে লোকে বলে নিষ্ঠুরতা, আর  যে নিষ্ঠুরতা অবলম্বন করেছিলুম তা নাকি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয় । ভেবে দেখুন,  ইরাকের অখন্ডতা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পেরেছিলুম, আর বাইরের শত্রুদের হাত থেকে দেশবাসীকে দীর্ঘদিন মুক্ত রাখতে পেরেছিলুম । এখন  নিজেরা লড়ে মরছে, ইউরোপে পালাচ্ছে  ।

রুশি ভুত : আমি ভ্লাদিমির লেনিন । আমাকে বিশ শতকের  প্রধান ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়।  শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের ব্যাপকভাবে বিবেচিত হয়েও, আমি ১৯৯১ সালে বিলোপ হওয়া অবধি সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে মরণোত্তরকালীন এক পরিব্যাপ্ত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের বিষয় ছিলুম। আমি মার্কসবাদ-লেনিনবাদের  আদর্শিক ব্যক্তিত্ব ছিলুম আর আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের ওপর  লক্ষণীয় প্রভাব ফেলেছিলুম। কিন্তু বিতর্কিত আর অত্যন্ত বিভাজক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে আমাকে আমার সমর্থকরা সমাজতন্ত্র আর শ্রমিক শ্রেণির চ্যাম্পিয়ন হিসাবে দেখলেও, অন্যদিকে বাম আর ডান উভয় দিকের সমালোচকরা আমাকে কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা হিসাবে আমার ভূমিকার ওপর জোর দেয় ।  তোমরা তো আমার মতন বিপ্লব আনোনি । আমি পুরো সমাজটা পালটে দিয়েছিলুম ; সবাই আনন্দে ছিল, অথচ আমার মূর্তিগুলো সব জায়গা থেকে ভেঙে ভেঙে ফেলে দিয়েছে ; এখনও কয়েক জায়গায় আছে । জানি না কদ্দিন থাকবে সেগুলো ।

জর্জিয়ার ভুত : আমি জোসেফ স্তালিন , আমার মূর্তিগুলোও দেশের লোকেরা উপড়ে ফেলে দিয়েছে। অথচ আমি একজন রুশ সাম্যবাদী রাজনীতিবিদ আর ১৯২২ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলুম। সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসের সেই সময়ে আমার নেতৃত্বে প্রচলিত রাজনৈতিক মতবাদ “স্তালিনবাদ” নামে পরিচিত। শুরুতে কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সচিব হিসাবে আমার ক্ষমতা সীমিত ছিল। ধীরে ধীরে আমি ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে নিয়ে দলের নেতা হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসনক্ষমতা কুক্ষিগত করে নিই। আমি সোভিয়েত ইউনিয়নে কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত অর্থনীতি ব্যবস্থার প্রচলন করেছিলুম। তার আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রায় সবটুকুই অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর ছিল। আমার দ্রুত শিল্পায়ন আর কৃষিকার্যের যৌথীকরণের মাধ্যমে পুরো দেশ অল্প সময়ের মধ্যে শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হয়। কিন্তু একই সময়ে অর্থনৈতিক উত্থান-পতনের দরুন বহু মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা যায়। ১৯৩০-এর দশকে আমি নিজের ক্ষমতা শক্ত করবার জন্য একটু-আধটু নিপীড়ন শুরু করেছিলুম, যার ফলে কমিউনিস্ট পার্টির শত্রু সন্দেহে বহু মানুষকে লোপাট করে দিই, কিংবা সাইবেরিয়া ও মধ্য এশিয়ার শ্রম শিবিরে নির্বাসিত করি। রাশিয়ার অনেক জাতিগোষ্ঠীকে তাদের বসতবাড়ি থেকে উৎখাত করে অন্য জায়গায় সরিয়ে দিই । সবই তো মানুষের ভালোর জন্যে করেছিলুম ; কিন্তু এমন আহাম্মক ওরা যে আমার মূর্তি লোপাট করে দিচ্ছে ।

স্পেনের ভুত : আমি ক্রিস্টোফার কলম্বাস, আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলুম । মিনেসোটার সেইন্ট পলে  আদি আমেরিকান বিক্ষোভকারীরা আমার দশ ফুট ব্রোঞ্জের মূর্তি দড়ি দিয়ে টেনে এর গ্রানাইটের ভিত্তি থেকে ফেলে দিয়েছে। ওরা বলেছে, বর্ণবাদ আর পুলিশের নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের চিত্র এটা। ওদের দাবি, বর্ণবাদ, দাসপ্রথা বা দাস ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের মূর্তি প্রকাশ্যে রাখা যাবে না। যদি রাখতেই হয়, তবে সেগুলোকে জাদুঘরে স্থানান্তরিত করতে হবে। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ষোড়শ শতাব্দীতে আমেরিকায় এসে স্থানীয়দের দাস হিসেবে ব্যবহার করেছিলুম।অনেক স্কুলে আমাকে ‘নতুন পৃথিবীর আবিষ্কারক’ হিসেবে পড়ানো হয়। জানি, এই ঘটনার অনেকদিন ধরেই বিরোধিতা করে আসছিলেন আমেরিকার আদি অধিবাসীরা। ওদের মতে, আমার অভিযানই আমেরিকার ঔপনিবেশিক শাসনের আর আদি আমেরিকান অধিবাসীদের গণহত্যার  কারণ। আমার আত্মা শান্তিতে ঘুমোতে পারছিল না বলে আপনাদের জমায়েতে নালিশ করতে এলুম ।

ব্রিটিশ ভুত : আমার নাম এডোয়ার্ড কলস্টোন । ব্রিস্টলে ব্রিটেনের ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ বিক্ষোভকারীরা আমার মূর্তি ভেঙে ফেলেছে । এতোদিন লোকে জানতো না আমি কে ! নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়েছিলুম স্ট্যাচু হয়ে, তাও থাকতে দিলো না ।

মামুনুল হক : আমি খেলাফত যুব মজলিসের নেতা । আমি মনে করি ধোলাইখালে শেখ মুজিবর রহমানের মূর্তি স্থাপন বঙ্গবন্ধুর আত্মার সঙ্গে গাদ্দারি করার শামিল। যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন করে, তারা বঙ্গবন্ধুর সু-সন্তান হতে পারে না। এর মাধ্যমে মসজিদের শহরকে মূর্তির শহরে পরিণত করার অপচেষ্টা চলছে। এ মূর্তি স্থাপন বন্ধ করুন। যদি আমাদের আবেদন মানা না হয়, আবারও তৌহিদি জনতা নিয়ে শাপলা চত্বর কায়েম হবে।

সৌরভ হোসেন নিয়াম : আমি হেফাজতের হামলার শিকার হয়েছি, তার কারণ আমার নাম সৌরভ হোসেন সিয়াম ।প্যান্ট খুলে নুনু দেখিয়ে, তাদের কাছে আমার পরিচয় নিশ্চিত করতে হয়েছে। চার কালেমার দুই কালেমা মুখস্থ বলতে হয়েছে। কয়টা সুরা মুখস্থ তা জানাতে হয়েছে। নামের একটা অংশে সৌরভ থাকায় তারা আমাকে মালাউন মনে করেছিল । বিশ থেকে বাইশ মিনিট একটা গাছ কাটার করাত কলে আটক ছিলুম। চারদিকে ঘিরে ছিল দাড়ি-টুপিওয়ালা তৌহিদি জনতা । প্রাণ নিয়ে বেঁচে ফিরতে পেরেছি এটাই অনেক। দুপুরে মাদানীনগর মাদ্রাসার সামনে হেফাজত কর্মীরা যখন বিক্ষোভ করছিল, তখন আমি ভিডিওতে ফোটো নিতে থাকলে তারা আমাকে ধরে মারধর শুরু করেন। সেসময় তারা আমার নাম জিজ্ঞেস করলে আমি সংক্ষেপে শুধু ডাক নাম “সৌরভ” বলি। এতেই তারা আমাকে মালাউন মনে করে ব্যাপক মারধর করে। কালেমা পাঠ করার পরও কুড়ি মিনিট আমাকে আটকে রাখেন। অন্য সাংবাদিকরা খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গেলে আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

খোকা তুগলক : হেফাজত কী জনাবেআলা ?

তোতলা তুগলক : আআআআবার প্রপপপপপশ্ন । 

জর্জ ফ্লয়েড : হেফাজত হল বজরং দলের আরেক নাম । বজরং দল হল হিন্দুত্ববাদে বিশ্বাসী বিশ্ব হিন্দু পরিষদের যুব বাহিনী। আল হিন্দের উত্তর প্রদেশে দলটা প্রতিষ্টিত হয় এবং গোটা ভারতে  হিন্দু জাতীয়তাবাদ দল হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে। এই দলের লক্ষ্য হল গোহত্যা বন্ধ করা আর  রাম এর জন্মভূমি আযোধ্যায় রামজন্মভুমি তৈরি । এছাড়াও ভারতের হিন্দুদের কমিউনিজমের প্রভাবমুক্ত করা , আর  ধর্মান্তর হতে বিরত রাখা। বাংলা নববর্ষ এবং পয়লা বৈশাখকে বিজাতীয় সংস্কৃতি হিসেবে প্রচার করে এর বিরোধিতা করে হেফাজতে ইসলাম। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময় বক্ততা, গণমাধ্যমে বাঙালি জাতির মধ্যে বিভেদমূলক, বিদ্বেষমূলক ও ভিন্ন ধর্মের বিরুদ্ধে বক্তব্য প্রদান ও প্রচার করে থাকে। এখানে উল্লেখ্য, বাংলা নববর্ষ বাঙালিদের কাছে বাংলা বছরের প্রথম দিন হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ হলো বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক একটি সংগঠন। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই সংগঠনটি বাংলাদেশে ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন পরিচালনা করে আসছে।কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যা হয়েছে তা রীতিমত চমকে দেওয়ার মত ঘটনা।   সুরসম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গনে আগুন দিয়েছে, সরকারি গ্রন্থাগারে আগুন দিয়েছে, রেললাইন উপড়ে ফেলেছে । 

মার্কিন ভুত : আমি জেফারসন ডেভিস, মার্কিন গৃহযুদ্ধের সময়ে কনফিডারেটের প্রেসিডেন্ট ছিলুম । আমার মূর্তি উপড়ে ফেলে দিয়েছে স্বদেশবাসী । মন খারাপ হয়ে গেল কবরে শুয়ে । তাই আপনাদের জমায়েতে নালিশ করতে এলুম ।

চেঙ্গিজ খান : কনফিডারেট আবার কী ব্যাপার ?

জর্জ ফ্লয়েড : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাতটা বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজ্য  ক্রীতদাসপ্রথা বজায় রাখতে চাইছিল । সেই রাজ্যগুলোকে বলা হয় কনফেডারেট রাজ্য । কনফেডারেশন গঠিত হয়েছিল: দক্ষিণ ক্যারোলিনা, মিসিসিপি, ফ্লোরিডা, আলাবামা, জর্জিয়া, লুইসিয়ানা আর টেক্সাস নিয়ে । এই  রাজ্যগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অতি-দক্ষিণ অঞ্চলের এলাকা । তাদের অর্থনীতি কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল – বিশেষত তুলো – আর প্ল্যানটেসান ব্যবস্থায় । তার জন্য তারা আফ্রিকান  দাসদের ওপর নির্ভর করত।  রিপাবলিকান প্রার্থী আব্রাহাম লিংকনের মার্কিন রাষ্ট্রপতির নির্বাচনের মাধ্যমে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য আর দাসত্বের প্রতিষ্ঠানকে প্রতিরোধ করার হুমকি দেওয়া হয়েছিল । তা ছিল এমন এক প্ল্যাটফর্মে যেটা পশ্চিম অঞ্চলগুলিতে দাসত্ব প্রসারিত করার বিরোধিতা করেছিল ।  আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় অনুগত রাজ্যগুলো ইউনিয়ন হিসাবে পরিচিতি লাভ করে, কনফেডারেশন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে তার বিচ্ছিন্নতা ঘোষণা করে। কর্নস্টোন অ্যাড্রেস নামে পরিচিত এক বক্তৃতায় কনফেডারেটের সহ-সভাপতি আলেকজান্ডার  স্টিফেনস তার আদর্শকে এইভাবে বর্ণনা করেছিল:  “এই মহান সত্যের ভিত্তিতে আমরা গোষ্ঠীবদ্ধ যে নিগ্রোরা সাদা মানুষের সমান নয়; দাস রাখা, উচ্চতর জাতির অধিকার, তার প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক অধিকার ।” 

ল্যাঙড়া তৈমুর : মোঙ্গোলিয়াতে আমার একখানা পেল্লাই মূর্তি বসিয়েছে । কেউ আবার সেটা নিয়ে জল ঘোলা করবে না তো ?

চেঙ্গিজ খান : না রে ! মোঙ্গোলিয়া নিয়ে পৃথিবীর অতো চিন্তা নেই । 

ল্যাঙড়া তৈমুর : আমার দেশে দুর্ভিক্ষও হয় না । এতো পশু, তাদের থেকেই যথেষ্ট দুধ-চর্বি-মাংস পাওয়া যায়।

গুলবদন পিসি : আবুল ফজল ওনার ‘আইন-ই-আকবরি’ বইতে লিখে গেছেন, মোগল যুগে কার্যত বাস্তবেই ছিল ‘লাঙ্গল যার জমি তার’ এই সুনীতি। ব্রিটিশদের নির্যাতনমূলক রাজস্ব নীতি, বিশেষ করে কুখ্যাত ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে’ সুবে বাংলার কৃষক পথে বসে, আর বেনিয়া মুৎসুদ্দিরা নিলামের জমি জলের দামে কিনে নিয়ে নতুন জমিদার সেজে বসে। তাদের হাতে ছিল নগদ টাকা। অথচ গৃহস্থদের কাছে ছিল জমি আর শস্য। ব্রিটিশরা ফসল দিয়ে রাজকর পরিশোধের হাজার বছরের নীতি পাল্টিয়ে নগদ অর্থে কর শোধের বন্দোবস্ত করায় অবস্থাপন্ন কৃষকরাও ভূমিহীন খেতমজুর হয়ে পড়ে, আর নতুন বেনিয়া মুৎসুদ্দিরা জমির মালিক হয়ে যায়। আল-হিন্দে আবাদ অনুযায়ী ভূমি করের চমৎকার আর বাস্তব বিধান চালু ছিল। যে নতুন চতুর মাড়োয়ারি ও বানিয়া  বাবুশ্রেণী সমাজের নতুন হর্তাকর্তা হয়ে ওঠে তাদের ঘিরে সমাজের চিহ্নিত শোষক ঠগ ও মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীদের একটি অপবিত্র সংঘ  গড়ে ওঠে, যার মধ্যে ছিল রাজানুগত আমলা , নায়েব, বেনিয়া, দাদনদার, সুদখোর, গোমস্তা, পাইকার, রাখিদার আর শ্রফ বা ব্যাংকার। এই নব্য সুবিধাখোর, সুদখোর চক্র ব্রিটিশ জবরদখলকে কায়েমি করে রাখে।     

ল্যাঙড়া তৈমুর : মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে এসব শুনে ।    

বাবর : শাহজাহান, তুই যেন কী বলতে চাইছিলিস ? শাহজাহান : আমি আমার বেগম আর প্রেমিকার জন্যে যে তাজমহল বানিয়েছি, তা আমাদের দুজনকে এমন অমরত্ব দিয়েছে যে পৃথিবীতে সে কথা বলে বেড়াতে হয় না ।

আওরঙজেব : ফালতু কথা । আব্বাহুজুর জানতেন যে নানা শহরে বিশাল আর সুন্দর নকশার অট্টালিকা তৈরি করে রেখে গেলে অমর হয়ে যাওয়া যাবে । আমিও একটা গুরুত্বপূর্ণ বই লিখিয়েছি, যার জন্য আমার ভক্তরা আমায় মনে রাখে । এদেশে ভুল কারণে হলেও, মনে রাখে । পাশের দেশের লোকেরা আমার জন্য গর্ব করে ; ছেলে আর নাতি হলে আমার নামে নাম রাখে । আব্বাহুজুর কতো অ্যান্টিপ্রপাগাণ্ডা করেছেন জাহাঙ্গিরের বিরুদ্ধে যে উনি আসতেই চাইলেন না এই জমায়েতে, যখন কিনা আমার বিরুদ্ধে নানা লোকের নানা প্রপাগাণ্ডা সত্বেও এসেছি । জাহাঙ্গিরও নিজের ছেলে খুসরু মির্জার চোখ অন্ধ করে দিলেন আর আব্বাহুজুর অন্ধ লোকটাকে এতো ভয় পেতেন যে তাকে দুর্গের ভেতরেই খতম করে দিলেন । আব্বাহুজুর প্রায়ই অন্য ধর্মের সাধু-সন্তদের ধর্মকথা শোনার নাম করে আগ্রায় ডেকে আনতেন। ওনার ধর্মনিরপেক্ষতার ফাঁদে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে উনি তাদের আস্তিকান্তরিত হবার হুকুম দিতেন। যারা ঐ হুকুম মেনে নিয়ে আস্তিকান্তরিত হতো তারা বেঁচে যেতো। বাকিদের পরদিন সকালেই নানা রকম পৈশাচিক অত্যাচার করে খুন করা হত। সব থেকে বেশী অবাধ্যদের হাতির পায়ের তলায় পিষে মারা হত। তাছাড়া ওনার প্রাসাদের মধ্যে ঘন ঘন যৌন দাসীদের মিনা বাজার  বসিয়ে সেখানে জোর করে ধরে আনা শয়ে-শয়ে কাফের মেয়েদের বেচা-কেনা চলতো, আব্বাহুজুরের জন্য ধরে আনা শয়ে-শয়ে কাফের মেয়েকে উপহার হিসেবে দেয়া, সরকারি খরচে বেশ কয়েকশো নৃত্যপটিয়সী যৌনদাসীর ভরণপোষণ, হারেম সুরক্ষার জন্য কয়েকশো খোজা প্রহরী, ইত্যাদির মধ্য দিয়ে কামুক আব্বাহুজুর ওনার কামনা ও লালসা চরিতার্থ করতেন। একবার আব্বাহুজুর ফতেপুর সিক্রি অবরোধ করে নির্মম অত্যাচারের মধ্য দিয়ে কাফের প্রজাদের সর্বস্ব লুট করেন আর অভিজাত হিন্দু মহিলাদের ধর্ষণ করার আর মাই  কেটে ফেলার হুকুম দেন ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : সেটা কী ? বইয়ের নাম কী ?

আওরঙজেব : ফতোয়ায়ে আলমগীরী,  যাকে আমার ভক্তরা বলে ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া । বইটা ইসলামি আইন সংকলন, যা সেই থেকে এই দেশের আইন ছিল।  সুন্নি হানাফি মাজহাবের ভিত্তিতে শরিয়া আইন এতে সংকলিত হয়েছে। অনেক আলেম এই বই লেখায় মদত দিয়েছেন। এতে কুরআন, সহীহ আল-বুখারী, সহীহ মুসলিম, সুন্না আবু দাউদ ও জামি’আত-তিরমিযী থেকে সব লেখা ইনক্লুড করিয়েছিলুম। বইতে বিভিন্ন সম্ভাব্য পরিস্থিতির সাপেক্ষে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, দাস, যুদ্ধ, সম্পদ, আন্তঃধর্মীয় সম্পর্ক, বিনিময়, কর, অর্থনীতি ও অন্যান্য আইন আর  আইনি নির্দেশনা দেয়া আছে । একশো হানাফি আলেম বইটা সম্পাদনায় অংশগ্রহণ করেছিল। সম্পাদক-মন্ডলীর সভাপতি ছিল শায়খ নিজামুদ্দিন।  বইতে বড়-বড় অক্ষরে লেখা আছে তা ইমাম আবু-হানিফার মাজহাব। 

শাহজাহান : কিন্তু তোর ভাষা তাঁবাদি হয়ে গেছে । তুর্কি, ফারসি, হিন্দুস্তানি মিশিয়ে আমার দরবারে যে উর্দুভাষা চালু করেছিলুম, এখন লোকে সেই ভাষা বোঝে । বাহাদুর শাহ জাফর, গালিব, ফিরাক, ফয়েজ, জোশ মলিহাবাদি, মীর তাকি মীর, হোসেইন-উদ-দৌলা এই ভাষায় শায়রি করেছে।

আওরঙজেব : যতোই যাই বলো, তোমার আর জাহানারার শাহজাহানাবাদ শহর তো ধ্বংস করে দিয়ে গেছে নাদির শাহ । যেটুকু টিকে ছিল, তাও ফিরিঙ্গিরা মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে । তোমার বাপ জাহাঙ্গির নিজের ছেলে খুসরু মির্জার  সমর্থকদের শূলে চড়িয়ে মেরেছিল চাঁদনি চকের দুপাশে দাঁড় করিয়ে আর তা দেখার জন্যে খুসরুকে হাতির পিঠে বসিয়ে চাঁদনি চকে নিয়ে গিয়েছিল হাঁকিয়ে । জাহাঙ্গিরনামা পড়েছো তো ?

শাহজাহান : জানি, জাহানারাকে হিংসে করিস, ও আমার সমর্থনে যুক্তি দেয় বলে ।  আমিও জানি, তুই ক্রীতদাসী  হিরা বাইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলিস আর মেয়েটা  অল্পবয়সে মারা গেল বলে দিওয়ানা হয়ে গিয়েছিলিস । বুড়ো বয়সে মুত্তা রাখেল উদয়পুরী বাইয়ের কবজায় ছিলিস। উদয়পুরী বাই দারা শুকোহর রক্ষিতা ছিল বলে তুই ওই মেয়েটাকে নিজের বিছানায় তুলেছিলিস । ওরা তো ছিল নাস্তিক, তার বেলায় ? এদিকে বিবাহিত স্ত্রী ছাড়া অন্য কোনো নারীর সঙ্গ আস্তিকদের অনুমোদন করে না। তাই মুত্তা। ‘মুত্তা’ বা ‘মুত্তাই’ হচ্ছে অস্থায়ী বিয়ে। নিকার মতো আইনানুগ নয়, কিন্তু বিয়ে তো বটে। তা তুমি যত খুশি মুত্তা করো, কেউ কিচ্ছুটি বলতে আসবে না। এক মুত্তা বেগমের ওপর থেকে বাদশার দিল উঠে গেল তো তার বদলে নতুন কোনো হাসিন মুত্তা বেগমের আবির্ভাব হয় শাহি হারেমে। । নবাব আর শাহজাদাদের প্রথম চার বিবিই শুধু বেগম। বাকিরা মহল। বেগমদের জোর তাদের খানদান, মুত্তা বেগমদের সম্বল তাদের রূপ। তা উদয়পুরির রূপ ছিল আর অদাও। এ দিয়েই সে চুরি করেছিল তোর দিল। তুই ছিলিস উদয়পুরি অন্তঃপ্রাণ। যে অপরাধ করলে অন্য লোকের গর্দান যায়, উদয়পুরি দুষ্টুমি করে সেই কাজ করেছে তোর সামনেই। । মদ-মাদক নিষিদ্ধ করেছিলিস তুই। কিন্তু ফর্সা ত্বকের উদয়পুরির আবার দিন-রাত মদে ডুবে থাকা চাই।   উদয়পুরিও ভালোবেসেছিল তোকে, দারার চিরশত্রুকে। দারা বেঁচে থাকতেই। সেই ভালোবাসায় কোনো খাদ ছিল না, জানি।  মুত্তা বেগম হলেও সাম্রাজ্যের আসলি সম্রাজ্ঞী ছিল উদয়পুরি, তোর বুড়ো বয়সের প্রেমিকা। তোর নয়নের মণি। তাই সন্তানধারণের অনুমতি পেয়েছিল। মুত্তা বেগম হওয়া সত্ত্বেও। মুহম্মদ কামবক্স, উদিপুরির আর তোর ছেলে।  কামবক্সের যখন জন্ম, উদিপুরির বয়স তখন পঁচিশ কি ছাব্বিশ আর তোর পঞ্চাশ। সেই মুহম্মদ কামবক্সকে চিঠি লিখেছিলিস তুই । লিখেছিলিস, ‘তোমার অসুস্থ আম্মিজান আমার মৃত্যুর পর সানন্দে সতী হয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে রাজি।’ মুত্তা উদয়পুরি বাই, সহমরণের দাবি করেছিল আর তুই  কামবক্সকে চিঠি লিখে তা করতে বারন করেছিলিস । প্রেমে পড়া গুনাহ নয় । অন্য ছেলেদের পেছনে লেগেছিলিস কিন্তু মুহম্মদ কামবক্সকে ভালোবাসতিস।

আওরঙজেব : আর তুমি কী করেছ ? জাহানারা আর রোশনারার বিয়ে দিলে জামাইরা-বেয়াইরা মিলে তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তোমাকে বাদশাহের সিংহাসন থেকে উৎখাত করে দিতো । তাই ওদের বিয়ে দাওনি । জাহানারা ওর আত্মজীবনীতে লিখেছে ও এক মালাউন সঙ্গীতশিল্পী রাজপুত যুবকের সঙ্গে প্রেমাবদ্ধ হয়েছিল । আত্মজীবনীতে জাহানারা আধুনিক ট্র্যাজিক নায়িকার মতো ব্যক্তিসত্ত্বার হাহাকার ও যন্ত্রণাকে লিপিবদ্ধ করেছে । তুমি পারমিশান দিলে বিয়ে করতে পারতো । ছেলেটা কাফের বলে দাওনি । তোমার ছোট মেয়ে চিমনি বেগমের সঙ্গে তোমার অবৈধ সম্পর্ক নিয়ে দরবারে হাসাহাসি হতো । বড় মেয়ে জাহানারার সঙ্গেও তোমার অবৈধ সম্পর্ক ছিল। তুমি নিজেই তোমার সম্পর্কের কথা প্রকাশ্যেই বলতে আর যুক্তি দেখাতে যে, গাছে ফল ধরলে বাগানের মালিরই অধিকার সবার আগে স্বাদ গ্রহণ করার। তুমি আমাকে ধর্মের আর প্রেমের গল্প শুনিও না ।

শাহজাহান : আকবর বাদশার হুকুম ছিল যে বাদশাদের মেয়েরা বিয়ে করবে না । ওনার নিজের ভগ্নিপতি ওনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল, ভুলে গেলি ? আকবর সেই জন্য ওকে কোতল করার হুকুম দিয়েছিলেন ।এমন আজগুবি তর্ক জুড়িস ! ওরা নিজেরাও বিয়ে করতে চায়নি, মনের মতন বর পায়নি বলে । জাহানারার সুফিসঙ্গ পছন্দ বলে বিয়ে করেনি । তুই ওকেও আমার সঙ্গে আগ্রার কেল্লায় বন্ধ করে রেখে দিলি । তোর আতঙ্কে দারা শুকোহ’র বউ নাদিরা বেগম আত্মহত্যা করে নিয়েছিল ।

আওরঙজেব : ওই ফিরিঙ্গিরা মহাবিদ্রোহের পর কী করেছে জানো ? তোমার কিলা-এ-মুবারক, যাকে এখন লাল কেল্লা বলে, সেখানকার বেগমদের আর রাখেলদের ধরে-ধরে ধর্ষণ করেছে । তাজমহলে বাজনা বাজিয়ে সাহেব-মেমরা সন্ধ্যাবেলা রোজ নাচতো । ওই গালিবই লিখেছে, লাল কেল্লা থেকে পাগলের মতন বেরিয়ে দৌড়োতে-দৌড়োতে সুন্দরী বেগম আর খাতুনরা ছেঁড়া জামাকাপড়ে চাঁদনি চকে কাঁদছে, ফিরিঙ্গিদের  থেকে প্রাণে বাঁচার জন্য ।

শাহজাহান : তুইই তো দাক্ষিণাত্যে গিয়ে বসে রইলি, দিল্লিকে, আগ্রাকে, লাহোরকে কমজোর করে দিলি । শিবাজী তোর ফাঁদ কেটে উড়ে গেল বলে বুড়ো বয়েস পর্যন্ত দাক্ষিণাত্যে বসে রইলি । তোর নাতিপুতিগুলো আরও কমজোর করে দিল । ফিরিঙ্গিরা ঢুকে পড়ল । হাতে বাজপাখি নিয়ে ছবি আঁকিয়ে ভেবেছিলিস, দাক্ষিণাত্যে বসে দিল্লি-আগ্রাকে সুরক্ষিত রাখবি ।

পাগলা তুগলক : আমার মনে হয় ইনব্রিডিঙের কারণে বংশধারা ক্রমশ দুর্বল হয়ে গিয়েছিল । ইমাম শাফেয়ী  বলেছেন: “যে সম্প্রদায়ের মহিলারা বাইরের কোন পুরুষকে বিবাহ করে না এবং পুরুষেরা বাইরের কোন মেয়েকে বিবাহ করে না, তাদের সন্তান হয় বোকা ধরনের। (আল ইনতিকা ফি ফাদায়িলিস ছালাছাতিল আয়িম্মাঃ ১/৯৮)।  এছাড়া ইমাম গাজজালী  পাত্রী পছন্দ করার ব্যাপারে যেসব  নির্দেশনা দিয়েছেন, তার মধ্যে একটা হল– পাত্রী যেন নিকটবর্তী আত্মীয় না হয়। কেননা, তা তাদের জৈবিক কামনাকে কমিয়ে দেবে। (ইহইয়াউ উলুমুদ্দিন:২/৪১)। নিকটবর্তী আত্মীয়স্বজন যেমন-ফুফাতো, চাচাতো, মামাতো, খালাতো ভাই বোনদেরকে বিবাহ করলে সন্তান দুর্বল হয় বলে অনেক ইসলামিক স্কলারের অভিমত। সে জন্য বলা হয়, বিবাহ দূরবর্তীদের সাথে হলেই ভালো হয়। মোগলরা এতোশত মানতো না । আলীবর্দী খানের কোনও ছেলে ছিল না। তাঁর ছিল তিন মেয়ে । তিন মেয়েকেই তিনি নিজের বড়ভাই হাজি আহমদ-এর তিন ছেলে, নোয়াজেশ মোহাম্মদের সাথে বড় মেয়ে ঘসেটি বেগমের, সাইয়েদ আহম্মদের সাথে মেজ মেয়ে এবং জয়েনউদ্দিন আহম্মদের সাথে ছোট মেয়ে আমেনা বেগম-এর বিয়ে দেন। ঘসেটি বেগম এসেছেন আপনাদের জমায়েতে । 

তোতলা তুগলক : এএএ ছোঁছোছোড়াটা উউউপদেশ দেদেদেবেই । পাপাপারা গেগেগেলো না এএএকে নিনিবিবিয়ে ।

চেঙ্গিজ খান : আরে তোমরা বাপ-বেটায় ঝগড়া করছ কেন ? কোথায় আজকে সবাই মিলে মৌজমস্তি করবে, তা নয় ঝগড়া আরম্ভ করে দিলে ।

মালিক অম্বর : এই অওরঙজেব লোকটা  নিজের বাপের তাজমহলের নকল একটা বাড়ি হাঁকিয়েছে । ওকেই জিগ্যেস করুন সেটা কেমন হয়েছে । লোকে দেখতে যায় আর ছি-ছি করে । ওর নামের রাস্তার নাম দিল্লিতে অলরেডি পালটে দেয়া হয়েছে । ওর নামে শহরের নামও দিনকতকে পালটে যাবে, দেখে নেবেন ।

আওরঙজেব : যাবে তো যাবে । আমি আমার কাজ কারবারের কারণে অনেকের মনের ভেতরে বংশপরম্পরায় থাকবো । 

শাহজাহান : তুই তো উদয়পুরি বাইকে ভালোবাসতিস । ওর সঙ্গে তো নিকা করিসনি, অথচ ওর ছেলের বাপ হলি। উদয়পুরি বাইও তোকে ভালোবাসতো, তার প্রমাণ আছে ।

মালিক অম্বর : শাহজাহান আমাদের রাজত্ব দখল করেছিলেন বলে আওরঙজেব সেখানে গিয়ে লাঠি ঘুরিয়েছিল। মোগল  সম্রাজ্যের দক্ষিণ সীমান্তে আহমেদনগরের  নিজামশাহী রাজ্য ছিল । আমি ছিলুম প্রধানমন্ত্রী । আমি মারা যাবার পর আমার ছেলে ফতেহ খান প্রধানমন্ত্রী হল ।  নিজামশাহী সুলতান মুর্তজা নিজাম গায়ে পড়ে আমার ছেলে ফতেহ খানের সঙ্গে ঝগড়া আরম্ভ করেছিল ।  রাজ্যের সুলতান মর্তুজার সঙ্গে দ্বন্দ্ব আরম্ভ হলে, সুলতান মর্তুজা ফতে খানকে বন্দী করে জেলে পুরে দিলো । পরে উনি ফতে খানকে মুক্তি দেন। ফতে খান এই অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মোগলদের সঙ্গে ষড় করে, সুলতান মর্তুজাকে বন্দী করেছিল, আর  ওনার নাবালক ছেলে হুসেন শাহকে সিংহাসনে বসিয়েছিল। ফলে ফতে খান  রাজ্যের প্রকৃত সুলতানে হয়ে যায়। এই সময় শাহজাহান, আপনি, আহমেদনগর জয় করার সিদ্ধান্ত নেন।  মোগল বাহিনী দৌলতাবাদ দুর্গ অবরোধ করে। ফতে খান দশ লক্ষ টাকা শাহজাহানকে ঘুষ দিয়ে ছাড়া পায় আর দুর্গটা মোগলদের দিয়ে দেয়। সুলতান হুসেন শাহকে গোয়ালিয়র দুর্গে পাঠানো হয়। আর ফতে খানকে মোগল সরকারের উচ্চপদ দেওয়া হয়।

অওরঙজেব : তবে ? আমি কখনও ঘুষখোরি করিনি । আমি যা বলেছি, ঠিকই বলেছি । মোগল সম্রাটদের মধ্যে আব্বাহুজুর ছিলেন সবচেয়ে বিলাসী। আকর্ষণীয় স্থাপত্যের প্রতি ওনার শুধু ঝোঁকই ছিল না; বরং তা রীতিমতো এক নেশায় পরিণত হয়েছিল। ফলে আল-হিন্দ জুড়ে গড়ে উঠেছে  এমন সব শৈল্পিক নিদর্শন, যা পর্যটকরা দেখতে আসে । আরজুমান আরা বেগমের সঙ্গে আব্বা হুজুরের প্রথম দেখা হয় ১৬০৭ সালে। তাঁর রূপে আর সেক্সুয়াল আকর্ষণে মোহিত হয়ে যান পনেরো  বছর বয়সী আব্বাহুজুর । এরপর  তড়িঘড়ি করে সেই বছরেই এঙ্গেজমেন্ট । আমার দাদাহুজুর  জাহাঙ্গীরের বউ নূরজাহান ছিলেন আরজুমানের ফুফু। কিন্তু এঙ্গেজমেন্টের দীর্ঘ পাঁচ বছর পর ১৬১২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে সম্পন্ন হয় তাঁদের। আব্বাহুজুর তাঁর নামকরণ করেন ‘মমতাজ মহল’ । তবে মমতাজ কিন্তু আব্বাহুজুরের একমাত্র স্ত্রী ছিলেন না। ওনার আরও বেগম ছিলেন, এমনকি মমতাজের পরও উনি আরেকটা বিয়ে করেছিলেন, এমনই সেক্সস্টার্ভড মানুষ । মমতাজের  আগে একবার বিয়ে হয়েছিল, আব্বাহুজুরের  ষড়যন্ত্রে সেই সম্পর্কের অবসান ঘটে । তাঁদের দাম্পত্য জীবন স্থায়ী হয় মাত্র উনিশ বছর। এই উনিশ  বছরের দাম্পত্য জীবনে অম্মিজানের কোলজুড়ে আসে চোদ্দটা বাচ্চা। ভেবে দেখুন আপনারা । মারা যান চোদ্দতম সন্তান প্রসবের সময়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে। আব্বাহুজুরেরে কাছে প্রেমের সংজ্ঞা ছিল বছরান্তে একটা করে সন্তান ! আব্বাহুজুরের সেক্সুয়াল চাহিদা উবে যায়নি । অম্মিজান মারা যাবার বছর পাঁচেক পর তাঁরই ছোট বোনের সঙ্গে  বিবাহবহির্ভূত অন্তরঙ্গ  সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। 

ঘসেটি বেগম : বলছিস কী আওরঙজেব ভাইজান !

আওরঙজেব : হ্যাঁ  বেগম। ওনার পুরো নাম আবুল মুজাফফর শিহাবুদ্দিন মুহম্মদ শাহজাহান সাহিব কিরান-ই-সানী । আব্বাহুজুরের  যেমন শৈল্পিক  মন ছিল, তেমনি সেই শিল্পের জন্য অহংবোধও ছিল  প্রবল। পরবর্তী সময়ে যদি সেসব শ্রমিকের হাত ধরে তাজমহলের মতো অন্য কোনো অনিন্দ্যসুন্দর স্থাপনা পৃথিবীর কোনো প্রান্তে দাঁড়িয়ে যায়, তাহলে আব্বাহুজুরের নাম অনেকটা স্তিমিত হয়ে যেতে পারে—এই আশঙ্কায়  চরম বর্বরতার পথ বেছে নেন উনি, তাদের আঙুল কাটার হুকুম দেন । তাজমহলে শ্বেতপাথরের ফলকে ফলকে জগদ্বিখ্যাত যে কারুকার্য খচিত রয়েছে, তাতে শুধু শ্রমিকের ঘাম নয়, মিশে আছে তাজা রক্তও। এসব ছবি যখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তখন তাজমহলকে প্রেমের নিদর্শন বলতে  দ্বিধাবোধ কাজ করলে তা নিশ্চয়ই খুব একটা অযৌক্তিক হবে না। জীবনের শেষ দিকে তাই আমি আব্বাহুজুরকে বন্দী করে রেখেছিলুম । মারা যাবার সময়ে ওনার নাম ছিল ‘শাহানশাহ আল-সুলতান আল-আজম ওয়াল খাকান আল-মুকাররম, মালিক-উল-সালতানাত, আলা হযরত আবু’ল-মুজাফফর শাহাব উদ্দিন মুহাম্মদ শাহ জাহান প্রথম, সাহেব-ই-কিরান-ই-সানী, পাদশাহ গাজী জিল্লু ‘ ল্লা, ফিরদৌস-আশিয়ানি, শাহানশাহ – ই – সুলতানন্ত উল হিন্দিয়া ওয়াল মুঘালিয়া’ । কী দরকার ছিল অমন নাম নেবার?

ঘসেটি বেগম : কিন্তু তাজমহল ছাড়াও দিল্লির জামা মসজিদ, পাকিস্তানে সিন্ধের শাহজাহান মসজিদ, লাহোরের মতি মসজিদ, লাহোরের শালিমার গার্ডেন, লাহোরের ওয়াজির খান মসজিদ, আগ্রার কেল্লা, লাহোরে নওলক্ষা দুর্গ, দিল্লির কেল্লায় দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাস, ময়ূর সিংহাসন উনিই তো তৈরি করে গিয়েছেন ।

আওরঙজেব : সেই কথাই তো তোমাদের বোঝাতে চাইছি । ইজ-উন-নিসা, হাসিনা বেগম, ফতেহপুরি মহল, মোতি বেগম, কুদসিয়া বেগম, আকবরাবাদি মহল — ওনাদের কেন অতোগুলো করে বাচ্চা হয়নি । হারেমে আরও কতো রাখেল, বাঁদি, ক্রীতদাসী ছিল । ওনার জন্যেই আমরা ভাইয়ে-ভাইয়ে আর বাপ-ছেলেতে খুনিখুনি করে মরলুম ।

শাহজাহান : তোর উচিত ছিল ফ্যানি হিল বইটা ফারসিতে অনুবাদ করিয়ে পড়া । প্রেম করেছিস আবার রোয়াবও দেখাচ্ছিস ।

ঘসেটি বেগম : ফ্যানি হিল কার লেখা ? ফারসি, তুর্কি, বাংলা, যে ভাষায় হোক অনুবাদ হলে আমাকে এক কপি দিও। লোকে ভাবে আমার হৃদয়ে প্রেম নেই ।

চেঙ্গিজ খান : তুই অমন করছিস কেন আওরঙজেব ? মশা কামড়াচ্ছে নাকি ?

শাহজাহান : বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে ফ্যানি হিলের মত উপন্যাস খুব কম আছে যা এত বার ছাপা হয়েছে। উনিশশো সত্তর সালের আগে উপন্যাসটার প্রকাশ আইনি স্বীকৃতি পায়নি। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে ব্রিটেন থেকে আমেরিকা, ফ্রান্স, আল-হিন্দ আর অন্যান্য বহু দেশে বইটার বেআইনি সংস্করণ ছাপা হয়েছে। প্রথম প্রকাশের ঠিক এক বছর পরে লেখক ক্লিল্যাণ্ডকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। অশ্লীলতার দায়ে ব্রিটেনের প্রিভি কাউন্সিলের সামনে তাঁকে হাজির হতে হয়। সরকারি ভাবে প্রকাশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বাজার থেকে উপন্যাসটা তুলে নেওয়া হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সব অভিযোগ কাটিয়ে উঠে, ধ্রুপদি সাহিত্যের মর্যাদায় উত্তীর্ণ হয়েছে ফ্যনি হিল। পাঠক সমাজে উপন্যাসটার প্রভাব এত প্রবল ছিল যে লণ্ডনের বিশপ একবার ভূমিকম্পের জন্য বইটিকে দায়ী করেছিলেন।

ফ্যানি হিলের সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য, উপন্যাসটির ভাষা সম্পূর্ণ রূপে বিশুদ্ধ সাহিত্যের, কোনও ভাবেই তার গায়ে বটতলা সাহিত্যের তকমা দেগে দেওয়া যায় না। অক্ষতযোনি ফ্যানি যখন এক কুৎসিত কামুক বেশ্যাসক্ত ইংরেজকে অনুনয় করছে তাকে রেহাই দেওয়ার জন্য, তখন বিকৃত উত্তেজনার বদলে পাঠকের অন্তর ব্যথায় টনটন করে ওঠে। ‘…সে আবার আক্রমণ করছে ফ্যানিকে, জাপটে ধরছে,…উরু দুটিকে নিরাবরণ করছে… ’ – ফ্যানির এমন দুর্দশা পড়ে পাঠকের মনে কাম নয়, জেগে ওঠে করুণা, ক্রোধ ।

উপন্যাসটা মূলত ফ্যানির দুটি দীর্ঘ চিঠির উপর দাঁড়িয়ে। একটি চিঠি নিয়ে প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় চিঠি নিয়ে পরের খণ্ড। মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে, বাবা-মাকে হারিয়ে, ল্যাঙ্কাশায়ারের একটি গ্রামের মেয়ে ফ্যানি, ক্রীতদাসীর চাকরির খোঁজে লণ্ডন শহরে পৌঁছয়। সেখানে তাকে ফুসলে নিয়ে যাওয়া হয়  পতিতালয়ে, যেখানে তার সঙ্গে চার্লসের পরিচয় হয়। চার্লসের প্রেমে পড়ে যায় ফ্যানি। উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের পাতায় পাতায় বর্ণিত হয়েছে চার্লস ও ফ্যানির প্রেমের সম্পর্ক। কখনও তা পৌঁছেছে কবিতার ভাষায়। ‘…চার্লস আমাকে দেখতে লাগল। আমার শরীরের সব ঐশ্বর্য তার দৃষ্টি ধীর ধীরে উপভোগ করছে। তার হাত দুটি একই সঙ্গে ব্যস্ত আমার শরীরের সর্বত্র।…আমার তাজা সুঠাম অবয়ব, আমার অঙ্গের নিজস্ব ভঙ্গি-ছন্দ, সব কিছু যেন ওকে মন্ত্রমুগ্ধ করেছে। কিন্তু এই শরীরের ওপর দিয়েই তো কিছুক্ষণ আগে আমারই উৎসাহে ঘটে গেছে ওর প্রবল প্রবাহ। এখন ও চাইছে ব্যথা ও ক্ষতর জায়গাগুলোকে মায়াময় চোখ দিয়ে দেখতে।…কিছুক্ষণ পরেই আবার নতুন উদ্যমে শুরু হল ঝড়।’

ফ্যানি হিলের মত উপন্যাস বিশ্ব সাহিত্যে খুব বেশি নেই যার ভাষা, চরিত্রায়ন ইত্যাদি সব কিছু যৌনতার বর্ণনাকে নস্যাৎ করে সামগ্রিক ভাবে ক্লিল্যান্ডের সৃষ্টিকে অনেক উঁচু আসনে বসিয়েছে। পরবর্তী কালে ক্লিল্যান্ডের লেখা আরও দুটি উপন্যাস যথাক্রমে ‘দ্য সারপ্রাইজেস অফ লাভ’ বা ‘দ্য উওম্যান অফ অনার’ কিন্তু কখনও ‘ফ্যানি হিলের’ সমান উচ্চতায় উঠতে পারেনি। আসলে লেখক ফ্যানিকে সাধারণ বেশ্যাদের তুলনায় এক অন্য অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছিলেন যেখানে ফ্যানি, তার বেশ্যালয়ের যৌনকর্মের মধ্যে ব্যর্থতা বা অনুশোচনা বা হা-হুতাশ নয়, অনুভব করে এক চরম শারীরিক আনন্দ যার সঙ্গে এক অর্থে নারীর স্বাভাবিক ও ন্যায্য শরীরি মুক্তির কথাও অব্যক্ত হয়ে থাকে যা সেই সময়ের পাশ্চাত্য সমাজে ছিল কল্পনারও বাইরে। ‘আমার সুন্দর পুরুষটি তখন যেন আমার শরীরের সঙ্গে বিচিত্র প্যাঁচে পাকে-পাকে জুড়ে আছে, যাতে আমাদের শরীরের গোপন অন্দরমহল পরস্পরকে ছুঁতে পারে।…’

ঘসেটি বেগম : দারুন, দারুন, আমাকে প্লিজ এক কপি যোগাড় করে দিন শাহানশাহ আল-সুলতান আল-আজম ওয়াল খাকান আল-মুকাররম, মালিক-উল-সালতানাত, আলা হযরত আবু’ল-মুজাফফর শাহাব উদ্দিন মুহাম্মদ শাহ জাহান প্রথম, সাহেব-ই-কিরান-ই-সানী, পাদশাহ গাজী জিল্লু ‘ ল্লা, ফিরদৌস-আশিয়ানি, শাহানশাহ – ই – সুলতানন্ত উল হিন্দিয়া ওয়াল মুঘালিয়া ।

খোকা তুগলক : আমারও এক কপি চাই । 

তোতলা তুগলক : তুতুতুইই কীকী করবি ? 

চেঙ্গিজ খান : কী রে আওরঙজেব, কী হয়েছে ? 

আওরঙজেব : না চেঙ্গিজদাদু, এই ছোঁড়া-ছুঁড়িগুলো আমাকে বিরক্ত করছে :

ল্যাঙড়া তৈমুর : ছোঁড়া-ছুঁড়ি ? কোথায় ছোঁড়া ? কই ছুঁড়ি ? আসার সময়ে আফিমের শরবত আর মদ মিশিয়ে খেয়ে এসেছিস ? তুই তো ওসব ছেড়ে দিয়েছিস শুনেছিলুম ।

আওরঙজেব : দেখতে পাচ্ছেন না ? আমি তো স্পষ্ট দেখছি । অ্যাই, তোমরা বিরক্ত কোরো না । লেখা নেবার হলে অন্যদের কাছে যাও । আমি আর কবিতা লিখি না । ফরমান লিখি ।

রুহ : হিঁঃ হিঁঃ হিঁঃ, আমি দারা শুকোহ, চিনতে পারছিস না ভাইজান ! আমাকে কোথায় দাফন করেছিলিস রে? আল-হিন্দের প্রত্নতাত্বিকরা হুমায়ুন-মকবরায় তিনশো কবর খুঁড়ে, ডিএনএ জাঁচ করিয়ে, আমার হাড়গোড় পায়নি! 

রুহ : হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ, আমি জাহানারা, বাদশা বেগম । ভাইজান, ভুলে গেলি ?

রুহ : কী রে ভাইজান, মনে পড়ছে না ? আমি মুরাদ বকশ । তুই আসবি শুনে আমরা দেখা করতে এসেছি।

রুহ : কেমন আছো আল-সুলতান আল-আজম ওয়াল খাকান আল-মুকাররম আবুল মুজাফফর মুহি উদ-দিন মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব  বাহাদুর আলমগীর  বাদশা গাজী, প্রথম আলমগীর ? আমাকে চিনতে পারছ না ? আমি সম্ভাজি, মারাঠা রাজ্যের শাসক । নিজেও তো কতো বড়ো নাম হাঁকিয়েছিলে ?

রুহ : আমাকে চিনতে পারলি না ? আমি নবম শিখ গুরু তেগ বাহাদুর ।

রুহ : আমি শাহ সুজা । মনে পড়েছে ?

রুহ : আমি আপনার ছেলে আকবর । মনে পড়ছে আব্বু ?

জোড়া-রুহ :  কী বুঢঢা ? আমরা দুজন বাচ্চা ছেলে, চিনতে পারছো ? আমাদের বাবার নাম গুরুগোবিন্দ সিংহ !

রুহ : কী চাচাজান ? চিনতে পারছো ? আমি সুলেমান শিকোহ, দারা শুকোহ’র ছেলে । মনে পড়ছে কেমন করে আমায় খুন করেছিলে ?

রুহ : আব্বাহুজুর ! আমি জেব-উন-নিসা, তোমার মেয়ে, নব্বুই বছর বয়স হয়ে গেল, এখনও গদি আঁকড়ে আছো ? মনে পড়ছে আমাকে ? সেলিমগঢ় দুর্গে সারাজীবন বন্দি করে রেখেছিলে ?

চেঙ্গিজ খান : আরে, অমন করে পালালো কেন আওরঙজেব ? ময়ুর সিংহাসনে তো বসেছিল একবার !

ভাগমতি : আপনারা আমার কথা শুনছেন না । ওই ভদ্রলোক বুড়ো হয়ে গেছেন, আত্মীয়স্বজন নেই, তাই হয়তো মাথাটা একটু বিগড়ে গিয়ে থাকবে ।

আওরঙজেব : দেখে নেবো । সব্বাইকে দেখে নেবো । আমাকে চেনো না । দেখাচ্ছি মজা । কফিহাউস থেকে বেরিয়ে নিচে এসো, টের পাবে কতো গমে কতো পরোটা । আমার চামচারা নিচে অপেক্ষা করছে তোদের আড়ং ধোলাই দেবার জন্য । খুলদাবাদ থেকে ট্রেন বাস বদল করে-করে অনেক কষ্টে আসতে হয়েছিল ।

মালিক অম্বর : এই লোকটার ফলোয়াররা   পাশের দেশের বাঙালি-বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, , ছাত্রনেতা শেখ কামাল, শেখ জামাল, তাদের নতুন বিয়ে-করা বউ সুলতানা কামাল আর রোজী জামালকে খুন করেছিল । তাদের হাতের মেহেদির রং বুকের তাজা রক্তে মিশে একাকার হয়ে গেল। তারা খুন করল মুজিবের ভাই শেখ আবু নাসেরকে,  সামরিক বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার কর্নেল জামিলকে, যিনি নিরাপত্তা দেবার জন্য ছুটে গিয়েছিলেন। খুন করল ডিউটিতে থাকা পুলিশ অফিসার আর কর্মকর্তাদের। আর সব শেষে খুন করল শেখ রাসেলকে, যার বয়স ছিল মাত্র দশ বছর। ওদের ভাষায়, রাসেলকে মার্সি মার্ডার  করা হয়েছিল। একই সঙ্গে একই সময়ে তারা খুন করেছিল যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনিকে আর তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনিকে। খুন করেছিল কৃষকনেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাতকে, তাঁর তেরো বছরের মেয়ে বেবিকে। রাসেলের খেলার সাথি দশ বছরের আরিফকে। বড়ো ছেলে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর বড়ো ছেলে চার বছরের সুকান্তকে, তাঁর ভাইয়ের ছেলে সাংবাদিক  সেরনিয়াবাত নান্টুসহ পরিচারিকা আর আশ্রিত কয়েকজনকে।

ল্যাঙড়া তৈমুর : সব দোষ আওরঙজেবের নয় । এর জন্য ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খলজিও অনেকটা দায়ি । 

চেঙ্গিজ খান : কী বলছ হে !!

মালিক অম্বর : হ্যাঁ, চেঙ্গিজদাদু । স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল তাঁরই মন্ত্রিপরিষদ সদস্য খন্দকার মোশতাক, রাষ্ট্রপতি হওয়ার খায়েশে। খুনিদের দলে ছিল কর্নেল রশিদ, কর্নেল ফারুক, মেজর ডালিম, হুদা, শাহরিয়ার, মহিউদ্দিন, খায়রুজ্জামান, মোসলেম গং। 

শাহজাহান : খুনোখুনির কথা শুনে মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে । এবার প্রেমের কথাই শোনা যাক।

ল্যাঙড়া তৈমুর : ঠিক আছে ভাগমতিদিদি, আপনার প্রেমের কথা বলুন । এখন প্রেম সম্পর্কে আমার সুস্পষ্ট আইডিয়া হয়েছে, যদিও আমার কোনও প্রেমিকা ছিল না ।

ভাগমতি : তখন আমার প্রেমিক মাত্র চোদ্দ বছরের রাজপুত্র।  একদিন মুসা নদীর পাড় ধরে আনমনে যাচ্ছিলেন রাজপুত্র, তখন  দেখলেন যে অনেকেই  মুসা নদীর ওপর নড়বড়ে কাঠের সেতু পেরিয়ে চলেছে ওপারে।কৌতুহলের বশে কয়েকজন কে প্রশ্ন করে জানলেন যে নদীর উল্টোদিকের জায়গাটার নাম যুক্তপুরা। সেখানে একটা গ্রাম আছে চিচলাম বলে।এই গ্রামে  রূপসী নর্তকী আছেন, অসাধারণ কুচিপুড়ি নাচ করেন। কোন মানবীর পক্ষে সেই স্বর্গীয় নাচ করা সম্ভব নয়। উনি নিশ্চয়ই কোন শাপভ্রষ্টা দেবী, স্থানীয় মন্দিরে আজ সেই দেবী নাচবেন । এঁরা চলেছেন তাঁর নাচ দেখতে। সেই মেয়েটাই আমি,  ভাগ্যমতি, আমি নিজের ছন্দে নাচছিলুম । তখন আমর কুড়ি বছর বয়স, আমাকে দেখে রাজপুত্র আমায় ভালোবেসে ফেললেন । আমার নাচ দেখার জন্য আর কোনও লোকের অধিকার রইলো না। শুধু রাজপুত্রের জন্যই আমি নাচতুম। তাঁর বাবা রাজপুত্রের এই অভিসার বন্ধ করতে পারলেন না ।  একবার মুসা নদীতে ভয়ঙ্কর বান এসেছে শুনে পাগলের মতন ঘোড়া ছুটিয়ে আমার কাছে পৌঁছনোর জন্য ঘোড়া শুদ্ধ নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন রাজকুমার । 

শাহজাহান : তারপর ? দারুন প্রেম তো !

ভাগমতি : এ ঘটনার পরে সুলতান ইব্রাহিম ছেলের যাতায়াতের জন্য মুসা নদীর ওপর পাথরের   সেতু তৈরি করান যার এখনকার নাম পুরানা পুল।  সুলতান ইব্রাহিম মারা গেলে  সিংহাসনে বসেন আমার প্রেমিক রাজকুমার মহম্মদ কুলি কুতুব শাহ। সকলের আপত্তি অগ্রাহ্য করে ওনার থেকে বয়সে বড় আমাকে উনি বিয়ে করেন । আমাকে  দেওয়া ওনার উপহার ছিল এক নতুন শহরের পত্তন— ভাগ্যনগর। আমি তো কাফের হিন্দু ছিলুম । ইসলাম ধর্ম নিয়ে আমার নাম রাখা হয়  ‘হায়দার মহল’ আর নতুন শহরের নাম হয় হায়দরাবাদ। যে বছর আমার প্রেমিক-স্বামী কুলি কুতুব শাহ মারা গেলেন, সেই বছর আমিও মারা গেলুম । আমাকে আমার প্রেমিকের পাশে গোর দেয়া হয়নি ; ইতিহাস থেকে আমাকে লোপাট করে দেয়া হয়েছে । কিন্তু আমার মেয়ে হায়াৎবক্স বেগমের কবর আছে, আমার জামাই মুহম্মদ কুতুব শাহ, ওদের ছেলে আবদুল্লা কুতুব শাহের সমাধি আছে ; এমনকি আবদুল্লা কুতুব শাহের গায়িকা প্রেমিকা তারামতির কবর আছে । আমি রয়ে গেছি গল্প হয়ে।

ঘসেটি বেগম : ভাগমতিদিদি, গল্পের জোর বেশি হয় কবরের চেয়ে । আমাকে দ্যাখো । আমার তো একটা নাম আছে। অথচ লোকে আমাকে ঘসেটি বেগম বলে বদনাম করে ।

ভাগমতি : আমি উঠি ঘসেটি বেগম আপা । আমার তো কবর নেই । আমাকে আমার গল্পে ফিরে যেতে হবে ।

ঘসেটি বেগম : আমারও তো কবর নেই । আমার আর ওসামা বিন লাদেনের জলকবর । জলের তলায় গিয়ে দেখি ওসামা বিন লাদেন ইউ টিউবে সুচিত্রা-উত্তমের ফিল্ম দেখছে । বলছিল, মালাউন মেয়েরা যে এমন সুন্দরী হয় তা জানতো না । যদি জানতো তাহলে বোমা-বন্দুক নিয়ে খুনোখুনি খেলতো না । অনেকে ছিল আমাদের সঙ্গে । ফর্সামনতন একজন বউ তার নাম শ্রীদেবী আর একজন কালো বউ তার নাম হুইটনি হুসটন, ওরা দুজনে নেশা করে স্নানের টবে ডুবে মারা গিয়েছিল । আর ছিল ব্রায়ান জোনস, লে কর্বুজিয়, হার্ট ক্রেন, ডেনিস উইলসন, অরুণেশ ঘোষ, আরও অনেকে, নানা দেশের পোশাকে ।

ভাগমতি : আহা গো !

ঘসেটি বেগম : জানো তো ? বব ব্যাটা আর মীরজাফরের সঙ্গে পলাশীর যুদ্ধে গোপন চক্রান্তে হাত মিলিয়েছিলুম। বলেছিলুম যতো টাকা লাগে দেবো। বব ব্যাটা আর  মীরজাফর তা বিশ্বাস করেছিল।   নবাব সিরাজউদ্দৌলা যুদ্ধে হেরে মরে গেল, আর মীরজাফরটা ববের হাতের পুতুল হয়ে মসনদে চড়ে বসলো।  ক্ষমতায় প্রভাব ছড়ানোর যে স্বপ্ন দেখেছিলুম তা দুঃস্বপ্ন হয়ে গেল বব ব্যাটার আধিপত্যের কারণে। মোটা টাকা দিতে পারিনি বলে মীরজাফর আর ওর ছেলে মীরমিরন আমার পোঁদে লাগলো। আমাকে বন্দী করে পাঠিয়ে দিলো পুরোনো  ঢাকার জিনজিরা প্রাসাদে। তবু আমি নানান প্যাঁচ কষেছিলুম। ব্যাটারা চটে গিয়ে ভাবলো ভবিষ্যতে বিপদ হতে পারে ।   মীরজাফরটা   কুষ্ঠ রোগে ভুগে মরেছে, বেশ হয়েছে ।  মিরন কয়েকজন অনুচরকে পাঠিয়েছিল জিনজিরায়। মুর্শিদাবাদে নিয়ে যাবার নাম করে আমরা দুই বোন আমেনা বেগম আর আমাকে, সিরাজের নিকটাত্মীয়দের, নৌকায় তুলে বুড়িগঙ্গা-ধলেশ্বরীর  ঠিক  মাঝনদীতে ওদের প্ল্যান অনুযায়ী মিরনের অনুচর আসফ খাঁ নৌকার তলার খিলগুলো খুলে দিয়েছিল। সলিল সমাধি হয়েছিল বুড়িগঙ্গা নদীতে সিরাজের মা আর খালার। এর ঠিক এক সপ্তাহ পরে মীরজাফরের ছেলে মিরন ব্যাটা মাথায় বাজ পড়ে মরেছিল, বেশ হয়েছিল, যেমন কর্ম তেমনি ফল ।

চেঙ্গিজ খান : কী রে ল্যাঙড়া ! তুই বলেছিলিস অনেকে আসবে কফিহাউসে । দারুন একখানা জমঘট হবে । কিন্তু সবাই তো আসছে আর চলে যাচ্ছে । তার চেয়ে চল খালাসিটোলায় যাই, ওখানে নিশ্চয়ই অনেক মালখোরকে পাওয়া যাবে ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : উতলা হচ্ছেন কেন চেঙ্গিজদা ? আসবে, আসবে, আমি গুলবদন বেগম, গালিব, বাহাদুর শাহ জাফর, জিনত উন নিসা, মোহম্মদ শাহ রঙ্গিলা, সেনোরা জুলিয়ানা ডা কোসটা, চঞ্চল বাই, সুরোশ বাই, ধ্যান বাই, নাদিরা বানু, বৈরাম খাঁ, মহব্বত খান, সাদুল্লা, মীরজুমলা আর শাহজাহানাবাদের অনেককে বলেছি যে  চেঙ্গিজদা আসছেন কফিহাউসে ।

শাহজাহান : ততোক্ষণ ওই প্রেমিক-প্রেমিকাদের দেখুন, কেমন পরস্পর ফিসফিসানিতে মশগুল ।

চেঙ্গিজ খান : ওনারা কে ? চিনিস ?

শাহজাহান : চিনি চেঙ্গিজদাদু । লুঙ্গিপরা বাবরিচুল লোকটা হল চণ্ডিদাসদা, তার সামনে বিনা ব্লাউজের মেয়েটি রামিদিদি। গোবেচারা জবুথবু ভদ্রলোক হলেন জীবনানন্দদা আর ওনার সামনের সুন্দরীর নাম বনলতা সেনদিদি । মোটা মতন লোকটা , চুলে কলপ সাদা জুলফি, ওনার নাম সুনীলদা তার সামনে মেয়েটা, যদিও বয়স অনেক কম, তার নাম নীরাদিদি । নিজের মনে কথা বলছেন ওই লোকটা বিনয়দা আর ওনার সামনে ন্যাড়ামাথা মেয়েটি গায়ত্রীদিদি । ওপরে দেখুন বারান্দায় ওই চশমা-পরা লোকটা ভাস্করদা আর ওঁর সামনে, আমাদের দিকে পেছন ফিরে ওই মেয়েটির নাম সুপর্ণাদিদি । ওদের পাশের টেবিলে চুপ করে বসে আছেন দুজনেই, শক্তিদা আর শীলাদিদি । তার পাশের টেবিলে যাঁরা, তাঁরা বাংলাদেশি আবুল হাসান আর সুরাইয়া খানম । হামিদুর রহমান আর নভেরা আহমেদ।

বাবর : এখানে হোমোরা আসে ?

শাহজাহান : হ্যাঁ,  ওই তো । অ্যালেনদা আর অরলভস্কিদা । ওনারা বিদেশ থেকে এসেছেন । এদেশের কারা হোমো বলতে পারব না । রঙিন মিছিল বেরোয় তাতে তো কবি বা কবিনীদের দেখিনি কখনও ।

চেঙ্গিজ খান : শাহজাহানাবাদের কথা বলছিল ল্যাঙড়া তৈমুর । জায়গাটা কোথায় ?

শাহজাহান : চেঙ্গিজদাদু, আপনি সেনর ভাস্কো দা গামার মুখে শুনুন, নয়তো নিজেরই গুণগান করা হবে ।

ভাস্কো দা গামা : এখনকার পুরোনো দিল্লির নাম শাহজাহানাবাদ, তৈরি হয়েছিল জাহানারাবেগমের প্ল্যান অনুযায়ী। এখন আল-হিন্দের রাজধানি দিল্লি শহরের  অংশ।  শাহজাহানবাদ নামে পাঁচিল ঘেরা শহর হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল  । শাহজাহান, সে সময়ের মোগল সম্রাট, আগ্রা থেকে মোগল রাজধানী দিল্লিতে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।  শহরটা তৈরি করতে তিরিশ বছর লেগেছিল। আল-হিন্দের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে পতনের আগে পর্যন্ত শাহজাহানাবাদ ছিল মোগল সাম্রাজ্যের রাজধানী ।  সুন্দর মসজিদ আর বাগানে সাজানো ছিল ।  রাজপুত্রদের, আর সম্রাটের বাড়ির সদস্যদের ভবনে ভরা ছিল। আল-হিন্দের অন্য জায়গা থেকে আসা লোকেদের  ঢেউয়ের ফলে এখন  অত্যন্ত জনাকীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও, এটা এখনও মহানগর দিল্লির প্রতীকী হৃদয় হিসাবে কাজ করে। আর বাজার, স্ট্রিট ফুড, শপিংয়ের জায়গা আর মোগল স্থাপত্যের জন্য পরিচিত; পুরানো শহরের মাঝে বিশাল দাঁড়িয়ে আছে শাহজাহানের তৈরি  জামে মসজিদ । সেসময়ের মাত্র কয়েকটা হাভেলি টিকে রয়েছে  । শাহজাহানাবাদের ঠিক মাঝখানে দিল্লির লাল কেল্লা । তবে সেই লাল কেল্লা আর নেই । আর মাঝখানের জায়গাটার নাম এখন চাঁদনি চৌক ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : চাঁদনি চক নাম কেন ?

ভাস্কো দা গামা : চাঁদনী চৌক বা ‘মুনলিট স্কয়ার’  শাহজাহানের মেয়ে জাহানারা বেগম তৈরি করেছিলেন। শাহজাহানাবাদে বিবি কা সেরাইয়ের সামনে ছিল একটা ঝিল, চারপাশে ছিল বাড়ি, আর চাঁদনি রাতে, এই ঝিলে  চাঁদনি প্রতিবিম্বিত হয়ে ভবনগুলোকে আলোকিত করত –  তাই এর নাম চাঁদনী চৌক । এখন আবার চাঁদনি চৌককে পুরোনো দিনের জৌলুস দেবার চেষ্টা করা হচ্ছে । লাল কেল্লা আর ফতেহপুরী মসজিদটির দু’পাশে চাঁদনী চৌক বাজারের সামনে দেড় কিলোমিটার  পুনর্নির্মাণ করা হচ্ছে যা হবে কেবলমাত্র পথচারীদের জন্য । মোগল-যুগের স্হাপত্যের অনুকরণে প্রশস্ত ওয়াকওয়ে, জলের ব্যবস্হা, এটিএম, টয়লেট কমপ্লেক্স আর রাস্তার পাশে বসার বন্দোবস্ত থাকবে।

চেঙ্গিজ খান : কী রে ল্যাঙড়া ! মীরজাফর, সিরাজ, মীরান, মুর্শিদকুলি খান, আলিবর্দী খান, ওদের খবর দিয়েছিলিস যে আমি কফিহাউসে গ্যাঁজাতে আসবো ?

ল্যাঙড়া তৈমুর : জানেন তো চেঙ্গিজদা, মির্জা মুহম্মদ সিরাজউদ্দৌলা হলো  আলীবর্দী খানের দৌহিত্র আর   জৈনুদ্দীন আহমদ খান আর  আমিনা বেগমের ছেলে । জানতে চাইছিল কোন ঘাটে নেমে কলেজ স্ট্রিটের কফিহাউসে পৌঁছোতে হবে, আর সেখান থেকে সোনাগাছি কতোদূরে ! ব্যাটা আমাদের মতন তরোয়াল চালাতে শিখবে, তা নয়, মাগিবাজি আর কচিকাঁচাদের পোঁদ মারায় সময় নষ্ট করে । এও ইনব্রিডিঙের ফসল ।

ঘসেটি বেগম : ওরা না এলেই ভালো । আমি তো ট্রেনে করে এসেছি । ওরা এসে তোমাদের মিসোজিনিস্ট আড্ডাকে আরও নোংরা করে দেবে । যত্তো সব পিতৃতান্ত্রিক ষড়যন্ত্র । 

ঢ্যাঙা তুগলক : একটিমাত্র চোখ, হেমলকে প্রতিবিম্বিত চক্ষুসদৃশ, তাহার দিকেই, মিলন অভিলাষিণী নববধূর দিকে চাহিয়াছিল, যে চক্ষু কাঠের, কারণ নৌকাগাত্রে অঙ্কিত, তাহা সিন্দুর অঙ্কিত এবং ক্রমাগত জলোচ্ছ্বাসে সিক্ত, অশ্রুপাতক্ষম, ফলে কোথাও মায়া রহিয়া গেল।

তোতলা তুগলক : নিজের মনে বিড় বিড় করা তোর গেলো না রে ঢ্যাঙা !

ল্যাঙড়া তৈমুর : ওই যে কে একজন এলেন । আমি তো চিনি না । তুমি কে গো বাছা ?

সাবিত্রী নামবুদিরি : আমার নাম সাবিত্রী নামবুদিরি, কেরালা থেকে আসছি, মানে কোচিন । চেঙ্গিজবাবু কলকাতার কফিহাউসে আসছেন আর জব্বর আড্ডা হবে শুনে থাকতে পারলুম না । আমার গল্প তো আপনারা জানেনই না । শুনে আপনাদের লবডঙ্কার লঙ্কা ঝুলে পড়বে !

ভাস্কো দা গামা : কেরালায় তো অনেক মালায়ালিকে আমরা আস্তিকান্তরিত করেছিলুম, আপনি কি তাদের বাড়ির কেউ ?

সাবিত্রী নামবুদিরি : না, আমি ঘোর নাস্তিক । ছেষট্টিজন আস্তিকের কাছা খুলে নিয়েছি । রসিয়ে রসিয়ে বলব কিন্তু। আমি একাই নবজাগরণ ঘটিয়ে দিয়েছি নামবুদ্রী বামুনদের সমাজব্যবস্হায় । এখনকার রাজনীতিতে তাই ওরা বেপাত্তা।

চেঙ্গিজ খান : মানে ?

সাবিত্রী নামবুদিরি : আমি কেরালার এক নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণের মেয়ে । আমার জন্মের সময় নক্ষত্ররা বিপদ সংকেত দিয়েছিল । জানেন তো নাম্বুদিরির পুরুষরা সব সময় বিশুদ্ধ থাকার ভান করে । নাম্বুদিরি মহিলাদের কাছে অমন বিশুদ্ধতা হলো অভিশাপ। তারা নির্দ্বিধায় চলাফেরা করতে পারে না, কারণ তাহলে অপরিচিতদের দৃষ্টিতে তারা অধঃপতিত হয় । পুরুষদের খাওয়ার আগে তারা খেতে পারে না, তবে রান্না করাটা  তাদের  দায়িত্ব। তারা সোনার কোনও অলঙ্কার পরতে পারত না, নাম্বুদিরি কনের জন্য কেবল পিতলের চুড়ি । অল্প বয়স্ক যুবকরা যখন নিয়ম মেনে চলত, তখন পুরানো নিয়মের কারাগারে আটকে পড়ত মেয়েরা  । আমি ছিলুম অন্তরালবর্তিনী, পরদার বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। তাদের চোখ আছে তবে আনন্দের ব্যাপার দেখা বারন ।  তাদের পা আছে তবে তাদের চলাচল নিষিদ্ধ । বাড়ির মেয়ে আর বউরা যেন জেলখানার প্রাণী ।  তাদের তাজা বাতাসে শ্বাস নেয়া, পৃথিবী দেখার অনুমতি নেই। একজন নাট্যকার  তো আমাদের জীবনকে  নরকের স্বীকৃতি দিয়েছিল । “একজন অন্তরালবর্তিনী কাঁদতে-কাঁদতে জন্মেছে, কান্নায় তার বেঁচে থাকা, আর কেঁদে কেঁদে মরে যাওয়া” । নামবুদিরিদের, নিজেরা ছাড়া, কোনও ঈশ্বর ছিল না ; শ্রদ্ধার জন্য কয়েকশো দেবতা ছিল – উত্তরে দেবতা, দক্ষিণে দেবতা; পূর্ব এবং পশ্চিমে, ছাদে দেবতা, মন্দিরে দেবতা আর আগুনেও দেবতা । এই সমস্ত দেবতাদের অনেক দাবী । তাদের  স্নান করাতে হবে – সকালে একটি স্নান এবং সন্ধ্যায় এক। আপনি বাসা থেকে বের হলে একটি স্নান, এবং কোনও যাত্রী দ্বার পেরিয়ে গেলে স্নান। যদি নিম্নবর্ণ আপনার পথে আসে, তবে স্নান  করতে হবে ।  বিশুদ্ধতা ছিল লক্ষ্য, কিন্তু এটি ছিল আনুষ্ঠানিক নিপীড়নের উপায় ।  হাতে তারা হাতকড়া পরিয়ে  দিল আর মনকে করা হলো দাস । রাজারা নামবুদিরি পুরুষদের   প্রণাম  করতেন, আর  রাজার বোনরাও  প্রণাম করতো । বউদের একমাত্র কাজ সন্তানদের জন্ম দেওয়া। আর পুরুষ  যদি  অন্য স্ত্রী আনে, তবে প্রথম স্ত্রীকে আনন্দ করতে হবে  যাতে আরও একজন দাসত্বের আনন্দ উপভোগ করতে পারে । দুইবার জন্মগ্রহণকারী প্রভুর নির্দেশে দেহ ও আত্মাকে স্বামীকে উপহার দেয় তারা। 

ল্যাঙড়া তৈমুর : সাবিত্রীদিদি, আসল গল্পটা বলুন তো । আমি যে ধৈর্য হারিয়ে ফেলছি ।

সাবিত্রী নামবুদিরি : আঠারো বছর বয়সে আমাকে একজন বুড়ো নামবুদিরির সঙ্গে বিয়ে দেয়া হলো । তার তো লিঙ্গই দাঁড়াতো না । আমার  থিয়েটার দেখতে ভালো লাগতো, কিন্তু বুড়ো বর কোথ্থাও নিয়ে যেতো না । একদিন আমি একজন কথাকলি অভিনেতার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করলুম। কী যে আনন্দ, কী বলব ! লোকটা তখন কীচক সেজেছিল, যে অন্যের স্ত্রীকে পেতে চায় । ব্যাস রাস্তা খুলে গেল । আমি বহু পুরুষের সঙ্গে সেক্স করলুম ।  এমনকি নামবুদিরি পুরুষদের সঙ্গেও, যারা সবসময় পবিত্রতার ভান করে ।

চেঙ্গিজ খান : তারপর ?

সাবিত্রী নামবুদিরি : বছরটা ছিল ১৯০৫, আর  কেলেঙ্কারিটা সংবাদপত্রে ফলাও করে প্রকাশিত হলো । সমস্ত কেরালায় একই সঙ্গে আমার বিরুদ্ধে আর নামবুদিরিদের বিরুদ্ধে লোকে রাগে ফেটে পড়ল । আধুনিকতার ঢেউ থেকে নামবুদিরিরা খুব দূরে থাকতো। হঠাৎ তাদের মহাবিশ্ব ডুবে যেতে লাগল । ওদের নৌকায় ইতিমধ্যে আমি ছ্যাঁদা করে দিয়েছিলুম যা বন্ধ করার উপায় ছিল না । আমাকে যখন রাজা জিগ্যেস করলেন, আমি বলেছিলুম “আমি একা আইন ভঙ্গ করিনি। যে লোকগুলো আমার শোবার ঘরে এসেছিল তাদেরও বিচার করা উচিত। আমি বিশ্বাসঘাতকদের তালিকা তৈরি করে প্রকাশ করে দিলুম । আমি যাদের সঙ্গে সেক্স করেছি তাদের নাম আর তারিখগুলো জানতুম, এমনকি তাদের পরিবারের নামও জানতুম । আরও অনেক বিবরণ – যেমন দেহের জন্মচিহ্ন, কোথায় জড়ুল বা  একটি তিল আছে ইত্যাদি  । ছেষট্টিজনের পুরো তালিকা দেখে ঢি-ঢি পড়ে গেল কেরালায় । তারপর থেকে নামবুদিরিরা অনেক পালটেছে । আমি চলে গিয়েছিলুম তামিলনাডুতে, নাম বদলে  থাকতুম । সেখানেই আমার শবদাহ হয়েছিল ।

ভাস্কো দা গামা : নিচু জাতের অবস্হার সুযোগ আমরা যেমন নিয়েছি, তেমন ডাচ আর ব্রিটিশরাও নিয়েছিল ।১৮৭১ সালের মাদ্রাজের প্রেসিডেন্সি আদমশুমারির প্রতিবেদনে দাসত্ব সম্পর্কিত একটি নোটে, আদমশুমারি কমিশনার উল্লেখ করেছিল যে কোনোরকম ব্যতিক্রম ছাড়া পুরো নিম্নবর্ণ সম্প্রদায়  উচ্চতর বর্ণের দাস ছিল , আর কৃষিক্ষেত্রের প্রায় সব চাষির একই রকম  অবস্থা ছিল।সেসময়ে  হিন্দু আইনের আওতায় আনুষ্ঠানিকভাবে পনেরো ধরণের দাসত্ব স্বীকৃত ছিল এবং স্পষ্টতই ব্রাহ্মণরা কখনও দাস হতে পারতো না। পর্তুগিজ বা ডাচ দাসব্যবসায়ীদের মতন অতো সক্রিয় না হলেও,  ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ  পরিবারসহ ছোট বাচ্চাদের কেনার জন্য  দাক্ষিণাত্যে দুটি ব্যাপক দুর্ভিক্ষ ও সামাজিক বিপর্যয়ের পুরোপুরি সুযোগ গ্রহণ করেছিল।  তানজোর আর মাদুরাইয়ের স্থানীয় শাসকদের কাছ থেকেও তারা দাস কিনে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে চালান করতো । ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ায় অমন অনেক মানুষ পাবেন ।

ঘসেটি বেগম : আরে বাহ ! তুমি তো ভালো বদলা নিয়েছিলে । আমি বদলা নিতে পারিনি । ট্রেনে একজন জিগ্যেস করছিল আমি চিৎপুরের কোন যাত্রা কোম্পানিতে আছি, আর কোন ভূমিকায় অভিনয় করছি । বললুম ঘসেটি বেগমের । বিশ্বাস করতে চাইল না । বলল, ওই ভূমিকায় আপনাকে মানাবে না, আপনি বরং প্রথম রানি এলিজাবেথের ভূমিকায় অভিনয় করুন ; উনি ন্যাড়া হয়েছিলেন আর আপনার টাক মুকুটের তলায় দেখা যাচ্ছে । টাক কী আর আপনা থেকে পড়েছে ! কতো যে দুশ্চিন্তা আমার, কেউ বুঝলো না । 

সাবিত্রী নামবুদিরি : আপনারা ডাকেননি । তবু এসে আমার গল্প শুনিয়ে গেলুম । এখন যাই । কফিহাউসে আগে আসিনি কখনও ।

ভাস্কো দা গামা : আমার বাড়িও ওখানেই ছিল । পাশেই  প্রাচীন সেন্ট ফ্রান্সিস চার্চ।  ওই চার্চে আমাকে গোর দেয়া হলেও চোদ্দ  বছর পর আমার  কফিন তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পর্তুগালে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন আপনারা, চেঙ্গিজদা আর ল্যাঙড়াদাকে দেখার জন্যে কতো দূর থেকে কতো কষ্ট করে এসেছি ।  উঁচু জাতগুলোর কাজকারবারের জন্যে আনেককে খ্রিস্টান বানাতে আমাদের এতো সুবিধা হয়েছে যে কী বলব । রাজাটাও ছিল উঁচু জাতগুলোর ধামাধরা ।  ট্রাভানকোরের রাজারা মুলাক্কারাম নামে দলিত মহিলাদের উপর একটি স্তন ট্যাক্স আদায় করত । যে দলিত মহিলারা নিজেদের মাই আঁচল দিয়ে ঢাকতো, তাদের মাই ট্যাক্স দিতে হতো । উঁচু জাতের লম্পটদের কী যে মজা, সারাদিন মাই দেখে বেড়ায় । যাদের মাই যতো যত বড় হতো তত বেশি ট্যাক্স দিতে হতো । যাদের পয়সাকড়ি ছিল তারা মাই ঢাকতো আর ট্যাক্স দিতো ।  কিন্তু উঁচু জাতের মহিলারা তাদের মাই দুটো ঢেকে  রাখতে পারত, রাষ্ট্রকে কোনও ট্যাক্স দেবার প্রয়োজন ছাড়াই। নাঙ্গেলি নামে এক গরিব দলিত মহিলা কর দিতে অস্বীকার করে ।  যখন কর আদায়কারী তাকে ধাওয়া করে, তার বাড়িতে ঢুকে মাই ঢাকা দেবার  জন্য ট্যাক্স  দাবি করল, তখন নাঙ্গোলি নিজের দুটো মাই ছুরি দিয়ে কেটে কলাপাতায় রেখে ট্যাক্স আদায়কারীর সামনে তুলে ধরল । সে ব্যাটা তো ভয়ে পালিয়ে গেল, আর নাঙ্গেলি ট্যাক্স আদায়কারীর বাড়িতে ঢুকে মুখ থুবড়ে পড়ে মারা গেল । তার স্বামী দুঃখে ক্লান্ত হয়ে নাঙ্গেলির শবের সঙ্গে লাফিয়ে পুরুষ-সতী হয়েছিল  ।  এই করের অবসান ঘটাতে রাজা বাধ্য হয় । নাঙ্গোলি যে বাড়িতে থাকতো সে জায়গাটা মুলাচিপারাম্বু নামে এখন বিখ্যাত । সেই থেকে দলিতরা উঁচু জাতের ওপর যতো চটেছে আমরা ততো তাদের খ্রিস্টান্তরিত করেছি । 

নোবিলিআত্মন : আমি হিন্দু সন্ন্যাসী হয়ে মীনাক্ষী মন্দির ঘুরে দেখেছি, মন্দিরে বসে ইনফিডেলদের মতন ধ্যান করেছি। ইনফিডেল হিদেনদের কল্পনাই যেন বাস্তব জগত । তিনটে মাইয়ের মূর্তি আছে মন্দিরে । তামিলনাড়ুর  পান্ডিয়ান রাজা মলিয়াধাজার মেয়ে জন্মেছিল তিনটে মাই নিয়ে। রাজা, ছিল শিবভক্ত, কিন্তু নিঃসন্তান, বছর তিনেক তপস্যা করার পরে মেয়ে হয় । আয়োনিজা নামে বাচ্চাটা জন্মেই রাজপরিবারকে হতবাক করে দেয় কারণ তার দুটির পরিবর্তে তিনটি স্তন রয়েছে। রাজা  ভেবেছিলেন বোধহয়  কোনও দৈত্যের দ্বারা অভিশাপিত হয়েছেন । শিবের কাছে প্রার্থনা করলেন, তখন তিনি  জানালেন যে মেয়েটিকে একজন পুরুষের মতোই বড় করা উচিত আর যখন সে বিয়ে করবে, তখন তার তৃতীয় মাই অদৃশ্য হয়ে যাবে। মীনাক্ষী, এই ‘ত্রুটি’ সত্ত্বেও   সুন্দরী  হয়ে বেড়ে ওঠে । যখন সে শিবের সাথে দেখা করে, আর তার প্রেমে পড়ে যায়, তখন তার তৃতীয় স্তন অদৃশ্য হয়ে যায় ।  এখন তিনি তামিলনাড়ুর বিখ্যাত মীনাক্ষী মন্দিরের মীনাক্ষী হিসাবে পূজিত হন। 

ল্যাঙড়া তৈমুর : বা্হ, মাই দেখে বেড়িয়েছো কাফেরের রূপ ধরে ?

নোবিলিআত্মন : না, আমি প্রয়াগে পূর্ণকুম্ভতেও নাগা সন্ন্যাসীদের সঙ্গে ল্যাঙটোপোঁদে  দৌড়ে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়েছিলুম। নাগা সাধু দিগম্বর অখিলেশপুরীর সঙ্গে কথা বলে জেনেছি ওনাদের লিঙ্গ অকেজো করে দেওয়া হয়। তাই কোনো কামনা-বাসনা থাকে না। যারা যৌন কামনার প্রবল বেগকে সামলে নিতে পারে তারাই নাগা। উনি বললেন,  সেই সিদ্ধি লাভ করে যে যৌনবাসনার বিরুদ্ধে জয়ী হয়। আল-হিন্দে এসে আমার যৌনবাসনা নষ্ট হয়ে গেছে । 

ল্যাঙড়া তৈমুর : মাই নিয়ে ভাবো মনে হয় । আকার-প্রকার নিয়ে চিন্তা করো ?

পাগলা তুগলক  : আমি বলছি জনাবেআলা । আমরা এখন ভোগবাদী সমাজে বাস করি, আর কোনো চাকরি বা কাজের জন্য বুদ্ধিমতী হলেও, শারীরীক আকর্ষণ হল সফলতার একটা সিঁড়ি । সুন্দর মুখমণ্ডলের ও দৈহিক কাঠামোর নারীরা কাজের বাজারে বেশি সুযোগ পান । তবে অত্যন্ত বড়ো মাপের স্তন আবার এক্ষেত্রে ক্ষতিকারক হতে পারে, তখন শল্যচিকিৎসা করিয়ে স্তনের মাপ ছোটো করার পথ ধরতে হবে । এখনকার ফ্যাশানও হয়েছে বড়ো মাপের বর্তুল স্তন আর খাঁজ । পোশাকের ডিজাইনাররা সেইভাবেই সুন্দরীদের উপস্হাপন করেন । অত্যন্ত বড়ো মাপের বা অত্যন্ত ছোটো মাপের স্তন হলে বাজারে ব্রা পাওয়াও কঠিন হয়ে যায় । সিলিব্রিটি সংস্কৃতির জগতে ছোটো মাপের স্তন নারীজগতে ঠাট্টা-ইয়ার্কির ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় — স্তনের মাপ বাড়িয়ে তোলার এও একটা কারণ । খ্যাতি আর জনপ্রিয়তার ভোগবাদী বাজারে স্তন এখন গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র — শল্যচিকিৎসা নারীকে বহুকাল যৌবন ধরে রাখার সুযোগ করে দিয়েছে । মিডিয়া যেহেতু সেলিব্রিটিদের  রোল মডেল  হিসাবে তুলে ধরে, তরুণীরা তাঁদের পথ অনুকরণ করেন । পর্ন ফিল্মগুলোতে যাঁরা অভিনয় করেন তাঁদের স্তন বেশ বড়ো হয় এবং অনেকে অমন ফিল্মে অভিনয় করার জন্যও স্তনের মাপ অবিশ্বাস্যভাবে বড়ো করে তোলেন । সানফ্রানসিসকোতে বুক-খোলা মেয়েরা জুতো পালিশ করেন, বার-ডান্স করেন বুক খুলে । বিভিন্ন দেশে প্রতিবাদের জন্য নারীরা বুক খুলে দাঁড়িয়ে পড়েন । স্তনের যৌনতা একই সঙ্গে আক্রমণের অস্ত্র আবার অনুরাগের ডাক দেবার কুহক।

তোতলা তুগলক : ছেলেটা মাঝখানে কথা বলা ছাড়তে পারল না ।

ভাস্কো দা গামা : আর কী জানো মাইয়ের ব্যাপারে ?

কফিহাউসের যক্ষ : স্যার, পোপ যখন পর্তুগাল আর স্পেনকে নির্দেশ দিলেন যে তারা যথাক্রমে পূর্ব আর পশ্চিম বিশ্বকে লুটপাটের জন্য ভাগাভাগি করে নিক, তার পর  সমস্ত প্রাচীন  সংস্কৃতি মূল থেকে ধ্বংস হয়ে গেছে — মিশরীয়, ইরানি, মেসোপটেমিয়ান, গ্রিক আর রোমান, আমেরিকার মায়া ও অ্যজটেক  এবং আরও আদিম জীবন-পদ্ধতি। ভারতে তারপর আবির্ভাব হলো ইসলামি শাসকদের । নগ্নতাকে যৌন ‘পাপ’ হিসাবে দেগে দিয়েছে তারাই, এমনকী যৌনতাকেও তারা লজ্জাজনক পাপকর্ম হিসাবে চিহ্ণিত করে দিয়েছে বিভিন্ন উপনিবেশে।  স্তন যেহেতু যৌন আহ্লাদ উদ্রেক করে, তাই স্তন ঢাকার চল শুরু হল তাদের আবির্ভাবের পর । অজন্তায় বুদ্ধের মা নিজের স্তন ঢেকে রাখেননি, আর তা সম্ভব হয়েছে ভারতে নগ্নতাকে লজ্জাজনক মনে করে হতো না বলে । দক্ষিণ আফ্রিকার জুলু আদিবাসদীরা এখনও স্তনকে খোলা রাখেন — প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জেকব জুমার নবম বিয়েতে তাঁর হবু স্ত্রী সমেত আগের বউরা আর কুড়িটা বাচ্চাদের মধ্যে মেয়েরা বুক খুলে নেচে ছিলেন । প্রাচীন ভারতে স্তনের সঙ্গে যেমন ফার্টিলিটির সম্পর্ক ছিল তেমনই ছিল যৌনতার । ধনী পরিবারের নারীর পরিধান ছিল উত্তরীয়, অন্তরীয় আর কোমরবন্ধ — উত্তরীয় এখনকার ওড়নির মতন যেটি দিয়ে বুক বাঁধা যেতো । অনেকে বাঁধতেন না, কেবল ঢেকে রাখতেন । মোগল বেগমরাও যে স্বচ্ছ মসলিনে ঢেকে রাখতেন তা এঁকে গেছেন মিনিয়েচার চিত্রকররা । জেনানা মহলে তাঁরা স্তনকে লুকোবার চিন্তায় ভুগতেন না তার কারণ খোজারা ছিল তাঁদের রক্ষী। কোনো কোনো বেগম, যাঁদের বিয়ে হতো না, তাঁরা স্তনে খোজাদের আদর নিতেন ।

ভাস্কো দা গামা : আমি জানতে চাইলুম, আর আমার দেশকেই দোষ দিচ্ছ ।

বাবর : মোগল বেগমদের ব্যাপারে যা বলেছে তা আমার কানেও এসেছে । কীই বা করবে । ওদেরও তো আনন্দ দরকার ।

চেঙ্গিজ খান : ল্যাঙড়া, তুই সম্রাজ্ঞী, বেগম, রানি, খাতুনদের ডাকিসনি ? মেয়েদের গল্পগুলো বেশি ইনটারেসটিঙ ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : ডেকেছি তো চেঙ্গিজদা। কুতলুক নিগার আনাম,  গুলবদন বেগম,খানজাদা বেগম,জিজি অনগা, মাহাম অনগা, দিলদার বেগম, বেগা বেগম, হামিদা বানু, সলমা সুলতান বেগম, মারিয়ম-উজ-জমানি, রোশনারা বেগম, আসিয়ান দৌলত বেগম, জিনত-উন-নিসা বেগম, জেব-উন-নিসা বেগম, গুলরুখ বেগম, গুলনার আগাচা, নারগুল আগাচা, চাঁদ বিবি, খুঞ্জা হুমায়ুন, বেগম সমরু সবাইকে বলে এসেছি । নুরজাহানকে বলার সাহস হয়নি ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : আরে, এ তো দেখছি আফজল খান আসছে, পেট থেকে নাড়িভূঁড়ি বেরিয়ে ঝুলছে, টপটপ করে রক্ত পড়ছে । ওর অবস্হার কথা জানতুম বলে বলিনি আসতে, তবুও এসেছে । কী রে আফজল, তুই আবার এলি কেন এই অবস্হায় ? প্রতাপগড় দুর্গের কবরে তো ভালোই ঘুমোচ্ছিলিস !

আফজল খান : তোমরা আজ কফিহাউসে আসছো আড্ডা দিতে, তাই সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইনি ।:তোমরা তো জানো বিজাপুরের সুলতান শিবাজীকে দমন করার জন্য আমাকে পাঠিয়েছিলেন। বন্ধুত্বের বার্তা দিয়ে শিবাজীকে আমন্ত্রণ পাঠিয়েছিলুম। কিন্তু কী আর বলব !  শিবাজী আমার অভিসন্ধি টের পেয়ে গিয়েছিল ।আলিঙ্গনের অজুহাতে যখন শিবাজীকে খুন করবার জন্য রেডি হয়েছি ঠিক তখনই শিবাজী গোপন হাতিয়ার বাঘনখ বের করে আমার পেটের নাড়িভূঁড়ি বের করে দিলে । তাতেই আমি অক্কা পেলুম । আমাকে বাঁচাতে আমার দেহরক্ষী কৃষ্ণানাজী ভাস্কর কুলকারনি তরোয়াল বের করে শিবাজীর দিকে তেড়ে গিয়েছিল । কিন্তু শিবাজীর দেহরক্ষী রুস্তম জামান তরোয়াল চালিয়ে ওর হাত কেটে দিলে ।

পাগলা তুগলক : নাস্তিককে বাঁচাতে আস্তিক আর আস্তিককে বাঁচাতে নাস্তিক দেহরক্ষী।

চেঙ্গিজ খান : এই অবস্হায় আসা তোর উচিত হয়নি । এমনিতেই চারিদিকে করোনার সাম্যবাদ ছড়িয়ে পড়েছে।

আফজল খান : আচ্ছা যাই, তোমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল । ভালো থেকো সবাই ।

কফিহাউসের যক্ষ: চলুন, আমি হেল্প করছি । আমার কফির ট্রেতে আপনার নাড়িভূঁড়ি রাখুন, তাহলে কষ্ট হবে না। 

ঘসেটি বেগম : আচ্ছা, মীরজাফরের বংশধরদের কী দোষ ? আজও ওরা পাবলিকের সামনে মুখ দেখাতে পারে না ।

কফিহাউসের যক্ষ : মীর জাফরের বংশধর এখনো মুর্শিদাবাদে বসবাস করেন। মীরজাফরের অষ্টম বংশধর হলেন মীর জাফর আলম খাঁ। আমি তাঁকে চিনি ।পেশায় একজন শিক্ষক। বর্তমানে অবসরে আছেন। মীর জাফর খাঁর বাড়ির প্রধান ফটককে লোকে বলে নেমকহারাম দেউড়ি।  এলাকাটার নাম জাফর গঞ্জ। মীর জাফর   ইংরেজ বেনিয়াদের সাথে যুক্ত হয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে স্বাধীন বাংলার পতন ঘটিয়ে ইংরেজদের হাতে দেশ তুলে দেয়াটা পাবলিক আজও মেনে নিতে পারেনি । যে বাড়িতে মীরজাফরের বংশধররা বসবাস করতেন তা দেখতে গিয়ে লোকজন বিশ্বাসঘাতকের বাড়ি বলে অহরহ গালাগালি করায় পূর্ব পুরুষের বিশ্বাসঘাতকতার গ্লানি আর লজ্জায় স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে না পারায় অনেক দিন হলো তারা সেই বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। মীর জাফরের বর্তমান প্রজন্ম খুবই ভদ্র নম্র হওয়া সত্বেও মানুষের কাছে সহজে উন্মুক্ত হতে পারছেন না। মীর জাফরের বিশ্বাসঘতকতার মাধ্যমে স্বাধীন বাংলার পতন এবং ইংরেজদের হাতে দেশের স্বাধীনতা চলে যাওয়ায় আজো মানুষ মীর জাফরের নামটি ঘৃণাভরে উচ্চারণ করে। যার গ্লানি জন্ম জন্মান্তর ধরে এই বংশকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। বংশধরদের দোষ দেয়া কেন ? ইংরেজদের পা চেটে অনেকে নাম কিনেছে, তাদের কেন বিশ্বাসঘাতক বলা হবে না ?

ভাইপো আকবর : ওই তো গুলবদনপিসি এসে গেছে । শ্যায়খুবাবা এলো না ?

গুলবদনপিসি : আমি এসে গেছি । হজ করতে গিয়েছিলুম, সবে কদিন হলো ফিরেছি । নতুন সংস্করণের জন্যে  হুমায়ুননামা ‘অর্ধেক জীবন’ বইটার প্রুফ দেখতে হবে । আগে হাতে কমপোজ হতো, পাণ্ডুলিপিতে ভুল থাকলে কমপোজিটাররা নিজেরা শুধরে দিতো । এখন কমপিউটার হয়ে, মুশকিল হয়েছে । কমপিউটার ভালো জানে, কিন্তু ভাষাটা ভালো জানে না বলে ভুল থেকে যায় । দুতিনবার করে প্রুফ দেখতে হয় । প্রথম সংস্করণে আমাদের পরিবারের কেচ্ছা সব বাদ দিয়েছিলুম ; এখন ভাবছি জুড়ে দেবো, তাহলে ভালো কাটতি হবে । 

পাগলা তুগলক : প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পর প্রতিটি ধর্মই কায়েমি স্বার্থবাদীদের দ্বারা জনস্বার্থের বিরুদ্ধে ব্যবহূত হয়েছে। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের বেলায়ও একই ধরনের ঘটনা দেখা যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ ধর্মের কিংবা আদর্শের অবলম্বন ছাড়া চলতে পারে না। আদর্শহীন বাস্তবতায় ধর্মকে শেষ করে দেওয়ার জন্য যতই চেষ্টা করা হচ্ছে, মানুষ ততই ধর্মের আশ্রয়ে চলে যাচ্ছে। গণতন্ত্রকে পুনর্গঠিত কিংবা নবায়িত করে সর্বজনীন গণতন্ত্রে রূপ দিলে এবং জনগণের জন্য প্রাণশক্তিসম্পন্ন আদর্শ রূপে সামনে আনা হলে ঘটনাপ্রবাহ সম্মুখগতি লাভ করবে।

তোতলা তুগলক : এএএ ছোঁছোছোছোড়া মুমুমুখ ববববন্ধ রারারাখতে পাপারে না ।

বাবর : আমার রুশ রক্ষিতা গুলনার আগাচা আর নারগুল আগাচাকেও আসতে বলেছ ? ওরা এসে আমার গোপন খবরাখবর না ফাঁস করে দেয় । ওরা বলছিল যে আমার কবরটা আগ্রায় থাকলেই ভালো হতো । আমি ভেবেছিলুম কাবুল জায়গাটা সুন্দর । এখন তো প্রত্যেকদিন বোমা মারামারি চলছে সেখানে । কোনওদিন না আমার কবরটাই চাঘতাই উজবেকি মনে করে উড়িয়ে দেয় । অবশ্য উজবেকিস্তান আর কিরগিজস্তানের লোকেরা আমাকে শ্রদ্ধা করে আজও । বেগম সমরুকে বলেছিস?  ও তো নাচনেওয়ালি ছিল, তায় আবার ক্যাথলিক খ্রিস্টান ।

শাহজাহান : আগ্রায় থাকলে আমি একটা নতুন ধরণের স্হাপত্য গড়ে দিতে পারতুম আপনার কবরের ওপর । কিন্তু আপনার কোন বেগমকে পাশে রাখতুম ? সেটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াতো । মাহাম বেগম, আশিয়া সুলতান বেগম, জৈনাব সুলতান বেগম, মাসুমা সুলতান বেগম, বিবি মুবারিকা গুলরুখ বেগম, দিলদার বেগম — কে আপনার সবচেয়ে পছন্দের তা তো জানি না । আমি তাজমহল বানিয়েছি আমার সবচেয়ে পছন্দের বেগমের স্মৃতিসৌধ হিসেবে । আপনার কবর আগ্রায় থাকলে সেই স্মৃতিসৌধ দেখতে বহু পর্যটক আসতো । হুমায়ুনের কবর দেখতে কতো মানুষ আসে । অথচ ওনার দেহ প্রথমে দিল্লিতে  রাজপ্রাসাদেই গোর দেয়া হয়েছিল । পরে খঞ্জর বেগ দেহাবশেষ নিয়ে যান পাঞ্জাবের সিরহিন্দে।  বিধবা বেগম হামিদা বানু হুমায়ুন মারা যাবার নয় বছর পরে এই সমাধিসৌধ নির্মাণের কাজ শুরু করান। আপনার বেগমরা বোধহয় ততো ভালোবাসতেন না আপনাকে ।

বাবর : আরে তোকে কী বলব ! লোকে জানেই না যে আমার নয়টা ছেলে আর নয়টা মেয়ে ছিল । আমার দুই বউ মাহাম বেগম আর দিলদার বেগমের একটা করে আর গুলরুখ বেগমের দুটো ছেলে ছিল সে কথা তুইও ভুলে যাচ্ছিস। তুই হয়তো ভাববি গুলরুখের দুটো ছেলে ছিল বলে ওকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতুম । তোদের সময়ের মতন ভালোবাসাবাসি ছিল না আমাদের সময়ে । হুমায়ুনের সময় থেকেই ভাইয়ে-ভাইয়ে খুনোখুনি আরম্ভ হয়েছিল । কামরন মির্জা নিজেই চলে গেল হজ করতে, আসকারি মির্জাকে হুমায়ুন অন্ধ করে হজ করতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। আর হিন্দল মারা গেল যুদ্ধ করতে গিয়ে । হুমায়ুনের সঙ্কটজনক অসুস্হ অবস্হায় আমি ওর খাটের চারপাশে তিন দিন অবিরাম পাক খেয়ে ওর জীবনের জন্যে প্রর্থনা করেছিলুম, এসব কেউ নির্ঘাৎ আফিমের শরবত খেয়ে কেউ লিখেছে । হুমায়ুন পটল তুলেছিল নেশা করার পর সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে, গুলবদন লিখেছে তো সেকথা হুমায়ুননামা নামের ‘অর্ধেক জীবন’ বইতে ।

শাহজাহান : ভুলে যাচ্ছেন কেন যে আবুল ফজলকে আব্বাহুজুর খুন করিয়েছিলেন ।  আবুল ফজল ওনার সিংহাসনে বসার বিরোধিতা করেছিলেন। তাই ওনার ষড়যন্ত্রে নারওয়ারের কাছে সরাই বীর আর অন্ত্রীর মাঝখানে কোনো এক জায়গায় বীর সিংহ বুন্দেলার হাতে তিনি খুন হন। ওনার কাটা মাথা এলাহাবাদে আব্বাহুজুরের কাছে পাঠানো হয়েছিল। আবুল ফজলকে অন্ত্রীতে গোর দেয়া হয়।  আবুল ফজলের খুনি বীর সিংহ বুন্দেলা পরে ওরছার শাসক হয়েছিল আর ১৬০২ সালে আব্বাহুজুর জাহাঙ্গির নাম নিয়ে মোগল সিংহাসনে বসেছিলেন। পরে যদিও আব্বাহুজুর আবুল ফজলের ছেলে শেখ আবদুর রহমান আফজল খানকে বিহারের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন।  আমিও সিংহাসন দখল করেছি শত্রুদের সরিয়ে দিয়ে, যখন কিনা আমি কাফের মা রাজপুত হিন্দু জগত গোঁসাইয়ের ছেলে । আবুল ফজল আর গুলবদন বেগম দুজনেই রাজপুত হিন্দু বউদের আসল নাম লেখেননি ; লিখেছেন মোগলদের দেয়া নাম । আব্বাহুজুরের মায়ের  নাম দিয়েছে মরিয়ম উজ জমানি, ওনার আসল নাম হরখা বাই গোপন করেছেন, বলিউডে যে ফিল্ম হয়েছে তাতে ওনাকে বলেছে যোধা বাই । হরখা বাইয়ের যে অনেকগুলো নিজের জাহাজ ছিল, আরবদেশে ব্যবসা করতে যেতো, হজযাত্রিদের নিয়ে যেতো, সেসব চেপে গেছে । আবদ-আল কাদির বাদায়ুনি তো আকবরের সংসারে এসে হরখা বাইয়ের হিন্দু পুজোপাঠ, বেদের হোমাগ্নি, শাকাহার, সূর্য আরাধনার বিরুদ্ধে রাগ উগরে গেছেন ।

ভাস্কো দা গামা : সেনর বাবর, আপনি আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে আল-হিন্দে খাবার মতো ফল নেই, দেখার মতন বাগান নেই, মানুষগুলোও বিদকুটে । তা আপনি আপনার দেশ থেকে নানা রকমের ফল এখানে এনে চাষ করাতে পারতেন ।  আমরা তো সুদূর দক্ষিণ আমেরিকা থেকে কতো ফল-ফুল-আনাজ এদেশে এনেছি যে এখানকার মানুষ ভাবে সেগুলো এই দেশেরই প্রডাক্ট ।

বাবর : আরে আমি হলুম বাদশা, পেটুক মানুষ, আর তোমরা এসেছো খ্রিস্টান্তরন করার উদ্দেশ্যে, আমরা মোগলাই খাবারের নতুন রেসিপি আরম্ভ করেছিলুম । আমার ছেলে হুমায়ুনের ইরানি বউ  হামিদা  জাফরান আর শুকনো ফল ব্যবহারের  প্রচলন করেছিল। আকবরের রাজত্বকালে মুঘলাই খাবার বিকশিত হতে শুরু করেছিল ; ওর বহু বৈবাহিক জোটের কারণে,  রান্নার রেসিপি আল-হিন্দের প্রতিটি কোণ থেকে এসেছিল, যেমন মুর্গ মুসললম, নবরতন কোর্মা, কাবাব, কোফতা,, পুলাও বা পাইলাফ, এবং তন্দুরি  মুঘলই মুরগি, মুঘলই বিরিয়ানি, মুঘলই পরোটা, মালাই কোফতা, রেশমি কাবাব,  মুঘলাই মিষ্টান্নগুলির মধ্যে নাম করতে হয় রুটির পুডিং, শাহি টুকরা, বরফি, কলাকান্দ আর ফালুদা।  । পাঁঠার মাংস রান্নাঘরে এনেছিল আকবর । গোরুর মাংস আকবর নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল । নিহারি রান্নাটা শাহজাহানের। ইব্রাইম লোদির সঙ্গে যুদ্ধে আমি আর সৈন্যরা ঘোড়া আর গোরুর শুকনো মাংস চর্বি মাখিয়ে পুড়িয়ে খেতুম ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : ওই তো, আওরঙজেবের চামচা মীর জুমলা এসে গেছে । কী রে মীর জুমলা, এতো দেরি হলো তোর? তোকে তো খবর পাঠিয়েছিলুম যে আজকে চেঙ্গিজদা আর আমি কফিহাউসে গ্যাঁজাতে আসছি ।

মীর জুমলা : কী বলব তোমায় ল্যাঙড়াদা । আসামের দিকে বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে তো এগিয়েছিলুম।  আসামের  আবহাওয়া এমন যে প্রথমে তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছিল, তারপর গড়গাঁও পর্যন্ত দখল করতে পেরেছিলুম । এরপর নেমে এলো আসামের বর্ষার ঢল। অতিবৃষ্টির কারণে আসামের রাস্তাঘাট ডুবে বন্যা সৃষ্টি হলো, সে তুমি ধারণা করতে পারবে না । আমার বাহিনী  উঁচু জমিতে আটকা পড়ে গেলো। তখন রাজা জয়ধ্বজের সৈন্যরা রাতের অন্ধকারে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করতে থাকে। এমনকি আমাদের রসদ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল । এর মাঝে সৈন্যরা জলের কারনে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে লাগলো । খাবারের অভাব আর রোগের প্রকোপে বেশিরভাগ সৈনিক মারা গেলে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে পিছপা হতে হলো আমাকে। বর্ষা শেষে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে আসাম ছাড়লুম, কী লজ্জা, কী লজ্জা, আলমগীর জানলে মাথা কেটে নিতো । ব্যর্থ আসাম অভিযান শেষে  বাংলায় ফিরে আবার যাত্রা শুরু করেছিলুম। তবে আসামের জলহাওয়ায় ভীষণ শরীর খারাপ হয়ে গেল । অসুস্থতার কারণে দুর্বল শরীরে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছিল । নৌকো করে ফেরার পথে খিজিরপুরে মারা গেলুম । সেই থেকে আসাম-মেঘালয় সীমায় ঠাকুরবাড়ি জেলার একটা টিলার কবরে শুয়ে আছি । কেউই খোঁজখবর নেয় না । জীবনে কতোকিছু করলুম ইরান থেকে এসে, পড়ে আছি অজ পাড়াগাঁয় ।

বাবর : আওরঙজেবটা তো তাই চটে থাকে কাফের নাস্তিকদের ওপর । ও জানে যে ওর শিরায় আছে কাফের বউদের নাস্তিক রক্ত । আসলে দোষটা আমারই, আমিই তো মোগল সিংহাসন বসিয়েছিলুম এই দেশে । 

গুলবদনপিসি : হ্যাঁ, আপনি আপনার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ” শত্রুকে পরাজিত করার পর আমরা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করলাম এবং ব্যপকভাবে হত্যা করতে থাকলাম। আমাদের শিবির থেকে প্রায় দুই ক্রোশ দূরে ছিল তাদের শিবির। সেখানে পৌঁছে আমি মুহাম্মদী ও আরও কয়েকজন সেনাপতিকে হুকুম দিলাম তাদের হত্যা করতে, কেটে দু’খানা করতে, যাতে তারা আবার একত্রিত হবার সুযোগ না পায়।” কত কাফের নাস্তিককে সেদিন হত্যা করা হয়েছিল তার হিসাব পাওয়া যায়না। বাবর হুকুম দিলেন, কাছাকাছি একটি পাহাড়ের কাছে সমস্ত নরমুন্ডকে জড়ো করে একটি স্তম্ভ তৈরী করতে। সেই টিলার উপর কাটা মুন্ডের একটি মিনার বানাতে হুকুম দিলাম। বিধর্মী  ও ধর্মত্যাগীদের অসংখ্য মৃত দেহ পথে-ঘাটে ছড়িয়ে ছিল। এমন কি দূর দেশ আলোয়ার, মেওয়াট ও বায়না যাবার পথেও বহু মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেল।”

চেঙ্গিজ খান : আমি কিন্তু ধর্ম-টর্মর কথা ভেবে কোনও দেশ দখল করিনি ; কারোর ধর্মও পালটাইনি । আমার বংশধররা নিজেরাই আস্তিকান্তরিত হয়ে মুসলমান বা বৌদ্ধ ধর্ম নিয়েছে বা কাফের নাস্তিক থেকে গেছে ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : আমি কতো দেশ দখল করেছিলুম । আমার বংশধররা কেউ সেগুলো ধরে রাখতে পারেনি ।

গুলবদনপিসি : ল্যাঙড়াদা, তোমার আত্মজীবনী  “তুজুক ই তৈমুরী”তে তুমি লিখিয়েছ ভারত অভিযানের তোমার দুটি উদ্দেশ্য ছিল। এক, বহুদেববাদ ও পৌত্তলিকতায় আচ্ছন্ন ভারতীয়দের সত্যধর্মে দীক্ষিত করা আর, দুই  ভারতের অমিত ধন ঐশ্বর্য লুঠ করা। আসলে ভারতের বিপুল পরিমাণ সম্পদ লুণ্ঠন করাই ছিল তোমার একমাত্র উদ্দেশ্য। পৌত্তলিকতার বিনাশ  অজুহাত মাত্র। মধ্য এশিয়া থেকে এত দূরদেশে অভিযানে আসতে তোমার সেনাবাহিনী ও আমির ওমরাহরা আপত্তি জানালে তুমি তাদের সামনে  ধর্মের কথা তুলে ধরো।সমরখন্দ থেকে বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে সিন্ধু, ঝিলাম ও রাভি নদী অতিক্রম করে রাজধানী দিল্লির দিকে এগোও। পথিমধ্য দীপালপুর, ভাতনার, শীরসা, কৈথাল  লুঠ করে আর বহু মানুষকে খুন করে  দিল্লির উপকন্ঠে পৌঁছে যাও । দিল্লিতে প্রায় একলক্ষ মানুষকে খুন করো । দিল্লির সুলতান নাসিরউদ্দিন মহম্মদ ও তার প্রধানমন্ত্রী মল্লু ইকবাল তোমার  কাছে হেরে যায় । মল্লু ইকবাল বরণ প্রদেশে আর সুলতান নাসিরউদ্দিন মহম্মদ গুজরাটে  পালায় ।

পাগলা তুগলক : আমারও তাই মনে হয় ।

গুলবদন পিসি : এরপর দিল্লিতে ঢুকে টানা পনেরোদিন ধরে লুঠপাট আর খুন করতে থাকো । মানুষের কাটা মাথা দিয়ে সৌধ তৈরি করে তোমার সেনাদল উল্লাস প্রকাশ করে। শবগুলো মাংসাশী পশু ও পাখির খাবারে পরিণত হয়। এরপর তুমি অঢেল ধনরত্ন ও অসংখ্য বন্দীকে দাস বানিয়ে নিয়ে দেশে ফিরে যাও  । দেশে ফেরার পথে ফিরোজাবাদ, মিরাট, হরিদ্বার ও জম্মু অঞ্চলে লুটপাট চালিয়ে আর শিবালিকা পাহাড়ের পথ ধরে উত্তরে যাওয়ার সময় কাংড়া  দখল করো।  বদাউনির মতন গোঁড়া লোকও  লিখেছে, তোমার হাত থেকে যারা নিষ্কৃতি পেয়েছিল তারা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে প্রাণ হারায় । তোমার ভারত আক্রমণের ফলে সুলতানী শাসনের সামরিক বাহিনীর দৈন্য দশা ফাঁস হয়ে যায়। তোমার ভারত আক্রমণের পর গুজরাট, সামনা, বিয়ানা, কালপি, মাহাবা, মুলতান, পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রভুতি অঞ্চলে স্বাধীন রাজ্য গড়ে ওঠে। সুলতানী সাম্রাজ্য দিল্লি থেকে পালামের ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্য সংকুচিত হয়ে পড়ে। হিন্দু মুসলমানদের মধ্য সম্প্রদায়গত যে বিরোধ তুমি সৃষ্টি করেছিলে  তা জালালুদ্দিন মুহম্মদ আকবরও জুড়তে পারেননি ।

ভাইপো আকবর : হক কথা বলেছো পিসি ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : আমি তো অতোশত ভাবিনি । সব লুটেরারা যা করে আমিও তাই করেছিলুম । বাবরও করেছিল । বাবর সম্পর্কে গুরুনানক লিখেছেন, “হে সৃষ্টিকর্তা ভগবান, জীবন্ত যম হিসেবে তুমি কি দানবরূপী এই বাবরকে পাঠিয়েছ ? অমানুষিক তার অত্যাচার, পৈশাচিক তার হত্যা লীলা, অত্যাচারিতের বুক ফাটা আর্তনাদ ও করুন ক্রন্দন তুমি কি শুনতে পাওনা? তাহলে তুমি কেমন দেবতা ?” ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খলজির দোষ আরো বেশি । তুমি হয়তো বলবে ওরা আমার দেখানো পথ অনুসরণ করেছে ।

গুলবদনপিসি : হ্যাঁ, ল্যাঙড়াদা, আমি তাইই বলব । দেখছো তো, আল-হিন্দে বাবরের মসজিদ তো ভাঙাই হয়েছে, বাবরের নামের রাস্তারও অন্য নাম দেবার চেষ্টা চলছে । তুমি জানো না যে   হিন্দু দর্শনে সর্বসৃজক ঈশ্বরে নয়, বরং প্রাচীন প্রার্থনাগাথা বেদকে মান্যকারী ব্যক্তি বা দল বা সম্প্রদায়কে আস্তিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয় । আস্তিক দর্শন অনুসারে বেদই হলো সমন্বয়বাদী হিন্দুধর্মের প্রাথমিক উৎস । এ সংজ্ঞানুসারে সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক, পূর্ব মীমাংসা এবং বেদান্তকে আস্তিক দর্শনের শ্রেণীভুক্ত করা হয়।

ভাইপো আকবর : পিসি, তোমার তুলনা নেই । শ্যায়খুবাবা এলো না ?

ঘসেটি বেগম : বিহারের বাসিন্দা হীরকচাঁদের মৃত্যুর পর তার ছোট ছেলে বিসেনচাঁদ জগৎশেঠ উপাধি পান। তার এক ছেলে ছিল কিসেনচাঁদ। লর্ড বেন্টিঙ্কের সময়ে তিনি ইংরেজ সরকার কর্তৃক জগৎশেঠ উপাধি পান। তার মৃত্যুর পর হীরকচাঁদের বড় ছেলে ইন্দ্রচাঁদ জগৎশেঠ হন। কোম্পানি তাকে বাৎসরিক ১,২০০ পাউন্ড পেনশন দিত। তিনি মারা গেলে তার দত্তক পুত্র গোপালচাঁদ জগৎশেঠ খেতাব পান। ১৮৪৩ সালে লর্ড অকল্যান্ড তাকে ৩০০ রুপি পেনসন দিতে চাইলে তিনি সেটা ফিরিয়ে দেন। তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রী প্রাণ কুমারী দেবী গোলাপচাঁদকে দত্তক নেন। তার চার ছেলে ছিল। বড় ছেলের নাম ফতেচাঁদ। ১৯১২ সালের ৭ই এপ্রিল তিনি কলকাতায় মারা যান। তার মৃত্যুর পর তার ছেলে সোবাগ চাঁদ জগৎশেঠ উপাধি পান। সোবাগ চাঁদ মহিমাপুরের বাড়িতে ডাকাতের হাতে মারা যান। তখন তার দুই ছেলে বর্তমান ছিল, জ্ঞান চাঁদ জৈন ও বিজয়চাঁদ। এদের পর আর জগৎশেঠ পরিবার সম্পর্কে জানা যায় না। ১৯১২  সালের পর আর কেউ জগৎশেঠ উপাধি বজায় রাখেননি । এদের বংশধরদেরে খোঁজ করা হয় না কেন ? 

গুলবদনপিসি  : সেনর ভাস্কো, আপনি ওমানি জাহাজি শেখ আহমেদ ইবন মজিদকে বোকা বানিয়ে, প্রচুর সোনাদানা দিয়ে, আপনার পাদরিদের গির্জায় তৈরি মদ খাইয়ে জাহাজে তুলে নিয়েছিলেন, নয়তো আল-হিন্দে আসতে পারতেন না, সেকথা ভুলে যাবেন না । আপনাদের ভাগ্য ভালো ছিল যে ইবন মজিদকে পেয়ে গিয়েছিলেন, আর তার দেখানো সমুদ্রপথে আল-হিন্দে এসেছিলেন তা সত্বেও আরবদের মুর বদনাম দিয়ে তাদের জাহাজ কামান দেগে ডুবিয়ে দিতেন আর বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের খ্রিস্টান বানাতেন । ইবন মজিদের কারণেই আপনারা আল-হিন্দ থেকে মশলা-রত্ন নিয়ে যেতেন — কালো মরিচ, জায়ফল, ছোটো এলাচ, লবঙ্গ, সুপুরি, দালচিনি, আদা, হলুদ । আরবদের থেকে জেনে গিয়েছিলেন মশলাগুলো গুঁড়িয়ে মাংসতে মাখালে তা সহজে পচে না, দুর্গন্ধও হয় না ।

ভাস্কো দা গামা : সেনর ল্যাঙড়া,: আপনারা এতো মানুষ মারলেন, এতো লুটপাট চালালেন, কিন্তু তার বদলে কিছু দিতে পারলেন না । আমরা এদেশে কি-কি দিয়েছি জানেন ? টম্যাটো, আলু, আনারস, আতা, পেঁপে, পেয়ারা, ঢেঁড়স, কাজুবাদাম, কাসাভা, চিনাবাদাম,ভুট্টা আর নানা রকম লঙ্কা । আগে এখানকার মানুষ গোলমরিচ ব্যবহার করতো আর তার জন্যেই আরব আর ইউরপীয় ব্যবসাদাররা লড়ে মরতো । আমরা দক্ষিণ আমেরিকা থেকে নানা রকমের ফলমূল অন্য দেশে নিয়ে গেছি । এদেশ থেকে নিয়ে গেছি আম । এখানকার আলফোনসো আম আমাদের অবদান । অবশ্য এদেশে তামাক আমরাই এনেছিলুম । আকবরের দরবারে বেশ জনপ্রিয় ছিল তামাক কিন্তু জাহাঙ্গির নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছিল । মেক্সিকো থেকে এনেছিলুম গাঁদাফুল । নানা রকমের লঙ্কা এনেছিলুম দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : আমি ওদিকটায় যাইনি, নয়তো আমিও নিয়ে যেতুম ।

ভাস্কো দা গামা : চিকেন কারি, মাটন কারি, ফিশ কারি, ভেজিটেবল কারি শব্দগুলো কিন্তু আমরা পর্তুগিজরাই দিয়েছি তোমাদের ।

শাহজাহান : সেনর ভাস্কো, মোগল বাদশাহের দেওয়া শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি ছিল ‘মাহি মারাতিব’।  মাহি, মানে মাছ ছিল একমেবাদ্বিতীয়ম  রুই। অবশ্যই কাঁচা রুই মাছ নয়, ধাতুর তৈরি রুই মাছের প্রতিমূর্তি। এর চেয়ে বেশি আর কী ভাবে কোনও মাছকে গৌরবান্বিত, মহিমান্বিত করা সম্ভব! ইতিহাস বলছে, মোগল সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ সম্মান ছিল  মাহি মারাতিব। এখন ভারতে ভারতরত্ন, ফ্রান্সে লিজিয়ঁ অফ অনার কিংবা ব্রিটিশ নাইটহুড যেমন—ঠিক সেই রকম। তবে মাহি মারাতিব একই সঙ্গে ছিল শৌর্য, বীরত্ব ও সাহসিকতার প্রতীক। এই ব্যাপারে যাঁরা শ্রেষ্ঠ হিসেবে গণ্য, তাঁদেরই মোগল সম্রাটরা দিতেন এই সম্মান। সোনার দু’টি দণ্ডের উপর বসানো রুইমাছের ওই বিশাল ধাতব প্রতিকৃতিকে শোভাযাত্রা করে নিয়ে যাওয়া হত । মোগলরা আর লখনউয়ের নবাবরা রুই মাছ খেতে ভালো বাসতেন। লখনউতে নবাবদের গড়া ইমারতগুলোতে দেখতে পাবেন দুটো করে রুই মাছ ।

গুলবদনপিসি : সেনর ভাস্কো, লোকে যদি জানতো আপনাদের ওই কারিতে কী লুকিয়ে আছে তাহলে খেলেই বমি করতো সেনর । আপনারা কয়েকশো আরব জাহাজিকে নোংরা মুর হিসেবে দেগে দিয়ে তাদের কান, নাক, হাত কেটে কালিকটের জামোরিন শাসককে পাঠিয়ে জানিয়েছিলেন, এই নাও কারিল পাঠালুম । লোকে রান্নার ঝোলকে বলতো কারিল। সেটাকে ইংরেজরা করে দিয়েছিল কারি, বিলেতেও এদেশ থেকে নিয়ে গেল চিকেন কারি, মটন কারি । আপনারা সমুদ্রিকে করে দিয়েছিলেন জামোরিন ।

ভাস্কো দা গামা : না, সেনোরিটা, আমরা করিনি । ইংরেজরা করেছে । আমরা বলতুম সামোরিম, ওলন্দাজরা বলতো সামোরজিন, চিনেরা বলতো শামিথিশি ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : আমি কতো দেশে লুটপাট চালিয়ে নিজের দেশে সোনাদানা টাকাকড়ি নিয়ে গিয়েছিলুম । সবই ফুরিয়ে গেছে । এখন সেই আগেকার অবস্হা । পশু চরাও আর ঘোড়ায় চেপে তীর-ধনুক চালাও ।

চেঙ্গিজ খান : আমিও কতো দেশ লুটেছিলুম । সব পয়সা খরচ করে ফেলেছে গুচ্ছের বংশধররা । একটা ব্যাপার ভালো হয়েছে যে বাইরের সৈন্য এসে আর আল-হিন্দ থেকে সোনাদানা টাকাকড়ি লুটে নিয়ে যায় না । এরা নিজেরাই লুটেপুটে বাইরে গিয়ে ঘাপটি মেরে থাকে, সুন্দরীদের হারেম রাখে, ফিরতে চায় না । বিজয় মাল্য নামে একজন লুটেরার নাম শুনলুম সেদিন, ছবিও দেখলুম হাফল্যাংটো মেয়েদের পাশে দাঁড়িয়ে হাসাহাসি করছে । শুনলুম ওর কচি গার্লফ্রেন্ড পিঙ্কি লালওয়ানিকে বিলেতে  বিয়ে করেছে । ব্যাঙ্ক থেকে নয় হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে লন্ডনে রয়েছে এই মদের ব্যবসাদার । আমি এদেশ থেকে নয় হাজার কোটি টাকার চেয়ে অনেক কম লুটে নিয়ে গিয়েছিলুম। আরও জানতে পারলুম ব্যাংক জালিয়াতির পান্ডা নীরব মোদি  হীরাজহরতের ব্যবসায়ী ; মুম্বাইয়ে ঘাঁটি গেড়ে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের একটা শাখা থেকে ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে ১১ হাজার ২০০ কোটি টাকা জালিয়াতি করে  বিদেশ পালিয়ে গেছে। তার সপ্তাহের মধ্যে তাঁর স্ত্রী, ভাইসহ ব্যবসার অন্য চাঁইয়েরাও দেশত্যাগী হয়েছে। ১০০ বিলিয়ন টাকার আর্থিক কেলেঙ্কারির দায়ে হর্ষদ মেহতাকে বম্বে উচ্চ আদালত এবং ভারতের সুপ্রিম কোর্ট  দোষী সাব্যস্ত করার পর কম বয়সেই লোকটা মরে গেলো, আজব ব্যাপার । আল-হিন্দের সবচেয়ে বড়ো জালিয়াতি মামলায় সত্যম কর্ণধার বি রামালিঙ্গ রাজু দোষী সাব্যস্ত হয়েছে।  হায়দরাবাদ আদালত সাত বছরের কারাদণ্ড আর পাঁচ কোটি টাকা জরিমানার নির্দেশ দিয়েছে তার বিরুদ্ধে। সারদা গোষ্ঠীর কর্ণধার সুদীপ্ত সেন  হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে কলকাতা থেকে পালিয়ে যায়, তখনই সে সিবিআইকে লিখে যায় একটা চিঠি,  আর তাতেই  উল্লেখ করে যায় বাইশ জনের নাম, যারা সারদা গোষ্ঠীর পতনের মূলে  ভূমিকা নিয়েছিল। রোজ ভ্যালি আর সারদা এই দুই চিট ফান্ড সংস্থার দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসার পর পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সেই সময় থেকেই গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে চিটফান্ড কেলেঙ্কারি। দুই চিটফান্ড সংস্থাই সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করতো। জমা দেওয়া টাকার অত্যধিক মূল্যে  ফেরত দেওয়া হবে এমন প্রতিশ্রুতি দিলেও শেষ পর্যন্ত টাকা শোধ করতে ব্যর্থ হয় এই দুই সংস্থা। হাসান আলী খান নামে এক ঘোড়া ব্যবসায়ী  টাকা পাচার করে সুইস ব্যাঙ্কে আট হাজার বিলিয়ন ডলার জমা করেছে ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : তাহলেই ভাবো । আমি তো সারা জীবন কতো দেশে কতো লুটপাট করলুম কিন্তু অতো হাজার হাজার টাকা চোখেই দেখিনি । 

চেঙ্গিজ খান : লোকটার নামে রেড কর্নার নোটিশ জারি হয়েছিল। নীরবের মামা মেহুল চোকসির বিরুদ্ধেও একইরকম অভিযোগ। সেও হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়ে বিদেশে পালিয়েছে । দীপক তলোয়ার নামে একজন হাওয়ালার মাধ্যমে প্রায় হাজার কোটি টাকা আর্থিক তছরুপ করে  দেশ ছেড়ে সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে গা ঢাকা দিয়েছে । সঞ্জয় ভাণ্ডারীর  বাড়ি আর অফিসে থেকে নিরাপত্তাসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ গোপন নথি মেলে। ফরেন এক্সচেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট  অমান্য করে প্রায় ২৭ কোটি টাকা আর্থিক তছরুপের অভিযোগ রয়েছে  সঞ্জয় ভাণ্ডারীর বিরুদ্ধে।সেও অন্য দেশে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে। আরেকজন হলো ললিত মোদি ; দক্ষিণ আফ্রিকায় হওয়া আইপিএল-এ বেআইনি বিদেশি টাকা লেনদেন করেছিল ।  যে কোনও ধরনের তদন্ত থেকে রক্ষা পেতে লন্ডনের ঘাঁটি গেড়েছে  ললিত মোদী। ওকে যখন গ্রেফতার করার সব প্রক্রিয়া শেষ তখন ও  পালিয়ে গেল বিদেশে। এক দেশ থেকে অন্য দেশে পালিয়ে পালিয়ে মোদী এখন বহাল তবিয়েতে আছে । অথচ সবাই বলছে আমরা এদেশে কিছুই দিইনি । এই ডাকাতগুলো তো আমাদের পথ অনুসরণ করছে । তবে ?

ল্যাঙড়া তৈমুর : ল্যাঙড়া আম বোধহয় আমার আবিষ্কার, নয়তো ল্যাঙড়া বলবে কেন, সেনর ভাস্কো ? তবে আমাদের বাবর তৈমুর সংস্কৃতির চাঘির এনেছিল, ঠিক বলছি তো বাবর ? আপেল, নাসপাতি আর আঙুরের মদ । তুই  এনেছিলিস মাজুম, যা তৈরি হয় আফিম আর গাঁজার বীজ মিশিয়ে, আখরোট, পেস্তাবাদাম, ছোটোএলাচ, মধু আর দুধ দিয়ে তৈরি বড়ি । ঠিক বলছি তো বাবর? 

ভাইপো আকবর : ওই সবের নেশাতেই আমার দুই ছেলে  মুরাদ আর দানিয়েল অল্প বয়সে মরে গেল। ভাগ্যিস শ্যায়খুবাবা এই সবের নেশার চেয়ে যুবতীদের নেশায় মজেছিল, নয়তো আমার সিংহাসন নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যেতো । শ্যায়খুবাবা এলো না কেন ? আমাকেও পর্তুগিজগুলো গড়গড়া টানার অভ্যাস করাবার তালে ছিল । ওই ধোঁয়ায় তো কোনও নেশা হলো না । আমার দরবারে খাপ খায় না । কিন্তু আবুল ফজলের মাথা কেটে আমার ওপর রাগ ফলাবার চেষ্টা করে ভালো করেনি । 

ভাস্কো দা গামা : সেনর আকবর, আপনিও বৈরাম খানকে দিয়ে হেমু বিক্রমাদিত্যের গলা কাটিয়ে আফগানিস্তানে আপনার ফ্যামিলি মেম্বারদের কাছে পাঠিয়েছিলেন, আর হেমুর দেহ একটা ফাঁসিকাঠে লটকে দিয়েছিলেন দিল্লিতে। ভেরি ব্যাড ফর ইয়োর রেপুটেশান ।

ভাইপো আকবর : হেমু ছিল বিপক্ষ পার্টিতে, আমার পার্টিতে থাকলে কাটাতুম না । শ্যায়খুবাবা এলো না ?

গুলবদনপিসি  : সেনর ভাস্কো, ল্যাঙড়াদার দেশে কিছুই হতো না অন্য দেশে নিয়ে যাবার মতন, ধর্মের নেশা আর নেশার ধর্ম  ছাড়া ।

ভাস্কো দা গামা : আচ্ছা, ওনারা কারা ? চুল-দাড়ি সবই পেকে গেছে । বেশ সিরিয়াস কিছু আলোচনা করছেন বলে মনে হচ্ছে ?

কফিহাউসের যক্ষ : আজ্ঞে ওনারা হলেন অগস্ত্য, অত্রি, ভরদ্বাজ, গৌতম, জমদগ্নি, বশিষ্ঠ আর বিশ্বামিত্র । লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক । শিল্পসাহিত্য আর জ্ঞান-বিজ্ঞান বিষয়ে চলমান ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে ব্যতিক্রমধর্মী চিন্তাধারা আর মতামত ব্যক্ত করার মুদ্রিত বাহনকে বলা হয় লিটল ম্যাগাজিন । ম্লেচ্ছদের সঙ্গে মেশেন না ।

সম্রাট অশোক : আমি ওই জানলার কাছের টেবিলে বসে আপনাদের আলোচনা শুনছিলুম । আপনাদের আলোচনার মাঝে ঢুকে পড়লুম বলে ক্ষমা করবেন । এখানে অনেকে সম্রাট বা সম্রাটদের বংশধর । আমি তৃতীয় মৌর্য সম্রাট ছিলুম , আমার বাবা বিন্দুসারের পর সিংহাসনে বসি । আমি কিন্তু বাইরে থেকে এসে সিংহাসন দখল করিনি । আমাকে ভারতবর্ষের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ  সম্রাট বলা হয় । হয়তো শুনে জালালুদ্দিন মোহম্মদ আকবরের খারাপ লাগবে । দাক্ষিণাত্যের কিছু অংশ ছাড়া ভারতবর্ষের বেশিরভাগ অঞ্চল শাসন করেছি। আমাকে একজন সর্বভারতীয় সম্রাট বলতে পারেন ।  সাম্রাজ্যের বাইরেও আমি ধর্মীয় আর সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করেছিলুম। আধুনিক যুগে জীববৈচিত্র্য রক্ষার যে মনোভাব দেখা যায়  খ্রিস্টপূর্ব যুগে বিশাল সাম্রাজ্যের শাসক হিসেবে সে ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলুম । আমার চারজন বউ ছিল, আপনাদের মতন, তিশ্যারাক্ষ, পদ্মবতী, কারুভাকী আর বিদিশা । যে পরিবারে জন্মেছিলুম তারা আজীবিক ধর্মে বিশ্বাস করতেন । তা ছিল অন্যতম  ভারতীয় ধর্ম। এই ধর্ম ২০০০ বছর ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত ছিল।  এই ধর্মের মূল বিষয় ছিল নিয়তি অর্থাৎ ভাগ্য। এই ধর্ম মতানুসারে নিয়তি সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং কোনো পৌরুষাকার একে পরিবর্তন করতে পারে না।কিন্তু রক্তক্ষয়ী কলিঙ্গ যুদ্ধের পর আমার রাজনৈতিক আর নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীতে আমূল পরিবর্তন আসে। আমার নামে বসানো পাথর আর স্তম্ভলিপির মাধ্যমে প্রকাশ করেছি, কী করে কলিঙ্গ যুদ্ধের রক্তবন্যা আমাকে একজন নীতিবান মানুষে  পরিণত করেছে।  ওই সময় থেকেই আমি জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিশ্বশান্তি আর ন্যায়নিষ্ঠ শাসন প্রতিষ্ঠায় নিজেকে নিয়োজিত করি। জীবনের বাকি সময় অহিংস  ধম্মই আমার পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছে । চেঙ্গিজ দেবশর্মা, ল্যাঙড়া দেবশর্মা, বাবর দেবশর্মা, আওরঙজেব দেবশর্মা, রাজত্ব বাড়িয়েও আপনারা কেন আত্মসমীক্ষা করলেন না তা ভাবতে ভাবতে আপনাদের টেবিলে উঠে এলুম ।

গুলবদনপিসি  : সম্রাট অশোক, আমি আপনার কথা পড়েছি । জালালুদ্দিন মুহম্মদ আকবর আপনার পথে হেঁটে সব ধর্মের মিলন ঘটাতে চেয়েছিলেন ।  দিন-ই-ইলাহি  সম্রাট আকবর প্রবর্তিত একটি ধর্ম। তিনি ধর্মীয় বিষয়ে গবেষণার জন্য  ফতেপুর সিক্রিতে একটা উপাসনা ঘর তৈরী করেছিলেন। যা’ধর্ম সভা’ নামে পরিচিত। সেখানে তিনি বিভিন্ন ধর্মের পণ্ডিতদের কথা শুনতেন। শেষে, সব ধর্মের সারকথা নিয়ে উনি নতুন একটি নিরপেক্ষ ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করেন। এটিই ‘দিন-ই-ইলাহি’  নামে পরিচিত। সেই সময়ের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা এই ধর্মমতকে ভালভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। অনেক ঐতিহসিক দিন-ই-ইলাহীকে নতুন ধর্ম বলতে অস্বীকার করেন। এই ধর্মমত  আকবরকে বিতর্কিতও করে তুলেছিল। ফলশ্রুতিতে এই ধর্মমত তেমন প্রসার লাভ করতে পারেনি। দিন-ই-ইলাহি ধর্মমতকে মেনে নিয়েছিলেন হাতে গোনা কয়েকজন, যেমন বিরবল, জহাঙ্গির, আবুল ফজল ইবন মুবারক, যুবরাজ মুরাদ, কাশিম খান, আজম খান, শেখ মুবারাক, আবদুস সামাদ, মোল্লা শেখ মোহাম্মদ শাহাদাত, সুফি আহমেদ, মির শরিফ আমল, সুলতান খাজা, মির্জা সদরুদ্দিন, তাকি সুস্তার, শেখজাদা গোসলা বেনারসি, সদর জাহান, সদর জাহানের প্রথম ছেলে, সদর জাহানের দ্বিতীয় ছেলে, শেখ ফয়েজি, জাফর বেগ, এনারা সবাই । দারা শিকোহ  ফার্সি ভাষায় ভগবত গীতা আর উপনিষদ অনুবাদ করেন। 

সম্রাট অশোক : আমার মনে হয়  মানুষের পক্ষে কোনো ঈশ্বর বা ধর্ম ছাড়াই ন্যায় ও নীতিসম্পন্ন হওয়া সম্ভব। এখানে কখনোই মনে করা হয় না যে, মানুষ জন্মগতভাবে ভালো কিংবা মন্দ অথবা প্রকৃতির চেয়ে বড়ো কিছু৷ বরং মানবতাবাদী জীবনাদর্শে মানবতার রক্ষা এবং মানবিক সিদ্ধান্তের প্রতি দৃষ্টিপাত করাই একমাত্র দায়িত্ব।

গুলবদনপিসি  : আকবর চেয়েছিলেন তাঁর সাম্রাজ্যের বিভিন্ন ধর্মের কিছু উপাদানকে একীভূত করতে । এই উপাদানগুলো প্রাথমিকভাবে ইসলাম, হিন্দু ধর্ম এবং জোরোস্ট্রিয়ান ধর্ম, খ্রিস্টান, জৈন ধর্ম এবং বৌদ্ধধর্ম থেকে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু জনসাধারণ তা মানতে চায়নি । এখন প্রত্যেকটা লোক মনে করে তার ধর্মটাই বড়ো, যখন কিনা বেশির ভাগ মানুষই অন্য কোনো ধর্ম বা ধর্মহীনতা থেকে আস্তিকান্তরিত । আচ্ছা, আপনার টেবিলে এক যুবক আর এক যুবতী আপনার সঙ্গে গল্প করছিলেন, ওনারা কারা ?

সম্রাট অশোক : ওহ ওরা ? ওরা বলিউডের অভিনেতা শাহরুখ খান আর কারিনা কাপুর খান । আমাকে নিয়ে একটা ভুলভাল ফিল্ম করেছে বলে ক্ষমা চাইতে এসেছে । শাহরুখ খান বিয়ে করেছে কাফের মেয়েকে আর কারিনা কাপুর নিজেই কাফের, পতৌদির নবাব বাড়ির ছেলেকে বিয়ে করেছে। ওদের ছেলের নাম রেখেছে তৈমুর  । যাই, ওরা অনেকক্ষণ হলো এসেছে, আজকেই ফিরে যাবে । ওরা জানতো না যে আমাকে দেখতে খারাপ বলে আমার বাবা আমায় পছন্দ করতেন না । রাজা রবি বর্মার আঁকা আমার ছবি দেখে ওরা ভেবেছে আমাকে দেখতে গ্রিক দেবতাদের মতন ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : আমার নামে ? দারুন । ওরা জানে তো যে আমি ল্যাঙড়া ছিলুম ?

গুলবদনপিসি : ভুলভাল কেন : বাবরনামা, হুমায়ুননামা, জাহাঙ্গিরনামা, তৈমুরনামার মতন বই নেই আপনার সম্পর্কে ?

সম্রাট অশোক : আছে, অশোকাবদান  বা অশোকরাজাবদান নামে । দ্বিতীয় শতাব্দীতে লেখা বই, যেখানে আমার, মানে তৃতীয় মৌর্য্য সম্রাট অশোকের জীবন  বর্ণনা করা হয়েছে। এই বইতে ঐতিহাসিক তথ্য ছাড়াও বহু কল্পকাহিনী স্থান পেয়েছে। এই বইতে আমাকে একজন বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক শাসক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, কেননা আমি বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই ধর্ম প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলুম।  অশোকাবদান বইটা বহু বৌদ্ধ প্রবাদ ও কাহিনীর সংগ্রহ হিসেবে পরিচিত দিব্যাবদান বইয়ের  অংশ বিশেষ।  ফা-হিয়েন এই বইটাকে আ-ইয়ু ওয়াং চুয়ান  নামে  চীনা ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। আমার আধ্যাত্মিক টিচার বৌদ্ধ ভিক্ষু উপগুপ্তর কাহিনী দিয়ে এই বইটার শুরু । উপগুপ্তর পূর্ব-জন্ম আর মথুরা শহরে তার যৌবনের বর্ণনায় এই বইতে তার সঙ্গে নর্তকী বাসবদত্তার সাক্ষাৎ আর ভিক্ষুকত্ব নেবার গল্প বলা হয়েছে। এই বইতে আমার পূর্ব জন্মের কাহিনী  আছে । সেই কাহিনী অনুসারে, পূর্ব জন্মে আমার নাম ছিল জয়। কৈশোরে জয়ের সঙ্গে গৌতম বুদ্ধের সাক্ষাৎ হয়। জয় ধুলোকে খাদ্য জ্ঞান করে তাঁকে এক বাটি ধুলো দান করেন। তার মহাপরিনির্বাণের বহু বছর পরে এই বালক পরবর্তী কোন এক জন্মে পাটলিপুত্র নগরী থেকে চক্রবর্তী সম্রাট হিসেবে শাসন করবেন বলে গৌতম বুদ্ধ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। অশোকাবদান বইতে বলা হয়েছে  যে, আমার বাবা বিন্দুসার আমার কুরূপের জন্য আমাকে অপছন্দ করতেন। 

গুলবদনপিসি : সিংহাসন দখলের জন্যে আপনাদের ভাইয়ে-ভাইয়ে বা কাকা-ভাইপোর মধ্যে মোগলদের মতন খুনোখুনি হতো না ?

সম্রাট অশোক : হতো না আবার ! আরও বেশি করে হতো । আমি আমার সৎভাই, যে সিংহাসনের  উত্তরাধিকারী ছিল, তার সঙ্গে শঠতা করে  জ্বলন্ত কয়লা ভর্তি গর্তে ফেলে দিয়ে খুন করেছিলুম । আমি আমার মন্ত্রীদের বিশ্বস্ততার ওপর সন্দেহ করে পাঁচশো  মন্ত্রীকে  একের পর এক খুন করিয়েছিলুম ।  বন্দিদের থার্ড ডিগ্রি টর্চার করার জন্য একটি হলঘর তৈরি করিয়েছিলুম। এই সবই পালটে গেল, মানে আমি নিজেই পালটে গেলুম । দুঃখ কষ্টে সহনশীল এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর সঙ্গে সাক্ষাতের পর আমি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে চুরাশি হাজার স্তূপ নির্মাণ করিয়েছিলুম ।

গুলবদনপিসি : আর কী আছে বইতে ? আমি ব্যাপারটা জানতে চাইছি যাতে হুমায়ুননামা বইটায় নতুন ইনটারেস্টিং কিছু অ্যাড করতে পারি ।

সম্রাট অশোক : বৌদ্ধ ধর্ম প্রসারে আমার ভূমিকা এই বইতে বিশদে লেখা আছে । এই বই অনুযায়ী, আমি আমার ভাই বীতাশোককে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণে উৎসাহিত করেছিলুম । এরপর বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সম্মান করার জন্য  মন্ত্রী যশসকে নির্দেশ দিই। তারপর উপগুপ্তকে সঙ্গে করে গৌতম বুদ্ধের সঙ্গে জড়িত জায়গাগুলোতে তীর্থ করতে বেড়িয়ে পড়ি। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য আমি একটা পঞ্চবার্ষিকী উৎসবের প্রচলন করেছিলুম। এই উৎসবে আমার সঙ্গে পিন্ডোল ভরদ্বাজের দেখা হয়। আমার বউ  তিষ্যরক্ষার ষড়যন্ত্রে আমার ছেলে কুণালের অন্ধত্বের কাহিনীও এই বইতে লেখা আছে। কুণাল পরবর্তীকালে অর্হত্ত্ব লাভ করে। বৌদ্ধ ধর্ম নেবার পরে দুটো ঘটনায় আমি চটে গিয়েছিলুম । একবার পুণ্ড্রবর্ধনের একজন লোক একটা ছবি এঁকে এনেছিল যাতে দেখানো হয়েছিল গৌতম বুদ্ধ নিগণ্ঠ ণাতপুত্তকের পা ছুঁয়ে প্রণাম করছেন । এক বৌদ্ধধর্মাবলম্বীর অভিযোগ পেয়ে আমি তাকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দিই আর পরে পুণ্ড্রবর্ধনের সমস্ত আজীবিক সম্প্রদায়ের মানুষদের মেরে ফেলার নির্দেশ দিই, যার ফলে প্রায় আঠারো হাজার মানুষ খুন হয়। কিছু সময় পরে, পাটলিপুত্র শহরের এক জৈন ধর্মাবলম্বী ওইরকম একটা ছবি আঁকলে আমি তাকে সপরিবারে জীবন্ত অবস্থায় পুড়িয়ে মারার হুকুম দিই ।  যারা  জৈন ধর্মাবলম্বীদের কাটা মাথা এনে দিতে পারবে আমি তাদের  রৌপ্য মুদ্রা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলুম। এই আদেশের ফলে ভুলক্রমে এক পশুপালক আমার ভাই বীতাশোককে জৈন সন্ন্যাসী ভেবে খুন করেছিল। আমার মন্ত্রীরা আমায় বলেন যে, এই হত্যাকাণ্ডগুলি জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিদের মধ্যেও বেদনার সঞ্চার করেছে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে আমি মৃত্যুদণ্ডের আদেশ রদ করে দিয়েছিলুম । অবশ্য এই গল্পগুলো বানানো, দেখাবার জন্যে যে আমি কতো খারাপ ছিলুম আর পরে কতো ভালো হয়ে গেলুম ।  তবে এটা ঠিক, অশোকাবদান বইয়ের বর্ণনা অনুসারে, শেষ জীবনে আমি আমার রাজকোষের সমস্ত সম্পদ সংঘগুলোকে দান করতুম। আমি সমস্ত সম্পদ দান করে দেবো এই ভয়ে আমার মন্ত্রীরা আমাকে রাজকোষে ঢুকতে দিতো না । তাই আমি নিজের ব্যক্তিগত সম্পদ দান করে দিয়েছিলুম ।

গুলবদনপিসি : আপনি তো খুনোখুনির ব্যাপারে দেখছি মোগল, উজবেক, আফগান, ইরানি, তুর্কি সম্রাটদের চেয়ে কম যান না ।

সম্রাট অশোক : একটা যুদ্ধের পর আমি পুরোপুরি পালটে গিয়েছিলুম । তোমার মোগল, উজবেক, আফগান, ইরানি, তুর্কি সম্রাটরা তা পারেনি । আল-হিন্দের পূর্ব উপকূলে কলিঙ্গদেশ ছিল, এখন ওডিশা নামে পরিচিত। কলিঙ্গবাসীরা যুদ্ধ করলো বীরের মতো কিন্তু আমার পরাক্রমশালী সেনাবাহিনীর সাথে পেরে উঠলো না। এক ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের পর জয়ী হলুম । এই সংগ্রাম আর বীভৎস অত্যাচার এত গভীরভাবে আমাকে আঘাত করলো যে, যুদ্ধ আর সব রকমের সামরিক কার্যকলাপের প্রতি আমার বিতৃষ্ণা জন্মে গেল।  যুদ্ধের এই ভয়াবহতা দেখে নিজের ভেতর এক বিষাদ অনুভব করলুম। এত রক্তপাত আর হত্যাকান্ডের বদলে পাওয়া রাজত্বের প্রতি নিরাসক্ত বোধ করতে আরম্ভ করলুম। এরপর আমি আর যুদ্ধ করিনি । দক্ষিণের এক ক্ষুদ্র খন্ড বাদে সমস্ত ভারত ছিল আমার অধীন, আর এই ক্ষুদ্র ভূখণ্ডও আমি অনায়াসে জয় করতে পারতুম।  গৌতম বুদ্ধের অহিংস নীতির প্রতি আকর্ষণ বোধ করতে লাগলুম, আর বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়ে বৌদ্ধধর্মের বাণী প্রচারের  চেষ্টায় জীবন কাটালুম। আমার ধর্ম,  মন্ত্র উচ্চারণ আর পূজা অর্চনায় ছিল না, মহৎ সামাজিক উন্নয়নের জন্য আমি মনোনিবেশ করলুম। দেশজুড়ে নির্মিত হলো বাগান, হাসপাতাল, রাস্তাঘাট। প্রজাদের সুপেয় পানীয়জল এর অভাব পুরণের জন্য নির্মাণ করা হলো অসংখ্য কুয়ো। নারীশিক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হলো। বিশাল বিশাল চারটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হলো, সেখানে জ্ঞানের সর্বোচ্চ শাখার পাঠদান করা হতো। এমনকি  পশুপাখিদের জন্যও আমি হাসপাতাল তৈরি করেছিলুম। এভাবে প্রজাদের উন্নতির জন্য কাজ করে, ছত্রিশ বছর রাজত্ব করে, মারা যাই । 

শাহজাহান : আমার বড়ো ছেলে দারা শুকোহ আর বড়ো মেয়ে জাহানারা অমন চরিত্রের ছিল । আওরঙজেব দুজনকেই সহ্য করতে পারতো না । আমি চেয়েছিলুম দারা শুকোহ সম্রাট হোক । আওরঙজেব ওকে খুন করে ওর গলা কেটে ফেললো । তারপর কাটা মাথাটা তরোয়াল দিয়ে থেঁতো করে আমার খাবার সময়ে পাঠিয়েছিল । দারা শুকোহকে হুমায়ুনের সমাধিতে কোথায় যে আওরঙজেব গোর দিয়েছিল তা আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি । দারার ছেলে সুলেমান শিকোহকেও একইভাবে খুন করেছিল ।

গুলবদনপিসি : সব পরিবারেই অবাধ্য সন্তান জন্মায় । আমাদের পরিবারে যেন বেশি জন্মেছে । আরে, ওই তো বাহাদুর শাহ জাফর আসছেন ।

বাহাদুর শাহ জাফর : অনেক কষ্টে এলুম তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে । বিদেশে নিয়ে গিয়েছিল ফিরিঙ্গিগুলো । এখন দেখে ভালো লাগছে মহাবিদ্রোহ সফল হয়েছে । এখানকার লোকেরা স্বাধীন হয়েছে । তবে আসার সময়ে শুনছিলুম চোর-ছ্যাঁচোড়ের সংখ্যা নাকি অনেক বেড়ে গেছে । যারা শাসক তারাই সিঁদ কাটছে । বেশি কথা বলতে পারি না, হাঁপিয়ে যাই । শায়রিও লিখতে পারি না । 

শাহজাহান : তোকে কী আর বলি বাহাদুর শাহ । আমি যে উর্দুভাষা তৈরি করেছিলুম, তুই আর গালিব ভালোবাসতিস, সেই ভাষা থেকে জন্মে গেল নতুন একদল মানুষ । তারা উর্দুভাষা নিয়ে একটা আলাদা দেশ বানিয়ে ফেললে । সেখানে পাসপোর্ট ছাড়া আমরা যেতে পারবো না । ওরা বলেছিল যে নাস্তিক কাফের মুরতাদদের থেকে আলাদা হয়ে যাবে, অথচ ওই দেশেই যারা সুবেবাংলার ভাষায় কথা বলতো, তাদের ওপর এমন অত্যাচার করতে লাগলো যে তারা আলাদা হয়ে গেল । উর্দূদেশের চেয়ে বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করছে । উর্দুদেশটায় সদাসর্বদা সামরিক চোখরাঙানি চলতেই থাকে ।

বাহাদুর শাহ জাফর : ভালোই হয়েছে । গালিবের কবর তো এই দেশে । সামরিক পাহারাদাররা এসেছে আমার সঙ্গে, যদি গালিবের কবরটা দেখতে দেয় তাহলে যাবো । শুনতে পেয়েছিলুম, তুমি বলছিলে, দারা শুকোহ’র কবর পাওয়া যায়নি, আওরঙজেব লোপাট করে দিয়েছে । নয়তো একবার যেতুম ওনার সমাধি দেখতে । দারা শুকোহর সমাধি আওরঙজেব লোপাট করেছিল আর আমার সমাধি লোপাট করেছিল ফিরিঙ্গিরা । ফিরিঙ্গিরা একটা পাথরের ফলক বসিয়েছিল,  তাতে লেখা, “বাহাদুর শাহ, দিল্লির সাবেক রাজা। মৃত্যু রেংগুনে, নভেম্বর ৭, ১৮৬২। এই স্থানের কাছে সমাধিস্থ করা হয়”। কিন্তু সমাধির নির্দিষ্ট স্থান হারিয়ে গিয়েছিল। বর্মার লোকেরা কেবল জানতো যে শেদাগন প্যাগোডার কাছে আমার সমাধি আছে। ওই জায়গাতে মজুররা নর্দমা বানানোর জন্য মাটি খুঁড়ছিল। হঠাৎ বেড়িয়ে পড়ে পোড়া ইটের দেয়াল দেয়া এক কবর। ওপরে কিছু লেখা। সেই লেখা পড়ে ওরা জানতে পারে ওখানে আমি শুয়ে আছি।  গড়ে ওঠে দরগাহ। পরে সেটা ট্যুরিস্টদের  জন্য খুলে দেয়া হয়েছে । বর্মার লোকেরা বলে, সম্রাট দরবেশের দরগাহ। মরে গিয়ে দরবেশ হয়ে গেছি । 

গুলবদনপিসি  : হ্যাঁ, বাহাদুর শাহ, তুই দরবেশ হয়ে মোগলদের মুক্তি দিয়ে গেছিস ।

বাহাদুর শাহ জাফর : ওই যে, সামরিক পাহারাদাররা আসছে । উঠে পড়ি । নয়তো শু চি’র মতন চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে যাবে । যাবার আগে এই দু’লাইন শুনিয়ে যাই, হোলি তো এসে গেল :

আজ বহুদিন পর হাতে পেয়েছি তোমায়, যেতে দেব না

তোমার উত্তরীয় ধরে আটকে কৃষ্ণ হোলি খেলবো তোমার সাথে

(বহোত দিনন মেঁ হাথ লাগে হো ক্যায়সে জানে দেউঁ

আজ ম্যায় ফাগওয়া তা সও কানহা ফ্যায়তা পাকাড় কর লেউঁ)

ভাইপো আকবর : বহুত খুব, বহুত খুব । শ্যায়খুবাবা আসবে না ?

পাগলা তুগলক : বিনির্মাণবাদ হলো আপেক্ষিক সংশয়বাদী একটা ধারা যা কিনা ফেড্রিক নিটসের হাত ধরে ষাটের দশকে দারিদার কাছে এসে পরিপুষ্ট হয়েছে। সাহিত্য বা মানুষের চিন্তার ক্ষেত্রে বিনির্মাণবাদ একটা নতুন দরোজা খুলে দিয়েছে। তিনি বলতে চেয়েছেন, আমরা একটা নির্দিষ্ট পরিসরে সুনির্দিষ্টভাবে ভাষা ব্যবহার করি, চিন্তার জগতকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। আর এক্ষেত্রে কোনও বিষয়ের লিখিত ও উপলদ্ধি-র মাঝে প্রায়শ ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থাকে। কাজেই কোন একটা টেক্সট পড়া দরকার টেক্সট হিসেবে। তাঁর বিনির্মাণবাদের মূলসূত্র তাই, “টেক্সট বা পাঠ প্রকৃতির বাইরে কিছু নেই”। আমরা এই ছোট্ট পরিসরে দারিদার এই নতুন দার্শনিক তত্ত্বের ব্যখ্যা নিয়ে আলোচনা করার সময় পাবো না, নয়তো দর্শন, সাহিত্য, সামাজিক বিজ্ঞান, ধর্ম, এবং ইতিহাসের ওপর এর প্রভাব কতো গভীরে তা একটু তলিয়ে দেখার সুযোগ পেতুম। তার আগে যে সামাজিক ও দার্শনিক বাস্তবতার মধ্যে দারিদার এই তত্ব আত্মপ্রকাশ করেছিলো তার সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে দু’চার কথা বলা দরকার ছিল, কিন্তু আজকের আড্ডা সিরিয়াস নয় বলে আর কিছু বলতে চাই না। 

তোতলা তুগলক : পাপাপাগলাটা এএএরককককমই রয়ে গেগেগেল ; দিদিদিল্লি থেকে দৌদৌদৌলতাবাদ। লোকেরা ওওওকে ঠিঢিঢিকমতন বুবুবুবুঝতে পাপাপারেনি ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : হ্যাঁ রে গুলবদন, হুমায়ুন এলো না ?

গুলবদনপিসি  : কোন হুমায়ুন ? হুমায়ুন আজাদ ? ওনাকে তো আলাউদ্দিন খলজির বংশধররা ভেড়া কাটার চপার মেরে মেরে খুন করে দিয়েছে । আর হুমায়ুন আহমেদ জেনানাঘরে বেগম আর খাতুনদের গপপো শোনাচ্ছেন ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : না, না । তুই যাকে নিয়ে হুমায়ুননামার ‘অর্ধেক জীবন’ লিখেছিস সেই নেশুড়ে হুমায়ুনের কথা বলছি ।

গুলবদনপিসি  : ও তো তেহরানে পালিয়ে যাবার স্মৃতি থেকে মুক্ত হয়নি । হেলমেটে ঘোড়ার মাংস সেদ্ধ করছিল ভেড়ার চর্বি মাখিয়ে । বোধহয় খেয়েদেয়ে আসবে । আফিমের শরবতের নেশায় চুর থাকে সারাদিন । বাবর আর আকবরের নাম উজ্বল করতে পারবে না হুমায়ুন ।

চেঙ্গিজ খান : আচ্ছা ল্যাঙড়া, তুই একবার বলেছিলিস আল-হিন্দে অপ্সরারা থাকে, কই একজনকেও তো কফিহাউসে দেখছি না । সবাই কি পাথরের মূর্তি হয়ে গেল ?

ল্যাঙড়া তৈমুর : আপনি যেমন শুনেছেন, আমিও তেমন শুনেছি । অপ্সরাদের মধ্যে নামকরা হলো উর্বশী, মেনকা, রম্ভা, তিলোত্তমা,  ঘৃতাচী, অলম্বুষা, মিশ্রকেশী্, জানপদী,  বিদ্যুৎপর্ণা, অদ্রিকা, পঞ্চচূড়া, সোমা, মরীচি, শুচিকা, অম্বিকা, ক্ষেমা, অসিতা, সুবাহু, সুপ্রিয়া, সুগন্ধা, সুরসা, বিশ্বাচী, পূর্বচিত্তি, প্রম্লোচা, বর্গা, প্রমথিনী, কাম্যা, শারদ্বতী, গুণবরা, ঋতুস্থলা, বুদ্বুদা, সৌরভেয়ী, ইরা, চিত্রাসেনা, সমীচী, চারুনেত্রা, পুঞ্জিকস্থলা, শুচিস্মিতা, বিশালনয়না আরও কারা কারা যেন। ওই দিকের টেবিলে কয়েকজনকে তো অপ্সরা বলেই মনে হচ্ছে ।

ঘসেটি বেগম : না, না, ওরা অমন সেজে এসেছে । দেখছো না, ওরা একটা লোককে ঘিরে বসেছে । ওই লোকটার একটা কাগজ আছে, ফি-হপ্তায় নাকি পনেরো দিনে একবার বেরোয় । ওই লোকটাই বোধহয় বিশ্বামিত্র, ওরা তালে আছে ওনার কাগজটায় নিজেদের লেখা ছাপাবার । ছাপলে তবে অপ্সরায় প্রোমোশান । যতোদিন না ছাপছে ততোদিন রাক্ষসদলেই থাকবে । অনেকে শেষ পর্যন্ত পারে না, আমার আর ওসামা বিন লাদেনের মতন জলে ডুবে মরে ।

চেঙ্গিজ খান : এই রে, লোকটা তো চলে গেল । বোধহয় কাউকে পছন্দ হয়নি ।

গুলবদনপিসি  : কিন্তু অন্য একজন বুড়ো আমাদের দিকে এতোক্ষণ তাকিয়েছিল, সে এদিকেই আসছে । বোধহয় আমাকেই অপ্সরা বলে মনে করছে । ওনার পেছন পেছন একজন যুবকও আসছে।

ল্যাঙড়া তৈমুর : তোকে তো দেখতে-শুনতে ভালোই । কতো আমির-ওমরাহ তোর জন্যে জান লড়িয়ে দিতো । তোকে হয়তো ওদের দুজনের ভালো লেগেছে । দ্যাখ, কাকে পছন্দ হয় ।

গুলবদনপিসি  : দুজনকেই আমার পছন্দ ।

নাতিন্দ্রনাথ : কিছু মনে করবেন না । আপনাদের কথা শুনছিলুম । অপ্সরার কথা তুললেন বলে দেয়ালে টাঙানো ছবি থেকে নেমে এলুম আপনাদের কাছে। অপ্সরারা আমাদের ধ্যানেই আছে, কোনোখানেই তা বিষয়ীকৃত হয় নি, এ কথা মানতে কারোর ভালো লাগে না। তাই  পুরাণে স্বৰ্গলোকের অবতারণা। যা আমাদের ভাবে রয়েছে অ্যাবস্ট্যাক্ট স্বর্গে তাই পেয়েছে রূপ। যেমন, ষে কল্যাণের পূর্ণ আদর্শ সংসারে রোজ দেখতে পাই নে, অথচ যা আছে আমাদের ভাবে, সত্যযুগে মানুষের মধ্যে তাই ছিল বাস্তবরূপে এই কথা মনে করে তৃপ্তি পাই। তেমনি এই কথা মনে করে আমাদের তৃপ্তি যে, নারীরূপের ষে অনিন্দনীয় পূর্ণতা আমাদের মন খোঁজে তা অবাস্তব নয়, স্বর্গে তার প্রকাশ উর্বশী-মেনকা-তিলোত্তমায়। সেই বিগ্রহিণী নারীমূর্তির বিস্ময় ও আনন্দ উর্বশী কবিতায় লিখেছি । অন্তত পৌরাণিক কল্পনায় এই উর্বশী একদিন সত্য ছিল, যেমন সত্য তোমরা আমরা। তখন মর্তলোকেও তার আনাগোনা ঘটত, মানুষের সঙ্গেও তার সম্বন্ধ ছিল ; সে সম্বন্ধ অ্যাবসট্র্যাক্ট নয়, বাস্তব। যথা পুরুরবার সঙ্গে তার সম্বন্ধ। কিন্তু কোথায় গেল সেদিনকার সেই উর্বশী । আজ তার ভাঙাচোরা পরিচয় ছড়িয়ে আছে অনেক মোহিনীর মধ্যে, কিন্তু সেই পূর্ণতার প্রতিমা কোথায় গেল ! ফিরিবে না, ফিরিবে না, অস্ত গেছে সে গৌরবশশী । একটা কথা মনে রেখো। উর্বশীকে মনে করে যে সৌন্দর্ষের কল্পনা কাব্যে প্রকাশ পেয়েছে, লক্ষ্মীকে অবলম্বন করলে সে আদর্শ অন্যরকম হত ; হয়তো তাতে শ্রেয়স্তত্ত্বের উচ্চস্বর লাগত। কিন্তু রসিক লোকে কাব্যের বিচার এমন করে করে না। উর্বশী উর্বশীই, তাকে যদি নীতি-উপদেশের খাতিরে লক্ষ্মী করে গড়তুম তা হলে ধিক্কারের যোগ্য হতুম। 

ল্যাঙড়া তৈমুর : দাদু, আমি তো কিছুই বুঝলুম না । বাদবাকি সবাই বুঝেছে কিনা জানি না ।

নাতিন্দ্রনাথ : তাহলে আরেকটা কথা বলি ।  যে প্রাণলক্ষ্মীর সঙ্গে ইহজীবনে আমাদের বিচিত্র সুখদু:খের সম্বন্ধ, মৃত্যুর রাত্রে আশঙ্কা হয়, সেই সম্বন্ধবন্ধন ছিন্ন করে বুঝি আর-কেউ নিয়ে গেল। যে নিয়ে যায় মৃত্যুর ছদ্মবেশে সেও সেই প্রাণলক্ষ্মী। পরজীবনে সে যখন কালো ঘোমটা খুলবে তখন দেখতে পাব চিরপরিচিত মুখশ্ৰী। কোনো পৌরাণিক পরলোকের কথা বলছিনে সে কথা বলা বাহুল্য, এবং কাব্যরসিকদের কাছে এ কথা বলার প্রয়োজন নেই যে বিবাহের অনুষ্ঠানটা রূপক। পরলোকে আমাদের প্রাণসঙ্গিনীর সঙ্গে ঠিক এইরকম মন্ত্র পড়ে মিলন ঘটবে সে আশা নেই। আসল কথা, পুরাতনের সঙ্গে মিলন হবে নূতন আনন্দে।

ভাইপো আকবর : দাদু, এরা বুঝবে না । এরা জাহিল । আমার দীন-ই-ইলাহী বুঝতে না পেরে এরা কতো আমার খিল্লি উড়িয়েছিল । জানে না যে, জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেক থাকাটাই যথেষ্ট নয়; তার সদ্ব্যবহারই প্রকৃত মানুষের কাজ।  সকলে তাদের জ্ঞান-বিবেকের সদ্ব্যবহার করতে পারে না। কেউ সদ্ব্যবহার করতে সমর্থ হলেও কেউ আবার ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। শ্যায়খুবাবা এলো না কেন ?

নাতিন্দ্রনাথ : সেই কথাই বলতে এসেছিলুম । যাক তুমি তো বুঝলে ? আমি যাই । সিঁড়ি দিয়ে নামতে আজকাল কষ্ট হয় । যেতে হবে জোড়াসাঁকো । দেখি উবের বা ওলা পাই কিনা । আমি আবার মোবাইল ঠিক মত হ্যাণ্ডল করতে পারি না । এই যুবক হয়তো নতুন করে বোঝাতে পারবে । 

ভাইপো আকবর : আপনারা পয়সাঅলারাই শুধু ব্রাহ্ম হলেন কেন ? চাকর-চাকরানি, মালি-মুদ্দোফরাসরা কী দোষ করেছিল । জমিদারির নমশুদ্র চাষিদের ব্রাহ্ম করতে পারতেন । আমাদের দেখুন, বাদশা থেকে ডোম-মেথর পর্যন্ত সবাই আস্তিকান্তরিত ।

নাতিন্দ্রনাথ : বাবামশায় বলতে পারবেন । উনি এখন উপাসনাঘরে ।

তিরিষ্ণুযুবক : আমি আমাদের উর্বশী আর গ্রিসের উর্বশী দুটোই হ্যাণ্ডল করেছি । গ্রিসের উর্বশীর নাম আর্টেমিস ।  দেশীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আত্মস্থ করার পাশাপাশি আমি প্রথম থেকেই বিদেশিনীদের সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠি। তাই আমার জীবনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ প্রবেশ করেছে  প্রথম থেকেই।  বয়সের কারণে, জাহাঙ্গিরের মতন আমার মনেও প্রবেশ করেছে অনুরাগ, আবেগ ও নানান প্রেরণা। জাহাঙ্গিরের মতন মাত্র আঠারো বছর বয়সে আমি ইতিবাচকতা, হতাশা ও আশাবাদে  প্রবলভাবে ভুগেছিলুম ।  উর্বশী আল-হিন্দে আমার অপরূপা সুন্দরী-প্রেমিকা । গ্রিসে আমার প্রেমিকা আর্টেমিস হলো বৃক্ষ ও অমাবস্যার দেবী, শিকারে পারদর্শী আর  তরুণদের রক্ষা করতে অবিকল্প দেবী সে। অন্য দিকে সে দেবতাদের আলোর পথের দিশারি। এই দুই সুন্দরীকে নিয়ে আমি ঘর করেছিলুম । অপার রহস্যেঘেরা সৌন্দর্যের বাগানে শাহজাহানের মতন শৈল্পিক দাপট দেখিয়েছি। শাহজাহান আর জাহাঙ্গির জানবেন যে প্রেমকাতরতা আর বিলাপ যেন মানুষের জীবন থেকে ফুরোতেই চায় না । অপেক্ষা আর মনের চাঞ্চল্য মিলিয়ে আমার অনুভবে-ধরা প্রেমের এক অপরূপ প্রবাহকে । মায়া ও বিভ্রমের এই পৃথিবীতে আমি বারবার প্রেমিকাকে নিয়ে আশার সাগর তৈরি করতে চেয়েছি । অবসাদ থেকে মুক্তির পথে অগ্রসর হয়েছি প্রতিনিয়ত। আমি কল্পনায় সাজিয়েছি পৃথিবীর আদি ও অনন্ত রূপ। নারী-পুরুষের কম্পমান হৃদয়ে স্থান দিয়েছি কল্পনার রাজ্যের অপার আনন্দ

শাহজাহান : বেশ ভালো লাগছে তোমার কথাগুলো যুবক । জাহাঙ্গির তো বহু নারীর সঙ্গে প্রেম করেছে, ও থাকলে তোমাকে শাহি দরবারে নিয়ে যেতো ।

ভাস্কো দা গামা : সেনর, আপনি শুধু ফর্সা, লাল ঠোঁট, পাতলা কোমর, উঁচু বুক, গোলাপি বোঁটা, প্রেমিকাদের নিয়েই ব্যস্ত আছেন?  আমরা তো আফরিকা থেকে তুলে এনে কতো হাবশি মেয়ে এদেশে  বিক্রি করেছি । আপনি একজনকে কিনে তাকে প্রেমিকা করে তুলতে পারতেন । তাদের মতন উঁচু বুক, উঁচু পাছা, চকচকে কালো ত্বক আপনি পাবেন না । জড়িয়ে ধরলে আপনি পাগল হয়ে যাবেন । 

নাতিন্দ্রনাথ : কালো মেয়ে নিয়ে আমি লিখেছি । এবার ছবির ভেতরে যাই, উবেরের ড্রাইভার ওপরে উঠে এসেছে ।

তিরিষ্ণুযুবক : না, তেমন সুযোগ হয়নি । পেলে ভালো হতো । প্রেমের নতুন পরিভাষা তৈরি করতে পারতুম । তবে সমস্যা হলো যে কলেজের ছাত্রছাত্রীরা আমার সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করতো । আপনাদের টেবিলে এসে ভালো লাগলো । যাই এবার । এই সময় আমার বাড়িতে বন্ধুবান্ধবরা এসে জড়ো হয়, সবাই মিলে এক-আধ পেগ মারি । ওই বুড়ো, যিনি একটু আগে এসেছিলেন, উনি বোধহয় যৌবনে একজন হাবশি মেয়েকে ভালোবেসেছিলেন । কেননা উনি লিখেছেন, “কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,   কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে,  কালো মেঘের কালো হরিণ-চোখ।ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে,   মুক্তবেণী পিঠের ‘পরে লোটে।কালো? তা সে যতই কালো হোক,   দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।ঘন মেঘে আঁধার হল দেখে   ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই, শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে   কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই।আকাশ-পানে হানি যুগল ভুরু   শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু। কালো? তা সে যতই কালো হোক,   দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ। পূবে বাতাস এল হঠাৎ ধেয়ে,   ধানের ক্ষেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ।আলের ধারে দাঁড়িয়েছিলেম একা,   মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ।আমার পানে দেখলে কি না চেয়ে   আমি জানি আর জানে সেই মেয়ে। কালো? তা সে যতই কালো হোক,   দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।এমনি করে কালো কাজল মেঘ   জ্যৈষ্ঠ মাসে আসে ঈশান কোণে।এমনি করে কালো কোমল ছায়া   আষাঢ় মাসে নামে তমাল-বনে।এমনি করে শ্রাবণ-রজনীতে   হঠাৎ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে।কালো? তা সে যতই কালো হোক,   দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,   আর যা বলে বলুক অন্য লোক।দেখেছিলেম ময়নাপাড়ার মাঠে   কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।মাথার ‘পরে দেয় নি তুলে বাস,   লজ্জা পাবার পায় নি অবকাশ।কালো? তা সে যতই কালো হোক,   দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।”

ভাইপো আকবর : বহুত খুব, বহুত খুব । আমার নবরত্নদের কারোর সঙ্গে তোমার কাছে পাঠিয়ে দেবো আমার পছন্দের হাবশি ক্রিতদাসীদের একজনকে । কোন হরিণের চোখের মেয়ে চাও ?  বল্গা হরিণ, মায়া হরিণ, সম্বর হরিণ,  চিত্রা হরিণ নাকি চাইনিজ ওয়াটার ডিয়ার, রেইনডিয়ার, এন্টিলোপ,  এশিয়ার মাস্ক ডিয়ার,  আর্দ্র ‌আফ্রিকার ওয়াটার চেভ্রোটেইন, কিংবা মাউস ডিয়ার, যেমন চোখের চাও, জানিও, পাঠিয়ে দেবো । শ্যায়খুবাবা এলোনা কেন ?

কফিহাউসের যক্ষ : স্যার ওই লম্বাদাড়ি লম্বাচুল বুড়ে, যিনি একটু আগে ছবি থেকে নেমে এসেছিলেন, উনিও মাই নিয়ে একটা কবিতা লিখেছেন, কড়ি ও কোমল বইতে আছে ; তবে কবিতাটার নাম স্তন ।

চেঙ্গিজ খান : শোনাও শোনাও ।

কফিহাউসের যক্ষ : নারীর প্রাণের প্রেম মধুর কোমল,

বিকশিত যৌবনের বসন্ত সমীরে

কুসুমিত হয়ে ওই ফুটেছে বাহিরে,

সৌরভ সুধায় করে পরান পাগল।

মরমের কোমলতা তরঙ্গ তরল

উথলি উঠেছে যেন হৃদয়ের তীরে।

কী যেন​​ বাঁশির ডাকে জগতের প্রেমে

বাহিরিয়া আসিতেছে সলাজ হৃদয়,

সহসা আলোতে এসে গেছে যেন থেমে–

শরমে মরিতে চায় অঞ্চল-আড়ালে।

প্রেমের সংগীত যেন বিকশিয়া রয়,

উঠিছে পড়িছে ধীরে হৃদয়ের তালে।

হেরো গো কমলাসন জননী লক্ষ্ণীর–

হেরো নারীহৃদয়ের পবিত্র মন্দির।

ভাইপো আকবর : বহুত খুব বহুত খুব । শ্যায়খুবাবা এলো না কেন ?

কফিহাউসের যক্ষ : স্যার ওই টেবিলে যে মেয়েটি বসে আছেন, ওনার নাম মিতুল দত্ত । উনিও স্তনের ওপর কবিতা লিখেছেন । ওনার কবিতার নাম দুর্বার জন্য কবিতা ।

চেঙ্গিজ খান : শোনাও শোনাও ।

কফিহাউসের যক্ষ : যেভাবে বুক দুটোকে বেঁধে রাখিস

মনে হয় ওরা তোর মেয়ে

একটুখানি ঢিলে দিলে বেয়াড়া অসভ্য হয়ে

ডেকে আনবে পাড়ার ছেলেদের

স্নানের সময় যেই খুলে দিস

হুটোপাটি করে ওরা স্নান করে

কেউ কাউকে একটু কষ্ট না দিয়ে

যে যার মতো একা 

ভাইপো আকবর : বহুত খুব বহুত খুব । শ্যায়খুবাবা এলো না এখনও !

নোবিলিআত্মন : মাই সম্পর্কে আর কী জানো ? ইটালিতে ফিরে যে আল-হিন্দ স্মৃতিকথা লিখব তাতে ইনক্লুড করে নিতে হবে ।

পাগলা তুগলক  : আমি বলছি, আমি বলছি ।মানুষই হল একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী যার যৌন উত্তেজনার সঙ্গে স্তনের সম্পর্ক রয়েছে। সাধারণত বড়ো মাপের স্তনের প্রতি পুরুষ বেশি আকর্ষণ অনুভব করে। নারী শরীরের অন্যতম নরম অংশ হল স্তন। এই কোমলতা পুরুষকে আকর্ষণ করে। ফলে স্তন স্পর্শ করতে, মুখ দিতে, মাথা রাখতে, এমনকী নারী দুই হাতে দুটি স্তনকে পরস্পরের সঙ্গে চেপে সঙ্গমছিদ্র তৈরি করলে পুরুষ আগ্রহ বোধ করে। নারী-স্তন পুরুষের কাছে অত্যন্ত আরামদায়ক। স্তনে মাথা রেখে বিশ্রাম নেওয়া তার সুপ্রাচীন অভ্যাস। জীবজগতে একমাত্র মানুষের ক্ষেত্রে নারীর স্তন বয়সের সঙ্গে মাপে বড়ো হয়, যখন কিনা স্তন্যপায়ী পশুদের স্তনের মাপ বড়ো হয় তারা পোয়াতি হয়ে বুকে দুধ আসার পর ; বাচ্চা বড়ো হবার পর আবার আগের মতো হয়ে যায় ।  ঋতুর বয়সে পড়লে নারীর বুকে কেন চর্বি জমে অমন আকর্ষক পিণ্ড গড়ে ওঠে তার নানা রকম ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছেন গবেষকরা। কিন্তু প্রধান তর্ক হল যে তা পুরুষকে আকর্ষণের জন্য প্রকৃতির অবদান । ২০১৮ সালে প্রকাশিত ‘দি কেমিস্ট্রি বিটউইন আস : লাভ, সেক্স অ্যান্ড দি সায়েন্স অব অ্যাট্রাকশান’ বইতে ল্যারি ইয়াং ও ব্রায়ান আলেকজান্ডার জানিয়েছেন যে নারীর স্তন সম্পর্কে পুরুষদের অবশেসন ঘটে যখন সে মায়ের কোলে শুয়ে দুধ খায় এবং মায়ের অক্সিটোসিন হরমোন নির্গত হয় যার দরুন স্তনের সঙ্গে পুরুষের পাকা বাঁধন তৈরি হয়ে যায়, অবচেতনায় গেঁথে যায় । পুরুষ তার সঙ্গিনীর মধ্যে সেই একই বাঁধনযোগ্যতা খোঁজে আর তার জন্য সে বড়ো মাপের স্তনের প্রতি আকৃষ্ট হয় । যারা বেশ্যালয়ে যাতায়াত করে তারাও সুন্দর মুখমণ্ডলের বদলে বর্তুল স্তন আর খাঁজের খদ্দের হয়ে ওঠে । পুরুষ যখন চোখে দেখে, ছোঁয়, মুখ দেয়, টেপে, তখন তার অবচেতনায় শৈশবের ভালোলাগা স্মৃতি কাজ করে । বড়ো মাপের স্তনের প্রতি পুরুষের আকর্যণের কারণ হল অবচেতনে তারা স্তনকে দুধের ভাঁড়ার হিসাবে দ্যাখে ; যতো বড়ো স্তন ততো বেশি দুধ । সন্তান প্রসবের পর কোনো কোনো নারীর অত্যধিক দুধ হয় যা আগেকার কালে গেলে ফেলে দেবার চল ছিল ; এখন ডাক্তাররা বলেন যে তা সংগ্রহ করে অন্যান্য শিশুদের দিতে কিংবা তা স্বামী নিজেই স্তন থেকে পান করতে পারেন ।

তোতলা তুগলক : হ্যাঁ, এএএকটা দিদিদিল্লিতে, আআআরেকটা দৌদৌদৌলতাবাদে ।

ভাইপো আকবর : বহুত খুব বহুত খুব । আরে, একটা কমবয়সী মেয়ে হনহন করে এদিকেই আসছে ! অথচ শ্যায়খুবাবা এলো না ।

কৃপা খাতুন : আপনারা তখন থেকে মেয়েদের বুক নিয়ে ফালতু গ্যাঁজাচ্ছেন । আজকের একটা ঘটনা আপনাদের শুনিয়ে যাই । আজকে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে, অটোতে পেছনের সিটে বসে বাড়ি ফিরছি। পেছনের সিটে অলরেডি তিনজন বসেছিল, তাই একটি স্কুল পড়ুয়া মেয়ে সামনের সিটে বসলো….

অটোচালক একজন মধ্যবয়স্ক লোক, অটো চলতে শুরু করলো, আমরা যে যার নিজের ফোন ঘাঁটছি…

হঠাৎ অটো কিছুটা চলার পরে সামনের সিটে বসে থাকা মেয়েটা চিৎকার করে উঠলো, অটো থামাতে বললো….

আমরা সবাই অবাক হয়ে গেলাম, হঠাৎ কি হলো কিছুই বুঝলাম না….

মেয়েটা রাগে গজগজ করছে, সমানে চিল্লাচ্ছে…

অটোচালক অটো থামালো, মেয়েটা অটো থেকে নেমে অটোচালকের কলার ধরে টেনে হিড়হিড় করে অটো থেকে নামানোর চেষ্টা শুরু করলো….

অটোচালক কিছুতেই নামবে না, আমরা সবাই অটো থেকে নামলাম….

আমি জিগ্যেস করলাম মেয়েটাকে কী হয়েছে বলো….

মেয়েটা রীতিমতো চিল্লাতে চিল্লাতে বলছে,

“যখন থেকে অটোতে উঠেছি, তখন থেকে লোকটা অসভ্যতামি করার চেষ্টা করছে। আমি প্রথমে ভাবলাম এত বয়স্ক মানুষ, হয়তো ভুল করে হাত লেগে গেছে বুকে….

কিন্তু এই লোকটা ইচ্ছে করেই বারবার কনুই ঠেকাচ্ছে বুকে, আমার বাবার বয়সী একটা লোক কি অসভ্য, ছিঃ!

একটু আগে এত জোরে কনুই দিয়ে বুকে আঘাত করলো, যে আমি আর সহ্য করতে পারলাম না তাই চিল্লিয়ে উঠলাম”….

মেয়েটা এই কথাগুলো বলতে বলতে আশেপাশের প্রচুর লোকজন জোগাড় করে ফেলেছে….

সবাই হাঁ করে মেয়েটার কথা শুনছে, মেয়েটার বুকগুলো দেখছে, অথচ কেউ এগিয়ে এসে লোকটাকে দুটো থাপ্পড় মারছে না, পুলিশ ডাকছে না….

আমি মেয়েটাকে শান্ত করলাম, ওর চোখে মুখে জল দিয়ে দিলাম….

আমি পুলিশকে ফোন করতে যাবো, ইতিমধ্যেই দেখলাম দুটো ছেলে এসে অটোচালককে রাস্তায় ফেলে মারছে…

দুটো ছেলে বিশাল দামি কোনো শার্ট প্যান্ট পরেনি, দেখলেই বোঝা যায় অল্প শিক্ষিত ছেলে। ওঁরা পাশের গ্যারেজে কাজ করছিলো, জামায় কালিঝুলি মাখানো, চুল উস্কোখুস্ক, চুলের সামনের দিকে আবার লাল রঙ করা, চোখ মুখ শুকনো ভীষণ….

মেয়েটার গলার চিৎকার শুনে ওঁরা ছুটে এসে লোকটাকে মারতে শুরু করেছে ততক্ষণে, আর যাঁরা তথাকথিত ভদ্র সভ্য শিক্ষিত (বাহ্যিক দিক থেকে) তারা হাত পা গুটিয়ে চুপচাপ তামাশা দেখছে….

যাইহোক অটোচালক প্রথমে নিজের ভুল স্বীকার করছিলো না, তারপর ছেলে দুটোর মার খেয়ে স্বীকার করেছে নিজের নোংরামির কথা। মেয়েটার পায়ে হাত দিয়ে ক্ষমা চেয়েছে….

পড়াশুনোয় অল্প শিক্ষিত গ্যারেজে কাজ করা ছেলেদুটো মেয়েটার কাছে এসে বললো,

“দিদি তুমি একদম কাঁদবা না, এই নোংরা লোকেদের জন্য আমাদেরকে সবাই খারাপ ভাবে দিদি। এই নোংরা লোকদের জন্য চোখের জল ফেলবা না”…..

ইতিমধ্যেই ট্রাফিক পুলিশ এসে অটোচালককে নিয়ে যায় ওখান থেকে….

মেয়েটাকে আমি বললাম, ওই নোংরা লোকটাকে এত সহজে ছেড়ে দিও না। উপযুক্ত শাস্তি দিও, পুলিশে অভিযোগ জানিও, আজকে তুমি ছেড়ে দিলে কালকে অন্য একটা মেয়ের সাথে ওই লোকটা আবার নোংরামি করবে, ওর কিন্তু জেল খাটা দরকার….

গ্যারেজে কাজ করা ছেলে দুটো অন্য একটা অটো ডেকে এনে মেয়েটাকে তুলে দিলো অটোতে, নিজেই পকেট থেকে ভাড়া বার করে দিয়ে দিলো….

মেয়েটা তারপর অন্য অটোতে চেপে বাড়ি ফিরেছে সুরক্ষিত ভাবে, মেয়েটার ফোন নম্বর নিয়েছিলাম, ফোন করে জানলাম। কালকে হয়তো অটোচালকের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাবে….

মেয়েটার বয়স বেশি নয়, ষোলো সতেরো হবে, তবুও যে ও এই প্রতিবাদটা করলো এত ছোট বয়সে, মেয়েটাকে কুর্নিশ…

মেয়েটা কিন্তু প্রতিবাদ না করে পিছিয়ে আসতে পারতো, চুপচাপ সহ্য করতে পারতো, বেশিরভাগ মেয়েরা তাই করে, কিন্তু মেয়েটা প্রতিবাদ করেছে, এটাই আমার কাছে অনেক….

আর ওই ছেলে দুটোকে প্রণাম জানাই….

ওই ছেলে দুটোকে বাহ্যিক দিক থেকে দেখলে মনে হবে পাড়ার মোড়ে বসে থাকা রকবাজ ছেলে। কিন্তু ওঁরাই আসল হীরে, সবসময় শিক্ষা পোশাকে থাকে না, শিক্ষা থাকে নিজের বিবেক বোধে….

আমি আজ খুব খুশি, চারিদিকে এত কাঁচের মধ্যে আজ দুটো হীরের টুকরো ছেলের সাথে আলাপ হলো।

ওই দুটো ছেলের কাছে আজীবন ঋণী থাকলাম, যাঁরা পড়াশুনোয় হয়তো বেশি শিক্ষিত নয়, কিন্তু মানবিক দিক থেকে আমাদের চেয়েও অনেক বেশি শিক্ষিত….

এরকম ছেলে ঘরে ঘরে জন্মাক…. 

মালিক অম্বর : চাইলেই জন্মায় না খাতুন, আব্বা-অম্মির ভালোবাসা দরকার !

আসমাঅধরা খাতুন : আমার নাম ধরাছোঁয়ার বাইরের নীলাকাশ, তাই কয়েকটা কথা বলে যাই ।কবি জানোতো, ঈশ্বর বন্দনা শেষে কানের পাশ ঘেঁষে যে ডেকে ওঠে সে শকুন, কোকিল নয়। চাঁদ পূজন শেষে সেই শকুনের মতই তারস্বরে ডেকে ওঠে অন্ধকার। ওঙ্কার, ভাষা আর উপভাষায় যাকেই ডাকবে পুঁথির মতো দুলে দুলে সুর তুলে, সে দেবতা ইন্দ্রিয়ের অতীত কোন সিন্ধু অথবা বিষাদের সাগরে ভাসিয়ে দিতেই অভ্যস্ত। এই সমস্ত চণ্ডাল রাহু কেতু পরিভ্রমণ শেষে সমস্ত উপাসনা সমাপ্ত হতেই দেখবে পুড়ে যাচ্ছো স্বশরীরে। অথচ, পৃথিবীর ছাপাখানায় যে কবিতার পাণ্ডুলিপি পাঠাও তাই, চৈতন্যের দোসর তোমার। এখানে ঈষদুষ্ণ লবঙ্গ জলে কিঞ্চিত নুন মিশিয়ে সেবন করে নিলেই অহেতুক ব্যথা কম হতে পারে, সে নশ্বরতার অভিশাপ নয়। কবি, তোমার কোমল ত্বক কি সইতে পারে আঘাত, যে আঘাতে মলম পট্টি করে দিলেই সেরে যায়! তবু, শ্রীকৃষ্ণ বাঁশী বাজালেই তুমি উতলা হয়ে ওঠো, ঘুঙুর বাঁধতেই ছুটে যাও বনপথে, ময়ূরের মত নাচতে নাচতে দেখো সেখানে পড়ে থাকে কেবল ঝরা পাতা- যে পাতা তোমারই পদতলে মুড়মুড় করে ভেঙ্গে যায়, সে পাতায় একটি ছোট কবিতা লিখে দেখাও তো কবি! কবিতা কি ভেসে যাচ্ছে না জলে? অশান্ত হচ্ছে না তোমার মনপুরার শান্ত অলকানন্দা? এসো বন্ধ করে দাও সমূহ অন্ধকার স্তুতিরূপ। কেবল নিজের কিয়দংশ ভরে রাখো নেফারতিতিয় রূপবন্দনা, তোমাদের অহমের অর্ধাংশও যদি নার্সিসিজম শিখে যায়, ভরে উঠবে খালি কবিতার খাতা, শূন্য গানের ঘর, পূর্ণ হবে অর্ধসমাপ্ত সমূহ গীতিকবিতা অথবা পাণ্ডুলিপি…

ঢ্যাঙা তুগলক : আহা, আহা, খাতুন, আহা !

ল্যাঙড়া তৈমুর : ওই দ্যাখ, বাবরের মতন দেখতে একজন বুড়ো এদিকেই আসছে, সিঁড়ি দিয়ে উঠে সোজা এদিকেই আসছে । কেউ চিনিস ওনাকে । মোগল বাদশা বলেই তো মনে হচ্ছে দেখে । বাবরের দাদু নাকি ?

দাদুন্দ্রনাথ  : না, আমি বাবরের দাদু নই । ওই বুড়ো যে একটু আগে ছবি থেকে নেমে এসে তোমাদের জ্ঞান দিয়ে গেল, আমি তার দাদু । আমি ব্রিটেনের কবরে শুয়ে থাকি, যদিও আমি কাফের, ইনফিডেল । আমার ছেলের বন্ধুবান্ধব আর নাতিরা মিলে তোমাদের আর খ্রিস্টানদের দেখাদেখি নতুন ধর্ম আরম্ভ করেছিল, যদিও এখন সবই ফক্কা হয়ে গেছে, ছেলেরা বউ পায় না, মেয়েরা বর পায় না, এমন অবস্হা । বাধ্য হয়ে কেউ তোমাদের বিয়ে করে, কেউ কাফের বিয়ে করে, কেউ খ্রিস্টান মেম বিয়ে করে ।

ভাইপো আকবর : আপনি বসুন, হাঁপাচ্ছেন দেখছি, জল খান, কফি আনিয়ে দিচ্ছি । শ্যায়খুবাবা এলো না কেন ?

দাদুন্দ্রনাথ : আমাকে সবাই প্রিন্স বলে ডাকে । আমার তো হৃৎপিণ্ড নেই যে হাঁপাবো । যখন বিলেতে মারা গেলুম ওরা কেউ খোঁজখবর নেয়নি । আমাকে ওখানকার লোকেরা গোর দিয়ে দিলে । আমার ছেলে আর নাতিরা চিন্তায় পড়েছিল যে দাহ না করে গোর দেয়া উচিত হয়নি । ওরা লোক পাঠিয়ে গোর থেকে আমার হৃৎপিণ্ডটুকু কেটে এনে দাহ করেছিল । ওরা আমাকে পছন্দ করতো না। আমার বউও আমাকে পছন্দ করতো না, বিলেতের মেমদের সঙ্গে মেশামিশি করি বলে একঘরে করে দিয়েছিল। এখন আমার গোরটাকে সেখানের বাঙালিরা নতুন করে তৈরি করেছে, তাতে আমার মারা যাবার তারিখ আছে কিন্তু জন্মাবার সন-তারিখ লেখা নেই ।

বাবর : কেন ? 

দাদুন্দ্রনাথ : আমি ধীরুভাই  হতে চেয়েছিলুম । সুবে বাংলাকে ধীরুভাইয়ের মতন বড়োলোকের দেশ করতে চেয়েছিলুম। কিন্তু ওদের পছন্দ হলো না । ওরা সারাদিন চোখ বুজে ধ্যান আর গান গাওয়া, শায়রি লেখাকে বড়ো কাজ মনে করতো ।

গুলবদনপিসি  : ওই তো পরীবিবি আর বেগম সমরু আসছেন ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : ধীরুভাই লোকটা কে ?

দাদুন্দ্রনাথ : চেনেন না ? ধীরুভাই তো দাউদের জাহাজে খেপে-খেপে মেশিন  এনে  পেটরলের পুরো কারখানা বসিয়ে ফেললো। আমি নিজের জাহাজ, রেল লাইন, প্রিন্সলি এসটেট, বীমা ব্যবসা, নীল ব্যবসা, আবাসন ব্যবসা আরম্ভ করেছিলুম । আমারই করা সম্পত্তি ওরা ভোগ করে আমাকেই পরিবার থেকে আলাদা করে দিলে । ধীরুভাইয়ের বড়ো ছেলে এখন এই দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী মানুষ । আমার নাতিপুতিরাও হতে পারতো । যাকগে, নাতির লেখা গান নিয়েই এখন সুবে বাংলার ব্যবসা চলছে । তবে কে একজন বন্দ্যোঘটি শুনেছি আমাদের বাড়ির কেচ্ছা বিক্রি করে ব্যবসা করছে । যদি আমি ধীরুভাই হতুম তাহলে এই সব ফালতু ব্যবসা করতে হতো না । হাওয়ায় ফিসফিস উড়ছিল যে কফিহাউসে তোমাদের আড্ডা হবে, তাই এসে বলে গেলুম নিজের দুঃখের কথা । আমার সময়ে তো কফিহাউস বা অকারণ আড্ডার ব্যাপার ছিল না, তাই খুঁজে বের করতে দেরি হয়ে গেল । সেই সকাল থেকে খুঁজছিলুম।  এবার উঠি । আমার কবরে , কে আবার মরে গিয়ে তার ভেতর এসে শুয়ে পড়বে । আজকাল গোরের জায়গা সহজে পাওয়া যায় না। ভাগ্যিস তোমরা গোরের ওপরে মহল খাড়া করে গেছ, নইলে দেখতে বেদখল হয়ে গেছে । ওকে, গুড নাইট ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : তোমাকে নিয়ে টানাটানির আবার কী হলো ? তুমি তো পুরোনো ঢাকায় শায়েস্তা খানের তৈরি দুর্গের কবরে শুয়ে থাকো বলে জানি, গুয়াহাটিতে তো নয় । বেগম সমরু, কেমন আছিস ? 

পরীবিবি : আসলে আমি তো অহোম রাজকুমারী । অহম রাজা জয়ধাজ সিংহের একমাত্র মেয়ে আর অসমিয়া যোদ্ধা লাচিত বোর্ফুকনের ভাগ্নী  রমনী গভারু ।  যখন আমার বয়স ছয় বছর তখন মীর জুমলার বাহিনীর কাছে মুক্তিপণ হিসাবে দিয়ে  দেওয়া হয়েছিল। আমার সঙ্গে ছিল টিপম রাজার নাবালিকা মেয়ে । তাকেও মোগলদের হাতে দেয়া হয়েছিল মুক্তির মূল অংশ হিসেবে।  মীর জুমলা অসুস্থ হয়ে পড়ে আর ঢাকায় যাওয়ার পথে মারা গিয়েছিল, আপনারা তো জানেন । ওনার সমাধি  মেঘালয়ের গারো পাহাড়ে । আমাকে সেসময়ে  বাংলার রাজধানী ঢাকায় নিয়ে গিয়ে শায়েস্তা খানের তত্ত্বাবধানে রাখা হয়েছিল । আওরঙ্গজেবের আদেশে আমাকে ইসলামে ধর্মে আস্তিকান্তরিত করে  রহমত বানু নাম দেওয়া হয়েছিল ।  আওরঙ্গজেবের ছেলে আমাকে বিয়ে করে   ১,৮০,০০০ টাকা যৌতুক নিয়েছিল । যদিও বাংলাদেশে আমি আমার জীবনের অন্য গল্পের ভেতরে বেঁচে আছি, সেই একই কবরে । ওরা মনে করে আমি শায়েস্তা খানের মেয়ে, যে আওরঙ্গজেবের ছেলে মুহম্মদ আজম শাহকে বিয়ে করেছিল । আমি মারা গেলে বেচারা বর, লালবাগ দুর্গটা পুরো করার আইডিয়া ছেড়ে দিয়ে আমাকে  প্রাসাদেই সমাধিস্থ করেছিল। আমি নাকি খুবই সুন্দরী, তাই আমার বর আমাকে পরীবিবি বলে ডাকতো । এখানকার রিকশঅলারা দুর্গটার নাম দিয়েছে পরীবিবির কবর । তারা প্যাসেঞ্জার এনে তাদের বলে, পরীবিবির  একজন প্রেতিনী,  রাতে লালবাগ কেল্লায় ঘোরাঘুরি করে ? ভেতরে উঁকি মেরে দ্যাখো , পরীবিবি মিটকি মেরে পড়ে আছে।  আমার ভাগ্য ভালো । কয়জনই বা একসঙ্গে দুটো দুরকম গল্পে বেঁচে থাকে, বলো ! চলি, খোদা হাফিজ । আমার কবর এমন ভাঙাচোরা যে সন্ধের আগে ভেতরে ঢুকে না পড়লে সাপখোপ আশ্রয় নেবে । বেগম সমরু, চললুম । আবার দেখা হবে । এসো একদিন পুরোনো ঢাকায় ।

জোয়ানা নোবিলিস সম্ব্রে : হ্যাঁ, যাবো রে পরীবিবি । ভালোই আছি ল্যাঙড়াদা । সেনর ভাস্কো ভালো আছেন তো ? কতোকাল দেখাসাক্ষাৎ কথাবার্তা হয়নি আপনাদের সঙ্গে ।

ভাস্কো দা গামা : ভালো লাগলো তোকে দেখে জোয়ানা নোবিলিস সম্ব্রে   । তুইই তো এদেশে একমাত্র ক্যাথলিক শাসক ছিলিস, সম্পত্তিও করেছিলিস অঢেল ।

জোয়ানা নোবিলিস সম্ব্রে : আপনারা, ক্যাথলিকরাই শুধু আমাকে সন্মান করেন । কিন্তু হিদেন আর ইনফিডেলরা আমাকে নাচনেওয়ালি-নাচনেওয়ালি বলে-বলে বদনাম করে । বেগম সমরু বললেই, তার সঙ্গে নাচনেওয়ালি জুড়ে দ্যায় ।

বাবর : তুই তো ছিলিসই নাচনেওয়ালি ।

জোয়ানা নোবিলিস সম্ব্রে : আপনার নাতি জালালুদ্দিন আর জালালুদ্দিনের ছেলে সেলিম তো একই নাচনেওয়ালি আনারকলিকে পেতে চাইতো ; সেলিম আনারকলিকে পেয়ে গেল বলে জালালুদ্দিন মেয়েটাকে জ্যান্ত কবর দিয়ে দিলে ।

ভাইপো আকবর : এই বেগম সমরু, মুখ সামলে কথা বলবি । তোর প্রাসাদে যে দুজন লোক আগুন লাগিয়েছিল, তুইও তাদের জ্যান্ত মাটিতে পুঁতে দিয়েছিলি । আমি তো একটা চারদেয়ালে বন্ধ করে দিয়েছিলুম । শ্যায়খুবাবা এলো না ?

চেঙ্গিজ খান : আরে ঝগড়া করছিস কেন । একটু বসুক, কফি-টফি খেয়ে চাঙ্গা হয়ে নিক, তারপর না হয় যে যার নিজের কথা বলিস ।

জোয়ানা নোবিলিস সম্ব্রে : আমাকে ল্যাঙড়া তৈমুর ডেকেছিল বলে এয়েছি । নইলে আসতুম নাকি অতোদূর থেকে এই নাস্তিকদের কফিহাউসে ! কতোকাল পরে তোমাদের সঙ্গে দেখা । সবাই বেশ ভালোই আছো দেখছি । কিন্তু তোমাদের কুতকুতে চোখ তো আল-হিন্দে হাজার বছরে হারিয়ে গিয়ে আবার যেমনকার তেমন হয়ে গেছে । সেনর ভাস্কোর লোকেরা, বব ক্লাইভের লোকেরা কতো মেয়ের সঙ্গে শুলো, তবুও জাতটা ফর্সা হলো কই । এই যদি আলেকজাণ্ডারের সৈন্যরা ধর্ষণ করতে-করতে আসতো তাহলে দেখতে, তুর্কি থেকে আল-হিন্দ পর্যন্ত মানুষেরা গ্রিক দেবী-দেবতার মতন দেখতে হয়ে যেতো ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : আলেকজাণ্ডারের সাইড নিচ্ছিস যে বড়ো । সারাজীবন  সাইড-বদল আর বর পালটিয়ে তো রাজত্ব করলি । তোকে কে বলল আলেকজাণ্ডারের সৈন্যরা ধর্ষণ করতে-করতে এগোয়নি । যে-সমস্ত দেশ হয়ে আলেকজাণ্ডার আল-হিন্দ পর্যন্ত পৌঁছেছিল, সেখানকার মানুষরা কতো ফর্সা আর তাদের নাক-নকশা কেমন গ্রিক দেবী-দেবতার মতন তা দেখেছিস । বেশিরভাগ মেয়েই তো রূপসী । তুই অমন বোঁচা নাক আর গালফোলা চেহারা পেয়েছিস বলে আমাদের দুষছিস কেন !

জোয়ানা নোবিলিস সম্ব্রে : আলেকজাণ্ডার কোনো দেশে গিয়ে নিজের ধর্ম চাপিয়ে দেয়নি । কুড়ি বছর বয়সে বেরিয়ে হ্যাণ্ডসাম ছেলেটা কতো দেশ জয় করে ফিরে গেল । 

বাবর : ওদের সময়ে এখনকার মতন ধর্ম ছিল না, তাই চাপাবার মতন কিছুই ছিল না । তুইও তো নিজের ধর্ম পালটালি রাজনৈতিক প্যাঁচ কষবি বলে । তুই ছিলি নাচনেওয়ালি ফরজানা জেব উন নিসা, কাশ্মিরি রক্ষিতার মেয়ে, রাস্তায় রাস্তায় নাচতিস দুজনে । তা থেকে হয়ে গেলি  পেশাদার প্রশিক্ষিত ভাড়াটে সেনাবাহিনীর প্রধান, তোর জার্মান লিভটুগেদার বুড়ো বয়ফ্রেণ্ড ওয়াল্টার রেইনহার্ট সোম্ব্রের কাছে  শিখে। বাংলার নবাব তোর বুড়ো বরকে হুকুম দিলে কিছু ইংরেজকে খেতে ডেকে তাদের খতম করে দিতে । সেকাজ করে তোর বুড়ো বর নাম ভাঁড়িয়ে পালালো লখনউ, অবধের নবাবের চাকরিতে । তোর বুড়ো বরের আগেই একটা আল-হিন্দের বউ আর ছেলে ছিল । তোর বুড়ো বর যোগ দিলো মোগল শাহ আলমের সঙ্গে আর পেয়ে গেল মিরাটের কাছে সরধনার জাগির । সে যখন পটল তুললো তার পুরো সম্পত্তি, ভাড়াটে সেনার দল পেয়ে গেলি আর পাকড়াও করলি কম বয়সী এক ফরাসি ছোকরাকে । ধর্ম পালটালি কেননা ব্রিটিশ অফিসারদের সঙ্গে সেক্স করতে তোর অসুবিধে হচ্ছিল । তুই আঁচ করেছিলিস যে ব্রিটিশরা এবার সিংহাসনে বসতে চলেছে । ব্রিটিশ চিত্রকরদের দিয়ে নিজের ছবি আঁকালি, পাগড়ি পরে, হাতে গড়গড়া নিয়ে, বেগম সমরু ।

জোয়ানা নোবিলিস সম্ব্রে : নাচনেওয়ালি বলো বা বেগম সমরু বলো বা রক্ষিতার মেয়ে বলো। নেমন্তন্ন করে ডেকে পাঠিয়ে যতো ইচ্ছে অপমান করে নাও । মনে রেখো, আমি যে চার্চ তৈরি করিয়েছি, তা আজও বহাল আছে । ক্রিস্টানরা রোববার দিন জমায়েত হয়  । যেদিন মরেছিলুম, ইংরেজরা মিলিটারি স্যালিউট দিয়েছিল । তোমাদের তো ঝাড়েবংশে নিকেশ করে দিয়েছে, শেষ বংশধরকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে । চললুম । আমার কবর এদেশেই। এখনও খ্রিস্টানরা ফুলের তোড়া রেখে যায় ।

ভাইপো আকবর : যা, যা । নিজের জাগিরের কবরে গিয়ে শুয়ে থাক । শ্যায়খুবাবা এলো না এখনও?

চেঙ্গিজ খান : মিছিমিছি চটিয়ে তাড়িয়ে দিলি মেয়েটাকে । একটু গল্পগুজব করা যেতো । 

ভাস্কো দা গামা : আপনাদের দেখছি মরবার পরও মোগলাই তেজ যায়নি । 

গুলবদনপিসি : সেনর ভাস্কো, আপনি দাবি করেন যে আল-হিন্দ আবিষ্কার করেছিলেন, পর্তুগিজরা গোয়া দখল করেছিল, কিন্তু আপনি হের্নান কোর্তেস, ভেলী দে ওয়াক্সাকার প্রথম মার্কেস-এর মতন গ্রেট এক্সপ্লোরার দখলদার হতে পারেননি । হের্নান কোর্তেস ছিলেন একজন স্পেনীয় দখলদার, যিনি ষোড়শ শতাব্দীতে একটি অভিযানের নেতৃত্ব দেন যার ফলে উত্তর আমেরিকা মহাদেশের দক্ষিণে অবস্থিত এজটেক সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং বর্তমান মেক্সিকোর বিশাল অঞ্চলগুলো স্পেনের ক্যাস্টিল রাজ্যের অধীনে আসে। ওনার খুড়তুতো ভাই  ফ্রান্সিসকো পিসার্‌রো, যিনি পরবর্তীকালে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের পশ্চিমে অবস্থিত ইনকা সাম্রাজ্য দখল করেছিলেন। কোর্তেস উত্তর আমেরিকা মহাদেশের দক্ষিণে অবস্থিত আজটেক সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে স্থানীয় অন্যান্য দেশজ জাতির সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে বাজি মাৎ করেছিলেন। কোর্তেস  দেশজ আমেরিকানদের সঙ্গে তাদের স্থানীয় ভাষা, কেচুয়া ভাষায় যোগাযোগ করার জন্য সেখানকার ডোনা মারিনা  নামের একজন মহিলার সঙ্গে লিভটুগেদার করতেন আর সাহায্য নিতেন। ডোনা মারিনা পরবর্তীকালে কোর্তেসের এক ছেলের মা হন । আপনারা তো এদেশের রাজা-বাদশাদের ভয়ে কিছুই করতে পারেননি । এমনকি পর্তুগিজদের বলেছিলেন গোয়ার মেয়েদের সঙ্গে যেন লিভটুগেদার না করে । ঠিক কি না, বলুন ?

ল্যাঙড়া তৈমুর : মোগলাই নয় সেনর ; বলুন তৈমুরি । আরেক রাউন্ড কফির অর্ডার দিই, কী বলিস গুলবদন ?

গুলবদনপিসি  : আমি তো হজ করে ফিরে টায়ার্ড হয়ে গেছি । এই ভাস্কোর লোকেরা সুরাটে আমাদের দলটাকে একবছর আটকে সময় নষ্ট করালো ; ওরা যাওয়া-আসার সামুদ্রিক ভিসা দিতে অনেক সময় নিয়েছিল । ওরা জাহাজ ভরে-ভরে কাকের মতন পোশাকে আর কালো টুপি-পরা  পাদ্রিদের এনেছে । সঙ্গে এনেছে শুয়োরের টাটকা মাংস, আগুনের ধোঁয়ায় সেঁকা মাংস, সসেজ নামের লম্বাটে কিমা, শুকনো মাছ, নানারকম মদ, অলিভ তেল, শুকনো মাখন, পাকা ডুমুর, নানারকমের ফল । জ্যান্ত মুর্গি, ভেড়া, টার্কি, হাঁস, খরগোশ, জ্যাম, জেলিও এনেছে এদেশে খাবে বলে । ওদের জাহাজে বড়ো-বড়ো কামান । আসলে মোগলদেরও নৌবহর থাকা উচিত ছিল । বাবরের সময় থেকে তোমরা শুধু পাহাড় মরুভূমি সমতলভূমি দখলের ধান্দায় সমুদ্রের কথা ভুলে গেলে । আওরঙজেব বিষয়টা নিয়ে ভাবতে পারতো, ও তো সমুদ্রের ধারেকাছেই কতোদিন রইলো ।

চেঙ্গিজ খান : আরে আওরঙজেবের কথা ছাড় । মারাঠাদের পোঁদে লেগে জীবন নষ্ট করল, মোগল সাম্রাজ্যেরও বারোটা বাজিয়ে দিলে । তোর হজের গল্প কর বরং । বাহান্ন বছর বয়সে গেলি, ছয়-সাত বছর ধরে কতো ঘোরাঘুরি করলি, চাড্ডিখানি কথা নয় ।

গুলবদনপিসি  : আমার আগে বেগা বেগম হজ করেছিলেন, ওনার কাছে খুঁটিনাটি জেনে নিয়েছিলুম । সুরাট বন্দরের কর্তা কুলিজ খান আন্দিজানি ছিল আমাদের সঙ্গে সব সময় । তাছাড়া সালিমা সুলতান বেগম, হিন্দলের বিধবা বউ সুলতানম, হাজি বেগম, গুলজার বেগম, উম কুলসুম, সলিমা খানুমকেও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলুম। চাকরানিরাও ছিল ।  মজার ব্যাপার হলো মৌলবাদী মৌলবীদের নির্দেশ অমান্য করে আকবর মোগল বেগমদেরও  হজ করতে পাঠিয়েছে । নানা দেশ থেকে লোক আসে । অনেক দেশের বউরা চোখে কাজল লাগিয়ে আসে — ওখানে তো মুখ খোলা রাখতে হয় । পুরোনো পোশাক ফেলে দিয়ে সাদা ধবধবে পোশাক পরতে হয় । হজ সেরে গরিবদের মধ্যে টাকাকড়ি, মোহর বিলিয়ে দিলুম । যদিও শিয়াদের কাছে পবিত্র, তবু উটের ওপরে চেপে আমরা কারবালা, কোম আর মাশাদে গিয়েছিলুম । ফেরার পথে এডেনে জাহাজের দুর্ঘটনা হলো, এক বছর সেখানে কাটাতে হলো । আমাদের সঙ্গে অবশ্য মীর হজ আর খোয়াজা ইয়াহা ছিল ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : তুই তো আশি বছর বয়সে মারা গেলি ।  বেচারা আকবর সম্রাট হলে কী হবে ! কেঁদে ভাসিয়ে দিয়েছিল আর  তোর জানাজা একাই  গোর পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল । পরের বছর হামিদা বানুও মারা গেল । আকবর দাড়ি কামিয়ে ন্যাড়া হয়ে গেল । 

বাহাদুর শাহ জাফর : তোমরা নিজেদের নিয়ে মশগুল রয়েছো । আমার বংশধররা আজ কে কোথায় আছে জানো? আমাকে  রেঙ্গুনে নির্বাসনের মধ্যে দিয়ে ব্রিটিশরা মুঘল সাম্রাজ্যর চারশো বছরের শাসনের ইতি ঘটিয়েছিল। আমার  কয়েকজন ছেলেকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ফলে পরিবারের অনেকজন জীবন বাঁচাতে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ, হায়দ্রাবাদ, উদয়পুরে পালিয়ে গিয়েছিল । পরবর্তীতে অনেকেই নিজেদেরকে মুঘল বংশধর বলে দাবি করে। তবে বর্তমানে কয়েকজন মুঘল বংশধরের খোঁজ পাওয়া যায়  যারা আল-হিন্দের বিভিন্ন জায়গায় করুণ অবস্থায় বেঁচে আছে। দিন এনে দিন খেয়ে জীবন পার করছে। সরকারের দেয়া সামান্য ভাতা দিয়ে সংসার চালাতে প্রতি মুহূর্তে হিমশিম খেতে হচ্ছে। যেমন সুলতানা বেগম, যিনি মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ নবাব বাহাদুর শাহ জাফরের নাতবৌ। সুলাতানার স্বামী মির্জা বেদের বুকত ১৯৮০ সালে মারা যান। এরপর থেকেই তার জীবনে দারিদ্র্য নেমে আসে। সুলতানা সরকারের কাছ থেকে প্রতি মাসে ভাতা হিসেবে পায় ছয় হাজার টাকা। যা দিয়ে ছয় ছেলেমেয়েসহ পুরো সংসার চালাতে হয় তাকে। বর্তমানে কলকাতার বস্তি এলাকায় বসবাস করেন তিনি। দুই রুমের একটি ছোট্ট বাসায় পুরো পরিবার নিয়ে থাকছেন তিনি। প্রতিবেশীদের সঙ্গে মিলিতভাবে রান্নাঘর ব্যবহার করেন। রাস্তার কল থেকে জল ভরতে হয়, সেখানে কাপড় ধুতে হয়। তারপর জিয়াউদ্দিন তুসি, যিনি বাহাদুর শাহ জাফরের উত্তরাধিকারী বর্তমানে ভাড়া বাড়িতে থাকেন । উনি আর সরকারি ভাতা পান না । তারপর বেগম লায়লা উমাহানি, যাঁর বাবা মির্জা পিয়েরে ছিলেন বাহাদুর শাহ জাফরের নাতি। তিনি এবং তার মা হাবিব বেগম হায়দ্রাবাদের ষষ্ঠ নিজাম মেহবুব আলী খান এর আত্মীয়।  স্বামী ইয়াকুব মঈনউদ্দিন তুসি। পঁচিশটা পরিবহন রিকশা ভাড়া থেকে তাদের সংসার চলে। তবে এটাই বাস্তবতা।

আলিবর্দী খান : আমার বংশধররা তো আর আল-হিন্দে থাকে না । লোকে তাদের খবর রাখে না । তারাও আমার বা সিরাজের সঙ্গে সম্পর্কের কথা গোপন রেখে জীবন কাটায় । ঢাকা শহরের একটি ছোট্ট ফ্ল্যাটে থাকেন নবাব সিরাজ উদ-দৌলার নবম বংশধরেরা। বর্তমানে তারা ঢাকা শহরের খিলক্ষেত এলাকার লেকসিটি কনকর্ড-এর বৈকালী টাওয়ারে বসবাস করছেন। লোকচক্ষুর আড়ালে, নীরবে নিভৃতে বাস করা বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের বংশধরদের খবর অনেকেই জানেন না।  শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ উদ-দৌলাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল।  সিরাজ উদ-দৌলার মৃত্যুর পর তার প্রিয়তমা স্ত্রী লুত্‍ফুননিসা একমাত্র শিশু কন্যা উম্মে জোহরা, নানা আলীবর্দী খানের স্ত্রী আশরাফুন্নেসা-সহ নবাব পরিবারের নারীদের ৮ বছর বন্দি করে রাখা হয়েছিল বুড়িগঙ্গা পাড়ের জিঞ্জিরা এলাকার একটি প্রাসাদে। স্থানীয় লোকজন ওই জরাজীর্ণ প্রাসাদটিকে এখনও জানে ‘নাগরা’ নামে। নবাব সিরাজ উদ-দৌলার মৃত্যুর পর থেকে তার ৫ম বংশধর পর্যন্ত কাউকে সরকারি কোনো চাকরি দেয়নি ব্রিটিশ সরকার । দেশভাগের সময়ে সপ্তম বংশধর সৈয়দ গোলাম মুর্তজা  মুর্শিদাবাদ থেকে পূর্ব বাংলায় চলে যান। প্রথমে যান রাজশাহীতে, রাজশাহী থেকে খুলনা শহরে একটি বাড়ি কিনে স্থায়ী হন। এখনও এক ধরনের অজানা আতঙ্ক তাদের মাঝে। সম্ভবত সে আতঙ্ক থেকেই প্রচারবিমুখ হয়ে আছেন তারা। মিডিয়াকে এড়িয়ে চলেন, সমাজে নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে রাখেন।

টিপু সুলতান : আমার বংশধরদেরও একই অবস্হা । আমার পরবর্তী সপ্তম প্রজন্মের উত্তরসূরী  সংসার চালাতে রিকশা চালায়। স্ত্রী সন্তানদের মুখে ভাত তুলে দিতে প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের উপরে রিক্সার প্যাডেলে চাপ দেয় বেচারা। ভাগ্যের পরিহাসে এই রাস্তা যাঁর নামে‚ সেই প্রিন্স গুলাম মহম্মদ আনোয়ার শাহ ছিলেন তার প্রপিতামহ। আনোয়ার আলি-র বাকি ভাইরাও কেউ রিক্সা চালায়। কেউ সেলাইয়ের কাজ করে। কেউ ছোট কারবার চালায়। সবাই থাকে ঘিঞ্জি বস্তির ঘুপচি কামরায়। এঁদো পরিবেশ বসে ভাবে একদিন যাবেন মহীশূর। যেখানে একদিন সূর্যের আলোয় ঝকঝকিয়ে উঠত টিপু সুলতানের তরবারি। অথচ কলকাতাতেই রাজার হালে থাকার কথা তাদের। কারণ এই শহরে বিস্তর সম্পত্তি ছিল টিপু সুলতানের। আজকের রয়াল ক্যালকাটা গল্ফ ক্লাব‚ টালিগঞ্জ ক্লাব, সব ছিল মহীশূরের সুলতান টিপুর। কিন্তু এখন তার দেখভালের দায়িত্ব প্রিন্স গুলাম মহম্মদ ট্রাস্টের। নামমাত্র ভাড়ায় লিজ নিয়ে রেখেছে গল্ফ ক্লাব আর টালিগঞ্জ ক্লাব। এছাড়াও আজকের পার্ক স্ট্রিট‚ চৌরঙ্গি‚ থিয়েটার রোড আর দক্ষিণ কলকাতার বিস্তীর্ণ চাষ জমির মালিক ছিলেন টিপু সুলতান। কিন্তু তাঁর বংশধররা বঞ্চিতই থেকে গেছে। কলকাতায় টিপু সুলতানের বংশধররা সবাই যে দিন আনা দিন খাওয়া অবস্থায় আছে তা নয়। কেউ কেউ মধ্যবিত্ত জীবনও যাপন করছে। কিন্তু কারওর জীবনেই ‘রয়্যাল‘ শব্দটার ছিটেফোঁটাও নেই। অথচ ভারতে এখনও রাজবংশের উত্তরসূরীরা আছেন‚ যাঁরা‚ রাজত্ব চলে গেলেও প্রাসাদে আছেন। রাজার হালেই নবাবি করছেন। তফাৎটা হল‚ যাঁরা ব্রিটিশদের সঙ্গে আপস করে মাথা নুইয়েছিলেন ‚তাঁরা টিকে গেছেন। কিন্তু যাঁরা ব্রিটিশ শাসনের প্রতিবাদ করেছিলেন তাঁদের গরিমা ধুলোয় মিশে গেছে।

কফিহাউসের যক্ষ : আচ্ছা স্যার, এতো জায়গা থাকতে আপনাদের কলকাতাতেই কেন এনে ফেলল ?

টিপু সুলতান : কলকাতা ওদের রাজধানী ছিল আর ওরা জানতো যে বাঙালিরা ওদের সঙ্গে আছে, বিদ্রোহে যোগ দিচ্ছে না । ওয়াজেদ আলি শাহকে যখন এনেছিল, তখনই বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেল । ওকে প্রথমে কয়েদ করে রেখেছিল । তারপর থাকার জন্যে এতো ভালো ব্যবস্হা করে দিলে যে ও এখানে ছোটোখাটো লখনউ বসিয়ে ফেললো । ওয়াজেদ আলির  প্রচারিত ও পৃষ্ঠপোষক লেখক এবং কবি ও মুশায়রা, গজল, মার্সিয়া, আর কাওয়ালি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ওনার   পরীখানায় বা  নৃত্যশিল্পীদের বাসায় নিয়মিত কথক নাচের অনুষ্ঠান হতো। মেটিয়াবুরুজের গানবাজনার আসর থেকে উপকৃত হয়েছেন স্থানীয় শিল্পীরা,  পাথুরিয়াঘাট ঠাকুর পরিবারের রাজা সৌরিন্দ্রমোহন ঠাকুর, আর পণ্ডিত যদুভট্টের মতো সেই যুগের গুণী শিল্পীরা ছিলেন। বাংলার জমিদারবাবুরা প্রথমবার এসব দেখে নিজেদের জলসাঘর  তৈরি করেছিল যেখানে নিয়মিত ঠুমরি বা কথকের অনুষ্ঠান হতো। ধনী বাঙালিরা শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ানোর পাশাপাশি  কেবল মেটিয়াবুরুজেই  নয়, সারা শহর জুড়ে কয়েকশো বাইজির কোঠা বসিয়ে ফেলেছিল। তারপর ওয়াজেদ আলির দেখাদেখি বাগানবাড়িতে রাখেল রাখার চল হল, হারেমের মতন, মদ খাওয়া, মোসাহেবদের জড়ো করে মদ আর আফিমের আড্ডা । 

কফিহাউসের যক্ষ : বাঙালিরা শুধু বাইজি নাচালো ? বিদ্রোহে অংশ নিলো না ?

বাহাদুরশাহ জাফর : বাংলাদেশের অধিকাংশ সমকালীন বুদ্ধিজীবীই সিপাহি বিদ্রোহকে সমর্থন করেননি, অংশ নেয়া তো দূরের কথা।  বাংলাসাহিত্যে এ নিয়ে কোনো আবেগ, গান, কবিতা, নাটক—কিছুই তৈরি হয়নি। এমনকি, যখন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় পলাশীর যুদ্ধ নিয়ে, সিরাজউদ্দৌল্লার পরাজয় নিয়ে কাব্য নাটক লিখছেন, তখনও হয়নি। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামেরও কোনো কবিতা বা গান নেই সিপাহি বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে। বিদ্রোহকে সেই সময়ের শিক্ষিত বাঙালি সমাজ সমর্থন করেনি; উপরন্তু তারা বিদ্রোহী সিপাহিদের ও বিদ্রোহের সঙ্গে যুক্ত নেতানেত্রীদের ব্যঙ্গবিদ্রুপ করেছিল। শিক্ষিত বাঙালি সমাজ এই বিদ্রোহে বিদ্রোহীদের পরাজয় ও ব্রিটিশদের জয় কামনা করেছিল।

কফিহাউসের যক্ষ : বাঙালিরা কেন সমর্থন করেনি জনাব ?

আলিবর্দী খান : শিক্ষিত বাঙালি সমাজ বিভিন্ন কারণে সিপাহি বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিল।  মধ্যযুগীশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার ভয়ে শিক্ষিত বাঙালি সমাজ মনে করেছিল বিদ্রোহীরা জয়লাভ করলে ভারতে আবার মধ্যযুগীয় মোগল শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। তারা মধ্যযুগীয় মোগল শাসনের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন।শিক্ষিত বাঙালি সমাজ ছিল আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কারের সমর্থক। তারা মনে করেছিল বিদ্রোহীরা জয়ী হলে তাদের সামন্ততান্ত্রিক শাসনে আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কারের অবসান ঘটবে। আধুনিকতার অবসানের ভয়েও তারা সমর্থন করেননি । বিদ্রোহের প্রতি বাঙালি সমাজ সেই সময়ের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তীব্র বিদ্বেষ প্রকাশ করে। বিদ্রোহ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাজা রাধাকান্ত দেবের সভাপতিত্বে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সভা হয়। সভায় বিদ্রোহীদের নিন্দা করা হয়। রাজা রাধাকান্ত দেবের সভাপতিত্বে বিদ্রোহ-বিরোধী আরও একটা সভা হয় মেট্রোপলিটন কলেজে । এই সভায় উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ হলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ, কমলকৃষ্ণ বাহাদুর, হরচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ। তারা সরকারকে সবরকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সভায় প্রস্তাব পাস করেন আর সরকারের কাছে তা পেশ করেন। সংবাদ ভাস্কর, সংবাদ প্রভাকর আর নানা পত্রপত্রিকায় শিক্ষিত বাঙালি সমাজবিদ্রোহীদের তীব্র বিরোধিতা করেছিল। সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার সম্পাদকের সিপাহি বিদ্রোহের নেতৃবৃন্দ নানাসাহেব, লক্ষ্মীবাঈ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা ছিল না। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় লিখেছিলেন যে, ‘হে বিঘ্ন হর….. ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের জয়পতাকা চিরকাল সমভাবে উড্ডীয়মান কর। অত্যাচারি অপকারি বিদ্রোহকারি দুর্জনদিগকে সমুচিত প্রতিফল প্রদান কর। ” এছাড়াও বিভিন্ন গ্রন্থ সমূহেও বাঙালি মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় নানাভাবে বিরোধিতা করেছিল।

গুলবদনপিসি : শুধু বাঙালিদের দোষ দেয়া কেন, অযথা ? যে সব সামন্তদের স্বার্থে ঘা পড়েনি, যেমন সিন্ধিয়া, গায়কোয়াড়, হোলকার প্রমুখ মারাঠি সর্দাররা, হায়াদ্রাবাদের নিজাম, মহীশূর আর ত্রিবাঙ্কুরের রাজারা, রাজপুতরা, মায় ঝিন্দ আর পাতিয়ালার শিখ সর্দাররা,  তাঁরা বিদ্রোহে সাড়া তো দেনইনি বরং এটা দমন করতে ব্রিটিশদের সাহায্য করেছিলেন পুরো দমে। 

কফিহাউসের যক্ষ : কিন্তু বেগম, মহাবিদ্রোহ শুরু হয়েছিল সুবে বাংলার ব্যারাকপুর থেকে ।

বাহাদুর শাহ জাফর : বিদ্রোহ তো শুরু হয়েছিল ব্যারাকপুর থেকেই। দক্ষিণে মহারাষ্ট্রে সাতারা, কোলাপুর, নারগুন্ড, মাদ্রাজের বিক্ষিপ্ত কিছু অঞ্চলে এর স্ফুলিংগ দেখা দিয়েছিল। শুধু অগ্নিশিখা হয়নি বলেই তাকে খারিজ করা হবে ?  তখন সেই সুদূর নিউ ইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউনে কার্ল মার্কস স্বয়ং একে ভারতবাসীর জাতীয় সংগ্রাম বলতে পারলেন, আর আমাদের নিজেদের দেশের ঐতিহাসিকদের এই গৌরবময় ঐতিহ্য মানতে এতো কুন্ঠা কিসের ? 

গুলবদনপিসি : বেয়ারা দুটো বর্শা নিয়ে আসছে, তাতে এক-একজনের মাথা গেঁথা, মুখে লাল রঙ মাখানো । এটা আবার কী রে বাবা !

কফিহাউসের যক্ষ : ম্যাডাম বেগম, এনারা এইভাবেই কফিহাউসে ঢুকছিলেন । আমি ভাবলুম হেল্প করি । 

ভাইপো আকবর : মাথা দুটো খুলে টেবিলের ওপর রাখো আর বর্শাগুলো চেয়ারে ঠেশান দিয়ে রাখো, ওনারা যখন যেতে চাইবেন, তখন বর্শার মাথায় পরিয়ে দেবো । আপনাদের নামটা জানতে পারি ? শ্যায়খুবাবা এলো না এখনও ।

প্রথম মাথা : আমিও একজন গুরকানি । কন্নড় ভাষায় জামাই বা গুরকানিকে বলে আলিয়া । আমি আলিয়া রাম রায়া নামে পরিচিত । বিজয়নগর সাম্রাজ্য আমার ভুলে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল । 

চেঙ্গিজ খান : আপনার ভুলে ? কী হয়েছিল ? গুরকানিরা তো সহজে ভুল করে না ।

দ্বিতীয় মাথা : মাথা তো আমারও কেটেছিল ; নিজের বিশ্বস্ত লোকে । আপনার মাথা যারা কেটেছিল তারা আপনাকে বোকা বানিয়ে কেটেছিল আলিয়া রাম রায়া । আমার শত্রুরা নামে কুকথা রটিয়েছিল । ইংরেজগুলো আমার প্যাঁদানি খেয়ে অন্ধকূপ হত্যা নামে একটা গাঁজাখুরি গল্প চাউর করেছিল । যা নাকি  সেনা হত্যাকাণ্ড, যা ব্রিটিশ আমলে সংঘটিত হয়েছিল । গল্পটা হল এই যে  ব্রিটিশ সরকারের গড়া ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের ভেতরে জানালাবিহীন ছোট্ট একটি কামরায় একশো ছেচল্লিশজন ইংরেজকে বন্দী করে রেখেছিলুম । সেখানে দমবন্ধ হয়ে এক রাতের মধ্যে একশো তেইশ জনের মৃত্যু ঘটে । এই গপ্পোটা গেঁজিয়েছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারী, পরবর্তীতে সেনাপতি, জন যেফানিয়াহ হলওয়েল, ওর বই ইন্ডিয়া ফ্যাক্টস্‌এ। মরে যাওয়া সাহেবদের স্মরণে দুর্গের পুবদিকের সামনে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেছিল, যা লর্ড হেস্টিংস ঘটনাটা গাঁজাখুরি জেনে ভেঙ্গে ফেলে। আমাকে  হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্য নিয়েই  এই কাহিনী লেখা ও প্রচারিত হয়েছিল । সেই সময়ের ইতিহাসে এই ঘটনার  কোনও উল্লেখ দেখা যায় নি। পরবর্তীতে ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের অনেকেই আমাকে নির্দয়, উদ্ধত, স্বেচ্ছাচারী প্রতিপন্ন করতে যাচাই না-করেই হলওয়েল সাহেবের গাঁজাখুরি গল্পটা বলে আর লিখে বেড়িয়েছে ।

প্রথম মাথা : আমি হতে চেয়েছিলুম দাক্ষিণাত্যের জালালুদ্দিন মুহম্মদ আকবর । সব ধর্মকে একই দৃষ্টিতে দেখতুম ।

ভাইপো আকবর : বাহ, ভালো কাজ করেছিলে । তাতে তো দোষের কিছু নেই । শ্যায়খুবাবা এলো না?

প্রথম মাথা :আমি ছিলুম বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সেনাপতি আর  রাজবংশের প্রতি বিশ্বস্ত   । রাজা সদাশিব রায়ের বয়স কম ছিল বলে আমিই রাজ্য চালাতুম ।  দাক্ষিণাত্যের হুসেন নিজাম শাহ, আলী আদিল শাহ আর ইব্রাহিম কুতুব শাহ সুলতানরা একসঙ্গে আক্রমণে আমাকে হারিয়ে দিলো । সহজেই জিতে যেতুম । তার বদলে যুদ্ধটা হয়ে উঠল  বিপর্যয় । আমার সেনাবাহিনীর দুই আস্তিক কমান্ডার  বিশ্বাসঘাতকতা করল, আর দল বদল করে সেনাদের নিয়ে সুলতানদের দিকে চলে গেল । এর ফলে আমাকে ওরা আচমকা গ্রেফতার করে সেখানেই মুণ্ডু কেটে ফেললো। আমার কাটা মাথা তালিকোটার যুদ্ধের বার্ষিকীতে আহমেদনগরের পথে-পথে মিছিল করে পাবলিককে দেখানো হয়েছিল। সুলতানদের বংশধররা মুণ্ডুতে তেল আর লাল রঙ মাখিয়ে বর্শার মাথায় গিঁথে রেখে দিয়েছিল । ওরা পুরো বিজয়নগরকে ধ্বংস করে মাটিতে মিশিয়ে দিলো আর প্রত্যেকটা বন্দীকে কচুকাটা করে খুন করেছিল । বিজয়নগর, যা ছিল একসময়  বিখ্যাত ঐশ্বর্যের শহর,  বিশাল সাম্রাজ্যের আসন, তা  নির্জন ধ্বংসাবশেষ হয়ে ওঠেছে । জায়গাটা  এখন সামান্য শহরতলী, হাম্পি নামে পরিচিত।

গুলবদনপিসি : তোমার উচিত ছিল ওদের পরিবারের মেয়েদের বিয়ে করে এনে নিজের পরিবারের সদস্য করা ; যেমন আকবর রাজপুত পরিবারের মেয়েদের বিয়ে করা । অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতানদের বেশিরভাগ মা ছিলেন রাজকীয় হারেমের উপপত্নী । তুমি যদি বংশধারা দ্যাখো, তাহলে টের পাবে । সুলতানদের সকলের মা তুর্কি ছিলেন না। যেমন, ওসমান প্রথম, তুর্কি । ওরহান, তুর্কি । মুরাদ প্রথম, গ্রীক । বায়েজিদ,  গ্রীক । আমি, তুর্কি। মুরাদ দ্বিতীয়, তুর্কি। মেহমেদ দ্বিতীয়, তুর্কি । বায়েজিদ দ্বিতীয়, তুর্কি । সেলিম , গ্রীক । সুলেমান , গ্রীক । সেলিম দ্বিতীয়, পোলিশ । মুরাদ তৃতীয়, ইতালিয়ান (ভিনিশিয়ান) । মেহমেদ তৃতীয়, ইতালিয়ান (ভিনিশিয়ান)। আহমেদ , গ্রীক । মোস্তফা প্রথম, আবখাজিয়ান । ওসমান দ্বিতীয়, গ্রীক বা সার্বিয়ান । মুরাদ চতুর্থ, গ্রীক। ইব্রাহিম, গ্রীক । মেহমেদ চতুর্থ, ইউক্রেনীয় ।দ্বিতীয় সুলেমান, সার্বিয়ান । আহমেদ দ্বিতীয়, পোলিশ । মোস্তফা দ্বিতীয়, গ্রীক । আহমেদ তৃতীয়, গ্রীক । মাহমুদ প্রথম, গ্রীক । ওসমান তৃতীয়, সার্বিয়ান । মোস্তফা তৃতীয়, ফরাসি। আব্দুলহামিদ প্রথম, হাঙ্গেরীয় । সেলিম তৃতীয়, জর্জিয়ান । মোস্তফা চতুর্থ, বুলগেরিয়ান । মাহমুদ দ্বিতীয়, জর্জিয়ান । আব্দুলমিসিড প্রথম, জর্জিয়ান বা রাশিয়ান । আব্দুলাজিজ প্রথম, রোমানিয়ান । মুরাদ পঞ্চম, জর্জিয়ান । আব্দুল হামিদ দ্বিতীয়, আর্মেনিয়ান বা রাশিয়ান । মেহমেদ পঞ্চম, আলবেনীয় । মেহমেদ ষষ্ঠ, জর্জিয়ান ।

দ্বিতীয় মাথা : তুমি বিয়ে করো বা যাই করো, যারা শত্রুতা করবে বলে প্যাঁচ কষে ফেলেছে, তারা সুযোগ পেলে তোমাকে ছাড়বে না । আমার সমাজে বিয়ে জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্ক নয় ; তা একটা জন্মের চুক্তি । আমাকে অনেকে বদনাম করে, অথচ ইতিহাসের খোঁয়াড়ে দুর্লভ রায়, জগত শেঠ, উমি চাঁদ, কৃষ্ণচন্দ্র রায়দের কেন ঘেরাও করা হয়নি? আমার আত্মীয়রা হারিয়ে গেল ! এদের বংশধররা কোথায় লুকিয়ে আছে ? কৃষ্ণচন্দ্র রায় ছিলেন একজন কূটকৌশলী ব্যক্তি। নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের সাথে সংঘাতে লিপ্ত হলে তিনি ইংরেজদের পক্ষ অবলম্বন করেন।  মীর কাশিম ওনাকে  বন্দী করলেও ইংরেজদের হস্তক্ষেপে তিনি মুক্তি লাভ করেন। কোম্পানি সরকার তার আনুগত্যের জন্য মহারাজা উপাধিতে ভূষিত করেন । কোম্পানিকে তেল দিয়ে হয়ে গেল মহারাজা । তাঁর শাসনকালে বাংলায় ইংরেজ শাসন কায়েম হয় এবং মুসলমান রাজত্বের অবসান ঘটে। এ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে তিনি ইংরেজদের সঙ্গে মিত্রতা করেন এবং ক্লাইভের পক্ষ নিয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন ত্বরান্বিত করেন। ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় নবাব  মীর কাশিম তাঁকে বন্দি করে মৃত্যুদন্ড দিলে ইংরেজদের সহায়তায় তিনি মুক্তিলাভ করেন। ইংরেজদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের পুরস্কারস্বরূপ তিনি ইংরেজ কর্তৃক ‘মহারাজা’ উপাধিতে ভূষিত হন। তদুপরি ক্লাইভের নিকট থেকে উপঢৌকন হিসেবে পান পাঁচটি কামান। সে সময়ে বাংলায় যে বর্গীর আক্রমণ হতো তা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তিনি তাঁর রাজধানী ‘শিবনিবাস’ নামক স্থানে স্থানান্তরিত করেন। ওনার পূর্বপুরুষ নদিয়া রাজবংশের আদি পুরুষ ভবানন্দ মজুমদার তিনি এই রাজবংশের সূচনা করেন। তাঁর বংশধররা ‘রাজা’ উপাধি ধারণ করে ব্রিটিশ শাসনের প্রতিষ্ঠাকাল পর্যন্ত নদিয়া শাসন করেন। জানা যায়, ভবানন্দ প্রতাপাদিত্যের (বারো ভুইঞাদের অন্যতম) রাজধানীতে প্রবেশের গুপ্ত পথ দেখিয়ে এবং প্রয়োজনীয় রসদ দিয়ে তিনি দিল্লির শাসক জাহাঙ্গীরের সেনাপতি মানসিংহকে সাহায্য করেছিলেন; তাই জাহাঙ্গীর তাঁর এই কাজে খুশি হয়ে ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে ফরমান জারি করে ভবানন্দকে মহৎপুর, নদিয়া, মারূপদহ, লেপা, সুলতানপুর, কাশিমপুর, বয়শা, মশুণ্ডা প্রভৃতি ১৪ টি পরগনা সনদসূত্রে দেন।  ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বাংলার নবাব ইসমাইল খাঁ ভবানন্দের বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে কানুনগো পদে নিযুক্ত করেন এবং সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে তাঁর জন্য সনদ ও মজুমদার উপাধি এনে দেন। ১৬৩১ সালে ভবানন্দ সম্রাটের কাছ থেকে ফরমানের মাধ্যমে বৃহৎ জমিদারি লাভ করেন। নদিয়া রাজবংশের আদি পুরুষ ভবানন্দ মজুমদার তিনি এই রাজবংশের সূচনা করেন। তাঁর বংশধররা ‘রাজা’ উপাধি ধারণ করে ব্রিটিশ শাসনের প্রতিষ্ঠাকাল পর্যন্ত নদিয়া শাসন করেন। জানা যায়, ভবানন্দ প্রতাপাদিত্যের (বারো ভুইঞাদের অন্যতম) রাজধানীতে প্রবেশের গুপ্ত পথ দেখিয়ে এবং প্রয়োজনীয় রসদ দিয়ে তিনি দিল্লির শাসক জাহাঙ্গীরের সেনাপতি মানসিংহকে সাহায্য করেছিলেন; তাই জাহাঙ্গীর তাঁর এই কাজে খুশি হয়ে ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে ফরমান জারি করে ভবানন্দকে মহৎপুর, নদিয়া, মারূপদহ, লেপা, সুলতানপুর, কাশিমপুর, বয়শা, মশুণ্ডা প্রভৃতি ১৪ টি পরগনা সনদসূত্রে দেন।  ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বাংলার নবাব ইসমাইল খাঁ ভবানন্দের বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে কানুনগো পদে নিযুক্ত করেন এবং সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে তাঁর জন্য সনদ ও মজুমদার উপাধি এনে দেন। ১৬৩১ সালে ভবানন্দ সম্রাটের কাছ থেকে ফরমানের মাধ্যমে বৃহৎ জমিদারি লাভ করেন।নদিয়া রাজবংশের আদি পুরুষ ভবানন্দ মজুমদার তিনি এই রাজবংশের সূচনা করেন। তাঁর বংশধররা ‘রাজা’ উপাধি ধারণ করে ব্রিটিশ শাসনের প্রতিষ্ঠাকাল পর্যন্ত নদিয়া শাসন করেন। জানা যায়, ভবানন্দ প্রতাপাদিত্যের (বারো ভুইঞাদের অন্যতম) রাজধানীতে প্রবেশের গুপ্ত পথ দেখিয়ে এবং প্রয়োজনীয় রসদ দিয়ে তিনি দিল্লির শাসক জাহাঙ্গীরের সেনাপতি মানসিংহকে সাহায্য করেছিলেন; তাই জাহাঙ্গীর তাঁর এই কাজে খুশি হয়ে ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে ফরমান জারি করে ভবানন্দকে মহৎপুর, নদিয়া, মারূপদহ, লেপা, সুলতানপুর, কাশিমপুর, বয়শা, মশুণ্ডা প্রভৃতি ১৪ টি পরগনা সনদসূত্রে দেন। ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বাংলার নবাব ইসমাইল খাঁ ভবানন্দের বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে কানুনগো পদে নিযুক্ত করেন এবং সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে তাঁর জন্য সনদ ও মজুমদার উপাধি এনে দেন । ১৬৩১ সালে ভবানন্দ সম্রাটের কাছ থেকে ফরমানের মাধ্যমে বৃহৎ জমিদারি লাভ করেন।

গুলবদনপিসি : কীই বা বলি বলো ! সবই সুবে বাংলার কপাল । 

দ্বিতীয় মাথা : তোমরা কি জানো এক সময় বাংলায় ছড়ি ঘুরিয়েছে বাঈজি বংশ ? আমার পরে তো সুবে বাংলায় শুরু হয়-বাঈজী বংশের শাসন। মীরজাফরের ঔরসজাত এবং বাঈজী মুন্নী বাঈর গর্ভজাত নজমউদ্দৌলাকে কোম্পানী বাংলার নবাব বানায়। বাঈজী বংশের দ্বিতীয় নবাব হন মুন্নী বাঈর অপর সন্তান সাইফউদ্দৌলা। বাঈজী বাবুবাঈও ভাগ্যবতী রমণী ছিলেন। সুবে বাংলায় পরবর্তী নবাব হন বাবুবাঈর গর্ভজাত সন্তান মোবারকউদ্দৌলা । পরে তারই ছেলে আর নাতিরা ধারাবাহিকভাবে বাংলার পুতুল নবাব হন।

কফিহাউসের যক্ষ : স্যার সুবে বাংলা নিয়ে একটা কথা আমার মাথাতেও ঘুরঘুর করে, যদি অনুমতি দ্যান তো বলি ।

চেঙ্গিজ খান : অনুমতির দরকার নেই । যার যা মনে আসে সেসব কথা বলার জন্যই তো আজকের জমায়েত ।

কফিহাউসের যক্ষ : বাংলার ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে বসলেই অধিকাংশ তথাকথিত প্রাজ্ঞজনের নজরে কেবল ঘোরাফেরা করেন শ্রী অরবিন্দ, চিত্তরঞ্জন দাশ, কিংবা আশুতোষ মুখার্জির মতন রাজনৈতিক চরিত্র। কিংবা রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর মশাইয়ের মতন সমাজ সংস্কারকদের কথা বলেন কেউ কেউ। সাহিত্যের আলোচনা হলে উঠে আসেন মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল কিংবা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সব ঠিকই আছে। কিন্তু ইতিহাস তো একচোখো বিষয় নয়। বাংলার স্বর্ণযুগের ইতিহাসে যাদের উপস্থিতি নিয়ে কেউ কখনও কথা বলেন না অথচ আজও যাদের নিয়ে বাঙালি গর্ব বোধ করে তাদের একজন যেমন ডক্টর বর্মণ, যাঁর নামে ডাবর কোম্পানি, ঠিক তেমনি এই মহেন্দ্র দত্ত। বিখ্যাত এই ছাতা নির্মাতার কথা অবশ্য আপনি বাঙালির বাজার লব্ধ চরিতাভিধানে পাবেন না। গুগলে খুঁজতে গেলে উঠে আসবেন প্রকাশক মহেন্দ্র দত্তের কথা, কিংবা বিপ্লবী মহেন্দ্র দত্তের নাটকীয় কর্মসূচি, আর পাবেন স্বামী বিবেকানন্দের ভাই মহেন্দ্র দত্তের উল্লেখ। কিন্তু ছাতা নির্মাতা মহেন্দ্র দত্ত খুঁজলে আপনার সামনে ভেসে উঠবে গুগল ম্যাপ। 

ল্যাঙড়া তৈমুর : হক কথা । কিন্তু আমরা আক্রমণ করতে বেরিয়ে ছাতা জিনিসটা কখনও দেখিনি । তুমি বলছ এই শহরেই পাওয়া যায় । ফিরে যাবার সময়ে দুটো কিনে নিয়ে যাবো । একটা আমার, আরেকটা আমার ঘোড়ার।

কফিহাউসের যক্ষ : আপনারা সবাই বিখ্যাত মানুষজন, দুর্ভাগ্য যে তুর্কি, ফার্সি, উজবেক, পর্তুগিজ, ফরাসি, ইংরেজি জানেন অথচ বাংলাভাষা জানেন না । আপনারা কি জানেন ? ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ খুলে মণীষী কলিম খান দেখতে পেলেন একই শব্দের অজস্র অর্থ এবং সেই শব্দের অর্থ খুঁজতে ডিক্সনারি বা থিসরাস মুখস্থ করার প্রয়োজন নেই। শব্দের মধ্যেই লুকিয়ে আছে শব্দের মানে। শব্দের বানানে যে বর্ণ বা ধ্বনিগুলি থাকে, সেগুলিই সেই শব্দের অর্থকে বহন করে। আমাদের মহাকাব্য ও বেদ-পুরাণের আপাত ধাঁধা ও জটিলতার জাল কেটে বেরোতে গিয়ে পেয়ে গেলেন ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থ তত্ত্ব। বলা ভালো পুনরাবিষ্কার করলেন। শব্দের অন্তর থেকে শব্দের অর্থ নিষ্কাশন একটি প্রাচীন ভারতীয় কৌশল। এই কৌশলের নাম ‘নির্বচন’। কলিম খান বলেন, এই কৌশলের আদি স্রষ্টা কে, তা জানা যায় না। ভারতবর্ষের সব বিদ্যার জনক যেহেতু সনাতন শিব, এই বিদ্যার স্রষ্টাও তিনিই হবেন। কথিত আছে, ‘১৪টি শিব স্ত্রোত্র’ এবং ‘মাহেশ্বর সূত্র’ অবলম্বন করেই পাণিনি তঁর বিখ্যাত ‘অষ্টাধ্যায়ী’ ও ‘শিক্ষা’ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এই কৌশল প্রথম লিপিবদ্ধ করেন যাস্ক ও পাণিনি। কলিম খান প্রাচীন কোনও চরিত্রকে ব্যক্তিচরিত্র ধরতে নারাজ। তাঁর মতে তখনও ‘ব্যক্তি’ গড়ে ওঠেনি। ফলত, যাস্ক ও পাণিনিও তাঁর মতে কোনও ব্যক্তিবিশেষ নয়, দুইটি পৃথক গোষ্ঠী। এইযুগের ভাষায় ‘ঘরানা’ বা ‘স্কুল অফ থট’ বলা যায়। এছাড়া বৌদ্ধযুগের ‘অমরকোষ’ও এই কাজটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করে গেছে। শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করে সেই অভ্যন্তরস্থ অর্থটিকে বাক্যের সাহায্যেই প্রকাশ করা রীতি। পরবর্তী কোষকারগণ একই পদ্ধতি মেনেছেন। মহাত্মা হরিচরণও একই কাজ করেছেন তার ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এ। কোনও ক্রিয়াই দৃশ্যমান নয়। কোনও কারক যখন সেই ক্রিয়াকে ধারণ করে, তখনই সেই ক্রিয়াকে দেখা যায়। ‘করণ’ বা ‘গমন’কে দেখা যায় না। কেউ কিছু করলে বা গমন করলেই ‘করণ’ বা ‘গমন’ দৃশ্যমান হয়। অর্থ কীভাবে শব্দের ভেতরে থাকে? কলিম খান উদাহরণ দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। যেমন ‘কর’ শব্দ = ক্‌+অ+র্‌+অ = ‘কারককে রক্ষা করে যে’। এটি আপনার ‘হাত’ হতে পারে, দেশের রাজার চাপানো ‘খাজনা’ হতে পারে, ‘রবির কর’ও হতে পারে। যে-যে সত্তা কারককে রক্ষা করে তাদের প্রত্যেকেই ‘কর’ পদবাচ্য। ফলত, শব্দ অনড় অচল নয়, স্থির নির্দেশক কোনও মানেও তার নেই। এখানে সতর্কও করছেন কলিম। তাই বলে শব্দের অনন্ত অসীম মানেও হয় না। ক্রিয়াটির সীমার মধ্যে যে-যে পড়বে, তাদের প্রত্যেককেই সেই শব্দ দিয়ে চিহ্নিত করা যাবে। এই তত্ত্বই প্রয়োগ করে কলিম খান পড়ে ফেললেন রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ। তারপরেই ঘটে গেল ম্যাজিক! চিচিং ফাঁক হয়ে খুলে গেল অন্তর্নিহিত অর্থের বন্‌ধ্‌ দরওয়াজা। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস নতুন রূপে হাজির হল।সহযাত্রী হিসেবে পেলেন শ্রীরামপুর কলেজের ইংরাজি ভাষা-সাহিত্যের অধ্যাপক রবি চক্রবর্তীকে। পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ লেখার পাশাপাশি বিপুল পরিশ্রম ও নিষ্ঠায় যৌথভাবে লিপিবদ্ধ করলেন ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থের বৃহৎ দুই খণ্ড অভিধান ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’। শুভানুধ্যায়ীদের নিয়ে তৈরি করলেন ‘বঙ্গযান’ পত্রিকা। বঙ্গীয় অ্যাকাডেমিক মহল প্রত্যশা মতোই তাঁর ভাবনাকে স্বীকৃতি জানায়নি। তাতে কী, তাঁরা তো হরিচরণকেও স্বীকৃত দেন না। হরিচরণের জন্মের সার্দ্ধশতবর্ষ নমো-নমো করে সারেন, ভুলেও ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অবশ্যপাঠ্য বইয়ের তালিকায় আসতে দেন না! কারন কী? হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজ সামনে আনা মানেই বাংলা ভাষা ও বানানবিধি নিয়ে ছিনিমিনি-খেলা অনেক ‘ভাষাবিদ’-এর করেকম্মে খাওয়ার দিন শেষ হয়ে যাবে। তাছাড়া অ্যাকাডেমি-নিয়ন্ত্রক পুঁজি একই শব্দের বহু অর্থ স্বীকার করবে কেন? বাজার সবসময়ই একরৈখিকতার পক্ষে। শব্দের বহুরৈখিকতা তাই স্বীকার্য নয়। হরিচরণ তাই ব্রাত্যই থেকে যান। তাঁর সুযোগ্য শিষ্য কলিম খান বিষয়েও স্বভাবত অ্যাকাডেমি নীরব। কলিম খান যা বলেছেন বা যা-যা বলেছেন সবই অক্ষয় সত্য, এমত বালখিল্য দাবি কেউই করেন না, কিন্তু ‘বিকল্প’ ভাবনা নিয়ে আলোচনা করতে বাধা কোথায়? তার বদলে হিরণ্ময় ‘নীরবতা’ দিকে তাঁকে উপেক্ষা করার এই ‘অ্যাকাডেমিক মৌলবাদ’ এত সক্রিয় কেন? আলোচনা বা চর্চায় ভয় কেন? প্রশ্নগুলো সহজ, কিন্তু উত্তর অজানা।

ভাইপো আকবর :  শ্যায়খুবাবা এলো না ?

কফিহাউসের যক্ষ : শ্যায়খুবাবা, শ্যায়খুবাবা করছেন কেন স্যার ? আপনার ছেলে সেলিম, মানে জাহাঙ্গির তো পাকিস্তানে মাটির তলায় । আনারকলিও সেখানে মাটির তলায় । দেখুন দুজনে মিলে কী করছে ।

ভাইপো আকবর : আমি জানতুম ও নিশ্চয়ই কোনো লন্দিফন্দি করছে । ছোকরা বয়সে সৎবোনের সঙ্গে লন্দিফন্দি করেছিল বলে আমি ওকে তার বুকের দুধ খেতে বাধ্য করেছিলুম । আদি গ্রন্হের লেখক পঞ্চম শিখ গুরু অর্জন দেবকেও খুন করিয়েছিল । নিজের আত্মজীবনীতে বেহায়াটা লিখেছে কী জানো ? লিখেছে, .. “ আমি নীলগাইয় মারার জন্য  তাক করে ছিলুম,  হঠাৎ করেই এক বর এবং দুজন পালকিবাহক কোথা থেকে এসে উপস্থিত হয়ে গেল আমার আর নীলগাইটার মাঝে । নীলগাই চিৎকার করে পালিয়ে গেলেও,  বরটাকে সেখানেই খুন করার হুকুম দিলুম আর পালকিবাহক দুটোকে গাধার ওপরে  চাপিয়ে  শিবিরের চারপাশে প্যারেড করালুম, যাতে অন্য কেউ  এমন কাজ করার সাহস না পায়। ” ভাঙ আর বিয়ার খাওয়া পাবলিকের জন্যে বন্ধ করে দিলেও নিজে তো আফিম আর দিশি মদের নেশা ছাড়তে পারল না, বইতে  আবার লিখেওছে বুক ফুলিয়ে যে আঠারো বছর বয়স থেকে নেশা করছে আর মাতাল হবার আনন্দ নিয়েছে । এতো মদ খেতো যে ওর হাত কাঁপা আরম্ভ করেছিল, তখন ও চাকরদের বলত ওর গলায় মদ ঢেলে দিতে ।  একজন ডাক্তার ওর নাড়ি চেক করে  বলেছিল যে ও ছয় মাসের বেশি বাঁচবে না। ডাক্তারের সামনেই  মদের সঙ্গে দিশি মিশিয়ে আর আফিম খেয়ে নিজেকে প্রফুল্ল করে তুলেছিল । আরেকটা স্বীকারোক্তি করেছে, যা শুনলে অবাক হয়ে যাবে ; ওর ছেলে শাহজাহানকে তার জন্মদিনে জোর করে মদ খাওয়াবার চেষ্টা করেছিল । আমার বাপ হুমায়ুন ছিলেন ঘরকুনো, কারোর সঙ্গে মিশতে চাইতেন না, নেশাভাঙ করে সিংহাসনে পড়ে থাকতেন, আর শ্যায়খুবাবা সারাজীবন নেশা আর মাগিবাজিতে কাটিয়ে দিল । নুরজাহানকে সেই কারণেই বিয়ে করেছিল যাতে বেগম সিংহাসন সামলাবে আর উনি লন্দিফন্দি করে বেড়াবেন । নয়তো সাঁয়ত্রিশ বছর বয়সে তেত্রিশ বছরের বিধবা বুদ্ধিমতী শিয়া মেয়েটাকে বিয়ে করবে কেন ?

কফিহাউসের যক্ষ : এই দেখুন, কে একজন মহিলা ছায়ামূর্তি এসেছেন ।

ছায়ামূর্তি : আমাকে নুরজাহান বেগম পাঠিয়েছেন । আমার নাম বেনজির ভুট্টো, জুলফিকার আলি ভুট্টোর মেয়ে । আমিও ও সেখানেই মাটির তলায় আছি বটে, তবে আমার দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল আপনাদের পাঠানো একজন মোহাজিরের ষড়যন্ত্রে, বোমা ফেটে । সে ছিল সেনাপতি, পরে রাষ্ট্রপতি । আমার আসতে অসুবিধা হয়নি, কেননা আমার তো ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্ট । নুরজাহান বেগম আমার আইকন । আমার মনে হয় উনি প্রত্যেক নারীবাদীর আইকন । আপনার শ্যায়খুবাবাও বহাল তবিয়তে আছেন । ওনার অম্মি, আপনার স্ত্রী তো ওখানেই আছেন মাটির তলায় জাহাঙ্গিরের তৈরি করা মসজিদে । 

ভাইপো আকবর : যাক, শুনে মনটা হালকা হলো । তা তোমার আইকন বলছ কেন ?

ছায়ামূর্তি : সম্রাট জাহাঙ্গীর আর নুরজাহানের নাম লেখা  স্বর্ণ এবং রৌপ্য মুদ্রা ছাড়ার পর সেসময়ের মুঘল রাজদরবারের লেখক, বিদেশি কূটনীতিক, বণিক এবং পর্যটকরা উপলব্ধি করতে শুরু করেছিলেনন যে মোগল সাম্রাজ্য পরিচালনায় বেগমের  বিরাট প্রভাব । নুরজাহান একদিন রাজপ্রাসাদের ঝরোকা বা বারান্দায় দেখা দিয়েছিলেন। তা তাঁর আগে পর্যন্ত কেবল পুরুষদের জন্যই সংরক্ষিত ছিল। তবে পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে নুর জাহানের এটিই একমাত্র বিদ্রোহ ছিল না। শিকারে বের হওয়া থেকে শুরু করে নিজের নামে রাজকীয় মূদ্রা এবং রাজকীয় ফরমান জারি, বড় বড় রাজকীয় ভবনের নকশা তৈরি, দরিদ্র নারীদের কল্যাণে ব্যবস্থা গ্রহণ, এরকম নানা কাজে নুর জাহান তার স্বাক্ষর রেখেছেন। যা ছিল সেকালের নারীদের মধ্যে ব্যতিক্রম। তাঁর স্বামীকে যখন জিম্মি করা হয়, তখন নুরজাহান তাঁকে রক্ষায় সেনাবাহিনীর অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছিলেন, যা তাঁকে ইতিহাসের পাতায় আর জনমানসে চিরদিনের জন্য স্থায়ী জায়গা করে দিয়েছে। প্রায়ই সম্রাটের সাথে বাঘ শিকারে যেতেন নুরজাহান। শক্তিশালী বাঘ শিকারি হিসেবে তার খ্যতি ছিল। তিনি ৬টি গুলি দিয়ে ৪টি বাঘ শিকার করেছিলেন। তাঁর বীরত্বের কবিতাও লিখেছিলেন সেসময়ের অনেক কবি। একসময় সম্রাটের বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন এই নারী ।  জাহাঙ্গীরের নামে তিনি রাজ্য শাসন করতেন। তিনি নিজের আত্মীয়দের দরবারের উচ্চপদে চাকরি দিয়েছিলেন। তাঁর অনুরোধে জাহাঙ্গীর তাঁর ভাই আসফ খাঁকে রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর পদ দিয়েছিলেন। তাঁর আগের পক্ষের মেয়ের সঙ্গে যুবরাজ শাহরিয়ারে বিবাহ দেন।

ভাইপো আকবর : শাহজাহান তো নুরজাহানের ওপর বেশ চটা ছিল শুনেছি । নুরজাহানের নামের সব মুদ্রা গলিয়ে ফেলেছিল আর যাদের কাছে ছিল, তাদের হুকুম দিয়েছিল গলিয়ে ফেলার । এখনকার কয়েন কালেক্টারদের কাছে ওই কয়েনগুলোর দাম অনেক ।

ছায়ামূর্তি : আমার বর যেমন ঘুষখোর ছিল, তেমন নুরজাহানের বাবাও ছিল ঘুষখোর । ‘আমার রাজ্য আমি এক পেয়ালা মদ আর এক বাটি সুরুয়ার বিনিময়ে আমার প্রিয় রানীর কাছে বেচে দিয়েছি।’ এই উক্তিও আর কারও নয়, সম্রাট জাহাঙ্গীরের। তিরিশজন বউয়ের মধ্যে জাহাঙ্গীরের সবচেয়ে প্রিয় বউ ছিলেন এই নূরজাহান। এত প্রভাব থাকা সত্ত্বেও নূরজাহানের জীবনের শেষ বছরগুলো ভালো যায়নি।  সম্রাট জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর নূরজাহান তড়িঘড়ি করে জামাই শাহরিয়ারকে সম্রাট ঘোষণা করতে চান। কিন্তু তাঁর ভাই আসফ খান নিজের মেয়ে মমতাজের স্বামী শাহজাহানকে সিংহাসনে বসাতে কৌশলে নুরজাহানকে বন্দী করেন। শাহজাহান এই সুযোগে নিজের ভাই শাহরিয়ারকে খুন করে করে  সিংহাসন দখল করে নিয়েছিল আরোহণ করেন। অথচ সম্রাট বেঁচে থাকা আমলে নূরজাহানের বাবা ও ভাই অর্থ আত্মসাৎ ও বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন তখন ঢাল হয়ে বাঁচিয়েছিলেন এই নুরজাহান। এমনকি তাঁদের পদোন্নতিতেও সাহায্য করেছিলেন তিনি। নিজের পরিবার পরিজনদের অনেককেই তিনি নিজের প্রভাব বলে প্রশাসন ও বিচার সম্বন্ধীয় উঁচু পদে বসিয়েছিলেন । জীবনের শেষ আঠারো বছর নুরজাহানের বন্দীদশাতেই কাটে। এই পুরো সময় তিনি রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে, তাঁর বাবার সমাধিতে দরগাহ   তৈরির তদারকি করে ও কাব্যচর্চা করে দিন কাটিয়েছিলেন ।  

ভাইপো আকবর : তোমাদের দেশে শুনেছি স্পেনের আদলে ইনকুইজিশন চলছে ? জানো তো ? ইউরোপীয় চার্চের দন্ডমুন্ডের কর্তা পোপ গ্রেগরির নির্দেশের ফলে পুরো ইউরোপে নেমে আসে ‘অন্ধকার যুগ’। তার  ফলাফল ছিল ইনকুইজিশন। চার্চের কর্তৃত্ব ধরে রাখা আর বিরোধীদের দমনের জন্য রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ বিরোধীদের গ্রেফতার ও জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। বিচারের সময় তাদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে চালানো হত অমানবিক নির্যাতন। যদি কেউ এমন কথা বলতো যা চার্চ সঠিক নয় তাহলে তার সর্বচ্চো শাস্তি ছিলো  জীবন্ত পুড়িয়ে মারা । ভয়াবহ নির্যাতন ও জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করার পদ্ধতিটিই ‘ইনকুইজিশন’ নামে পরিচিত। এই ইনকুইজিশন শুধু খ্রিস্টধর্ম বিরোধীরাই নয়, অন্যান্য ধর্মের, বিশেষ করে ইহুদি, মুসলমান আর দক্ষিণ আমেরিকার আদিনিবাসী বহু নিরপরাধ পুরুষ, নারী ও শিশু নির্যাতন ভোগ করছে। 

ছায়ামূর্তি : জানি । শুনে অবাক হবেন যে আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর পরিবার শিয়া ইসমাইলি মতের অনুসারী ছিল, যাদের এখন তালিবানিদের হাতে অত্যাচার ভোগ করতে হচ্ছে । জিন্নাহর ঠাকুর্দা ভারতের গুজরাতের কাঠিয়াওয়ারের গোন্ডাল রাজ্যের পানেলি মতি গ্রামের বানিয়া উপজাতের সদস্য ছিলেন। তিনি মাছের ব্যবসা  করতেন, আর সেই কারণে তিনি তার  হিন্দু লোহানা জাত থেকে বয়কট হন। তিনি  মাছের ব্যবসা বন্ধ করে দেবার পরও তাঁকে জাতে ফেরার অনুমতি দেয়া হয়নি। ফলে, তাঁর ছেলে পুঞ্জলাল ঠাক্কর, যিনি জিন্নাহর বাবা,  এতটাই অপমানিত ও ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি তাঁর এবং তাঁর চার ছেলের ধর্ম পরিবর্তন করে নেন,  এবং ইসলাম ধর্মে আস্তিকান্তরিত হন । জিন্নাহর বাবা পুঞ্জাভাই জিন্নো খোজা ইসমাইলি ফিরকা বিশ্বাসের সাথে প্রথম প্রজন্মের মুসলমান ছিলেন, তবে পরবর্তী প্রজন্ম তাদের বিশ্বাস শিয়া ইসলামের দিকে নিয়ে যায়। আমার দেশের লোকেরা এই ইতিহাস জানে ।

চেঙ্গিজ খান : আমি বলেছিলুম তো যে সব খান চেঙ্গিজ খান নয় ।

ছায়ামূর্তি : চরমপন্থী গোষ্ঠীর সদস্যরা আমাদের দেশেও জাতপাতের সূচনা করেছে স্যার । তাদের লক্ষ্য হলো হিন্দু, খ্রিস্টান, শিয়া, বেরেলভি, সুফি, আহমাদিয়া আর দেওবন্দী ।  কয়েক হাজার শিয়া সুন্নি উগ্রপন্থী নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি করে মরেছে। খুনোখুনির  উল্লেখযোগ্য দিক হ’ল চরমপন্হীরা তাদের আক্রমণের ধর্মীয় দিকগুলিকে জোর দেওয়ার জন্য উপাসনার জায়গাগুলোকে টার্গেট করে।  সূফি মাজারেও হামলা হয় । এই নতুন জাতপাতের রেশারেশির ঝগড়ায় সিপাহ-ই-সাহাবা, তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান,  জুন্ডাল্লাহ ,  তেহরিক-ই-তালিবান  দায় স্বীকার করেছে। মেয়েরা বোরখা না পরলে তালিবানরা তাদের মাথায় গুলি মেরে খুন করে ।

ভাইপো আকবর : তোমার ড্যাড নিজে প্রধানমন্ত্রী হবার ধান্দায় শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেয়নি, তাই দেশটা দুটুকরো হয়ে গেল, যুদ্ধ বাধলো । যুদ্ধে যে নব্বুই হাজার সেনা বন্দি হয়েছিল তারা কি তাদের অপমান ভুলতে পারে। তারা দল বেঁধে তোমার বাপকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দিলো ।

ছায়ামূর্তি : আমার ড্যাড আল-হিন্দের প্রধানমন্ত্রী মিস্টার নেহেরুর মতন ফ্ল্যামবয়েন্ট ছিলেন ।

চেঙ্গিজ খান : মিস্টার নেহেরু প্রায়ই এই গানটা টেলিফোনে একজনকে খাম্বাজ রাগে গেয়ে শোনাতেন–

আমি      চিনি গো চিনি    তোমারে ওগো বিদেশিনী।

তুমি      থাক সিন্ধুপারে    ওগো বিদেশিনী॥

তোমায়  দেখেছি শারদপ্রাতে,    তোমায়    দেখেছি মাধবী রাতে,

তোমায়  দেখেছি হৃদি-মাঝারে    ওগো বিদেশিনী।

আমি     আকাশে পাতিয়া কান    শুনেছি    শুনেছি তোমারি গান,

আমি     তোমারে সঁপেছি প্রাণ    ওগো বিদেশিনী।

      ভুবন ভ্রমিয়া শেষে   আমি      এসেছি নূতন দেশে,

আমি    অতিথি তোমারি দ্বারে    ওগো বিদেশিনী॥

ল্যাঙড়া তৈমুর : হায় মাওলা কী করলা । আল-হিন্দের রোগ ওদেরও ধরেছে । আমার সময়ে তো এরকম জাতপাতের খুনোখুনি ছিল না, কে বড়ো আর কে ছোটো, তা নিয়ে কাটাকাটি-মারামারি হতো না ! মেয়েদের বোরখা পরতে হতো না । 

ভাইপো আকবর : বলছিলুম । নির্ঘাত নব্য-ইনকুইজিশন । আমার দরবারে নিরীশ্বরবাদীরাও আসতো ।  নিরীশ্বরবাদ আক্ষরিক অর্থে “ঈশ্বরের অনস্তিত্ব সংক্রান্ত ধারণা”, কিংবা “ঈশ্বরহীনতা সংক্রান্ত মতবাদ” । ঈশ্বর বা দেবতার অস্তিত্বে অবিশ্বাস হিন্দু দর্শনের একাধিক মূলধারার ও ব্যতিক্রমী ধারার শাখায় সুপ্রাচীন কাল থেকে স্বীকৃত হয়েছে।] ভারতীয় দর্শনের তিনটে শাখা বেদের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করেছে। এই তিনটি শাখা হল জৈনধর্ম, বৌদ্ধধর্ম ও চার্বাক। এগুলোকেই ‘নাস্তিক’ দর্শন বলা হয়। নাস্তিক বা ব্যতিক্রমী ধারার দর্শনে যদিও ঈশ্বরে অবিশ্বাসের থেকে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে, বেদের কর্তৃত্ব অস্বীকার ।  এই শাখাগুলো সৃষ্টিকর্তা দেবতার ধারণাটিকেও প্রত্যাখ্যান করেছে। আমি নানারকম আলোচনা শুনতুম কিন্তু খুনোখুনি বরদাস্ত করতুম না । তোমার ভাবনা তোমার কাছে রাখো, অন্য সবায়ের ওপর চাপাবার কী দরকার ?

গুলবদন পিসি : একদম ।

চেঙ্গিজ খান : সন্ধ্যা হয়ে গেল তো । এবারে চলো খালাসিটোলায় । বাদবাকি চর্চা সেখানেই মাতাল হয়ে করা যাবে। চল রে ল্যাঙড়া । মহিলারা ওখানে অ্যালাউড নয় । যারা-যারা যেতে চাও চলো । পরের আড্ডা পয়লা বৈশাখ হবে নিউ টাউন কফি হাউসে । গুড নাইট লেডিজ । সি ইউ সুন ।

Posted in Uncategorized | Leave a comment

গলগণ্ড : মলয় রায়চৌধুরীর উত্তরাধুনিক নাটক

–বড়োমামা,  তুমি নাকি ইনডিয়ার ডেফিনিশান তৈরি করে ফেলেছো ?

–হ্যাঁ তো । 

–দেশকে ডিফাইন করা যায় ?

–কেন যাবে না ভোম্বোল ? তোকে  দেশের জীবনের সংজ্ঞায়িত মুহুর্তগুলোকে একটার সঙ্গে আরেকটা জুড়তে হবে। দাঁড়া, বেশ দীর্ঘ, পড়ে শোনাতে হবে আমার ডায়রি থেকে । বিন্তি, আমার কালো রঙের ডায়েরিটা এনে দে তো । 

–এই নাও । 

–শোনাও, শোনাও, প্লিজ ।

–শোন, মন দিয়ে । স্বদেশের ডেফিনিশন । কাটমানি, কালোবাজার, কালোটাকা, ঘুষ, নজরানা, উৎকোচ, হাওয়ালা, স্মাগলিঙ, গরু পাচার, কয়লা পাচার, মেয়ে পাচার, গণধর্ষণ, ডাকাতি, খুন, তহবিল তছরূপ, ভর্তি কেলেঙ্কারি, নারদা, সারদা,  কর্পোরেট কেলেঙ্কারি, জালিয়াতি, নোটনকল, রোজভ্যালি, চাকরি বিক্রি, দলিল কারচুপি, জিপ কেলেঙ্কারি, এলআইসি কেলেঙ্কারি, বেনামি সম্পত্তি, টেলিকম কেলেঙ্কারি, এইচডিডব্লিউ সাবমেরিন কেলেঙ্কারি, জেএমএম ঘুষ কেলেঙ্কারি, তানসি ল্যান্ড ডিল কেলেঙ্কারি, বিটুমেন কেলেঙ্কারি, ইউরিয়া কেলেঙ্কারি, লটারি কেলেঙ্কারি, অনন্তনাগ পরিবহন সাবসিডি কেলেঙ্কারি, তেলগি স্ট্যাম্প পেপার কেলেঙ্কারি, তোলাবাজি, সিন্ডিকেট, নির্বাচনে টিকিট বিক্রি, জোচ্চুরি, কাজের বরাত, নদীতটের বালি বিক্রি,  পনজিস্কিম কেলেঙ্কারি, চিটফাণ্ড কেলেঙ্কারি, ফাটকা জোচ্চুরি,  কালোটাকা সাদা করা, সাংবাদিক হত্যা, শেল কোম্পানি, সত্যম কেলেঙ্কারি, কমনওয়েল্থ গেমস কেলেঙ্কারি, মাদক পাচার, জাল ওষুধ বিক্রি, ব্যাপম কেলেঙ্কারি, আদর্শ হাউসিঙ কেলেঙ্কারি, কার্টেল, সুইসব্যাঙ্কে লুকোনো টাকা, নীরব মোদি জালিয়াতি, ক্রিকেটে গড়াপেটা, ললিত মোদির ক্রিকেট কেলেঙ্কারি, বিজয় মাল্য আর্থিক কেলেঙ্কারি, বিষমদ কাণ্ড, আসল বোতলে নকল ব্ল্যাক লেবেল-শিভাস রিগাল, বেআইনি লেনদেন, এবিজি শিপইয়ার্ড ব্যাঙ্ক জালিয়াতি, রাজীব গান্ধী ফাউন্ডেশন-রাজীব গান্ধী চ্যারিটেবল ট্রাস্ট-ইন্দিরা গান্ধী মেমোরিয়াল ট্রাস্ট কেলেঙ্কারি, ন্যাশানাল হেরাল্ড কেলেঙ্কারি , আলি বুদেশ, আনিশ ইব্রাহিম, দাউদ ইব্রাহিম, হাসান আলি খান, আবদুল লতিফ, হাজি মস্তান, টাইগার মেমন, ইয়াকুব মেমন, ভরদারাজন মুদালিয়ার, ছোটা রাজন, ছোটা শাকিল, বক্সার ভাদিভেলু, বীরপ্পন, হেরোইন, আফিম, কোকেন, গুণ্ডা, মস্তান, অমিত ভরদ্বাজ, মেহুল চোকশি, সয়েফ দরবার, রাজকিশোর দত্ত, রজত গুপ্ত, হরশদ মেহতা, নটওয়রলাল, শিবাজী পাঁজা, রামালিঙ্গা রাজু, জি জনার্দন রেড্ডি, আবদুল করিম তেলগি, মুখতার আনসারি, ঠগ বেহরাম, লরেন্স বিশনোই, দিলীপ বুয়া, রঞ্জিত চিমা, মায়া ডোলাস, কোলি ফয়াজ, ভিকি গোস্বামী, সান্তোখবেন জাদেজা, এম পি জয়রাজ, বিনদি জোহাল, এজাজ লাকড়াওয়ালা, করিম লালা, ভুরা মুঞ্জা, নায়িম, রবি পুজারী, মুথাপ্পা রায়, ছোটা রাজন, গোপাল রাজওয়ানি, কোতওয়াল রামচন্দ্র, আবু সালেম, অগ্নি শ্রীধর, শ্রীপ্রকাশ শুক্লা, মানয়া সুরভে, হরিশংকর তিওয়ারি, আক্কু যাদব, ডি পি যাদব, মায়া ডোলাস, আনন্দপাল সিং, নির্ভয় গুজ্জরম মণীন্দ্রপাল সিং, জালিয়াৎ, অপহরণকারী, চন্দ্রমোহন শর্মা, ধন্না সিং,এম জয়শংকর, রিপার জয়নন্দন, চন্দ্রকান্ত ঝা, মোহন কুমার, রভিন্দর কুমার, মোট্টা নাভাস, সন্তোষ পোল, রমণ রাঘব, উমেশ রেড্ডি, সতীশ, দেবেন্দ্র শর্মা, দরবারা সিং,আশারাম, ফলাহারিবাবা, এম জয়শংকর, মনিন্দরপাল সিং কোহলি, বিট্টি মোহান্তি, সুনীল রস্তোগি, উমেশ রেড্ডি, সতীশ, দরবরা সিং, তাঁতিয়া ভীল, ফুলন দেবী, কোলি ফয়াজ, ইথিক্কারা পাক্কি, জম্বুলিঙ্গম নাদার, জগ্গা জাট, সীমা পরিহার, শিবকুমার প্যাটেল, কোতওয়াল রামচন্দ্র, দেবেন্দ্র শর্মা, মান সিং, পানসিং তোমার, কিরণজিত সিং আহলুওয়ালিয়া, নভজ্যোত সিং সিধু, হংসরাজ গঙ্গারাম আহির, প্রেমচন্দ গুপ্তা, এস জগতরকশাকন, শ্রীপ্রকাশ জায়সওয়াল, নবীন জিন্দল, মধু কোডা, দাসারি নারায়াণা রাও, সুবোধকান্ত সহায়, রাডিয়া টেপ, অজয় সিং চৌতালা, পুরুষোত্তম নরেশ দ্বিবেদী, পাপ্পু কালানি, রামনিবাস গোয়েল, বালমুকুন্দ গৌতম, মায়া কোডনানি, সজ্জনকুমার, বীর সিং মাহতো, বিক্রম সিং মাজিথিয়া, রশিদ মাসুদ, জগন্নাথ মিশ্রা, ভুরা মুঞ্জা, নীললোহিতাদাসন নাদার, ফ্রানসিসকো পাচেকো, রাজু পাল, আর বালকৃষ্ণ পিল্লাই, মনোজ প্রধান, প্রবোধ পুরকাইত, গোপাল রাজওয়ানি, সাহি রাম, সুখ রাম, সুরেশ রাণা, ভি কে শশীকলা, টি এম সেলভাগণপতি, মোহম্মদ শাহাবুদ্দিন, জগদীশ শর্মা, রাধারমণ শাস্ত্রী, বিজয়কুমার শুক্লা, তাহির হুসেন সিদ্দিক, অক্ষয়প্রতাপ সিং, আনন্দমোহন সিং, অনন্তকুমার সিং, প্রভূনাথ সিং, সঞ্জীব সিং, সুরজভান সিং, মোহম্মদ সুর্তি, প্রেম খাণ্ডু থুঙ্গন, শেখর তিওয়ারি, সান্দ্রা ভেঙ্কটা ভিরাইয়া, আনন্দসেন যাদব, মহেন্দ্র যাদব, বন্যপ্রাণীর দেহাংশ বিক্রি, জুলুমবাজি, দাঙ্গা, সন্ত্রাস, সুপারি কিলিঙ, শিশু চুরি, অবৈধ গর্ভপাত, ছিনতাই, এনকাউন্টার, মিত্রোখিন পেপার্স, হিংসা, হপ্তাউসুলি, ডাকাতি, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, প্রোটেকশান মানি ।

–আরে ! এতো দারুন ! তুমি তো পুরো দেশটা কভার করে ফেলেছো। 

–এই কথাগুলো শুনলে আমার কিন্তু বেশ রাগ আর ঘৃণা হয় ।

–বুঝলেন মেজকাকু,  রাগ হল এমন অনুপ্রেরণামূলক আবেগ যা একজন মানুষের মগজে এই ভাবনার জন্ম দেয় যে সে অন্যদের, অন্যকিছু, অন্যঘটনা  নিয়ন্ত্রণ করতে পারে বা পারতো।সমাজকে আর সমাজের আর পরিবারের লোকেদের মধ্যে বদল ঘটাবার  ক্ষমতা তার আছে ; ব্যাপারটা তার নিজের সম্পর্কে  উচ্চ মূল্যায়নের। অর্থাৎ, দুঃখের মতো অন্য নেতিবাচক আবেগের উল্টোদিকে , যেখানে ‘মোকাবিলা করার সম্ভাবনা’ দৃষ্টান্তমূলকভাবে কম ।

–তুই এমন কথা বলিস শীর্ষেন্দু ! রাগারাগির কী আছে ? সেই ঘটনাটা মনে আছে তোর ? সেই ত্রিভূবনদাস ভিমজি জাভেরির দোকানে নকল সিবিআই অফিসারদের ডাকাতি হয়েছিল , যে ঘটনা নিয়ে অক্ষয়কুমারের স্পেশাল ছাব্বিশ নামে একটা ফিল্ম হয়েছে । দু কোটি টাকার গয়না আর নগদ নিয়ে চম্পট সেই নকল সিবিআই অফিসার আজও ধরে পড়েনি ।

–তবে ? আমাদের দেশ বলতে অমন সজ্ঞাকে গুরুত্ব দিতে হবে ।

– কমলবাবু,আপনাকে একটা জলবিভাজক ঘটনা মনে করিয়ে দিই । ১২ মার্চ ১৯৯৩ তারিখে, ১২টা পরপর বিস্ফোরণ মুম্বাইকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল, ২৫০ জনেরও বেশি মানুষ মারা যায় আর ৭০০ জনেরও বেশি ঘায়েল হয়। ঘটনাটার নাম ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ আক্রমণ। এই বোমা হামলায় প্রথমবার আরডিএক্স  ব্যবহার হয়েছিল। গ্যাংস্টার দাউদ ইব্রাহিম কাসকর আর টাইগার মেমন আর ওদের দোসররা এই হামলার পরিকল্পনা করেছিল  বাবরি মসজিদ ধ্বংসের  প্রতিশোধ হিসাবে। বিস্ফোরণগুলো ২ ঘন্টা ১০ মিনিট ধরে ঘটেছিল ।  বিস্ফোরণে ২৭ কোটি টাকার সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল । দুপুর দেড়টায় বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের বেসমেন্টে প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে। এর পরেই কাথা বাজার, দাদারের শিবসেনা ভবন, এয়ার ইন্ডিয়া বিল্ডিং, মাহিম কজওয়ের ফিশারম্যানস কলোনি, সেঞ্চুরি বাজার, জাভেরি বাজার, হোটেল সি রক, প্লাজা সিনেমা, হোটেল জুহু সেন্টার আর পাসপোর্ট অফিসে বিস্ফোরণ ঘটেছিল । ওরা প্রথমে শিবাজি জয়ন্তীর দিন বিস্ফোরণ ঘটাবার পরিকল্পনা করেছিল।  ৯ মার্চ দাঙ্গার জন্য পুলিশ টাইগার মেমনের দলের  গুল মোহাম্মদ শেখ ওরফে গুল্লুকে গ্রেপ্তার করার পরে পরিকল্পনাটা পালটে ফেলেছিল । গুল্লু মুম্বাইয়ের  বোমা বিস্ফোরণের  পরিকল্পনার কথা পুলিশকে বলে ফেলেছিল , কিন্তু  পুলিশ ভেবেছিল লোকটা ফালতু বকছে।  মুম্বাই পুলিশ বিস্ফোরণের ৪৮ ঘন্টার মধ্যে ঘটনার অপরাধিদের চিহ্ণিত করে ফ্যালে। ততোক্ষণে টাইগার মেমন, তার ভাই ইয়াকুব আর দাউদ ইব্রাহিমের ভাই আনিস ইব্রাহিমসহ বেশ কয়েকজন প্রধান আসামি  দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। ইয়াকুব মেমনকে পরে ১৯৯৪ সালে গ্রেপ্তার করা হয় আর মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। মামলায় দাউদ ইব্রাহিম আর টাইগার মেমনসহ ৩৫ জন এখনও ফেরার। আবু সালেম, করিমুল্লাহ শেখ আর অন্য চারজনকে ২০১৭ সালে  বিশেষ আদালত এই মামলায় দোষী পায় আর তারা এখন জেল খাটছে।

কী করব ! তোর উচ্চারিত শব্দগুলো তো ক্রোধ আর ঘৃণাই জাগায় !

–ইনডিয়া ইজ নট ডিফাইনেবল লাইক পাকিস্তান অর বাংলাদেশ ।  আমার ফ্ল্যাটের সামনের মারোয়াড়ি পরিবারও মাঝে-মাঝে ওদের তরকারি দিয়ে যায় । ওদের দুই ভাইয়ের একদিন হাতাহাতি হয়েছিল কে কোন ঘরে শোবে তা নির্ণয় করা নিয়ে । বড়ো ছেলের বউয়ের দুটো মেয়ের পর ছেলে চাইছিল; গর্ভবতী হয়ে গেছে সেকথা বাড়িতে বলেনি, সলিলাকে দিয়ে প্রেগনেন্সি কিট আনিয়ে শিয়োর হয়েছিল । গণেশপুজোর সময়ে তিন ঘণ্টা লাইন দিয়ে লালবাগের রাজা নামে বিখ্যাত গণেশের কাছে মানত করেও মেয়ে হলো । একই সময়ে বউটার বোনের ছেলে হয়েছিল, তৃতীয়বার ছেলে । সন্তান বদলাবদলি করে নিলো, কিন্তু ক্রমে টের পেলো ছেলেটা কথা বলতে পারে না । ইতিমধ্যে ছোটো বউটার ছেলে হওয়ায় ছোটো ছেলের কদর শশুর-শাশুড়ির  কাছে বেড়ে গেছে । ছেলে পাবার জন্য ছোটো ছেলেটার বউ রোজ সকালে সাই মন্দিরের গরুকে তুলসীপাতা খাওয়াতে যেতো । দুই ভাইয়ের মারামারির সমাধান করার জন্য ওদের বাপ রিটায়ার করে যে টাকা পেয়েছিল সেই টাকায় কাছেই একটা ওয়ান বেডরুম ফ্ল্যাট কিনেছে । বড়ো ছেলেকে সেখানে শিফ্ট করে দিলো ।  বড়ো ছেলেটার মেয়ে দুটো আমাদের ন্যাওটা হয়ে গিয়েছিল । আর এদিকে আসে না ।

–যেহেতু আমাদের দেশটা এতই কলুষিত, মিথ্যা-আক্রান্ত, অস্থির, অতিরঞ্জিত আর  অন্যায্যতায় ঠাশা,  নিজের ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যা অনুভব করা যায় শুধু তাই বিশ্বাস করা উচিত ।  ভারতের যে কোনও জায়গার তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ ইন্দ্রিয়কে শক্তিশালী করে তোলে। এই কারণে, বাঙালিরা যদিও অদক্ষ মন্ত্রী, স্থানীয় নেতা, অধ্যাপক, আমলা, সাংবাদিক আর জোচ্চোর ব্যাবসাদারদের  সহ্য করে, কিন্তু  রবীন্দ্রসঙ্গীত , ধ্রুপদী নৃত্য, নাটক, টেলিভিশন, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, বাংলাখাবারের অযোগ্যতা সহ্য করবে না। বিশৃঙ্খলা,  দুর্যোগ আর প্রতারণার এই দেশে, কখনও কখনও শুধুমাত্র সৌন্দর্যকে বিশ্বাস করা যেতে পারে।  আনন্দ নিয়ে দর কষাকষি করা যাবে না । আর ক্ষুধার্তের কাছে  খাবারই একমাত্র স্বর্ণমুদ্রা ।

—তুমি যখন ভেরিভিকেশানে নোট পোড়াবার অফিসার ছিলে, তখনও তো নোটের পাহাড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে ।

–হ্যাঁ, পচা, স্যাঁতসেতে, চটচটে, ছাতাপড়া, দুর্গন্ধে হাঁপিয়ে পড়ার পাহাড় । ভাগ্যিস ওই চাকরি ছেড়ে গ্রামীণ উন্নয়নের চাকরিটা পেলুম । কিন্তু সেসময়ে কাউন্টিঙ মেশিন ছিল না ; হয়তো ছিল, আমাদের দেশে আমদানি হয়নি । আমার স্টাফরা হাতে গুনতো,ওদের যেকটা প্যাকেট দিতুম স্যাম্পল কাউন্টিঙের জন্য । ওদেরও হাতে আর লাংসে নানা অসুখ দেখা দিতো, যদিও অফিস থেকে অ্যাসপিরিনের কোটা ছিল । এখন আর হাতে গুণতে হয় না, মেশিনেই গোনা হয়, বড়ো মেশিন, এক লপ্তে দশ-কুড়ি হাজার গুনে প্যাকেট আর বাণ্ডিল তৈরি হয়ে যায় । আমার সময়ে নোট নষ্ট করার জন্য ইনসিনারেটরে পোড়ানো হতো, এখন নোটগুলো মেশিনে শ্রেডিঙ করে তার পাল্প তৈরি হয়।

–সুন্দরী মেয়েরা সব সময় দেখি বিটকেল চেহারার পুরুষদের পছন্দ করে ।  

–যেমন মেরি সেটন, যিনি ভি. কে. কৃষ্ণমেননের প্রেমে পড়েছিলেন। ওনাদের সম্পর্কের ভাঙনের ফলে ১৯৩৫ সালে কৃষ্ণমেননকে লণ্ডনের হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল । ব্যর্থ প্রেমে উনি আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিলেন । মেরি সেটন  ছিলেন একজন অভিনেত্রী এবং একজন দক্ষ শিল্প, থিয়েটার, চলচ্চিত্র সমালোচক, যিনি তার সারা জীবন একজন সমাজবাদী ছিলেন, ১৯৮৫ সালে মারা যান। তিনি ছিলেন ক্যাপ্টেন সেটনের মেয়ে,  ভারতে পোস্টেড ছিলেন আর  বিদ্রোহে আহত হন ।  মেনন সম্পর্কে মেরি বলেছিলেন, : উনি যে কোনও ভারতীয়ের মতো নন, দূর থেকে চিকন আর অতিরিক্ত সাধারণভাবে অ্যাঙ্গুলার৷ গঠনের দিক থেকে তিনি খুব সুদর্শন পুরুষ কিনা, নাকি তিনি স্বতন্ত্র ছিলে,ন তা নির্ধারণ করা কঠিন ছিল৷ দৃষ্টি শয়তানের মতন, যখন চোখে চোখ ফেলে দেখতো, তখন ওনার বাদামের আকৃতির চোখ বাজপাখির মতো দেখাতো।

–কৃষ্ণমেনন তো আরেকজন মেমের প্রেমে পড়েছিল, তাই না ?

–হ্যাঁ। কৃষ্ণমেননের রাজনৈতিক পতনে,  ব্রিজেট টুনার্ড নামে একজন যুবতীর সঙ্গে তাঁর প্রেমের ভূমিকা ছিল।  দক্ষিণ আফ্রিকার কমিউনিস্ট নেতা ডক্টর ইউসুফ দাদু’র স্ত্রী উইনি দাদু’র স্মৃতিচারণে  রয়েছে যে ১৯৪৯ সালে যখন তাঁরা মেননের সাথে দেখা করেছিলেন, তখন মেনন আর মিসেস টুনার্ড একসাথে বসবাস করছিলেন। সাংবাদিক ইন্দর মালহোত্রাও,  লিখেছেন যে মেনন-টুনার্ড ভালোবাসা-সম্পর্ক ইন্ডিয়া লিগ অফিসের সাথে যুক্ত সকলেরই জানা ছিল।

–উনি শাকাহারি ছিলেন আর মদ খেতেন না । ছোটোবেলা থেকে ইংল্যাণ্ডে থাকার দরুন ভালো মালায়ালিও বলতে পারতেন না ।

–মেরি সেটনই তো সত্যজিৎ রায়, সের্গেই আইজেনস্টাইন আর জওহরলাল নেহেরুর জীবনী লিখেছেন । কৃষ্ণমেননকে দেখতে অমন হলেও, শুনেছি লণ্ডনে ওনার অসংখ্য অনুরাগিনী ছিল । স্বাধীন ভারতে ঘুষ খাবার আদি পর্বটা কিন্তু মেননই শুরু করেছিলেন । ১৯৪৭-৪৮ সালে, দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে, পাকিস্তান দখল করতে চাইছে কাশ্মীর, তার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ভারতের আরও কিছু জিপ গাড়ির দরকার ছিল। তখন ব্রিটেনের ভারতীয় হাইকমিশনার ভি. কে. কৃষ্ণ মেনন পুরোনো মেরামত করা ২০০০ জিপ কেনার জন্য  অর্ডার দেন ৷ ওই পুরনো  জীপ কিনতে যে দাম দেওয়া হচ্ছিল সেই  দামেই নতুন জীপ কেনা যেত আমেরিকা বা কানাডা থেকে । নাম না-জানা  যে অ্যান্টি-মিস্টান্টেসকে জিপগুলো সরবরাহ করার জন্য বরাত দেওয়া হয়েছিল, তার মূলধন ছিল মাত্র ৬০৫ পাউন্ড। কৃষ্ণমেনন এজন্য ১৭২০০০ ডলার দিতে রাজি হন ।তার মধ্যে মোট পেমেন্টের ৬৫% কোনো পরিদর্শন শংসাপত্র ছাড়াই দেওয়া হয় আর ডেলিভারি দেওয়ার সময় ২০% । বাদবাকি টাকা ডেলিভারী হওয়ার এক মাস পরে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়৷ কোম্পানিটি অবশ্য দুই বছরে মাত্র ৫৯টি জিপ সরবরাহ করে  সরকারকে ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার করে।ব্রিটেন কর্তৃক জিপগুলির অর্থ প্রদান ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ভারতকে ব্রিটিশ যুদ্ধ ঋণের অংশ হিসেবে ।  মেনন এই চুক্তিতে তার ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিলেন। মেনন প্রোটোকল এড়িয়ে একটি ৮০ লক্ষ টাকার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন । যদিও বেশিরভাগ টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়েছিল , মাত্র ১৫৫টা জিপ ডেলিভারি করা হয়েছিল ; যদিও প্রটোকল অনুসারে মেননকে পদত্যাগ করে ভারতে ফিরে আসতে বলা হয়, তবে নেহেরু সরকারকে জিপগুলি গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিলেন । এদিকে চুক্তির তথ্য ভারতে পৌঁছলে এখানকার সংসদ সহ গোটা দেশে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয় ।

–বেচারা । 

–আপনি মিত্রোখিন পেপার্সের খবর পড়েছেন ? ইনডিয়াকে আমাদের চেয়ে বিদেশিরা বেশি বুঝেছে। সোভিয়েত আমলের গুপ্তচর মিত্রোখিন যেসব কাগজপত্র রেখে গেছে তাতে দাবি করেছে যে কৃষ্ণমেননের ১৯৬২ আর ১৯৬৭ সালের নির্বাচনে ওরা প্রচুর টাকা দিয়েছিল ওনাকে জেতাবার জনয় । কৃষ্ণমেনন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হয়ে ব্রিটিশ যুদ্ধবিমানের বদলে তাই সোভিয়েত মিগ কিনেছিলেন ।

–অ্যাঁ ! কী কাণ্ড !

–তুমি যে মোটা লোকটার কথা বলছ, তারও অনুরাগিণী ওই একমাত্র যুবতী নয় । পবিত্র সরকার এতো রেগে গেছেন যে বলেছেন লোকটার  হারেম আছে । মেনন দুজন মেমের প্রেমে পড়িছিলেন । ওনার জিপ কেনার কেলেঙ্কারি তদন্ত করেছিল আয়ঙ্গার সাব-কমিটি আর ১৯৫১ সালের ৯ই এপ্রিল নেহরুর কাছে পেশ করা রিপোর্টে গোলমালের তথ্যগুলো ছিল। তদন্ত হয়েছিল ; সেসব ধামাচাপা পড়ে যায়  পরে, মেননকে কোনও পোর্টফোলিও ছাড়াই অবশ্য মন্ত্রী হিসেবে নেহরু মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে মেনন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর বিশ্বস্ত বন্ধু হন। মহাত্মা গান্ধীর ব্যক্তিগত সচিব , ইউ ভি কল্যাণম , এক সংবাদপত্রের সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, এটা উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে নেহরু, কৃষ্ণমেননের মতো দুর্নীতিবাজ সহকর্মী তৈরি করেছিলেন, যিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী থাকাকালীন কুখ্যাত ‘ জীপ কেলেঙ্কারি ‘তে জড়িয়ে পড়েন৷ 

–পড়েছি, পড়েছি । মিত্রোখিন লিখেছে  যে জোসেফ স্টালিন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু সম্পর্কে ভালো মতামত দেননি । স্ট্যালিন মনে করতেন  নেহেরু আর মহাত্মা গান্ধী দুজনে “সাম্রাজ্যবাদী পুতুল” , যারা ব্রিটিশদের সামনে মাথা নত করেছিল আর তাদের জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, ব্রিটিশদের ভারতে তাদের দখল শক্ত করতে সাহায্য করেছিল। মিত্রোখিন আরও লিখেছে যে ইন্দিরা গান্ধীকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের বিনিময়ে দুকোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল আর সোভিয়েত গুপ্তচরদের অবাক করে দিয়ে, তিনি যে ব্যাগটিতে টাকা পেয়েছিলেন তাও ফেরত দেননি।

–তুই জানিস না বোধহয়, জিন্নার মেয়ে কিন্তু ভারতে থেকে গিয়েছিলেন । ভারত ভাগের সলতে পাকানোয় প্রত্যক্ষ মদত ছিল জিন্নার। সেই কাজে তিনি সফলও হয়েছিলেন। কিন্তু  অনুগামীদের পাশে পেলেও নিজের মেয়েকেই পাকিস্তানে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হন তিনি।উনিশ বছর বয়সেই দিনা মুম্বইয়ের শিল্পপতি নেভিল ওয়াদিয়ার প্রেমে পড়েন। তারপর অনেক ভেবেচিন্তে দু’জনে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। স্বাভাবিকভাবেই বেঁকে বসেন জিন্না। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, এ বিয়ে কোনওমতেই হতে পারে না। একজন পার্সি ছেলের হাতে মেয়েকে কিছুতেই তুলে দিতে পারেন না তিনি। দেশে তো অনেক মুসলিম ছেলে রয়েছে।দিনার জবাব ছিল এরকম— ‘বাবা, তাহলে আপনি ভারতে হাজারো মুসলিম মেয়ে থাকা সত্ত্বেও বেছে বেছে কেন একজন পার্সি রমণীকেই ঘরে আনলেন?’ দিনার মা রতনবাঈ পেটিট ছিলেন পার্সি। বিয়ের পর তিনি মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেন। নাম পাল্টে রাখেন মারিয়ম। যাইহোক, দিনার স্পষ্ট জবাবের ফল ভালো হয়নি। বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। মুম্বইয়ে ফিরে নেভিলের সঙ্গে নতুন করে সংসার পাতেন। এর পরই দম্পতির কোল আলো করে জন্ম নেন নুসলি।  স্বাধীন ভারতীয় নাগরিকের পরিচয়েই বাকি জীবন কাটিয়েছেন।  ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে মৃত্যু হয় তাঁর। মা’য়ের একগুঁয়ে স্বভাব অর্জন করেছেন নুসলি ওয়াদিয়া ।

—আরে ! আপনি তো প্রথম ঘটনাটাই উল্লেখ করলেন না । 

—সেটা আবার কী ? তুই নিজেই বল । আমার ঠিক মনে পড়ছে না ।

১৬ ই আগস্ট ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় মুসলিম লিগের সভা। বিভিন্ন ধরনের প্রাণঘাতী অস্ত্র হাতে সেদিন সভায় উপস্থিত ছিল প্রায় পঞ্চাশ হাজার মুসলমান। মঞ্চে উপস্থিত ছিল হোসেন সোহরাওয়ার্দী‚ খাজা নাজিমুদ্দিন‚ ইস্পাহানি ও মুসলিম লিগপন্থী দলিত নেতা যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। সমর্থকদের উদ্দেশ্যে সোহরাওয়ার্দী সুস্পষ্ট নির্দেশ দেয়‚ “সেনা ও পুলিশকে সংযত করা হয়েছে। চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিলাম‚যা করতে পারিস কর। সভা শেষ হতেই উপস্থিত মুসলমান জনতা প্রথমে আক্রমণ করে সভা দেখতে আসা হিন্দু জনতাদের। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ – হুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে তারা দল বেঁধে ছড়িয়ে পড়ে কলকাতার বিভিন্ন রাস্তা ধরে। অবাধে চলে লুটপাট‚ খুন জখম‚ ধর্ষণ। ক্যানিং স্ট্রিট‚ ওয়েলেসলি স্ট্রিট‚ ধর্মতলা স্ট্রিট‚ কর্পোরেশন স্ট্রিট‚ মানিকতলা রোড আর বিবেকানন্দ রোডে গণলুঠ হয়। লুট হয় কমলালয় স্টোর্স‚ ভারতকলা ভান্ডার‚ লক্ষ্মী স্টোর্সের মতো বিখ্যাত দোকানগুলো। আক্রান্ত হয় উত্তর ও মধ্য কলকাতার হিন্দু পাড়াগুলি। গড়পাড়‚ নারকেলডাঙা‚ বেলেঘাটা‚ ফুলবাগান‚ পার্ক সার্কাস‚ কলুটোলা‚ চিৎপুর জুড়ে সন্ত্রাস চালিয়ে বেড়ায় ‘মুসলিম লিডার’-রা। আর শুধু সাধারণ মানুষই না‚ তাদের আক্রমণ থেকে বাদ পড়েননি অভিনেতা ছবি বিশ্বাস‚ গণিতজ্ঞ যাদব চক্রবর্তী‚ রাজা দেবেন্দ্র মল্লিক‚ ডেপুটি পুলিশ কমিশনার এস.এস.মুখার্জির মতো বিশিষ্ট বাঙ্গালিরাও। আক্ষরিক অর্থেই যেন একখণ্ড নরক নেমে আসে কলকাতার বুকে। নিহত হয় অসংখ্য হিন্দু‚ ধর্ষিতাদের সংখ্যা ছিলো অগুনতি। হিন্দুদের উপর বিজয়ের চিহ্ন স্বরূপ রাস্তার পাশে ধর্ষিতা মৃত মেয়েদের মৃতদেহ ঝুলিয়ে রাখা হয়। আক্রমণ চলল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও। ভিক্টোরিয়া কলেজের লেডিজ হোস্টেল আক্রমণ করে লিগের গুন্ডারা। অন্যান্য মেয়েরা সময়মতো বাড়িতে পালিয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত পালাতে পারেনি চারজন ছাত্রী। হোস্টেলেই ছিল তারা।  হতভাগিনীদের উপর গণধর্ষণ চালিয়ে তাদের হত্যা করে আক্রমণকারীরা। ধর্ষণের পর তাদের স্তন কেটে নিয়ে তারপরে তাদের যৌনাঙ্গে গো-মাংস ঝোলানোর শিক ঢুকিয়ে‚ তাদের মৃতদেহগুলিকে কলেজের দোতলার একটি ক্লাসরুম থেকে প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল হিন্দুদের মধ্যে ভয় সৃষ্টির জন্য। আর শুধু বাঙ্গালিই নয়‚ হিন্দু হলেই আর ছাড় ছিল না কারও। মেটিয়াবুরুজে উড়িয়া শ্রমিকদের বস্তিতে চলে আক্রমণ। কম করে ৫০০ জন উড়িয়া শ্রমিককে সেখানে হত্যা করা হয়েছিলো। অসহায় শ্রমিকদের রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিলো সেদিন হুগলি নদীর জল।

—ঠিক বলেছিস । সেই থেকে কলকাতা হয়ে গেছে হত্যার শহর ।

—দেশভাগ ! ওফ ভাবা যায় না । আমি তখন নোয়াখালিতে । কোনোরকমে বাবা-মায়ের সঙ্গে পালিয়ে এসেছিলেম ।

–তুইও পড়িসনি বোধহয়, ‘ফ্রম প্ল্যাসি টু পাকিস্তান’-বইতে হুমায়ূন মির্জা লিখছেন, “পাকিস্তানের এক সময়কার প্রতিরক্ষা সচিব ইসকান্দার মির্জা, যিনি পরে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতিও হয়েছিলেন, তিনি মি. জিন্নাহকে বলেছিলেন, যে মুসিলম লীগ পাকিস্তান দিল, সেই দলটাকে যেন অবহেলা করা না হয়।”  সঙ্গে সঙ্গে মি. জিন্নাহ পাল্টা জবাব দিয়েছিলেন, “কে বলল মুসলিম লীগ আমাদের পাকিস্তান দিয়েছে? আমি পাকিস্তান বানিয়েছি, আমার স্টেনোগ্রাফারের সাহায্যে।”

–আরে কী যে বলেন, সেই কবে পড়েছি,  খালিদ লতিফ গৌবা এক জায়গায় লিখেছিলেন যে তিনি মি. জিন্নাহকে কোনও একটা মসজিদে নামাজ পড়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। “আমি জানি না কীভাবে নামাজ পড়তে হয়,” জবাব দিয়েছিলেন মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ। মি. গৌবা বলেছিলেন, “মসজিদে অন্যরা যা করবে, আপনিও তাদের দেখাদেখি সেটাই না হয় করবেন।”

–তুমি এটা জানো ? মি. জিন্নাহর সহকারী ছিলেন মুহাম্মদ করিম চাগলা, যিনি পরে ভারতের বিদেশ মন্ত্রী হয়েছিলেন।তিনি আত্মজীবনী ‘রোজেস ইন ডিসেম্বর’-এ লিখেছেন, “একবার আমি আর মি. জিন্নাহ ঠিক করেছিলাম বোম্বের বিখ্যাত রেস্তোরাঁ ‘কর্ণগ্লিয়াজ’-এ খেতে যাব। উনি দু কাপ কফি, পেস্ট্রি আর শুয়োরের মাংসের সসেজ অর্ডার করলেন। আমরা বেশ তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছিলাম। হঠাৎই এক বয়স্ক দাড়িওয়ালা মুসলমান ব্যক্তি ওখানে হাজির হলেন, তাঁর সঙ্গে একটা বছর দশেকের বাচ্চা ছেলে।” “ওঁরা মি. জিন্নাহর বেশ কাছাকাছি বসেছিলেন। হঠাৎ খেয়াল করলাম, ওই বাচ্চা ছেলেটি মি. জিন্নাহর সামনে রাখা সসেজের দিকে হাত বাড়াচ্ছে আর তারপরেই ছোট একটা টুকরো তুলে নিজের মুখে পুরে দিল। আমি এই বাচ্চাটার কাণ্ড দেখে বেশ মজা পাচ্ছিলাম।” একটু পরে ওঁরা চলে গেলেন। তখন মি. জিন্নাহ আমার ওপরে বেশ রেগে গিয়ে বললেন, “চাগলা, তোমার লজ্জা হওয়া উচিত। ওই বাচ্চা ছেলেটাকে শুয়োরের মাংসের সসেজ খেতে দিলে তুমি?”

–ইনডিয়াকে ডিফাইন করে কেলেঙ্কারিগুলো । তোমরা স্বীকার করো বা না করো । স্বাধীন ভারতের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি হয়েছিল ১৯৫৭  সালে । এখনকার কেলেঙ্কারিগুলোর তুলনায় মামুলি, কিন্তু সেসময়ে, সবে সংবিধান মেনে রাষ্ট্র চলতে আরম্ভ করেছে, কেলেঙ্কারিটা ছিল বোমা ফাটার মতন । অর্থমন্ত্রী, টি টি কৃষ্ণমাচারীকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল। জানা যায় যে, ১৯৫৭ সালের জুন মাসে পাবলিক সেক্টর লাইফ ইন্স্যুরেন্স কর্পোরেশন (এলআইসি) কলকাতা-ভিত্তিক ব্যবসায়ী হরিদাস মুন্ধ্রার মালিকানাধীন ছয়টি কোম্পানিতে ১.২৪ কোটি  টাকা মূল্যের জালি স্টক কিনেছিল। . এলআইসির তখন পর্যন্ত ইতিহাসে বিনিয়োগটি সবচেয়ে বড় ছিল, কিন্তু নিয়মানুযায়ী তার বিনিয়োগ কমিটির সঙ্গে পরামর্শ করা হয়নি। ব্যবসায়িক সাংবাদিক সুচেতা দালাল তার শিল্পপতি এ.ডি. শ্রফের জীবনীতে লিখেছেন, “প্রচুর প্রমাণ ছিল,” যে মিঃ মুন্ধরা “কোম্পানিগুলোকে রক্তাক্ত করছিলেন আর বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছিলেন, একই সাথে বাজারে  ফাটকা খেলে দাম বাড়াচ্ছিলেন।”

–আপনিও জানেন কি না জানি না, নেহেরু যুগে, কংগ্রেস প্রায়ই শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করত, যা কখনও কখনও দল এবং সরকারকে সমস্যায় ফেলেছিল। উদাহরণস্বরূপ, যখন মুন্ধরা, একজন শিল্পপতি যিনি 1950 এর দশকে পার্টিকে অর্থায়ন করেছিলেন, আর্থিক সমস্যায় পড়েছিলেন, তখন তিনি সরকারকে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে এটি ফেরত দেওয়ার সময়। নেহেরু বাধ্য হয়ে এলআইসিকে তার কোম্পানির শেয়ার স্ফীত দামে কেনার নির্দেশ দেন। অর্থমন্ত্রী টি টি কৃষ্ণমাচারী, যিনি স্পষ্টতই উপর থেকে নির্দেশে কাজ করছিলেন, সত্য বেরিয়ে এলে চাকরি হারান।

–সবচেয়ে আগে জওয়াহারলাল নেহেরুর প্রেমের কথা বলো ! ওই মোটা লোকটা একজন যুবতীর প্রেমে পড়ে নানা গোলমাল করেছে বলে লোকেরা চেল্লাচ্ছে । নেহেরুর প্রেম নিয়ে সেসময়ে তেমন চেঁচামেচি হয়নি । ডিকি মাউন্টব্যাটেন লোকটাও কেমন ! বউয়ের সঙ্গে ওপন ম্যারেজ চুক্তি করে ফেললো যাতে দুজনে যার সঙ্গে ইচ্ছে প্রেম করতে পারে । কে কার সঙ্গে সেক্স করছে দ্যাট ইজ ইমম্যাটেরিয়াল । দেশ স্বাধীন হতে চলেছে, লক্ষ-লক্ষ মানুষ চোদ্দোপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যাচ্ছে অন্য জায়গায় মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে, কতো বউরা-মেয়েরা ধর্ষিত হচ্ছে, খুনোখুনিতে মারা পড়ছে হাজার-হাজার মানুষ, আর তুমি তখন একজন মেমের সঙ্গে প্রেম করছ। একটা ফোটোতে দেখেছি, মাউন্টব্যাটেন ক্যাবলার মতন দাঁড়িয়ে রয়েছে আর ওর পেছনে হাসাহাসি করছে নেহেরু আর এডউইনা । নকল হাসি নয়, বুকভরা হাসির ছররা ।  জওহরলাল-এডউইনা-মাউন্টব্যাটেনের সম্পর্ক পাবলিকের সামনে আসার পর্বটাও  হয়েছিল  নোংরামি ও কদর্যতার মাধ্যমে, যখন আরেক বিবাহিতা নারী আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিল তার স্বামীর সাথে এডুইনার অবৈধ প্রণয়ের ব্যাপারে নালিশ জানাতে। এছাড়া এডুইনা ভালোবাসার খেলায় মেতেছিল লেসলি হাচিনসন নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পীর সাথেও, যে বিষয়টা পাবলিকের নজরে এলে চারিদিকে ঢি ঢি পড়ে গিয়েছিল।  স্ত্রীর পরকীয়া সম্পর্ক নিয়ে খুব বেশি দুঃখবিলাস করেনি মাউন্টব্যাটেন। অনেকের মতে, স্ত্রী সম্পর্কে মাউন্টব্যাটেন হয়ে পড়েছিল উদাসীন । ১৯২৯ সাল নাগাদ, মাউন্টব্যাটেন এডুইনার সাথে এক  সন্ধিচুক্তি করেছিল, যাকে ওরা বলে ‘খোলা বিয়ে’ । 

–আপনি ওটা জানেন? ওরা যেদিন আমাদের দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছিল, সেদিনের বিদায় সভায় নেহেরু সরাসরি এডউইনাকে সবায়ের সামনে বলেছিল, আপনি যেখানেই গেছেন, আপনি সান্ত্বনা এনেছেন, আপনি আশা এবং উত্সাহ এনেছেন ; এটা কতো আশ্চর্যের বিষয় যে ভারতের জনগণ আপনাকে ভালবাসবে এবং আপনাকে নিজেদের একজন হিসাবে দেখবে এবং আপনি যাচ্ছেন বলে দুঃখিত হবে । ওদের মধ্যে প্লেটোনিক সম্পর্ক ছিল নাকি যৌন সম্পর্ক ছিল তা কেউই জানে না। তার এডউইনার মেয়ে স্বীকার করেছে যে ১৯৪৭ সালের পরেও তারা ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ওরা চিঠি আদান প্রদান করত । ১৯৬০ সালে এডউইনা মারা যান। মেয়ে লিখেছেন যে তার মা নেহেরুর সাথে বেশ উন্মাদভাবে সম্পর্কিত ছিলেন, এতটাই যে মিস্টার মাউন্টব্যাটেনও চোখ বন্ধ করতেন যেমনটি আমরা অনেক ঐতিহাসিক ছবিতে দেখতে পাই ।

–হ্যাঁ, ছবি দেখেছি ।

–নেহেরু সেই সময়ে একজন বিপত্নীক আর সমসাময়িক ভারতীয়দের তুলনায়  ‘আধুনিক’ ছিলেন, তাই এডউইনার সাথে একটি নিবিড় সম্পর্ক গড়ে নিয়েছিলেন, যদিও হয়তো শারীরিক নয় কিন্তু এমন কিছু যা খুব কমই স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের আজও করতে দেয়। এডউইনার ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়, যাঁকে সেই সময়ে সেরা পোশাক পরা মহিলাদের একজন হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছিল, যিনি জমকালোভাবে কেনাকাটা করতেন, পার্টিতে  চটকদার ছিলেন আর ওনার নৌ অফিসার ভাইসরয় স্বামী  তার চেয়ে অনেক বেশি গ্ল্যামারাস ছিলেন। স্বামী লোকটি তার স্ত্রীর সাথে খুব বেশি রোমান্টিকভাবে যুক্ত ছিলেন না । তাঁরও বহু যুবতীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। মাউন্টব্যাটেন একবার বলেছিলেন, তারা দম্পতি হলেও, দুজনেই বিছানায় অন্যদের সাথে বেশি সময় কাটিয়েছেন।

– তুমি এটা বোধহয় শোনোনি ।নেহরুর আগে বা হয়তো তাঁর সাথে থাকাকালীনও, সামাজিক প্রজাপতি এডউইনার অনেক অভিজাত ইংরেজ আর আমেরিকান পুরুষদের সাথে সম্পর্ক ছিল ,এমনকি যৌন সম্পর্ক, অভিজাত থেকে মিডিয়া হাউসের মালিকদের সঙ্গে আর তাও মেয়ের জন্মের পরে।  তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই যে নেহরুর পক্ষে তার সাথে ফ্লার্ট করা সহজ ছিল।

–আমি ইনডিয়াকে ডিফাইন করতে আরেকটা পয়েন্ট দিচ্ছি । যখন ইরফান খান, হিউ গ্রান্ট আর কেট ব্ল্যানচেটকে নিয়ে এই বিষয়ে একটা ফিল্ম তৈরি হচ্ছিল,  তখন এটার শুটিঙ ভারতের গোপন ধমকানিতে  নাটকীয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এর পরের কংগ্রেস সরকারগুলো এই ঘটনাটা লুকিয়ে রাখতে  হয়েছিল। শাসকদের ভয় ছিল গ্রামীণ ভোটব্যাংক। কিন্তু একই সময়ে তারা সম্পূর্ণভাবে বা সম্ভবত অসতর্কতার সাথে এটি অভিজাতদের কাছ থেকে আড়াল করতে ব্যর্থ হয়েছে, যাদের অবশ্য এতে কোন সমস্যা ছিল না । ওই লুকোছাপা থেকেই আরম্ভ হলো রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক দুরাচার ।

–নেহেরুর ভূমিকায় ইরফান খান অসাধারণ অভিনয় করতো । কেন যে লোকটা এতো তাড়াতাড়ি মারা গেল !

–এডউইনার চেয়ে কেট ব্ল্যানচেট হাজারগুণ সুন্দরী । এলিজাবেথ ফিল্মটায় কতো ভালো দেখাচ্ছিল ওনাকে। উনি তো অস্ট্রেলিয়ান, ইংরেজদের মতন ইংরেজি বলতে হয়েছিল । যাই হোক না কেন, কিন্তু  নেহরু সেসময়ে  ‘বামপন্থী’ তরুণদের প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন। রাশিয়ার পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা নকল করে । ওনার প্রেমের গল্প, যদিও স্বর্গীয় নয়, অবশ্যই আকর্ষণীয় আর আনন্দদায়ক ।

–তোকে একটা কথা মানতেই হবে । যাঁরা প্রায়ই নেহরুর যুগকে ভারতীয় গণতন্ত্রের সোনালি সময় বলে দাবি করেন তাঁদের সম্ভবত বুঝতে হবে যে দুর্ভাগ্যবশত, নেহেরুর উত্তরাধিকার আরও বেশি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে কারণ তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্বকালীন সময়ে যে পচন তৈরি হয়েছিল তা আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে পরপর কংগ্রেস সরকারের রাজত্বে । নেহেরুর উন্নয়ন বা শাসনের মডেল যা কংগ্রেস কয়েক দশক ধরে কেন্দ্র আর রাজ্যের স্তরে গর্বের সাথে এগিয়ে নিয়ে গেছে তা আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা দরকার আর দায়িত্ব নির্ধারণ করা দরকার কারণ ভারতের নাগরিকদের দুর্নীতি, অদক্ষতার জন্য বিশাল মূল্য চোকাতে হচ্ছে ।  স্বজনপ্রীতি শাসনের নেহেরু মডেলের বৈশিষ্ট্য হয়ে গেছে ; যে সরকারই গদিতে বসুক তারা স্বজনপ্রীতির মডেলটা দক্ষতার সঙ্গে চালিয়ে গেছে। এটা বললে ভুল হবে না যে আমাদের শাসন ব্যবস্থার তিনটি প্রধান অসুখের শিকড় –- দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর অদক্ষতা, নেহেরু যুগে অঙ্কুরিত  হয়ে এখন মহীরুহ হয়ে গেছে ।

–স্বাধীনতার পরপরই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ভারতীয় কৃষিকে পুনরুজ্জীবিত করা আর লক্ষ লক্ষ ভারতীয়দের পর্যাপ্ত খাবার সরবরাহ করা, যাদের ক্ষুধার্ত থাকতে হচ্ছিল।“কৃষি আর লাখ লাখ মানুষের খাদ্য উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়ায় সামান্য অগ্রগতি দেখা গেছে পরে । ভারতে  খাদ্যের উৎপাদন,  প্রতি একর ফলন উদ্দেশ্যমূলকভাবে কিন্তু বিপজ্জনকভাবে কয়েক বছর ধরে গোপন করা হয়েছিল।  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে লক্ষ লক্ষ টন বিনামূল্যে বা ডাম্প করা খাবারের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কিছু মন্ত্রীর বরং লাভ হচ্ছিল।  চল্লিশের দশকে বাংলার দুর্ভিক্ষ থেকে স্পষ্টতই, নেহরুর সময়ে   কোনও উপযুক্ত শস্যভাণ্ডার বা স্টোরেজ ব্যবস্থা ছিল না। এইভাবে দুর্ভিক্ষ,   শস্য ফটকাবাজ আর মজুতদারদের টাকার ভাঁড়ার উপচে তোলে ।

–প্রকৃতপক্ষে, নেহরুর শহুরে মানসিকতা এবং গ্রামীণ ভারতের সাথে তার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া একটি দক্ষ শাসন মডেল স্থাপনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় শহুরে মন প্রতিফলিত হয়। নেহরু, বেশিরভাগ ভারতীয় রাজনীতিবিদদের মতো, শহুরে ছিলেন। তাদের শহরের বাইরে রাজনীতিবিদরা পানি ছাড়া মাছের মতো। এই কারণেই কৃষিকে, যদিও হাজার হাজার পৃষ্ঠা, লক্ষ লক্ষ শব্দ, এবং বিভিন্ন বিশাল প্রকল্প, যেমন সম্প্রদায়ের উন্নয়ন বা গ্রো মোর ফুড ক্যাম্পেইন দেওয়া হয়েছে, পর্যাপ্ত কার্যকর পদক্ষেপ দেওয়া হয়নি… যেমন নেহরু পরিকল্পনা বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়েছে, এবং তা ছাড়া সাধারণ কৌশল, তারা ছোট কারিগরি স্কুল থেকে শুরু করে বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প পর্যন্ত শত শত বিভিন্ন প্রকল্পে চলে কিন্তু তারা তাদের অগ্রাধিকার বা লক্ষ্যে খুব বেশি অশুদ্ধ হওয়ার প্রবণতা দেখায়; বুদ্ধিবৃত্তিক এবং তারপরে কঠিন প্রযুক্তিগত প্রস্তুতির ভিত্তির খুব অভাব… সম্পাদনে খুব বেশি ত্রুটি যাতে অনেক, সম্ভবত, বেশিরভাগ লক্ষ্য এবং ভার্চুয়াল ব্যর্থতার ক্ষেত্রে একটি ঘাটতি হয়েছে।

–নেহেরু মদ-মাংস খেতেন ?

–নেহেরু  ওয়াইন আর শ্যাম্পেন পছন্দ করতেন, বি.কে.নেহেরুর স্মৃতিচারণ অনুযায়ী । কমিউনিস্ট দেশগুলোর জন্য নিয়ম ভাঙতে ইচ্ছুক ছিলেন, কিন্তু  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে  তিনি অনড় ছিলেন। নেহেরু যখন রাষ্ট্রপতি কেনেডির সাথে দেখা করতে যান, তখন বি কে নেহরুকে দৃঢ়ভাবে বলা হয়েছিল, কোনও হুইস্কি বা জিন নয়; শুধুমাত্র ওয়াইন আর শ্যাম্পেন।  নেহেরু খুব অসুস্থ এবং ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন তাই তিনি নিজেও শ্যাম্পেন ককটেল গিলেছিলেন । বি.কে.নেহেরু লিখেছেন যে নেহেরু সেরিন একটি বড় গ্লাস চোঁচোঁ করে খেয়ে বললেন, এর স্বাদ খুব ভাল, আরও  এক গ্লাস দাও ।

–আমি একটা পয়েন্ট দিচ্ছি ।দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়ে, গান্ধীজির প্রাক্তন ব্যক্তিগত সচিব ভি কল্যাণম, গান্ধী জয়ন্তীর প্রাক্কালে, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুকে আজ দেশে দুর্নীতির ক্রমবর্ধমান মাত্রার জন্য দায়ী করেছেন। এই গান্ধীবাদী, যিনি ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত মহাত্মা গান্ধীর ব্যক্তিগত সচিব হিসাবে কাজ করেছিলেন, দাবি করেছেন, পন্ডিত নেহেরু ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত সৎ ছিলেন। মনমোহন সিংয়ের মতোই সৎ। বর্তমান দুর্নীতির জন্য আমি মনমোহন সিংকেও দায়ী করি। মনমোহন সিং ব্যক্তিগতভাবে খুবই সৎ। কিন্তু তাঁরা দুর্নীতিবাজদের  রক্ষা করেছেন। তাই আমি বলি তারা সবাই দুর্নীতিকে মদদ দিয়েছে। কেউ দুর্নীতিগ্রস্ত হলে, আপনার উচিত তাদের শাস্তি দেওয়া । কারোর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে, তাকে, আপনার উচিত অবিলম্বে বরখাস্ত করা ।  ভারতের স্বাধীনতার এক মাসের মধ্যে, গান্ধীজি পঞ্চাশটি চিঠি পেয়েছিলেন, যার মধ্যে দশটিতে  দেশে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। কল্যাণম অভিযোগ করেছেন, তখন তিনজন ব্যক্তি খুব দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ভি কে কৃষ্ণ মেনন, পন্ডিত নেহরুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী টিটি কৃষ্ণমাচারী আর পাঞ্জাবের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রতাপ সিং কাইরন । কিন্তু নেহেরু তাদের বরখাস্ত করেননি।  আমি এখন ক্রমবর্ধমান দুর্নীতির জন্য নেহেরুকে দায়ী করি।”

–বুঝলেন, আলটিমেটলি,বিউটি অ্যান্ড দি বিস্টের ব্যাপার । কিংবা ব্যাঙ আর রাজকুমারী । ওই দুজনের আর নেহেরু ও কৃষ্ণমেননের প্রেমকে অনুমোদন করে বলল, তোমরা নাস্তিক বলে হিন্দু দেবী-দেবতার খবর রাখো না । জানো, পুরাণের সূর্য আর চন্দ্রের গল্প ?  চন্দ্র দক্ষের সাতাশটা মেয়েকে বিয়ে করেছিল। কিন্তু  কামাসক্ত হয়ে সে দেবগুরু বৃহস্পতির স্ত্রী তারাকে অপহরণ করে সঙ্গম করেছিল । দেবগুরু বৃহস্পতি প্রেমে অভিভূত হয়ে নিজের বড়ো ভাইয়ের স্ত্রী মমতা অন্তস্বত্বা থাকা সত্বেও তার সঙ্গে সঙ্গম করেছিল। আবার ঋগ্বেদে আছে রুদ্রদেব তার নিজের মেয়ে উষার সঙ্গে অজাচারে লিপ্ত হয়েছিল। পৌরাণিক যুগে বিষ্ণুই হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা। কিন্তু তিনিও পরস্ত্রী বৃন্দা ও তুলসীর সতীত্ব নাশ করেছিলেন।

– আচ্ছা, এই সতীত্ব নিয়ে এরকম দুশ্চিন্তা ইউরোপ-আমেরিকায় তো নেই ? ইনডিয়াকে নয়, এই ব্যাপারটা ভারতবর্ষকে ডিফাইন করে ।

–আরে বোলো না ! মিডল ক্লাস ফ্যামিলিতে  যখন মেয়েদের নৈতিকতা সম্পর্কে শেখানো হয়, তখন প্রায়ই সহানুভূতি, দয়া, সাহস বা সততার কথা বলা হয় না। বলা হয় সতীচ্ছদ বা যোনিচ্ছদ নিয়ে । আমি কাজের সূত্রে আরব দেশগুলোতে গেছি । সতীচ্ছদের দেবতা আরব দেশগুলোতে জনপ্রিয়। তুমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করো বা গোপন নাস্তিক হও, কোন ধর্মের তা বিবেচ্য নয়,  পুরুষরা প্রত্যেকেই সতীচ্ছদের দেবতার পূজা করে। সতীচ্ছদ, যা সবচেয়ে অপলকা অংশ, যার ওপর কুমারীত্বের দেবতা বসে আছেন, তাকে  অক্ষত রাখার জন্য যা কিছু সম্ভব করে ওদের দেশের কর্তাবাবারা৷ সতীচ্ছদের দেবতার বেদিতে,  কেবল  মেয়েদের শারীরিক পরিপূর্ণতা আর  আনন্দের অধিকারই নয়, যৌন নিষেধের মুখে তাদের ন্যায়বিচারের অধিকারকেও বলি দেয়া হয় । কখনও কখনও  তাদের বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নেয়া হয়, সম্মানের নামে । অনেক পরিবার তো  তাদের মেয়েদের মেরেও ফ্যালে, জাস্ট সতীচ্ছদের দেবতাকে সন্তুষ্ট রাখবার জন্য। পুরো সমাজ মনে হয় একটা পাতলা সতীচ্ছদের ওপর দাঁড়িয়ে আছে ।

–-কোনো-কোনো বাঙালি ফ্যামিলিরও অমন ছুয়াছুত আছে । হরিয়ানা সাইডে গ্রামে তো সুহাগ রাতের পর বাড়ির বাইরে চাদর টাঙিয়ে রক্তের ছোপ দেখানো হয় পাবলিককে ।

–যাকগে,  তুমি গড আর গডেসদের গল্পটা কনটিনিউ করো ।

–তার চেয়ে অপ্সরাদের গল্প শোনো । অপ্সরা বলে তো আর কিছু হতে পারে না, তাই গল্পগুলো বেশ ইনটারেস্টিঙ।

–আরে, কী যে বলিস ! অপ্সরা হতে পারে না তো তোমাদের পলিটিশিয়ানগুলো কাদের প্রেমে হাবুডুবে খেয়েছে আর এখনও খাচ্ছে ? টিভি আর ফিল্মের নায়িকাদের দেখেছো ? অপ্সরাদের চেয়ে সুন্দরী ।

–শোনো না, বলছি তো অপ্সরাদের কাহিনি । চোখ বুজে কোনো ফিল্মের নায়িকাকে মনে করে নাও। পুরুরবা আর উর্বশীর মিলনের সবচেয়ে পুরোনো উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগ্বেদের সংবাদসুক্তে। সেখানে যে আখ্যান আছে, সে আখ্যান অনুযায়ী উর্বশী চার বছর পুরুরবার সঙ্গে ছিলেন, আর গর্ভবতী হবার পর উনি গায়েব হয়ে যান। শতপথব্ৰাহ্মণের কাহিনী অনুযায়ী উর্বশী কয়েকটা শর্তে পুরুরবার সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে থাকতে রাজী হন । প্রথম, উর্বশী যেন কোনদিন পুরুরবাকে উলঙ্গ না দেখেন, দ্বিতীয়, উর্বশীর বিছানার পাশে ছেলের মতন দুটো ভেড়া বাঁধা থাকবে আর কেউ যেম ভেড়াগুলোকে চুরি না করে। তৃতীয়,  উর্বশী একসন্ধ্যা শুধু ঘি খাবেন । অন্য কাহিনী অনুযায়ী আরও একটা শর্ত ছিল । সেটা হচ্ছে, উৰ্বশী কামাতুরা না হলে, সঙ্গম করা চলবে না। শতপথব্রাহ্মণ অনুযায়ী পুরুরবা শর্তগুলো মেনে নিতে রাজি হন।  পুরুরবা আর উর্বশী পরম সুখে অনেক বছর একসঙ্গে বসবাস করেন । কিন্তু দেবলোকে উর্বশীর অনুপস্থিতে গন্ধৰ্বরা ব্যথিত হয়ে ওঠে । গন্ধর্বরা তখন উৰ্বশীকে দেবলোকে নিয়ে যাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে । পুরুরবার সঙ্গে উর্বশীর বসবাসের শর্তগুলো তারা জানত। তাই ছলচাতুরি  করে তার শর্তগুলো ভাঙাবার উপায় বের করে। একদিন রাতে গন্ধৰ্ব বিশ্বাবসু, উর্বশীর ভেড়া দুটোকে চুরি করে । ভেড়াদের দেখতে না পেয়ে উর্বশী কাঁদতে-কাঁদতে পুরুরবাকে ভেড়া দুটোকে উদ্ধার করবার জন্য অনুরোধ করে । পুরুরবা উলঙ্গ অবস্থাতেই বিছানা থেকে  উঠে  বিশ্বাবসুকে ধরার জন্য দৌড়োয়।  এই সময় দেবতারা বজপাতের সূচনা করে বিদ্যুতের সৃষ্টি করে। বিদ্যুতের আলোকে উর্বশী পুরুরবাকে নগ্ন দেখে তৎক্ষণাৎ তাকে ত্যাগ করে অদৃশ্য হয়ে যায়।

–মুনি-ঋষিরা ল্যাংটো হয়ে শুতো ? ইনডিয়ায় তো কেউ অমন শোয় বলে মনে হয় না । আমেরিকায় শোয়, ইংল্যাণ্ডে জেমস বণ্ড শোয় ।

–আরে, পুরোটা শোনো না । পুরুরবা তখন উর্বশীর খোঁজে সারা দেশ ঘুরে বেড়ায়। একদিন কুরুক্ষেত্রের কাছে একটা পুকুরে পুরুরবা চারজন অপ্সরার সঙ্গে উর্বশীকে স্নান করতে দেখে । পুরুরবা তাকে ফিরে আসতে অনুরোধ করে। উর্বশী বলে, ’আমি তোমার সহবাসে গর্ভবতী হয়েছি। তুমি এক বছর পর আমার সঙ্গে দেখা করলে, আমি তোমাকে আমার প্রথম সন্তান উপহার দেব এবং মাত্র একরাত্রি তোমার সঙ্গে বাস করব । এভাবে দীর্ঘ ছয় বছর কাল এক রাতের জন্য উর্বশী আর পুরুরবার মিলন ঘটতে থাকে। উর্বশীর চিরসঙ্গী ও চিরপ্রেমিক উর্বশীর গর্ভে মোট ছয় সন্তান হয়,  আয়ু, বিশ্বায়ু, অমাবসু, বলায়ু দৃঢ়ায়ু ও শতায়ু ।

–তবে ? ভেবে দ্যাখো ! সামনের মারোয়াড়ি ফ্যামিলিতে একটা বউয়ের ছেলে হলো না বলে দুই ভাই মারামারি করে আলাদা হয়ে গেল !

–নেহেরুর মেয়ে ইন্দিরা গান্ধীও কম যান না । ওনার সম্পর্কেও অনেকে নানা কথা লিখে গেছে ওনার কাছের লোকেরা ।

–হ্যাঁ, এমারজেন্সি, অপারেশান ব্লু স্টার, ঝুপড়ির মুসলমানদের খোজা বানানো, জিপগাড়ি স্ক্যাণ্ডাল । পরে, ১৯৬৯ সালে কংগ্রেস ভাঙার পর, ইন্দিরা গান্ধী টাকার জন্য কমিউনিস্ট দেশগুলোর ওপর খুব বেশি নির্ভর করতে শুরু করেন। স্বাভাবিকভাবেই, সোভিয়েতরা তাঁকে উদ্ধার করেছিল। একটু আগে কথা উঠেছিল ভাসিলি মিত্রোখিনের, যিনি কেজিবি আর্কাইভসের দায়িত্বে ছিলেন, ১৯৭১ সালের নির্বাচনের আগে মস্কো কীভাবে কংগ্রেসের কার্যক্রমে টাকা যুগিয়েছিল সে সম্পর্কে বিস্ফোরক তথ্য প্রকাশ করেছেন। এমনকি ইন্দিরা গান্ধির ক্যাবিনেটেও সোভিয়েটের চর ছিল।

–ইতিহাস পড়েছিস ? মুঘল আমলে ছিল নজরানা, সেটাই স্বাধীনতার পর উৎকোচ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নজরানার অ্যামাউন্ট দুর্নীতিবাজ কাজীদের  আদালতে মামলার ভাগ্য নির্ধারণ করতো । নজরানা দিতে না পারলে চাষীদের না খেয়ে মরতে হতো । অনেক সময়ে  একজন দরবারী বা মনসবদারের চতুর্থবার বিয়ে করা নির্ভর করতো নজরানার ওপর। জাহাঙ্গিরের আমলে নজরানার নোংরামি নিয়ে লিখে গেছেন নেদারল্যাণ্ডসের পর্যটকরা। ওই ব্যাপারটাই নেহেরুর বংশের লোকেরা চালিয়ে গেছে ।

–আপনি কী জানেন, বি জি দেশমুখ, যিনি ১৯৮৬-৮৯ সালে মন্ত্রিপরিষদের সচিব ছিলেন, তিনি  আত্মজীবনীতে লিখেছেন: বোফর্স ঘটনার সূত্রপাত ইন্দিরা গান্ধীর শুরু করা প্যাঁচের  মধ্যে পড়ে । কংগ্রেস পার্টির জন্য তহবিল সংগ্রহের জন্য ওনার ছেলে সঞ্জয় তাকে আরও চেকনাই দিয়েছিল৷  ইন্দিরা, তিনি বলেছেন নির্বাচনের  জন্য আর দলের অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য টাকা তোলা জরুরি মনে করেছিলেন। এর জন্য, তিনি রজনী প্যাটেল আর বসন্তরাও নায়েকের মতো অনুগত সমর্থকদের উপর নির্ভর করতেন। যখন ইন্দিরা ভারতীয় রাজনীতিতে তাঁর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করলেন, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে টাকা যোগাড়ের আরও ভাল উপায় হল বিদেশী লেনদেন থেকে কাটমানি নেয়া। সঞ্জয় গান্ধী ১৯৭২ সাল থেকে একে আরও নিখুঁত ও পরিমার্জিত করে ফেলেছিল ।

–জানি, জানি, তুইই তো বইটা দিয়েছিলিস ।সেই যুগের আরও দু’জন সমানভাবে অপ্রতিরোধ্য সাক্ষী হলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি  ভেঙ্কটারমন এবং শিল্পপতি জে আর ডি টাটা। তার আত্মজীবনী মাই প্রেসিডেন্সিয়াল ইয়ার্স বইতে, ভেঙ্কটারমন টাটার সঙ্গে তাঁর  কথোপকথন বর্ণনা করেছেন। টাটা  বোফর্সের কাছ থেকে কংগ্রেস পার্টির কমিশনের প্রাপ্তি অস্বীকার করা কঠিন । কারণ টাটা অনুভব করেছিলেন যে ১৯৮০ সাল থেকে, শিল্পপতিদের টাকা দেবার জন্য যোগাযোগ করা হতো না । শিল্পপতিরা বুঝতে পেরেছিলেন  যে শাসক দল  কমিশন তুলছিলেন অস্ত্রচুক্তিগুলো থেকে । ব্যাপারটা তহবিল সংগ্রহের প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি হয়ে গিয়েছিল, তাই বোফর্স যে ঘটবে তা জানা কথা। এই কেলেঙ্কারিতে, রাজীব আর অন্যদের বিরুদ্ধে কমিশন নেবার অভিযোগ ছিল, সুইডিশ অস্ত্র প্রস্তুতকারক বোফর্সের কাছ থেকে । ভারত যখন সেনাবাহিনীর জন্য ফিল্ডগান কিনেছিল তখন কিকব্যাক নেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল। রাজীব সংসদে এই অভিযোগ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেন। যাইহোক, নেহেরু-গান্ধীরা কখনই ব্যাখ্যা করতে পারেননি যে  বোফর্স কোম্পানি কেন মারিয়া এবং ওটাভিও কোয়াত্রোচির অ্যাকাউন্টে  ৭.৩  মিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছিল। 

–এই লোকটা স্ট্রেঞ্জ ! কোয়াত্রোচিরা এই টাকা বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ব্যাঙ্কে সরিয়ে রাখা আরম্ভ করেছিল।  শেষে  চ্যানেল দ্বীপপুঞ্জে নিয়ে গিয়ে রেখেছিল । বাজপেয়ী সরকার যুক্তরাজ্য সরকারকে এই অ্যাকাউন্টটি সিজ করতে বলেছিল, কিন্তু মনমোহন সিং সরকার লন্ডনকে তা প্রত্যাহার করতে আদেশ দেয়, যার ফলে কোয়াত্রোচিরা শেষ পর্যন্ত ৭.৩ মিলিয়ন ডলার নিয়ে পালিয়ে যায়। ভারত যখন তার সেনাবাহিনীর জন্য ফিল্ডগান কিনছিল তখন কেন একজন ইতালীয় ব্যবসায়ী কমিশন খেয়েছিল ? কেন সোনিয়া গান্ধী মনমোহন সিং সরকারকে কোয়াত্রোচিদের অ্যাকাউন্ট ডিফ্রিজ করতে আদেশ দিয়েছিলেন? 

–ওই সময়ের আরেকটা ঘটনা হলো জাতিসংঘের খাদ্য’র জন্য তেল কর্মসূচির অধীনে ইরাকি তেল বিক্রির অ-চুক্তিমূলক সুবিধাভোগীদের বিষয়ে ভলকার কমিটির রিপোর্টে । তাতে বলা হয়েছে  যে ইরাকি স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেন কংগ্রেসকে বেশ মোটা টাকা দিয়েছিলেন । মনে রাখা দরকার যে সাদ্দাম হোসেনের ইরাক ছিল জরুরী অবস্থার সময় ইন্দিরা গান্ধীর একনায়কত্বকে সমর্থনকারী দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে একটি । 

–ভালো বলেছো ।ওনার কাটমানির গল্প ছাড়াও প্রেমের নানা কাহিনি শুনেছি আর পড়েছি । তরুণী আর যুবতী থাকাকালে, এমনকি বিয়ের পরেও একাধিক প্রেমে পড়েছিলেন । ইন্দিরার এসব প্রেম কাহিনি পাওয়া যায় তার জীবনী লেখিকা ক্যাথেরিন ফ্রাঙ্কের  ‘দ্য লাইফ অব ইন্দিরা নেহেরু গান্ধী’ বইতে। এছাড়া পাওয়া যায় নেহেরুর সচিব এম ও মাথাইয়ের আত্মজীবনীতেও।

–হ্যাঁ, তোর কাছেই শুনেছিলাম । ১৯৩৬ সালে ইন্দিরার মা কমলা নেহেরু মারা যাওয়ার পর ইংল্যাণ্ডে পড়াশুনা করতে যান ইন্দিরা গান্ধী। সেখানে তাঁর সাথে প্রেম হয় ফিরোজ গান্ধীর আর ১৯৪২ সালে  বিয়ে করেন তাঁকে । ফিরোজ গান্ধী ছিলেন  পার্সি । এ কারণে এ বিয়ে মেনে নিতে চাননি তার বাবা জওহরলাল নেহেরু। বিয়েতে আপত্তি ছিল মহাত্মা গান্ধীরও। তবে কোনো কিছুই বাধা হতে পারেনি। অবশ্য শেষ পর্যন্ত সুখের হয়নি তাদের এ বিয়ে। বিবাহ বিচ্ছেদ না ঘটলেও ১৯৫০ সালের পর আর একসাথে থাকা হয়নি ফিরোজ-ইন্দিরার। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা শেষ না করেই ভারতে ফিরে আসেন তিনি। তাঁর বাবা তাকে ভর্তি করে দেন রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে। সেখানে তিনি প্রেমে পড়েন এক জার্মান শিক্ষকের। ওই শিক্ষক তাঁকে জার্মান ভাষা শেখাতেন। ১৯৫০ সালে ফিরোজ গান্ধীর সাথে সম্পর্কচ্ছেদের পর থেকে ইন্দিরা তাঁর বাবার একান্ত সহকারী হিসেবে কাজ করতেন তাঁদের ‘তিন মূর্তি ভবনে’। এখানে  তিনি প্রেমে পড়েন তাঁর বাবার সচিব এম ও মাথাইয়ের। মাথাইয়ের সাথে তাঁর প্রেম চলে প্রায় ১২ বছর। শেষ পর্যন্ত ইন্দিরার যোগ শিক্ষক ধীরেন্দ্র ব্রহ্মচারীর কাছে হেরে যান মাথাই। এসব ঘটনা ইতিহাসবিদ এস. গোপালের বইতে পাওয়া যায়। যেহেতু মাথাই দেখতে সুদর্শন ছিল না, সেদিক থেকে ধীরেন্দ্র ছিল অনেক বেশি সুদর্শন এক বিহারী যুবক। এরপর ইন্দিরার জীবনে আসেন দিনেশ সিং। সে প্রতিদিন প্রধানমন্ত্রী ভবনে গিয়ে আড্ডা দিতো ইন্দিরার সাথে। তারপর থেকেই শুরু হয় প্রেম। দিনেশ সিং ছিলেন জওহরলাল নেহেরুর মন্ত্রিসভার বিদেশমন্ত্রী। এর মধ্যে ফিরোজ গান্ধীর সাথে সম্পর্ক থাকাকালেই আরো একজনের সাথে প্রেম ছিল ইন্দিরার। তার নাম মোহাম্মদ ইউনুস। কে এন রাও তার ‘নেহেরু ডায়নাস্টি’ বইতে লিখেছেন, ইন্দিরার ছোট ছেলে সঞ্জয় গান্ধী মূলত ইন্দিরা-ইউনুসের ছেলে। কারণ সঞ্জয় মানেকাকে বিয়ে করায় ইউনুস ছিল ক্ষুব্ধ। একজন শিখ মেয়ের সাথে নিজের ছেলের বিয়ে মেনে নিতে পারেনি সে। ঘটনাটি মোহাম্মদ ইউনুসের লেখা ‘পারসন, প্যাশন অ্যান্ড পলিটিক্স’ বইতেও পাওয়া যায়।  এতসব সত্ত্বেও রাজনীতিতে কোনো কিছুই বাধা হতে পারেনি ইন্দিরার। 

–ধ্যুৎ, গাঁজা, পলিটিশিয়ানদের অতো সময় আছে নাকি যে প্রেম করবে !

–আর কী জানেন ? ভোটারদের দ্বারা নির্বাচিত  শব্দটা একটা ফাঁকা কথা । আমাদের ইসকুল-কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান আর অর্থনীতির বইগুলো ফালতু । আমাদের দেশটাকে একদল  অলিগার্ক, বিগ বিজনেস আর  একটা সংকীর্ণ, স্বার্থপর, রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক অভিজাতরা  হাইজ্যাক করে নিয়েছে । একটা ছোট এবং বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত গোষ্ঠী যারা টাকাকড়ি লুট করার  জন্য শাসন করে । এই এলিটরা , দেশপ্রেম আর গণতন্ত্রের নামে, সমস্ত মূল্যবোধের নামে, যা একসময় প্রাচীন ভারতীয় ব্যবস্থার অংশ ছিল,  পরিকল্পিতভাবে  ধ্বংস করেছে, কোষাগার লুট করেছে, আমাদের গণতন্ত্রকে কলুষিত করেছে আর পাবলিকের মাথায় হেগেছে । 

–আচ্ছা, সারদা কেলেঙ্কারিটা কী ব্যাপার ? ওটা কি সলভ হয়ে গেছে ? নাকি ধামাচাপা পড়ে গেছে ?

–জানেন না ? ওটা পশ্চিমবঙ্গের একটা পনজি স্কিমের নাম । 

–পনজি মানে ?

–তাও জানেন না ? পনজি  হচ্ছে এক ধরনের কূট কৌশল যেখানে নতুন বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে আদায় করা টাকা পুরনো বিনিয়োগকারীদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। চার্লস পনজি নামের এক ব্যক্তির নাম থেকে এটা চালু হয়েছে। পঞ্জি স্কিমগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করার মাধ্যমে তাদের বিনিয়োগের সর্বস্ব আত্মসাত করা। এ ধরনের স্কিম থেকে মূল পরিকল্পনাকারীই কেবল লাভবান হয়ে থাকেন। সঙ্গতভাবেই এ ধরনের ব্যবসার আইনি বৈধতা থাকে না। পঞ্জি স্কিমগুলোতে কোনো প্রকৃত পণ্য, সেবা বা ব্যবসায়িক কাঠামো থাকে না। থাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে উপস্থাপন করা কিছু মিথ্যা প্রতিশ্রুতি অথবা প্রস্তাবনা। সহজে অর্থ আয় করার লোভ থেকে বিনিয়োগকারীরা এর ফাঁদে পড়ে পুঁজি হারান। সাধারণ মানুষের লোভকে কাজে লাগিয়ে ব্যক্তি বিশেষের লাভবান হওয়ার এমন পঞ্জি স্কিমের ইতিহাস বেশ পুরনো। ঞ্জি স্কিমগুলো মূলত পিরামিড আকৃতির কাঠামোর হয়ে থাকে, যার একেবারে চূড়ায় থাকে মূল পরিকল্পনাকারীরা, যারা স্কিমটি শুরু করেন। এরপর থাকে প্রাথমিক সদস্যরা। প্রাথমিক সদস্যরা নতুন সদস্য সংগ্রহ করেন, যারা তাদের নিচের ধাপে থাকে এবং এভাবে সদস্য দ্বারা সদস্য সংগ্রহের প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকার মাধ্যমে উপর থেকে নিচের দিকে ছড়ানো একটি পিরামিড আকারের গ্রাহক অবস্থান তৈরি হয়। এই পিরামিডের যতই নিচের দিকে যাওয়া যাবে, ততই এর আকৃতিটি ছড়ানো হয়। অর্থাৎ সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। পুরো পরিকল্পনা থেকে মূল পরিকল্পনাকারী ও প্রাথমিক সদস্যরাই কেবল লাভবান হতে পারেন। স্বল্পমেয়াদে মুনাফা সহ বিনিয়োগ ফেরৎ পাবার টোপ দেখিয়ে নতুন নতুন গ্রাহক তৈরি করা হয়। নতুন গ্রাহকরা মনে করেন, তারা যদি আরও কিছু গ্রাহককে ঘোষিত স্কিমে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন তবে তার মুনাফা আরো বাড়বে। তবে পঞ্জি স্কিমগুলো থেকে গ্রাহকরা শেষপর্যন্ত ক্ষতির শিকার হয়ে থাকেন।

আমি বলছি, আমি বলছি । বামফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকার সময়েই সুদীপ্ত সেন গুছিয়ে তুলছিলেন তাঁর বেআইনি কাজের ভিত। ২০০৯ সাল থেকে সেবি  সারদার উপর নজরদারি শুরু করে। ২০১১ সালে তারা রাজ্য সরকারকে সারদার সন্দেহজনক গতিবিধির কথা জানায়। ২০১২ সালে সেবি সারদা সংস্থাকে বিনিয়োগ সংস্থা হিসেবে কাজ না করতে বলে, কিন্তু সারদা তাতে সাড়া দেয়নি। ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে সংস্থা ধসে পড়ার আগে পর্যন্ত কাজ চালিয়ে গিয়েছে তারা। ব্র্যান্ড তৈরির ব্যাপারে, জনমানসে সংস্থার ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সারদা তথা সুদীপ্ত সেনের নজর ছিল সবচেয়ে বেশি। এ ব্যাপারে কাজে লাগানো হয়েছিল রাজ্যের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস ও সে দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন পরিচিত মুখকে। ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করা হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ শতাব্দী রায়কে। সারদা গোষ্ঠীর মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করা হয় তৃণমূল কংগ্রেসের তৎকালীন রাজ্যসভা সাংসদ মিঠুন চক্রবর্তীকে । তৃণমূল কংগ্রেসের আরেক সাংসদ কুণাল ঘোষকে সারদা মিডিয়া গোষ্ঠীর সিইও নিযুক্ত করা হয়। তিনি মাসে ১৬ লক্ষ টাকা বেতন পেতেন।  আরেক তৃণমূল সাংসদ সৃঞ্জয় বসুর সঙ্গে সারদা মিডিয়া গোষ্ঠী ছিল ঘনিষ্ঠ। তৃণমূল কংগ্রেসের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র ছিলেন সারদা গোষ্ঠীর কর্মী ইউনিয়নের শীর্ষে ছিলেন। তিনি প্রকাশ্যেই সারদায় টাকা খাটানোর পরামর্শ দিতেন। কলকাতা পুলিশকে মোটর সাইকেল উপহার দিয়েছিল সারদা গোষ্ঠী। রাজ্যের নকশাল অধ্যুষিত এলাকায় অ্যাম্বুল্যান্স এবং মোটর সাইকেল প্রদান করে সরকার, যা স্পনসর করেছিল সারদা গোষ্ঠী। ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল সিবিআই-কে একটি চিঠি লেখেন সুদীপ্ত সেন। তাতে তিনি লিখেছিলেন, বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতাদের তিনি প্রচুর পরিমাণ অর্থ দিয়েছেন। কুণাল ঘোষের চাপাচাপিতেই যে তিনি লোকসানভোগী মিডিয়া গোষ্ঠীতে বিনিয়োগ করেন, এবং তাঁর ব্ল্যাকমেলের জন্যই বাজার দরের চেয়ে কম অর্থে একটি টেলিভিশন চ্যানেল বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন, সে কথাও বলেছিলেন তিনি। তদন্ত শুরুর পর তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত নেতাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। সিবিআই গ্রেফতার করে সৃঞ্জয় বসু, মদন মিত্র ও কুণাল ঘোষকে। জেরা করা হয় টিএমসি সহ সভাপতি তথা রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি রজত মজুমদার, তৃণমূল যুব কংগ্রেসের প্রধান শঙ্কুদেব পাণ্ডা, সাংসদ শতাব্দী রায় এবং তাপস পালকে। মমতার নির্ভরযোগ্য সাথী, বর্তমান বিজেপি নেতা মুকুল রায়কেও জেরা করেছিল সিবিআই।সারদা কাণ্ডে সুদীপ্ত সেন গ্রেফতার হবার পর, গোটা সারদা প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ার পর, দেরাজ থেকে কঙ্কালের মত বেরিয়ে আসতে থাকে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে সারদার যোগ। নাম জডায়নি, এমন কোনও নেতার সংখ্যা হাতে গোণা। আর সারা রাজ্য জুড়ে অসংখ্য তৃণমূলের ছোট-বড় নেতা কর্মীরা যে এই পঞ্জি স্কিমের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাও প্রকাশ্য হতে থাকে।সারদা কেলেংকারি ফাঁস হবার পর মমতা সরকার এর তদন্তে পুলিশের এক বিশেষ তদন্তদল গঠন করে। সে তদন্তদলের শীর্ষে ছিলেন রাজীব কুমার। অভিযোগ, বিশেষ তদন্ত দল সারদার সল্টলেকে অবস্থিত অফিস থেকে বেশ কিছু জিনিস বাজেয়াপ্ত করে, যার মধ্যে ছিল একটি লাল ডায়েরি ও একটি পেন ড্রাইভ। এই দুটিতেই নাকি ছিল যেসব প্রভাশালীদের অর্থ দেওয়া হয়েছে, তাদের নাম। সিবিআইয়ের বক্তব্য সিট এই দুটি জিনিস তাদের কাছে জমা দিচ্ছে না। এ ব্যাপারে রাজীব কুমারকে সন্দেহ করে তারা। সিবিআই রাজীব কুমারের বাড়িতে তল্লাশি করতে এলে, তা প্রতিক্রিয়ায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গণতন্ত্র বাঁচানোর দাবিতে ৪৫ ঘন্টা ধর্নায় বসেন ধর্মতলা চত্বরে। মমতার এই প্রতিক্রিয়ার পর, লাল ডায়েরি ও পেন ড্রাইভে কাদের নাম রয়েছে তা নিয়ে সন্দেহ ঘোরতর হতে থাকে। 

–আর নারদা কেলেঙ্কারি ?

পশ্চিমবঙ্গের দুটি আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা রাজ্যের মানুষকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছিল। এর একটি হলো সারদা এবং অন্যটি নারদ। এই দুটি আর্থিক কেলেঙ্কারি মামলায় জড়িয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল। সরদাকাণ্ডে জড়িয়ে কারাদণ্ড ভোগও করেছেন তৃণমূলের সাংসদেরা। ম্যাথিউ স্যামুয়েল এবং তাঁর সহকর্মী অ্যাঞ্জেল আব্রাহাম, এই দুই জন মিলে আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত ৫২ ঘণ্টা ব্যাপী একটি স্টিং অপারেশন চালান। এই ভিডিও ২০১৬ সালে জনসমক্ষে প্রকাশ্যে আসে। এই স্টিং অপারেশনে প্রমাণ সংগ্রহের জন্য গোপন ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়েছিল। গোপন ক্যামেরারূপী এই অস্ত্রে কিছু পরিচিত নেতাদেরই মুখ অভিযুক্ত হিসাবে জনসমক্ষে আসে। এই তালিকায় রয়েছেন, ফিরহাদ হাকিম, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, মদন মিত্র, মুকুল রায়, শুভেন্দু অধিকারী, কাকলি ঘোষ দস্তিদার, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুলতান আহমেদ, অপরূপা পোদ্দার, শঙ্কুদেব পণ্ডা, আইপিএস অফিসার এস এম এইচ মির্জা প্রমুখ। এই ভিডিও ক্লিপে দেখা যায় এই তালিকাভুক্ত সবাই কিছু বিশেষ প্রতিশ্রুতির পরিবর্তে টাকা নিয়েছেন। এদিকে, স্টিং অপারেশনে ব্যবহৃত ৮৫ লক্ষ টাকা ম্যাথিউ কোথা থেকে পেল, এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হলে, ম্যাথিউ জানান যে তিনি সাংসদ কে. ডি. সিং-এর সংস্থার থেকে পেয়েছেন। ম্যাথিউয়ের বক্তব্যকে যাচাই করতে এ বিষয়ে আবার তদন্ত শুরু হয়। এই তদন্তে, ম্যাথিউর দাবিকে খারিজ করে দেয়। এরপরে, ম্যাথিউকে অনেকবার নোটিশ পাঠানো হলেও, ম্যাথিউর তরফ থেকে কোনো প্রকারের সাড়া পাওয়া যায়নি।এরই মাঝে, একুশের বিধানসভা নির্বাচনের আগে নারদা কান্ড নয়া মোড় নেয়। তৃণমূল দাবি করে যে, স্টিং অপারেশনের ফুটেজে তৃণমূল ত্যাগী ও বিজেপিতে যোগদানকারী মুকুল ও শুভেন্দুর ফুটেজ অনুপস্থিত। যদি বিজেপির তরফ থেকে এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।উল্লেখ্য, সিবিআই-এর তরফে এই প্রথমবার নারদা মামলায় চার্জশিট পেশ করা হয়েছে। ২০১৬ সালের মার্চ মাসে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের বেশ কয়েকজন নেতা, মন্ত্রী, সাংসদ ও বিধায়কদের অর্থ গ্রহণের এক চাঞ্চল্যকর ভিডিও তথ্য ফাঁস করে প্রচারের আলোতে উঠে এসেছিল দিল্লির নারদ নিউজ ডট কম নামের একটি ওয়েব পোর্টাল। সেদিন তারা তৃণমূল কংগ্রেসের ওই সব নেতা, মন্ত্রী, বিধায়কদের গোপনে অর্থ গ্রহণের ফুটেজ ফাঁস করে দিয়েছিল। সেই ভিডিওটি আবার কলকাতার রাজ্য বিজেপির কার্যালয়েও সেদিন ফাঁস করে দিয়েছিল বিজেপি। ওই স্টিং অপারেশনের ভিডিও ফুটেজে দেখা গিয়েছিল, তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক নেতা ও মন্ত্রীদের ঘরে ঘরে, হাতে হাতে পৌঁছে যাচ্ছে টাকা। তাঁরা তা গ্রহণও করছেন।  

–আরেকটা হয়েছিল রোজভ্যালি কেলেঙ্কারি ? সেটাও পঞ্জি স্কিম ?

–সেটা চিটফাণ্ড স্কিম । রোজভ্যালি  চিটফান্ড কাণ্ডে এবার সাজা ঘোষণার পালা। সংস্থার এক আধিকারিক অরুণ মুখোপাধ্যায়কে সাত বছরের কারাবাসের সাজা দিল নগর দায়রা আদালত। সেইসঙ্গে আড়াই লক্ষ টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও ৬ মাস কারাবন্দি থাকতে হবে তাঁকে। এই প্রথমবার রোজভ্যালি সংস্থার একাধিক মামলার মধ্যে একটিতে সাজা ঘোষণা হল।ভুয়ো সংস্থার আর্থিক কেলেঙ্কারি নিয়ে বেশ কয়েকটি মামলা চলছিল রোজভ্যালির। শেয়ার ডিবেঞ্চার সংক্রান্ত একটি মামলায় সংস্থার কর্ণধার গৌতম কুণ্ডু-সহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রায় ১৩ কোটি টাকা আর্থিক তছরূপের মামলার তদন্ত করছিল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট । তাদের দেওয়া চার্জশিটে ছিল ৯ জনের নামই। এরপর চার্জ গঠনের সময়ে অন্যতম অভিযুক্ত সংস্থার আধিকারিক অরুণ মুখোপাধ্যায় নিজেই কেলেঙ্কারির দায় নিজের কাঁধে নেন। ফলে তিনি একাই দোষী সাব্যস্ত হন। শুক্রবার তাঁকে ৭ বছরের জন্য কারাবাসের সাজা শোনাল নগর দায়রা আদালত। গ্রেপ্তার হওয়ার পর ইতিমধ্যে অরুণ মুখোপাধ্যায়ের ৪ বছর কারাবাসের মেয়াদ শেষ হয়েছে। ফলে আর তিন বছর জেলে কাটাতে হবে তাঁকে।

—ময়দা, সবচেয়ে কোরাপ্ট কারা জানেন ?

–কারা ?

–অনেক, অনেক । সুরেশ কলমাডি ; ওনাকে মুম্বাইতে বলা হয়  ওয়ান ম্যান আর্মি। একশো কোটি টাকার বেশি একাই গেঁড়িয়েছে কলমাডি। কমনওয়েলথ গেমস কেলেঙ্কারিতে তিহার জেলে ছিল ; এখন কোথায় জানি না । দুনম্বরে, আন্দিমুথু রাজা : টুজি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারির কথা মনে আছে? হ্যাঁ,  মুথু কুখ্যাত টুজি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারিতে ১৭৬০০০ কোটি টাকা গেঁড়িয়েছিল । জেল-ফেল হয়নি, দিব্বি জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছে। তিন নম্বরে মায়াবতী :  সবাই জানে যে উনি  মুখ্যমন্ত্রীর পদের অপব্যবহার করে সফলভাবে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছেন। তাজ করিডরে রোজগার করেছেন, নিম্নবর্ণের লোকেদের কাছ থেকে টাকা তুলেছেন, লখনউতে বিশাল পার্ক করেছেন, পুরোটা সিমেন্টের, তাতে  হাতি, ওনার আর ওনার গুরুর মূর্তিতে ছয়লাপ। চার নম্বরে  লালু প্রসাদ যাদব: জোকারি করে বেশ জনপ্রিয় । পশুখাদ্য কেলেঙ্কারিতে তিন হাজার কোটি টাকা গেঁড়িয়েছিলেন আর জেল খেটেছিলেন । জেল মানে ফাইভ স্টার হাসপাতাল। পাঁচ নম্বরে শরদ পাওয়ার:  ভারতের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা , এককালে দাউদ ইব্রাহিমের গুরু । রামগোপাল ভর্মার ফিল্মে উনি একজন ক্যারেক্টার । জাল স্ট্যাম্প মামলায় জড়িয়ে ছিলেন যার মাধ্যমে  হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করেছেন। তার বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির মামলা হলেও তিনি মুক্ত ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পাক্কা খিলাড়ি। ছয় নম্বরে ভি কে শশিকলা:  সুপ্রিম কোর্ট  অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদের জন্য জেলে পাঠিয়েছিল । কর্নাটকের জেলে ছিল বলে তামিলদের পার্টি বেশ চটে গিয়েছিল । তারপর ধরাধরি করে জেলেই ভালো ঘর আর খাবার-দাবারের ব্যবস্হা হয় । সাত নম্বর জয়ললিতা: তামিলরা ডাকতো আম্মা । বেঁচে থাকতে ওনার বিরুদ্ধে ৪৬টা দুর্নীতির মামলা দায়ের হয়েছিল। কয়লা আমদানি কেলেঙ্কারি, তানসি জমির লেনদেন মামলার অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ,  আরও অনেক মামলায়  জড়িয়ে ছিলেন।আট নম্বরে বিএস ইয়েদুরাপ্পা: ঘুরেফিরে কর্ণাটকের  মুখ্যমন্ত্রী হয়, বেশ কয়েকটা জেলার  আকরিক লোহা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে  ছিল। দুর্নীতির দায়ে  মন্ত্রীর পদ খুইয়েছিল।নয় নম্বরে মধু কোডা: ভারতের সবচেয়ে দুর্নাম মন্ত্রীদের একজন। কোডার বিরুদ্ধে অবৈধ খনির ইজারা লাইসেন্স দিয়ে ঝাড়খণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণের অভিযোগ ছিল।  ক্ষমতায় থাকাকালীন জমানো সম্পদ লুকিয়ে রেখেছিলেন। তাকে গ্রেফতার করে জেলে পোরা হয়েছিল। দশ নম্বরে মুলায়ম সিং যাদব: আরেকজন মহা ঘোড়েল দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী যাকে  মায়াবতীর সঙ্গে তুলনা করা হয়। যখনই অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পত্তির মামলা হয়, তখনই মুলায়ম সিংয়ের নাম উঠে আসে।

–ব্যাস দশজন ? আমি তো ভেবেছিলুম একশো জনের নাম বলবে । আচ্ছা মনমোহন সিংকে কী বলবে ? আমি তাকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত মনে করি । উনি সোনিয়া গান্ধীর  ছদ্মনামের মতো আচরণ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদকে লজ্জা দিয়েছেন। কংগ্রেসের বিপক্ষদের আক্রমণ করার জন্য  সিবিআইকে লেলিয়ে  হেয় করেছেন। অনেক কেলেঙ্কারী, অনেক বিতর্ক, কিন্তু তিনি কখনই কোন কিছুর জন্য নিজেকে দায়ী মনে করেননি। অত্যন্ত যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও উনি বোবা হয়ে সমস্ত নোংরামি সহ্য করেছেন আর একটি শব্দও বলেননি।

–আরে ওনার কথা বাদ দাও । সবাই জানে উনি নিজেকে পরিষ্কার রাখতে সফল । কিন্তু সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন ছিলেন মানিক সরকার, ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী, নিজের গাড়ি-বাড়ি ছিল না । টাকার জোরে বিজেপি দখল করে নিলো ত্রিপুরা রাজ্যকে ।

–কোরার সাইটে কোরাপ্ট কারা জানতে চাওয়া হলে একজন এই তালিকা দিয়েছে, তুই তাদের অনেককে বাদ দিয়েছিস । লোকগুলো হলো, জওয়াহারলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধি, রাজিভ গান্ধি, সোনিয়া মাইনো ( গান্ধি ), রাহুল গান্ধি, প্রিয়ঙ্কা ভদ্রা, শরদ পাওয়ার, আহমদ প্যাটেল, পি চিদাম্বরম, কপিল সিবাল, অভিষেক সংভি, কমলনাথ, সুশীলকুমার শিন্দে, দেভে গউড়া, পৃথ্বীরাজ চৌহান, বসন্তরাও দাদা পাটিল, ডি.কে. শিভকুমার, এইচ, ডি, কুমারস্বামী< হুডা, ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং ।

–সবচেয়ে ইনটারেস্টিঙ পশ্চিমবাংলার মন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীর চাকরি পাওয়া। ২০১৮-তে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পরেই মন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারী এসএসসিতে চাকরি পেয়ে যান।  প্রথমে কোনও মেধা তালিকায় অঙ্কিতার নাম না থাকলেও ওয়েটিং লিস্টে অঙ্কিতার নাম প্রথমে চলে আসে। যার জেরে উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ির ববিতা সরকারের ওয়েটিং লিস্টে নাম ২০ থেকে ২১-এ চলে যায়। চাকরি হয় ওয়েটির লিস্টে ২০ পর্যন্ত। বঞ্চিত থেকে যাওয়া ববিতা হাইকোর্টে মামলা করেন। আরটিআই করে অঙ্কিতার নম্বর জানতে চান। কিন্তু কোনও উত্তরই তিনি পাননি। শেষে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় নির্দেশ দিলে এসএসসির তৎকালীন চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থ মজুমদার জানান, অঙ্কিতার বিষয় ভিত্তিক এবং অ্যাকাডেমিক স্কোর ৬১।  অন্যদিকে ববিতা সরকারের পার্সোনালিটি টেস্টে অংশ নিয়েছেন। তাঁর বিষয় ভিত্তিক, অ্যাকাডেমিক এবং পার্সোনালিটি টেস্টের স্কোর হল ৭৭। অর্থাৎ বেশি নম্বর পেয়ে বঞ্চিত রয়ে গিয়েছেন ববিতা। অঙ্কিতা অধিকারী আদালতের রায়ে চাকরি খুইয়েছেন। তাঁকে ৪১ মাসের মাইনে ফেরতের নির্দেশ দিয়েছেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। 

–তোমরা আর্থিক কেলেঙ্কারির পাণ্ডাদের বাদ দিচ্ছ কেন ? ওরা তো হাওয়ালার মাধ্যমে কোটি-কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে ।

–কারা ?

এক নম্বর, সত্যম কেলেঙ্কারি – ১৪০০০ কোটি । ২০০৯ সালের এই কর্পোরেট কেলেঙ্কারিটি ‘ভারতের এনরন কেলেঙ্কারি’ নামেও পরিচিত এবং এটিতে বি রামালিঙ্গা রাজু এবং তার সত্যম কম্পিউটার সার্ভিসেস লিমিটেডের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায়। কোম্পানি স্বীকার করে যে তারা ১৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি অ্যাকাউন্টের জালিয়াতি করেছে। দুনম্বর, বিজয় মালিয়া – নয় হাজার কোটি । একটা সময় ছিল যখন মানুষ বিজয় মালিয়াকে ‘King of good times’ বলে ডাকত, কিন্তু আজ তার নামে ভালো কোনও কথা কারোর মুখ থেকেই বের হয় না। ২০১৬ সালে, মালিয়া দেশে প্রতারণা এবং অর্থ পাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার পরে দেশ থেকে পলাতক হয়েছিলেন এবং ব্রিটেনে আশ্রয় চেয়েছিলেন। বিজয় মাল্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যাঙ্কের নয় হাজার কোটি টাকারও বেশি পাওনা রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।তিন নম্বর, কয়লাগেট কেলেঙ্কারি – ১.৮৬ লক্ষ কোটি ।কয়লা বরাদ্দ কেলেঙ্কারি বা ‘কয়লাগেট’ হল একটি রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি যা ২০১২ সালে ইউপিএ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন সামনে আসে। কেলেঙ্কারিটি কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) প্রথম প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন।  তৎকালীন সরকারকে ২০০৪ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে অবৈধভাবে ১৯৪টি কয়লা ব্লক বরাদ্দ করার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছিল। যদিও CAG প্রাথমিকভাবে ১০ লক্ষ কোটি টাকার বেশি ক্ষতির অনুমান করেছিল, চূড়ান্ত রিপোর্টে কেলেঙ্কারির পরিমাণ ১.৮৬ লক্ষ কোটি টাকা উল্লেখ করা হয়েছে।চার নম্বর,  বোফোর্স কেলেঙ্কারি – ৬৪ কোটি । এটা একটি বড় অস্ত্র-চুক্তি কেলেঙ্কারি যা ১৯৮০-৯০ -এর দশকে ভারত এবং সুইডেনের মধ্যে ঘটেছিল। ১৯৮৬ সালে, ভারত ভারতীয় সেনাবাহিনীকে তাদের ১৫৫ মিমি ফিল্ড হাউইটজার সরবরাহ করার জন্য সুইডিশ অস্ত্র প্রস্তুতকারক বোফর্স এবির সাথে ১৪৩৭ কোটি টাকার (প্রায়) একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। আজকের সময়ে, বোফর্স কেলেঙ্কারির আনুমানিক পরিমাণ প্রায় ৪০০ কোটি টাকা।পাঁচ নম্বর, নীরব মোদী পিএনবি ব্যাঙ্ক জালিয়াতি ১১,৪০০ কোটি ।পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রধান অভিযুক্ত নীরব মোদী ও তাঁর ভাইপো মেহুল চোসকি। আর্থিক দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসার আগেই গত বছর জানুয়ারির শেষের দিকে তাঁরা দেশ ছেড়ে পালান।  ১৪ মার্চ ৪৮ বছরের নীরব মোদীকে গ্রেফতার করে স্কটল্যান্ট ইয়ার্ডের পুলিশ ভারতে আর্থিক তছরুপের অভিযোগে গ্রেফতার করে। ছয় নম্বর, অগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ড হেলিকপ্টার কেলেঙ্কারি- ৩৬০০ কোটি । ভারতের কুখ্যাত প্রতিরক্ষা কেলেঙ্কারিগুলির মধ্যে একটি এই প্রতারণা মামলা। এই মামলাটি ২০১০ সালের UPA সরকার এবং অগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ডের মধ্যে ১২টি হেলিকপ্টার অধিগ্রহণের জন্য স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি যা ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য ভিভিআইপি দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল। চুক্তিটি ৩৬০০ কোটি টাকা মূল্যের ছিল।সাত নম্বর, হাওয়ালা কেলেঙ্কারি – ১৮ মিলিয়ন ডলার । হাওয়ালা কেলেঙ্কারি ১৯৯০-এর দশকে জনসাধারণের নজরে আসে, যা এল কে আডবানি, অর্জুন সিং, যশবন্ত সিনহা এবং মদন লাল খুরানার মতো রাজনীতিবিদদের এবং আরও অনেককে ঘুষের সাথে জড়িত বলে স্পটলাইট করে। এই কেলেঙ্কারীটি জৈন ভাই নামে পরিচিত হাওয়ালা ভাইদের ঘিরে তৈরি হয়েছে। 

–হাওয়ালা ব্যাপারটা কী ? কেমন কে অপারেট করে একটু বুঝিয়ে বলুন ? হাওয়ালা কেলেঙ্কারিতে একবার আঠারো মিলিয়ন ডলার লেনদেনের খবর পড়েছিলাম। হাওয়ালা কেলেঙ্কারি ১৯৯০-এর দশকে জনসাধারণের নজরে আসে, যা এল কে আডবানি, অর্জুন সিং, যশবন্ত সিনহা এবং মদন লাল খুরানার মতো রাজনীতিবিদদের এবং আরও অনেককে ঘুষের সাথে জড়িত বলে স্পটলাইট করে। এই কেলেঙ্কারিটিা জৈন ভাই নামে পরিচিত হাওয়ালা ভাইদের ঘিরে তৈরি হয়েছিল বলে শুনেছিলাম। 

‘হাওয়ালা’  শব্দটা আরবি । এর মানে, লেনদেন।  পশ্চিম এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা আর ভারতীয় উপমহাদেশে একদল দালাল আছে যারা পারস্পরিক বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে কাজ করে। চিরাচরিত ব্যাঙ্ক বা অর্থব্যবস্থায় যে টাকা লেনদেন হয়, হাওয়ালা হল তার সমান্তরাল  পদ্ধতি।  আগেকার কালে টাকা বা সোনা নিয়ে অনেকখানি  রাস্তা পাড়ি দেওয়া নিরাপদ ছিল না । হাওয়ালা গোয়েন্দাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কারণ, জঙ্গিরা নাশকতা চালাতে যে টাকাকড়ি যোগাড় করে কিংবা রাজনীতিবিদরা ভোটের সময় যে খরচ-খরচা করে, তার সিংহভাগ টাকা আসে এই কায়দায়। এদেশে তোলা ঘুষও বিদেশে যায় একই কায়দায় ।হাওয়ালায় একদল দালাল থাকে টাকা নেবার জন্য। এদের বলা হয় হাওয়ালাদার। ধরা যাক,  দুবাইয়ের হাওয়ালাদার কারও কাছ থেকে টাকা পেল। তখন সে যোগাযোগ করবে যেখানে টাকা পাঠাতে হবে, সেই দেশে নিজের এজেন্টের সঙ্গে। এ বার সেই এজেন্টকে টাকা পাঠানো হবে না, শুধু  ‘পাসওয়ার্ড’ দেওয়া হবে। এমন একটি শব্দ, যা মনে রাখতে হবে এজেন্টকে। যে লোকটাকে এজেন্ট টাকা দেবে, তাকেও বলে দেওয়া হবে ওই শব্দ। যার হাতে টাকাটা দিতে হবে সে ‘পাসওয়ার্ড’ এজেন্টকে বললে তবেই এজেন্ট  গ্রাহকেকে টাকাটা দেবে। প্রতিটা লেনদেনের ক্ষেত্রে হাওলাদাররা দুই শতাংশ কমিশন নেয়। মুখে-মুখে লেনদেন হয় বলে ব্যাঙ্ক বা বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় কেন্দ্রে এর কোনও প্রমাণ থাকে না। 

–-হ্যাঁ। সরকারের অনেক লোকসান হয় । আবার রাজনীতিকরা আর কালোবাজারিরা হাওয়ালায় বিদেশে টাকা পাঠায় ।  ভারতে হাওয়ালা লেনদেনের ছবিটা ভয়াবহ। আইআইএম ব্যাঙ্গালোরের অধ্যাপক আর বৈদ্যনাথনের মতে, ভারত গত ছয় দশকে কর ফাঁকি বাবদ দেড় লক্ষ কোটি ডলার হারিয়েছে। আর এর ৪০ শতাংশই হয়েছে হাওয়ালা লেনদেনের কারণে। হাওয়ালা অবৈধ । হাওয়ালা নিয়ে যা আইন আছে, তা খুব কড়া। কিন্তু হাওয়ালায় এত বিপুল টাকা দেওয়া-নেওয়া হয় যে, গোয়েন্দারা এখন তা বন্ধ করতে পারেনি। বিদেশে  অনেক ভারতীয় আছে, যাঁরা ব্যাঙ্ক মারফত টাকা পাঠায় না। কারণ সংশ্লিষ্ট দেশে হয়তো বেআইনিভাবে বসবাস করছে। ব্যাঙ্কে গেলে নাম-ঠিকানা দিয়ে টাকা পাঠাতে হবে। সেক্ষেত্রে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই বাড়িতে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে হাওয়ালার আশ্রয় নিতে হয়। ভারতে হাওয়ালায় টাকা লেনদেন বেআইনি ঘোষিত হয়েছে দু’টো আইন মারফত। একটা হল ফেমা বা ফরেন এক্সচেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট, ২০০০ অন্যটা প্রিভেনশন অফ মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট, ২০০২। 

–ইনডিয়াকে আরেকজনের মাধ্যমে ডিফাইন করি, কী বলেন ?আগের অর্থমন্ত্রী পালানিয়াপ্পান চিদাম্বারামকে দুর্নীতি আর অর্থ পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল।অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন সময় ঘুষ নিয়ে বিদেশী বিনিয়োগের অর্থ আত্মসাত করেছিলেন । তার বিরুদ্ধে তদন্ত করা হচ্ছে।২০০৭ সালে অর্থমন্ত্রী থাকাকালে আইএনএক্স গ্রুপের দশ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিদেশী বিনিয়োগ আত্মসাত করার অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। মি. চিদাম্বারামের ছেলে কার্তি চিদাম্বারামের বিরুদ্ধে অভিযোগ, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ঐ বিনিয়োগের ছাড়পত্র পাইয়ে দেয়ায় আইএনএক্স’এর কাছ থেকে ঘুষ পেয়েছিলেন তিনি। আর্খিক লেনদেন বিষয়ক অপরাধের তদন্ত করা সংস্থা সিবিআই এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট অভিযুক্ত দুই ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। ২০১৮ সালে কার্তি চিদাম্বারামকে গ্রেফতার করে সিবিআই, কিন্তু পরে তাকে জামিনে ছাড়া হয়। তিনি ভারতের দক্ষিনাঞ্চলের রাজ্য তামিল নাড়ুর একজন কংগ্রেস এমপি ।

–বুঝলেন,ভারতীয় রাজনীতিকদের দুর্নীতির দায়ে শাস্তি দেওয়া খুবই কঠিন। কোনো কিছুই প্রমাণ হয় না, যদি শাসকের সঙ্গে একটু আপোস করা যায়। বোফর্সে রাজীব, হাওলায় নরসিংহ রাও, সাংসদ কেনাবেচায় শিব সোরেন, নারদা-সারদা-রোজভ্যালিতে তৃণমূল, কফিন কেলেঙ্কারিতে জর্জ ফার্নান্ডেজ, সঙ্গতিহীন সম্পদে মুলায়ম সিং বা মায়াবতী, ২জি কেলেঙ্কারিতে এ রাজা-কানিমোঝি, কমনওয়েলথ গেমস দুর্নীতিতে সুরেশ কালমাদি, গুজরাট গণহত্যায় নরেন্দ্র মোদি, সোহরাবুদ্দিন শেখ হত্যায় ও বিচারপতি লোয়ার মৃত্যুতে অমিত শাহ, কেউই দোষী সাব্যস্ত হয়নি। সকলেই ধোয়া তুলসি পাতা। ব্যতিক্রম কেবল লালু প্রসাদ যাদব। কারণ তিনি আদবানির রথ রুখেছিলেন আর সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে বিজেপির সঙ্গে আপোস করেননি।

–সবচেয়ে চুতিয়া টাইপের নিরক্ষর হল রাজনৈতিকভাবে  অশিক্ষিতরা । তারা শোনে না, কথা বলে না বা রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে না। তারা জীবনের দাম জানে না , বাজারে জিনিসপত্রের দাম কেন বাড়ছে জানে না, কারা বাড়াচ্ছে জানে না । আলু-পটলের দাম, মাছের, আটার দাম, ভাড়া, জুতো, ওষুধের দাম, সবই নির্ভর করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর। রাজনৈতিক নিরক্ষর  লোকগুলো এতটাই বোকা যে তারা গর্ব করে বুক ফুলিয়ে বলে যে তারা রাজনীতিকে ঘৃণা করে। মূর্খরা জানে না যে, তাদের রাজনৈতিক অজ্ঞতা থেকে জন্ম নেয় পতিতা, পরিত্যক্ত সন্তান আর সর্বাপেক্ষা জঘন্য চোর, রাষ্ট্রীয় ও বহুজাতিক কোম্পানির দুর্নীতিবাজ, দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের কোটিপতি দোস্ত।

–কারেক্ট । যে বউটা নিজের চটি খুইয়ে চটিটা ছুঁড়ে মারতে চেয়েছিল তাকে তারিফ করতেই হয় ।

–হ্যাঁ, খালি পায়ে বাড়ি ফিরেছে । ওটা কিন্তু আসল ইনডিয়ার সংজ্ঞা ।

–চটি মারার ব্যাপারটাকে নিম্নমর্ণের ক্রোধ হিসেবেও দেখা যায় । সাবলটার্ন ইনডিয়া ।

–দুর্নীতি ভারতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে আর ভারতীয় সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে সেঁদিয়ে গেছে। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন একাডেমিয়া, ব্যবসা, ব্যাঙ্কিং, আইন প্রয়োগকারী আর অন্য রোজকার পরিষেবাগুলোয় ঘটে যাওয়া ব্যাপক দুর্নীতি আমাদের মতন মানুষের ঘাড়ে খাঁড়ার কোপের মতন নেমে এসেছে ।সামাজিক শৃঙ্খলা দুর্নীতি  সামাজিকভাবে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে আর অনেক ক্ষেত্রে এটা অনিবার্য আদর্শ হয়ে উঠেছে। আমি তো কলকাতা থেকে এসে ভোটার কার্ডটা ট্রান্সফার করাবার জন্য কতো দৌড়োদৌড়ি করলুম । তারপর শুনলুম যে ঘুষ না দিলে হয় না । 

–শেষ পর্যন্ত হয়েছে ?

–তুমি  রেশন কার্ড করিয়ে দেবার পর হয়েছে ।

–সউদি আরবে যাচ্ছো নাকি, ছেলের কাছে ? 

–আরে হঠাৎ টপিক পালটে ফেললে ; এখনও তো কয়লা পাচার, গোরু পাচার, আরো নানা পাচার-কাহিনি আলোচনা হয়নি তো !

–নাহ, আর কোথাও যাবো না ; ছেলেকে অবশ্য বলেছিলুম, একটা আরবি মেয়েকে বিয়ে কর, আরবের সবাই বেশ ফর্সা আর সুন্দরী, তাহলে আমরাও হজ করতে যাবো । মক্কা-মদিনা দেখা হয়ে যাবে। ও বলেছে ও আর কোনো নারীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়বে না । যাকে বিয়ে করেছিল তার গায়ে বিটকেল গন্ধ আর চেপে গিয়েছিল যে ওর ইউটেরাসে সমস্যা আছে, কোনোকালে মেন্স হয় না।

–ও বাবা, আমাদের বলেননি তো !

–এসব আবার বলাবলির বিষয় নাকি ।

–নাহ, আর কোথাও যাবো না । বিদেশের মরুভূমি দেখা হয়ে গেছে দুবাই, আবুধাবিতে, গ্র্যাণ্ড মসজিদ ঘোরা হয়ে গেছে । ইউরোপে তুষার দেখা হয়ে গেছে । যা-যা দেখার আর খাবার তা সেরে ফেলেছি। কতো মেমেন্টো জড়ো করা হয়েছে নানা দেশ থেকে, সেগুলো এখন সমস্যা । ধুলো পড়ে এমন হয়েছে যে চেনা যায় না। কলকাতা ছাড়ার সময়ে অনেক মেমেন্টো বিলিয়ে দিয়ে এসেছি আর আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিয়েছি। যেগুলো ফ্রিজে আটকানো ছিল সেগুলো ফ্রিজসুদ্ধ দিয়ে দিয়েছি । যৌবনে জড়ো করা সব জিনিস এখন ফালতু মনে হয়।

বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির প্রবণতা নিয়ে রিপোর্ট দেয় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ৷ তাদের রিপোর্ট অনুসারে, ২০১৪ সালে ভারতের দুর্নীতির র‌্যাঙ্কিং ছিল ৮৫ তম স্থানে । ২০২১ সালে ভারতের অবস্থান আরও কিছুটা নিচে নেমে গিয়েছে ৷ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সততার এই পরীক্ষায় ডেনমার্ক আর নিউজিল্যান্ড ১০০-র মধ্যে ৮৮ পেয়েছে ৷ আর ফিনল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, সুইডেন এবং সুইজারল্যান্ড ৮৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে বিশ্বের সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসবে নিজেদের প্রমাণ দিয়েছে ৷ ভারত এই পরীক্ষায় মাত্র ৪০ শতাংশ নম্বর পেয়েছে ৷ সারা বিশ্বে এই গড় ৪৩ শতাংশ৷ আর এই ক্ষেত্রে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১ টি দেশের গড় ৪৫ শতাংশ । ভারতের র‌্যাঙ্কিং এশিয়া-প্যাসিফিক গড়ের চেয়ে অনেক খারাপ । চিন ৪২ নম্বর পেয়ে ৭৮তম স্থান জায়গা করে নিতে পেরেছে৷ কোরোনা প্যানডেমিক কেবলমাত্র একটি অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্য বিপর্যয়ই নয়, এটি দুর্নীতিও বাড়িয়ে দিয়েছে বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ৷ 

–আরেকটা নতুন টার্ম শুনছি, কাটমানি। সেটা কী ? 

–তুই জানিস না ? পশ্চিমবঙ্গের সমসাময়িক পরিস্থিতি বলছে, ‘কাটমানি’ হল সেই টাকা যা কোনো সরকারি প্রকল্পের অনুমোদন দিতে বা পরিষেবা পাইয়ে দিতে জনপ্রতিনিধি, মানে দাপুটে নেতার হাতে তুলে দিতে হয়। অর্থাৎ, সরকার নির্ধারিত মোট টাকা থেকে যে টাকা ‘কাট’ করে কাজের স্বার্থে প্রভাবশালীর হাতে তুলে দিতে হচ্ছে, সেটাই ‘কাটমানি’। মোদ্দাকথা হচ্ছে কোন সরকারি অর্থ বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারের মধ্যে সাহায্য হিসেবে বিতরণ করতে হলে এই উক্ত শ্রেণীর মাধ্যমে অর্থাৎ— ফুলনেতা, হাফনেতা , টেপিনেতা, ফুটিনেতা এনাদের হাতে কাটমানি হয়ে অবশেষে যতকিঞ্চিত, যার নামে সকারী খাতায় টাকাগুলো মঞ্জুর হয়েছে এর হাতে এসে পৌছায়।উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে, কোনো সরকারি প্রকল্পে বরাদ্দের পরিমাণ ১০০ টাকা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি গ্রাহককে জানালেন, ওই টাকা পাওয়ার অনুমোদন পেতে তাঁকে ২৫ টাকা ‘চার্জ’ জিতে হবে। এই টাকা বেশির ভাগ সময়ই নিচু তলার রাজনীতিক থেকে উঁচু তলায় স্তরে স্তরে পৌঁছে যায়।

–-সিন্ডিকেট ? সেটাও তো পশ্চিমবাংলার অবদান । কিন্তু ইনডিয়াকে ডিফাইন করে আই থিংক ।

–সিন্ডিকেট নামের রাক্ষসগুলোর জনক কারা , এই প্রশ্ন তুললে দলগুলোর মধ্যে চাপানওতোর চলে । বামপন্থীরা বলে, তাঁদের জমানায় রাজারহাটে কো-অপারেটিভ ছিল ।  তৃণমূল কংগ্রেস এসে  সিন্ডিকেট ব্যবস্থার সৃষ্টি করেছে । তৃণমূল কংগ্রেস বলবে, তারা উত্তরাধিকার সূত্রে ব্যবস্থাটা পেয়েছে । কেন প্রতিটি দলই পশ্চিমবঙ্গে সিন্ডিকেট বা সেরকম ব্যবস্থাকে তোল্লাই দেয়, সেই প্রশ্নের উত্তর আছে রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থায়। পশ্চিমবঙ্গে বড়ো শিল্প নেই, ফলে বড় মাপের কর্মসংস্থানও নেই। যা আছে,  তা প্রচ্ছন্ন বেকারত্ব ।  এই অবস্থায়  রাজনৈতিক প্রতিপত্তি ব্যবহার করে কনট্রাক্টরদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে একটা দল । যে হেতু পশ্চিমবাংলায় চাকরি-বাকরি নেই তাই  রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে সিন্ডিকেটে কাজ করতে হয় বেকার ছেলেদের । আবার, তাদের হাতে রাখতে চায় রাজনৈতিক দলগুলো । ফলে, সিন্ডিকেটকে প্রশ্রয় না দিয়ে  উপায় নেই।  এক নেতা একবার বলেছিলেন, সিন্ডিকেটের গায়ে হাত পড়লে সরকার পড়ে যাবে ।  সিন্ডিকেট থেকে বাড়ি তৈরির মাল আর শ্রমিক নিতে হয় । না নিলে বিপদ । চাকরির সমস্যার সমাধান না হওয়ায়  এই রাজনৈতিক হাতিয়ার প্রয়োগ করতে হয়। সিন্ডিকেটের নামে  জুলুম চলে। 

–সিন্ডিকেট ব্যাপারটা ঠিক কী ? একটু বুঝিয়ে বলুন ।

–সিন্ডিকেটের একেবারে প্রাথমিক ধাপ হল, যখন কোনও পার্টির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন প্রোমোটাররা, তাঁকে সেই ওয়ার্ডের প্রভাবশালী নেতাকে ‘প্রণামী’ দিতে হয়, মানে মোগল আমলের সেই নজরানা। কী সেই ‘নজরানা’? দমদম সংসদীয় এলাকায় জায়গা বুঝে একটা থোক টাকা, সেটা দু’লক্ষ,তিন লক্ষ কিংবা তারও বেশি হতে পারে। তারপরের ধাপ হল সিন্ডিকেটের বরাত। এখন এই মুহূর্তে দমদম এলাকায় সেই রেট চলছে ৩৫০-৩৭০ টাকা স্কোয়্যার ফিট। প্রোমোটারদের কথায়, এতে আবার রয়েছেন সেই দাদা-দিদিদেরই অনুগামীরা। তাঁদেরকে সেই টাকা দিতে হয়। তাঁরাই মূলত ইট-বালি-সিমেন্টের বরাত পান। এর অবশ্য বিকল্প ব্যবস্থা রয়েছে। প্রমোটারদের চলতি কথায়, তা হল ‘সিন্ডিকেট কেনা’। এই অনুগামীদের বরাত না দিয়ে তাঁদেরকে একটা থোক টাকা দিয়ে দেওয়া হল। একেবারে কর্পোরেট কায়দায় চলে সিন্ডিকেট রাজ। কাউন্সিলরদের মধ্যেই যে সিন্ডিকেট নিয়ে বিবাদ তুঙ্গে, তা তাঁর কথাতেই স্পষ্ট। আর এরই ফায়দা লুঠছে এক শ্রেণির মানুষ।

–সরকার কনট্রোল করলেই তো পারে ?

–সিন্ডিকেটকে কেন কনট্রোল করা উচিত, সেই প্রশ্নের একরকম উত্তর রাজারহাটে পাওয়া গেলে অন্যরকম উত্তর পাওয়া যাবে হলদিয়ায়। এক দিকে যেমন সিন্ডিকেটের জুলুমে বাড়িটাড়ি তৈরির খরচ বেড়ে যায়, ফলে ফ্ল্যাটের দাম ন্যায্য স্তরের তুলনায় বেশি হয়, অন্য দিকে বাড়ি তৈরির গুণমানও  ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে, বাজারে  চাহিদা পড়ে যায়। তার প্রভাব পড়ে কাজে, ইঁট-বালি-সিমেন্ট-লোহার  সার্বিক চাহিদায়। অন্য দিকে, হলদিয়ার অভিজ্ঞতা বলবে, এই সিন্ডিকেটের জুলুমে এক বহুজাতিক সংস্থা বন্দরের কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হল, আর তার ফলে বন্দর-বাণিজ্যের একটি বড় অংশ চলে গেল প্রতিবেশী রাজ্যে। মানে, সিন্ডিকেটের জুলুমে যে শুধু কনট্রাক্টারের ক্ষতি হয়, তাই নয়— ক্ষতি হয় পুরো  রাজ্যের । সিন্ডিকেট প্রথা কনট্রোল করা অসম্ভব হয়ে গেছে । 

–প্রতিটি নির্বাচনের আগেই তোলাবাজি, কাটমানি ও সিন্ডিকেট নিয়ে হুঁশিয়ারি দেবে প্রশাসনের শীর্ষ মহল। বিরোধীরাও গলা চড়াবেন। ঠিক যেমন গত বুধবার তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলের ভাবী কাউন্সিলরদের সিন্ডিকেট ও তোলাবাজি নিয়ে হুঁশিয়ারি দেন। কিন্তু তাতে পরিস্থিতি বদলাবে কি? আরও এক নির্বাচনের আগে সেটাই প্রশ্ন। ভুক্তভোগীদের বক্তব্য, গত ভোটে মমতা কাটমানির টাকা ফেরত দিতে বলার পরেও পরিস্থিতি বদলায়নি। দিনকয়েক চুপ ছিলেন নেতা-দাদারা। শোরগোল থিতিয়ে যেতেই যে কে সে-ই! পুরভোটের পরেও তেমনটাই হতে পারে। তাঁদের অভিযোগ, পুর পরিষেবার মাধ্যমেই বছরভর সব চেয়ে বেশি টাকা কামানোর কারবার চলে। মমতাও বুঝিয়ে দিয়েছেন, বিষয়টি তাঁর অজানা নয়। জনসভায় তিনি বলেন, ‘‘আমার এলাকায় কেউ ঘরবাড়ি করলে সমস্ত কিছু আমার থেকে কিনতে হবে, তা হবে না। কেউ ঘরবাড়ি করলেই আমাকে এত টাকা দেবে, তা-ও হবে না।

–আর তোলাবাজি ? কতোরকমের টার্ম যে ইনডিয়াকে ডিফাইন করে তার ইয়ত্তা নেই মাইরি ।

–জানিস না ? তোলা মানে চাঁদা । বাড়ি-বাড়ি গিয়ে বা রাস্তায় গাড়িটাড়ি থামিয়ে, চাঁদা আদায় । আজকাল বাজারে চাঁদা তোলার রসিদও বিক্রি হয় । রসিদ দেখিয়ে দিলে সন্দেহ কম হয় । তবে আবদার বদলে গিয়েছে হুকুমে। খুদেদের সরিয়ে ঢুকে পড়েছে বড়রা। দুর্গা, কালী, জগদ্ধাত্রীর সঙ্গে একই সারিতে ঢুকে পড়েছে সরস্বতীও। সৌজন্যে চাঁদার জুলুম। আর তার ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে। সম্প্রতি হাঁসখালির ফুলবাড়িতে চাঁদার জুলুমবাজিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় নাম জড়িয়েছিল কৃষ্ণগঞ্জের বিধায়ক সত্যজিৎ বিশ্বাসের। অভিযোগ, তাঁর অনুগামীরা এক ট্রাক চালক ও খালাসিকে গাড়ি নিয়ে তাড়া করে বেধড়ক মারধর করে। গুরুতর জখম অবস্থায় ওই দু’জনকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। তাঁদের ‘অপরাধ’ ছিল সরস্বতী পুজোর উদ্যোক্তাদের দাবি মতো তাঁরা চাঁদা দিতে পারেননি।

–আপনি তো গায়ক হতে চেয়েছিলেন ! ইনডিয়ার ল্যাঙ খেয়ে গেলেন ?

–ঘায়ে খোঁচা দিও না যারা  সাহিত্য, সঙ্গীত, ব্যবসা, রাজনীতি, খেলাধুলো, শিল্পকলা ইত্যাদিতে সর্বশ্রেষ্ঠ হওয়ার স্বীকৃতি লাভ করে — তাদের সবচেয়ে প্রতিভাবান মনে করার কারণ নেই। আমাদের মধ্যে অগণিত মানুষ আরও বেশি গুণ সম্পন্ন হলেও, তাদের বিকাশের সুযোগ, বাজারের সমর্থন বা সম্পদের অভাবে তারা ঢাকা পড়ে যায়। যদিও সাফল্য আর প্রতিভার মধ্যে সম্পর্কটা অস্পষ্ট,  গণসমাজ একটা মেধাতান্ত্রিক আদর্শকে সমর্থন করে, যা উল্টোটায় জোর দেয়, মানে যারা সবচেয়ে বেশি সাফল্য অর্জন করেছে, তারা সর্বদা সবচেয়ে প্রতিভাবান। এর ফল বিষময়। সফলতা  যাদের গণমানসে এড়িয়ে যায়, তারা কেবল ব্যর্থতার  আঘাতগুলোকে সহ্য করে না,  তাদের অযোগ্য বলে বিবেচিত হওয়ার অপমানও সহ্য করতে হয়, কারণ তাদের প্রয়োজনীয় সুযোগ, বাজারের  সমর্থন আর সম্পদ নেই।

–কথাটা ঠিক । আচ্ছা গরু পাচারেও নাকি পলিটিশিয়ানদের হাত আছে ? দেশে গোমাংস বিরোধী একটা উন্মাদনা যেমন ধর্মনিরপেক্ষতার সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করছে, তেমনই খাদ্য নির্বাচনের স্বাধীনতা হরণকেও আন্তর্জাতিক কূটনীতি ভাল চোখে দেখে না। নিজের সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি কারও উপর চাপানো ঠিক নয়। জাতীয় স্বার্থে রাজনীতি ও কূটনীতি পরিচালিত করার বদলে ‘এক ধর্ম, এক ভাষা, এক খাদ্য’কে সামনে আনা হচ্ছে, যার অর্থ হল গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সহিষ্ণুতার আদর্শকে বিসর্জন দেওয়া হচ্ছে । সাম্প্রতিক কালে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন আর আগে চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং যখন ভারতে এসেছেন, তখন তাঁদের নিরামিষ খেতে দেওয়া হল, যা রুশ ও চিনা অতিথিরা ভাল ভাবে নেননি।

ভোট রাজনীতির সুবিধা তোলার জন্য হিন্দু জাতীয়তাবাদের ব্যবহার করে শাসকদল এবং তাদের ধ্বজাধারীরা সমাজের জটিল ভারসাম্য নষ্ট করছে এবং এর ফলাফল যে কী হতে পারে, সেটি সম্পর্কে তাঁদের কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই। এই ঘটনাপ্রবাহ এখনও পর্যন্ত যথেষ্ট স্থিতিস্থাপকতার পরিচয় দিয়েছে। মনে রাখা প্রয়োজন যে, ১৯৯০-এর দশকে মুসলিম মৌলবাদের জোয়ারের সময়ে ভারতীয় মুসলমানরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চরমপন্থার ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হননি। কিন্তু বর্তমানে এই মানুষেরা ক্রমাগত পক্ষপাত এবং শাসানির শিকার হচ্ছেন। এই আক্রমণ তাঁরা আর কত দিন সহ্য করতে পারবেন, তা স্পষ্ট না হলেও ভারতীয় গণতন্ত্রের ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তিতে ভাঙন ধরানোর ফলাফল যে মারাত্মক হবে, সে কথা বলাই বাহুল্য।

–মুসলমানদের অবস্থাও শোচনীয়। তথাকথিত গো-রক্ষা গোষ্ঠীর লোকজন দ্বারা নির্যাতন এবং খুনের একাধিক ঘটনার পরে বর্তমানে মুসলমানদের নিধন করার জন্য খোলাখুলি ভাবে প্রচার চালানো হচ্ছে। গুরুগ্রামে মুসলমানদের শুক্রবারের নমাজ পাঠ বন্ধ করার জন্য ধারাবাহিক প্রচার চালানো হচ্ছে। এই মুহূর্তে দেশের সর্বাধিক আধিপত্য বিশিষ্ট মতবাদ, ‘হিন্দুত্ব’, সম্পূর্ণ অশিক্ষিত না হলেও প্রকৃত ইতিহাসের এক অর্ধশিক্ষিত ধারণার উপরে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এই মুহূর্তে একটি উদ্ভট মতবাদ গড়ে তোলা হচ্ছে যে, বর্তমানে দেশের মুসলিম অধিবাসীরা ব্যক্তিগত ভাবে সেই সকল নৃশংসতার জন্য দায়ী যা আজ থেকে কয়েকশো বছর আগে কোনও মুসলমান শাসক বা আক্রমণকারী দ্বারা করা। খ্রিস্টান জনসেবামূলক কাজ এবং বিদ্যালয়গুলির উপরে ধর্মান্তরকরণের অপবাদ দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু দেড়শো বছর ব্রিটিশদের ‘খ্রিস্টান’ শাসনের পরেও কেন এ দেশের মাত্র ২% মানুষ এই ধর্মাবলম্বী সে বিষয়ে কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি।

বেড়ে চলা অসহিষ্ণুতার অভিযোগে ভারতের সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, অভিনেতারা সোচ্চার হয়ে উঠছেন৷ দলমত নির্বিশেষে লেখকরা দলে দলে সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার ফিরিয়ে দিচ্ছেন৷ অথচ সরকার এর পেছনে রাজনৈতিক চক্রান্ত দেখছে৷ হিন্দুত্ববাদীদের রোষের মুখে প্রাণ দিতে হয়েছে কর্ণাটক রাজ্যের শিক্ষাবিদ কালবুর্গি থেকে শুরু করে উত্তর প্রদেশের দাদরিতে মহম্মদ আখলাককে৷ সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ, সমাজকর্মী গোবিন্দ পানসারে, নরেন্দ্র দাভোলকর আর যুক্তিবাদী এমএম কালবুর্গী হত্যার মধ্যে  যোগাযোগ আছে, সেকথা সবাই জানে ।

ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কিছু না কিছু ভিন্ন সম্প্রদায়ের ছেলে মেয়ের মধ্যে প্রেম, ভালোবাসা এবং বিয়ে হচ্ছে৷ মৌলবাদী হিন্দুরা যার নাম দিয়েছে ‘লাভ জিহাদ’৷ প্রথমদিকে নাম ছিল রোমিও জিহাদ৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা কিছুতেই এই‘লাভ জিহাদ’ মেনে নিতে পারছে না৷ কেন পারছে না ? কারণ, এটা তাদের মতে, ধর্মান্তর করা ছাড়া আর কিছুই না৷ এই অভিযোগে হিন্দু-মুসলিম দম্পতির বাড়িতে গিয়ে চড়াও হচ্ছে বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল বা সংঘ পরিবারের ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ৷ তাদের নানাভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে৷

‘মৌলবাদ’ শব্দটির ব্যবহার বিগত শতাব্দীতে এমন কি এই বিংশ  শতাব্দীর প্রথমার্ধেও আদৌ হয়েছিল বলে মনে হয় না। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্ৰ বা রবীন্দ্রনাথ–বাংলা ভাষা ও সাহিত্য যাদের হাতে শৈশব পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করেছিল, তাঁরা ধর্ম, ধর্মীয় গোড়ামি, ধর্মীয় কুসংস্কার, ধর্ম সম্প্রদায় ও সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি প্রসঙ্গে বহু আলোচনা করলেও তাদের লেখায় কোথাও মৌলবাদ শব্দটি সাধারণভাবে চােখে পড়ে না। এটি অবশ্যই ঠিক যে, তাদের প্রতিটি লেখা খুঁটিয়ে পড়ে তারপর এমন মন্তব্য করা হচ্ছে তা নয়। উপযুক্ত গবেষক ও মনোযোগী পাঠক এ ব্যাপারে আলোকপাত করতে পারবেন। তবে এতে অন্তত কোন সন্দেহ নেই যে, বিংশ শতাব্দীর শেষ দুই দশকে (বিশেষত আশির দশকের শেষার্ধ থেকে, রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ বিতর্কের প্রসঙ্গে) বাংলা ভাষায় এই শব্দটি পূর্বেকার কয়েক শত বছরের তুলনায় এত বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে যে, শব্দটির উদ্ভবই এই সময়ে ঘটেছে বলে বলা যায়।

আমাদের এই সংস্কৃতির ভিত্তি বা উৎস ধর্ম নয়, বরং লোকায়ত চিন্তা ও ভাবাদর্শ, যা প্রজন্ম–পরম্পরায় চলে আসছে। সেই চর্যাপদের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত। শুধু আধুনিক লিখিত সাহিত্যে নয়, পালা, পল্লিগান, যাত্রা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতির প্রকাশ ও বিস্তার আমরা দেখি, যার মধ্যে কিছু ধর্মীয় বিষয় ও কখনো কখনো রাজপুরুষদের কাহিনি থাকলেও (মহাকবি ও শ্রেষ্ঠ নাট্যকার শেক্‌সপিয়ারের নাটকেও রাজরাজড়ার ও ভূত-প্রেতের কাহিনি আছে) মর্মবস্তুর মধ্যে যা প্রধান ছিল, তা হলো মানুষের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও উদারপন্থী মতবাদ। ঐতিহাসিক সুজিত আচার্য ‘বাংলায় ইসলাম ধর্মের আদিপর্ব’ নামক রচনায় বলেছেন, এ দেশে ইসলাম ধর্ম বিস্তার লাভ করেছিল তরবারির জোরে নয়, বরং সুফি মতবাদী ধর্ম প্রচারকদের দ্বারা। তাঁদের মতবাদের সঙ্গে এই দেশের শোষিত নিম্নবর্ণের হিন্দুরা তাদের সহজিয়া মতবাদের অনেক সামঞ্জস্য খুঁজে পেয়েছিল। ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের অনেক আগেই যে বৌদ্ধধর্মের সহজিয়া মতবাদ ও বেদবিরোধী লোকায়ত দর্শন জনমনে গভীরভাবে স্থান করে নিয়েছিল, তার মানবিক দিক ছিল ।

–কর্পোরেট বাজারও মৌলবাদ, তা ভুললে চলবে না ।  ধরে নেয়া হয় যে বাজারের সর্বোচ্চ ব্যবহার সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতাকে উন্মুক্ত করবে আর  ফলাফল হবে আরো ভালো পণ্য, আরো বেশি বিক্রি, আরো বেশি মুনাফা আর এজন্য সবকিছুই বৈধ। এই প্রতিযোগিতার প্রভাব কার উপর কেমন পড়লো কিচ্ছু যায় আসে না। বর্তমানের তথাকথিত ‘মুক্ত বাণিজ্য’র আদর্শ এই নয়া-উদারনীতিকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চায়। এই বাজার মৌলবাদে এটি প্রায় একটি বিশ্বাস হিসাবে ছড়িয়ে দেয়া হয় যে বাজারের অদৃশ্য হাত সবসময়ই ভালো ফলাফল বয়ে আনবে। বাজার মৌলবাদ কার্যত পুরুষতান্ত্রিক। পুঁজিবাদ কার্যত পুরূষতন্ত্রের একটি রূপ। নারীবাদীদের অনেকেই বলেছেন পুঁজিবাদ এবং পিতৃতন্ত্র সম্পূর্ণ একদেহ না হলেও দুই-এর সম্পর্ক নিবিড়। পুঁজি আর পিতৃতন্ত্রের যৌথতায় নারীর অধঃস্থনতার আধুনিক কাঠামো তৈরি হয়েছে। 

–বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে হওয়া লোহাচুর কেলেঙ্কারির বিপুল আর্থিক দায় নিতে হল তৃণমূল কংগ্রেস সরকারকে। বাম আমলে চীনে আকরিক লোহা রপ্তানির জন্য নেওয়া ঋণের বকেয়া (সুদ ও আসল মিলিয়ে) বাবদ ১৮৫ কোটি ৮৩ লক্ষ ৭৩ হাজার ৫৩০ টাকা ন’টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে সোমবার মিটিয়ে দিল খাদ্য দপ্তর। এই দপ্তরের অধীনস্থ অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সরবরাহ নিগম (ইসিএসসি) ২০০৫ সালে লোহা আকরিক রপ্তানির জন্য ন’টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কনসোর্টিয়ামের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিল। কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে লোহা আকরিক রপ্তানি করা হয়েছিল। কিন্তু চীন পর্যন্ত ওই লোহা পৌঁছায়নি বলে অভিযোগ। এই ঋণ মেটানোর জন্য বিপুল চাপ ছিল খাদ্য দপ্তরের উপর। ঋণ পরিশোধ না করে কোনও উপায় ছিল না। কারণ চলতি অক্টোবর মাসের মধ্যে এই টাকা পরিশোধ না করলে ইসিএসসি-কে দেউলিয়া ঘোষণা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যেত। সংস্থার ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলির লেনদেন বন্ধ হয়ে যেত। চলতি বছরেই এটা করা হয়েছিল। তখন খাদ্য দপ্তরের অনুরোধে ছ’ মাস অ্যাকাউন্টে লেনদেন করার অনুমতি দেওয়া হয়। সেই সময়সীমা শেষ হচ্ছে অক্টোবরে। ২০১৬ সালের নতুন কেন্দ্রীয় আইনে ‘কর্পোরেট ইনসলভেন্সি রেজুলিউশন প্রসেস’-এর মাধ্যমে ঋণ পরিশোধের প্রক্রিয়া চলছিল।  সরকারি উদ্যোগে চাষিদের কাছ থেকে ধান কেনার মূল দায়িত্ব ইসিএসসি-র। নভেম্বর মাস থেকে এই কাজ শুরু হবে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে গেলে ধান কেনার কাজই থমকে যেত। শুধু তাই নয়, দেউলিয়া ঘোষণা হওয়ার পর ইসিএসসি-র স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি নীলাম করে বকেয়া টাকা আদায় করতে পারত ব্যাংকগুলি। তাই আর্থিক সংকট থাকা সত্ত্বেও টাকা মেটাতে হয়েছে। এর জন্য নতুন করে ব্যাংক ঋণ নিতে হয়েছে নিগমকে। ঋণের গ্যারান্টার হয়েছে খাদ্য দপ্তর। গত বেশ কয়েক মাস ধরে ঋণ মেটানোর জন্য ব্যাংকগুলির সঙ্গে আলোচনা চলছিল। রাজ্য সরকার চেয়েছিল সুদ ছাড়া বকেয়া ঋণের আসল অংশটুকু পরিশোধ করতে। তা হলে ১৫৬ কোটি ৯৫ লক্ষ টাকা দিতে হত। কিস্তিতে টাকা পরিশোধ করার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ব্যাংকগুলি তাতে রাজি না হওয়ায় একসঙ্গে প্রায় ১৮৬ কোটি টাকা দিতে হল। পুরো ঘটনায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। তিনি বলেন, বামফ্রন্ট সরকারের সময় রাজনৈতিক মদতে চলা ‘লুটপাটের’ গুনাগার দিতে হল তাঁদের সরকারকে। লোহাচুর কেলেঙ্কারির টাকার ভাগ বামফ্রন্টের বড়-ছোট শরিকদের কাছে গিয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি প্রাক্তন মন্ত্রী নরেন দে-র দিকেও অভিযোগের আঙুল তুলেছেন। টাকা পরিশোধ করার জেরে দপ্তরের উন্নয়নমূলক কাজ কিছুটা ব্যাহত হবে বলে মন্ত্রী জানিয়েছেন। লোহা আকরিক কেলেঙ্কারির তদন্তে আরও গতি আনার জন্য সিআইডি-কে খাদ্য দপ্তরের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। লোহাচুর কেলেঙ্কারির মামলায় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে সিআইডি একমাত্র জেরা করেছিল প্রবীণ ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা নরেন দে-কে। তিনি খাদ্য দপ্তরের মন্ত্রী ছাড়াও ইসিএসসি-র চেয়ারম্যান পদে ছিলেন। জ্যোতিপ্রিয়বাবু রাজনৈতিক মদতের যে অভিযোগ তুলেছেন, সেই প্রসঙ্গে নরেনবাবু এদিন বলেন, সিআইডি তো আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। আমি লিখিতভাবে তাদের নির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলাম। সিআইডি তাতে সন্তুষ্ট হয় বলে প্রাক্তন মন্ত্রীর দাবি। নরেনবাবু দাবি করেন, তিনি যখন সমবায় দপ্তর থেকে খাদ্য দপ্তরের দায়িত্বে আসেন, তখন লোহাচুরের বিষয়টি ‘ক্লোজড চ্যাপ্টার’ হয়ে গিয়েছে। খাদ্য দপ্তরে তাঁর পূর্বসূরি প্রয়াত কলিমুদ্দিন শামসের সময়ে লোহাচুর রপ্তানির বিষয়টি হয়েছিল বলেও তিনি দাবি করেছেন। এই মামলার তদন্তে খাদ্য দপ্তর আরও গতি আনতে চাইছে। এ প্রসঙ্গে নরেনবাবু বলেন, যা ইচ্ছা তাই করুক। লোহাচুর কেলেঙ্কারির ঘটনায় সিআইডি ইতিমধ্যে আদালতে একাধিক চার্জশিট পেশ করেছে। মামলার শুনানিও চলছে। এই মামলায় তৎকালীন নিগমের শীর্ষ পদে থাকা দুই আইএএস আধিকারিক দেবাদিত্য চক্রবর্তী ও এস সি জামির গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। 

ইসলামী মৌলবাদকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে মুসলমানদের একটি আন্দোলন হিসেবে  যারা অতীতকে ধারণ করে এবং ধর্মের মূলে ফিরে যেতে  চায় এবং একইভাবে জীবনযাপন করে যেভাবে নবী মুহাম্মদ   ও তার সাহাবীগন জীবনযাপন করতেন। ইসলামী মৌলবাদীরা ইসলামের প্রাথমিক উৎস (কুরআন ও সুন্নাহ) এর “আক্ষরিক এবং মৌলিক ব্যাখ্যা” সমর্থন করে, এবং তাদের জীবনের প্রতিটি অংশ হতে, তাদের ধারণা আনুযায়ী “বিকৃত” অনৈসলামিক প্রভাব দূর করতে চায় ।

—–ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু পাচার একটি দীর্ঘ দিনের সমস্যা। মূলত এ ক্ষেত্রে ‘ট্রানজিট পয়েন্টে’র কাজ করে পশ্চিমবঙ্গ। বিএসএফ সূত্রে বলা হয়েছে, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলি থেকে চোরা পথে গরু এসে পৌঁছয় পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকাগুলিতে। এর পর রাতের অন্ধকারে নির্দিষ্ট কিছু এলাকা দিয়ে ওই গরু বাংলাদেশে পাচার হয়ে যায়। পাচারকারীদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা, ও বিএসএফের একাংশ জড়িয়ে রয়েছে বলেও অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। তবে পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টায় দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর। পাচার রুখতে সক্রিয় হয় কেন্দ্র। বিএসএফের দাবি, সীমান্তে নজরদারি বাড়ানোয় আগের চেয়ে গরু পাচার অনেক কমেছে। ২০১৩-১৪ সালে প্রায় কুড়ি লক্ষ গরু পাচার হয়েছিল। বিএসএফের যুক্তি, পাট গাছের দৈর্ঘ্য সাত থেকে দশ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। ওই উচ্চতাকে কাজে লাগায় গরু পাচারকারীরা। পাটগাছের উচ্চতার কারণে ক্ষেতের ভিতর দিয়ে গরু নিয়ে পালালে চোখে পড়ার সম্ভাবনা কম। রাতের অন্ধকারে দূর থেকে আলো ফেললেও ক্ষেতের মধ্যে থাকা গরুদের গতিবিধি বোঝা সম্ভব হয় না। অন্য স্থানে নজরদারি বাড়ানোয় এখন অধিকাংশ গরু পাচারের ঘটনা পাটের ক্ষেতের মধ্যে দিয়েই হচ্ছে। বিএসএফের ডিজি ডি কে পাঠক বলেন, ‘‘অনেক ক্ষেত্রেই পাচারকারীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে ওই এলাকায় পাট চাষ হয়ে থাকে। তাই সীমান্ত এলাকায় পাট চাষ বন্ধ করার জন্য কেন্দ্রের কাছে আবেদন করেছি।’’ বিএসএফ চাইছে, কেন্দ্র যেন বিষয়টি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আলোচনা করে পাটচাষিদের বিকল্প চাষের ব্যবস্থা করে দেয়।

—তুই বোধহয় জানিস না, কলা গাছের ভেলা বানিয়ে গরুকে সেটার সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয়, যাতে শুধু মাথা জলের ওপরে ভেসে থাকে। আর এভাবেই গরুগুলোকে ভাসিয়ে দেওয়া হয় নদীর জলে। গরু পাচারের অভিনব আর নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করছে গরুপাচারকারীরা। মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান সীমান্ত লাগোয়া বীরভূমের বেশ কয়েক’টি জায়গা থেকে ফের পাচার শুরু হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীর অভিযোগ। সম্প্রতি মুরারই ২-এর বিডিও-র কাছে এ ব্যাপারে অভিযোগ জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। লিখিত অভিযোগের পেয়ে বিডিও কৃষ্ণকান্ত ঘোষ পুলিশের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন। পাচার রুখতে কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন জেলাশাসক পি মোহন গাঁধীও। বাংলাদেশ লাগোয়া জেলা-সীমান্তের অর্থনীতি চার পায়ে হাঁটে, বিধানসভা ভোটের আগে সেই তত্ত্বই বীরভূমে ফের স্বমহিমায়। এলাকাবাসীর মত, সীমান্ত এলাকায় পুলিশ-বিএসএফের যৌথ নজরদারির জেরে কয়েক মাস কিছুটা হলেও গরু পাচারে ভাটা পড়েছিল। তবে পাচার কখনই থেমে থাকেনি বলে অভিযোগ। ইদানীং সেটাই আড়ে-বহড়ে বাড়তে শুরু করেছে বলে মত এলাকাবাসীর। প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকেই বলছেন, ‘‘মুরারই-মিত্রপুর রাস্তার উপর দিয়ে দিনের আলোয় গরু হাঁটিয়ে পার করানো হচ্ছে। পুলিশকে ফোনে সে সব জানানো সত্ত্বেও তৎপরতা নজরে আসেনি।

–কয়লা পাচার ?

খনি অঞ্চলে বেআইনি কয়লা খনন চলছে দীর্ঘ দিন ধরেই। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মূলত তিন পদ্ধতিতে এই কয়লা চুরি চলে। প্রথমত, ইসিএল বা ব্যক্তি মালিকানার জমিতে অবৈধ খাদান তৈরি করে কয়লা তোলা হয়। দ্বিতীয়ত, ইসিএলের বন্ধ বা চালু খোলা মুখ খনিতে গভীর সুড়ঙ্গ (র্যাট হোল) বানিয়ে কয়লা তোলা হয়। তৃতীয়ত, ইসিএলের কয়লা ডম্পার বা রেলের পরিবহণের সময়ে কয়লা নামিয়ে নেওয়া হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, আসানসোল-দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেট গঠনের পরে ইসিএল বা ব্যক্তি মালিকানার জমিতে খাদান তৈরি করে কয়লা তোলা কমেছে। কিন্তু অন্য সব পদ্ধতিতে এখনও চুরি চলছে।বারাবনির জামগ্রাম, গৌরান্ডি, মদনপুর, সরিষাতলি এলাকাতেও অবৈধ কয়লার কারবার রমরম করে চলছে বলে এলাকা সূত্রে জানা যায়। যার জেরে মাঝে-মধ্যে ধসের ঘটনাও ঘটছে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। স্থানীয় তৃণমূল নেতা পাপ্পু উপাধ্যায় দাবি করেন, বামেদের সময় থেকে চলে আসা এই অবৈধ কারবার চলছে এখন কিছুটা রোধ করা গেলেও পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি। পাপ্পু বলেন, “আমরা পুলিশের কাছে এই চুরি বন্ধের দাবি করেছি। তা না হলে এক দিন সবাই তলিয়ে যাব।” জামুড়িয়ার কাটাগড়িয়া জঙ্গল, পরিহারপুর ।

—পুলিশ ধরপাকড় করে না ?

—আরে, গরু ও কয়লা পাচার কান্ডে এবার রাজ্যের ৬ পুলিশকর্মীকে নোটিস পাঠাল সিবিআই (CBI) । তাদের মধ্যে একজন ডিএসপি পদ মর্যাদার অফিসার ও রয়েছেন। ডিসেম্বর মাসে গরু পাচারকারী তদন্তের ডিআইজি সহ বিএসএফের ৪ অফিসারকে নোটিশ পাঠায় সিবিআই। যে চারজনকে নোটিস পাঠানো হয়েছিল তাদের মধ্যে একজন ডিআইজি ছিলেন। উল্লেখ্য কয়েক মাস ধরেই কয়লা গরু পাচারকা কান্ডে তৎপর সিবিআই। দফায় দফায় সারা রাজ্য জুড়ে তল্লাশি চালাচ্ছে সিবিআই (CBI)। বর্তমানে কয়লা ও গরু পাচার নিয়ে সরগরম রাজ্য রাজনীতি। এ ভাবেই পাচার হচ্ছে কয়লা। বর্ধমান জেলার পাণ্ডবেশ্বর এলাকার বিভিন্ন খাদান থেকে সাইকেলে কয়লা চাপিয়ে ময়ূরাক্ষী নদী পেরিয়ে বীরভূমের ভীমগড় স্টেশনে নিয়ে আসা হয়। তার পর ট্রেনে যাত্রীবাহী ট্রেনে জেলার বিভিন্ন স্থানে পাচারের কয়লা নামানো হয় বলে অভিযোগ। নিত্য দিন এমন ঘটনা ঘটলেও পুলিশ-প্রশাসনকে কোনও পদক্ষেপ করতে দেখা যায় না বলেই স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি ।

এখন বারাবনি ও সালানপুরে কয়লা চুরির রমরমা সবচেয়ে বেশি। এর পরে জামুড়িয়া, রানিগঞ্জ, কুলটি ও আসানসোলের কিছু এলাকায় চলছে এই চুরি। সালানপুরের বনজেমাহারি, সংগ্রামগড়, ডাবর কোলিয়ারি লাগোয়া এলাকায় খাদান গড়ে কয়লা তুলছে চোরেরা। বনজেমাহারি রেল সাইডিং থেকেও কয়লা চুরি যাচ্ছে। বারাবনির রসুনপুর এলাকা থেকেও চোরেরা কয়লা কাটছে। সাইকেল, গরুর গাড়ি বা মোটরবাইকে চাপিয়ে এই কয়লা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া অবৈধ ডিপোয়। রূপনারায়ণপুরের দেশবন্ধু পার্ক লাগোয়া এলাকার কিছু বাসিন্দার অভিযোগ, চোরেরা অবৈধ কয়লা পুড়িয়ে তা বস্তাবন্দি করে জ্বালানির কাজে ব্যবহারের জন্য বিক্রি করে। সেই কয়লা পোড়ানোর জেরে দূষণে তাঁরা নাজেহাল হচ্ছেন বলে ওই বাসিন্দাদের অভিযোগ। স্থানীয় বাসিন্দা অনাথবন্ধু চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “এই দূষণে শ্বাস নিতে পারি না। ঘরের দরজা-জানালা খোলা থাকলে হাঁফ ধরে যায়।” বাসিন্দাদের অভিযোগ, পুলিশকে অনেক বার বলেও কিছু হচ্ছে না।

—কয়লা পাচার-কাণ্ডে ধৃত ইস্টার্ন কোল্ডফিল্ড লিমিটেড (ইসিএল)-এর সাত জন বর্তমান ও প্রাক্তন কর্তাকে পাঁচ দিনের সিবিআই হেফাজতে পাঠাল আদালত। বৃহস্পতিবার আসানসোলের বিশেষ সিবিআই আদালতের বিচারক রাজেশ চক্রবর্তী এই নির্দেশ দিয়েছেন। সিবিআই সূত্রের খবর, বর্তমান ও প্রাক্তন মিলিয়ে কোলের এই সাত ইসিএল আধিকারিককে বুধবার সকাল ১১টা নাগাদ নিজাম প্যালেসে ডেকে অনেক ক্ষণ ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। তাঁদের জবাবে অসঙ্গতি ধরা পড়ায় গ্রেফতার করা হয়। ধৃতদের মধ্যে রয়েছেন বর্তমান ইসিএল আধিকারিক এসসি মৈত্র। পাশাপাশি, ইসিএলের তিন প্রাক্তন জেনারেল ম্যানেজার সুশান্ত ব্যানার্জি, অভিজিৎ মল্লিক এবং তন্ময় দাস। তন্ময় দাস আগে ইসিএলের প্রধান নিরাপত্তা আধিকারিক ছিলেন। এ ছাড়া ম্যানেজার নিরাপত্তা আধিকারিক ছিলেন মুকেশ কুমার। নিরাপত্তা আধিকারিক রিঙ্কু বেহেরা ও দেবাশিস মুখোপাধ্যায়।

—কয়লাগেট কেলেঙ্কারি কিন্তু কয়লা পাচার কেলেঙ্কারি থেকে আলাদা । কয়লাগেট কেলেঙ্কারিতে সরকারের ১.৮৬ লক্ষ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছিল । কয়লা বরাদ্দ কেলেঙ্কারি বা ‘কয়লাগেট’ হল একটি রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি যা ২০১২ সালে ইউপিএ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন সামনে আসে। কেলেঙ্কারিটি কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) প্রথম প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন।  তৎকালীন সরকারকে ২০০৪ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে অবৈধভাবে ১৯৪টি কয়লা ব্লক বরাদ্দ করার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছিল। যদিও CAG প্রাথমিকভাবে ১০ লক্ষ কোটি টাকার বেশি ক্ষতির অনুমান করেছিল, চূড়ান্ত রিপোর্টে কেলেঙ্কারির পরিমাণ ১.৮৬ লক্ষ কোটি টাকা উল্লেখ করা হয়েছে।

–গণধর্ষণ ? 

১৯৯০ সালের ৩০ মে গোসাবায় একটি টীকাকরণ কর্মসূচি সেরে তিন জন স্বাস্থ্য আধিকারিকের একটি দল কলকাতায় ফিরছিলেন।এই দলে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অতিরিক্ত জেলা গণমাধ্যম বিভাগের উপ-আধিকারিক অনিতা দেওয়ান, স্বাস্থ্য মন্ত্রকের উচ্চপদস্থ আধিকারিক উমা ঘোষ এবং ইউনিসেফের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন দিল্লি কার্যালয়ের প্রতিনিধি রেণু ঘোষ। সন্ধ্যা সাড়ে ছটা নাগাদ যখন তারা ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাসের কাছে বানতলায় পৌঁছান তখন ৪-৫ জন যুবক স্থানীয় ক্লাবের কাছে তাদের গাড়ি থামাতে বাধ্য করে। গাড়ির চালক অবনী নাইয়া তাদের পাশ কাটিয়ে গাড়ি নিয়ে পালাতে গেলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়িটি উলটে যায়। এই সময় আরও ১০-১২ জনের একটি দল সেখানে উপস্থিত হয়। তারা গাড়ির একজন আধিকারিককে টেনে বার করে। আগের দলটি অন্য দুই আধিকারিককে বার করে। গাড়ির চালক তাদের বাধা দিতে যান, কিন্তু ব্যর্থ হন। দলটি গাড়ির চালককে হত্যা করার চেষ্টা করে এবং গাড়িটিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। আধিকারিকদের কাছের একটি ধানক্ষেতে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করা হয়। একজন আধিকারিক তাদের বাধা দিতে যান। ধর্ষকরা তাকে হত্যা করে। রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ পুলিশ গিয়ে আধিকারিকদের নগ্ন দেহ উদ্ধার করে। তাদের ক্যালকাটা ন্যাশানাল মেডিক্যাল কলেজের আপদকালীন বিভাগে ভর্তি করা হয়ে। প্রথম দিকে তাদের মৃত মনে করা হয়ে হয়েছিল। কিন্তু দুজন বেঁচে ছিলেন। তাদের চিকিৎসা শুরু হয়। একজন মহিলা ডাক্তার জনৈক আধিকারিকের যোনিতে একটি ধাতব টর্চ দেখে অজ্ঞান হয়ে যান। আহত ড্রাইভার অবনী নাইয়াকে এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার দেহে ভারী অস্থের ৪৩টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়।  আক্রমণকারীরা তার পুরুষাঙ্গটি পিষে দিয়েছিল। ১৯৯০ সালের ৪ জুন, সকাল ৫টা ৪০ মিনিটে তিনি মারা যান। 

—হাঁসখালি গণধর্ষণের কাণ্ড শুনেছিলাম ?

–হাঁসখালি গণধর্ষণ কাণ্ডে ধীরে ধীরে নিজেদের তদন্তের জাল গুটিয়ে আনতে শুরু করে দিলো সিবিআই। হাইকোর্ট দ্বারা তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার পরই তাদের আসরে নামতে দেখা যায়। গতকাল হাঁসখালি কাণ্ডে প্রধান অভিযুক্ত ব্রজ গোপালের বাবা তথা তৃণমূল নেতা সমরেন্দ্র গোয়ালিকে গ্রেফতার করা হয়। এদিন তাকে চার দিনের সিবিআই হেফাজতের রায় দিলে রানাঘাট মহকুমা আদালত। তবে এসকল বিষয়কেও ছাপিয়ে এদিন আদালতে তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে বিস্ফোরক দাবি করল সিবিআই। হাঁসখালি ধর্ষণ কাণ্ডে প্রথম থেকেই নিরুদ্দেশ ছিল মূল অভিযুক্ত ব্রজ গোপালের বাবা সমরেন্দ্র গোয়ালি। তবে শেষ পর্যন্ত সিবিআইয়ের জালে ধরা পড়ে সে। এরপর বেশ কয়েকবার সিবিআইয়ের তলবের মুখে পড়তে হয় তাকে এবং গতকাল তৃণমূল নেতাকে গ্রেফতার করে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। এলাকার শক্তিশালী নেতা হওয়ায় মৃত্যুর পরপরই ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়া ওই কিশোরীর দেহ সৎকার করা হয়। এ ঘটনা যাতে প্রকাশ না পায়, সে জন্য ধর্ষণকারীর বাবা কিশোরীর পরিবারকে মামলা না করার হুমকি দেন। ফলে ঘটনার পর চার দিন কিশোরীর বাবা কোনো কথা না বললেও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা চাইল্ড লাইনের সহযোগিতায় হাঁসখালি থানায় ধর্ষণ ও হত্যা মামলা করেন। ঘটনার পর পুলিশ প্রধান অভিযুক্ত ব্যক্তিসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করলেও গা ঢাকা দেন ধর্ষণকারীর বাবা সমরেন্দ্র গয়ালি ।

বর্ধমানের কালনায় গণধর্ষণের শিকার হলেন এক আদিবাসী গৃহবধূ। স্বামীর অনুপস্থিতিতে তাঁকে গভীর রাতে বাড়ির সামনে থেকে তুলে নিয়ে যায় দুষ্কৃতীরা। অভিযোগ, দুষ্কৃতীদলে ছিলেন এক মহিলাও। আক্রান্ত বধূকে হাসপাতালে ভর্তি করে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। ইতিমধ্যে ১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে কালনা থানা সূত্রে। মঙ্গলবার গভীর রাতে ঘর থেকে কোনও কাজে বেরিয়েছিলেন মহিলা। আগে থেকেই বাড়ির সামনে অপেক্ষা করছিল দুষ্কৃতীরা। মহিলা বেরোতেই তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা। গলায় ছুরি ধরে মুখ বেঁঝে নিয়ে যায় নিরালা জায়গায়। সেখানে মহিলাকে একে একে ৩ জন ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ। অভিযোগ, দুষ্কৃতীদের মধ্যে ছিলেন এক মহিলাও। তার সামনেই বধূকে ধর্ষণ করে দুষ্কৃতীরা। মহিলা জানিয়েছেন, বেশ কিছুক্ষণ নির্যাতনের শিকার হয়ে রাতের অন্ধকারে কোনও ক্রমে পালিয়ে বাঁচেন তিনি। তবে চোখ বাঁধা থাকায় দুষ্কৃতীদের কাউকেই দেখতে পাননি। মহিলা বাড়ি ফিরলে তাঁকে কালনা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে ভর্তি করেন পরিজনরা। খবর যায় থানায়। ঘটনায় গণধর্ষণের ধারায় অভিযোগ দায়ের করে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। 

—নতুন ক্যামেরা দেখানোর নাম করে এক নাবালিকাকে ফুঁসলে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণের অভিযোগ উঠল গাইঘাটায়। ধর্ষণে যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছে এক নাবালকের বিরুদ্ধে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ওই নাবালিকা বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর আর ফেরেনি। এরপরই সেই নাবালিকার খোঁজে বের হয় তার পরিবারের লোকেরা। সেই নাবালিকার বাবা দাবি করেছেন, যে ঘরে এই ঘটনাটি ঘটেছিল সেখানে খুব জোরে গান চালানো ছিল মিউজিক সিস্টেমে। যাতে চিৎকারের আওয়াজ বাইরে না আসে। 

—বাঞ্চোৎ বাঙালি ছোঁড়াগুলো কাউকেই ছাড়ে না !

—২০১৪ সালের ২১ জানুয়ারি আদিবাসী অধ্যুষিত বীরভুম জেলার লাভপুর থানা এলাকার মধ্যে সুবলপুর গ্রামে এই ঘটনা ঘটে। এর আগে, ২০শে জানুয়ারি সালিশি সভার “তলবে” অত্যাচারিতা এবং তার প্রেমিককে ধরা হয় এবং সারা দিনরাত আটকে রাখা হয়, তাদের একটি গাছে বেঁধে লাঞ্ছিত করা হয় বলে অভিযোগ। এরপর ক্যাঙ্গারু আদালত তাদের ৫০,০০০ টাকা জরিমানা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। মেয়েটি যখন জরিমানা দিতে অক্ষম হয়, তখন গণধর্ষনের আদেশ দেওয়া হয়।নির্বাচিত গ্রাম পঞ্চায়েত নেতার নেতৃত্বে গ্রাম স্তরের স্ব-শাসিত প্রতিষ্ঠান গ্রাম সভা সালিশি সভা নামে একটি ক্যাঙ্গারু আদালতের আয়োজন করেছিল।[৪] সালিশি সভার প্রধান সুনীল সোরেনও এই ধর্ষণের সাথে জড়িত ছিল। 

 —এবার দক্ষিণ ২৪ পরগনার নামখানায় এক মহিলাকে গণধর্ষণ করে পুড়িয়ে মারার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে (allegation of gang rape and attempt to murder at Namkhana) । প্রমাণ লোপাটে ওই মহিলার গায়ে কেরোসিন ঢেলে তাঁকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করে অভিযুক্তরা ৷ হাঁসখালিতে নাবালিকাকে ধর্ষণ ও মৃত্যুর ঘটনার মধ্যেই নামখানার এই ঘটনা রাজ্যে মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে ৷ নির্যাতিতা ওই মহিলা বর্তমানে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কাকদ্বীপ মহকুমা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন । ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে নামখানা থানার পুলিশ ৷

–অভিযুক্তরা কাজ পাইয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখানোয় বাংলাদেশের শরিয়তপুর জেলার পুটিয়াকান্দির ১৭ বছরের এক কিশোরী ভারতে নিয়ে আসে। পরিবারের আর্থিক টানাপড়েন দূর করতে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা বাগদার হরিহরপুরে আসে সে। শরিফুল মল্লিক নামে এক যুবকে তাকে কাজ জোগাড় করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন ওই কিশোরী।বাগদা পুলিশ বলছে, শরিফুল মল্লিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে অবৈধপথে ভারতে আসে ওই কিশোরী। সেখানে যাওয়ার পর গত বৃহস্পতিবার (১৪ অক্টোবর) শরিফুল মল্লিক (৩৮) ও তার সঙ্গী মহসিন বিশ্বাস (২৮) কিশোরীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করেন। গ্রামের বাসিন্দারা কিশোরীকে ধর্ষণের এই খবর থানায় পৌঁছে দেন। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাকে উদ্ধারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরে তার অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা দায়ের এবং দুই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

—মেয়ে পাচার ?

—-জানা যায়, এই নিয়ে ১৫ নম্বরবার বিয়ে করতে যাচ্ছিল অভিযুক্ত। এসিপি ইস্ট শুভেন্দ্র কুমার জানান , “রাহুল সরকার ওরফে রাজু ওরফে সফিয়ুল ইসলামের নামে পশ্চিমবঙ্গের একাধিক থানায় অভিযোগ রয়েছে। মূলত ধর্ষণ ও অপহরণের অভিযোগ রয়েছে। শিলিগুড়ি থানা, ভক্তিনগর থানা, মেটেলি ও হলদিবাড়ি থানাতেও অভিযোগ রয়েছে। মূলত প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ে করে মেয়েদের পাচার করত সে। জিজ্ঞাসাবাদ করে আরও তিনজন মেয়েকে উদ্ধার করা হয়েছে। গোটা ঘটনার তদন্ত চলছে।” পুলিশের অনুমান এই ঘটনার পেছনে বড় কোনও পাচার চক্র জড়িত। 

কন্যা ভ্রূণ বা কন্যাশিশু হত্যার কারণে পাঁচ কোটি মেয়ে ভারত থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। সমস্যাটা সবচেয়ে প্রকট উত্তর ভারতের রাজ্যগুলোতে, যেখানে বহু পুরুষ বিয়ে করার মতো মহিলাই পাচ্ছেন না – আর তার জেরে সারা দেশ জুড়ে জন্ম হচ্ছে সংগঠিত নারী-পাচার চক্রের। দারিদ্র্য ও অসচেতনতার সুযোগে বিয়ে করেন ৭৫টি, বিয়েকে হাতিয়ার করে পাচার করেন ২০০জন নারীকে৷ কেউ আবার পাচার করেন কিশোরীর টিকটক তারকা হবার স্বপ্নকে ভাঙিয়ে৷ উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্য‌ এবং গোটা ভারতের মধ্য‌ে সংযোগের কাজ করে থাকে পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্য‌ের ১৯টি জেলা রয়েছে এবং ২৩টি শহর রয়েছে যার জনসংখ্য‌া এক লক্ষেরও বেশি। সব চেয়ে বড় শহরগুলি হল, কলকাতা, আসানসোল, শিলিগুড়ি ও হাওড়া — এই শহরগুলি পাচার হয়ে যাওয়ার বড় কেন্দ্র। এই শহরগুলিতে বেশ কয়েকটি পরিচিত ‘লালবাতি’ এলাকা রয়েছে যেখানে দেহ ব্য‌বসার কথা সুবিদিত। অন্য‌ দিকে রাজ্য‌ের গ্রামের বিস্তৃত অঞ্চলে দারিদ্র, শোষণ ও বঞ্চনা এখনও রয়ে গিয়েছে। সেখানে লিঙ্গ বৈষম্য‌ রয়েছে, রয়েছে গার্হস্থ্য হিংসার বাতাবরণও। এই দারিদ্রপীড়িত সামাজিক ক্ষেত্র, যেখানে জীবনধারনের জন্য‌ স্থায়ী রোজগারের ব্য‌বস্থা নেই, তা পাচারকারীদের শিকার ধরার আদর্শ জায়গা। এই রাজ্য‌ের সঙ্গে বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের আন্তজার্তিক সীমানা রয়েছে। এই গুরুত্বপূর্ণ ও ভঙ্গুর অবস্থানের জন্য‌ এ রাজ্য‌ শুধু আন্তর্রাজ্য‌ পাচার নয় বরং আন্তর্জাতিক পাচারের উল্লেখযোগ্য‌ কেন্দ্র হিসাবে চিহ্নিত। এক দিনে এই পরিস্থিতি গড়ে ওঠেনি। দীর্ঘদিন ধরে পাচারকারীরা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে অঞ্চল চিহ্নিত করে তাদের কাজ চালিয়ে নিয়ে গিয়েছে। তাদের পাল্টা নেটওয়ার্কের মোকাবিলা করা খুবই দুষ্কর।

—-চোলাই ?

—-চোলাই মদ মূলত ইথাইল অ্যালকোহল। আবগারি দফতর ও চোলাইয়ের কারখানাগুলির থেকেই জানা গিয়েছে, মদের আকর্ষণ বাড়াতে ইথাইল অ্যালকোহলের সঙ্গে পিরিডিন জাতীয় জৈব খার, মিথানল, ইউরিয়া এমনকী কীটনাশক বিষও মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে আজকাল। তাতে চোলাই খাওয়ার পর অল্প সময়েই নেশায় বুঁদ হয়ে যাওয়া যাচ্ছে। নেশার বহর বা়ড়তেই বেড়ে চলেছে খদ্দেরও সংখ্যাও। কিন্তু দিনের পর দিন বিষাক্ত এই মদের জেরে শরীরে থাবা বসাচ্ছে নানা মারণ রোগ। নষ্ট হচ্ছে চোখ। এমনকী অনেক সময়ই নেমে আসছে মৃত্যু। চোলাইয়ের শিকার যাঁরা, তাঁরা অনেকেই এ সব জানেন। তবু ছাড়তে পারেন না। অনেকে আবার এ সব জানেনও না। দিনের পর দিন নেশার বিষ শরীরে ঢুকে চলেছে সামান্য সুখানুভবের হাত ধরে।গৃহস্থ বাড়ির মাটির উনুনে বড় হাঁড়িতেই চোলাই তৈরি হয়। গ্রামে নানা পদ্ধতিতে তৈরি হয় চোলাই। আগে নিম্নমানের চাল দিয়ে ভাত তৈরি করে নেওয়া হয়। তারপর তাতে বাখড় মিশিয়ে দেওয়া হয়। বাখড় হল এক ধরনের মিষ্টি যা মূলত চোলাইয়ে ইস্ট-এর কাজ করে। অর্থাৎ চটজলদি ভাত পচাতে সাহায্য করে। ভাত পচে গেলে একটি বড় হাঁড়িতে বসিয়ে তা ফের ফোটানো হয় উনুনে। ওই হাঁড়ির উপরে বসানো হয় আরও একটি হাঁড়ি। পচা ভাতের বাষ্প পাইপের মাধ্যমে ফোঁটা ফোঁটা করে জমা হয় জারিকেনে বা বোতলে। এটাই হচ্ছে চোলাই মদ বা ইথাইল অ্যালকোহল। কেউ কেউ আবার পচা ভাতের বদলে চিটে গুড় বা চিনির গাদার সঙ্গে বাখড় মিশিয়ে তৈরি করেন চোলাই। এখন নেশার বহর বাড়িয়ে এই মদের খদ্দের বাড়াতে এর সঙ্গে মেশানো হচ্ছে নানা রকমের রাসয়নিক দ্রব্য। ইউরিয়া, পিরিডিন থেকে মিথানল মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

ধৃতদের কাছ থেকে বিভিন্ন বিলিতি ব্র্যান্ড মদের স্টিকার লাগানো বোতল ও ৩২ লিটার নকল মদ উদ্ধার করেছে আবগারি দফতর। এ ছাড়া, মিলেছে মদ তৈরির উপকরণও। জেলা আবগারি দফতরের সুপারিন্টেন্ডেন্ট শম্ভু রায় বলেন, “ধৃতেরা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিলিতি মদের বোতল জোগাড় করে তাতে নতুন করে ওই কোম্পানির স্টিকার লাগিয়ে নকল মদ ভরে বিক্রি করত। এই মদ খেলে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এই চক্রের সঙ্গে আরও কেউ জড়িত কিনা, তা দেখা হচ্ছে। আবগারি দফতরের দাবি, জেরায় ধৃতেরা জানিয়েছেন, রাহুল ও তাঁর বাবা নিজের বাড়িতে ওই নকল মদ বানাতেন। বিলিতি মদের খালি বোতল জোগাড় করতেন। বিভিন্ন মদের ব্র্যান্ডের নকল স্টিকার ও হলোগ্রামও মজুত ছিল তাঁদের কাছে। নকল মদ বানিয়ে পুরনো বোতলে নতুন করে ভরে নকল স্টিকার ও হলোগ্রাম বোতলে লাগিয়ে দেওয়া হত। লক্ষ্মণ তাঁদের বানানো মদ বিভিন্ন ধাবা ও দোকানে বিক্রি করতেন। বাঁকুড়ার ধলডাঙায় গোপাল বাঙালের একটি ধাবা রয়েছে। ওই ধাবাতেও এই নকল মদ বিক্রি হত। আবগারি দফতরের এক কর্তা জানান, এই কারবারের খবর গোপন সূত্রে পেয়ে প্রথমে লক্ষ্মণকে আটক করে জেরা করতেই তিনি সব ফাঁস করে দেন। বৃহস্পতিবার রাতে ধরপাকড়ে নামে আবগারি দফতর। প্রথমে রাহুলের বাড়িতে অভিযান চলে। সেখানে নকল মদ, মদ তৈরিতে ব্যবহৃত প্রায় ৩০ লিটার স্পিরিট, দুই লিটার ক্যারামেল-সহ বিভিন্ন উপকরণ উদ্ধার হয়। পাশাপাশি প্রায় ৬ হাজার বিভিন্ন বিলিতি মদের ব্র্যান্ডের স্টিকার ও নকল হলোগ্রাম এবং বহু পুরনো মদের খালি বোতল পান আবগারি দফতরের আধিকারিকেরা। উদ্ধার হয়েছে বেশ কয়েক বোতল দিশি মদও। 

পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে অধ্যাপকের বেশে রাজনৈতিক দালালরা ছাত্রভর্তিতে তোলাবাজি,পরীক্ষায় পাশ করানোর নামে অনৈতিক সুবিধা নেওয়া,ছাত্রীদের হেনস্থা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক দুর্নীতিতে জড়িয়ে রয়েছে বামপন্থী-তৃণমূলী বুদ্ধিজীবীরা। শিলিগুড়ি কলেজের অধ্যাপক অমিতাভ কাঞ্জিলাল ছাত্রীকে পরীক্ষায় পাশ করাতে দশ হাজার টাকা চাইছেন,বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অংশুমান কর একাধিক ছাত্রীকে হেনস্থা করছেন, আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কনফিডেন্সিয়াল একাউন্ট এর টাকা নয়ছয়ের পরেও দিলীপ সরকারের মতো ব্যক্তি উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার পদে পুনর্বহাল হচ্ছেন।

ভিন রাজ্য থেকে বিভিন্ন পন্য বাংলাদেশে আমদানি- রপ্তানি হয় বসিরহাটের ঘোজাডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে। ইট, বালি, পাথর, ফল, ফুল, সবজি, তেল বিভিন্ন কাঁচামাল যায় বাংলাদেশে। বাংলাদেশ থেকেও এদেশের বিভিন্ন রাজ্যে যায় বিভিন্ন পন্য। এই যাতায়াতের পথে বিভিন্ন ট্যাক্স দিয়ে থাকেন পণ্যবাহী ট্রাক চালকরা। টোল ট্যাক্স বা পৌরকরের মতো বিভিন্ন ট্যাক্স দিয়ে যাতায়াত করতে হয় ট্রাক গুলোকে। কিন্তু ট্রাক চালক ও খালাসিদের অভিযোগ, ‘বিভিন্ন নিয়মী কর ছাড়াও নতুন করে কর ধার্য করা হয়েছে এই আমদানি রপ্তানির ট্রাকগুলোর উপর। সেখানে বসিরহাট ব্রিজ থেকে ঘোজাডাঙ্গা বর্ডার অব্দি যেতে একটা অংকের টাকা দিতে হয় ট্রাক গুলিকে। তার কোনোটিতে লেখা ‘শ্রমিক ইউনিয়ন’, কোনোটিতে ‘কর্মহীন শ্রমিক বাঁচাও কমিটি’ কোনোটি ‘বর্ডার গাইড’। এই রকম বিভিন্ন নামে বিল ছাপিয়ে ট্রাক গুলির উপর থেকে কর আদায় করে বেশ কয়েকটি ছেলে। মূলত বসিরহাট থেকে ইন্ডিয়া যাওয়ার আগে কল বাড়ি, কালীবাড়ি মোড় এইসব অঞ্চলগুলোতে বাঁশ ফেলে ট্রাক আটকানো হয়। এরপর ট্রাকচালকদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় একটি বিল। যদি টাকা না দেওয়া হয় তাহলে ট্রাক যেতে দেওয়া হয় না। ট্রাক চালকদের গাড়ি থেকে নামিয়ে মারধর করা হয় বলে জানান ট্রাক চালক সুরিন্দর সিং। তবে স্থানীয় ট্রাক গুলোর ক্ষেত্রে মাসোয়ারার ব্যবস্থা রয়েছে। তাদের জন্য একটি পরিচয় পত্রের ব্যবস্থাও করে দিয়েছে সিন্ডিকেট। সারা বাংলা ট্রাক মালিকদের সংগঠনের যুগ্ম সম্পাদক সজল ঘোষ জানান, ‘এই সবটাই হয় স্থানীয় প্রশাসনের সমর্থনে। পুলিশই জুলুম করে টাকা নেয়। এটা সীমান্তে আসা ট্রাক গুলোর দীর্ঘদিনের অভিযোগ। ট্রাক ড্রাইভাররা বহুবার আক্রান্ত হয়েছে। আমরা একাধিক অভিযোগ করে ফল পায়নি। তাই আজ ধর্মঘটের পথে।’ সূত্র মারফত জানা গিয়েছে, বিভিন্ন পণ্যের ট্রাক পিছু ভিন্ন ভিন্ন মূল্য ধার্য করা রয়েছে। খালি ট্রাক গেলে ২০০ টাকা, পাথর বোঝাই গাড়ি ১৩০০ টাকা, আলু, পটল, পেঁয়াজের মতো আনাজ বা সবজির গাড়ি পিছু ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা। আরও জানা গিয়েছে, প্রত্যেকদিন ৩০০ থেকে সাড়ে ৩৫০টির বেশি পণ্যবাহী গাড়ি এখান দিয়ে যাতায়াত করে। তাহলে যদি প্রত্যেক গাড়ি থেকে গড়ে ৮০০ থেকে ১০০০ বা ১৫০০ করে টাকা নেওয়া হয় তাহলে দিনে কয়েক লক্ষ টাকা উঠছে। মাসে কোটি কোটি টাকা আদায় করছে সিন্ডিকেট। তবে সিন্ডিকেটের দাবি, ‘এই টাকার একটা অংশ ভোগ করছে সিন্ডিকেট। অন্য অংশ যায় পার্টির ফাণ্ডে।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক নেতা জানান, ‘বছর খনেক আগে থেকে গরু পাচার বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই এই নতুন ব্যবসা চালু হয়। এর নেপথ্যে রয়েছে বসিরহাটেরই এক শীর্ষ নেতা। যার অঙ্গুলি হেলনেই হয় সমস্ত কিছু। দীর্ঘদিন ধরে বসিরহাটে গরু পাচারের হোতা ছিলেন তিনি। গরু বন্ধ হতেই এই ব্যবসা শুরু করেন তিনি। সাম্প্রতিক এক বস্তা সোনার বার সমেত ধরাও পড়েছিলেন তিনি। সোনা ছাড়াও প্রশাসনের নাকের ডগায় ভিন্ন বেআইনি কারবার চালিয়ে আসছেন তিনি।’ তবে এনিয়ে প্রশাসনের কাছে কোনও অভিযোগই নেই বলে জানান বসিরহাট পুলিশ জেলার পুলিশ সুপার কে শবরী রাজকুমার। তবে তদন্ত করে ঘটনাটি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। এনিয়ে রা বসিরহাটের বিজেপি প্রার্থী সায়ন্তন বসু এই ঘটনাকে তোলাবাজির লেটেস্ট নিদর্শন বলে আক্ষা দিয়েছেন। তার কথায়, ‘এর আগেও সিপিএম তোলাবাজি করত তবে সেটা আন-রেজিস্টার ছিল। এখন এটা স্বীকৃত তোলাবাজি আর সিন্ডিকেট রাজে পরিণত হয়েছে।’ 

–পার্কস্ট্রিট গণধর্ষণ কাণ্ড ?

—-২০১২ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি পার্ক স্ট্রিটে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। পুলিশ প্রথমে মহিলার অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে । সংবাদমাধ্যমের চাপে শেষপর্যন্ত অভিযোগ দায়ের করে পার্কস্ট্রিট থানা। সরকারের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয় মহিলা সঠিক অভিযোগ করছেন না। এরপর তৎকালীন পুলিস কমিশনারও মহিলার বক্তব্যে অসঙ্গতি রয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন। তৎকালীন পুলিসকমিশনার রঞ্জিতকুমার পচনন্দা সাংবাদিকদের বলেন, `নাথিং হ্যাপেনড` তদন্তের আগেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী ঘটনাটিকে সাজানো বলে মন্তব্য করেছিলেন।পরে অবশ্য গোয়েন্দারা ধর্ষণের প্রমাণ পান, কিন্তু তারপরেই সরিয়ে দেওয়া হয় পুলিশের গোয়েন্দা প্রধানকে।আদালতে ধৃতদের যে চার্জ পড়ে শোনানো হয়, তাতে তিন অভিযুক্ত – সুমিত বাজাজ, রুমন খান ও নাসির খান – সবার বিরুদ্ধেই গণধর্ষণ ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছে। দুজনের বিরুদ্ধে মারধর ও হুমকির অভিযোগও রয়েছে ।মূল অভিযুক্ত কাদের খান এবং আরও একজন এখনও ফেরার রয়েছে।

—-পার্ক স্ট্রিটের একটি পাঁচতারা হোটেলের নাইটক্লাব থেকে ওই মহিলাকে নিয়ে গাড়িতে করে বেরিয়েছিলেন অভিযুক্তরা তার ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ছবি, তাদের গাড়ি থেকে পাওয়া ধর্ষণের প্রমাণ, ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্ট দিয়েছে পুলিশ । অন্যান্য শহরে চলন্ত গাড়িতে গণধর্ষণের কথা শোনা গেলেও কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে রাজপথে দীর্ঘক্ষণ ধরে একটি গাড়িতে গণধর্ষন করা হচ্ছে, পুলিশের নজরে পড়ছে না, আবার ভোররাতে একটা থানার কাছেই গাড়ি থেকে ধর্ষিতাকে ফেলে দেওয়া হচ্ছে– এটা একটা বিরল ঘটনা । তদন্ত শুরুর আগেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বলে দেন যে সরকারের বেকায়দায় ফেলার জন্য ঘটনাটা সাজানো হয়েছে । পুলিশ কমিশনারকে দিয়েও প্রায় একই বয়ান দেওয়ানো হয়। মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য নিয়ে যখন ব্যাপক সমালোচনা চলছে, তখনই পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ প্রাথমিক তদন্তে গণধর্ষনের প্রমাণ পাওয়ার কথা ঘোষণা করে দেয়। মুখ্যমন্ত্রী যেটাকে সাজানো ঘটনা বলেছিলেন, সেটাকে গণধর্ষণ বলে দেওয়াতে কয়েকদিনের মধ্যেই কম গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে বদলি করা হয় কলকাতার প্রথম মহিলা গোয়েন্দা প্রধান দময়ন্তী সেনকে। মুখ্যমন্ত্রীর ‘সাজানো ঘটনা’ মন্তব্যের পরে কয়েকজন রাজ্যের এক মন্ত্রী ওই মহিলা যৌনকর্মী কী না – সেই ইঙ্গিতবাহী প্রশ্ন করেছিলেন। কংগ্রেসের এক মহিলা সাংসদ আবার সেই ইঙ্গিত দিয়ে বলেন যে পার্ক স্ট্রিটের ঘটনা কোনও ধর্ষণ নয়, ওই মহিলা আর তাঁর ক্লায়েন্টদের মধ্যে দরদাম নিয়ে অশান্তি করেছিলেন ।  এই মামলায় সরকারের দায়সারা মনোভাবের জন্য সম্প্রতি দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল ।

-––সাড়ে চার বছরের বেশি পালিয়ে পালিয়ে থেকেও লাভ হল না। শেষ পর্যন্ত পুলিসের জালে ধরা পরে গেল পার্কস্ট্রিট গণধর্ষণ কাণ্ডের মূল অভিযুক্ত কাদের খান ও তাঁর সঙ্গী আলি। কিন্তু কীভাবে পুলিস দুজনের খোঁজ পেল? গতমাসে পুলিস জানতে পারে বিহার-নেপাল সীমান্তের গ্রামে রয়েছে । কাদেরের পরিবারের সদস্যদের উপর নজর রাখতে শুরু করে পুলিস। তাঁদের ফোন ট্র্যাক করে পুলিস।  দেখা যায় দিল্লির একাধিক নম্বর থেকে ফোন আসছে কাদেরের বাড়িতে।বিভিন্ন মাধ্যমে দিল্লিতে টাকাও পাঠাচ্ছেন কাদেরের পরিবারের সদস্যরা। পুলিস নিশ্চিত হয় দিল্লি বা সংলগ্ন এলাকাতেই লুকিয়ে আছে কাদের আর আলি। একাধিক ফোন নম্বর ব্যবহার বাড়িতে যোগাযোগ করছে। এরপরেই গাজিয়াবাদে কাদের আর আলির ডেরার খোঁজ মেলে। সেখান থেকেই দুজনকে গ্রেফতার করে পুলিস।

—আচ্ছা । আজ এ-পর্যন্তই থাক । আবার অন্য একদিন বসা যাবে ।

—হ্যাঁ। ততোদিনে আবার নানা কলঙ্কবাজি উঠে আসবে পশ্চিমবাংলার পেঁকো সমাজ থেকে ।

—শুধু পশ্চিমবঙ্গের ঘটনার কথা বলছেন কেন ? বলুন ভারতবর্ষ, দ্যাট ইজ ইন্ডিয়া ।

—কারেক্ট, কারেক্ট, থ্যাঙ্কিউ ।

Posted in Uncategorized | Leave a comment

নষ্টনটদের কলোনি : মলয় রায়চৌধুরী

এক

[ ম্যাশাপ কাকে বলে আগে জেনে নিন :For the uninitiated, a ‘mashup’ is when you take several established styles of anything and mix them together to make something completely new and unique. The popularity of the mashup really exploded onto the cultural scene with the advent of postmodern literature. It combines all literary canons and makes fun of it by indirectly attacking the author’s rotting society. Creative artists of all kinds have been doing mashups for quite some time. Ever hear of fusion cuisine? Ate a fusion dish ? Drank fusion liquor ? Heard fusion music ? They’re mashups. A mashup novel or text (also called  “mashed-up text”), is an unauthorised non-canonical (and not even in-universe) work of fiction (often parody) which combines a pre-existing literature text, often work of authors, with another genre,  into a single narrative. Marjorie Kehe of the Christian Science Monitor renders this admixture of classic text as “somewhere between 60 and 85 percent original text, with new plot twists added by contemporary co-authors”. The term appears to have first been coined in a review of Seth Grahame-Smith’s 2009 novel, Pride and Prejudice and Zombies. Initially calling it a ‘parody’ and ‘literary hybrid’, Caroline Kellogg, lead blogger for Jacket Copy, The LA Times‘ book blog, later describes the work as “novel-as-mashup”. As the popularity of the narrative grew and a bidding war commenced over the film rights to the book, the term spread. Subsequent mash-up narratives include Sense and Sensibility and Seamonsters, “Little Women and Werewolves” and Abraham Lincoln, Vampire Hunter (also by Grahame-Smith). তাছাড়া, 1969 সালে, কবি হাওয়ার্ড ডব্লিউ. বার্গারসন এবং জেএ লিন্ডন একটি কাট-আপ কৌশল তৈরি করেন যা শব্দভাণ্ডার ক্লেপ্ট কবিতা নামে পরিচিত , যেখানে একটি বিদ্যমান কবিতার সমস্ত শব্দ নিয়ে তাদের পুনর্বিন্যাস করে, প্রায়শই মাত্রা এবং স্তবকের দৈর্ঘ্য সংরক্ষণ করে একটি কবিতা তৈরি করা হয়। কৌশলটির একটি নজির 1920-এর দশকে একটি দাদাবাদী সমাবেশের সময় ঘটেছিল যেখানে ত্রিস্তান জারা একটি টুপি থেকে এলোমেলোভাবে শব্দ টেনে ঘটনাস্থলে একটি কবিতা তৈরি করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন । কোলাজ , যা মোটামুটিভাবে পরাবাস্তববাদী আন্দোলনের সাথে সমসাময়িকভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল, কখনও কখনও সংবাদপত্র বা ব্রোশারের মতো পাঠ্য অন্তর্ভুক্ত করে। এই ইভেন্টের আগে, টেকনিকটি জারার কবিতায় 391 সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল, দাদা ম্যানিফেস্টো  : দুর্বল প্রেম এবং তিক্ত প্রেমের উপ-শিরোনামে, একটি দাদাইস্ট কবিতা তৈরি করুন 1977 সালে পারফরম্যান্স কবি হেডউইগ গোর্স্কির পাঁচটি কণ্ঠে লেখা একটি নাটক মুদ্রণ প্রকাশের পরিবর্তে শুধুমাত্র অভিনয়ের জন্য কবিতা তৈরির ধারণার উদ্ভব করেছিল। বুবি, মামা শিরোনামের ‘নব পদ্য নাটক’ ! পাবলিক প্লেসে “গেরিলা থিয়েটার” পারফরম্যান্সের জন্য লেখা সংবাদপত্রের কাট-আপগুলির সংমিশ্রণ ব্যবহার করা হয়েছিল যা অ-পেশাদার অভিনেতাদের একটি দলের জন্য সম্পাদনা এবং কোরিওগ্রাফ করা হয়েছিল। ক্যাথি অ্যাকার , নানা ধরণের ম্যাশাপের ন্যারেটিভ তৈরি করেছিলেন । আমি এখানে যে নাম ব্যবহার করেছি, তা সাহিত্যের বিখ্যাত চরিত্র । ]

দুই

কলোনি সরকারের বিজ্ঞপ্তি

( ‌১ ) দেখুন, আপনাকে যারা চেনে জানে, সেই মুষ্টিমেয় পাঠকেরা এই সমস্ত প্রাসঙ্গিকতার প্রমাণ চায় না, স্যর। বোঝেন তো, বাংলা সাহিত্য-পড়া যুবক-যুবতী প্রতিক্রিয়াশীল খোকা-খুকি সিলেবাস-প্যাঁদানো অভিজ্ঞতায় ভারতচন্দ্র থেকে আরম্ভ করে খুব বেশি দূর এগোতে পারেন নি — বড়োজোর ১ ছটাক বঙ্কিম সাড়ে ৩ সের শরৎ ও ৬০ মন রবীন্দ্রের সঙ্গে পোয়াটাক বিভূতি প্লাস তারাশঙ্করের চাকনা ছিটানো লাবড়া সাপটে এখন নীতিঠাকমার পুণ্য দায়িত্ব স্বেচ্ছায় পালন করছেন “স্বচ্ছ ভারত”-তুল্য তৎপরতায়। যদিও, আপত্তির মূল কারণ — “মোটা ও মসৃণ তুলতুলে বাহু”-র মধ্যে যে অনাধুনিক আটপৌরে মাধুর্য আছে তা আপনার প্রিয় অথচ “ছোটো বুক” ভাল্লাগে না আপনার। বলিহারি আপনার রুচি। এ ভারি অন্যায়, হ্যাঁ ! ক্রমশ অ্যানোরেক্সিয়া আক্রান্ত বেআক্কেলে ফ্যাশনিস্তার সামনে সত্যি কথা টুসকি মেরে মুখের উপর বললে মুখঝামটা খেতেই হবে সাবেকি মিসোজিনিস্ট হওয়ার অভিযোগে। (আঁচলগোঁজা নারীবাদী জেঠিমারা তেড়ে এলো বলে!)

আরে… মহায়, আলঙ্কারিক আড়ম্বর ছেড়ে সোজা কথার সরল স্বীকারোক্তি যে ডিসফাংশনাল হরমোন-স্রাবী অপরিণত দেহের মেয়েছেলেটার হীনম্মন্যতা ফিরিয়ে আনতে পারে — এবার থেকে সেটাও খেয়াল রাখবেন মাইরি লিখতে বসার আগে। ব্যঙ্গভূমির ধুমাধাড় সঙোসকিরিতি আপনার ক্ষুধার্ত যুগেও যা ছিল, এখনও তা-ই আছে। এককথায় যা তা। ঔচিত্যবোধ নিংড়ে যে গেরস্তের পাঁচালি হতে পারে কিন্তু সাহিত্য হতে পারে না — সাহিত্য যে হিতোপদেশের সংকীর্ণ উপত্যকা ছেড়ে সেই ৬০ দশকেই মধ্যবিত্ত ছুঁৎমার্গ ডিঙিয়ে বিশ্বকৃষ্টির বিচিত্র মোহনায় মেশার স্পর্ধা দেখাতে পেরেছিল, অন্তত প্রাতিষ্ঠানিকতা ভাঙার ঐকান্তিক প্রয়াস একটা ছিল — সে আর ক’জন মনে রেখেছে‽ (গণখোরাকের চিড়বিড়ে পুলকে অস্থির পাঠকবৃন্দ ভাবছে কে এই মলয় মাকড়া? আমি তো ফালগুনী রায়, অরুণেশ ঘোষ, সুবিমল বসাক কাউকে চিনি না; রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায় ও নবারুণ ভট্টাচার্য পটল তুলেছে তাতে কারোর সামান্যতম ছেঁড়া যায়নি। পেঁয়াজি মারা হচ্ছে, অ্যাঁ, নষ্টনট ?

( ২ ) নষ্টনটদের কলোনিতে তাদেরই পাঠানো হয় যারা অতিবুদ্ধিমান হবার দরুন সরকারের পক্ষে ক্ষতিকর । কেবল পুরুষদের পাঠানো হয় । কলোনি একেবারে নারীবর্জিত । সরকারি আইন অনুযায়ী পালা করে তারা সমকামে লিপ্ত হবার অধিকার পেয়েছে । তাই তাদের কোনো পোশাক দেয়া হয়নি । শীত গ্রীষ্ম বর্ষা হেমন্ত বসন্ত শরৎ সারা বছর তারা উলঙ্গ থাকে । তাদের খাবার আকাশ থেকে ছুঁড়ে ফেলা হয় । জলের আকাল থাকলেও সেই জল খেতে তারা অভ্যস্ত । কেউ মরে গেলে তার মাংস খাবার অনুষ্ঠান করা হয় । কলোনির অদৃশ্য সরকার তাদের হুকুম দিয়েছে যে তারা সারা বছর অপেক্ষা করবে নানা সমস্যা গড়ে ওঠার জন্য এবং সেগুলো সমাধান করার জন্য আকাশপথে একজন নটবর আবিভূত হবে । 

( ৩ ) এই কলোনিতে যারা আছে তারা কেউ ব্রহ্মার মুখ, বাহু, ঊরু ও পা থেকে জন্মায়নি । তারা ডারউইন সাহেবের কলম থেকে জন্মেছে ।

( ৪ ) নষ্টনট কলোনির নিবাসীরা একে আরেকজনের স্বপ্ন হ্যাক করার ক্ষমতা রাখে । তাই কে কার নাম নিয়ে কী বলছে তা টের পাওয়া কঠিন । তাদের যখন কলোনিতে পাঠানো হয় তখন একটা নাম বাছাই করার সুযোগ দেয়া হয় । কিন্তু কলোনির নিবাসীদের সঙ্গে মেলামেশার দরুন তারা পরস্পরের নাম আর বক্তব্য চুরি করে নিজের বলে চালায় । তারা জানে যে এই পদ্ধতি তাদের অমরত্ব দিয়েছে । 

তিন

দেবদাস : যত্তো সব মাতালের দল । খালাসিটোলা আর বাঙালিটোলার তফাত জানে না ।

গোরা : আমরা পাগলটোলায় জড়ো হয়েছি কেন, কিসের জন্য অপেক্ষা করছি ?

বিনয় : আজকে নটবরের আসবার কথা ।.

মহেন্দ্র : পাগলটোলায় কোনও কাজ হচ্ছে না কেন ?

বিপ্রদাস : পাগলরা কেন আইন প্রণয়ন না করে বসে আছেন? 

মধুসূদন : কারণ নটবর আজকে আসবেন ।.

নলিনাক্ষ : পাগলদের এখন আইন প্রণয়ন করে কী লাভ ?

নক্ষত্র রায় :নটবর একবার এখানে এসে পড়লে তিনিই আইন প্রণয়ন করবেন ।.

গোবিন্দমাণিক্য : আমাদের রাজপুত্তুর এতো ভোরবেলা উঠে পড়লেন কেন ? আর কেনই বা উনি শহরের মাঝখানে সিংহাসনে বসে আছেন ? মাথায় মুকুট পরে, দরবার সাজিয়ে ?.

অমিত রায় : কারণ নটবর আজকে আসবেন ? আর রাজপুত্তুর ওনাকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য অপেক্ষা করছেন ।

শশাঙ্ক : তাঁকে দেবার জন্য ওনার হাতে একটা গোটানো কাগজও রয়েছে, নানা খেতাব, গম্ভীর রকমের উপাধির তালিকা ।.

রঞ্জন : আমাদের দুজন খোচর আর কোটনা বাইরে বেরিয়ে এসেছেন কেন ? ওনাদের কারুকাজ করা লাল রঙের পোশাক পরে ?.

মদন : ওরা নীলকান্তমণি-বসানো ব্রেসলেট পরে আছে কেন ? আঙুলে ঝলমলে পান্নার আঙটি ?

অর্জুন : ওদের হাতে ছড়ি রয়েছে কেন, রুপো আর সোনার সুন্দর কাজ করা ?

রহমত : কারণ আজকে নটবর আসছেন, আর ওই ধরণের জিনিসে নটবরের চোখ ধাঁধিয়ে যায় ।

তারাপদ : আমাদের পাগল-হাউসের বাগ্মীরা রোজকার মতন আসেননি কেন ? বাকতাল্লা দেবার জন্য, যা বলবার তা বলার জন্য ?

নিখিলেশ : কারণ নটবর আজকে আসছেন, আর উনি বাগ্মীতা আর বক্তৃতায় বিরক্ত বোধ করেন। 

চন্দ্রকান্ত : কেন হঠাৎ এই ধন্দ, এই বিভ্রান্তি?

সন্দীপ : রাস্তাগুলো আর চৌমাথা এতো তাড়াতাড়ি ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে কেন ? সবাই চিন্তায় মশগুল হয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে ?

জগমোহন : রাত হতে চলল আর নটবর এখনও এলেন না ।

নীলান্দস্বামী : আর পাগল স্ট্রিট থেকে আমাদের যে লোকজন এসেছে তারা বলছে, নটবর বলে  কিছু নেই ।

আদিত্য : এবার আমাদের কী হবে নটবর না এলে ?

নবকুমার : নটবরই তো ছিলেন সমস্যা-নির্মাণ আর আগুনখেকো  সমাধান ।

দেবদাস : যত্তো সব মাতাল । পার্বতী আর চন্দ্রমুখীর তফাত জানে না ।

মাল্যবান : আমাকে একটু আহ্লাদ দাও।

জিতেন দাশগুপ্ত : স্বপ্নের কী জানেন ফ্রয়েড? ভিয়েনা শহরে বসে গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে স্নায়ুরোগীদের স্বপ্ন নিয়ে কোনো স্বপ্নতত্ত্ব বানানো যায় না। চড়কের মাঠে কোনোদিন তো আর যাবেন না ফ্রয়েড সাহেব,স্বপ্নের আর কী বুঝবেন।

কতলু খাঁ : ঐ দেখ ! যেন পদ্মবনে হংসী সমীরণোত্থিত তরঙ্গহিল্লোলে নাচিতেছে; প্রফুল্ল পদ্মমুখী সবে ঘেরিয়া রহিয়াছে। দেখ দেখ, ঐ যে সুন্দরী নীলাম্বরপরিধানা, ঐ যার নীল বাস স্বর্ণতারাবলীতে খচিত, দেখ! ঐ যে দেখিতেছ, সুন্দরী সীমন্তপার্শ্বে হীরকতারা ধারণ করিয়াছে, দেখিয়াছ উহার কি সুন্দর ললাট! প্রশান্ত, প্রশস্ত, পরিষ্কার; এ ললাটে কি বিধাতা বিলাসগৃহ লিখিয়াছিলেন? ঐ যে শ্যামা পুষ্পাভরণা, দেখিয়াছ উহার কেমন পুষ্পাভরণ সাজিয়াছে? নারীদেহ শোভার জন্যই পুষ্প-সৃজন হইয়াছিল। ঐ যে দেখিতেছ সম্পূর্ণ, মৃদুরক্ত, ওষ্ঠাধর যার; যে ওষ্ঠাধর ঈষৎ কুঞ্চিত করিয়া রহিয়াছে, দেখ, উহা সুচিক্কণ নীল বাস ফুটিয়া কেমন বর্ণপ্রভা বাহির হইতেছে; যেন নির্মল নীলাম্বুমধ্যে পূর্ণচন্দ্রালোক দেখা যাইতেছে। এই যে সুন্দরী মরালনিন্দিত গ্রীবাভঙ্গী করিয়া হাসিয়া হাসিয়া কথা কহিতেছে, দেখিয়াছ উহার কেমন কর্ণের কুণ্ডল দুলিতেছে? কে তুমি সুকেশি সুন্দরী? কেন উর:পর্যন্ত কুঞ্চিতালক-রাশি লম্বিত করিয়া দিয়াছ? পদ্মবৃক্ষে কেমন করিয়া কালফণিনী জড়ায়, তাহাই কি দেখাইতেছ? আর, তুমি কে সুন্দরী, যে  সুরা ঢালিতেছ? কে তুমি, যে সকল রাখিয়া তোমার পূর্ণলাবণ্যদেহ আমাপ্রতি  ঘন ঘন সতৃষ্ণ দৃষ্টিপাত করিতেছে? কে তুমি অব্যর্থ কটাক্ষে  হৃদয় ভেদ করিতেছ? ও মধুর কটাক্ষ চিনি; তুমি বিমলা। অত সুরা ঢালিতেছ কেন? ঢাল, ঢাল, আরও ঢাল, বসন মধ্যে ছুরিকা আছে ত? আছে বই কি। তবে অত হাসিতেছ কিরূপে? কে তোমার মুখপানে চাহিতেছে। ও কি? কটাক্ষ! ও কি, আবার কি! ঐ দেখ, সুরাস্বাদপ্রমত্ত যবনকে ক্ষিপ্ত করিলে। এই কৌশলেই বুঝি সকলকে বর্জিত করিয়া আমার প্রেয়সী হইয়া বসিয়াছ? না হবে কেন, যে হাসি, যে অঙ্গভঙ্গী, যে সরস কথারহস্য, যে কটাক্ষ! আবার সরাব!  যে চাহনি চাহিয়া বিমলা হাতে সুরাপাত্র দিতেছে! ও কি ধ্বনি? এ কে গায়? এ কি মানুষের গান, না, সুররমণী গায়? বিমলা গায়িকাদিগের সহিত গায়িতেছে। কি সুর! কি ধ্বনি! কি লয়!  এ কি? মন কোথায় তোমার? কি দেখিতেছ? সমে সমে হাসিয়া কটাক্ষ করিতেছে; ছুরির অধিক তোমার হৃদয়ে বসাইতেছে, তাহাই দেখিতেছ? অমনি কটাক্ষে প্রাণহরণ করে, আবার সঙ্গীতের সন্ধিসম্বন্ধ কটাক্ষ! আরও দেখিয়াছ কটাক্ষের সঙ্গে আবার অল্প মস্তক-দোলন? দেখিয়াছ, সঙ্গে সঙ্গে কেমন কর্ণাভরণ দুলিতেছে? হাঁ। আবার সুরা ঢাল, দে মদ দে, এ কি ! এ কি! বিমলা উঠিয়া নাচিতেছে। কি সুন্দর! কিবা ভঙ্গী! দে মদ! কি অঙ্গ! কি গঠন!  স্থির হও!“

দেবদাস : যত্তো সব মাগিবাজ । ইনডিয়া আর ভারতের তফাত জানে না ।

হেম : যে-সব সাহচর্য তোমাকে ঘিরে থাকে,তারা তোমার চারিত্র্যও কোনো-না কোনো ভাবে কাটে-ছাঁটে; তুমি যে-সমাজে বাস করতে শুরু কর,তার কথ্যভাষার টানটাও তোমার জিভে এসে যায় ।

গফুর : প্রথম যখন আমার খৎনা হলো, তখন আমার বয়স আট বৎসর। দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র। রোল, একানব্বই। মোট ছাত্র-ছাত্রী বিরানব্বই। পড়াশোনায় ছিলাম ডাব্বা। ভাবলাম, শাস্তি হয়তোবা। একজন ডাক্তার আসলেন স্কুলে। এসে আমার প্যান্ট খুলে বললেন, ‘কই দেখি ছোটপাখি? কিচিরমিচির ডাকি ডাকি..!’ বলে আমার ছোটপাখি বের করে কচ করে কেটে দিলেন অল্প একটু চামড়া। আমি তারস্বরে চিৎকার করে উঠলাম। কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী আমার দিকে আঙ্গুল তাক করে হাসলো। আমি চিৎকার গিলে ফেললাম। বাসায় ফেরার পথে দেখলাম, আমার প্যান্টের জিপারে রক্ত লেগে আছে। রাস্তাঘাটের অনেকেই আমার দিকে আঙ্গুল তাক করে কুৎসিত কথা বলল। বাসায় ফিরে ছোটপাখি কাটা যাওয়ার তীব্র যন্ত্রণা সামলে উঠতে সময় লাগল বেশ কিছুদিন। আমি ঘর থেকে বের হতে পারলাম না। হাঁটতে গেলেও লুঙ্গিতে ঘষা খেত আহত পাখি। কিচিরমিচির ডেকে উঠত খুব। ঘাম দিতো শরীর। সেকি যন্ত্রণা! পুরো নয়দিন লাগল যন্ত্রণা দূর হতে। দশদিনের মাথায় আমি পুরোপুরি সুস্থ। ফের খেলতে ছুটলাম, ব্যাগ কাঁধে স্কুল। সব ঠিকঠাক। এক মাস পর রাস্তায় হাঁটছি। হাতে ব্যাট। মাত্রই ক্রিকেট খেলে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছি। ডাক্তার সামনে উপস্থিত। হাতে যন্ত্রপাতি। আমি আশপাশ তাকালাম। আজ কার ছোটপাখি কাটা হবে? ডাক্তার এসে আমার প্যান্ট খুলে আমারই ছোটপাখি বের করে ফের কেটে দিলেন আরেকটুখানি। আমি চিৎকার করে উঠলাম।

‘এক পাখি কয়বার কাটবেন হারামজাদা?’ ‘এক দুই মাস পর পর কাটতে হবে বেটা।’ ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে আমার বিশ্বাস হলো না। কী বলে এই লোক! দৌড়ে বাড়ি আসলাম। আব্বা লুঙ্গি উঁচু করে বসে বললেন, ‘কী হয়েছে রে তোর?’ ‘আমার ছোটপাখি দুইবার কাটা হয়েছে।’ আব্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আমার চারশো একান্নবার।’আব্বার চোখে জল। আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম আব্বার বুকে। আব্বা কাঁদো স্বরে বোঝালেন, ‘কিচ্ছু করার নেই বাবা। এটাই আমাদের শরীর। মাসে এক দুইবার করে কাটা যাবে।’ ‘আমাদেরই কেন?’ ‘প্রকৃতি এইভাবেই তৈয়ার করেছে আমাদের।’ ‘তাই বলে মাসের পর মাস?’ ‘তো কী? এখন ডাক্তার কাটতেছে, আরেকটু বড়ো হলে নিজেকেই কাটতে হবে।’ ‘নিজেকে মানে? নিজের পাখি নিজে কী করে কাটবো?’ আমার বয়স এখন একুশ। আজ জোছনা রাত। ছাদে লুঙ্গি খুলে বসে আছি। হাতে কেঁচি। একটু পর যখন চাঁদ উঠবে, সমস্ত ছাদজুড়ে জোছনা থইথই করবে, কুটুস করে আমি আমার ছোটপাখির মাথা কেটে নিবো তখন। তিরানব্বই বারের মতোন। রক্তে ভেসে যাবে ছাদ। অথচ কেউ টের পাবে না। কেউ জানবে না। শহরের ছাদে ছাদে অসংখ্য পাখি কাটা যাবে, রক্তে ভেসে যাবে জোছনা, কারো টু শব্দ থাকবে না। পুরুষের শারীরিক দুঃখ কষ্টগুলো অত্যন্ত গোপন একটা বিষয়। আশপাশের কেউ তার হদিস রাখে না।

দেবদাস :  যত্তো সব  মাতাল । খোসা-ছাড়ানো বাঙালি আর খোসাসুদ্দু বাঙালির তফাত জানে না ।

রাজপুত্র : ওই তো আকাশ থেকে নটবরের ইগলু নামছে, তিনটে প্যারাশুটে বাঁধা।

সওদাগরপুত্র : ওটা ইগলু নয় । মহাকাশযান থেকে কাউকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে । সেই লোকটা ওই ক্যাপসুলে বসে আছে ।

শ্রীকান্ত : আমার মনে হয়, স্বর্গ থেকে মেনকা, উর্বশী, রম্ভা, তিলোত্তমা, ঘৃতাচী, অলম্বুষা, মিশ্রকেশী্, জানপদী,  বিদ্যুৎপর্ণা, অদ্রিকা, পঞ্চচূড়া, সোমা, মরীচি, শুচিকা, অম্বিকা, ক্ষেমা, অসিতা, সুবাহু, সুপ্রিয়া, সুগন্ধা, সুরসা, বিশ্বাচী, পূর্বচিত্তি, প্রম্লোচা, বর্গা, প্রমথিনী, কাম্যা, শারদ্বতী, গুণবরা, ঋতুস্থলা, বুদ্বুদা, সৌরভেয়ী, ইরা, চিত্রাসেনা, সমীচী, চারুনেত্রা, পুঞ্জিকস্থলা, শুচিস্মিতা, বিশালনয়না যে সব অপ্সরারা থাকে তাদের গুমুত আর মাসিকের কাপড় ফেলা হচ্ছে ডাবায় ভরে । দেবরাজ ইন্দ্র প্রায়েই অপ্সরাদের মর্তে পাঠান নেতাদের লোভ দেখিয়ে চুতিয়া বানাবার  জন্য। 

খোকা : যখন আমাকে নেতারা এখানে পাঠাচ্ছিলেন তখনই দেখেছিলুম ওনারা মহাচুতিয়া ।

রাজপুত্র : অপ্সরাদের গুমুত দিয়ে মূর্তি গড়ে আমরা একজন শাসক তৈরি করতে পারি । অবশ্য যদি নটবর এসে পড়েন তাহলে গুয়ের তৈরি শাসকের দরকার নেই ।

অমরনাথ : যে নামছে, তাকে আমরা নটবরের জায়গায় বসাই আর ওকেই অনুরোধ করি আমাদের সমস্যা তৈরি করে তার সমাধান খুঁজে বের করতে ।

শচীন্দ্র : ও কি জানে এটা নষ্টনটদের কলোনি আর আমরা উলঙ্গ, সরকার আমাদের পোশক বরাদ্দের আইন পাশ করেনি, ল্যাংটো করে নষ্টনট কলোনিতে পাঠিয়েছে, সঙ্গে তরতাজা যুবতীদের পাঠায়নি ।

নগেন্দ্র : আমি মোটেই নষ্টনট নই, আমি স্কিৎসোফ্রেনিক ।

মহেন্দ্র : আমিও নষ্টনট নই । আমি মনোরোগে ভুগছি ।

সতীশ : আর সবাই জানে আমি হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত হই ।

রমেশ : আগে দেখা যাক যে নামছে সেও নষ্ট কিনা । হয়তো অন্য গ্রহ থেকে ওকে নষ্টনটদের কলোনিতে পাঠানো হয়েছে, আমাদের সঙ্গ দেবার জন্য ।

বেণী ঘোষাল : চল চল চল চল নেমেছে নেমেছে ।

সব্যসাচী : লোকটা নিজে থেকেই বেরোবে না আমরা লাথি মেরে ক্যাপসুলটা খুলবো ?

অপূর্ব : যদি কেউ ভেতরে না থাকে ? যদি অপ্সরাদের গুমুত দিয়ে ভরা থাকে ? 

গফুর : যদি লোকটা পাগল না হয় ?

মহিম : যদি ওর মধ্যে কোনো পাগলি থাকে ?

শশী: পাগলি থাকলে আমি নেবো । সহনশীল হতে হতে এক অত্যাশ্চর্য ঘুণপোকা হবার পর, কুরে খাচ্ছি নিজের একান্ত ব্যক্তিগত মস্তিষ্ক ।

আনন্দ : না আমি নেবো । তোমার তো কুসুম আছে । রোজ শালবনে নিয়ে গিয়ে চোদনকম্মো করতে, মানিক বাঁড়ুজ্জে জানতে পারলে তোমার লিঙ্গ কেটে তোমাকে খাইয়ে দিতো ।

যতীন : পাগলি থাকলে আমরা কি তাকে নটবউ বলব ? 

সদানন্দ : নটবউ হলে তো মুশকিল, আমাদের সমস্যা বেড়ে যাবে । পাগলদের দেশে স্যানিটারি ন্যাপকিন নিষিদ্ধ । হয়তো তিনি রুপবতী, তিনি গুনবতী, তিনি ভাগ্যবতী। হয়তো তাঁর কপালের সাথে আপনার কপালের একটি মাত্র ঘষায় আপনিও হয়ে উঠতে পারেন বাংলার মুকেশ আম্বানি। হয়তো তিনি বাহিরে গরম, ভিতরে শরম টাইপ মানবী। হয়তো কন্যার হাসি আপনার সালমান খানের  মতন কঠিন হৃদয়ও গলিয়ে ফেলে ভানু বাঁড়ুজ্জের মতো হাসতে হাসাতে শেখাবে। হয়তো কন্যার কথায় আপনি আদানির মতো চানাচুর বেচে তিন দিনে কোটিপতি হওয়ার মতো মোটিভেশান পাবেন। ভাইসব সামনে শীতকাল, যিনি আসছেন সেই কচি এলাচের মতো কোমল হৃদয়ের নারীটির ওপর রহম করেন, বিনিময়ে সে পুরা শীতকাল নোরা ফাতেহির মতো তার শাড়ীর আঁচল কেটে আপনারে ল্যাঙোট পরাবে। তাঁর জন্য একটি শীতকালীন টাটকা প্রেমিক আবশ্যক, তাঁর জন্য একটি জীবন্ত কম্বল জরুরী,পরবর্তীতে তিনি শীতকালীন প্রেমকে গ্রীষ্মকালীন তিন তালাকে রুপান্তর করে দেবেন। অতএব ভাইসব যারা শীতকালীন প্রেমিক হইতে আগ্রহী তারা কন্যারে নক দিয়ে দলে দলে দোজাহানের নেকি হাসিল করুন।

ঠকচাচা : মোর উপর এতনা টিট্‌কারি দিয়া বাত হচ্ছে কেন? মুই তো এ শাদি কর্‌তে বলি —একটা নামজাদা লোকের বেটী না আন্‌লে আদমির কাছে বহুত শরমের বাত, মুই রাতদিন ঠেওরে-ঠেওরে দেখেছি যে, পাগলরা আচ্ছা আদমি —তেনার নামে বাগে গরুতে জল খায় —দাঙ্গা-হাঙ্গামের ওক্তে লেঠেল মেংলে লেঠেল মিল্‌বে —আদালতের বেলকুল আদমি তেনার দন্তের বিচ —আপদ্ পড়্‌লে হাজারো সুরতে মদত্‌ মিলবে। কাঁচড়াপাড়ার রামহরি বাবু সেকন্ত আদ্‌মি —ঘেসাট ঘোসাট করে প্যাট-টালে —তেনার সাথে খেসি কামে কি ফায়দা? 

দেবদাস : যত্তো সব মাতাল । লাবিয়া ম্যাহোরা আর লাবিয়া মাইনরার তফাত না জেনেই প্রেম করতে যায় ।

বিপিন : নটবউ নয়, যারা ক্যাপসুলে বসে নামে তাদের বলে অ্যস্ট্রোনট । 

সত্যচরণ : ধ্যুৎ, পুঁজিবাদীরা বলে অ্যাস্ট্রোনট, আমরা বলি কসমোনট ।

খোকা : আমি তো নষ্টনট হবার আগে শুনেছিলুম ওদের বলে অন্তরীক্ষযাত্রী ।

অপু : না, না, মহাকাশচারী ।

হরিহর : তোরা জানিসনে । ওদের বলে নভচর । নভচর মানেই নটবর। নব ঘোরা দিকি, বেরিয়ে আসুক লোকটা । একটা ছোট্ট নব, সারাবছর যার কোনো ভূমিকা বা গুরুত্বই নেই, এই সময়ে তাকে হিমসিম খেতে হয়। কান মুচড়ে, কান মুচড়ে তাকে একটাই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে–টু বি অর নট টু বি? হ্যাঁ দ্যাট ইজ দ্য প্রশ্ন বটে ! ফ্যান চলবে কি চলবে না? চললেও একে না দুয়ে নাকি তিনে? মিনমিন করে মিন যারা, তারা বলবে, বন্ধই থাক। একে করোনা, তায় হিম। সমস্বরে ওদিক থেকে প্রতিবাদ আসবে। তা কি হয়? ফ্যান চলুক। তালে কততে? আবার কান মুচড়োবে তার.. গলদঘর্ম হয়ে সে গান ধরবে–মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে চলে, এদিন ভরা সাঁঝে..যেতে যেতে দুয়ার হতে কী ভেবে ঘোরালে নবখানি ।

নিখিলেশ : আমরা সবাই মার্কামারা নষ্টনট । 

সন্দীপ : ওঙ্কারের মতো ছড়িয়ে যায় কে দাবানল দাবানল খেলে ! প্যালেট জুড়ে অদ্ভুত আঁচড়ে বিধবা রঙের চাঁদ আঁকতে গেলে মর্গের শীতল বায়ু মনে পড়ে। মনে পড়ে কন্ঠনালীতে বসে যাওয়া দাগ এক করুণ বিলাপ, রুদ্ধ চিৎকার, কালচে ক্ষত। জাহাজের সারেং গুছিয়ে নিচ্ছে নোঙরের দড়ি, সেও এক দৃশ্যবাজিকর। কুয়াশা ভেজা আধো আলোতে নগ্ন পথ হেঁটে যেতে যেতে মুছে ফেলতে চাই স্পর্শের সমস্ত আকুলতা। জোছনাদগ্ধ তৃষ্ণাতুর ভেজা চোখ গলে গলে পড়া পীচ জানে ঠিক কী কী অপমানে অট্টহাসিও ক্ষয়ে যায়। মন খারাপের এমন রাতে পৃথিবীর দীর্ঘতম শ্বাস ফেলে আকাশে তাকালে হলুদ হয় চোখ। মৃত্যু ভয় করে না বলে চিলেকোঠা সাজে ফাঁসের দড়িতে। ছেলেবেলার পানকৌড়ির ডুব মনে পড়ে খুব। বিষণ্ণ প্রাণ মুক্তি না পেলে উচ্ছলের ভাব-সম্প্রসারণ হয় না, তাই হারিয়ে যাবার নাম রাখা হোক- একটি নিখোঁজ সংবাদ। এই যে রোদ্দুর নেই, ছায়া নেই, বৃষ্টি নেই। এতোখানি আয়ু নিয়ে কী করে নষ্টনটের দল ?

দেবদাস : যত্তো সব মাতাল । স্বদেশ আর পায়ুদেশের তফাত জানে না ।

চার

ক্যাপসুল মাটিতে নামার পর নষ্টনট কলোনির ল্যাংটো ভাবুকরা লাথি মেরে খুলে দেখতে পায় ভেতরে একজন বসে আছেন, কথা বলার চেষ্টা করছেন কিন্তু পারছেন না । লোকটার মুখের কাছে কান নিয়ে গিয়ে খোকা চেঁচিয়ে উঠলো, ও বলছে ওর নাম রুক-রুককে-করো। 

হরিহর : ওকে কাতুকুতু দে, তাহলে মুখ দিয়ে স্পষ্ট কথা বেরোবে, পুরো নাম বলবে। 

ঠকচাচা : মুই বলি এসব ফেল্‌ত বাতের দরকার কি? ত্যাল খেড়ের বাতেতে কি মোদের প্যাট ভর্‌বে? 

খোকা : বলেছে, বলেছে । ওর নাম রুক্মিণীকুমার ।

নবকুমার : হারুকি মুরাকামি কী লিখছেন, মিলান কুন্দেরা কী লিখেছেন, সেসব দিয়ে আমাদের  বিচার হওয়া উচিত নয়। ওঁরা কোনোকালে মঙ্গলকাব্য পড়েননি, চরিতামৃত পড়েননি, কথামৃত পড়েননি, বিষাদসিন্ধু পড়েননি। ওঁদের চিন্তার জাত  আমাদের  জাতের সঙ্গে মিলতেই পারে না। যদি মিলে যায়, আমাদের কোনো নষ্টনটের নষ্টামির সঙ্গে যদি দেখা যায় ওরহান পামুকের বেশ মিল আছে, মুরাকামির লেখা মনে পড়ে যাচ্ছে তাঁর লেখা পড়ে, বুঝতে হবে সেটা ম্লেচ্ছ নষ্টামি। ম্লেচ্ছ নষ্টামি আন্তর্জাতিক নষ্টামি নয়। আন্তর্জাতিক নষ্টামি তখন হবে, যখন আমাদের কোনো নষ্টনট বিশ্বনষ্টামিতে এমন কিছু যোগ করতে পারবেন, যার ফলে পৃথিবী নড়েচড়ে উঠবে। সেটা অনুকরণ, অনুসরণ বা নকলনবিসির দ্বারা হওয়ার নয়। যে নষ্টনট শিবপুরাণ পড়েননি, তাঁকে আমি সন্দেহ করি। ‘কাফকা অন দ্য শোর’ না পড়েও নষ্টামি করা যায়, কিন্তু ‘রামকৃষ্ণ কথামৃত’ যে পড়েনি, সে বাঙালি নষ্টনটই নয়, আন্তর্জাতিক নষ্টামি তো দূরের কথা।।

গোবিন্দমাণিক্য : নষ্টনটেরা কতদিন নষ্টনটদের বিরুদ্ধে ছড়ি ঘোরাতে পারে? আমার চোখে দেখা 

কত কঠোর নষ্টনট শিক্ষক রিটায়ার্ড হলেন, কত দক্ষ নষ্টনট প্রশাসক বদলি হলেন, কত বড় বড় নষ্টনট নেতা মন্ত্রী চলে গেলেন, দেশবরেণ্য কত নষ্টনট …আজ আর কেউ বেঁচে নেই ! তারা কত দাপুটে ছিলেন; কাজেই, কি হয় এতসব – সাময়িক ভয়াবহ ভনিতা কঠোরতা কান্ডকারখানা করে? এতকিছু রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরেও নষ্টনট কলোনির উন্নতি সেভাবে হলনা ! তুমি তবে কিএমন মারাক্কু মোরব্বা খাওয়াবে? নষ্টনটরা কতদিন নষ্টামির ছড়ি ঘোরাতে পারে? নষ্টনটরা নিজেও সেটা বুঝতে পারেনা; তাই ক্ষমতার মদগর্বে, আত্মঅহংকারে ধরাকে সরা ভাবতে ভাবতে বড় বেশি সরভাজা খেয়ে ফেলে।

দেবদাস : যত্তো সব মাতাল । সরভাজা আর ডিমভাজার তফাত জানে না ।

পাঁচ

রুক্মিনীকুমার বেরিয়ে আসেন । বকরবকর শুরু করে । মহাকাশে মুখ বন্ধ রাখতে হয়েছিল বলে কতো কথা জমে আছে পাকস্হলিতে ।

রুক্মিণীকুমার : আমি কতকগুলো জিনিস বিশ্বাস করি । আপনি হয়তো অদ্ভুত মনে করবেন । আমি বুঝলেন বংশ মর্যাদায় বিশ্বাস করি । আপার ক্লাসে বিশ্বাস করি । আপার ক্লাসের মনটা, তার সেনসিবিলিটি আপার ক্লাসের । আপার ক্লাস বলতে ভারতীয় আপার ক্লাস ।  হঠাৎ কতোগুলো আইডেনটিটি অফ ওয়র্ড উপনিষদ থেকে বললুম সেরকম মিস্টিসিজম হয় না — তার অত্যন্ত একটা, ফলে তার সৌন্দর্যবোধ একটা থাকে যাতে করে টপটপ করে — আজকে ধরুন গ্রিস মরে গেছে, কী করে হল যে ভারতীয় দুম করে উঠে গেল । 

খোকা : এখেনে সবাই ডিক্লাস নটবর সাহেব, মুকখুর ডিম, সবাই সাবঅলটার্নদের চেয়েও তলাকার, দেখছেন তো গায়ে দেবার পৈতেটুকুও নেই ।

সত্যচরণ : কবি লিখেছিলেন, করুণ শঙ্খের মতো স্তন, দুধে আর্দ্র আর কলোনির সরকার লিখলেন: উড্ডীয়মান মনিময়তা ! স্তন এখানে যেন ম্যাক্স আর্নস্তের সবুজ জীবাশ্ম নিসর্গের গুহ্য চোখ, মাইয়ের বোঁটায় যার এমারেলড চাহনি। যদিও এই রূপকল্পটি  সুকুমারীদির স্তনের নয় পার্সি স্টাইলে পরা শাড়ির ঘোমটার পিন অর্থাৎ চমৎকার পান্নার হিরোনডেলের বর্ণনায় দিয়েছেন যার শুধু ডানাদুটি চুনীর, ইহা এক বিশাল ক্লাসিসিজম ! আছে আছে আছে আছে, গল্পটা দশবার পোড়ো।ও কেউ আর লিখতে পারবে না কোনো দিন । ভালো জিনিসকে মডেল করলে জিনিস ভালো হয়… এখানে আমি বিশেষত রাত ভ’রে বৃষ্টি-র অনুষঙ্গে কবিবর বুবু’র এই পদটিকে উজ্জ্বল স্তনের ইমেজ-ব্যঞ্জনা হিসেবে কাজে লাগালাম; কবিবর বুব একটা পাতা শুধু রতিসুখ আপ্লুত ক্লান্ত নিদ্রাতুর মালতীর স্তনের জমকালো পরাবাস্তব নির্জন ভয়াল বিনির্মাণে খরচ করেছেন, ফাদার দ্যতিয়েনের বাংলা গদ্যপরম্পরা দুইতে সংকলিত হওয়ার মতো ইটসেলফ পৃষ্ঠাটিই একটি মাস্টারপিস…

গোবিন্দমাণিক্য : খরচ করলেও, ওসব বেচেবুচে টাকাকড়িও কম করেননি ।

সওদাগরপুত্র : আপনি শেষ কবে স্তন ছুঁয়েছেন ? মনে হয় মায়ের স্তন ছাড়া অন্য কারোর স্তন ছোঁয়া হয়নি জীবনে ।

দেবদাস : যত্তো সব মাতাল । স্তন আর মাইয়ের তফাত জানে না ।

রুক্মিণীকুমার : আমি কৌশিক সরকারের ম্যাশাপ পেইনটিঙে দেখেছি, বুকের একদিকে মাই আর অন্য দিকে স্তন ।

চন্দ্রকান্ত : পর্দায় থাকতে হবে, তীব্র গরমে হাত-মোজা, পা-মোজা, মাথায় বাঁধাকপি বেঁধে বেরুতে হবে বাইরে তাও অতিশয় ইমার্জেন্সি না হলে না, নিনজা টারটেলস এর মতন চক্ষু দেখা যাবে কি যাবে না কারণ চক্ষে আবার অপ্সরাদের ব্যাপক তৃষ্ণা ও কাম ঝরঝর করে ঝরে পড়ে, সেইটায় আবার তাগো ঝিরঝিরা এন্টেনায় নেটওয়ার্ক আইসা পড়ে। পড়াশোনা করানোর দরকার নেই ঘরে থাকুক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পুরুষ টিচার আছে, সহপাঠী আছে। যদিও পড়াশোনা করেই ফেলেন বিয়ের পর সব বন্ধ। ডাক্তারের ও চাকরির দরকার নেই, পুং ডাক্তার আছে ওখানে। কোন পুং কে রক্ত দেয়া যাবেনা ইত্যাদি ইত্যাদি (কারণ এরা তেঁতুঁল)। এরাই আবার এইরকম ও চায়। এখন তাইলে কি করতে হবে? ডেলিভারির আগে মঙ্গল বরাবর দরখাস্ত করবেন জনাব, টুপ করে ঝরে পড়বে ডাক্তার, মহিলা এলিয়েনেরা। আর আপনি সারাজীবন এইরকম খাবি খাওয়া খুব কিউট এবং সমানতালে কনফিউজড ক্যারেক্টার নিয়া দৌড়াইবেন। আপনারে ভালুবাসা । ডাক্তারের চাইতে যখন তার লিঙ্গ(খুবই ফেয়ার অর্থে) বড় হয়ে যায় আরকি, হেহে…ওই যে সিকিৎসার সময়! বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিঁচিঁইঁইঁইঁ…

শ্রীকান্ত : নিশ্বাস ফেলিয়া পাল্‌কিতে উঠিয়া বসিলাম। দেখিলাম, বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না—ইহা দূরেও ঠেলিয়া ফেলে। ছোট-খাটো প্রেমের সাধ্যও ছিল না—এই সুখৈশ্বর্য্য-পরিপূর্ণ স্নেহ-স্বর্গ হইতে মঙ্গলের জন্য, কল্যাণের জন্য আমাকে আজ একপদও নড়াইতে পারিত। বাহকেরা পাল্‌কি লইয়া ষ্টেশন-অভিমুখে দ্রুতপদে প্রস্থান করিল। মনে মনে বারংবার বলিতে লাগিলাম, লক্ষ্মী, দুঃখ করিয়ো না ভাই, এ ভালই হইল যে, আমি চলিলাম। তোমার ঋণ ইহ-জীবনে শোধ করিবার শক্তি আমার নাই। কিন্তু যে জীবন তুমি দান করিলে, সে জীবনের অপব্যবহার করিয়া আর না তোমার অপমান করি—দূরে থাকিলেও এ সঙ্কল্প আমি চিরদিন অক্ষুণ্ণ রাখিব। 

রুক্মিণীকুমার:  স্তন চোখের থেকেও রহস্যময়, শিল্পী না হলে মর্ম বুঝবে না, ওটা বরিশালের কবির সাবজেকট, স্তনের সফটনেস: স্তনের ভায়োলেন্স: স্তনের কটাক্ষ, পেন্সিলে ছাড়া আঁকা যায় না

স্তনের মনুমেন্টালিটি, ল্যাবিরিন্থ, স্তনের অভ্যুত্থান, স্তব্ধতা ভার্টিগো।

বেণী ঘোষাল : আপনি বোধহয় আফ্রিকার স্তনে টোকে মেরে টনটন শব্দ শোনেননি । এক্কেবারে মেটালিক সাউণ্ড । আপনাকে নটবরের মান্যতা দেয়া বেশ কঠিন । এই নষ্টনট কলোনির পাগলবৃন্দ, আপনারা সমস্যা তৈরি করুন, দেখুন, যদি উনি সমাধান বের করতে পারেন । এর চেয়ে তো অপ্সরাদের গুয়ের ডাবা পড়লে আনন্দ হতো । যাদের লিঙ্গোথ্থানের সমস্যা তার সুরাহা হতো।

গোরা : নষ্টনটদের অনেকের লিঙ্গের দোষ ছিল বলে এই কলোনিতে পাঠানো হয়েছে । কেননা লিঙ্গ-যোনির মিল হয়নি । ফলে ডিভোর্স – যে কোন কারণেই হতে পারে। কিন্তু যে কারণেই হোক, ডিভোর্স লেটারে স্পস্টভাবে প্রতিটায় উল্লেখ থাকে মেয়েটা চরিত্রহীনা। এটা যদি ছেলে নাও দিতে চায় তার ফ্যামিলি এবং লইয়ার ফোর্স করে দেয়ায়। কারণ তাতে নাকি ডিভোর্সের উপযুক্ততা শক্তপোক্ত হয়। আপনি দীর্ঘ সময় প্রেম করে বিয়ে করলেন, বিয়ের পর টিকলো না। হতেই পারে। আপনি বিয়ে করলেন, মোটামুটি পরিচিত, মিলছে না। হতেই পারে। আপনার এক বা দুইটা সন্তান আছে, তবুও সম্ভব হচ্ছে না। হতেই পারে। বা মনে করেন প্রেমের এক পর্যায়ে দুইজন সিদ্ধান্ত নিলো ঠিক আছে আমরা আমরা করে ফেলি পরে ফ্যামিলিকে রাজী করানো যাবে। ফ্যামিলি রাজী হচ্ছে না, হলো না। ফ্যামিলির বাইরে বিয়ে করার সাহস আছে, কিন্তু ফ্যামিলি জানার পর সংসার করার সাহস নেই। সো, ডিভোর্স। মানলাম এটাও হতেই পারে। কিন্তু আইনি প্রক্রিয়ায় যাবার সাথে সাথে একজন উকিল কী পরিমান বাজে কথা বলবে, একমাত্র এটা প্রমাণের জন্য যে, শুধুমাত্র চরিত্রের দোষে এটা ডিভোর্সে যাচ্ছে।  চরিত্র বলতে আমরা  বুঝি, এই মেয়ে বিভিন্ন জায়গায় নানা পুরুষের সঙ্গে শোয়। সিরিয়াসলি, এটাই চরিত্রের একমাত্র ডেফিনিশন । আর বাকি যে স্বামী তিনি ফুলেল চরিত্রের অধিকারী। বা তার ডিভোর্স পেপারে এটা থাকার বাধ্যকতা নেই। একটা মেয়ে চেষ্টা করে প্রচুর, টেকাতে। অনেক ছেলেও করে৷  জীবনভর বিতৃষ্ণা, মারামারি, কাটাকাটি, ভেতরে মরে যাবার চাইতে ডিভোর্স ভালো। কিন্তু এই ডিভোর্সের সময় মেয়েদের শারীরিক অত্যাচারের প্রমাণ দিতে হয়, না হলে প্রমাণ হয় না সে নির্যাতিত। কোন মেয়েই পারতপক্ষে বাইরে বলে না আঘাতের দাগটা তার স্বামীর মার। সে বলে কোনভাবে আঘাত পেয়েছে। কেন বলে এমন, কারণ সে মানে ওটা তার পরিবার, পরিবারের সম্মান। সে চায় একদিন ঠিক হয়ে যাবে। সে সহ্য করে। কিন্তু ওই পরিবারে সে শুধুমাত্র পরের ঘরের। আপন নয়। সবাই এমন তাও না, আমি ম্যাক্সিমামের কথা বলছি। কেউ চায়না এই প্রমাণ করে বা বলে তার সিচুয়েশনটুকু পরিবারে আরো খারাপ পর্যায়ে যাক। যে পরিবারের সম্মান, স্বামীর সম্মান সে ভেবে এগুলো চেপে যায়, সে পরিবার তাকে কতটুকু ভাবে? এখন সবাই কি প্রমাণ রেখে মারে? সেখানে মেয়ের পরিবারের কেউ উপস্থিত থাকলে মারবে নাকি উপস্থিত করে মারবে। মেয়েটা কি ডাক্তারের কাছে যাবার সুযোগ পাবে? বা গেলেও ওটাই বলবে স্বামী দ্বারা নির্যাতিত? তো এই ব্যাপারগুলো কিভাবে প্রমাণিত হয়? কেন সাক্ষী বা ডাক্তারি সার্টিফিকেট এতো জরুরি। কেউই সেই পর্যায়ে না গেলে অন্তত কোর্ট পর্যন্ত যায় না, অথচ ওখানে একমাত্র মেয়ে ও তার ফ্যামিলি তীর্যক দৃষ্টি, সামাজিক ব্যাভিচার ও অযাচিত অন্যায় অপমানের শিকার হন। আমাদের ল ইয়ারদের কি মনে হয়না তারা অন্যায় করছেন? আমাদের সমাজে যারা ভালো অবস্থানে আছে, তারা পারেন না এইরকম আইন গুলো সংশোধন এর জন্য দুটো কথা বলতে? বাংলাদেশের ম্যাক্সিমাম পরিবারে আমাদের কন্যা, বোন, সুসম্পর্কের আত্মীয় স্বজন এর এই ঘটনা আছে। আমরা মেনে নিয়ে চুপ করে থাকি। একবার ভাবিনা এই একটা কারণে ওই মেয়েটার ভবিষ্যৎ কোথায় চলে যাচ্ছে। একটা পুরুষ এভাবে ভোগে কম।

দেবদাস : যত্তো সব মাতাল । ডিভোর্স আর ভেন্ন হবার তফাত জানে না ।

গফুর : নটবর সাহেব! আমি যে বিরাট কাজ্জাব হয়ে যাচ্ছি; আমি আমার ভেতর নাফাকির সমস্ত আলামত দেখতে পাচ্ছি । নটবর সাহেব  আমি বুঝতে পারছি, আমি চিনতে পারছি, মানুষের নানারঙি হিজাবের বাতাস । নটবর সাহেব, আমি যে পাপে ঢুকেই যাচ্ছি, ডুবেই যাচ্ছি, আমাকে উদ্ধারের কোনো পথ আমি পাচ্ছি না যে! নটবর সাহেব ! আপনার  মিঠা-চরিত্র আমি পড়ি, আমি মুক্তি পাই না, আমি নাজাত পাই না । নটবর সাহেব ! আমার সামনে আন্ধারের আয়না কালো আরও কালো হয়ে আছে । আমি ভিতরজ্বলনে দগ্ধ, ভিতরআগুনগ্রস্ত, ভিতরের তলানি আমায় খেয়ে ফেলেছে সবটুকু । নটবর সাহেব,  আমি  দারুণ পীড়িত, রুগ্‌ণ, আমি কী করে আপনাকে বলি! নটবর সাহেব, নষ্টনটদের কলোনিতে আমি তো ডুবে আছি অবিশ্বাসিদের জড়াজড়ি খেলায় ।কী করব বলুন, নষ্টনটেরা যে  পিছনের দিকে গতিশীল । যখন  কেটে নিয়েছিলেন খোসা, আমি তখন বোদলেয়ার র‌্যাঁবো ভেরলেন অতোনা আতো আওড়াই; আমার প্রিয় পরিজন বলে কেউ নাই । নটবর সাহেব ! আপনার সুশীতল হাত আমার মাথার উপর নাই, আমি অধঃপতিত হয়ে গেছি নটবর সাহেব। আমার দেহে দেখা দিয়েছে ছত্রাক, মানে মাশরুম, কিন্তু তা বিক্রি করতে পারছি না, অথচ আমার গালে-মুখে দুধসাদা মুথাঘাস গজিয়েছে, হে নটবর সাহেব, আমি পীড়িত, জ্বলে যাচ্ছে পুরো দেহ, আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি, আমি দপ করে নিভে যাই,আমি জ্বলে উঠি,  আমার মুক্তি আসে না, আমি কবিতা লিখি, জোয়ান বয়সে ঢুকে আমি ঘুরি বিশ্বসাহিত্যের জানলায়, বাতাসে, আমি শব্দকে পাই ওকতাভিও পাজের কথায়, রক্তের আগে, চিন্তারও আগে, নটবর সাহেব, একদিন সালমান রুশডির পাঠানো  প্রিয় দূত জিবরিল বলেছিল চল মাগিবাজি করি, সে কথা যখন আমি শুনি জান্নাতের পথভ্রষ্ট কোনো মানুষের মুখে,কী করে আমি তাকে অগ্রাহ্য করি? যখন ওপথের যাত্রি নষ্টনটরা দিতে পারেন না কোনো সন্তোষ-বাণী  নটবর সাহেব ! গঙ্গাজলে ধোয়া ছিল আপনার হৃদয়,আপনাকে বানানো হয়েছিল, যাতে আপনি কমলকুমার মজুমদার অমিয়ভূষণ মজুমদার বিনয় মজুমদার আওড়ান, হে নটবর, আপনার মতো সুষম কোনো মানুষ-অস্তিত্ব এ জগত দেখেনি,সংসার দেখেনি কোনো এমন অবিশ্বাস্য নট । আপনি বুঝতেন হৃদয়ের অন্ধারের কথা, আপনি কাঁদতেন মাটিচাপা কুসুমকন্যাদের কথা মনে করে, আপনি রক্ত ঝরিয়েছেন আল মাহমুদ পড়ে, আপনার ছিল না কোনো অভিযোগ মানুষের প্রতি, সমাজের প্রতি, নীটশের প্রতি তো আপনি ছিলেন—দেরিদার মুখে, তার হাবিব, হে নটবর, আর যারা নষ্টনট—যেমন জীবনানন্দ : এরা মানুষের প্রশ্ন আর জিজ্ঞাসা খণ্ডন করতে-করতে চঞ্চল থেকেছেন কোনো এক অসাধারণ কারণে কারুবাসনায়, আমি জানি, হে নটবর! আমার মতো না থেকেও তারা আমার মতোই ছিলেন, ছিলেন অস্থিতি আর অস্থিরতার ঝড়ের পতাকা, এরা ক্রমাগত লাফিয়েছেন, আটকে গেছেন, আবার চিৎকার করেছেন, নীরব হয়ে গেছেন, এদের কারো কেটে নেয়া হয়েছে জিভ আর কারো লিঙ্গ আর পাঠানো হয়েছে এই কলোনিতে ! আমি তো তাদের তুলনায় নস্য, ওই মাপকাঠিতে তো আমাকে মাপা যায় না; আমার ভাষা একটাই, আমার অক্ষর অক্ষমতা শুধু এক ভাষাতেই; আমার দৌড়ঝাপ-আর্তনাদ সীমাবদ্ধ ভাষার পরিসীমাতেই । আমি শুধু আপনার উলঙ্গ শরীর দেখতে চেয়েছি, তাও স্বপ্নে, এখন আপনাকে স্বচক্ষে দেখছি, আপনার কপচানো শব্দগুলোর অর্থানুধাবন করি, আমার দু চোখ থেকে বেরিয়ে আসে পিরিতির গরম ধাতুরস; আর আপনার নাম-স্মরণে,  এক লাল মিনারের নিচের জ্বলনে আমার চামড়া পুড়ে-পুড়ে যায়, দেহের ক্ষত থেকে ঝরে পড়তে থাকে অসহ্য সোনারুপোর গলন, হে নটবর, আমি নষ্টনটোত্তম, মিথ্যুক ও অপরাধী, আমি মুখোশধারি, হিপোক্রেট, জায়গাবিশেষে মাস্তান, কামাসক্ত, আপনাকে আমার কী বলার থাকতে পারে! আমার ভিতর-জ্বলন, আমার  কান্না; আমার আশৈশব ল্যাংটো থাকার অভিশাপ;  হায়, নটবর ! আমি শান্তি খুজছি…নটবর,  আমি শক্তি খুজছি…নটবর,  আমি শান্তি খুজছি…

রুক্মিণীকুমার : নাটক কোরো না ; অধঃপতন থেকে ওঠা যায় না । দ্যাখো, সিনেমা বানাতে পারবে না তাই ওসব রয়েসয়ে দেখবে অনেক ভালো ছবি অনেক আছে সব দেখার দরকার নেই ওসব বাজে প্রলোভন। বই পড়ো, তাহলে ভাবতে পারবে, ভাবতে খরচা লাগে না। সিনেমা একটা আউটমোডেড মিডিয়াম যত দিন যাবে তত খারাপ হবে; এটা করপোরেট দুনিয়া রে ভাই পুরো জালি লাইন ওখানে সারভাইভ করতে প্যাখম বেরিয়ে যাবে — নির্জনতা নেই। ভাবো, ভাবো, ভাবার কোনো বিকল্প হয় না। নষ্টামি জিনিসটা, বিজ্ঞানের চেয়েও বড় বিদ্যা, তুখোড় রিগরাস সায়েন্স! ওসব কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে-টাসে বরিশালের কবির আঁতলামি ভুলে যাও; আরে, হৃদয় খুঁড়েই তো আসল মজা মহেঞ্জোদারো — আর্কিওলজি অব নলেজ, হৃদয় না খুঁড়লে প্রুস্তিয়ান প্রজেক্টে ঢুকবে কী করে! বেদনা ছাড়া কিছু নেই; বুদ্ধ এটা জানতে পেরেছিলেন তাই বলেছিলেন জীবন দুঃখময় — সো মাচ দা বেটার! দুঃখ আমার উইজডম। দেরিদা বলেন আই মোর্ন দেয়ারফোর আই অ্যাম: আমি শোকগ্রস্ত, শোকেই আমি সুন্দর ! ধন্যবাদ , মানে একর্ডিং টু হাইডেগার আই উইল থিঙ্ক অব ইউ! নষ্টামি তোমাকে কোনো কিছু ভুলতে দেবে না, মন সব কিছু ছুঁয়ে যাবে, ছুঁয়ে থাকবে, চিরকাল ভাবতে থাকো…

নিখিলেশ : মহাকাশে সিনেমা হলও আছে ? সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা। ফেলিনির ছবিতে যেমন মার্সেলো মাস্ত্রেওয়ানি, কুরোসাওয়ার সিনেমায় যেমন তোশিরো মিফুনো, চ্যাপলিনের ছবিতে যেমন স্বয়ং চ্যাপলিন, কীটনের সিনেমায় স্বয়ং বাস্টার কীটন, হিচককের সিনেমায় কেরি গ্রান্ট, ঠিক তেমনই সত্যজিতের সৌমিত্র। এ নিয়ে অনেকের অনেক বক্রোক্তি থাকতে পারে, কিন্তু কিছু করার নেই। উত্তমকুমার আর সৌমিত্রর একটা তুলনা প্রায় ৫০ বছর চলছে, কিন্তু সেটারও কোনো ভিত্তি আমি দেখি না। উত্তমের সঙ্গে তুলনা করতে হলে দিলীপ কুমারের করা যায়, যে দিলীপ কুমার ভারতের প্রথম মেথড এক্টর, কিন্তু শেষ বিচারে হয়ত উত্তমকুমার তাঁর চেয়ে বড় অভিনেতা। উত্তমের সঙ্গে তুলনা রাজ কাপুর বা শিবাজি গণেশনের হয় স্টার হিসাবে। কিন্তু সৌমিত্রের জিনিয়াসের সঙ্গে উত্তমের তুলনা হয় না। এ দেশে সৌমিত্রর চেয়ে দক্ষ অভিনেতা একজনও জন্মায়নি। এ দেশ বলতে আমি ভারত বোঝালাম, পশ্চিমবঙ্গ নয়। দক্ষতা দিয়েই শ্রেষ্ঠত্বের বিচার হয় না। শেষ কথা বলেন জীবন দেবতা। যদি অমিতাভ বচ্চন, বলরাজ সাহানি, মোতিলাল, অশোক কুমার, ছবি বিশ্বাস, নাসিরুদ্দিন, কমল হসন, মোহনলাল, সঞ্জীব কুমার আর বিকাশ রায়ের সঙ্গে সৌমিত্রের তুলনা করতে চান, সেটা একেকটা জ্যোতিষ্কের সঙ্গে আরেকটার তুলনার ব্যাপার হয়ে যাবে। বিচার করবেন জীবন দেবতা।

রুক্মিণীকুমার : না, টাকাকড়ির অভাবে ব্লু ফিল্মও করে উঠতে পারিনি । কৌশিক সরকার অবশ্য বলেছেন যে টাকা যোগাড় করে দেবেন ।

গোবিন্দমাণিক্য : কিছু মানুষ থাকে তারা কোনকিছুতেই সন্তুষ্ট না, তুমি যদি পাঁচ টাকার আইসক্রিম কিনে খাও এবং তুষ্ট হও, তারা পাঁচ হাজার টাকার কুলফি মালাই খেলেও বলবে, ‘ধুর, এটা কিছুই হয়নি, এটা ভালো না, এর থেকে ওটা আরো ভালো।’ এটা না ওটা, ওটা না এটা, এই এটা সেটা করতে করতে, এটা ওটা সেটা করতে গিয়ে এদের ভেতর একটা দ্বিধার সমুদ্র গড়ে ওঠে, আর সেখানে তুমি যদি দ্বন্দ্বের সুরে বেফাঁস কিছু বলো, এমন করে তোমাকে চিরে দেবে, দেবে খোঁটা

তোমার অন্নপ্রাশনের ভাত মুখে উঠে আসবে পুরোটা। তাই এইসব মহান মানুষের থেকে, নিজেকে অন্ততঃ দশ হাত দূরে রাখো, এককথায় এদের এড়িয়ে চলাই ভালো। কথা কম বলো এদের সাথে

এরা মানে এক ভিন্ন প্রজাতির উট কিংবা ঘোড়া, উট যেমন লম্বা গলা দিয়ে উঁচিয়ে সবকিছু দ্যাখে

কিংবা ঘোড়া তার আড়াই চালে কিস্তি মাৎ করতে চায়, এরাও অনেকটা সেরকম। এদের মন পেতে হলে, কোনো তপস্যাই তার জন্য যথেষ্ট নয়, জাস্ট তুমি মৃত্যুর কথা ভেবে নিতে পারো, অথবা সরাসরি মরে যাও, যদিও মরে গেলেও, তুমি এদের মন কিছুতেই জয় করতে পারবে না, এরা এমনই এক ভিন্ন প্রজাতির, অদ্ভুত প্রকৃতির কিছু একটা।

দেবদাস : যত্তো সব মাতাল । কোথায় দিলীপ কুমার আর কোথায় শাহরুখ খান ।

ছয়

ঠকচাচা : হা—হা—হা—হা—মকদ্দমা করা কেতাবী লোকের কাম নয়—তেনারা একটা ধাব্‌কাতেই পেলিয়ে যায়। এনার বাত মাফিক কাম করলে মোদের মেটির ভিতর জল্‌দি যেতে হবে—কেয়া খুব! 

গদাধর : খালাসিটোলায় গিয়ে দেখুন । গোকুলের ষাঁড়ের ন্যায় বেড়ায়— যাহা মনে যায় তাই করে— কাহারো কথা শুনে না— কাহাকেও মানে না। হয় তাস—নয় পাশা— নয় ঘুড়ি—পায়রা—নয় বুলবুল, একটা না একটা লইয়া সর্ব্বদা আমোদেই আছে—খাবার অবকাশ নাই—শোবার অবকাশ নাই—বাটীর ভিতর যাইবার জন্য চাকর ডাকিতে আসিলে, অমনি বলে—যা বেটা যা, আমরা যাব না। দাসী আসিয়া বলে, অগো মা-ঠাকুরানী যে শুতে পান্ না—তাহাকেও বলে—দূর হ হারামজাদি! দাসী মধ্যে মধ্যে বলে, আ মরি, কী মিষ্ট কথাই শিখেছ! ক্রমে ক্রমে পাড়ার যত হতভাগা লক্ষ্মীছাড়া—উনপাঁজুরে—বরাখুরে ছোঁড়ারা জুটিতে আরম্ভ হইল। দিবারাত্রি হট্রগোল—বৈঠকখানায় কাণ পাতা ভার—কেবল হোহো শব্দ— হাসির গর্‌রা ও তামাক-চরস গাঁজার ছর্‌রা, ধোঁয়াতে অন্ধকার হইতে লাগিল…..

বিপিন : এই ধোঁয়া আমাদের পাগল করে রেখেছে । সিনেমা দেখতে দেয় না । নষ্টামির জায়গাটা এখন একরকম স্যাচুরেটেড হয়ে গেছে। যত দুর্দান্ত উপন্যাস কেউ ভাবুক, যত স্বর্গীয় কবিতা কেউ ভাবুক, এখন আর পাঠক অবাক হবে না। সবাই তো একরকম ভাবতে পারে আজকাল। কেউ একটু বেশি ভাল ভাবে, কেউ একটু কম ভাল, কেউ হয়ত বেশ খারাপ। কারও চিন্তার ভুল হয়, কারও হয় না। কেউ নাচতে নাচতে ভাবে, কেউ জানে না। ভাবতে মোটের উপর সবাই পারে। কেউ যদি তার মধ্যে দারুণ কিছু ভেবে ফেলে, অন্যদের তাতে কি সুবিধা হয় কিছু? অসুবিধাই হয়। কারণ স্ট্যান্ডার্ডটা হাই হয়ে যায়। সেটাকে অ্যাচিভ করার জন্য অতিরিক্ত খাটতে হয়, চুরি-টুরিও করতে হতে পারে। শ্রোতা তো নেই। সবাই ভাবুক ।কেউ কেউ হয়ত অলসতার কারণে, বা লোকলজ্জার কারণে ভাবে না, কিন্তু মনে মনে সেও ভাবুক। এমতাবস্থায়, সিরিয়াস ভাবাভাবির খুব সংকট। প্রথম কথা কিছু লোক সিরিয়াস ভাবনাকে আঁতলামি বলে উড়িয়ে দেওয়ার রাস্তাটা চেপে ধরে আছে, আর কিছু লোক সিরিয়াস ভাবনার কাছে গেলেই তাদের ঘুম পেয়ে যায়। সবাই ভাবুক ।কেউ জেগে থাকা ভাবুক, কেউ ঘুমন্ত ভাবুক। তুমি বানচোদ ভাল ভাবছ, তাতে আমার কী? আমার ভাবনাও কি কিছু কম যায়! সেই নষ্টনট আমার ভাবনা শুনে বলেছে একদিন আমিও  পুরস্কার পাবো। আমাকে আর ল্যাংটো থাকতে হবে না ।

রুক্মিণীকুমার : মহাকাশে থাকতে আমিও সেই অপ্সরার সঙ্গে প্রেম করতাম দশ বছর আগে তিনঘণ্টা কথা বলতে হত রোজ এ জন্য ও আমাকে ফোন কিনে দিয়েছিল স্যামসাং গুরু ছোট্ট স্ক্রিন দুজিবি চিপ লাগানো যেত তাতে সাড়ে চারশো গান ভরা ছিল কানে ঠুলি পুরে সারারাত গল্প করতাম ডেডলি ম্যারাথান ইরেকসান না ফেললে নামে না খাড়াই থাকে আর ঠনকায় উজ্জীবিত নীড়ে…

অমরনাথ : চাঁদের কথা বলছেন ? চাঁদনি মাখানো সারা গায়ে ? ইরেকসান হলে কী করতেন মহাকাশে বসে ? শূন্যে ভাসার সময় ইরেকশান হয় ? 

রুক্মিণীকুমার : উপন্যাস ভাববার শেষ দেখতে চাইলে, জেমস জয়েসের ইউলিসিস ভাবো, শখ করে ভাবা যায় না, পৃথিবীর সবচেয়ে বোরিং ভাবনা, আই মিন স্ট্রাকচারালি, ভীষণ বন্ধুর, ভিরমি খেয়ে যাবে, একেকটা চ্যাপটার একেটা কাঠামোয় গড়া, সার্সিই তো একটা ভাবনার চেয়ে বড়, শুধু একটা বর্গ ভাবো, লাইব্রেরি এপিসোড, পেনেলোপে, ইথেকা, পুরো ভাবনা ভাবতে যেও না,মারা পড়ে যাবে। অবশ্য এলেম থাকলে মেঘনাদ বধ কাব্য ভাবতে পারো পারো ।

সব্যসাচী : মহাকাশে শূন্যে ভাসতে-ভাসতে আপনি তো দেখছি মহানট হয়ে গেছেন । তাহলে তো আপনি অনেক সমস্যা তৈরি করতে পারবেন। 

মহিম : ‘অদ্ভুত রামায়ণ’ থেকে জানা যায়, সীতা নাকি রাবণ ও মন্দদরীর মেয়ে। আবার অন্যত্র বলে রাবণ তার ভ্রাতুষ্পুত্র নলকুবেরের স্ত্রী রম্ভাকে বলপূর্বক ধর্ষণ করেন। এই ধর্ষণের ফলে রাবণের ঔরসে রম্ভার গর্ভে সীতার জন্ম হয়। তাঁর জন্মের আগে গণকরা জনিয়েছিলেন, তিনি নাকি রাবণের ধ্বংসের কারণ হবেন। তাই রাবণ তাঁকে পরিত্যাগ করেন। ‘আনন্দ রামায়ণ’ নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে, রাজা পদ্মাক্ষের কন্যা পদ্মাই নাকি পরবর্তী জন্মে সীতা হন। রাবণ পদ্মার শ্লীলতাহানি করতে চাইলে তিনি আগুনে আত্মঘাতী হন। পরজন্মে তিনিই সীতা হিসবে অবতীর্ণা হন এবং রাবণের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ান। আর একটি প্রচলিত ধারণা এই— সীতা পূর্বজন্মে ছিলেন বেদবতী নামে এক পুণ্যবতী নারী। রাবণ তাঁর শ্লীলতাহানি করতে চাইলে তিনি রাবণকে অভিশাপ দেন যে, তিনি পরবর্তী জন্মে রাবণকে হত্যা করবেন। 

সওদাগরপুত্র : ইনি একজন এদেশীয় বাংগালী ‘প্রুষ’। আপাগণ, ইনারে আমার জানা যত গালি আছে স্টকে সব দিসিলাম। সেইম সেইম টেক্সট সে আমার বড় বইনেরেও দিসিলো। আমার বইনে আমার মতন অসভ্য না তাই গাইলায় নাই, আমি কল ও ধরছি, ইচ্ছামতন গাইলাইছিও। এই ‘প্রুষ’ আবার ঢাকার এক প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ইংলিশের টিচার। দুই বইনে উনার কলের যন্ত্রণায় পাগলায়ে গেসিলাম। হয়তো উনি জানতো না ওইটা আমার বইন। এ হেন গালি শুনলে যে কেউ ঘেন্নায় মইরাই যাইতো। তারপরেও উনি উনার বাল না কামানোর ফ্যান্টাসি বয়ান দেয়। সেই লোক ইদানীং  এক মিউচুয়াল আপারে পটাইতে চাইতেসে দেখলাম। হিন্টস দিয়া দিসি বুঝলে বুঝেন, না বুঝলে মাখায়া মুড়ি ভর্তা খান গিয়া। বাল! ও আইচ্ছা আমার বইনে বিবাহিত এবং বাচ্চার মা। জামাই এবং গ্যাদাবাচ্চা সহ ছবিও ভরপুর। তারেও এইগুলাই কইসে।

রুক্মিণীকুমার: মিকেল্যানজেলোর ভাবনা নিয়ে প্যাটারের আলোচনা আমাকে মাত করে দিল এই মডেলে পরে হোলডারলিনের কেসটা নিয়ে লিখেছেন মরিস ব্লাঁশো ওটাও খুব ফ্যাসিনেটিং আমার ভাবনার কাঠামোয় এ সবই একজনেরই ভাবনা, যে ভাবে সে হ্যাক করে যোগাযোগ বুনোট একটা বিরাট ফ্যাব্রিক সবাই আমরা ওস্তাগর রিফু করছি..

সদানন্দ : মহাকাশে কি সেলাই-ফোঁড়াই হয় ? 

অমিত রায় : আমরা যারা টুকটাক ভাবনা ভাবি, বা গল্প বা উপন্যাস, তারা সবাই জানি মাঝেমাঝে ভাবতে না পারার যন্ত্রণা। এটা সাময়িক হতে পারে বা দীর্ঘ সময়। এই ফাঁকা সময়টা আমরা হয়তো কারোর ল্যাংটো দেহ নিয়ে ফান করি, তার পোঁদে ছবি আঁকি । সাথে আমরা যারা এক্টিভিস্ট তারা বিভিন্ন ইস্যুতে ভাবনা ভাবি। অনেকের মতন কেবল র‌্যালির‌্যালা ফাটাই না স্বশরীরে আমরা রাস্তাতেও থাকি। আন্দোলনে বা মিছিলে বা অবস্থানে। অথচ ম্যাক্সিমাম লোকজন আমাদের কেবল শরীর সর্বস্ব ভাবেন। স্টোরিতে ছবিতে আপনার রিএকশন থাকে ভাবনার উলটো। ভেবে নেয়া ছবিতে আপনি শালীন, গোপন ভাবনায় আপনার কামভাব ঠিক লালার মতো করে ঝরঝর ঝরিয়ে দেন। এই কাজটাতে আপনি আমার কাছে চরম নীচে নেমে যান, আপনার দু মুখো সাপের মতন চরিত্র আমার কাছে উন্মোচিত হয়ে যায়। মজার ব্যাপার আপনার তাতে কোন মাথাব্যথা নাই। আপনার ধর্ষকামী মনোভাব ও ফুটে ওঠে।  এক ইংরেজী ভাবুক আমাকে বলতো সে আমাকে দেখলে উত্তেজিত হয়। উনি আমাকে বলে যে তার কেশগুচ্ছ ভালোলাগে, তাই বগল এবং এ সংশ্লিষ্ট কেশ বড় বিষয় । উত্তর না পেয়েও উনি ভাবতেই থাকেন।  আচ্ছা আসেন স্তনের কথায়। মেয়ে মাত্রই এটা স্বাভাবিক। আপনার মা, বোন, স্ত্রী, কন্যা সবার আছে। এবং এটা যেভাবেই হোক বোঝা যাবে। সেটা আপনি উন্মুক্ত বা ঢেকে যেভাবেই রাখেন। তেমনি আপনারও তো লিঙ্গ আছে। সেটাও তেমনই ব্যাপার। তো আপনার প্যান্টের ওখানে ফুলে থাকলে তো কোনও মেয়ে গিয়ে খপ করে ধরে বলে না যে এই স্ফীত ভাব দেখে আমার কাম উদ্বেলিত হয়েছে। আপনি কেন তা করেন? আপনি আপনার লোমশ বুক বের করে দেখিয়ে বেড়ান, তা দেখে কোন মেয়ে বলেনি সে উত্তেজিত হয়েছে । আপনি কেন বলবেন বুক দেখে আপনার নেটওয়ার্ক টাওয়ার ফুলে গগনচুম্বী ? কেউ আমরা এমন অশ্লীল ভাবনা ভাবি না । কেবল মুখ দেখেই আপনার দাঁড়িয়ে যায়? টন টনাটন টন ? তাই যদি হয়, আপনি যদি কোন অসহায় মেয়ে বিপদে পড়া অবস্থায় পান তবে তো অঘটন এই আপনিই ঘটাবেন এটাই প্রতীয়মান হয়। আমি জেনেরেলাইজ করছি না, বলছি ম্যাক্সিমাম পুং-মানুষ এমন।

রুক্মিণীকুমার : আমি করি কি ভাবনাটা না ভেবে আগে একটু অ্যাকটিং করে ঝালিয়ে নিই। পরে কাগজে উৎরোই। আগে অভিনয়ের স্পেসটায় সশরীরে ভারবালি ইমপ্রভাইস করি। ঐ যাকে বলে সলিলকি গোছের। কৌশিক সরকার ফুটলাইটের নির্দেশ দিয়েছেন, আলো যাতে কোথাও অবস্কিওর না হয়ে যায়, চরিত্র মঞ্চের কোণে গেলেও জনান্তিকে যেন পায় সঠিক আলোর ইমপেটাস, স্বগতোক্তি। আমিও তার মানে দেখা যাচ্ছে থিয়েটারেরই লোক, আই মিন এসেনসিয়ালি। ফরাসিরা কী করল সব অ্যাকটিং-থিংকিং এ ঢুকে গেল। আঁকলোই না। বলল স্প্যানিশরা এ শতকের দায়িত্ব নিক আমরা সাহিত্য চিত্রকলার রেটরিকে মধ্যে আর নেই। ইমপ্রেসানিজমে অনেক খেটেছি উনবিংশ সিয়েক্লেতে। আর রঙ ভাল্লাগছে না। এবার একটু কালোশাদা অক্ষরের স্পেসে কী করা যায় দেখা যাক। এখন তোমরা প্লাসটিক পরিসরে কিউবিজম করো,তাহেলকা মাচাও, পরে না হয় স্ট্রাকচারালিজমে তাকে আমরা তাত্ত্বিক জায়গায় রিঅ্যাপ্রপ্রিয়েট করে নেব’খন। তারপর তাকেও অক্ষত রাখব না, ডিকন্সট্রাকট করে দেব, কেমন। জটিল ভাবনা সহজ করে ভাবছি, যথাসম্ভব। লাকাঁকে দ্যাখো, কী অ্যাকটিং! পুরো আর্তোর নাটকীয় টেকনিক। ফুকোও তেমনি, অনর্গল। হাসতে হাসতে হেঁচকি উঠে যায়, দেবশিশু এত ইলকয়েন্ট আর লাজুক। সব অভিনেতা। বিদ্যাসাগর বলতেন, কইয়ে বলিয়ে। নিজে ঢিপলে তো তোতলা ছিল।… ভেবে নিলে কিন্তু ভাবনাটা পরে জমে ভালো। ইনভিজিবল অ্যাপলাউজ। আসলে ভাবনা বলে কিছু হয় না, দেখা যাচ্ছে মানেই, ডায়ালগ, ডাবল — যা মূলত প্লেটোনিক। নইলে ঐ হিউজ কনফেসনসের পর ডায়ালগ ভাববে কেন ফের জাঁ জাক হুসো! ফুকোর ভাবনাটা ভেবো । রস পাবে। ও তো দারুণ পাজল সলভ করতে ওস্তাদ। যাদুকর। সব সময় অ্যাকটিং করবে ভাবনায় । বিনা টেরেসকে বিলডিং।

গোবিন্দমাণিক্য : কলেজের ক্যান্টিনে,ঠোঁটে ঠোঁটে সিগারেট ট্রান্সফার হবে, হাতে হাত ধরে থাকবে ওরা টেবিলে ও নীচে, পিঠে ধাক্কা মেরে গল্পে হেসে চলে যাবে, বাইকে সুঁইং ক’রে, একসাথে কতদূর যাবে ওরা কেউ জানেনা, কলেজ খুললে, এতদিনের যমুনার জল,কোথা থেকে কোথায় গড়াবে, তুমি আমি সে তাহারা কেউ, অনুমানের ছিঁটেফোঁটাও করতেই পারিনা, কলেজ এখন থেকে প্রত্যেকদিনই যেতে হবে, কত ভাবনা ভাবা বাকি, কত জ্ঞান আলোচনা অভিজ্ঞতা আয়োজন ভাবনাপর্ব, জীবনের প্রস্তুতি সব এতদিনের জমানো গল্পগাছা উৎকণ্ঠা আর, উল্টোপাল্টা, সব ঠিকঠাক করে নিয়ে, এইবার, এনজয়মেন্ট ফুলফিল করে নিতে হবে, ক্লাশ থেকে ছাদ বারান্দা মাঠ বাগান, লাইব্রেরি ক্যান্টিন ল্যাব রাস্তাঘাট টোটো অটো বাস, রিক্সা সাইকেল মোটরসাইকেল সবখানে শুধু, গিজগিজ গিজগিজ গিজগিজ গিজগিজ…আরে ভাই জরা দেখকে চঢ়ো…

দেবদাস : যত্তো সব মাতাল । গাঁজা আর চরসের তফাত জানে না ।

সাত

ব্র্হ্মচারী সত্যানন্দ : মহেন্দ্র চেয়ে দ্যাখো, , এক অপরূপ সর্বাঙ্গসম্পন্না, সর্বাঙ্গবরণভূষিতা জগদ্ধাত্রী মূর্তি।  ‘‘মা যা ছিলেন’’। দ্যাখো মা কালীর মূর্তি।  ‘‘দেখ, মা যা হইয়াছেন। কালী- অন্ধকারসমাচ্ছন্না, কালিমাময়ী। হৃতসর্বস্বা, এই জন্য নগ্নিকা। আজি দেশের সর্বত্রই শ্মশান তাই মা কঙ্কালমালিনী।’’ দ্যাখো সোনার তৈরী দশভুজা দুর্গা প্রতিমা।  ‘‘এই মা যা হইবেন। দশভুজ দশ দিকে প্রসারিত, তাহাতে নানা আয়ুধরূপে নানা শক্তি শোভিত, পদতলে শত্রু বিমর্দিত, পদাশ্রিত বীরকেশরী শত্রু নিপীড়নে নিযুক্ত, দিগভুজা, নানা প্রহরণধারিণী, শত্রুবিমর্দিনী বীরেন্দ্র পৃষ্ঠবিহারিণী, দক্ষিণে লক্ষ্মী ভাগ্যরুপিণী, বামে বাণী বিদ্যাবিজ্ঞানদায়িনী, সঙ্গে বলরুপী কার্তিকেয়, কার্যসিদ্ধিরুপী গণেশ।’’ 

রুক্মিণীকুমার: আপনারা সবাই পাগল না জোম্বি ?

শশী : বুঝতে পারছি, আপনি একজন মহানটবর । তাই আপনাকে এখানে পাঠানো হয়েছে নেতৃত্ব দেবার জন্য । 

রুক্মিণীকুমার : ফরাসিরা আর কবিতা ভাবেনি । টোয়েন্টিয়েথ শতকে আর ছবিও আঁকেনি। ইতিহাসের সন্তান ওরা। হিসটিরিসিটির প্রতিভু। সব উনিশ শতকে ফেলে এসেছে। সত্যিকারের একটা হিংসুটে জাত: জার্মান আইডিয়ালিজমকে সারপাস করতে হবে! অজ্ঞেয় কালেকটিভ প্রতিজ্ঞা, রেজলিউসন। দ্যাখো, হাইডেগারের পর জার্মান উত্যুঙ্গ প্রতিভা আর নেই। স্ট্রেঞ্জ নয়! অথচ ফরাসি মুলুকে একটার পর একটা অগ্নুৎপাত। আমি আবার একটু দেরিদার ভক্ত। ভাবুক মাত্রই ফাঁকিবাজ। সে যে-ই হোক। তার গোটা প্রক্রিয়াটাই একটা মস্ত বুজরুকি। আমি কিংবা ফুকো, নো ম্যাটার কে? যত স্কলারলি লোক তুমি হও না কেন! নোভালিস থেকে মালার্মের সমান্তর টানছে দেরিদা। এ তো আরবিট্রারি ফাইনডিং। তার কিন্তু ইমপ্যাকট ভয়ংকর ডিসকার্সিভ টেক্সচুয়াল পরিসরে। মনে হবে লোকটা সর্বজ্ঞ। সব ভাবে নিয়েছে । তা নয়, ওটা ম্যাজিক। নিছক হাতসাফাই। অশ্রদ্ধা করছি না। ফ্র্যাঙ্কলি, দেবতা মানি। আমার হক আছে। দুইয়ে নিই, নিংড়ে, ছিবড়ে করে ছেড়ে দেব, মাথার মধ্যে আমার বত্রিশ কোটি দাঁত। কিন্তু অল দা সেম দেরিদা পর্যন্ত যথেষ্ট হাইডেগেরিয়ান নয়, প্রভাইডেড হাইডেগার হিমসেল্ফ ওয়াজ পরিপূর্ণ হাইডেগারিয়ান। ল্যাংড়াদা বলেছিল, পুরো স্বামীই বা হব কেন, পুরো বাবাই বা হব কেন — যদি নাই হই, আমি আমার ভাবনাকেই বা পুরো দেব কেন!… বিষ মাল। কিন্তু কত গূঢ় ইনসাইট ভাবো, এই জিজ্ঞাসা, প্রত্যাখ্যান! কী মারাত্মক ভ্যাসাকটমি — নাসবন্দি খেলা! আত্মনপুংসকীকরণ, স্বেচ্ছায় — যে, আমি কাফকা হতে নিজেকে রিফিউজ করছি, এ অন্য লেভেলের কাউন্টার কুরবানি : বস্তুত ল্যাংড়াদা একটা ইভেন্ট, অন্তর্ধান। কিন্তু ওটা তুরীয় অবস্থায় কথিত। ভার্চুয়ালি ভেবে গেছে যত্ত রাবিশ, টাকাকড়ির ধান্দায়, মক্ষিচুষ লোক । আমিও আর ভাবনা ভাবি-টাবি না: স্রেফ থিওরি কপচাই। বাংলা ভাবনার একটা গতি করে যেতে হবে তো…ঋত্বিক ঘটকের হুকুম ।

গফুর : হ্যাঁ নটবর মিয়াঁ । বাংলার একটা গতি করুন । আপনার মধ্যে সেই পাগলামি রয়েছে, যা রামমোহনের, বিদ্যাসাগরের, রবীন্দ্রনাথের, প্রমথ চৌধুরী, কমলকুমার মজুমদারের ছিল ।

রুক্মিণীকুমার : আমিও এরকম শিবের মতো মার দুদুটা ধরে শুয়ে থাকতাম, একদিন লেভ তলস্তয় এসে আমাকে কি বকা দিলে, এই ব্যাটা দামড়া খোকা ওঠ, যা যুদ্ধে যা। আমি বললাম আপনি নেপোলিয়নকে নিয়ে লিখুন এখন আমি হেগেল পড়ছি, নেপোয় মারে দই! আচ্ছা খাজুরাহো না দেখার দুঃখ তো কৌশিক সরকার কোথাও লেখেননি, আরে কেশব সেনকে দেখে কী হবে, খাজুরাহো তো কোরিওগ্রাফিতে গ্রীক ভাস্কর্য আর ব্যালেকেও হার মানায় অবশ্য এটা একাদশ শতকের কর্মকাণ্ড পৃথ্বীশ নিয়োগী আর সত্যজিৎ রায়ের কথোপকথনটা আবার ভাবতে ইচ্ছে করছে।  মন আামি কবে যে প্রমথবাবুর মতো বাঙালি হবো!

বিপিন : সেক্স- এমন একটা শব্দ, আপনি কোন ইস্যুতে কইলেন সেটা ব্যাপার না। এটা জেন্ডার নাকি প্রেম, নাকি রেপ, নাকি হুদাই কিচ্ছু দেখবে না। চোখে সেক্স শব্দ পড়সে মানে সে ভিজুয়ালাইজ করতে শুরু করে আপনি খুব লাগালাগি করে ইয়া বড় পেট একটা নিয়া হাটতেসেন। আপনি সস্তা, ব্যাস টোকা দেয়া শুরু, কারণ ওই শব্দ দেইখাই উনার এন্টেনায় প্রচুর কারেন্ট আসছে এবং নেটওয়ার্ক ফুল হয়া গেসে। মাসিক- এটা সমার্থক বা প্রতিশব্দ বা ইংরেজি শব্দ যেমনেই কন, এইডা একটা অপবিত্র এবং উত্তেজক শব্দ। এই শব্দ দেখলেই উনাদের হাতের আঙুলেও প্রচুর কারেন্ট উৎপাদন হয়, পশ্চাৎদেশে জ্বালাপোড়া হয়। উনারা চোখ বন্ধ কইরা এক সেকেন্ডেই দেখেন সেই মেয়েটার পা বায়া হরেদরে রক্ত গড়ায়া পড়তাসে। ব্যাস আঙ্গুলের কাজ শুরু, টাইপ করবেন, ওয়ালে কমেন্ট অযাচিত আহা এবং উহুউউউ, আর খুব মাখন টাইপ। কেউ কেউ  গালি এমন ভাবে দিবেন যেন গালিতে রতিসুখ, রতিক্রিয়া সম্পন্ন এবং খুব ভরে দিয়ে উনি আপনারে প্র‍্যাগন্যান্ট বানায়া দিসেন। এইগুলা অতি সত্য কথা, অযাচিত কুতর্ক ভাল্লাগবেনা। বালামার!

অমরনাথ : চারদিকের কিছু নতুন গজিয়ে ওঠা বালের মতো ক্যারেক্টার দেখি। যার নতুন ওঠে সে তো পুলকের চোটে বালে হাত বুলায় আর ভাবে আহা কি নরম কোমল মোলায়েম! থাক আর কিছুদিন। ঠিক তখনই এইসব বাল লম্বায় বাড়তে বাড়তে এতো বড় হয় যে বালের মালিক নিজের বালে পেচায়া মইরা যায়। এদেরকে তাল দেয় আবার পুরান পাইকা তামার তার হওয়া বালের মালিক। আরে তোর এতো খাউজানি থাকলে নিজের তামার তারগুলা প্লাইয়ার্স দিয়া কাইটা আঁটি বাইন্ধা বাজারে নিয়া বেইচা দে হারামজাদা গুস্তাখ! ঘটনা হইসে পাকনা বাল গুলারে সবাই চিনে, নতুন বাল ওলারা বুঝেনা এই মুর্শিদ তোরে সুটায়া লাল করে দিবে, ব্যথায় হাঁটতেও পারবি না।

বালামার!

মহিম : আমাদের ছোটবেলায় সর্দিজ্বর হলে ভাত বন্ধ থাকত। অখাদ্য সাবু বা বার্লি গিলতে হত ওই তেতো মুখে। তারপর যেদিন ভাত খাওয়ার নিদেন দিত ডাক্তার, সেদিন হত শিঙ্গি মাছের ঝোল। ভাতের পাতে সবার প্রথমে উচ্ছে ভাজা। তেতোয় তেতো কেটে যায় বলে। এমনিতে তেতো না খাওয়া মুখ, উচ্ছে ভাজা যে অত মধুর হয়, সেদিন বুঝতাম। আর সবশেষে আমলকির আচার। এই সব যত্নগুলো ছিল বলেই বোধহয় জ্বরের দিনগুলো ভুলে যেতাম সহজে। এখন জ্বর হলেও স্নান করা, ভাত খাওয়া আর অ্যান্টিবায়োটিক। আজ খুব ইচ্ছে হল নিজেকে যত্ন করি। তিনদিন সর্দিজ্বরের পর, (যদিও এ ক’দিন ভাতটাত সবই চলেছে) উচ্ছে ভাজা, লালশাক ভাজা, ডাল, তরকারির পর বড়ি দিয়ে জ্যান্ত মাছের পাতলা ঝোল। আর সবশেষে আমলকির আচার। জল খেয়েও মুখ মিষ্টি হয়ে আছেL

নিখিলেশ :জানি না ইউক্যালিপটাস তেল নিয়ে কার কী অভিজ্ঞতা। উটি বেড়াতে গিয়ে প্রথমবার তিনি এসেছিলেন বাড়িতে। আমার ওই বিশ্রী গন্ধ কোনোদিন ভাল লাগেনি। উপকারী না অপকারী তাও জানতাম না। আমার বিরোধী পক্ষ অবশ্য সেই তেলের ফ্যান। দিবারেত্রি ঘিসিং এন ঘিসিং… যাই হোক, এই করোনাকালে সর্দিকাশি হলেই ভয় হয়। ওষুধের পাশাপাশি সেই বিচ্ছিরি তেল ইনহেল করলাম। নাকে, গলায়, কপালে লাগিয়ে দেখলাম, সত্যিই ম্যাজিক! সর্দি বসায় না, বরং তুলে দেয়, মাথা যন্ত্রণা গায়েব। নাক খুল যা সিমসিম! বিরোধী পক্ষকে ধন্যবাদ। যারা সর্দিকাশিতে ভোগেন, অনলাইনে নাহয় আনিয়ে নিন এক শিশি।

রুক্মিণীকুমার :  ভার্জিনিয়া উলফ, আমার অসম্ভব প্রিয় ভাবুক– চল্লিশ বছর ধরে ওঁর ভাবনা ফলো করছি, নকল করিনি, আমি উন্মত্ত জয়েসিয়ান; অধিকন্তু এ মেয়েটা হালকা ডাবল স্ট্যানডারড আছে — লরেন্সের ওপর লিখছে, অদ্ভুত — ততদিনে লরেন্স মরে ভূত  — আরে লেডি চ্যাটার্লি নিয়ে ভাবো, তা না সন্স অ্যানড লাভার এর গুণকীর্তন করতে বসেছে, আজব, জানি মেয়েদের একটু সমস্যা ছিল তখন, বিশেষত ইংলনডে, কিন্তু তোমাকে তো ভাবতে হচ্ছে না, লরেন্স দায়িত্ব নিয়ে ভেবে গেছে, তোমার কাজ শুধু রিয়্যাপ্রপ্রিয়েট করা ক্রিটিকো-তাত্ত্বিক পরিসরে, সেখানেও অ্যামগুইটির গল্প, এতেই শেষ নয় বারবার কোয়াইট অপ্রাসঙ্গিকলি প্রুস্তের সঙ্গে তুলনা টানছে, অথচ হাতের কাছেই জয়েস আছে দেদীপ্যমান দুজন ন্যাংটা সেক্সমেনিয়াকের তুলনা করো; ভয়, মিথ্যাচার, উফ কী বলব! প্রুস্ত একটা সাত্ত্বিক লেখক এক জায়গায় সে বলেওছে জীবনের কার্নাল প্লেজারের স্পেসটা তো পুরো বাদ দেওয়া যায় না — কিন্তু সে আমাদের জয়েস লরেন্সের মতো পোস্ট পর্নোগ্রাফিক নভেলিসট নয় — তার সঙ্গে তুলনার কারণই হচ্ছে একটা বাজে ইনটেনসনালিটি, ঠারেঠোরে জয়েসকে অস্বীকার করা শুধু নয় ভারচুয়ালি ভাবনার ইতিহাস থেকে এলিমিনেট করে দেওয়া, প্রচ্ছন্ন কনসপিরেসি, এসব ভীরু ভাবুক শাক দিয়ে মাছ ঢাকছে সারাক্ষণ, ফ্র্যাঙ্কলি ভাবতে পারে না; সন্ন্যাসিনীর গোপন খবর! এদিকে একটা মরণোত্তর খতিয়ানও না করলেই নয়, চক্ষু লজ্জার খাতিরে, বিবেকেরও জ্বালা: লরেন্সের অন্য ভাবনাকে তো যেমন প্রাসিয়ান অফিসার পর্নোগ্রাফি বলে খারিজই করে দিচ্ছে সরাসরি আর আসল ভাবনার তো নামই মুখে আনেনি এরা ভাবনাকে সব সময় পেছন দিকে টানে ভাগ্যিস ইতিমধ্যে অ্যানাইস নিন সিনে চলে এসেছে হেনরি মিলারের চেয়েও অকপট, সেক্স ছাড়া ভাবনা হয়?

খোকা : আপনি সম্ভবত ফ্যানি হিল বইটা ভাবেননি। ‘ফ্যানি হিল : মেমোয়ার্স অফ আ উওম্যান’ লণ্ডনে প্রথম প্রকাশিত হয় সতেরশো আটচল্লিশ সালে। পরের বছর প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় খণ্ড। জন ক্লিল্যান্ড ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী। সতেরশো উনত্রিশ থেকে সতেরশো চল্লিশ, তিনি  বম্বেতে ছিলেন। সতেরশো একচল্লিশে লণ্ডনে ফিরে যান। আরও সাত বছর পরে ফ্যানি হিল প্রকাশিত হয়। সম্ভবত বম্বেতে থাকাকালীন ক্লিল্যান্ড এই ভাবনা ভাবতে শুরু করেছিলেন। বিশ্ব ভাবনার ইতিহাসে ফ্যানি হিলের মতন ভাবনা খুব কম আছে যা এত বার পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। উনিশশো সত্তর সালের আগে ভাবনাটির প্রকাশ আইনি স্বীকৃতি পায়নি। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে ব্রিটেন থেকে আমেরিকা,  ফ্রান্স এবং অন্যান্য বহু দেশে ভাবনাটির বেআইনি সংস্করণ ছাপা হয়। প্রথম প্রকাশের ঠিক এক বছর পরে ক্লিল্যাণ্ডকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। অশ্লীলতার দায়ে প্রিভি কাউন্সিলের সামনে তাঁকে হাজির হতে হয়। সরকারি ভাবে প্রকাশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বাজার থেকে ভাবনাটি তুলে নেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সব অভিযোগ কাটিয়ে উঠে, ধ্রুপদি ভাবনার মর্যাদায় উত্তীর্ণ হয়ে ফ্যনি হিল। ভাবুক সমাজে ফ্যানি হিলের প্রভাব এত প্রবল ছিল যে লণ্ডনের বিশপ একবার ভূমিকম্পের জন্য বইটিকে দায়ী করেছিলেন। ফ্যানি হিলের সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য,  ভাবনার ভাষা সম্পূর্ণরূপে বিশুদ্ধ , কোনও ভাবেই তার গায়ে সোনাগাছি ভাবনার তকমা দেগে দেওয়া যায় না। অক্ষতযোনি ফ্যানি যখন এক কুৎসিত কামুক বেশ্যাসক্ত ইংরেজকে অনুনয় করছে তাকে রেহাই দেওয়ার জন্য, তখন বিকৃত উত্তেজনার বদলে ভাবুকদের অন্তর ব্যথায় টনটন করে ওঠে।

ঠকচাচা : কেতাবি বাবু সব বাতেতেই ঠোকর মারেন। মালুম হয় এনার দুসরা কোই কাম কাজ নাই। মোর ওমর বহুত হল —নুর বি পেকে গেল —মুই ছোকরাদের সাত হর ঘড়ি তকরার কি কর্‌ব? কেতাবি বাবু কি জানেন এ সাদিতে কেতনা রোপেয়া ঘর ঢুক্‌বে?

দেবদাস : যত্তো সব মাতাল । সোনাগাছি আর সোনাগাজির তফাত জানে না ।

আট

অপু : পূজাপর্বের সূচনায় ছিল রাজবেশের প্রস্তাব। দৈববাণী। মরমে পশিল! প্রথার বাইরে এসব। সমিতি বা সংঘকে অস্বীকার করে সেই প্রেম।চৈতন্যের আকাশে আলোকরশ্মির ক্ষণায়ু তাও মন্দ কি! বেশের আড়ালে সমস্ত ক্ষতই লালন স্বভাবী। সে দেখবে না বলেই দেখেনি।নিমিত্তের স্বার্থ নেই, অশ্রু মানে পুষ্পবৃষ্টি। নিমিত্ত, দর্পণের সিঁদুর। বিসর্জনও। পড়ে রইলো সেই রাজবেশ আর সে শিউলিদের ডেকে জড়ো করল।সেই দৃশ্যে প্রতিটা গাছের সায় ছিল। ঝাঁকিয়ে দিয়েছিল শাখা-প্রশাখা। ফুলের আভরণে ঢেকে গিয়েছিল মাধুকরীর আলতা পা। ঝড় এসে বেআব্রু করে দিয়েছিল অধিবাস। রাত্রি ভাসিয়ে দিয়েছিল সেই মান্দাস। তারপরে আবার পুজাপর্বের সূচনায় ।

সদানন্দ : পেলাম তাকে সোনার দরে, পান মিশিয়ে একটু ভাঙা গড়া, নাকছাবিতে মোতি’র ঝুটো, আস্কারা রোদ দু-এক মুঠো, বাবুয়ানায় হাজার তানাবানা,রঙ পাঠাল রোশনওয়ালি, ঠোঙায় ভরা শ’হাততালি, খুলতে গিয়েই ফুড়ুৎ পাখির ডানায়,এ ডাল ও ডাল লাফিয়ে খুশি,এমন আলোয় আমিও হঠাৎ কাঙাল,আয়না হাসে আয়না কাঁদে,কাপড় শুকায় তিজন মাঠে,রাত বিরেতে যাত্রা পার্টির বাসে

হাজার মানুষ হুড়োহুড়ি,শ্যাম তোহারি পায়ে পড়ি,দু-হাত কেন এমন করে রাঙাস

রুক্মিণীকুমার : প্রুস্ত রোজ একপাতা ভাবো, গুজবে কান দেবে না, আমি একটা তত্ত্বসিদ্ধ মহাপুরুষ, আমার কথা শোনো, আর কারুর কথা শুনতে হবে না, আমি দশহাজার ভাবনা দশ মাথায় ঘেঁটেছি, আমি রাবণ, ঐ এক পাতাতেই রসার্স এর সব রস আছে মানে প্রতিটা পাতাই বাকি তিনহাজার পাতার পরিপূরক; বড় ভাবুকরা এরকমই ভাবেন কাফকা ফুকো কমলকুমার যে কোনো ভাবনা দ্যাখো — প্রথম ভাবনা থেকে শুরু করতে হবে কথা নেই, শেষ ভাবনা থেকে শুরু করো, নিয়ম সব ভেঙে দাও, পিকাসোর পর কোনো নিয়ম চলে না: ভাঙাটাই নিয়ম! ফৈয়াজ খাঁর মতো, গুঁড়িয়ে গাও, ফতে আলি খানের মতো কণ্ঠ পালক ওড়াও, পোলকের মতো রক্ত পিচকারি আমি বলছি, আমাকে বেদবাক্য জানবে, ফারিশতা রুক্মিণীকুমার, রিশতা বানানো আমার ফার্জ, পাথমেকার, রাস্তা বানাই, তুমি যাবে বলে অরুণোদয়ের পথে! প্রুস্তের পাতাই পতাকা, নিশান ধরে এগিয়ে যাও — আমি আছি….জেনেরাল স্যাম ম্যানেকশ বলেছেন ।

সন্দীপ : যাক আপনি আমাদের সঙ্গে আছেন । আমরা ভাবছিলুম পাগলভূমে এ কোন মগজহীন নভচারী ।

অপূর্ব : প্রাণের লণ্ঠন আজ খেলুড়ির মুখ চিনে তারই রাস্তায় বসে পড়ে, খেলুড়ির বড় বড় চোখের পাতার নীচে যেসব নক্সা খেলা করে, তাজ্ঝিম মাজ্ঝিম লেগে যায়,চন্দ্রাহত দিনে তার ঠোঁটের রেখাটি ধরে সেসব হাঁটায়,সে এক অদ্ভুত ছিল মুদির দোকান,মৌরি লজেন্স দিতো খেলনাবাটির প্রলোভন

তার মুখ আঁকা ছিল আশ্চর্য দিনের হাঁড়িকুঁড়ি,সে যে বিক্রি হয়ে গেছে প্রাণ,আমি তার হাত ধরে মারি মরিয়ার মতো টান,প্রাণের লণ্ঠন তবু খেলুড়ির চোখের আঠাতে,আমাকে চেয়েছে তার গলিতে পাঠাতে, মরা নদী শুয়ে আছে যেখানে রাস্তার বহু নীচে,যমজ সেতুর ‘পরে জ্যোৎসনায় তারা সেথা ক্রিকেট খেলিছে,প্রাণের লণ্ঠন তুমি ধূর্ত মার্জারী হয়ে পদশব্দ থাবায় লুকিয়ো,সুপ্ত মেয়ের চাবি আঁচলের গিঁটে বাঁধা রুপোর ইলিশ এনে দিও,খেলুড়ির রোয়াকের কাছে,আতুর পাগল বেশে, প্রাণের লণ্ঠন বসে আছে….

নবকুমার : ছুটির ডাক দেয়, বলে মার্বেল খেলতে আসবেন? মার্বেলের মধ্যেকার কাঁচের জঙ্গলে ঢুকবেন? চা খেতে ছুটবেন রাত দুপুরে? আর চলুন হাত ধরে কোমল গান্ধারের খড়ের গাদায় ঢুকে যাই, যখন সুপ্রিয়া দেবী সেই জ্বলন্ত চোখের যুবককে প্রস্তাব দিচ্ছেন নিবেদনে, আর ঋত্বিক উপুড় করে দিচ্ছেন ওপার বাংলাদেশ, ছুটির ডাক দিতো, আঁশটে ডাক দিতো না,সোনাগাছির দিকে তাকালে তার চোখ দুর্বারের মতো জ্বলে উঠত, হোটেলের ঘরের দিকে তাকালে তার চোখ আসংস্কার ঘৃণায়, তবু জয় গোঁসাই যখন ফলিডল হাতে মেঘের দিকে চলে যাওয়া, প্রেমিক প্রেমিকার,দাদা বৌদির,তুতো ভাইবোনদের জন্য, আকাশের দালালের কাছে চিঠি লিখছেন, মুঠো পাকাচ্ছেন, আমি স্পষ্ট দেখেছি ওও গাড়িটাকে পাশে দাঁড় করিয়ে সঙ্গ নিয়েছে, তর্জা করেছে রীতিমতো, বুককে তারাবাজির মতো চড়চড় শব্দে না পোড়ালে, দেওয়ানা দিয়ালী হয় না, তারাবাজির মতো মন পুড়ছে, তার জসনে বাহার উঠছে কি উঠছে না কবিতায়, ভগবান জানে,খেলতো, তাই খেলায় ডাক দিতো, এখন খেলা বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকছে কদিন, আমাদের দুজনেরই আওতায় আছে, মৃত খেলার দিনের হাসি, কলকণ্ঠ, লুকোচুরি, রাখা আছে, শুনছি না, খেলার ডাকটি মনে আছে, ছাদের ডাকটি মনে আছে ।

গফুর : পাশে সম্ভবত জহির ছিলো, ক্রপ কইরা ফালায়া দিছি। নারীদের সাথে আমার অন্য কাউরে সহ্যই হয় না। দুম্মম কইরা আর্মি স্টেডিয়ামের কোন কনসার্টে দেখা হইয়া যাবার পর কর্তব্যরত আমারে কিঞ্চিৎ পাত্তা দিতে চাইয়া কবি আসমা অধরা সেল্ফি তুলছিলেন। নিজের খোমা দেইখা মনে হইতেছে বছর কয়েক আগে, সম্ভবত জয় বাংলা কনসার্টে।আসমার কবিতায় একটা অদ্ভুত মায়া আছে, আদর আছে। সহজতা আছে। ওঁর মতোই।এরপর দেখা হইলে, তোমার ভালো ক্যামেরায় ভালো ভালো ছবি তুইলা রাইখো। কবে আর ‘আর দেখা হবে না’ স্টেজে চইলা যাইতে হয়, কে বা আমরা জানি! তার আগ পর্যন্ত, তোমার শক্ত না’গুলি সব হ্যাঁ হয়ে যাক সহজে ।

তারাপদ : তোমার ঘরের টেবিলটা, তোমার ফ্রিজের ম্যাগনেট, আমার ঝাড়ামুছোর আদরের, আমার টুকরো ছুটির স্নেহের, হাতে খাওয়ানো কুকুর, তারা আমার গন্ধ চেনে,আমার স্মৃতিতে ল্যাজ নাড়ে, তোমার ঘরের গ্রিল, গ্রিলের চিলতে আকাশ, আকাশে সরে সরে যাওয়া মেঘ, মেঘের আবড়ালে রামধনু, আমাদের অপ্রাকৃত তারা, আমার তোমার প্রিয় সিনেমার ঘর, তোমার বারান্দায় ঝুঁকে থাকা ল্যাম্পপোস্টটি জিজ্ঞেস করলো সেদিন, সে মেয়েটি কোথায় গেল? এ মেয়েটি কে?, সে মেয়েটি আমাদের কালচার বুঝতো, আমাদের পছন্দ ছিলো, এরকমই কিছু বললো ছাদের উপরদিকে, অব্যবহৃত, চিলেকোঠা ঘরও, আমরা হেসেছি, ধুস এরা সুপ্রাচীন, আমাদের মোহভঙ্গ আমাদের নানা রঙ্গ সহজে বোঝে না, রাত্রে ছাদের ক্যাঁচকোঁচ, কাঠে কাঠে লোহার বরগায়, তোমার অবিশ্বাসী শীৎকারে ভ্রুকুটি করেছে, সে মেয়েটি কই?, কই?, যে কোন শব্দ করতো না?

মহেন্দ্রলাল : আছে সুখ, আছে দুঃখ, আছে অপমান, আছে তাচ্ছিল্য, আছে ঘৃনা , আছে ক্রোধ , আছে লালসা , আছে বিরক্তি , আছে ভালোবাসা ,আছে ব্লা ব্লা ব্লা ….গপপোর শুরু বাংলার স্বাধীন রাজ্য ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের খাসমহল থেকে তারপর গল্পের মোড় ঘুরিয়ে উনি নিয়ে গেলেন জোড়াসাঁকোর রবীন্দ্রনাথের কাছে তারপর জ্যোতিন্দ্রনাথ, কাদম্বরী দেবী, বঙ্কিম, স্বামী বিবেকানন্দ , জগদীশ চন্দ্র বসু….এভাবে আরো কত চেনাজানা লোকজনদের যে এর মধ্যে আসা যাওয়া হলো তার হিসেব নাই!  যত গভীরে ঢুকবেন ততো জানতে পারবেন অন্দরমহলের ঘটনা। রবীন্দ্রনাথ কবি কীভাবে হলো, কাদম্বরীর আত্মহননের কারণ, স্বামী বিবেকানন্দর রামকৃষ্ণ পরমহংস নামক এক পাগলা সাধুর সংস্পর্শে এসে ঘোর নাস্তিক থেকে ধর্মানুরাগী হওয়ার কারণ, আরো নানাবিধ ইত্যাদি সিত্যাদি । তাছাড়া সেকালে ভারতে কি হচ্ছে, কিভাবে হচ্ছে, ব্রিটিশরা কেমন করে আস্তে আস্তে পুরো দেশটাতে জাঁকিয়ে বসছে তার ইতিহাসের একটা ছবি উঠে এসেছে গপপোর মধ্যে। এক কথায়  শুধু দিনের আলো নয় বরং রাতের নিকশ অন্ধকারের কথাও মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে ৷ যাই হোক একটা মর্মান্তিক কিন্তু চূড়ান্ত রকম হাস্যকর কাহিনি বলার লোভ সামলাতে পারছি না – তখন চাকরি-বাকরির এমন ই অবস্থা যে অনেক বেকার যুবক শ্মশানঘাটগুলোতে গিয়ে সারাদিন কাটায় । কোন পুরুষ মরা এলেই তারা সাগ্রহে গিয়ে জিজ্ঞেস করে , “কোন হৌসে কাজ করতেন ? কেরানি না দারোগা ?” তারপর তারা দরখাস্ত পাঠায় এই বয়ানে – ‘’ স্যার লার্নিং ফ্রম দ্য বার্নিং ঘাট দ্যাট এ পোস্ট ইজ লাইইং ভেকান্ট ইন ইউর অফিস।”

দেবদাস : যত্তো সব মাতালের দল । পশ্চিমবাংলা আর বেঙ্গলের তফাত জানে না ।

রমেশ : কিছুদিন আগে পর্যন্ত ছিল থ্রিলার। এখন আর শুধু থ্রিলারে কুলোচ্ছে না। তাই ঐতিহাসিক থ্রিলার(ঐথ্রি)। কাঁঠালের আমসত্ত্ব। এবং প্রকাশিত বা প্রকাশিতব্য সব ঐথ্রি গুলোই বিষয় বৈচিত্রে ভরপুর। শুধু তাই নয়, চরিত্ররা অনালোচিত ও অনালোকিত। এবং এখানেই শেষ নয়! এই সব নব নব ঐথ্রি গুলোর মতো কাজ আর হয়নি আগে। এই বাংলায় এই প্রথমবারের মতো আপনার সামনে এসেছে এরা। এদের জুড়ি মেলা ভার বন্ধুরা। প্রিবুকিং ও বুকিং করে ফেলুন শিগগিরী। বুকিং-এর লম্বা লাইনের প্রথম ২০০ জনের মধ্যে না থাকলে সই সহ কপি পাবেন না। তাতে আপনার মান, ইজ্জত, সম্ভ্রম সব যাবে। ঐথ্রির জয় হউক!

অমরনাথ : আধুনিক সংস্কৃতির গ্রহণযোগ্যতা অনেক। উত্তর আধুনিকবেত্তার উষ্মার কারণ হলেও সংগীতের বিষয়ে আমরা যুগের সঙ্গে চলতে বাধ্য । যদিও সময় জবাব দেবে তার। আগের সময়েও একটা তুলনামূলক চর্চা চলত। বিষয় একই –আগের গানের মত গান হচ্ছে না। এ বিষয়ে শিল্পী মান্না দে মহাশয়ের মত জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বকেও নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল ওঁর কাকা শ্রী কৃষ্ণচন্দ্র দে’র গান স্বকন্ঠে রেকর্ড করার পর। ” ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে” গানের রেকর্ডের কথা বলছি। আমরা কিন্তু একটা মডিউলেশন শুনতে পেয়েছিলাম। আসলে বাংলা গানের প্রণেতাদের গানের ক্ষেত্রে কোনো কপিরাইটের ব্যপার ছিল না বলেই হয়ত আমরা মান্না দে’র গানের ওই অমূল্য সম্পদকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছিলাম।‌অন্যদিকে আমরা কিন্তু এখনও মেনে নিতে পারিনি শিল্পী নির্মলা মিশ্রের জনপ্রিয় সেই গানটি অন্য কারো কন্ঠে।এক লাইভে এ বিষয়ে শিল্পী স্বয়ং স্বীকার করেছিলেন। সেই বিশেষ গানটি ” ও তোতা পাখি রে…”। মনে আছে এক সাক্ষাৎকারে শিল্পী মান্না দে, এ আর রহমানের প্রথম প্রকাশিত চলচ্চিত্র ” রোজা’র” গান শুনে বিরক্ত প্রকাশ করে বলেছিলেন ” হুলিগ্যানের গান”। যদিও ওই ফিল্মের গানগুলো জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। হয়ত তখন থেকেই ফিউশনের জন্ম এবং কনফিউশনের। অথচ এর অনেক আগে শ্রাবন্তী মজুমদার বা রাণু মুখার্জি পাশ্চাত্য ভাবধারায় গান করে ফেলেছিলেন। ১) বুসিবল , , কুহেলি রাত ইত্যাদি গান রেডিওতে প্রায়শই বাজত ( রাণু মুখার্জির গান)। অন্যদিকে শ্রাবন্তী মজুমদারের গান ১) মধুপুরে পাশের বাড়িতে তুমি থাকতে ২) আমি একটা ছোট্ট বাগান করেছি ইত্যাদি। ভি. বালসারাজী পাকাপাকি ভাবে চলে এলেন বাংলা গানের দুনিয়ায়। এই সময়ও সম্ভবত পরিচিত এই সব গানের সঙ্গে। এখন গুরুমুখি তালিমে সীমিত শিক্ষার্থী আদি ঘরাণাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এর মহিমা যে কতখানি সেটার অভিজ্ঞতা যাদের রয়েছে তারাই বলতে পারবেন। একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, গ্রহণযোগ্যতা কোনো পথ্য নয়– রসাস্বাদন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তালিম শব্দটি বদলে নতুন নামকরণ হয়েছে ” ভয়েস ট্রেনিং”।মিউজিক আ্যারেঞ্জারের পারদর্শীতা শিল্পীর থেকেও উচ্চতর আসনে বসে আছে সম্ভবত। কিন্তু আমরা ভুলিনি সুরকার সুধীন দাশগুপ্ত’র কথা বা নচিকেতা ঘোষ অথবা প্রবীর মজুমদারের কথা অথবা আরও অনেকে। একই ভাবে হিন্দি গানের ক্ষেত্রেও সেই স্বর্ণযুগের অবসান রাহুল দেব বর্মনের গান দিয়ে। পরীক্ষা নিরীক্ষা সব সময় চলেছিল বা এখনও চলছে। এসে গেছেন কবীর সুমন, নচিকেতা আরও অনেকে। মানুষ গ্রহণ করেছেন কারণ শ্রোতারও একটা খিদে থাকে। অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে ” মহীনের ঘোড়াগুলি” র মত কতটা কালজয়ী হবে এদের গান সেটাও সময়ের তূল্যমূল্যে। সম্প্রতি একটি ওয়েব সিরিজের নাম না করে পারছি না। Bandish Bandits। ফিউশন বনাম কনফিউশনের এক দ্বন্দ্ব এক অদ্ভুত বাতাবরণের সৃষ্টি করেছে। ফিউশনকে যদি blending বলা হয় তবে তার সঙ্গে আন্দাজের দক্ষতা অনিবার্য। জয়পুর ঘরাণার কিছু উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের পাশে ফিউশন তাৎক্ষণিক বিনোদনে থেমে গেছে। তখনই একজন শিক্ষার্থীকে আমরা দেখতে পেলাম যে তাকে ফিরে যেতে হচ্ছে সরস্বতী আরাধনায়। এখান থেকেই কনফিউশনের জন্ম। নিজেকে এবং শ্রোতাকে যাচাই করার সদিচ্ছা হয়ত আরও উন্নততর প্রসাদ আমাদের হাতে তুলে দেবে। হোক না সে নিমিত্ত মাত্র। এই সাধনার ফসল আমাদের উপহার দিয়েছে হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া’র মত এক বংশীবাদক কে, যিনি পন্ডিত রবিশঙ্করের স্ত্রী অন্নপূর্ণা দেবীর কাছে সঙ্গীত জীবনের মধ্যাহ্নে উপস্থিত হয়েছিলেন। ওঁকে তালিম দিতে প্রথমে রাজি হননি অন্নপূর্ণা দেবী। শেষে এক কঠিন শর্ত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া’কে সম্মত করেছিল তালিম নেওয়ার জন্য। রাতারাতি উনি অন্নপূর্ণা দেবীর নির্দেশে বাঁ হাতে বাঁশি তুলে ধরেন। এক কঠিন অধ্যাবসায়। অবশ্যই প্রশ্ন উঠতে পারে এর কারণ বিষয়ে। অন্নপূর্ণা দেবী চেয়েছিলেন অন্য ঘরাণার ছাপ যেন ওঁর ছাত্রের সুরে ও সুর প্রয়োগে না পড়ে। এই অভিনিবেশ সত্যিই অবাক করে দেবার মত। অবশ্যই একে ছুৎমার্গ বলা চলে না। প্রশ্নটা ছিল সিগনেচারের। বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তি গানকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। অতীতের অনেক শিল্পীই এখন ট্র্যাকে গান গাওয়ায় অভ্যস্ত অথবা ডাবিংয়ে। আসলে এই সমঝোতা সংগীতের প্রতি ভালোবাসার কারণে। কনফিউশন থাকলে রি– টেকের সুবিধাও রয়েছে। তীর্থের পথ এখন দূর্গম নয় । পথ পরিণত হয়েছে রাস্তায়।

নগেন্দ্র : দুই শতকেরও বেশি সময় ধরে, আমাদের যে প্রত্যক্ষ ইউরোপীয় নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকতে হয়েছিল— সেই সত্যকে আমরা বাদ দিতে পারি না। ভুলে থাকতে পারি না, পাশ কাটিয়ে যেতে পারি না। তার পাশাপাশি আবার প্রাক-ঔপনিবেশিক পর্বে ফিরে যাবার চেষ্টা করেও ঔপনিবেশিকতাকে প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব নয়। মলয় রায়চৌধুরী তাই তাঁর এই উপন্যাস তিনটিতেই ইউরোপীয় সন্দর্ভগুলিকে এবং সেই সঙ্গে ইউরোপ ও ভারতবর্ষের ক্রিয়া-প্রতিক্রয়ার মধ্যে অবস্হানকারী সুবিধাভোগী অংশের দ্বারা উৎপাটিত সন্দর্ভগত সক্রিয়তাকেও ইন্টারোগেট করেন। সেই সূত্রে তিনি বুঝে নিতে চান, ইউরোপ কেমনভাবে মতাদর্শগত আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সূত্রে তাদের কোড বা সংকেতগুলিকে আমাদের সামাজিক ব্যবস্হার প্রবহমানতার মধ্যে গ্রহণযোগ্য করে তুতে পেরেছিল, এবং এখনও কেন পারছে। এইভাবে বুঝে নিতে চাইবার পরিণতিতে, আধিপত্যকামী সন্দর্ভের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে, মলয় রায়চৌধুরীকে নির্মাণ করে নিতে হয়েছে বিকল্প সন্দর্ভের এমন এক পরিসর যা ঔপনিবেশিকতার প্রভাবমুক্ত জাতীয় ও আঞ্চলিক উপাদানের দ্বারা সম্পৃক্ত এক সচল চিন্তাপ্রবাহের দ্বারা নির্ধারিত। এই চিন্তাপ্রবাহের সূত্রেই মলয়ের বিকল্প সন্দর্ভ প্রতিনিয়ত শুষে নিচ্ছে চারপাশের নিরুচ্চার বর্গের জীবন থেকে স্বতোৎসারিত বিভিন্ন জায়মান কোড বা সংকেতগুলিকে, এবং সেই সঙ্গে শিল্পের নিজস্ব পরম্পরা এবং শৃঙ্খলার সূত্রেই তা ক্ষয়িত করে বাংলা উপন্যাসের প্রচলিত আধিপত্যকারী সন্দর্ভকে।

নয়

রুক্মিণীকুমার :  বিদ্যাসাগর এসে হাজির আমাদের ক্রিক রোর বাসায়। বলেন, তুই নাকি দ্বিতীয় দার পরিগ্রহ করছিস? বললাম খেপেছেন, রোজ দুটো ডিম খাই তবু একটাকে সামলাতে পারছি না, ঢলানি বুকের আঁচল খসিয়ে জানলার সামনে দাঁড়িয়ে ফ্রি শো দেয়। তার ওপর দ্বিতীয় বিয়ে করলে শিলাজুৎএও আর সামলাতে পারব না। বিদ্যাসাগর বললেন, তবে কি মদনা ভুল বলল?

— না ঠিকই শুনেছেন।

— তাহলে খবর্দার তুই এ বিয়ে করবি না।

বললাম, শিবনাথও তো দুটো বিয়ে করেছে একটা আবার কচি মেয়ে শীল ভাঙেনি প্রথমটার সঙ্গেই শোয় এক রাত কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারে না রোজ তিনখেপের কোটা বরাদ্দ, ছোট মেয়েটা কাঁদে পাশের ঘরে শুয়ে খুব সেক্স পায় বেচারার — শিবুকে তো বুকে আগলে রেখেছেন, ওর বাপ পর্যন্ত ওর জন্য সুপারি ফিট করেছে, কবে উড়িয়ে দেয় ঠিক নেই, এ শালা মুঘল মসনদের থেকে খাতারনাক হিন্দুত্ববাদ, ছেলেকে এলিমিনেট করে দিচ্ছে বাপ হয়ে, ভাবা যায়! ওকে বলুন বুড়িটাকে ছেড়ে চিকনা কচিটার সঙ্গে ইলোপ করতে। বিদ্যাসাগর আর দাঁড়ালেন না, চটি খটখটিয়ে সটান হাঁটা দিলেন। জানি এ লোক কোনো দিন আর আমার মুখদর্শন করবেন না। কিন্তু কী করব, রসের টান; আমি ফিওদর পাবলোভিচ কারামাজভ: সব মেয়েকে ভালো লাগে, ইরেকটাইল ডাবল ফাংসানিংএ ভুগি, সারপ্লাস ভ্যালু, সবই লিবিডিনাল ক্যাপিটালের খেলা, পুঁজি শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে নিজের ভিতরে অনবরত পুনরুজ্জীবিত হয়, ইরসান আছে কিন্তু এসেন্সিয়ালি পুঁজির বিনাশ নেই, সে পাল্টে যায় ।

বাঞ্ছারাম : ক্রিক রো ? মহাকাশেও আছে নাকি অমন গলি ? ক্রিক রো-এর নাম পাল্টে স্যার নীলরতন সরকার সরণি হয়েছে I নীলরতন সরণি আমরা কজন বলি, আমার জানা নেই I অন্তত আমি কারো মুখে ক্র্রিক রো কে নীলরতন সরণি বলতে শুনিনি I কিন্তু যদি কোনো দিন ক্রিক রো এই নামটা হারিয়েও যায়, তার ইতিহাস হারিয়ে গেলে খুব দুঃখজনক হবে I ক্রিক রো-এর এককালে নাম ছিল ‘ডিঙ্গাভাঙ্গা’ লেন I কেন? ক্রিক রো ছিল তখন গঙ্গার অংশ I গঙ্গা থেকে একটা শাখা বেরিয়ে এসে পড়েছিল ওয়েলিংটন স্কয়ারে-এ I আর সেখান থেকে সাপের মতন এঁকে বেঁকে গিয়ে শেষ হতো আমাদের এখনকার সল্ট লেক-এ, যেটা তখনকার সময় ছিল জনমানবশূন্য নোনা জলা জমি I ওয়েলিংটন থেকে এই শাখাটির নাম ছিল ক্রিক রো I তখন এই জলের ওপর নৌকা চলাচল করতো I দুপাশের পাড়ে ছিল সবুজের সমারহ I কোনো এক ঝড়ের রাতে এখানে ডুবে গেছিলো কারোর নৌকো, সেই থেকে অনেকে বলেন ডিঙ্গাভাঙ্গা লেন I কালে কালে এই নদীর জল গেল শুকিয়ে, আর ঠিক তখনি আর পাঁচটা রাস্তার মতন এই নদীর খাল বুঝিয়ে তৈরী হলো রাস্তা I ক্রিক রো দিয়ে হেটে গেলে তার দুপাশের বাড়ি গুলো লক্ষ্য করলে এখনো দেখা যাবে সেই নদী তে নামার বাড়ি থেকে সিঁড়ি I তখন হয়তো এই সমস্ত বাড়ির পূর্বপুরুষেরা জল নিতে এই ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে জল আনতেন I 

রুক্মিণীকুমার : যথার্থ বলেছেন । আমি মহাকাশে নৌকো পারাপার করতুম । মঙ্গল থেকে শনি থেকে বৃহস্পতি । আমি যে মহানটবর তা নিজেই জানতুম না ।

হরিহর : ভেবে ফেলেছিলাম এক বড়সড় ঐতিহাসিক ভাবনা । এবার আকার আয়তন, অফ টপিক দেখে প্রকাশক না পাওয়া…ভেবেছিলাম হয়ত উপন্যাসটি আর বই হবে না। তারপর লকডাউন। প্রলম্বিত অপেক্ষা, উদবেগ কাটিয়ে অবশেষে আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। সম্পাদনার কাজ চলছে আপাতত। আমিও অবাধ্য, জেদি, নিজের জায়গায় অনড়, সম্পাদকও তেমনই। এইসবের মধ্য দিয়েই ভাবনাটা প্রকাশিত হবে খুব তাড়াতাড়িই মনে হচ্ছে। একটা ভাবনা আর তাকে পুস্তকাকারে পেতে এত বেগ পেতে হয়েছে, এত দীর্ঘ সময় হতাশায় কাটাতে হয়েছে..সেইসব আমার কাছেই থাক। আলো আসুক। একজন ভাবুকের দীর্ঘ পরিশ্রম আর অপেক্ষা দীর্ঘায়িত না হোক, এই কামনা কর নষ্টনট কলোনির নিবাসীরা । আলোকিত হোক বিশ্বভুবন। আশায় বাঁচুক ভাবুকরা । 

রুক্মিণীকুমার : গেল বুধবার কালই তো, রেলগাড়ির কামরায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে হঠাৎ দেখা! বললেন এসো  যদি আপত্তি না থাকে তোমার সঙ্গে একটা সেলফি তুলব, পয়সা দোব বিশ্ব-বা-রথীর অ্যাকাউন্ট থেকে, জানি তুমি অভাবী লোক। তুমি ভায়া এখন আমার চেয়েও বেশি নটরায়টি হাসিল করেছ এত চাপ সামলাও কী করে, আমি তো সমালোচনা পড়া ছেড়েই দিয়েছিলুম। বললাম, আমার সঙ্গে ছবি তুলবেন, আমি কিন্তু আপনার লেখা পড়ি না! রবিবাবু বললেন, দুর! আমি কি তোমাদের মতো ইনটেলকচুয়ালদের জন্য লিখি আমার লেখা অমিয়ভূষণ শঙ্খ সুনীল গাঙ্গুলি পড়বে তোমরা ফুকো পড়বে দেরিদা পড়বে। আমি ওসব কঠিন বই পড়িটড়ি না, আমি মনের খেয়ালে লিখেছি , ওসব হাবিজাবি লোক মুখস্থ করে আওড়ায় আবৃত্তি করে, খেউড় বোঝ! — কিন্তু গুরুদেব ছবি তোলার মুশকিল আছে লোকে ভাববে আমি সুপারইমপোজ করেছি, সত্যিই আপনার সঙ্গে মোলাকাত হয়নি। তখন হো হো করে এমন হাসলেন যে ডেনচার ছিটকে বেরিয়ে এল আমি ঠিক ডাইভ দিয়ে সোলকারের মতো ধরে ফেলেছি গালিতে, ক্যাচ। আপনাদের কারোর দাঁতের পাটি না থাকলে বলবেন; লাগিয়ে দেবো ।

মহীন : মানুষ এক আলোকভুখা পোকা, বিষাদের ঘন উদযাপনে, আমি আজ একটি প্রদীপও জ্বালাই নি, যেমন প্রেমের কাছে আধেক যাওয়া যায় না, তেমনি আলোর কাছেও আধেক যাওয়া যায় না, আমি আজ দীপান্বিতা ভারতকে দূর থেকে দেখি, প্রাণভরে দেখি, ভুলে যেও না মানুষ একটি আলোকভুক পোকা, চড়চড় শব্দে তারাবাজি জ্বলে ওঠে, ছাদে ছুটে যাই, যাদের মুখ নীচে উদ্ভাসিত

যাদের মুখ নীচে উৎসবের দিনে উপচারের অভাবে ম্লান, তাদের বিষাদ আনন্দ সঙ্ঘটনের চাইতে অনেক দূরে, আকাশের দিগন্তে দিগন্তে শব্দহীন আলোয় জ্বলতে থাকা বহুতল বাড়ি, আর নিঃশব্দ সুদূরের গোত্রহীন তারাবাজি, তাদের অপরূপে আমায় মনে করিয়ে দেয়, ব্রহ্মাণ্ডের অন্তহীনতায় আমার যে আত্মচেতনা, স্থায়িত্বের জন্য আমার যে কাঙালপনা, তা ভ্রান্ত, আমি এই ছাদে উঠে প্রত্যেকবার শুধু কষ্ট পেয়েছি, সামনের ঘন সবুজ কবে দালানকোঠার হাতে মারা পড়বে, সন্ধেয় প্রতিবেশী বাড়িগুলোর ফাঁক দিকে হ্রদের বুকে সূর্যের প্রাত্যহিক আত্মহত্যা, কবে তা আর দেখতে পাবো না, এই প্রতি মূহুর্তের হারানোর ভয়, আঁকড়ানোর যাতনা, যুধিষ্ঠির যেমন বলেছেন, পৃথিবীর পরম আশ্চর্য, মৃত্যুর প্রতি নশ্বরের শাশ্বত অবিশ্বাস, শহরের দিগন্তবৃত্তে হঠাৎ জ্বলে ওঠা তারাবাজি

সবুজ, সোনালী, ঘন লাল, অদ্ভুত ফোয়ারার মতো উত্তল, অবনত, ওহে পরিবেশ প্রেমী, সমস্ত বছর গাছ লাগিও বরং, আজ বাদ সেধো না, ভুলে যেও না মানুষ এক আলোকভুক পোকা, যুগ যুগান্ত ধরে সে মণি মাণিক্যে আলো পরিধান করেছে, আলোর উপাসক, আলো থেকে জন্মে, আলো চেয়ে, একদিন প্রবল প্রতিবাদে অন্ধকারে মিশে যাবে, ক্ষনিক তারাবাজি, আমার একটি পয়সা খরচ না করে চুরি করে দেখা শহর ময় আলো, আমার সুন্দর তারাবাজি, আমি আলোর কাছে আর প্রেমের কাছে ফিরে যাবো, ক্ষণিক হলেও সম্পূর্ণে যাবো, পূর্ণতায় যাবো, 

অপু : বিরক্তকর লোকটি খোয়াবের মধ্যে খুবই জ্বালাচ্ছে,ঘুমাতে দেয়না; বলছেঃ ধানের সাথে, ভাতের, ক্ষুধার এবং কৃষিঋণের সম্পর্ক;লাঙ্গলের সাথে মাটির আর কৃষ্ণ কৃষকের এবং মশালের সাথে আগুনের খেলা! স্বপ্নের মধ্যে সে সন্ত্রাসী, তার গায়ে অবসরপ্রাপ্ত আর্মি-আর্মি গন্ধ, ওস্কে দিতে দিতে উর্দূতে বলছেঃ -“তোমার জন্ম তো পূর্ব পাকিস্তান, পাক সার জমিন সাদ বাদ, গেয়ে গেয়ে…তুমি বেড়ে উঠেছো, বড় হয়েছো। খাজনা দাও”। -“কেনো এতো ‘নাও নাও’ করো! কি কারণে এতো নদীমার্তৃক? “কাঠ আর লোহার পেরেকে সেলাই করা নৌকার, সাথে নৌকাডুবির সম্পর্ক”!, ঘুমের মধ্যে ঘিন্না, ঘুমের মধ্য জিন্না, এবং ঘুমের মধ্যেই তাকে কীভাবে যেনো খুন করলাম।, জেগে দেখি, আমার হাতে শয়তানের শাদা রক্ত!, .

মাল্যবান : কোনোদিন ফুরুবে না শীত,রাত আমাদের ঘুম? ফুরুবে না।ফুরুবে না। কোনোদিন ফুরুবে না শীত, রাত,আমাদের ঘুম? না,না,ফুরুবে না। কোনোদিন ফুরুবে না শীত,রাত,আমাদের ঘুম? ফুরুবে না।ফুরুবে না।কোনোদিন…

সন্দীপ : আরে মশাই মাল্যবান, আপনি তো ডায়রিতে সাংকেতিক ভাষায় লিখেছিলেন যে আপনার বউটা মরে গেলেই ভালো । তাহলে খোলা মনে লিখতে পারবেন । আপনাকে নষ্টনটদের কলোনিতে না পাঠিয়ে বদনটদের কলোনিতে পাঠানো উচিত ছিল ।

মুরারী শীল : মাঝে মাঝে হৃদয় যুদ্ধের জন্য হাহাকার করে ওঠে, মনে হয় রক্তই সমাধান, বারুদই অন্তিম তৃপ্তি; আমি তখন স্বপ্নের ভেতর জেহাদ, জেহাদ বলে জেগে উঠি। জেগেই দেখি কৈশোর আমাকে ঘিরে ধরেছে। যেন বালিশে মাথা রাখতে চায় না এ বালক, যেন ফুৎকারে উড়িয়ে দেবে মশারি, মাতৃস্তনের পাশে দু’চোখ কচলে উঠে দাঁড়াবে এখুনি; বাইরে তার ঘোড়া অস্থির, বাতাসে কেশর কাঁপছে। আর সময়ের গতির ওপর লাফিয়ে উঠেছে সে। না, এখনও সে শিশু। মা তাকে ছেলে ভোলানো ছড়া শোনায়। বলে, বালিশে মাথা রাখো তো বেটা। শোনো, বখতিয়ারের ঘোড়া আসছে।

আসছে আমাদের সতেরো সোয়ারি, হাতে নাংগা তলোয়ার। মায়ের ছড়াগানে কৌতূহলী কানপাতে বালিশে, নিজের দিলের শব্দ বালিশের সিনার ভিতর।, সে ভাবে সে শুনতে পাচ্ছে ঘোড়দৌড়। বলে, কে মা বখতিয়ার?, আমি বখতিয়ারের ঘোড়া দেখবো।, মা পাখা ঘোরাতে ঘোরাতে হাসেন, আল্লার সেপাই তিনি, দুঃখীদের রাজা।, যেখানে আজান দিতে ভয় পান মোমেনেরা, আর মানুষ করে , মানুষের পূজা, সেখানেই আসেন তিনি। খিলজীদের শাদা ঘোড়ার সোয়ারি। দ্যাখো দ্যাখো জালিম পালায় খিড়কি দিয়ে, দ্যাখো, দ্যাখো।, মায়ের কেচ্ছায় ঘুমিয়ে পড়ে বালক, তুলোর ভেতর অশ্বখুরের শব্দে স্বপ্ন তার, নিশেন ওড়ায়।, কোথায় সে বালক?, আজ আবার হৃদয়ে কেবল যুদ্ধের দামামা

মনে হয় রক্তেই ফয়সালা।, বারুদই বিচারক। আর, স্বপ্নের ভেতর জেহাদ জেহাদ বলে জেগে ওঠা।

দেবদাস : যত্তো সব মাতাল । অন্তর্ঘাত আর পোঁদে আঘাতের তফাত জানে না ।

দশ

নিখিলেশ : ভাতের ফেনা ফুটতে থাকে টগবগ, জুঁই ফুলের মতন ঘুরতে থাকে ভেতরে, কেমন এক মাতাল করা সুবাস ভেসে বেড়ায়। আমার তোমাকে মনে পড়ে। ভেতরে অমন তীব্র বলক ওঠা মন নিয়ে আমি ভাতের মাড় ঝরাই, হাত বেয়ে লাভার মতন মাড় পড়তে থাকে। আমি ধরেই থাকি, আমার তোমাকে মনে পড়ে। এমন সওয়ার হলে, ডাকিনী যোগিনী পালিয়ে যায় দূরে। ভাঁপে পোড়া হাত নিয়ে ভাবি সালুন থাক আজকে, খানিক আগুন ঝাল ভর্তা বানানো যাক, ঝালের আড়াল হয়েও খানিক যদি ঝরে যাও তুমি। লইল্লা ইচা খোলাতে হালকা থেকে গাঢ় লাল হয়। আমার তোমাকে আরো বেশি মনে পড়ে। নিজেকে সীমার বাইরে বধীর করে নেবার পর, বুকের ভেতর আস্ত কামারশালার হাপর জ্বলে যায় মুখাভিনয় বন্ধ থাকেনা, চোখের পিউপিল বদলে যায় ধীরে। এই মনে না করার প্র‍্যাকটিসে পারদর্শী হবার পর অন্তত এ ভারী অন্যায়! নিবিষ্ট মনে পেঁয়াজ টেলে নিয়ে গরম তেলে শুকনো মরিচের সাথে মন টাও ভাজতে থাকি বেশ উল্টেপাল্টে। সেখান থেকে তীব্র ঝাঝালো তোমার গন্ধ ভেসে আসে। পোড়া মন আর ঝালের রঙ ততোধিক কালচে লাল হয়, থেঁতো পেঁয়াজের সাথে তাকে মাখাচ্ছি বেশ, লাল কমছে না তো!

রুক্মিণীকুমার : এখন প্রুস্ত ভাবছি । বারগোতের মৃত্যু। ভারমিয়েরের একটা হলুদ দেওয়ালের প্যাচ। প্রাক বার্থিয়ান অলৌকিক পাংকটাম। এ নিয়ে প্রুস্ত যা করল, এ যে কী অবস্কিওরানটিস্ট পরম্পরা, ফ্লোবেয়ারে শুরু, তারপর প্রুস্ত তারপর নাতালি সারোত রিখিয়ার লেখক। সুহাসিনীর পোমেটম এ একটা জীর্ণ দেওয়ালের এমন বিবরণ আছে যে, ওটাই ক্রুসিফিকস এরোটো ধর্ষকাম, বেশ্যার মতো হলহলা ফুটো। ঢোলকা পেরেকের গর্ত। বালি খসছে। বরিশালের কবি যেমন জল খসাত। যেন সাই টমলের ক্যানভাস, নাথিংনেসের গ্রাফিজম। বারগোৎ এগজিবিশানে অই হলুদ প্যাচওয়ার্ক দেখে ভাবল আমার এরকমই ভাবা উচিত। আমার শেষ বইগুলো বড্ড বিশুষ্ক, রস চাই! ভাবতে ভাবতে সে অক্কা পেল। সটান পটল ড্যাঙায়, পাড়ি। এ তো ফ্লোবেয়ারের অ্যামবিসান! যা সারোত প্ল্যানেটরিয়াম এ আনজাম দেওয়ার চেষ্টা করেছে: কে কোথা থেকে কী নিয়েছে সব জানি। আমি প্রুস্তের মতোই একজন শার্লক হোমস। সাহিত্য পুরোটাই — যত সিরিয়াসই হোক — ডসটয়েভস্কি জয়েস লরেন্স স্টার্ন, নিছক ডিটেকটিভ গল্প, আমরা সবাই জাসুস, এতে লজ্জার কিছু নেই, খোঁজ নিয়ে চলেছি সন্ন্যাসিনীর গোপন খবর; ইনকিওরিবল ফ্রয়েডিয়ান, স্বপ্নে পর্যন্ত হানা দিই…ইউলিসিস ডিসাইফার করতে হবে না, শুধু রিদমটা ধরো। স্বগত ছন্দ, স্বর ও নিশ্বাসের বিন্যাস; মন্থর শব্দ উদগিরণ; যা দেখছে তাই বলছে: ভিতর বাহির জাকসটাপজিসন। স্মৃতি আর চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা। অবলোকন ও স্পেকুলেসন। আর একটার পর রাস্তা পার হয়ে যাওয়া, অন্তহীন পথনামচা। কলকাতা রোডম্যাপ খুলে ভাবা যায় এ ভাবনা । খুব সোজা। অলিগলির নাম ইতস্তত ঢুকিয়ে দিলেই পাঠক হ্যালু খেয়ে যাবে। গল্প একটা ডিসকনটিনিউয়াস প্রসেস, তুমি আরবিট্রারি শব্দ টপকাও আমি মানে করে নেব । না নিয়ে উপায় নেই আমার। ভাবুকই অরগ্যানিক হোল। ভাবুক নৈরাজ্য, কেঅসমস। যা খুশি ভাবুক ভেবে খালাস। বিপন্ন কৌশিক সরকার ওসব সাজাতে বাধ্য হয়। ও ব্যাটা বিশৃঙ্খলতার মধ্যে বাস করতে পারে না…

দেবদাস : যত্তো সব মাতাল । কবে দেশ স্বাধীন হয়েছিল ? ২০১৪ সালে না ১৯৪৭ সালে ?

হুতোম : আজকাল বাঙ্গালী ভাষা কৌশিক সরকারের মত মূৰ্ত্তিমান কবিদলের অনেকেরই উপজীব্য হয়েছে। বেওয়ারিশ লুচীর ময়দা বা তইরি কাদা পেলে যেমন নিষ্কৰ্ম্মা ছেলেমাত্রেই একটা না একটা পুতুল তইরি করে খ্যালা করে, তেমনি বেওয়ারিস বাঙ্গালী ভাষাতে অনেকে যা মনে যায় কচ্চেন; যদি এর কেউ ওয়ারিসান থাকৃত, তা হলে স্কুলবয় ও অসিদের মত গাধাদের দ্বারা নাস্তানাবুদ হতে পেতে না-তা হলে হয়ত এত দিন কত গ্রন্থকার ফাঁসী যেতেন, কেউ বা কয়েদ থাকতেন, সুতরাং এই নজিরেই আমাদের বাঙ্গালী ভাষা দখল করা হয়। কিন্তু এমন নতুন জিনিস নাই যে, আমরা তাতেই লাগি—সকলেই সকল রকম নিয়ে জুড়ে বসেছেন বেশীর ভাগ অ্যাকচেটে, কাজে কাজেই এই নক্সাই অবলম্বন হয়ে পড়লো। কথায় বলে, এক জন বড়মানুষ, তারে প্রত্যহ নতুন নতুন মঙ্করামে দ্যাখাবার জন্য, এক জন ভড় চাকর রেখেছিলেন; সে প্রত্যহ নতুন নতুন ভাঁড়ামো করে বড়মানুষ মহাশয়ের মনোরঞ্জন কত্তো, কিছু দিন যায়, অ্যাকদিন আর সে নতুন ভাঁড়ামো খুঁজে পায় না; শেষে ঠাউরে ঠাউরে এক ঝাঁকা-মুটে ভাড়া করে বড়মানুষ বাবুর কাছে উপস্থিত। বড়মানুষ বাবু তার ভাঁড়কে ঝাঁকা-মুটের ওপর বসে আসতে দ্যাখে কুলন,—“ভাড়, এ কি হে?” ভাঁড় বলে, “ধৰ্মাবতার। আজকের এই এক নতুন !”

ঠকচাচা : কাল রাতে কোন কবিতা ভাবছিলাম! এই দেখো, না লিখে খুব ভুল হয়ে গেল! তোমার নাম শুনলে কোন গন্ধ আমার মনে পড়ে! তোমাকে সবুজ ভেবে ব্যক্তিগত করে রাখি, আমি ছাড়া অন্য কোথাও তোমার আনন্দ হলে আমার দুঃখ লাগে, আমি কি কালার ব্লাইণ্ড! তা না হলে কেন খালি সবুজের কথা বলি! সমস্ত ধূসর কেন সবুজের ভিতর দিয়ে দেখি! কাকের কথার দিকে গেলে কলস আর পাথরের কথা ভাবি, আমি ত অর্থ জানি না, একটা শব্দ লিখে তারপর অভিধান দেখি, কী আশ্চর্য! অজ্ঞাত শব্দ তবু দরদের সম্ভাবনার দিকে কদম ফেলে রাখে, আমি ত লিরিক্যাল নই, তবু কেন লিরিক্যাল বাতাস চারদিকে, কখনো ডালডার কথা মনে হয়, কখনো তালমাখনার কথা

আর থেকে থেকে ইতিহাসের নানা গুড়াগাড়া খাবারের উপাদানের কথা মনে পড়ে, স্বামীর সন্দেহের মতো তোমাকে আলগোছে দেখি, সদকার প্রশান্তিমতো তোমার সাথে কথা বলা, আমার কালো অস্মিতার ভিতর হলুদ ওড়না উড়ে যায়, আমি কালো ও হলুদকে ভালোবেসেছি, হলুদ খাতার ভিতর নিজস্ব ফার্ম গড়ে তুলেছি, প্লাস্টিক চেয়ার কালো হাতলের ইমেজ সেখানে গড়ে ফেলে, এক নির্জন চেয়ার কোথাও আমার জন্য কাদে, রাগ করে কোনোদিন ভাত না খেয়ে থেকে যেতে ভয় লাগে,

যেদিন থেকেছি সেদিন খুব করে কেউ ডাকেনি, এ এমন দিন, দেজা ভ্যুর ভিতরে হেজে গিয়ে, যেন উঠে বসি আশ্চর্য বিদাশে, যেন একটা দিন যাবে চুপিসারে আর কিছু নয়, কোথাও কোনো প্রাণ একটুও বড় হবে না ।

মাল্যবান : ওপরের ঘরের বাথরুমে  স্নান করতে দেয় না আমার বউ ।  স্নান করতে হবে বাড়ির অন্য মহিলাদের নজরের সামনে নীচের চৌবাচ্চায়। এক-গা লোম নিয়ে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে বৌ-ঝিদের আনাগোনা চোখ-মারা মুখ-টেপার ভেতর স্নান করতে ঠিক জুত লাগছে না আমার । যেন শিবলিঙ্গের কাক-স্নান হচ্ছে । উত্তরে বউ বলে, তা হলে তুমি কি বলতে চাও দরজা জানলা বন্ধ ক’রে এক-হাত ঘোমটা টেনে তুমি ওপরের বাথরুমে গিয়ে ঢুকবে, আর মেয়েমানুষ হয়ে আমি নিচের চৌব্বাচায় যাব–ওপরের বারান্দায় ভিড় জমিয়ে দিয়ে ওদের মিনসেগুলোকে কামিখ্যে দেখিয়ে দিতে?

বিপিন : আপনাদের রাধেশ্যাম গড়াইয়ের গল্প বলি…কয়লাখনি অঞ্চল রানিগঞ্জ থেকে জাতীয় সড়ক ধরে সিউড়ির দিকে কিমি দশেক গেলে চিচুরিয়া মোড়…সেখান থেকে আরও কিমি পাঁচেক গেলে আলিনগর গ্রাম। ১৯৮৯ সাল থেকে এই গ্রাম ও লাগোয়া এলাকায় গাছ পুঁতে এসেছেন রাধেশ্যাম.. .৩২ বছরে কতগুলি গাছ বসিয়েছেন তিনি? পাঁচ লক্ষ (ঠিকই পড়লেন, সংখ্যাটা পাঁচ লক্ষ) …. এলাকাটি পুরোদস্তুর বনভূমির চেহারা নিয়েছে এখন…আপনি গুগল ম্যাপ দেখুন, জঙ্গলটা ভালো করে বুঝতে পারবেন…একটা মানুষ সম্পূর্ণ একার হাতে এই জঙ্গল তৈরি করেছেন কোনও সরকারি, বেসরকারি দাক্ষিণ্য ছাড়া…পরে অবশ্য তাঁর ছেলে তাঁকে সাহায্য করতেন…কেন এই জঙ্গল বানালেন রাধেশ্যাম? খনি এলাকার রুক্ষ পাথুরে জমি গ্রীষ্মে তেতে ওঠে…হাঁটাচলাই দায়…চড়া রোদে তালু ফেটে যায় যেন…রাধেশ্যাম ভাবলেন, এই সব পতিত জমিতে যদি গাছ বসানো যায় তবে মানুষ একটু ছায়া পাবে, অত কষ্ট হবে না…সেই শুরু…প্রতিদিন সকালে লুঙ্গি পরে একচিলতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তেন রাধেশ্যাম…বউ গামছায় মুড়ি আর শসা কিংবা গুড় বেঁধে দিতেন…সারাদিন গাছ বসিয়ে অক্লান্ত রাধেশ্যাম সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে পরদিনের পরিকল্পনা করতেন…জঙ্গলের ভিতরে একটি জলাশয় তৈরি করে, তাতে কটা মাছও ছাড়লেন…এভাবেই একদিন তাঁর স্বপ্নের অরণ্য তৈরি হয়ে গেল…এই যে জঙ্গলের ছবিটা দেখছেন, এটা ওঁর হাতে তৈরি…ভাবতে পারছেন, একটা মানুষ একার হাতে এই পতিত জমিতে অরণ্যের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন !! পুরস্কার, সম্মান এসব কিছু পেয়েছেন?

হ্যাঁ… একবার বন দপ্তরের কিছু কর্তা বনভূমি দেখে খুব প্রশংসা করে উপহার তুলে দিয়েছিলেন রাধেশ্যামের হাতে…কী উপহার? একটি লুঙ্গি আর একটি গামছা…বলা যেতে পারে শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার…

বাঞ্ছারাম : একদিন স্মৃতির ভিতর বিকট শব্দ তুলে একটি ট্রেন ঢুকে এল, কালো ধোঁয়া, অমনোযোগী বিকেল আর সাদাকালো ভিক্ষাপাত্র সমেত, এই রেল ঝমঝম করছে ব্রিজের উপর। নীচে অনন্ত খাদ, তোমার জানুর মতো উপত্যকাগুলি কেঁপে উঠল একবার, হে প্রলয়, দেখো বিস্ময় কেমন স্থির হয়ে আছে গাছের বয়সের কাছে, এই যে ভ্রমণে লেগে গেল অকারণ রমণ তাকে নিয়ে তুমি হো হো হেসে ওঠো, ওই জলোচ্ছ্বাসের মতো ঠোঁট এবার ডুবিয়ে মারবে ভ্রমণে ভ্রমণে, এই সামান্য করতল আমার, তাতে লেগে গেছে যে বিষণ্ণ ছায়া তাকে তুমি তাচ্ছিল্য করেছ। হে প্রলয়, হে ব্যাভিচার, তুমি অসহায় মানুষের গায়ে চালিয়ে দিয়েছ দুরন্ত রেল, গবগব করে ধোঁয়া উঠছে, ঢেকে যাচ্ছে আকাশের গা, ভিতরে নিভে এল গান, রাত্রি ছুঁয়েছিল রেলের চাকায় ছিটিয়ে যাওয়া শব্দের পরাগ, এইমাত্র স্মৃতিখানি ভেঙে গিয়ে ছায়ারিক্ত হয়ে এল ভ্রমণ, সামান্য ঠোঁট আর চোখের পলক পথে পথে ফেলে গেছে রক্তাভ রমণ….

অমিত রায় : বাপের বিষয় পেতে আর ধুমধামের পরিসীমা ছিল না। যখন যা মনে আসে তাই করেন। কখন হোটেলের খানা আনিয়ে আমোদ আহ্লাদ কচ্চেন, কখন তেলেভাজা ফুলরি বেগ্‌নির সহ রকমারি নিয়ে ইয়ারকি দিচ্চেন। আজ স্যাম্‌পেন ঢালোয়া — কাল ব্রাণ্ডির মোচ্ছব — পরশু পাঁচ রকম মদ দিয়ে পঞ্চ্‌ কচ্চেন। বাঁদি নেসা না হলে কখন বা মদের সঙ্গে, লডেনম্‌, ও মরফিয়া মিশাচ্চেন। পাঁচ ইয়ারির দল হলেই পাঁচ রকম লোক এসে যোটে। কোথাও ভটচাজ্জির টিকি কেটে সন্দেশের সঙ্গে ফ্যান্সি বিষকুট দিয়ে খাওয়াচ্চেন। কোথায় কাহাকে ডাবের জলে এমিটিক দিয়ে খাওয়াচ্চেন। কোথায় কেহ নেশায় অচেতন হয়ে পোড়ে আছে। কোথায় কেহ হাত পা আছড়াচ্চে, কোথাও কেহ গড়াগড়ি দিচ্চে, কোথাও কেহ বমি কোচ্চে, কোথাও কেহ দুটো হাত তুলে ইংরাজী লেকচার দিচ্চে, কোথাও কেহ বাঙ্গালায় বক্তৃতা কোচ্চে।”

দেবদাস : যত্তো সব মাতাল । হুইস্কির বোতলে কটা পেগ আর চুল্লুতে কটা ভাঁড় তার তফাত জানে না ।

এগারো

মেঘের ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে জাম্বোজেট উড়োজাহাজের সবকয়টা পায়খানা একসঙ্গে খুলে দেবার ফলে নষ্টনটদের মাথার ওপর ঝরে পড়তে লাগলো গুমুত বৃষ্টির ফুল । তারা তো আহ্লাদে কুচুরমুচুর। রুক্মিণীকুমারকে নিয়ে নাচা আরম্ভ করে দিলে ; উদ্ধারকারী নটবর এসে ওদের পাগলামি সারিয়ে দিয়েছে, তাই, আকাশ থেকে গুমুতপুষ্প বৃষ্টি সৃষ্টি করতে পেরেছে, কলোনিবাসীদের মাথায় হাওয়া ভরে দিতে পেরেছে ।  তারা নাচতে নাচতে গাইতে থাকে…”মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ। তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে সদা বাজে, তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ॥ হাসিকান্না হীরাপান্না দোলে ভালে, কাঁপে ছন্দে ভালোমন্দ তালে তালে, নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু পাছে পাছে, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ। কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ, দিবারাত্রি নাচে মুক্তি নাচে বন্ধ–সে তরঙ্গে ছুটি রঙ্গে পাছে পাছে, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ॥ সে কী অপরূপ দৃশ্য ! কয়েক হাজার উলঙ্গ মানুষ দুহাত ওপরে তুলে নাচছে । 

সন্দীপ : ক্ষুদ্র কীট যেমন পুপসহবাসে দেবশিরে আরোহণ করে, আমরা বাস্তবতাকে মুছে ফেলতে পারি, যদিও এতে ভয়ের কিছু নেই, যেহেতু ঐ বস্তু তার অনপনেয় দাগ রেখে যায়।

নিখিলেশ : দিন কতক ভাবিনি।  রাজ্যের ডিফিকাল্ট ভাবনা। এমনকি ভিটগেনস্টাইন। তবে মুখ্যত ফুকো। কৌশিক সরকারকে বললাম, ফুকোকে রিয়্যাপ্রপ্রিয়েট করতে যে আরো কত বছর লাগবে ভাবলে ভিরমি খেতে হয়। অথচ ওর প্রতিভা ডিসকোর্স আকস্মিক নয়। প্রাকৃতিক ইতিহাস যখন জীববিজ্ঞান হল সেই ট্রানজিশনাল জাঙ্কচারটা ও খুলে দেখালো, এ কবিতার চেয়ে হাজার গুণ কঠিন প্রভোকেটিভ ফ্যাসিসিনেটিং উদঘাটন; বোকারা কবিতা পড়ে, কবিতা লেখে: ফুকো পড়ো যদি কবিতার প্রকসিমিটিতে বসত করতে চাও, কবিতা কবিতায় নেই, কবিতা উত্তর দার্শনিক ডিসকোর্সে আছে। সন্ধ্যেবেলা কল করল কুন্তল। এরম সময় করে না। আমি ভাবলাম, উন্মেষ। যে, আসব? অর্থাৎ পাঁইট নিয়ে। গতদিন বাদামমাখাটা আনেনি। যে বাদাম আনল সেটা আপ টু দা মার্ক নয়। ফার ফ্রম ইট। সড়া হুয়া। সাপোজ পচা বাদাম একটা আগার মুখে পড়ল — পড়েওছিল — থুকিয়ে, সে গ্লানি, অবমাননা হিউমিলিয়েসন আমি এমনকি বলব কনসপিরেসি থেকে শত কুলকুচো চতুর্দিকে করেও নিস্তার নেই। উন্মেষ হলে কী বলব ভাবলাম। ফোন রিসিভ করার আগে এমনকি কার কল দেখার আগেও উপন্যাসোপম বিদ্যুৎ-লেখা অকল্পনীয় ডিফেন্স মেকানিজম টেক্সটুয়ালি তৈরি প্রুফ কারেকসান সমেত ঝটিতি প্রিন্ট আউট হয়ে যায়, সার্কুলেট করে, সর্বত্র। অথচ গরজ ওর একার নয়। মেয়েকে লুকিয়ে কিচেনে ছাপ্পারে খাওয়ার গিল্ট এড়াতে এখানে আসে। কী বলব: হ্যাঁ-হ্যাঁ চলে আয়! নাকি আজকের দিনটা স্কিপ করে যাই চল, কাল শনিচার, কাল আায়! সাত্যকি হলে বলত, আজকের দিনটা কাটিয়ে দিন। অনেকদিন আবার সাত্যকির কোনো সাড়াশব্দ নেই। আমি কল করি না। ও খুব মুডি ছেলে। পরম বন্ধু। বয়সে অনেক ছোট। পরম বন্ধু কিন্তু কথার কথা নয়। ফ্র্যাকসানস অব সেকেন্ড। তার মধ্যে কত সংঘর্ষ, চিন্তা সিদ্ধান্ত। লেখা শুধু স্পনটেনিয়াস নয় অসম্ভব ক্রিটিকাল। একটা শব্দও আরবিট্রারি নয়। রাইটিং পিকুলিয়ার রেসপনসিবিলিটি। সাত্যকির সঙ্গে অদ্ভুত সম্পর্ক। ইউনিক। এরকম পৃথিবীর কারুর সাথে কারুর নেই। ও আমার পাঠক। দেবতাজ্ঞান করে। খুবই এমব্যারাসিং ব্যাপার। ছিল সন্দীপনের ভক্ত, আমি হ্যাক করে নিয়েছি। ও আমার ইঁউহি তুড়িতে, চুটকিসে। এসব ফেরেব্বাজি আমার খুব ভালো আসে। পাঠক ফুসলানো। তা বলে ভেব না ও ধুর! বস্তুত সবচেয়ে সিরিয়াস, রোম্যান্টিক, একগুঁয়ে পাঠক। ওকে আমি কোনো দিন ফিলজফি পড়াতে পারব না। ও কেরুয়াকের ভক্ত। আমার সব কেরুয়াক ওর কাছে। ওর সব কুন্দেরা আমার কাছে। এরকম হয়। কুন্দেরা আমি মাস্টারবেট করার জন্যও পড়ি না। ট্রিসট ট্রপিক আমার জান। ওটাও ও রেখে গেছে, ক্লোদ লেভি-স্ট্রোস। রোজ একটা প্যারা পড়লেই হল। একেকটা সম্পর্ক কত গভীরে চলে যায়, পরস্পরের। পাঁচ বছর বাদে দেখা হয়। তেরো বছর বললে লোকে বিশ্বাস করবে না, উঞ্ছ সন্দীপন বলেছিল। প্রথম পৃষ্ঠায় কেউ এসব লেখে! বলে একাধিক বার ব’লে দেখেছি, কেউ বিশ্বাস করেনি। অর্থাৎ সূর্যোদয় দ্যাখেনি। খসড়া, ছাপার আগে, আমাকে পড়ালে, বকা দিতাম। ওটা কেটে দাও সন্দীপন। অত এগজিস্টেন্সিয়ালিস্ট অ্যাবসার্ডিস্ট হতে হবে না। মরুগ্গে যাক। সাত্যকির সঙ্গে যত কমই দেখা হোক না কেন রোজ আমরা পরস্পরকে ভাবি, আমার ধারণা। এটাই সম্পর্ক। খারাপ ভাবি না। অনেক রিলেসান আছে খারাপ না ভেবে উপায় নেই। ওসব কুচুটে লোক। বৌ আরো কুচুটে। কত সম্পর্ক শুরুটা ভালো ছিল। বিষিয়ে গেল। টেঁকেনি। অনিমেষ, কেটে পড়ল, না বলে, আমার লাইফ থেকে। সাদমা। আমার অহংকার, আমার বলে নয়, যে কারুর — যাকে বলে, সেলফ এসটিমেসান, হুবহু পিকাসোর মতো, অবিকল — এসব বলতে আমার মুখে আটকায় না, যে জিলোকে বলেছিল: আমাকে কেউ ছেড়ে যায় না! এই আস্ফালন টুকু না করলেই হয়ত জিলো থেকে যেত। অন্য ভাবে বলতে পারত, মত যা, গোরী! যে যাবার সে অবশ্য যাবেই। হাতেপায়ে ধরেও আটকানো যাবে না। সেলিনের অন্য উত্তর আছে, কুইকার দ্যান দা বস্। মালিক তোমায় স্যাক করার আগে তুমি রেজিগনেশন লেটার দাখিল করো। কুন্তল জিগেস করল, ফারনান্দো পেশোয়া কি সুইসাইড করেছিলেন? জানি না। তবে বায়োগ্রাফি নিয়ে বেশি কালক্ষেপ কোরো না। অভয়ের কথা পড়বে। ক্ষেত্রও খুব সম্ভব খুদখুশি করেছিলেন। ত্রিবেদী ইঙ্গিত দিলেও রাজ খুলাসা করেননি। এত বড় ঘটনা, মিসতিরি, মোহিতলাল কেন আলোচনা করলেন না আই ওয়ানডার। সেলিনও, ইন অল প্রব্যাবিলিটি। বলতেনও, নিজেকে আমি শেষ করে দেব। পারসিকিউসন মেনিয়া, আমরা ভাবতাম। আমার ধারণা সে লেথাল বড়ি গিলে ঘুমিয়ে পড়ল। কেননা নর্থ লিখছিল সেদিন লুসেতকে ডেকে বলল, লেখা শেষ, গালিমারকে এত্তেলা করো। সেদিন সন্ধ্যবেলায় সেলিন চোখ বুঁজলেন। ইনসমনিয়াক। এর আগে কোনো দিন ঘুমোননি। মাথায় বিস্ফোরণের শব্দ হত, বিরামহীন….

গোবিন্দমাণিক্য : সুনসান নীরবতা। অশোক-এর পাতা নীরবে কাঁপছিল। মৃদু-ভূ কম্পনের লক্ষণ।

বাতাসে ভর করেছিল ভয়। নারীরা সিঁদুর মুছে ফেলেছে। পায়ের নকশা অ্যারাবিক কৌশল হয়ে গেছে ততক্ষণে। পালিয়েছে হনুমানজি। শস্য আর সূর্যী দেবী ছেড়ে গেছে পূজারী। এমনটা আগে কখনও, চারিদিকে খাজুরাহো ভাঙা পাথর। খচ্চরের সেনাবাহিনী পিঠ ঠেসে দিয়েছে মাটিতে। হে বখতিয়ারের খচ্চর তুমি কি সু-সংবাদ এনেছো? নাকি দানব দাঁত কেলাচ্ছে নাঙ্গা খঞ্জর হাতে? নিরীহকে অধিগ্রহণ নেশায় মত্ত একদল নষ্টনট। যোনী নাকি পায়ু থেকে জন্মেছিলে ?  একটা অধ্যায় আবার, ভ্রুণ হয়ে ঢুকে গেছে জঠরে। আসো শান্তির ছায়া তলে। আসো, নিজে থেকেই হয়ে যাও। ওই যে সিন্দুক। সেখানে রাখবো তোমায়। তুমি গাধা হয়ে যাও। হে বখতিয়ারের গাধা তুমি আর কি এনেছো? এই বাংলা ভূখণ্ডে। সেদিন তুমি আর যা এনেছিলে তার নাম আরোপিত বিশ্বাস।  আরও একটা ভাইরাস।

রাজপুত্র : আপনার বক্তিমে শেষ করেন ।

রাজপুত্তুর রুক্মিনীকুমারকে নিয়ে গিয়ে প্লাস্টিকের সিংহাসনে বসিয়ে গোটানো কাগজ থেকে খেতাবগুলো পড়তে শুরু করল ।

রাজপুত্র : মহামান্য নটবর, আজ থেকে আপনার পরিচয় সান্দ্রোকোত্তোস-এ-আজম আন্দ্রাকোত্তাস, আল-সুলতান আল-আজম ওয়াল খাকান আল-মুকাররম আবুল মুজাফফর মুহি উদ-দিন বাহাদুর আলমগীর  বাদশা গাজী, সর্বদক্ষিণাপথরাজ, উদায়িভদ্দক, নুরুদ্দিন মহম্মদ জাহাঙ্গীর বাদশাহ গাজী, সালভাদোর ডোমিঙ্গো ফেলিপি জেসিন্তো দালি ই দোমেনেখ, ১ম মার্কুইস দ্য দালি দ্য পুবোল, পাবলো, দিয়েগো, হোসে, ফ্রান্সিসকো ডি পাওলা, হুয়ান নেপোমুসিনো, মারিয়া ডি লস রেমিডিওস, সিপিয়ানো ডে লা সান্তিসিমা ত্রিনিদাদ, রুইজ পিকাসো, মাসাচ্চিও, ব্রুনেলেস্কি, গিবারটি, পিয়েরো ডেলা ফ্রান্সেসকা, ডোনাটেল্লো, ও মাইকেলোতসো, ভিনসেন্ট ভ্যান গখ, পল সেজান, পল গোগাঁ, জর্জ সেরাট এবং অঁরি দ্য তুলুজলোত্রেক,  হেনরি মাতিস, জর্জ ব্রেক, আন্দ্রে ডারেন, রৌল ডিফী, জ্যান মেটজিংগার,মরিস ডি ভ্যালমিনক, আবুল মোজাফ্ফর সাহিব উদ্দীন মোহাম্মদ সাহিব-ই কিরান শাহজাহান বাদশা গাজি, কুতুব উদ্দিন মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম শাহ আলম, দ্য অর্ডার অফ লেনিন, আসফ জাহ  মীর আকবর আলী খান সিকান্দার জাহ, দ্য মোস্ট এক্সিলেন্ট অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার, নাইট ইন দি অর্ডার অব দি আর্টস অ্যান্ড লিটারেচার, সেজোং দা গ্রেইট, গ্র্যান্ড প্রিন্স  আইভান ভেসিলিভিখ দ্য টেরিবল….

সওদাগরপুত্র : থাক, থাক, অতো বড়ো গোটানো কাগজে মুড়ে ওনাকে এবার মহাশূন্যে পাঠানো হোক, ওই যে একটা ক্যাপসুল আসছে ওনাকে নিতে ।

নিখিলেশ : না না, আরেক কিস্তি গুমুতপুষ্প বৃষ্টি করতে আসছে ।

বারো

কাগজে মোড়া রুক্মিনীকুমার চিৎকার করতে থাকেন বাঁচাও,  বিশ্বরূপ দে সরকার বাঁচাও শিগগির এসো, বাঁচাও এই নষ্টনট কলোনির পাগলদের হাত থেকে । সব কটা ল্যাংটো পোঁদে আমার সঙ্গে যা-তা করতে চাইছে, বিশ্বরূপ দে সরকার, আকাশ থেকে নেমে এসো, অপ্সরাদের কোল থেকে নেমে এসো, ইন্দ্রের বাকল ছেড়ে বেরিয়ে এসো ।দেবদাস : যত্তো সব মাতাল ।

Posted in Uncategorized | Leave a comment

কলকাতা বিক্রি আছে – পোস্টমডার্ন নাটক : মলয় রায়চৌধুরী

নুরুদ্দিন মহম্মদ জাহাঙ্গীর বাদশাহ গাজী : আমি সিংহাসন দখল নিয়ে ব্যস্ত ছিলুম বলে ইংরেজগুলো সুবে বাংলায় ঢুকে পড়তে পেরেছিল।৩৬ বছর বয়েসে  বাবা মারা যাবার ৮ দিন পর ৩০ নভেম্বর, ১৬০৫  থেকে আমার ২২ বছরের রাজত্বের শুরু। মনে রাখিস লক্ষ্মীকান্ত, জায়গিরটা আমিই তোদের দিয়েছি, যদিও সুন্দরবনের লাগোয়া বলে তোরা নিতে চাইছিলিস না । তা আমি কী করব বল ! ভবানন্দ মজুমদার ছিল আমাদের খোচর । ওকে ভালো জমিজমা দিতে হলো । তোরা প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে আমাদের হেল্প করলে তিন ফসলি জমিজমা পেতিস । যারা ইতিহাস লিখবে তাদের বলে দিস যে কলকাতার জনক আসলে আমি, কেননা আমিই গ্রামগুলো তোদের দিয়েছি।

সুবাহার ইবরাহিম খান : দ্যাখ জোব চার্ণক, জমি আমি দিচ্ছি, তোরা আবার গোয়ার পর্তুগিজদের মতন দুর্গ খাড়া করিসনি যেন  । সুতানুটি, গোবিন্দপুর আর কলিকাতা গ্রাম তিনটে  মুঘল সম্রাটের খাসমহলের জমি, বাদশা জাহাঙ্গির সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের দিয়েছে জায়গিরটা । আমি তোকে ব্যবসা করার সুবিধে করে দিলুম । ইতিহাসে লিখতে ভুলিসনি যে কলকাতার জনক আমি ।

বিদ্যাধর রায়চৌধুরী : কিন্তু সুবাহদার, এই গ্রাম তিনটের জায়গিরদারি তো সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের । আমাদের যৎসামান্য আয় হয় গ্রামগুলো থেকে ; প্রজারাও আমাদের ভালোবাসে । ইংরেজরা দিল্লির বাদশাকে মাত্র ষোলো হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে কাজ হাসিল করে ফেললো । আমরাই তো এই গ্রামগুলোর জনক । 

ভিদকুন কুইসলিঙ : আমার আসল নাম সৈয়দ মীর জাফর আলী খান, ইরান থেকে এসে আলীবর্দী খানের সৈন্যদলে যোগ দিয়েছিলুম, বাংলা বিশেষ বলতে পারি না, ফারসিতে কাজ চালাই । তা যতোই প্রজারা ভালোবাসুক । তোমরা তো ক্লাইভকে তুষ্ট করতে পারোনি । সিরাজের যুদ্ধ আদ্যন্ত এক ‘বেওসা’, যার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাবে মুনশি নবকেষ্টর মতো লোক রাতারাতি মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুর হয়ে গেল। শোভাবাজার রাজবাড়ি এখন তাই বিয়ে, অন্নপ্রাশন, উপনয়নের জন্য ভাড়া দেয়া হয়। ওরা মনে করে ওরাই কলকাতার জনক । আমাকেই লোকে অযথা দোষ দ্যায় । এই নবকেষ্ট তো ক্লাইভের জন্যে মানত করে দূর্গাপুজোও করে ফেলল । নবকেষ্টর বংশধররা  জোব চার্ণককে কলকাতার জনক বলে উঠেপড়ে লেগেছিল ; হাইকোর্টে মামলায় হেরে গিয়ে এখন তারা ফিবছর সুতানুটি উৎসব চালায় ।

মির্জা মুহম্মদ সিরাজ-উদ-দৌলা :  শোভাবাজর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নবকৃষ্ণ দেব পলাশীর যুদ্ধের আগে  ছিল  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুন্সি, পরে হয়েছিল সুতানুটির তালুকদার। এর পরে ওয়ারেন হেস্টিংসের মুন্সি, তারপর ড্রেক সাহেব তেজাউদ্দীনকে কোম্পানির মুন্সির পদ থেকে সরিয়ে সেখানে বসালে নবকৃষ্ণকে।পলাশীর যুদ্ধের ফলে নবকৃষ্ণের কপাল খুলে গেল। মীরজাফর, রামচাঁদ রায়, আমীর বেগ আর নবকৃষ্ণ মিলে আমার লুকোনো কোষাগার লুঠ করে বহু কোটি টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ বাঁটোয়ারা করে নিলে। নবকৃষ্ণ কেবল টাকাই পেলো না ! বাড়তি পাওনা পেল সম্মান ও ক্ষমতা ।১৮৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশির রণাঙ্গনে মীরজাফরের বেইমানির দরুণ ইংরেজ সেনপতি ক্লাইভের হাতে আমার পরাজয় ঘটলে সবচেয়ে যারা উল্লসির হয়েছিল তাদের মধ্যে ছিল হিন্দু বিশ্বাসঘাতকরা, নদিয়ার কৃষ্ণচন্দ্র আর কলকাতার নবকৃষ্ণ। কোম্পানির জয়কে তারা হিন্দুর জয় বলে প্রচার চালালো। ধূর্ত ক্লাইভও তাদের তেমনই বোঝালো। ক্লাইভের পরামর্শেই তারা পলাশীর যুদ্ধের বিজয়-উৎসব করার আয়োজন করলো।বসন্তকালীন দুর্গাপুজোকে তাঁরা পিছিয়ে আনলো শরৎকালে ! ১৭৫৭ সালে বহু টাকা খরচ করে শরৎকালীন দুর্গাপুজো করে তারা পলাশীর যুদ্ধের স্মারক উৎসব পালন করলো ! অন্যা হিন্দু জমিদার আর ব্যবসাদাররাও মহা উৎসাহে সেই ফূর্তিতে যোগদান করলো ! হেরে গেলেও, আমিই মালিক । আমাকে কলকাতার জনক মনে করা উচিত ।

জুডাস ইসকারিয়ট : আমার আসল নাম রায় দুর্লভরাম । আমাকে কেন কলকাতার জনক মনে করা হবে না ? আমি তো বাংলার নবাবি শাসনামলের একজন কর্মকর্তা। আমি নবাব আলীবর্দী খানের অধীনে উড়িষ্যার প্রাদেশিক শাসনকর্তা পদে ছিলুম। বাংলায় মারাঠা আক্রমণকালে আমি বাংলার নবাবের পক্ষে মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিই। যদিও পলাশীর যুদ্ধের সময়  নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ইংরেজদের সহযোগিতা করেছিলুম আর যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত ছিলুম।  বিশ্বাসঘাতকদের জন্যেই তো ক্লাইভ জিতেছিল । আমি বিশ্বাসঘাতকতা না করলে কলকাতা দখল করে ক্লাইভের মুণ্ডু ধড় থেকে আলাদা করে দিতো সিরাজদ্দৌলা।আমাকে কলকাতার জনক মনে করা উচিত।১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে মীর কাশিম ইংরেজদের সাথে বক্সারের যুদ্ধে যাবার প্রাক্কালে ষড়যন্ত্রকারী আমার গলায় বালির বস্তা বেঁধে মুঙ্গেরের দূর্গশীর্ষ থেকে জীবন্ত দেহ নিক্ষেপ করে গঙ্গার বুকে। এভাবেই গঙ্গার বক্ষে সলিল সমাধি হয় আমার।

দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর : বড় লোকেদের যেন একটা ধারণা ছিল যে ভাল মন্দ বিচার না করিয়া খুব খরচ করিতে পারিলেই সমাজের মধ্যে প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পাইবে। মাতৃশ্রাদ্ধে নবকৃষ্ণ দেবের ন’লক্ষ টাকা খরচের পিছনে এই উদ্দেশ্য উঁকি দেয়। তাঁর মাতৃশ্রাদ্ধ উপলক্ষে যে সভা হয় এবং যেখানে সমবেত অভ্যাগত ও পণ্ডিতগণের আবাসস্থল এবং কাঙালিদের জন্য পণ্যবীথিকা সংস্থাপিত হয়, তা থেকে উক্ত অঞ্চলের নামকরণ হয় সভাবাজার বা শোভাবাজার (পূর্ব নাম রাসপল্লি)। ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ক্লাইভের চেষ্টায় তিনি ‘মহারাজা বাহাদুর’ উপাধি ও ৬-হাজারি মনসবদারের পদ পান। তাঁর অধীনে আরজবেগী দপ্তর, মালখানা, চব্বিশ পরগনার মাল আদালত, তহশিল দপ্তর প্রভৃতি ছিল। পরে তিনি কোম্পানির কমিটির রাজনৈতিক বেনিয়ান হন।তিনি ও তাঁর বংশজগণ প্রায় শতাধিক বছর ধরে ক্ষমতা ও প্রভাব বহাল রেখেছিলেন।১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে বিজয় লাভে শোভাবাজার রাজবাড়িতে রাজা নবকৃষ্ণ দেব লর্ড ক্লাইভের সম্মানে দুর্গাপূজার আয়োজন করে বিজয় উৎসব পালন করেন। সেই থেকে প্রতি বৎসর শোভাবাজার রাজবাড়িতে দুর্গাপূজার আয়োজন হয়ে থাকে। । সিরাজদ্দৌলার কোষাগার থেকে চুরি করা টাকায়  নবকৃষ্ণ দেব রাজবাড়িটি নির্মাণ করেন ।পলাশির পরে কলকাতার সামাজিক সাম্রাজ্যে তিনি হয়ে উঠলেন প্রায় মুকুটহীন সম্রাট। তাঁর সামাজিক গুরুত্ব তখন রাজনৈতিক নেতাদের থেকে বেশি। এই সামাজিক গুরুত্ব লাভে তাঁকে সাহায্য করেছিল তার সরকারি পদের গুরুত্ব এবং কলকাতার কোম্পানির কর্তাদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক। নিজের সামাজিক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে তিনি কলকাতায় ডেকে এনেছিলেন উঁচুদরের কুলীনদের। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের দান করেছিলেন জমি, বাড়ি ইত্যাদি। এই সবই দলপতি হওয়ার পূর্বপ্রস্তুতি। দলপতি হতে প্রয়োজন ছিল বিত্ত-বৈভব প্রদর্শন। তার মাধ্যম ছিল শ্রাদ্ধ, বিয়ে বা অন্য পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে অপরিমিত অর্থব্যয়। সে কালে ধনীদের দু’হাতে দানধ্যান করাকে বদান্যতা ভাবলে ভুল হবে। নবকৃষ্ণ কলকাতার দুষ্টক্ষত । আমরা জোড়াসাঁকো পরিবারই কলকাতার জনক; আমাদের ছাড়া কলকাতা অচল ।

আজিম-উশ-শান : ঘাবড়াসনি বিদ্যাধর । ব্রিটিশ বসতি  অন্য ভূস্বামীদের আরও আটত্রিশটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। এটা  ১৭১৭ সাল । ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে  তোদের গ্রামের জমিদারি সত্ব দিলেও, অন্য জমিদারদের কাছ থেকে ওরা বাকি গ্রামগুলো কিনতে  পারেনি। তোর টাকাকড়ি জমিয়ে রাখতে পারলি না ; সবাই একগাদা বিয়ে করে গুচ্ছের বাচ্চা পয়দা করলি । যাই হোক, সব গ্রামগুলো তো মুঘল বাদশার । তাই আমিই কলকাতার জনক, মনে রাখিস ।

বিদ্যাধর রায়চৌধুরী : আমরা  ব্রিটিশদের এই তিনটে গ্রাম ছেড়ে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলুম না ।  ব্রিটিশরা মুঘল রাজদরবারে ঘুষ দিয়ে এই গ্রাম তিনটের ইজারা কেনার অনুমতি আদায়ে সমর্থ হয়েছে। এটা ১৬৯৮ সাল । আপনারা ইংরেজদের হাতে গ্রাম তিনটে তুলে দিতে বাধ্য করলেন। ওরা বার্ষিক মাত্র ১,৩০০ টাকা রাজস্বের বিনিময়ে গ্রাম তিনটের ইজারা কিনে নিলে। চুক্তিপত্রটা ফার্সি ভাষায় লেখা ; ভাগ্যিস আমাদের পরিবারে সবাই ফার্সি ভাষা জানে । আপনি তো জানেন এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা জিয়া গঙ্গোপাধ্যায়  সন্ত কামদেব ব্রহ্মচারী নামে সন্ন্যাসী হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর ছেলে লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়  ১৬০৮ সালে  মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে সুন্দরবনের লাগোয়া ভূসম্পত্তি জায়গির হিসেবে পেয়েছিলেন।  মুঘল সম্রাট আকবর আমাদের ‘রায়’ আর জাহাঙ্গির  ‘চৌধুরী’ উপাধি দিয়েছিলেন। তাই ‘রায়চৌধুরী’ আমাদের পদবিতে পরিণত হয়েছে। আমরা দাবি করি না যে আমরা কলকাতার জনক । 

আজিম-উশ-শান : আমিই বা কী করব ? শায়েস্তা খান এর উত্তরাধিকারী সুবাহদার ইবরাহিম খান বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্য আবার শুরু করতে ব্রিটিশদের ডেকে পাঠিয়েছিল। দুটো প্রধান বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে জব চার্নক নামে ওদের একজন প্রতিনিধি সুবাহদারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছিল। একটা ছিল ইংরেজদের বসতি হুগলি থেকে সুতানুটিতে স্থানান্তরের প্রস্তাবে সরকারকে অবশ্যই রাজি হতে হবে। দ্বিতীয়ত, বার্ষিক পূর্বনির্দিষ্ট ৩০০০ টাকা কর পরিশোধের বিনিময়ে কোম্পানিকে বাংলায় শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের অনুমতি প্রদানকারী একটি ফরমানের দ্বারা সুবাহদার তাদের অনুমতি দেবেন। সুবাহদার ইবরাহিম খান তাদের তোলা দুটো প্রস্তাবই মেনে নিলে । মনে হচ্ছে কলকাতা নামের বাচ্চাটার বাপ অনেকগুলো ।

বিদ্যাধর রায়চৌধুরী : হ্যাঁ, জব চার্ণক মারা যাবার পর ওর জামাই  ক্যাপ্টেন চার্লস আয়ারকে আমরা ১৬৯৮ সালের ১১ই নভেম্বর কলকাতা – সুতানুটি – গোবিন্দপুর গ্রাম তিনটের প্রজাস্বত্ব মাত্র ১৩০০ টাকায় একটি দলিলের দ্বারা দান করে দিতে বাধ্য হয়েছিলুম, তার কারণ আপনারা ঘুষ খেয়ে আমাদের ওপর চাপ দিয়েছিলেন । আমরা এখানকার জায়গিরদার  অথচ মুঘলরা আমাদের গুরুত্ব দিল না । দলিলটা আমরা  সই করেছিলুম আটচালা বাড়িতে, যেখানে আজও আমরা দূর্গাপুজো করি । ক্লাইভের চামচা নবকৃষ্ণদেবের অনেক আগে থেকে আমাদের পুজো হয় । আমরা ক্লাইভের পোঁদে তেল দিতে রাজি হইনি । রাজা বা মহারাজা খেতাব আমাদের দরকার পড়েনি, নবকৃষ্ণ আর কৃষ্ণচন্দ্রর মতন ।

বেনেডিক্ট অ্যারনল্ড : আমার আসল নাম মীর মুহম্মদ কাসিম আলী খান । শোভাবাজার রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা নবকৃষ্ণ দেব সম্পর্কে এই কথাটি অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়। পিতৃহীন অবস্থায় কলকাতার কাছে গোবিন্দপুরে এসে থাকতে শুরু করে। বলা ভালো, অত্যন্ত সাধারণ অবস্থা ছিল। কিন্তু বুদ্ধি ছিল প্রখর। নিজের চেষ্টায় উর্দু, আরবি, ফার্সি শিখেছিল। ইংরেজ সরকারের হয়ে কাজ করার জন্য সমস্ত রকম গুণই তার মধ্যে বর্তমান ছিল।  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামান্য মুনশী হিসেবে জীবন শুরু হয় নবকৃষ্ণ দেবের। সরকারি কাজকর্মের পাশাপাশি ওয়ারেন হেস্টিংসকে ফার্সি ভাষা শেখানোর কাজ করতো। বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে রবার্ট ক্লাইভ। সিরাজের পক্ষে আছে মীরজাফর। ক্লাইভ তখন নিশ্চিন্ত ।  সময়মতো নবাবের পক্ষ ত্যাগ করল মীরজাফর। ‘ইনাম’স্বরূপ মীরজাফর নবাবের গদিতে বসল। কিন্তু পেছনে থেকে লাভবান হলো আরও দুজন।  কৃষ্ণচন্দ্র এবং নবকৃষ্ণ দেব। মীরজাফরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইতিমধ্যেই তারা খুঁজে পেয়েছে সিরাজের গোপন কোষাগার। সবাই সেই বিপুল ধনসম্পত্তি ভাগাভাগি করে নেয়। তা সত্তেও নবকৃষ্ণের ভাগে কম কিছু পড়েনি। দেখতে দেখতে বিশাল ধনদৌলতের মালিক হয়ে গেল নবকৃষ্ণ। শুধু টাকাই নয়, এল সম্মানও। ইংরেজদের পক্ষ নেওয়ার জন্য পেল ‘রাজা বাহাদুর’ খেতাব; অতঃপর ১৭৬৬ সালে ‘মহারাজা বাহাদুর’। সবথেকে বড়ো কথা, গোটা সুতানুটি অঞ্চলের তালুকদার হয়ে গেল । সামান্য মুনশী থেকে বিশাল সাম্রাজ্য ও ধন-দৌলতের মালিক— এমনই চমকপ্রদ উত্থান রাজা নবকৃষ্ণ দেবের। সেইসঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হল শোভাবাজার রাজবাড়ি । তখন সবে পলাশীর যুদ্ধ শেষ হয়েছে। নবকৃষ্ণদেব ভীষণ খুশি। আর এখানেই ধর্মের তাসটি খেললেন চতুর ক্লাইভ। নিজে খ্রিস্টান, মূর্তিপূজার ঘোর বিরোধী; তা সত্তেও নবকৃষ্ণকে বোঝালেন কলকাতায় একটি বিজয় উৎসব করার জন্য। ‘হিন্দু ভাবাবেগ’ রক্ষা পেয়েছে বলে কথা ! কিন্তু কীভাবে হবে উৎসব? নবকৃষ্ণ ঠিক করলেন, দেবী দুর্গার আরাধনা করেই তুষ্ট করবেন ক্লাইভকে। শুরু করবেন বিজয় উৎসব। ১৭৫৭ সালেই নিজের নবনির্মিত ঠাকুরদালানে শুরু করলেন অকাল বোধন। শুরু হল কলকাতার দুর্গাপূজা। তাতে একশো এক টাকা দক্ষিণাও পাঠিয়েছিলেন ক্লাইভ ! বিশাল আয়োজন করে শুরু হল শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো। কালে কালে যা শহরের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে গেছে । বিশ্বাসঘাতকের পুজোতে ভোগ খেয়ে বাঙালিও সেই বিশ্বাসঘাতকতা আর কোষাগার চুরির অংশভাক। চুরির টাকা খরচ করে কলকাতার জনক হতে চাইছে ওর বংশধররা । 

মহারাজা প্রতাপাদিত্য : মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়   নদীয়ার রাজা আর কৃষ্ণনগর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদারের বংশধর। ভবানন্দ আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে রাজবংশ শুরু করেছিল । কৃষ্ণচন্দ্রের কৃষ্ণনগরেই তাঁর জন্ম; বাবা রঘুরাম রায়। রক্ষণশীল এই হিন্দু রাজা বাংলা, সংস্কৃত ও ফারসি ভাষায় সমান ব্যুৎপন্ন ছিল। কৃষ্ণচন্দ্র ছিল রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন কূটকৌশলী লোক। তার ষড়যন্ত্রে বাংলায় ইংরেজ শাসন কায়েম হয় এবং মুসলমান রাজত্বের অবসান ঘটে। এই রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ও ইংরেজদের সঙ্গে মিত্রতা করে আর ক্লাইভের পক্ষ নিয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন ত্বরান্বিত করেছিল। ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় নবাব  মীর কাসেম তাকে বন্দি করে মৃত্যুদন্ড দিলে ইংরেজদের সহায়তায় ও মুক্তি পায়। ইংরেজদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের পুরস্কার হিসেবে  ইংরেজ কর্তৃক ‘মহারাজা’ উপাধিতে ভূষিত হয়। তদুপরি ক্লাইভের কাছ থেকে উপঢৌকন হিসেবে পায়  পাঁচটা কামান। সে সময়ে বাংলায় যে বর্গীর আক্রমণ হতো তা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ও নিজের রাজধানী ‘শিবনিবাস’ নামের জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল। ক্লাইভের চামচা হিসেবে ওরা তো নিজেদের কলকাতার জনক দাবি করতেই পারে ।

জয়চাঁদ : আমার আসল নাম নবকৃষ্ণ দেব ।পলাশীর যুদ্ধের আগে বাংলা অঞ্চলে সাতজন হিন্দু রাজা ছিল। এদের মধ্যে রাজনৈতিক দিক থেকে বিচক্ষণ নদীয়ার শাসক মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় উপলব্ধি করে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় মুসলমানদের শাসনের দিন ফুরিয়ে এসেছে। অন্যদিকে ব্রিটিশদের উত্থান ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। বিষয়টি তিনি অন্য ছয়জন হিন্দু রাজাকেও বোঝাতে সক্ষম হন। কৃষ্ণচন্দ্র অন্য হিন্দু রাজাদের আরও বোঝাতে সক্ষম হন যে, তাদের সনাতন ধর্ম মুসলমানদের হাতে নিরাপদ নয়, বরং ব্রিটিশদের হাতে নিরাপদ। ফলে সব হিন্দু রাজার সমর্থন নিয়ে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় হাত মেলায় রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে। ইংরেজদের সঙ্গে এই সখ্যতা এমন পর্যায়ে পৌঁছোয় যে, রবার্ট ক্লাইভ পলাশীর যুদ্ধ-ময়দানে যাওয়ার সময় কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের প্রাসাদে রাত কাটিয়েছিল । যুদ্ধের পর ইংরেজদের সঙ্গে এই সখ্য চললেও নবাব মীর কাশেমের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র। এই দ্বন্দ্বের রেশ ধরেই কৃষ্ণচন্দ্র রায়কে মৃত্যুদণ্ড দেন মীর কাসিম। কিন্তু ক্লাইভের বদান্যতায় বেঁচে যায় আর রাজা খেতাব পায় ।বস্থায় মারা যান উমিচাঁদ

মার্কাস ব্রুটাস : আমাদের  পরিবারের নাম জগত শেঠ । পলাশীর যুদ্ধে একদিকে যেমন ইংরেজদের কূটকৌশল আর অস্ত্রশস্ত্র কাজ করেছিল, অন্যদিকে ঠিক তেমনিভাবে কাজ করেছিল আমার অঢেল টাকা। আমার আসল নাম মহাতাপ চাঁদ। আর  টাইটেল  জগৎ শেঠ, যার অর্থ পৃথিবীর ব্যাংকার। মূলত এই টাইটেলটা প্রথম লাভ করে আমার দাদা ফাতেহ চাঁদ। আমরা মাড়োয়ারি  পরিবার । মূলত সুদের কারবার আর ব্যাংকিংয়ে জড়িত । পলাশীর যুদ্ধের আগেই বংশ পরম্পরায় পিতামহের টাইটেল জগৎ শেঠ আমার নামে যুক্ত হয়।  য় জমিদাররা আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই খাজনা পরিশোধ করতো। আবার নবাবরাও দিল্লিতে খাজনা পাঠাতে আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করতো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে ইংরেজরা এদেশে আসতে থাকলে ইংল্যান্ডের মুদ্রার সঙ্গে ভারতীয় মুদ্রা বিনিময় করার প্রয়োজন দেখা দেয়। আর এ সুযোগটি গ্রহণ করি আমরা। বিশেষত ইংরেজরা ঘুষ আর দুর্নীতি বাবদ ভারতীয় মুদ্রায় যে অর্থ পেত তা ইংল্যান্ডের মুদ্রায় বা সোনা ও রত্নে বিনিময় করে দিতুম আমরা । তাই ইংরেজদের কাছে আমাদের কদর ছিল। ফলে নবাব সিরাজউদ্দৌলকে পলাশীর যুদ্ধে হারানোর ষড়যন্ত্রে ব্যাপক ভূমিকা নিই । পলাশীর যুদ্ধের পর মীর জাফরের আমলে ভালোই ছিলুম আমি, মহাতাপ চাঁদ আর খুড়তুতো ভাই  মহারাজ স্বরূপ চাঁদ। কিন্তু  মীর কাসিমের সঙ্গে খেয়োখেয়িতে জড়িয়ে পড়লে ওর বিরুদ্ধে  নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করতে বাধ্য হই। পলাশীর যুদ্ধের ছয় বছরের মাথায় ইংরেজদের কাছে  ষড়যন্ত্রমূলক একটি চিঠি লিখেছিলুম । কিন্তু চিঠিটা কেমন করে যেন  মীর কাসিমের হস্তগত হয়। এতে চটে  ওঠে  মীর কাসিম আর আমাকে মুর্শিদাবাদ থেকে তাড়ায় । এদিকে ১৭৬৩ সালে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে হেরে যায়  মীর কাসিম ।  মীর কাসিম এই অপমান মানতে পারেননি। ব্যাটা ছুটে আসে আমাদের নতুন আস্তানা মাংঘরে। মাংঘরে একটি টাওয়ারে আশ্রয় নিয়েও প্রাণ বাঁচতে পারিনি আমি।  মীর কাসিম আর ওর সৈন্যরা আমার, মহাতাপ চাঁদের, আর  স্বরূপ চাঁদসহ  পরিবারের সবার মুণ্ডু ধড় থেকে আলাদা করে দ্যায় । এই আত্ম বলিদানের জন্যে আমি দাবি করি যে আমিই কলকাতার জনক ।  

সুশীল চৌধুরী : ১৭৫৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বাংলার নওয়াব  সিরাজউদ্দৌলা ও ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়। নওয়াব কলকাতার ইংরেজ বসতি অধিকার করেন (১৮-২০ জুন ১৭৫৬) এবং ইংরেজরা তাঁর প্রকৃত ক্ষতিসমূহের প্রতিবিধান করতে অস্বীকার করলে তিনি তাদের কলকাতা শহর থেকে বিতাড়িত করেন। তিনি এ শহরের নতুন নামকরণ করেন আলীনগর। ইংরেজরা সাহায্যের আবেদন জানালে মাদ্রাজ থেকে ক্লাইভ এবং ওয়াটসন-এর অধীনে অতিরিক্ত সৈন্যবাহিনী উপনীত হয় এবং কলকাতা পুনর্দখল করে। নওয়াব কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু কলকাতার কাছে খুব ভোরে ইংরেজরা আকস্মিক আক্রমণ করলে নওয়াব পশ্চাদপসরণ করেন। ইংরেজরা তাঁকে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য প্রস্তাব দেয়। নওয়াব তাঁর প্রধান উপদেষ্টাবৃন্দ ও মন্ত্রীদের পরামর্শক্রমে এ চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তির প্রধান ধারাগুলি হলো ক. নওয়াব ১৭১৭ সালের ফররুখ সিয়ারের ফরমান এ প্রদত্ত সকল সুবিধা ইংরেজদেরকে দেবেন, খ. কোম্পানির দস্তক এর আওতায় বাংলার ভেতর দিয়ে যেসব পণ্যদ্রব্য অতিক্রম করবে সেগুলির ওপর থেকে শুল্ক তুলে নিতে হবে, গ. নওয়াব বিনা বাধায় কলকাতার ইংরেজ দুর্গটিকে সুরক্ষিত করার অনুমতি দেবেন এবং ঘ. কলকাতায় ইংরেজগণ স্বাধীনভাবে মুদ্রাঙ্কন করতে পারবে। এ চুক্তির শর্তাবলি বাংলায় ইংরেজদের অনুকূলে ছিল এবং সেখানে তাদের প্রভাব বৃদ্ধি করেছিল। ১৭৫৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ক্লাইভ সিলেক্ট কমিটির কাছে লিখেন যে, এ চুক্তির শর্তাবলি কোম্পানির জন্য ‘একই সঙ্গে সম্মানজনক ও সুবিধাজনক’। সিরাজউদ্দৌলার জন্য এ চুক্তি কিছুটা অপমানকর হলেও তিনি এটি মেনে নেন। তবে তিনি ইংরেজদের সামরিক বাহিনীর ভয়ে ভীত হয়ে একাজ করেন নি। তিনি বরং আহমদ শাহ আবদালীর নেতৃত্বে আসন্ন আফগান আক্রমণের আশঙ্কায় আলীনগরের চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। এ সময় তিনি খবর পেয়েছিলেন যে, আহমদ শাহ আবদালী দিল্লি ধবংস করার পর (১৭৫৬) বাংলার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। পরবর্তী ঘটনাবলি দ্বারা তাঁর ধারণা ভুল প্রমাণিত হলেও সম্ভবত তিনি মনে করেছিলেন যে, ওই মুহূর্তে ইংরেজরা নয় বরং আফগানরাই ছিল তাঁর জন্য অধিকতর বিপজ্জনক। এ কারণে তিনি রাজা রামনারায়ণের নেতৃত্বে তাঁর সামরিকবাহিনীর সেরা অংশটি আফগান বাহিনীকে বাধা দেওয়ার জন্য পাটনায় প্রেরণ করেছিলেন। যদিও এ চুক্তি বেশি দিন স্থায়িত্বলাভ করে নি। এর প্রধান কারণ, ইংরেজরা এর শর্তাবলি মেনে চলে নি। ফলে চুক্তিটি ভেঙ্গে যায় এবং ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। 

আহমদ শাহ দুররানি : আমি সুবে বাঙ্গাল আক্রমণের কথা ভাবিনি । কাফেরদের ধ্বংস করার কাজে ব্যস্ত ছিলুম । সিরাজ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলে ইংরেজদের তাড়াতে হেল্প করতে পারতুম । আমি শিখ গণহত্যায় কুখ্যাত হয়ে আছি, অমৃতসরে শিখদের পবিত্র স্বর্ণ মন্দিরে হামলা করে  ধংস্ব করে দিয়েছিলুম। এছাড়াও তিনি ১৭৪৬ ও ১৭৬২ সালে হাজার হাজার শিখকে খুন করেছিলুম।আফগানিস্তানে আমাকে লোকে বলে আহমদ শাহ বাবা ।

মার্শাল পেতাঁ : আমার নাম উমিচাঁদ । প্রকৃত নাম ছিল আমির চাঁদ। আমি একজন শিখ আর জন্মসূত্রে পাঞ্জাবের বাসিন্দা। কিন্তু কলকাতায়  দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করছিলুম আর অঢেল ধনদৌলত কামিয়েছিলুম। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতেও টাকা খাটিয়েছিলুম আর মুর্শিদাবাদ দরবারে কোম্পানির পক্ষে দালালি করতুম। এতে বেশ লাভবান হই । কলকাতায় অনেক ঘরবাড়ি কিনি । আরও লাভের আশায় আমিও গোপনে লর্ড ক্লাইভ আর মীর জাফরের সঙ্গে যোগ দিই।   পলাশীর যুদ্ধে নবাবকে হারিয়ে যে ধন-সম্পদ পাওয়া যাবে তার পাঁচ অংশ চেয়েছিলুম।  গোপন পরিকল্পনা ফাঁসের হুমকিও দিয়েছিলুম। ক্লাইভ ব্যাটা আমার প্রস্তাবে সম্মত হয়ে একটি চুক্তি করেছিল । চুক্তিটার যে দুটো কপি করিয়েছিল তা জানতুম না। যার একটাতে আমাকে অর্জিতব্য সম্পদের  পাঁচ ভাগ দেওয়ার কথা লেখা থাকলেও অন্যটাতে অর্থাৎ মূল কপিতে তা লেখা হয়নি। মূল কপি ব্যাটা আমাকে দেখায়নি । আসল ঘটনা জানার পরে আমি সত্যিই পাগল হয়ে গিয়েছিলুম ।  হ্রাস পায় আমার  স্মৃতিশক্তি।  অসহায় আর করুণ অবস্থায় দশ বছর উন্মাদ ছিলুম । ওই অস্হায় ১৭৬৭ সালে মারা যাই । এই যে ইংরেজদের ঢুকিয়ে আনলুম তাতে তো প্রমাণ হয় যে আমিই কলকাতার জনক ।

হুমায়ুন : দশম শতাব্দীতে যে পাঁচজন ব্রাহ্মণকে বাংলায় সর্বশ্রেষ্ঠদের মধ্যে অন্যতম বলে গন্য করা হতো, সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবার তাঁদের অন্যতম । তা সত্তেও ওদের চরিত্রে ক্ষত্রিয়ের তেজ দেখে  বংশের পঞ্চানন গঙ্গোপাধ্যায়কে খান উপাধি দিয়েছিলুম । ওরা রায়চৌধুরীর বদলে খান পদবী ব্যবহার করলে ভালো করতো । আফগান সেনাদের প্রধান হয়ে পঞ্চানন তো পাঁচু শক্তিখান নামে আগ্রা, দিল্লি, লাহোর, কাবুলেও খ্যাতি পেয়েছিল । ওকে শের শা্হ সুরি ডেকেছিল ওর পক্ষের সেনাপতি হবার জন্য, কিন্তু যায়নি । অবশ্য ওদের বংশই তো কলকাতার জনক হলো ।

পাঁচু শক্তিখান : হ্যাঁ, শের শাহ আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল, যাইনি কেননা মোগল সম্রাট আমাকে সন্মান দিয়েছেন ।মারাঠারা আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল ওদের সঙ্গে যোগ দিতে । ওদের গেরিলা যুদ্ধশৈলী পছন্দ ছিল না বলে যাইনি ।কে কলকাতার জনক হবে তা নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ ছিল না ।

ভোলা ময়রা : আমার নাম ভোলানাথ মোদক।  হুগলী জেলার গুপ্তিপাড়ায় জন্মছিলুম। বাবার নাম কৃপানাথ। কলকাতার বাগবাজারে আমার মিষ্টির দোকান ছিল। পাঠশালায় সামান্য লেখাপড়া করলেও সংস্কৃত, ফারসী ও হিন্দিতে জ্ঞান ছিল। পুরাণ ও ধর্মশাস্ত্র সামান্য পড়েছিলুম। কবির দল তৈরীর আগেও  বহু কবিতা রচনা করেছিলুম। কলকাতার অনেক খবরই রাখি । কলকাতার মাঝখানে এখনকার বিবাদীবাগের লালদিঘির কাছে সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের কাছারি আর গৃহদেবতা শ্যাম রায়ের  মন্দির  ছিল।  কাছারির দোল উৎসবের আবিরে দিঘির রং লাল হয়ে যেত বলে এই দিঘির নাম হয়েছিল লালদিঘি। জন অ্যান্টনি নামে এক পর্তুগিজ ভাগ্যান্বেষী সাবর্ণদের কাছারিতে কাজ করতো। তার পৌত্র অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি পরে বিখ্যাত কবিয়াল হয়েছিল।ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথমে এই কাছারিটা ভাড়া নেয় আর পরে কিনে নেয়। ওখানেই বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সচিবালয় মহাকরণ । আমার মনে হয় আমরা কবিয়ালরা কলকাতার জনক ।

মোহনলাল : ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধের সময় আমি সিরাজের প্রতি অবিচল বিশ্বস্ততায় যুদ্ধ করেছিলুম। যুদ্ধক্ষেত্রে মীর মদনের মৃত্যুর পরেও আমার একক চেষ্টায় যুদ্ধের গতি সিরাজের অনুকূলে ছিল। কিন্তু নিজের অদূরদর্শিতা ও মানসিক দুর্বলতার কারণে সিরাজ,  মীর জাফর প্রমুখ বিশ্বাসঘাতকদের প্রভাবে যুদ্ধ বন্ধ রাখার আদেশ দেন। ফলত: নবাব বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় ও শোচনীয় পরাজয় ঘটে। আমি যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যাইনি।  যুদ্ধে আহত হই আর যখন জানতে পারি যে মীর জাফর আমাকে খুন করার জন্য তল্লাশি চালাচ্ছে, তখন গা ঢাকা দিই। কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তী পর্যায়ে আমার বড় ছেলে, পূর্নিয়ার নায়েব নাজিম, শ্রীমন্ত লালকে  মিরন খুন করেছিল। ছোট ছেলে হুক্কা লাল পালিয়ে আত্মরক্ষা করেছিল। আমার বোন ছিল সিরাজের প্রণয়িনী আর আমি তাদের বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে ময়মনসিংহে চলে যাই। তারপর আমার অজ্ঞাতবাস পর্বের নানা কিংবদন্তি ছড়িয়ে আছে বাংলায়।এই কিংবদন্তিগুলোই কলকাতার জনক ।

কানকাটা দানশা ফকির : ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন পলাশীর যুদ্ধে হেরে যাবার পর, সিরাজদ্দৌলা – তার স্ত্রী লুৎফুন্নেসা ও চাকর গোলাম হোসেনকে নিয়ে রাজধানী থেকে বের হয়ে স্থলপথে ভগবানগোলায় পৌঁছে যান আর সেখান থেকে নৌকাতে পদ্মা ও মহানন্দার মধ্য দিয়ে উত্তর দিক যাত্রা করেন। তাঁর আশা ছিল পশ্চিমাঞ্চলে পৌঁছোতে পারলে ফরাসি সৈনিক মসিঁয়ে নাস-এর সহায়তায় পাটনা পর্যন্ত গিয়ে রামনারায়ণের কাছ থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে ফরাসি বাহিনীর সহায়তায় বাংলাকে রক্ষা করবেন। শেষরক্ষা হয় নি । মহানন্দা নদীর স্রোত অতিক্রম করে এলেও তাতে জোয়ার ভাটার ফলে হঠাৎ করে জল কমে যাওয়ায় নাজিমপুরের মোহনায় এসে তাঁর নৌকা চড়ায় আটকে যায়। তিনি নৌকা থেকে নেমে খাবার সংগ্রহের জন্য একটি মসজিদের কাছে বাজারে আসেন। আমি নবাবকে দেখে চিনে ফেলি কেননা একবার নবাবের শাস্তি পেয়ে আমি একটা কান হারিয়েছিলুম। আমি নবাবের খবর জানিয়ে দিই । মীর জাফরের লোক এসে  সিরাজদ্দৌলাকে বন্দি করে রাজধানী মুর্শিদাবাদে নিয়ে যায় । এর পরের দিন ৪ জুলাই  মীরজাফরের নির্দেশে তার ছেলে মিরনের তত্ত্বাবধানে মুহম্মদি বেগ নামের এক জল্লাদ সিরাজদ্দৌলাকে খুন করে করে। সিরাজের মৃত্যুর পর তার শব হাতির পিঠে চড়িয়ে সারা শহর ঘোরানো হয়। মুর্শিদাবাদের খোশবাগে নবাব আলিবর্দী খানের কবরের কাছে তাকে কবর দেয়া হয়। মীর জাফর আমাকে জমিজমা আর  মোটা ইনাম দিয়েছিল । আমি ধরিয়ে না দিলে কলকাতার জন্ম হতো না ।

কৌস্তুভ দে সরকার : সিরাজের কাছে হেরে গিয়ে, কলকাতা উদ্ধারে সর্বাত্মক অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় ইংরেজদের তরফ থেকে। এক্ষেত্রেও ইংরেজ বাহিনীর প্রধান হিসেবে প্রস্তাব করা হয় ক্লাইভের নাম। বিশেষ করে পণ্ডিচেরির দায়িত্বে থাকা পিগটের নামও এসেছিল এ অভিযান পরিচালনায় নেতৃত্বের জন্য; কিন্তু অল্প অভিজ্ঞতা নিয়ে এমন অভিযানের জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। পক্ষান্তরে হাঁপানি রোগী লরেন্সের পক্ষে বাংলার আর্দ্র-উষ্ণ আবহাওয়ায় অভিযান পরিচালনা করা অনেক কঠিন ছিল। শেষ পর্যন্ত ক্লাইভের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে নেতৃত্বের দায়ভার গিয়ে উপস্থিত হয় কর্নেল জন এডলারকর্নের ওপর। তিনি পদাতিক ও নৌযুদ্ধে পারদর্শী ছিলেন। পাশাপাশি বাংলার পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ চালিয়ে নেয়ার সাহস ও শক্তিমত্তা তার মধ্যে ছিল। এর পর ইংরেজ বাহিনী সেন্ট ডেভিডের মাটি থেকে কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করে। আরেক দফা সংঘাতে কেঁপে ওঠার আতঙ্কে থমথমে অবস্থা বিরাজ করে প্রকৃতিতে।

গৌতম বসুমল্লিক : বাংলায় দুর্গাপুজো প্রবর্তনের কৃতিত্ব যাঁরই হোক না কেন, কলকাতায় দুর্গার পুজো প্রথম অনুষ্ঠিত হয় ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে, বরিষার ,বেহালা সখের বাজার অঞ্চল,  সাবর্ণ গোত্রীয় রায়চৌধুরী পরিবারের আটচালা মণ্ডপে। তখন অবশ্য কলকাতা শহরে রূপান্তরিত হয়নি, তবে মণ্ডপটি আরও একটি কারণে ঐতিহাসিক। ওই আটচালা মণ্ডপে বসেই ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দের ১০ জুন তারিখে জোব চার্নকের জামাই চার্লস আয়ারের সঙ্গে ‘সুতানুটি’, ‘গোবিন্দপুর’ ও ‘কলকাতা’ গ্রাম তিনটির হস্তান্তরের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছিল রায়চৌধুরী বাড়ির তত্কালীন কর্তাদের সঙ্গে । সুতরাং ওনারাই কলকাতার জনক ।

সুবিমল বসাক : সুতানুটী নামটা এসেছে ওই টেক্সটাইল শিল্পের বাড়বাড়ন্ত থেকে। বাঙালির কলকাতার শ্রী ইংরেজ আসার আগে কিরকম ছিল, সেটা ইংরেজরা যে দিল্লির বাদশাকে ১৬০০০ টাকা দিয়েছিল এই তিনটে গ্রাম সুতানুটী, কলকাতা, গোবিন্দপুরের প্রজাসত্ত্ব কেনার জন্য ১৬৯৮ সালে, তা দেখলে টের পাওয়া যায়। সাবর্ণদের ১৩০০ টাকা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সাবর্ণরা তো দেওয়ার মালিক নয়, মোগল আমলে সমস্ত জমিই বাদশার, লোকে প্রজাসত্ত্ব (রেভেনিউ রাইট) কিনতে পারে কেবল, তো কলকাতার সেই প্রজাসত্ত্ব কিনতে বাদশার ফরমান আনতে হয়েছিল। এঁদো জমির জন্য কে ১৬০০০ টাকা দেয়? কলকাতা যদি গণ্ডগ্রাম হত, সেযুগে এই পরিমাণ টাকার ঝুলি হাতে নিয়ে বাদশার দ্বারস্থ হত না ইংরেজ।ব্রিটিশদের আসার আগে সুতানুটি অঞ্চলের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী বণিক পরিবার ছিলুম আমরা বসাকেরা। আমরা ছিলুম সুতানুটি বাজারে প্রধান বস্ত্রব্যবসায়ী। ব্রিটিশদের আসার পর আমাদের পরিবারের  সমৃদ্ধি ঘটেছিল। আমার পূর্বপুরুষ শোভারাম বসাক (১৬৯০-১৭৭৩)   কোটিপতি ব্যবসায়ী ছিলেন আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বস্ত্র সরবরাহ করতেন। গোবিন্দপুর দুর্গনির্মাণের জন্য ধ্বংস করা হলে বসাকরা উত্তর সুতানুটি হাট (বর্তমান বড়বাজার) অঞ্চলে সরে যায় । পরে মাড়োয়ারিরা আসার ফলে  বসাকেরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। সুতানুটি হাটের নামও পরে বদলে  বড়বাজার হয়।  শোভারাম বসাকের উত্তরসূরি রাধাকৃষ্ণ বসাক (মৃত্যু ১৮১১) বেঙ্গল ব্যাংকের দেওয়ান হয়েছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে শহরের প্রধান ব্যবসায়িক পরিবারগুলি নগরাঞ্চলীয় সম্পত্তিতে বিনিয়োগ করতে শুরু করেন। শোভারাম বসাক তার উত্তরসূরিদের জন্য সাঁইত্রিশটি বাড়ি রেখে গিয়েছিলেন। রাধাকৃষ্ণ বসাক কেবল বড়বাজারেই রেখে যান ষোলোটি বাড়ি। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কলকাতার বিকাশ শুরু হলে  বসাকদেরও পতন শুরু হয়।  বসাকদের সঙ্গে সঙ্গে সুতানুটিও কলকাতায় বিলীন হয়ে যায়।  ১৬৯০ সালে সুতানুটিতেই জব চার্ণক প্রথম এসেছিল। এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে শুধুমাত্র কলকাতা শহরটিই বিকশিত হয়ে ওঠেনি, বরং ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূচনায় এখানেই ঘটেছিল। আদি কলকাতার ব্ল্যাক টাউন তথা কলকাতার সংস্কৃতির আঁতুড়ঘর সুতানুটি আজও কলকাতার ইতিহাস সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তিদের কাছে এক পরম আগ্রহের বিষয়। সুতরাং কলকাতার জনক আমরা, জোব চার্ণকের আগে থেকে যারা এখানে ছিলুম ।

কংস নারায়ণ : ১৬ শতকে  বাংলার নবাব দিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছিল। বাংলা তখন স্বাধীন নবাবের হাতে। পরাক্রান্ত মুঘলদের আটকাতে তাঁরা তৈরি করলেন একশ্রেণীর হিন্দু জনশক্তি। তাঁদেরই একজন ছিলুম আমি ।আমি  নবাবদের সাহায্য নিয়েছিলুম।  নবাবী আমলে কিন্তু দুর্গাপূজা কখনও বাধাপ্রাপ্ত হয়নি। মোটামুটি ভাবে বলা যায়, অবিভক্ত বাংলার  প্রথম দুর্গা পুজোর উদ্বোধন আমি করেছিলুম । তা থেকে প্রমাণ হয় যে ষোড়শ শতকে আমি তখনকার গৌড়ের সুলতানদের কাছ থেকে প্রভূত অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সাহায্য পেতুম। সুতরাং আমার দুর্গাপূজা স্বাভাবিকভাবেই হিন্দু্–মুসলমানের উৎসব হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু পলাশীর যুদ্ধকে কেন্দ্র করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠল ইংরেজদের বাণিয়া শক্তি। যে যে হিন্দুদের হাতে অর্থ ছিল, তাঁদের হাতে কোনও রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল না। তাই তাঁরা গোপনে লর্ড ক্লাইভকে সাহায্য করতে শুরু করলেন। এদের পূর্বভাগে ছিলেন কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের শোচনীয় পরাজয়ের পর খুব স্বাভাবিকভাবেই বাংলার রাজনৈতিক শক্তির পুনর্বিন্যাস ঘটে। রাজতন্ত্র থেকে বাংলার ক্ষমতা এক লাফে চলে যায় বাণিয়াদের হাতে। সেই সময়ে কিন্তু ইংরেজরা সরাসরি ভারতে প্রবেশ করেনি। প্রবেশ করেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি। আর সেই কম্পানির দৌলতে ইংরেজদের ঘাঁটি হয় কলকাতায়। ফলে তাদের সৌজন্যে কলকাতায় তৈরি হল একশ্রেণীর উচ্চবিত্ত রাজমহল। তাঁদের মধ্যে অন্যতম শোভাবাজার রাজবাড়ি রাজা নবকৃষ্ণ দেব। নবকৃষ্ণ কলকাতায়  ইংরেজ শক্তিকে তেল মারার জন্য বারোয়ারি দুর্গাপুজোর উদ্বোধন করেচিল। ইংরেজরা শুধু যোগদানই করেনি, রীতিমতো সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল  ছোটলাট ও বড়লাট। আমি ইংরেজদের তেল মারার জন্য দুর্গাপুজো করতুম না ।

হাইনরিখ লুশকভ : আমার আসল নাম সৈয়দ মীর জাফর আলী খান  । আমি  ইরানি বংশোদ্ভূত। আমার বাবার নাম সৈয়দ আহমেদ নাজাফি। আমি বাবা-মা র দ্বিতীয় ছেলে। ইরান থেকে একদম নিঃস্ব হয়ে  বাংলায় এসেছিলুম ভাগ্যান্বেষণে। এখানে এসে বিহারের নায়েব আলীবর্দী খানের অধীনে চাকরি শুরু করি। অনেকেই জানেন না ইরানি ভাষায় খুব সুন্দর গান গাইতে পারতুম আমি । কিন্তু আমি ভালো বাংলা বলতে পারতুম না বলে আলীবর্দী খান নিজের উত্তরাধিকারী হিসেবে সিরাজউদ্দৌলাকে বেছে নেন । পলাশির যুদ্ধে আমি সেই অবহেলার বদলা নিয়েছিলুম ।

মীর কাসেম আলী খান : মীর জাফরকে ক্ষমতাচ্যুত করে আমি  ক্ষমতা দখল করেছিলুম। পরে ইংরেজদের সাথে আমার বিরোধ বাধে আর বকসারের যুদ্ধে হেরে যাই ।  ইংরেজদের ভয়ে পালিয়ে বেড়াতুম । অচেনা অবস্থায় দিল্লীতে মারা গিয়েছিলুম । আমার মাথার কাছে পড়ে থাকা একটা পোঁটলায় পাওয়া যায় নবাব মীর কাসেম হিসেবে ব্যবহৃত আমার চাপকান। তা  থেকে লোকে জানতে পারে শবটা বাংলার ভূতপূর্ব নবাব মীর কাসেম আলী খান। জানি না আমার কবর কোথায় । তবে আমিই কলকাতার জনক, কেননা আসল কলকাঠি তো আমিই নেড়েছিলুম ।

ঘনাদা : ১৮৮৬ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ট্রায়াল অব মহারাজা নন্দকুমার’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে যে, মিডলটনের পত্রালাপ দাখিল করা হলে ওয়ারেন হেস্টিংস ঘুষ নেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হতো। ওয়ারেন হেস্টিংস, তার বন্ধু ইলাইজা ইম্পের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসির আদেশ বের করেছিল। মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসি ওয়ারেন হেস্টিংসের জীবন ও কর্মকাল এবং কোলকাতার একটি বিতর্কিত অধ্যায়।মাত্র ২৩ বছর বয়সে সিরাজউদ্দৌলা ১৫ এপ্রিল ১৭৫৬ সালে নবাবী লাভ করেন। তার নবাবীর সময়কাল ছিল মাত্র ১ বছর ২ মাস ৮ দিন অর্থাৎ ৪৩৪ দিন। এ সময়ের মধ্যে নবাব সিরাজউদ্দৌলা দু’দুবার ইংরেজদের বিরুদ্ধে কলকাতা অভিযানে স্বয়ং নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং ইংরেজদের পরাজিত করেছেন। পূর্ণিয়ার যুদ্ধে শত্রুকে পরাজিত করেছেন। প্রধান সেনাপতি মীর জাফর, সেনাপতি রাজা দুর্লভরাম, উমিচাঁদ, রাজা রায়বল্লভ, ইয়ার লতিফ, জগৎ শেঠ, ঘসেটি বেগম, ইংরেজ সেনাপতি ওয়াটসন, ওয়াটস, ক্লাইভ প্রমুখ সিরাজউদ্দৌলার নবাবীর প্রথম দিন থেকে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের মাধ্যমে বিশ্বাসঘাতকতা, রাজদ্রোহ ও দেশদ্রোহিতায় লিপ্ত থেকে নবাবকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিল। তাতে একদিনের জন্য তরুণ নবাবের ব্যক্তিগত জীবনে কোনো আরাম-আয়েশ ভোগ-বিলাসের সময়-সুযোগ ছিল না। সিরাজউদ্দৌলাই প্রকৃতপক্ষে কলকাতার জনক । 

খান আবদুল হাদি :আলিবর্দীর শাসনকালের শেষ দিকে স্বার্থান্বেষী মহল কীভাবে গোটা শাসনতন্ত্রকে নিজেদের হাতের মুঠোয় পুরতে সচেষ্ট হয়ে উঠেছিল, সে সম্পর্কে সিরাজকে আমি বারবার সতর্ক করে দিয়েছিলুম। সেনাবাহিনীকে কেন্দ্র করে মীরজাফর আর খাদিম হুসেন খানের একটা বড় অঙ্কের টাকা পকেটস্থ করার বিষয়টা হাতেনাতে ধরিয়ে দিয়েছিলুম। বস্তুত এই ঘটনাবলী জানার ফলে সিরাজের ভেতরে যে অগ্নিবর্ষী একটি দৃষ্টিভঙ্গি প্রবল হয়ে উঠেছিল, তা কায়েমি স্বার্থান্বেষীদের প্রায় কোণঠাসা করে ফেলেছিল। তাই তারা সিরাজকে দুর্বিনীত, চরিত্রহীন ইত্যাদি নানা অভিধায় অভিহিত করে পলাশী যুদ্ধের পটভূমিকা নির্মাণের কাজটি বেশ জোরদারভাবেই করতে শুরু করে দিয়েছিল। সিরাজই কলকাতার জনক ।

মীর মদন : পলাশীর আমবাগানে আমি আর মোহনলাল  দুই সেনাপতি মিলে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পক্ষে আমৃত্যু লড়াই করেছিলুম। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে অন্য বিশ্বাসঘাতক সেনাপতিরা নিশ্চেষ্ট থাকলেও আমরা দুজনে ইংরেজ বাহিনীকে আক্রমণ করি।  প্রবল আক্রমণে টিকতে না পেরে ইংরেজ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভ তার সেনাবাহিনী নিয়ে আমবাগানে আশ্রয় নেয়। মীর জাফর, ইয়ার লতিফ খান, রায় দুর্লভ প্রমুখ নিস্পৃহ থাকলেও আমার গোলন্দাজ বাহিনীর প্রতাপে ইংরেজ বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। দুপুরের দিকে হঠাৎ বৃষ্টি নামলে নবাব বাহিনীর গোলাবারুদ ভিজে যায়। তবুও আমি আর মোহনলাল ইংরেজদের সাথে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলুম। কিন্তু প্রধান সেনাপতি মীর জাফর সিরাজকে বোঝালো যুদ্ধ বন্ধ রাখতে। যুদ্ধ চলার সময়ে গোলার আঘাতে আমি মারা যাই । আমার অনুগত কিছু সৈনিক আমার মৃতদেহকে গোপনে মুর্শিদাবাদের রেজিনগরের কাছে ভাগীরথী নদী তীরবর্তী ফরিদপুর গ্রামে কবর দে। এখনও ফরিদপুরে ফরিদ খানের সমাধির পাশে অবহেলায় সমাধিস্থ রয়েছি। এছাড়াও পলাশীর স্মৃতিসৌধের কাছে চাষজমির ভেতরে তিনটি অনুচ্চ স্মারক আছে, যা মীর মদন, নৌবে সিং হাজারি আর বাহাদুর খানের স্মৃতিতে তৈরি। পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্রের আমবাগান আর নেই । একসময় প্রচুর আমগাছ ছিল। তা ছিল রানি ভবানীর আমবাগান । এখন রাস্তা হয়েছে।  এখানে সমাধিস্থ করা হয় নবাবের আরও দুই বীর কমান্ডার বাহাদুর আলী খান আর ক্যাপ্টেন নৌবে সিং হাজারিকে। বন্দুকধারী ইউনিটের অধিনায়ক ছিলেন বাহাদুর আলী খান। আর গোলন্দাজ বাহিনীর ক্যাপ্টেন ছিলেন নৌবে সিং হাজারি। যুদ্ধের পরপরই এখানে গোপনে তাঁদের সমাধিস্থ করা হয়েছিল। সমাধিস্থলে যাওয়ার কোনো পাকা রাস্তা নেই। পাটখেতের আল ধরে যেতে হয়।

মোহনলাল : ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধের সময় আমি সিরাজের প্রতি অবিচল বিশ্বস্ততায় যুদ্ধ করেছিলুম। যুদ্ধক্ষেত্রে মীর মদনের মৃত্যুর পরেও আমার একক চেষ্টায় যুদ্ধের গতি সিরাজের অনুকূলে ছিল। কিন্তু নিজ অদূরদর্শিতা ও মানসিক দুর্বলতার কারণে সিরাজ,  মীর জাফর প্রমুখ বিশ্বাসঘাতকদের প্রভাবে যুদ্ধ বন্ধ রাখার আদেশ দেন। ফলত: নবাব বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় ও শোচনীয় পরাজয় ঘটে। আমি যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যাইনি।  যুদ্ধে আহত হই আর যখন জানতে পারি যে মীর জাফর আমাকে খুন করার জন্য তল্লাশি চালাচ্ছে, তখন গা ঢাকা দিই। কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তী পর্যায়ে আমার বড় ছেলে, পূর্নিয়ার নায়েব নাজিম, শ্রীমন্ত লালকে মীর মিরন খুন করেছিল। ছোট ছেলে হুক্কা লাল পালিয়ে আত্মরক্ষা করেছিল। আমার বোন ছিল সিরাজের প্রণয়িনী আর আমি তাদের বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে ময়মনসিংহে চলে যাই। তারপর আমার অজ্ঞাতবাস পর্বের নানা কিংবদন্তি ছড়িয়ে আছে বাংলায় । আমাকে একটি কলঙ্কিত চরিত্র হিসেবেই ব্রিটিশরা তুলে ধরেছিল। অথচ আমি পলাশীর যুদ্ধে সমস্ত রকমের বিরুদ্ধাচরণকে অস্বীকার করে যেভাবে দেশের হয়ে লড়েছিলুম, সে সম্পর্কে ইতিহাস প্রায় নীরব। সিরাজের কলকাতা অভিযানকালেও (১৭৫৬) আমি যে দক্ষতা আর অসমসাহসের পরিচয় রেখেছিলুম, সেই ইতিহাসও বাঙালির কাছে তুলে ধরা হয় না। পূর্ণিয়া অভিযান এবং পূর্ণিয়ার শাসনব্যবস্থার খোলনলচে বদলাতে আমার ঐতিহাসিক অবদানের কথা ব্রিটিশরা চেপে গেছে। পলাশীর পরিপ্রেক্ষিত রচনার ক্ষেত্রে চন্দননগরকে ঘিরে ফরাসি এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির টানাপোড়েনে সিরাজকে সঠিক ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে আমার আর মীরমদনদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সঠিক। ফলে জগৎ শেঠদের  মতো লোকেরা ভালোভাবেই বুঝতে পারছিল যে সিরাজ কোনো অবস্থাতেই তাদের হাতের পুতুল হবেন না। জগৎ শেঠের সঙ্গে আমার সংঘাতের স্বরূপটা বেশ ভালোভাবেই বুঝেছিল মীর জাফর। 

শওকত জঙ্গ : আমি হলুম বাংলার নবাব আলীবর্দী খান-এর নাতি আর সিরাজউদ্দৌলার পিসতুতো ভাই।আলীবর্দী খানের ছিল তিন মেয়ে। তিন মেয়েকেই উনি নিজের বড়ভাই হাজি আহমদ-এর তিন ছেলে, নোয়াজেশ মোহাম্মদের সাথে বড় মেয়ে ঘসেটি বেগমের, সৈয়দ আহমদ খান সওলত জং সাথে মেজ মেয়ে মায়মুনা বেগমের আর জয়েনউদ্দিন আহম্মদের সাথে ছোট মেয়ে আমেনা বেগমের বিয়ে দেন। তিনি ছিলেন আলীবর্দী খানের মেজ মেয়ে মায়মুনা বেগমের সন্তান। আমিও চেষ্টা করেছিলুম সিরাজকে সরিয়ে সিংহাসনে বসতে । অথচ পলাশীর পর কেউ আমাকে পাত্তা দিল না । 

শশী ঘোষ : কলকাতা বিশ্বের সব থেকে পুরনো শহরের মধ্যে অন্যতম। এমন একটা শহর যার পরতে পরতে লুকিয়ে আছে ইতিহাস। এই ইতিহাসে রয়েছে যেমন ভালবাসা ঠিক তেমনি রয়েছে রোমাঞ্চ। ধরুন আপনার কাছে একটা টাইম ট্রাভেল মেশিন আর সেই টাইম ট্রাভেলে করে এসে পৌঁছালেন পুরনো শহরে। কলকাতায় তখন ব্রিটিশ রাজ। আপনার জানার মধ্যে শুধু ধর্মতলা আর স্রেফ কয়েকটা জায়গার নাম। বাকি অংশ শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল। ধর্মতলা থেকে রাজভবন হয়ে এগোতে শুরু করলেন অফিসপাড়ার দিকে। এই জায়গা তখন শুধু নির্জন রাজপথ। কলকাতার ওয়েলেসলি প্লেস থেকে কাউন্সিল হাউজ পর্যন্ত এই রাস্তাটিকে তখন বলা হত ‘ফ্যান্সি লেন’।মনে হতেই পারে ব্রিটিশ আমলের কোনও ইংরেজের শখ বা শৌখিনতার সঙ্গে এর নিশ্চয় রাস্তার সম্পর্ক আছে। যার জন্যে এর নাম হয়েছে ‘ফ্যান্সি লেন’। তবে বলে রাখি আপনার এই মনে হওয়াটা একদমই ভুল। ইংরেজী শব্দ ফ্যান্সির সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই।এই ‘ফ্যান্সি’ কথাটা এসেছে ‘ফাঁসি’ শব্দ থেকে। আঁতকে উঠলেন বুঝি! ফাঁসি। তাও প্রকাশ্য দিবালোকে। ভরা রাস্তার উপর। জনসাধারণের চোখের সামনে। বীভৎস এই ঘটনার সাক্ষী থেকেছে শহর কলকাতা! সাহেবি উচ্চারণে ‘ফাঁসি’টা হয়ে গিয়েছে ফ্যান্সি, ফলে গোটা মানেটাই ঘেঁটে ঘ ! ঐতিহাসিকরা বলছেন, ইংরেজি ‘ফ্যান্সি’ (Phancy) শব্দটি যে ‘শৌখিন’ অর্থে ব্যবহৃত হয়, এই রাস্তার নামের মানে মোটেই তা নয়। কলকাতার অন্যতম পুরনো রাস্তা এটি, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু ঘটনা। একটা সময় এর পাশ দিয়ে একটা খাল বা ‘ক্রিক’ প্রবাহিত হত বলে জানা যায়। এখন অবশ্য সেটি মুছে গেছে। আর্চডিকন হাইড তাঁর ‘প্যারোকিয়াল অ্যানালস’ এবং ‘পেরিশ অব বেঙ্গল’ বই দুটিতে সেই বর্ণনা দিয়ে গেছেন— “The creek took a half turn round this battery and kept Eastwards beneath three gated bridges, until the fences turned downwards from it at Fancy Lane.” তখন খুব বেশি দিন হয়নি ইংরেজরা কলকাতায় এসেছে। জোব চার্নক তখনও জীবিত। ডালহাউসির কাছে এখন যেখানে কাউন্সিল হাউস স্ট্রিট, বিলিতি আমলে একেবারেই লালদিঘির প্রায় গা-ঘেঁষা সাহেবপাড়া। গোটা জায়গাটাই ছিল জঙ্গল। লোকজন তখন এই ধারে তেমন ঘেঁষতে সাহস পেত না। লোকজন বিশেষ ছিল না বললেই চলে।চারপাশে শুধু অজস্র গাছ, আর তাঁতে লুকিয়ে থাকতো চোর-ডাকাত। সে অন্য যুগ। অন্য জগৎ। জব চার্নকের কলকাতায় তখন নতুন রাজত্ব। সাহেবদের শৌখিনতা তখন গরিব লোকদের ফাঁসি দেওয়া। অপরাধ তখন যাই থাকুক না কেন একটাই শাস্তি ফাঁসি। ১৮০০ সালের কথা। ঢেঁড়া পিটিয়ে বেড়াচ্ছে কম্পানির লোক। কী, না ব্রজমোহনের ফাঁসী হবে। ব্রজমোহনের অপরাধ একটা মুল্যবান ঘড়ি সে চুরি করেছে। যার দাম ২৫টাকা। সে ফাঁসি হবে প্রকাশ্য স্থানে কোনও চৌমাথায়। বহু লোকের সামনে। চারদিকে থেকে পিল পিল করে লোক আসছে। ফাঁসি দেখবে। আজকের ওয়েলেসলি প্লেসে তখন অনেক বড় বড় গাছ ছিল। সেখানেই বসলো মেলা। রাস্তার মোড়ে একটি গাছের কাছে তৈরি করা হয় ফাঁসির মঞ্চ। ফাঁসি হল। সবাই ইংরেজদের এই ন্যায়পরায়ণতা দেখে ধন্যি ধন্যি করল। সেই সময় থেকেই রাস্তার মাঝখানেই এইভাবে ফাঁসি দেওয়া আরম্ভ হল। অত্যন্ত লঘু অপরাধেও অনেক সময় ফাঁসি দেওয়া হত। রাস্তার ধার ঘেঁষে সার সার ঝুলে থাকত দেহ। ফাঁসি দেওয়া রাস্তাটির নামই পরবর্তীকালে হয়ে যায় ‘ফ্যান্সি লেন’ যা বর্তমান পান্নালাল রোড। ইংরেজদের মুখে মুখে ‘ফাঁসি’ শব্দটাই বদলে হয়ে গিয়েছিল ‘ফ্যান্সি’। সেই থেকেই এই নাম। পুরনো কলকাতা নিয়ে লেখায় শ্রীপান্থ বলছেন, মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসি দেখে সবাই ফিরেছিলেন গঙ্গাস্নান করে।কারণ নন্দকুমার ছিলেন ব্রাহ্মণ। ব্রহ্মহত্যা দেখার মহাপাপ ধুয়ে ফেলতে গঙ্গাস্নানই ছিল সামাজিক বিধান। তবে সাধারণ অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট যে রাস্তা ছিল, সেখানে মহারাজ নন্দকুমারকে ফাঁসি দেওয়া হয়নি। গলিটিতেই এখন রয়েছে রাজভবনের স্টাফ কোয়ার্টার্স। আর কিছু অফিস ও দু’একটি দোকান। এবং ব্রিটিশ আমলের চিহ্ন নিয়ে ভেঙে-পড়া পুরোনো বাড়ি। পুরনো কলকাতার এই ভয়ঙ্কর ইতিহাস অনেকেরই হয়তো অজানা। সুতরাং বুঝতেই পারছেন যে নন্দকুমার ছিলেন কলকাতার জনক ।

সুপ্রীতি বর্মণ : কলকাতা শহরকে ইউরোপীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করতে ১৭৫৬ সালের জুন মাসে সিরাজ অতর্কিতে কলকাতা আক্রমণ করেন। ইতিমধ্যে কোম্পানি কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণ করে পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছিল। ২০ জুনের আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতার পতন ঘটে। ফলে ভারতীয়রা শহরের দখল নেন।এরপর সেনাপতি মানিকচাঁদের হাতে দুর্গের শাসনভার ছেড়ে দিয়ে সিরাজ-উদ-দৌলা রাজধানীতে ফিরে আসেন, ১২ জুলাই । কলকাতার নতুন নাম দেন – আলিনগর । এই নামটার একটা ধারা মেনেই – বর্তমান কলকাতার একটা অংশের নাম – আলিপুর ।

আলীবর্দী খান : ১৭৫৬ সালে কলকাতায় দুর্গনির্মাণে বিরক্ত হয়ে আমার নাতি নবাব সিরাজদ্দৌল্লা কলকাতা আক্রমণ করেছিল। কলকাতা অধিকারের পর সিরাজ এই শহরের নাম বদল করে আমার নামানুসারে ‘আলিনগর’ রেখেছিল । ১৭৫৮ সালে ইংরেজরা কলকাতা পুনরুদ্ধার করলে পুরোনো নামটা আবার বহাল হয়। তবে সিরাজের কলকাতা দখল ছিল ইংরেজদের কাছে এক দুঃস্বপ্নের সময়। এই যুদ্ধে গোবিন্দপুর, সুতানুটি, কলকাতা ও চিৎপুরের মধ্যে কেবলমাত্র ‘হোয়াইট টাউন’ নামে পরিচিত কলকাতা সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ‘ব্ল্যাক টাউন’ খুব একটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। কেবল বড়োবাজারে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল আর ইংরেজরা গোবিন্দপুর গ্রামটা জ্বালিয়ে দিয়েছিল। হুগলি নদীর চল্লিশ কিলোমিটার ভাটিতে ফলতায় ইংরেজরা পালিয়ে যায়। আলিনগর নাম থেকে প্রমাণিত যে আমিই কলকাতার জনক । 

মহারাজা নন্দকুমার : পলাশীর ষড়যন্ত্রের পর নন্দকুমারকে মীর জাফর দেওয়ান নিযুক্ত করে সব সময় তাকে নিজের কাছে রাখতেন। নন্দকুমার ভূষিত ছিল মহারাজা উপাধীতে। কিন্তু ওয়ারেন হেস্টিংস এর সাজানো মিথ্যা মামলায় আসামীর কাঠগড়ায় তার বিচার হয়। অদৃষ্টের কি নির্মম পরিহাস তাকে শেষ পর্যন্ত এই বিচারের রায়ে শেওড়াগাছে ঝুলতে হয় ফাঁসী কাষ্ঠে। মহারাজ নন্দকুমারের সাথে মীর জাফরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মীর জাফর তার শেষ জীবনে যাবতীয় কাজ কর্ম নন্দকুমারের পরামর্শনুসারে করতেন। তার অন্তিম শয্যায় নন্দকুমারই তার মুখে কিরীটেশ্বরী দেবীর চরণামৃত তুলে দিয়েছিলেন।

ধিরুভাই অম্বানি : বাঙালি বাড়ির বউরা আমার বউয়ের মতন হলে আজ পশ্চিমবাংলা অনেক ধনী রাজ্য হতো । একটা উদাহরণ দিই । দ্বারকানাথের ইংরেজ-সংসর্গ তাঁর মা বা স্ত্রী কেউই ভাল চোখে দেখেননি। দ্বারকানাথ এ ব্যাপারে স্ত্রীর মতামত অগ্রাহ্য করলে দিগম্বরী স্বামীর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতেও ইতি টানেন। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়ায় যে, দিগম্বরী হিন্দু পণ্ডিতদের ডেকে ম্লেচ্ছদের সঙ্গে একত্রে পানভোজন করা স্বামীর বিরুদ্ধে বিবাহবিচ্ছেদের বিধানও চেয়েছিলেন। পণ্ডিতেরা নিদান দেন, ‘স্বামীকে ভক্তি ও তাঁহার সেবা অবশ্য কর্তব্য, তবে তাঁহার সহিত একত্র সহবাস প্রভৃতি কার্য্য অকর্তব্য।’ স্ত্রীর সাংসারিক দায়িত্বটুকু পালন করা ছাড়া দিগম্বরী স্বামীর সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক রাখেননি। কাজের সূত্রে দ্বারকানাথের সঙ্গে যত বার কথা বলতে হত, তত বারই নাকি তিনি গঙ্গাজলে চান করতেন, এমন কথাও শোনা যায়। সুতরাং দ্বারকানাথই কলকাতার জনক।

জয়িতা ভট্টাচার্য : কলকাতায় ইংরেজরা তাদের বসতির বাইরে দুর্গপ্রাচীরের মতো প্রতিরক্ষা বেষ্টনী তৈরির চেষ্টা নিলে নবাবের নির্দেশে তা ধ্বংস করা হয়। একইভাবে ফরাসিরা প্রাচীর নির্মাণ করলেও তারা নবাবকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, এটা কোনো দুর্গ না, বরং স্থাপত্যিক কাঠামোর সংস্কার করা হচ্ছে মাত্র। নবাব ফরাসিদের কথা বিশ্বাস করলেও ইংরেজদের বিশ্বাস করতে চাননি। ফলে ফরাসিরা তাদের দুর্গপ্রাচীর টিকিয়ে রাখতে পারলেও শেষ পর্যন্ত ধ্বংস করা হয় ইংরেজদের দুর্গ। তবে এখানকার মূল বাস্তবতা হচ্ছে, ইংরেজরা যে দুর্গপ্রাচীর নির্মাণ করেছে, সেটা যতটা না নবাবের বিরুদ্ধে যায়, তার চেয়ে ঢের ফরাসিদের প্রতিরোধে কার্যকর হতো। এক্ষেত্রে তার খালা ঘষেটি বেগমের চক্রান্ত করার সুযোগ হয়ে যায়। পাশাপাশি কুশলী ইংরেজ গভর্নর রজার ডেরেক পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চাইলেন। সব মিলিয়ে যুবক সিরাজদ্দৌলার পক্ষে এ ধরনের অস্বাভাবিক ঘটনায় উপযুক্ত ও কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয়নি। ক্ষিপ্ত সিরাজদ্দৌলা এবার প্রতিটি ক্ষেত্রে ইংরেজদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করেন। তিনি মুর্শিদাবাদের কাছাকাছি কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি দখল করে কলকাতার দিকে অগ্রসর হন। ইংরেজরা প্রথম থেকেই নবাবকে প্রতিরোধ করার মতো সাহস রেখেছিল; কিন্তু তাদের সামরিক ছাউনিতে উপযুক্ত সংখ্যায় সৈন্য ছিল না। এতে তাদের মনে ত্রাস সৃষ্টি হয়। তাই তারা নবাবের বাহিনীর আগমন বুঝতে পেরে কুঠি ত্যাগ করে। গভর্নর ডেরেক সপরিবারে চেপে বসেন একটি জাহাজে। এর পর পুরো কুঠি নবাবের আনুকূল্যে চলে যায়। আর কুখ্যাত অন্ধকূপ হত্যার গাঁজাখুরি গল্প ফাঁদা  হয় ঠিক এর পর পরই। কলকাতার পতন হলে ভারতে অবস্থানরত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা নড়েচড়ে বসেন। দীর্ঘ বৈঠকের পর কলকাতা পুনরুদ্ধারের জন্য সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করার উদ্যোগ নেয়া হয়। ছয় সপ্তাহের প্রস্তুতি চলে সেন্ট ডেভিড দুর্গে। 

বাহাদুর শাহ জাফর : মূলত জোব চার্ণকের সহস্র দোষ ছিল এবং সুতানুটিতে যখন সে  ১৬৯০ সালে পৌঁছেছিল  তার তিনবছর পরই সে যৌনরোগের কারণে দেহত্যাগ করে তাই কখনই তাঁকে কলকাতা শহরের প্রতিষ্ঠাতা বলা সম্ভব নয়। এরপর ১৬৯৬সালে চার্লস আয়ার(জোব চার্ণকের জামাই) কলিকাতা কুঠীর এজেন্ট হিসাবে নিযুক্ত হয়। সেই সময় চার্লস আয়ার চক্রান্ত করে আওরঙজেবের পৌত্র পাটনা-নিবাসী আজিম উস শানের থেকে একটা সনদ নিয়ে আসে। এই সনদটি আনবার জন্য আজিম উস শানকে ষোল হাজার টাকা ঘুষ দিয়েছিল কোম্পানি । তাতে লেখা থাকে যে বাংলার সকল জমিদারদের ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে সাহায্য করতে হবে। কিন্তু সাবর্ণরা এই আদেশপত্রে সাক্ষর করতে রাজি ছিলেন না তবুও সম্রাটের আদেশ মতন বড়িশার আটচালায় চার্লস আয়ারের সাথে সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের প্রজাসত্ত্ব হস্তান্তরিত হয় বার্ষিক ১৩০০টাকা খাজনার বিনিময়ে। এই খাজনা ব্রিটিশ কোম্পানি ১৭৫৭ সাল অবধি সাবর্ণদের দিতো । সুতরাং কলকাতা কখনই বিক্রি করে দেওয়া হয়নি। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ আমলে কলকাতায় বড় বর ইমারত তৈরি হলেও প্রথম ইমারতটি তৈরি হয়েছিল জমিদার সাবর্ণ চৌধুরীদের আমলেই। সুতরাং সাবর্ণরা প্রজাসত্ত্ব হস্তান্তরিত করেছিল, জমিদারিসত্ত্ব নয়। এই প্রজাসত্ত্ব ছিল বাদশাহের অধীনস্থ তালুকদারের অধিকার। কেন না, অন্যান্য জায়গীরের মতন সুতানুটি, কলিকাতা এবং গোবিন্দপুরের জমিদারিসত্ত্ব বিক্রি করার অধিকার সাবর্ণদের ছিল না। সুতরাং এতদিন যারা এই বিক্রি করার গল্প সাজিয়েছেন তারা নিতান্তই ব্রিটিশ তোষণের জন্যই করেছেন এর কোন বাস্তবিক ভিত্তি নেই। সুতরাং কলকাতার জনক আজিম উস শান ।

 মীর মোহাম্মদ আলী খান : লোকে আমাকে মীরণ নামে এক ডাকে চেনে । আমি পলাশী ষড়যন্ত্রের পরবর্তী ঘটনাগুলোর প্রধানতম নায়ক। আমিই সিরাজের মূল হত্যাকারী, সিরাজের মাতা আমেনা বেগম, সিরাজের ভাই মির্জা মেহেদীকেও নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করেছিলুম । আমারই নির্দেশে মোহাম্মদী বেগ সিরাজকে খুন করে। শুধু খুন  নয় ; সিরাজউদ্দৌলার লাশকে আমি ক্ষত বিক্ষত করে তারই প্রিয় হাতির পিঠে  বেঁধে গোটা মুর্শিদাবাদ শহর ঘুরিয়েছিলুম যাতে সবাই এই বীভৎস দৃশ্য দেখে যেনো পরবর্তীতে বাংলার বুকে বিদ্রোহ করতে না পারে।  সিরাজের মা আমেনা বেগম তার ছেলের লাশ দেখার জন্য দৌড়ে হাতির কাছে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান আর সে’সময় মীরণের স্যাঙাতরা সিরাজের মাকে কিল, চড় ও ঘুষি মেরে আবার জেলখানায় বন্দী করে রাখে। হাতিটা কিন্তু সে সময় সিরাজের লাশ তার পিঠে নিয়ে আমেনা বেগমের সামনে বসে পড়ে। আমার মৃত্যু ঘটে বজ্রপাতে। মীর জাফর তখনও বাংলার নবাব। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতই পিতার কানে সে সংবাদ পৌঁছেছিল। তিনি মীরণের মৃত্যু শুনে বেঁহুশ হয়ে পড়েন। মুর্শিদাবাদে মীরণের লাশ, নিয়ে আসা হলো। কি বীভৎস বিকৃত পোড়ালাশ। পিতাকে না দেখতে দিয়ে লাশ দাফন করা হলো। এভাবেই মীরণের মৃত্যু। এটা আর কিছুই নয় আসল ঘটনাকে চাপা দেওয়ার একটা কৌশল মাত্র। মীরণকে খুন করে ইংরেজদের নির্দেশে মেজর ওয়ালস্। তবে  এই ঘটনাটা ধামাচাপা দেয়ার জন্য ইংরেজরা বজ্রপাতে মীরণের মৃত্যুর মিথ্যা গল্প বানিয়েছিল।

 মোহাম্মদী বেগ : আমি ছিলুম নবাব আলীবর্দী খাঁর খাস চাকর। আলীবর্দী খাঁর আমল থেকেই তাঁর পরিবারের একজন সদস্যরূপে তাঁরই স্নেহছায়ায় আমি বেড়ে উঠি। সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গেও আমার বিশেষ সখ্যতা ছিল। সিরাজউদ্দৌলাকে মীরণের নির্দেশে হত্যা করেছিলুম আমি । আমি একটা খঞ্জর দিয়ে আঘাত করে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলুম। দিনটি ছিল ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দের ৩’রা জুলাই। নবাব সিরাজ এ সময় আমার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাননি । তিনি কেবল আমার কাছ থেকে দু’রাকাত নামাজ পড়ার অনুমতি চেয়েছিলেন। বলাবাহুল্য  সিরাজের সেই অন্তিম ইচ্ছাও প্রত্যাখ্যান করেছিলুম।  সংসারের দাম্পত্য কলহে বদ্ধ উম্মাদ হয়ে গিয়েছিলুম আর একদিন কুঁয়োয় ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করি। 

 ইয়ার লতিফ খান : আমি ছিলুম নবাব সিরাজের একজন সেনাপতি।  পলাশী ষড়যন্ত্রের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলুম। পলাশীর যুদ্ধের মাঠে আমার সেনারা মীর জাফর, রায় দুর্লভের বাহিনীর মতন কাঠের পুতুল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। যুদ্ধের পরে বখরা দেবার ভয়ে ইংরেজরা আমাকে খুন করে লাশ লোপাট করে দিয়েছিল ।

মেহের উন নিসা বেগম : লোকে আমাকে ঘসেটি বেগম নামেই বেশি চেনে । আমি  নবাব আলীবর্দী খানের বড় মেয়ে। বিয়ে হয়েছিল নওয়াজিস মুহম্মদ শাহমাত জং-এর সাথে  যিনি  ঢাকার নায়েব নাজিম নিযুক্ত হয়েছিলেন। নিঃসন্তান হওয়ায় আমি আর আমার স্বামী সিরাজউদ্দৌলার ছোটো ভাই ইকরামউদ্দৌলাকে দত্তক নিয়েছিলুম। কিন্তু ইকরামউদ্দৌলা তরুণ বয়সে গুটিবসন্তে মারা যায়।  নওয়াজশ মুহম্মদ দুঃখে মারা যান। আমি উত্তরাধিকার সূত্রে  স্বামীর  প্রচুর সম্পদ পেয়েছিলুম । নবাব আলীবর্দী খান মারা যাবার পরে, আমি চেষ্টা করছিলুম দ্বিতীয় বোন মায়মুনা বেগমের ছেলে শওকত জংকে সিংহাসনে বসানোর। কিন্তু সিরাজউদ্দৌলা সিংহাসনে বসতে করতে সমর্থ হয়। শেষে, তিনি আলীবর্দী খানের সেনাপতি মীর জাফর, ব্যবসায়ী জগৎ শেঠ আর উমিচাঁদের সঙ্গে গোপনে ষড়যন্ত্র করি। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলা হেরে যাবার পর ইংরেজরা মীর জাফরকে নবাব বানায়।মীর জাফর, আমাকে ঢাকার জিনজিরা প্রাসেদে বন্দি করে রেখে ডিয়েছিল। কিন্তু আমাকে বিপদজনক শত্রু মনে করে, মীর জাফরের ছেলে  মীরন আমাকে ১৭৬০ সালে মুর্শিদাবাদ ফেরত নিয়ে আসার আদেশ দেয়। , মুর্শিদাবাদ ফেরার পথে আমাদের নৌকো খরস্রোতা বুড়ীগঙ্গা নদীতে পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক আমাকে নৌকায় তুলে বুড়ীগঙ্গা নদীতে নৌকা ডুবিয়ে মেরে ফেলে। আমার আর্তনাদ আহাজারী নদীর কিনার থেকে নিশুতি রাতে পথচারীরা শুনতে পেয়েছিল।

ওয়াটস : আমি কোম্পানির একজন আমলা । পলাশীর যুদ্ধে  ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল আমার। আমি পাল্কীতে করে বউ  সেজে মীর জাফরের বাড়িতে গিয়ে চুক্তিতে মীর জাফরের স্বাক্ষর এনেছিলুম। পলাশীর যুদ্ধের পর কোম্পানীর কাছ থেকে বরখাস্ত হয়ে মনের দুঃখে ও অনুশোচনায় ইংল্যান্ডে হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যাই।

প্রদোষচন্দ্র মিত্র : সাম্রাজ্যবাদের পূজারিরা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে জোব চার্নককে কলকাতার ‘বাবা’র আসনে বসানোর যত অপচেষ্টাই করুন না কেন, কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের এবং ভারতবর্ষের মানুষ তা প্রত্যাখ্যান করবেনই। প্রসঙ্গত শেষ বার যখন চার্নক সুতানুটিতে এসেছিলেন তখন তিনি বর্তমান বেনেটোলা আর শোভাবাজারের মধ্যবর্তী মোহন টুনির ঘাটে নেমেছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। তবে জোব চার্নক কলিকাতা বা গোবিন্দপুরে আসেননি, কারণ তিনি গুপ্তরোগে আক্রান্ত ছিলেন। এবং তাঁর অবস্থা ছিল বড়োই শোচনীয়। প্রায় দু’শো লোক তখন জ্বরে ও ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত। তার ওপর তিনিও আক্রান্ত। শেষ বয়সটা সুতানুটিতে কাটিয়ে তাঁর জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। তা হলে তাঁকে কেন কলকাতার জনক বলা হবে? তা ছাড়া কলকাতা নামের উৎপত্তি বহু প্রাচীন গ্রন্থেই পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকদের অনুমান, কলকাতা দু’ হাজার বছরের পুরোনো এক জনপদ। ‘আইন-ই-আকবরি’র রাজস্ব আদায়ের খতিয়ানে ‘কলিকাতা’ নামের উল্লেখ আছে। বিপ্রদাস পিপলাইয়ের ‘মনসাবিজয়’ কাব্যে (১৪৯৫-৯৬), কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এ কলিকাতার উল্লেখ পাওয়া যায়। ওলন্দাজ বণিক ফান ডেন ব্রুক-এর অঙ্কিত মানচিত্রেও কলকাতার উল্লেখ রয়েছে। ‘পদ্মাবতী’র রচনাকাল আনুমানিক ১৬৪৫-৫২ সাল। সেই গ্রন্থেও কলকাতা রয়েছে। তা হলে কখনোই জোব চার্নককে কলকাতার জনক বলা যায় না। তা ছাড়া চার্নক আসার বহু আগে থেকেই কলকাতা ধীরে ধীরে শহরে রূপান্তরিত হতে শুরু করে – পাকাবাড়ি, পাকা রাস্তা, বাণিজ্যনগরীর নানান কাজও শুরু হয়ে যায় চার্নক আসার বহু আগে থেকেই। তাই এ তত্ত্ব কখনোই সমর্থনযোগ্য নয় যে জোব চার্নক কলকাতার জনক ।

Posted in Uncategorized | Leave a comment

কলকাতা বিক্রি আছে – পোস্টমডার্ন নাটক : মলয় রায়চৌধুরী

কলকাতা বিক্রি আছে – পোস্টমডার্ন নাটক : মলয় রায়চৌধুরী 

নুরুদ্দিন মহম্মদ জাহাঙ্গীর বাদশাহ গাজী : আমি সিংহাসন দখল নিয়ে ব্যস্ত ছিলুম বলে ইংরেজগুলো সুবে বাংলায় ঢুকে পড়তে পেরেছিল।৩৬ বছর বয়েসে  বাবা মারা যাবার ৮ দিন পর ৩০ নভেম্বর, ১৬০৫  থেকে আমার ২২ বছরের রাজত্বের শুরু। মনে রাখিস লক্ষ্মীকান্ত, জায়গিরটা আমিই তোদের দিয়েছি, যদিও সুন্দরবনের লাগোয়া বলে তোরা নিতে চাইছিলিস না । তা আমি কী করব বল ! ভবানন্দ মজুমদার ছিল আমাদের খোচর । ওকে ভালো জমিজমা দিতে হলো । তোরা প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে আমাদের হেল্প করলে তিন ফসলি জমিজমা পেতিস । যারা ইতিহাস লিখবে তাদের বলে দিস যে কলকাতার জনক আসলে আমি, কেননা আমিই গ্রামগুলো তোদের দিয়েছি।

সুবাহার ইবরাহিম খান : দ্যাখ জোব চার্ণক, জমি আমি দিচ্ছি, তোরা আবার গোয়ার পর্তুগিজদের মতন দুর্গ খাড়া করিসনি যেন  । সুতানুটি, গোবিন্দপুর আর কলিকাতা গ্রাম তিনটে  মুঘল সম্রাটের খাসমহলের জমি, বাদশা জাহাঙ্গির সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের দিয়েছে জায়গিরটা । আমি তোকে ব্যবসা করার সুবিধে করে দিলুম । ইতিহাসে লিখতে ভুলিসনি যে কলকাতার জনক আমি ।

বিদ্যাধর রায়চৌধুরী : কিন্তু সুবাহদার, এই গ্রাম তিনটের জায়গিরদারি তো সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের । আমাদের যৎসামান্য আয় হয় গ্রামগুলো থেকে ; প্রজারাও আমাদের ভালোবাসে । ইংরেজরা দিল্লির বাদশাকে মাত্র ষোলো হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে কাজ হাসিল করে ফেললো । আমরাই তো এই গ্রামগুলোর জনক । 

ভিদকুন কুইসলিঙ : আমার আসল নাম সৈয়দ মীর জাফর আলী খান, ইরান থেকে এসে আলীবর্দী খানের সৈন্যদলে যোগ দিয়েছিলুম, বাংলা বিশেষ বলতে পারি না, ফারসিতে কাজ চালাই । তা যতোই প্রজারা ভালোবাসুক । তোমরা তো ক্লাইভকে তুষ্ট করতে পারোনি । সিরাজের যুদ্ধ আদ্যন্ত এক ‘বেওসা’, যার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাবে মুনশি নবকেষ্টর মতো লোক রাতারাতি মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুর হয়ে গেল। শোভাবাজার রাজবাড়ি এখন তাই বিয়ে, অন্নপ্রাশন, উপনয়নের জন্য ভাড়া দেয়া হয়। ওরা মনে করে ওরাই কলকাতার জনক । আমাকেই লোকে অযথা দোষ দ্যায় । এই নবকেষ্ট তো ক্লাইভের জন্যে মানত করে দূর্গাপুজোও করে ফেলল । নবকেষ্টর বংশধররা  জোব চার্ণককে কলকাতার জনক বলে উঠেপড়ে লেগেছিল ; হাইকোর্টে মামলায় হেরে গিয়ে এখন তারা ফিবছর সুতানুটি উৎসব চালায় ।

মির্জা মুহম্মদ সিরাজ-উদ-দৌলা :  শোভাবাজর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নবকৃষ্ণ দেব পলাশীর যুদ্ধের আগে  ছিল  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুন্সি, পরে হয়েছিল সুতানুটির তালুকদার। এর পরে ওয়ারেন হেস্টিংসের মুন্সি, তারপর ড্রেক সাহেব তেজাউদ্দীনকে কোম্পানির মুন্সির পদ থেকে সরিয়ে সেখানে বসালে নবকৃষ্ণকে।পলাশীর যুদ্ধের ফলে নবকৃষ্ণের কপাল খুলে গেল। মীরজাফর, রামচাঁদ রায়, আমীর বেগ আর নবকৃষ্ণ মিলে আমার লুকোনো কোষাগার লুঠ করে বহু কোটি টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ বাঁটোয়ারা করে নিলে। নবকৃষ্ণ কেবল টাকাই পেলো না ! বাড়তি পাওনা পেল সম্মান ও ক্ষমতা ।১৮৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশির রণাঙ্গনে মীরজাফরের বেইমানির দরুণ ইংরেজ সেনপতি ক্লাইভের হাতে আমার পরাজয় ঘটলে সবচেয়ে যারা উল্লসির হয়েছিল তাদের মধ্যে ছিল হিন্দু বিশ্বাসঘাতকরা, নদিয়ার কৃষ্ণচন্দ্র আর কলকাতার নবকৃষ্ণ। কোম্পানির জয়কে তারা হিন্দুর জয় বলে প্রচার চালালো। ধূর্ত ক্লাইভও তাদের তেমনই বোঝালো। ক্লাইভের পরামর্শেই তারা পলাশীর যুদ্ধের বিজয়-উৎসব করার আয়োজন করলো।বসন্তকালীন দুর্গাপুজোকে তাঁরা পিছিয়ে আনলো শরৎকালে ! ১৭৫৭ সালে বহু টাকা খরচ করে শরৎকালীন দুর্গাপুজো করে তারা পলাশীর যুদ্ধের স্মারক উৎসব পালন করলো ! অন্যা হিন্দু জমিদার আর ব্যবসাদাররাও মহা উৎসাহে সেই ফূর্তিতে যোগদান করলো ! হেরে গেলেও, আমিই মালিক । আমাকে কলকাতার জনক মনে করা উচিত ।

জুডাস ইসকারিয়ট : আমার আসল নাম রায় দুর্লভরাম । আমাকে কেন কলকাতার জনক মনে করা হবে না ? আমি তো বাংলার নবাবি শাসনামলের একজন কর্মকর্তা। আমি নবাব আলীবর্দী খানের অধীনে উড়িষ্যার প্রাদেশিক শাসনকর্তা পদে ছিলুম। বাংলায় মারাঠা আক্রমণকালে আমি বাংলার নবাবের পক্ষে মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিই। যদিও পলাশীর যুদ্ধের সময়  নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ইংরেজদের সহযোগিতা করেছিলুম আর যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত ছিলুম।  বিশ্বাসঘাতকদের জন্যেই তো ক্লাইভ জিতেছিল । আমি বিশ্বাসঘাতকতা না করলে কলকাতা দখল করে ক্লাইভের মুণ্ডু ধড় থেকে আলাদা করে দিতো সিরাজদ্দৌলা।আমাকে কলকাতার জনক মনে করা উচিত।১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে মীর কাশিম ইংরেজদের সাথে বক্সারের যুদ্ধে যাবার প্রাক্কালে ষড়যন্ত্রকারী আমার গলায় বালির বস্তা বেঁধে মুঙ্গেরের দূর্গশীর্ষ থেকে জীবন্ত দেহ নিক্ষেপ করে গঙ্গার বুকে। এভাবেই গঙ্গার বক্ষে সলিল সমাধি হয় আমার।

দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর : বড় লোকেদের যেন একটা ধারণা ছিল যে ভাল মন্দ বিচার না করিয়া খুব খরচ করিতে পারিলেই সমাজের মধ্যে প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পাইবে। মাতৃশ্রাদ্ধে নবকৃষ্ণ দেবের ন’লক্ষ টাকা খরচের পিছনে এই উদ্দেশ্য উঁকি দেয়। তাঁর মাতৃশ্রাদ্ধ উপলক্ষে যে সভা হয় এবং যেখানে সমবেত অভ্যাগত ও পণ্ডিতগণের আবাসস্থল এবং কাঙালিদের জন্য পণ্যবীথিকা সংস্থাপিত হয়, তা থেকে উক্ত অঞ্চলের নামকরণ হয় সভাবাজার বা শোভাবাজার (পূর্ব নাম রাসপল্লি)। ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ক্লাইভের চেষ্টায় তিনি ‘মহারাজা বাহাদুর’ উপাধি ও ৬-হাজারি মনসবদারের পদ পান। তাঁর অধীনে আরজবেগী দপ্তর, মালখানা, চব্বিশ পরগনার মাল আদালত, তহশিল দপ্তর প্রভৃতি ছিল। পরে তিনি কোম্পানির কমিটির রাজনৈতিক বেনিয়ান হন।তিনি ও তাঁর বংশজগণ প্রায় শতাধিক বছর ধরে ক্ষমতা ও প্রভাব বহাল রেখেছিলেন।১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে বিজয় লাভে শোভাবাজার রাজবাড়িতে রাজা নবকৃষ্ণ দেব লর্ড ক্লাইভের সম্মানে দুর্গাপূজার আয়োজন করে বিজয় উৎসব পালন করেন। সেই থেকে প্রতি বৎসর শোভাবাজার রাজবাড়িতে দুর্গাপূজার আয়োজন হয়ে থাকে। । সিরাজদ্দৌলার কোষাগার থেকে চুরি করা টাকায়  নবকৃষ্ণ দেব রাজবাড়িটি নির্মাণ করেন ।পলাশির পরে কলকাতার সামাজিক সাম্রাজ্যে তিনি হয়ে উঠলেন প্রায় মুকুটহীন সম্রাট। তাঁর সামাজিক গুরুত্ব তখন রাজনৈতিক নেতাদের থেকে বেশি। এই সামাজিক গুরুত্ব লাভে তাঁকে সাহায্য করেছিল তার সরকারি পদের গুরুত্ব এবং কলকাতার কোম্পানির কর্তাদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক। নিজের সামাজিক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে তিনি কলকাতায় ডেকে এনেছিলেন উঁচুদরের কুলীনদের। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের দান করেছিলেন জমি, বাড়ি ইত্যাদি। এই সবই দলপতি হওয়ার পূর্বপ্রস্তুতি। দলপতি হতে প্রয়োজন ছিল বিত্ত-বৈভব প্রদর্শন। তার মাধ্যম ছিল শ্রাদ্ধ, বিয়ে বা অন্য পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে অপরিমিত অর্থব্যয়। সে কালে ধনীদের দু’হাতে দানধ্যান করাকে বদান্যতা ভাবলে ভুল হবে। নবকৃষ্ণ কলকাতার দুষ্টক্ষত । আমরা জোড়াসাঁকো পরিবারই কলকাতার জনক; আমাদের ছাড়া কলকাতা অচল ।

আজিম-উশ-শান : ঘাবড়াসনি বিদ্যাধর । ব্রিটিশ বসতি  অন্য ভূস্বামীদের আরও আটত্রিশটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। এটা  ১৭১৭ সাল । ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে  তোদের গ্রামের জমিদারি সত্ব দিলেও, অন্য জমিদারদের কাছ থেকে ওরা বাকি গ্রামগুলো কিনতে  পারেনি। তোর টাকাকড়ি জমিয়ে রাখতে পারলি না ; সবাই একগাদা বিয়ে করে গুচ্ছের বাচ্চা পয়দা করলি । যাই হোক, সব গ্রামগুলো তো মুঘল বাদশার । তাই আমিই কলকাতার জনক, মনে রাখিস ।

বিদ্যাধর রায়চৌধুরী : আমরা  ব্রিটিশদের এই তিনটে গ্রাম ছেড়ে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলুম না ।  ব্রিটিশরা মুঘল রাজদরবারে ঘুষ দিয়ে এই গ্রাম তিনটের ইজারা কেনার অনুমতি আদায়ে সমর্থ হয়েছে। এটা ১৬৯৮ সাল । আপনারা ইংরেজদের হাতে গ্রাম তিনটে তুলে দিতে বাধ্য করলেন। ওরা বার্ষিক মাত্র ১,৩০০ টাকা রাজস্বের বিনিময়ে গ্রাম তিনটের ইজারা কিনে নিলে। চুক্তিপত্রটা ফার্সি ভাষায় লেখা ; ভাগ্যিস আমাদের পরিবারে সবাই ফার্সি ভাষা জানে । আপনি তো জানেন এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা জিয়া গঙ্গোপাধ্যায়  সন্ত কামদেব ব্রহ্মচারী নামে সন্ন্যাসী হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর ছেলে লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়  ১৬০৮ সালে  মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে সুন্দরবনের লাগোয়া ভূসম্পত্তি জায়গির হিসেবে পেয়েছিলেন।  মুঘল সম্রাট আকবর আমাদের ‘রায়’ আর জাহাঙ্গির  ‘চৌধুরী’ উপাধি দিয়েছিলেন। তাই ‘রায়চৌধুরী’ আমাদের পদবিতে পরিণত হয়েছে। আমরা দাবি করি না যে আমরা কলকাতার জনক । 

আজিম-উশ-শান : আমিই বা কী করব ? শায়েস্তা খান এর উত্তরাধিকারী সুবাহদার ইবরাহিম খান বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্য আবার শুরু করতে ব্রিটিশদের ডেকে পাঠিয়েছিল। দুটো প্রধান বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে জব চার্নক নামে ওদের একজন প্রতিনিধি সুবাহদারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছিল। একটা ছিল ইংরেজদের বসতি হুগলি থেকে সুতানুটিতে স্থানান্তরের প্রস্তাবে সরকারকে অবশ্যই রাজি হতে হবে। দ্বিতীয়ত, বার্ষিক পূর্বনির্দিষ্ট ৩০০০ টাকা কর পরিশোধের বিনিময়ে কোম্পানিকে বাংলায় শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের অনুমতি প্রদানকারী একটি ফরমানের দ্বারা সুবাহদার তাদের অনুমতি দেবেন। সুবাহদার ইবরাহিম খান তাদের তোলা দুটো প্রস্তাবই মেনে নিলে । মনে হচ্ছে কলকাতা নামের বাচ্চাটার বাপ অনেকগুলো ।

বিদ্যাধর রায়চৌধুরী : হ্যাঁ, জব চার্ণক মারা যাবার পর ওর জামাই  ক্যাপ্টেন চার্লস আয়ারকে আমরা ১৬৯৮ সালের ১১ই নভেম্বর কলকাতা – সুতানুটি – গোবিন্দপুর গ্রাম তিনটের প্রজাস্বত্ব মাত্র ১৩০০ টাকায় একটি দলিলের দ্বারা দান করে দিতে বাধ্য হয়েছিলুম, তার কারণ আপনারা ঘুষ খেয়ে আমাদের ওপর চাপ দিয়েছিলেন । আমরা এখানকার জায়গিরদার  অথচ মুঘলরা আমাদের গুরুত্ব দিল না । দলিলটা আমরা  সই করেছিলুম আটচালা বাড়িতে, যেখানে আজও আমরা দূর্গাপুজো করি । ক্লাইভের চামচা নবকৃষ্ণদেবের অনেক আগে থেকে আমাদের পুজো হয় । আমরা ক্লাইভের পোঁদে তেল দিতে রাজি হইনি । রাজা বা মহারাজা খেতাব আমাদের দরকার পড়েনি, নবকৃষ্ণ আর কৃষ্ণচন্দ্রর মতন ।

বেনেডিক্ট অ্যারনল্ড : আমার আসল নাম মীর মুহম্মদ কাসিম আলী খান । শোভাবাজার রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা নবকৃষ্ণ দেব সম্পর্কে এই কথাটি অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়। পিতৃহীন অবস্থায় কলকাতার কাছে গোবিন্দপুরে এসে থাকতে শুরু করে। বলা ভালো, অত্যন্ত সাধারণ অবস্থা ছিল। কিন্তু বুদ্ধি ছিল প্রখর। নিজের চেষ্টায় উর্দু, আরবি, ফার্সি শিখেছিল। ইংরেজ সরকারের হয়ে কাজ করার জন্য সমস্ত রকম গুণই তার মধ্যে বর্তমান ছিল।  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামান্য মুনশী হিসেবে জীবন শুরু হয় নবকৃষ্ণ দেবের। সরকারি কাজকর্মের পাশাপাশি ওয়ারেন হেস্টিংসকে ফার্সি ভাষা শেখানোর কাজ করতো। বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে রবার্ট ক্লাইভ। সিরাজের পক্ষে আছে মীরজাফর। ক্লাইভ তখন নিশ্চিন্ত ।  সময়মতো নবাবের পক্ষ ত্যাগ করল মীরজাফর। ‘ইনাম’স্বরূপ মীরজাফর নবাবের গদিতে বসল। কিন্তু পেছনে থেকে লাভবান হলো আরও দুজন।  কৃষ্ণচন্দ্র এবং নবকৃষ্ণ দেব। মীরজাফরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইতিমধ্যেই তারা খুঁজে পেয়েছে সিরাজের গোপন কোষাগার। সবাই সেই বিপুল ধনসম্পত্তি ভাগাভাগি করে নেয়। তা সত্তেও নবকৃষ্ণের ভাগে কম কিছু পড়েনি। দেখতে দেখতে বিশাল ধনদৌলতের মালিক হয়ে গেল নবকৃষ্ণ। শুধু টাকাই নয়, এল সম্মানও। ইংরেজদের পক্ষ নেওয়ার জন্য পেল ‘রাজা বাহাদুর’ খেতাব; অতঃপর ১৭৬৬ সালে ‘মহারাজা বাহাদুর’। সবথেকে বড়ো কথা, গোটা সুতানুটি অঞ্চলের তালুকদার হয়ে গেল । সামান্য মুনশী থেকে বিশাল সাম্রাজ্য ও ধন-দৌলতের মালিক— এমনই চমকপ্রদ উত্থান রাজা নবকৃষ্ণ দেবের। সেইসঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হল শোভাবাজার রাজবাড়ি । তখন সবে পলাশীর যুদ্ধ শেষ হয়েছে। নবকৃষ্ণদেব ভীষণ খুশি। আর এখানেই ধর্মের তাসটি খেললেন চতুর ক্লাইভ। নিজে খ্রিস্টান, মূর্তিপূজার ঘোর বিরোধী; তা সত্তেও নবকৃষ্ণকে বোঝালেন কলকাতায় একটি বিজয় উৎসব করার জন্য। ‘হিন্দু ভাবাবেগ’ রক্ষা পেয়েছে বলে কথা ! কিন্তু কীভাবে হবে উৎসব? নবকৃষ্ণ ঠিক করলেন, দেবী দুর্গার আরাধনা করেই তুষ্ট করবেন ক্লাইভকে। শুরু করবেন বিজয় উৎসব। ১৭৫৭ সালেই নিজের নবনির্মিত ঠাকুরদালানে শুরু করলেন অকাল বোধন। শুরু হল কলকাতার দুর্গাপূজা। তাতে একশো এক টাকা দক্ষিণাও পাঠিয়েছিলেন ক্লাইভ ! বিশাল আয়োজন করে শুরু হল শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো। কালে কালে যা শহরের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে গেছে । বিশ্বাসঘাতকের পুজোতে ভোগ খেয়ে বাঙালিও সেই বিশ্বাসঘাতকতা আর কোষাগার চুরির অংশভাক। চুরির টাকা খরচ করে কলকাতার জনক হতে চাইছে ওর বংশধররা । 

মহারাজা প্রতাপাদিত্য : মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়   নদীয়ার রাজা আর কৃষ্ণনগর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদারের বংশধর। ভবানন্দ আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে রাজবংশ শুরু করেছিল । কৃষ্ণচন্দ্রের কৃষ্ণনগরেই তাঁর জন্ম; বাবা রঘুরাম রায়। রক্ষণশীল এই হিন্দু রাজা বাংলা, সংস্কৃত ও ফারসি ভাষায় সমান ব্যুৎপন্ন ছিল। কৃষ্ণচন্দ্র ছিল রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন কূটকৌশলী লোক। তার ষড়যন্ত্রে বাংলায় ইংরেজ শাসন কায়েম হয় এবং মুসলমান রাজত্বের অবসান ঘটে। এই রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ও ইংরেজদের সঙ্গে মিত্রতা করে আর ক্লাইভের পক্ষ নিয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন ত্বরান্বিত করেছিল। ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় নবাব  মীর কাসেম তাকে বন্দি করে মৃত্যুদন্ড দিলে ইংরেজদের সহায়তায় ও মুক্তি পায়। ইংরেজদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের পুরস্কার হিসেবে  ইংরেজ কর্তৃক ‘মহারাজা’ উপাধিতে ভূষিত হয়। তদুপরি ক্লাইভের কাছ থেকে উপঢৌকন হিসেবে পায়  পাঁচটা কামান। সে সময়ে বাংলায় যে বর্গীর আক্রমণ হতো তা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ও নিজের রাজধানী ‘শিবনিবাস’ নামের জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল। ক্লাইভের চামচা হিসেবে ওরা তো নিজেদের কলকাতার জনক দাবি করতেই পারে ।

জয়চাঁদ : আমার আসল নাম নবকৃষ্ণ দেব ।পলাশীর যুদ্ধের আগে বাংলা অঞ্চলে সাতজন হিন্দু রাজা ছিল। এদের মধ্যে রাজনৈতিক দিক থেকে বিচক্ষণ নদীয়ার শাসক মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় উপলব্ধি করে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় মুসলমানদের শাসনের দিন ফুরিয়ে এসেছে। অন্যদিকে ব্রিটিশদের উত্থান ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। বিষয়টি তিনি অন্য ছয়জন হিন্দু রাজাকেও বোঝাতে সক্ষম হন। কৃষ্ণচন্দ্র অন্য হিন্দু রাজাদের আরও বোঝাতে সক্ষম হন যে, তাদের সনাতন ধর্ম মুসলমানদের হাতে নিরাপদ নয়, বরং ব্রিটিশদের হাতে নিরাপদ। ফলে সব হিন্দু রাজার সমর্থন নিয়ে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় হাত মেলায় রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে। ইংরেজদের সঙ্গে এই সখ্যতা এমন পর্যায়ে পৌঁছোয় যে, রবার্ট ক্লাইভ পলাশীর যুদ্ধ-ময়দানে যাওয়ার সময় কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের প্রাসাদে রাত কাটিয়েছিল । যুদ্ধের পর ইংরেজদের সঙ্গে এই সখ্য চললেও নবাব মীর কাশেমের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র। এই দ্বন্দ্বের রেশ ধরেই কৃষ্ণচন্দ্র রায়কে মৃত্যুদণ্ড দেন মীর কাসিম। কিন্তু ক্লাইভের বদান্যতায় বেঁচে যায় আর রাজা খেতাব পায় ।বস্থায় মারা যান উমিচাঁদ

মার্কাস ব্রুটাস : আমাদের  পরিবারের নাম জগত শেঠ । পলাশীর যুদ্ধে একদিকে যেমন ইংরেজদের কূটকৌশল আর অস্ত্রশস্ত্র কাজ করেছিল, অন্যদিকে ঠিক তেমনিভাবে কাজ করেছিল আমার অঢেল টাকা। আমার আসল নাম মহাতাপ চাঁদ। আর  টাইটেল  জগৎ শেঠ, যার অর্থ পৃথিবীর ব্যাংকার। মূলত এই টাইটেলটা প্রথম লাভ করে আমার দাদা ফাতেহ চাঁদ। আমরা মাড়োয়ারি  পরিবার । মূলত সুদের কারবার আর ব্যাংকিংয়ে জড়িত । পলাশীর যুদ্ধের আগেই বংশ পরম্পরায় পিতামহের টাইটেল জগৎ শেঠ আমার নামে যুক্ত হয়।  য় জমিদাররা আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই খাজনা পরিশোধ করতো। আবার নবাবরাও দিল্লিতে খাজনা পাঠাতে আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করতো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে ইংরেজরা এদেশে আসতে থাকলে ইংল্যান্ডের মুদ্রার সঙ্গে ভারতীয় মুদ্রা বিনিময় করার প্রয়োজন দেখা দেয়। আর এ সুযোগটি গ্রহণ করি আমরা। বিশেষত ইংরেজরা ঘুষ আর দুর্নীতি বাবদ ভারতীয় মুদ্রায় যে অর্থ পেত তা ইংল্যান্ডের মুদ্রায় বা সোনা ও রত্নে বিনিময় করে দিতুম আমরা । তাই ইংরেজদের কাছে আমাদের কদর ছিল। ফলে নবাব সিরাজউদ্দৌলকে পলাশীর যুদ্ধে হারানোর ষড়যন্ত্রে ব্যাপক ভূমিকা নিই । পলাশীর যুদ্ধের পর মীর জাফরের আমলে ভালোই ছিলুম আমি, মহাতাপ চাঁদ আর খুড়তুতো ভাই  মহারাজ স্বরূপ চাঁদ। কিন্তু  মীর কাসিমের সঙ্গে খেয়োখেয়িতে জড়িয়ে পড়লে ওর বিরুদ্ধে  নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করতে বাধ্য হই। পলাশীর যুদ্ধের ছয় বছরের মাথায় ইংরেজদের কাছে  ষড়যন্ত্রমূলক একটি চিঠি লিখেছিলুম । কিন্তু চিঠিটা কেমন করে যেন  মীর কাসিমের হস্তগত হয়। এতে চটে  ওঠে  মীর কাসিম আর আমাকে মুর্শিদাবাদ থেকে তাড়ায় । এদিকে ১৭৬৩ সালে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে হেরে যায়  মীর কাসিম ।  মীর কাসিম এই অপমান মানতে পারেননি। ব্যাটা ছুটে আসে আমাদের নতুন আস্তানা মাংঘরে। মাংঘরে একটি টাওয়ারে আশ্রয় নিয়েও প্রাণ বাঁচতে পারিনি আমি।  মীর কাসিম আর ওর সৈন্যরা আমার, মহাতাপ চাঁদের, আর  স্বরূপ চাঁদসহ  পরিবারের সবার মুণ্ডু ধড় থেকে আলাদা করে দ্যায় । এই আত্ম বলিদানের জন্যে আমি দাবি করি যে আমিই কলকাতার জনক ।  

সুশীল চৌধুরী : ১৭৫৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বাংলার নওয়াব  সিরাজউদ্দৌলা ও ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়। নওয়াব কলকাতার ইংরেজ বসতি অধিকার করেন (১৮-২০ জুন ১৭৫৬) এবং ইংরেজরা তাঁর প্রকৃত ক্ষতিসমূহের প্রতিবিধান করতে অস্বীকার করলে তিনি তাদের কলকাতা শহর থেকে বিতাড়িত করেন। তিনি এ শহরের নতুন নামকরণ করেন আলীনগর। ইংরেজরা সাহায্যের আবেদন জানালে মাদ্রাজ থেকে ক্লাইভ এবং ওয়াটসন-এর অধীনে অতিরিক্ত সৈন্যবাহিনী উপনীত হয় এবং কলকাতা পুনর্দখল করে। নওয়াব কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু কলকাতার কাছে খুব ভোরে ইংরেজরা আকস্মিক আক্রমণ করলে নওয়াব পশ্চাদপসরণ করেন। ইংরেজরা তাঁকে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য প্রস্তাব দেয়। নওয়াব তাঁর প্রধান উপদেষ্টাবৃন্দ ও মন্ত্রীদের পরামর্শক্রমে এ চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তির প্রধান ধারাগুলি হলো ক. নওয়াব ১৭১৭ সালের ফররুখ সিয়ারের ফরমান এ প্রদত্ত সকল সুবিধা ইংরেজদেরকে দেবেন, খ. কোম্পানির দস্তক এর আওতায় বাংলার ভেতর দিয়ে যেসব পণ্যদ্রব্য অতিক্রম করবে সেগুলির ওপর থেকে শুল্ক তুলে নিতে হবে, গ. নওয়াব বিনা বাধায় কলকাতার ইংরেজ দুর্গটিকে সুরক্ষিত করার অনুমতি দেবেন এবং ঘ. কলকাতায় ইংরেজগণ স্বাধীনভাবে মুদ্রাঙ্কন করতে পারবে। এ চুক্তির শর্তাবলি বাংলায় ইংরেজদের অনুকূলে ছিল এবং সেখানে তাদের প্রভাব বৃদ্ধি করেছিল। ১৭৫৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ক্লাইভ সিলেক্ট কমিটির কাছে লিখেন যে, এ চুক্তির শর্তাবলি কোম্পানির জন্য ‘একই সঙ্গে সম্মানজনক ও সুবিধাজনক’। সিরাজউদ্দৌলার জন্য এ চুক্তি কিছুটা অপমানকর হলেও তিনি এটি মেনে নেন। তবে তিনি ইংরেজদের সামরিক বাহিনীর ভয়ে ভীত হয়ে একাজ করেন নি। তিনি বরং আহমদ শাহ আবদালীর নেতৃত্বে আসন্ন আফগান আক্রমণের আশঙ্কায় আলীনগরের চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। এ সময় তিনি খবর পেয়েছিলেন যে, আহমদ শাহ আবদালী দিল্লি ধবংস করার পর (১৭৫৬) বাংলার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। পরবর্তী ঘটনাবলি দ্বারা তাঁর ধারণা ভুল প্রমাণিত হলেও সম্ভবত তিনি মনে করেছিলেন যে, ওই মুহূর্তে ইংরেজরা নয় বরং আফগানরাই ছিল তাঁর জন্য অধিকতর বিপজ্জনক। এ কারণে তিনি রাজা রামনারায়ণের নেতৃত্বে তাঁর সামরিকবাহিনীর সেরা অংশটি আফগান বাহিনীকে বাধা দেওয়ার জন্য পাটনায় প্রেরণ করেছিলেন। যদিও এ চুক্তি বেশি দিন স্থায়িত্বলাভ করে নি। এর প্রধান কারণ, ইংরেজরা এর শর্তাবলি মেনে চলে নি। ফলে চুক্তিটি ভেঙ্গে যায় এবং ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। 

আহমদ শাহ দুররানি : আমি সুবে বাঙ্গাল আক্রমণের কথা ভাবিনি । কাফেরদের ধ্বংস করার কাজে ব্যস্ত ছিলুম । সিরাজ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলে ইংরেজদের তাড়াতে হেল্প করতে পারতুম । আমি শিখ গণহত্যায় কুখ্যাত হয়ে আছি, অমৃতসরে শিখদের পবিত্র স্বর্ণ মন্দিরে হামলা করে  ধংস্ব করে দিয়েছিলুম। এছাড়াও তিনি ১৭৪৬ ও ১৭৬২ সালে হাজার হাজার শিখকে খুন করেছিলুম।আফগানিস্তানে আমাকে লোকে বলে আহমদ শাহ বাবা ।

মার্শাল পেতাঁ : আমার নাম উমিচাঁদ । প্রকৃত নাম ছিল আমির চাঁদ। আমি একজন শিখ আর জন্মসূত্রে পাঞ্জাবের বাসিন্দা। কিন্তু কলকাতায়  দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করছিলুম আর অঢেল ধনদৌলত কামিয়েছিলুম। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতেও টাকা খাটিয়েছিলুম আর মুর্শিদাবাদ দরবারে কোম্পানির পক্ষে দালালি করতুম। এতে বেশ লাভবান হই । কলকাতায় অনেক ঘরবাড়ি কিনি । আরও লাভের আশায় আমিও গোপনে লর্ড ক্লাইভ আর মীর জাফরের সঙ্গে যোগ দিই।   পলাশীর যুদ্ধে নবাবকে হারিয়ে যে ধন-সম্পদ পাওয়া যাবে তার পাঁচ অংশ চেয়েছিলুম।  গোপন পরিকল্পনা ফাঁসের হুমকিও দিয়েছিলুম। ক্লাইভ ব্যাটা আমার প্রস্তাবে সম্মত হয়ে একটি চুক্তি করেছিল । চুক্তিটার যে দুটো কপি করিয়েছিল তা জানতুম না। যার একটাতে আমাকে অর্জিতব্য সম্পদের  পাঁচ ভাগ দেওয়ার কথা লেখা থাকলেও অন্যটাতে অর্থাৎ মূল কপিতে তা লেখা হয়নি। মূল কপি ব্যাটা আমাকে দেখায়নি । আসল ঘটনা জানার পরে আমি সত্যিই পাগল হয়ে গিয়েছিলুম ।  হ্রাস পায় আমার  স্মৃতিশক্তি।  অসহায় আর করুণ অবস্থায় দশ বছর উন্মাদ ছিলুম । ওই অস্হায় ১৭৬৭ সালে মারা যাই । এই যে ইংরেজদের ঢুকিয়ে আনলুম তাতে তো প্রমাণ হয় যে আমিই কলকাতার জনক ।

হুমায়ুন : দশম শতাব্দীতে যে পাঁচজন ব্রাহ্মণকে বাংলায় সর্বশ্রেষ্ঠদের মধ্যে অন্যতম বলে গন্য করা হতো, সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবার তাঁদের অন্যতম । তা সত্তেও ওদের চরিত্রে ক্ষত্রিয়ের তেজ দেখে  বংশের পঞ্চানন গঙ্গোপাধ্যায়কে খান উপাধি দিয়েছিলুম । ওরা রায়চৌধুরীর বদলে খান পদবী ব্যবহার করলে ভালো করতো । আফগান সেনাদের প্রধান হয়ে পঞ্চানন তো পাঁচু শক্তিখান নামে আগ্রা, দিল্লি, লাহোর, কাবুলেও খ্যাতি পেয়েছিল । ওকে শের শা্হ সুরি ডেকেছিল ওর পক্ষের সেনাপতি হবার জন্য, কিন্তু যায়নি । অবশ্য ওদের বংশই তো কলকাতার জনক হলো ।

পাঁচু শক্তিখান : হ্যাঁ, শের শাহ আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল, যাইনি কেননা মোগল সম্রাট আমাকে সন্মান দিয়েছেন ।মারাঠারা আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল ওদের সঙ্গে যোগ দিতে । ওদের গেরিলা যুদ্ধশৈলী পছন্দ ছিল না বলে যাইনি ।কে কলকাতার জনক হবে তা নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ ছিল না ।

ভোলা ময়রা : আমার নাম ভোলানাথ মোদক।  হুগলী জেলার গুপ্তিপাড়ায় জন্মছিলুম। বাবার নাম কৃপানাথ। কলকাতার বাগবাজারে আমার মিষ্টির দোকান ছিল। পাঠশালায় সামান্য লেখাপড়া করলেও সংস্কৃত, ফারসী ও হিন্দিতে জ্ঞান ছিল। পুরাণ ও ধর্মশাস্ত্র সামান্য পড়েছিলুম। কবির দল তৈরীর আগেও  বহু কবিতা রচনা করেছিলুম। কলকাতার অনেক খবরই রাখি । কলকাতার মাঝখানে এখনকার বিবাদীবাগের লালদিঘির কাছে সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের কাছারি আর গৃহদেবতা শ্যাম রায়ের  মন্দির  ছিল।  কাছারির দোল উৎসবের আবিরে দিঘির রং লাল হয়ে যেত বলে এই দিঘির নাম হয়েছিল লালদিঘি। জন অ্যান্টনি নামে এক পর্তুগিজ ভাগ্যান্বেষী সাবর্ণদের কাছারিতে কাজ করতো। তার পৌত্র অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি পরে বিখ্যাত কবিয়াল হয়েছিল।ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথমে এই কাছারিটা ভাড়া নেয় আর পরে কিনে নেয়। ওখানেই বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সচিবালয় মহাকরণ । আমার মনে হয় আমরা কবিয়ালরা কলকাতার জনক ।

মোহনলাল : ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধের সময় আমি সিরাজের প্রতি অবিচল বিশ্বস্ততায় যুদ্ধ করেছিলুম। যুদ্ধক্ষেত্রে মীর মদনের মৃত্যুর পরেও আমার একক চেষ্টায় যুদ্ধের গতি সিরাজের অনুকূলে ছিল। কিন্তু নিজের অদূরদর্শিতা ও মানসিক দুর্বলতার কারণে সিরাজ,  মীর জাফর প্রমুখ বিশ্বাসঘাতকদের প্রভাবে যুদ্ধ বন্ধ রাখার আদেশ দেন। ফলত: নবাব বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় ও শোচনীয় পরাজয় ঘটে। আমি যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যাইনি।  যুদ্ধে আহত হই আর যখন জানতে পারি যে মীর জাফর আমাকে খুন করার জন্য তল্লাশি চালাচ্ছে, তখন গা ঢাকা দিই। কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তী পর্যায়ে আমার বড় ছেলে, পূর্নিয়ার নায়েব নাজিম, শ্রীমন্ত লালকে  মিরন খুন করেছিল। ছোট ছেলে হুক্কা লাল পালিয়ে আত্মরক্ষা করেছিল। আমার বোন ছিল সিরাজের প্রণয়িনী আর আমি তাদের বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে ময়মনসিংহে চলে যাই। তারপর আমার অজ্ঞাতবাস পর্বের নানা কিংবদন্তি ছড়িয়ে আছে বাংলায়।এই কিংবদন্তিগুলোই কলকাতার জনক ।

কানকাটা দানশা ফকির : ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন পলাশীর যুদ্ধে হেরে যাবার পর, সিরাজদ্দৌলা – তার স্ত্রী লুৎফুন্নেসা ও চাকর গোলাম হোসেনকে নিয়ে রাজধানী থেকে বের হয়ে স্থলপথে ভগবানগোলায় পৌঁছে যান আর সেখান থেকে নৌকাতে পদ্মা ও মহানন্দার মধ্য দিয়ে উত্তর দিক যাত্রা করেন। তাঁর আশা ছিল পশ্চিমাঞ্চলে পৌঁছোতে পারলে ফরাসি সৈনিক মসিঁয়ে নাস-এর সহায়তায় পাটনা পর্যন্ত গিয়ে রামনারায়ণের কাছ থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে ফরাসি বাহিনীর সহায়তায় বাংলাকে রক্ষা করবেন। শেষরক্ষা হয় নি । মহানন্দা নদীর স্রোত অতিক্রম করে এলেও তাতে জোয়ার ভাটার ফলে হঠাৎ করে জল কমে যাওয়ায় নাজিমপুরের মোহনায় এসে তাঁর নৌকা চড়ায় আটকে যায়। তিনি নৌকা থেকে নেমে খাবার সংগ্রহের জন্য একটি মসজিদের কাছে বাজারে আসেন। আমি নবাবকে দেখে চিনে ফেলি কেননা একবার নবাবের শাস্তি পেয়ে আমি একটা কান হারিয়েছিলুম। আমি নবাবের খবর জানিয়ে দিই । মীর জাফরের লোক এসে  সিরাজদ্দৌলাকে বন্দি করে রাজধানী মুর্শিদাবাদে নিয়ে যায় । এর পরের দিন ৪ জুলাই  মীরজাফরের নির্দেশে তার ছেলে মিরনের তত্ত্বাবধানে মুহম্মদি বেগ নামের এক জল্লাদ সিরাজদ্দৌলাকে খুন করে করে। সিরাজের মৃত্যুর পর তার শব হাতির পিঠে চড়িয়ে সারা শহর ঘোরানো হয়। মুর্শিদাবাদের খোশবাগে নবাব আলিবর্দী খানের কবরের কাছে তাকে কবর দেয়া হয়। মীর জাফর আমাকে জমিজমা আর  মোটা ইনাম দিয়েছিল । আমি ধরিয়ে না দিলে কলকাতার জন্ম হতো না ।

কৌস্তুভ দে সরকার : সিরাজের কাছে হেরে গিয়ে, কলকাতা উদ্ধারে সর্বাত্মক অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় ইংরেজদের তরফ থেকে। এক্ষেত্রেও ইংরেজ বাহিনীর প্রধান হিসেবে প্রস্তাব করা হয় ক্লাইভের নাম। বিশেষ করে পণ্ডিচেরির দায়িত্বে থাকা পিগটের নামও এসেছিল এ অভিযান পরিচালনায় নেতৃত্বের জন্য; কিন্তু অল্প অভিজ্ঞতা নিয়ে এমন অভিযানের জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। পক্ষান্তরে হাঁপানি রোগী লরেন্সের পক্ষে বাংলার আর্দ্র-উষ্ণ আবহাওয়ায় অভিযান পরিচালনা করা অনেক কঠিন ছিল। শেষ পর্যন্ত ক্লাইভের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে নেতৃত্বের দায়ভার গিয়ে উপস্থিত হয় কর্নেল জন এডলারকর্নের ওপর। তিনি পদাতিক ও নৌযুদ্ধে পারদর্শী ছিলেন। পাশাপাশি বাংলার পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ চালিয়ে নেয়ার সাহস ও শক্তিমত্তা তার মধ্যে ছিল। এর পর ইংরেজ বাহিনী সেন্ট ডেভিডের মাটি থেকে কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করে। আরেক দফা সংঘাতে কেঁপে ওঠার আতঙ্কে থমথমে অবস্থা বিরাজ করে প্রকৃতিতে।

গৌতম বসুমল্লিক : বাংলায় দুর্গাপুজো প্রবর্তনের কৃতিত্ব যাঁরই হোক না কেন, কলকাতায় দুর্গার পুজো প্রথম অনুষ্ঠিত হয় ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে, বরিষার ,বেহালা সখের বাজার অঞ্চল,  সাবর্ণ গোত্রীয় রায়চৌধুরী পরিবারের আটচালা মণ্ডপে। তখন অবশ্য কলকাতা শহরে রূপান্তরিত হয়নি, তবে মণ্ডপটি আরও একটি কারণে ঐতিহাসিক। ওই আটচালা মণ্ডপে বসেই ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দের ১০ জুন তারিখে জোব চার্নকের জামাই চার্লস আয়ারের সঙ্গে ‘সুতানুটি’, ‘গোবিন্দপুর’ ও ‘কলকাতা’ গ্রাম তিনটির হস্তান্তরের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছিল রায়চৌধুরী বাড়ির তত্কালীন কর্তাদের সঙ্গে । সুতরাং ওনারাই কলকাতার জনক ।

সুবিমল বসাক : সুতানুটী নামটা এসেছে ওই টেক্সটাইল শিল্পের বাড়বাড়ন্ত থেকে। বাঙালির কলকাতার শ্রী ইংরেজ আসার আগে কিরকম ছিল, সেটা ইংরেজরা যে দিল্লির বাদশাকে ১৬০০০ টাকা দিয়েছিল এই তিনটে গ্রাম সুতানুটী, কলকাতা, গোবিন্দপুরের প্রজাসত্ত্ব কেনার জন্য ১৬৯৮ সালে, তা দেখলে টের পাওয়া যায়। সাবর্ণদের ১৩০০ টাকা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সাবর্ণরা তো দেওয়ার মালিক নয়, মোগল আমলে সমস্ত জমিই বাদশার, লোকে প্রজাসত্ত্ব (রেভেনিউ রাইট) কিনতে পারে কেবল, তো কলকাতার সেই প্রজাসত্ত্ব কিনতে বাদশার ফরমান আনতে হয়েছিল। এঁদো জমির জন্য কে ১৬০০০ টাকা দেয়? কলকাতা যদি গণ্ডগ্রাম হত, সেযুগে এই পরিমাণ টাকার ঝুলি হাতে নিয়ে বাদশার দ্বারস্থ হত না ইংরেজ।ব্রিটিশদের আসার আগে সুতানুটি অঞ্চলের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী বণিক পরিবার ছিলুম আমরা বসাকেরা। আমরা ছিলুম সুতানুটি বাজারে প্রধান বস্ত্রব্যবসায়ী। ব্রিটিশদের আসার পর আমাদের পরিবারের  সমৃদ্ধি ঘটেছিল। আমার পূর্বপুরুষ শোভারাম বসাক (১৬৯০-১৭৭৩)   কোটিপতি ব্যবসায়ী ছিলেন আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বস্ত্র সরবরাহ করতেন। গোবিন্দপুর দুর্গনির্মাণের জন্য ধ্বংস করা হলে বসাকরা উত্তর সুতানুটি হাট (বর্তমান বড়বাজার) অঞ্চলে সরে যায় । পরে মাড়োয়ারিরা আসার ফলে  বসাকেরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। সুতানুটি হাটের নামও পরে বদলে  বড়বাজার হয়।  শোভারাম বসাকের উত্তরসূরি রাধাকৃষ্ণ বসাক (মৃত্যু ১৮১১) বেঙ্গল ব্যাংকের দেওয়ান হয়েছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে শহরের প্রধান ব্যবসায়িক পরিবারগুলি নগরাঞ্চলীয় সম্পত্তিতে বিনিয়োগ করতে শুরু করেন। শোভারাম বসাক তার উত্তরসূরিদের জন্য সাঁইত্রিশটি বাড়ি রেখে গিয়েছিলেন। রাধাকৃষ্ণ বসাক কেবল বড়বাজারেই রেখে যান ষোলোটি বাড়ি। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কলকাতার বিকাশ শুরু হলে  বসাকদেরও পতন শুরু হয়।  বসাকদের সঙ্গে সঙ্গে সুতানুটিও কলকাতায় বিলীন হয়ে যায়।  ১৬৯০ সালে সুতানুটিতেই জব চার্ণক প্রথম এসেছিল। এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে শুধুমাত্র কলকাতা শহরটিই বিকশিত হয়ে ওঠেনি, বরং ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূচনায় এখানেই ঘটেছিল। আদি কলকাতার ব্ল্যাক টাউন তথা কলকাতার সংস্কৃতির আঁতুড়ঘর সুতানুটি আজও কলকাতার ইতিহাস সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তিদের কাছে এক পরম আগ্রহের বিষয়। সুতরাং কলকাতার জনক আমরা, জোব চার্ণকের আগে থেকে যারা এখানে ছিলুম ।

কংস নারায়ণ : ১৬ শতকে  বাংলার নবাব দিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছিল। বাংলা তখন স্বাধীন নবাবের হাতে। পরাক্রান্ত মুঘলদের আটকাতে তাঁরা তৈরি করলেন একশ্রেণীর হিন্দু জনশক্তি। তাঁদেরই একজন ছিলুম আমি ।আমি  নবাবদের সাহায্য নিয়েছিলুম।  নবাবী আমলে কিন্তু দুর্গাপূজা কখনও বাধাপ্রাপ্ত হয়নি। মোটামুটি ভাবে বলা যায়, অবিভক্ত বাংলার  প্রথম দুর্গা পুজোর উদ্বোধন আমি করেছিলুম । তা থেকে প্রমাণ হয় যে ষোড়শ শতকে আমি তখনকার গৌড়ের সুলতানদের কাছ থেকে প্রভূত অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সাহায্য পেতুম। সুতরাং আমার দুর্গাপূজা স্বাভাবিকভাবেই হিন্দু্–মুসলমানের উৎসব হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু পলাশীর যুদ্ধকে কেন্দ্র করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠল ইংরেজদের বাণিয়া শক্তি। যে যে হিন্দুদের হাতে অর্থ ছিল, তাঁদের হাতে কোনও রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল না। তাই তাঁরা গোপনে লর্ড ক্লাইভকে সাহায্য করতে শুরু করলেন। এদের পূর্বভাগে ছিলেন কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের শোচনীয় পরাজয়ের পর খুব স্বাভাবিকভাবেই বাংলার রাজনৈতিক শক্তির পুনর্বিন্যাস ঘটে। রাজতন্ত্র থেকে বাংলার ক্ষমতা এক লাফে চলে যায় বাণিয়াদের হাতে। সেই সময়ে কিন্তু ইংরেজরা সরাসরি ভারতে প্রবেশ করেনি। প্রবেশ করেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি। আর সেই কম্পানির দৌলতে ইংরেজদের ঘাঁটি হয় কলকাতায়। ফলে তাদের সৌজন্যে কলকাতায় তৈরি হল একশ্রেণীর উচ্চবিত্ত রাজমহল। তাঁদের মধ্যে অন্যতম শোভাবাজার রাজবাড়ি রাজা নবকৃষ্ণ দেব। নবকৃষ্ণ কলকাতায়  ইংরেজ শক্তিকে তেল মারার জন্য বারোয়ারি দুর্গাপুজোর উদ্বোধন করেচিল। ইংরেজরা শুধু যোগদানই করেনি, রীতিমতো সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল  ছোটলাট ও বড়লাট। আমি ইংরেজদের তেল মারার জন্য দুর্গাপুজো করতুম না ।

হাইনরিখ লুশকভ : আমার আসল নাম সৈয়দ মীর জাফর আলী খান  । আমি  ইরানি বংশোদ্ভূত। আমার বাবার নাম সৈয়দ আহমেদ নাজাফি। আমি বাবা-মা র দ্বিতীয় ছেলে। ইরান থেকে একদম নিঃস্ব হয়ে  বাংলায় এসেছিলুম ভাগ্যান্বেষণে। এখানে এসে বিহারের নায়েব আলীবর্দী খানের অধীনে চাকরি শুরু করি। অনেকেই জানেন না ইরানি ভাষায় খুব সুন্দর গান গাইতে পারতুম আমি । কিন্তু আমি ভালো বাংলা বলতে পারতুম না বলে আলীবর্দী খান নিজের উত্তরাধিকারী হিসেবে সিরাজউদ্দৌলাকে বেছে নেন । পলাশির যুদ্ধে আমি সেই অবহেলার বদলা নিয়েছিলুম ।

মীর কাসেম আলী খান : মীর জাফরকে ক্ষমতাচ্যুত করে আমি  ক্ষমতা দখল করেছিলুম। পরে ইংরেজদের সাথে আমার বিরোধ বাধে আর বকসারের যুদ্ধে হেরে যাই ।  ইংরেজদের ভয়ে পালিয়ে বেড়াতুম । অচেনা অবস্থায় দিল্লীতে মারা গিয়েছিলুম । আমার মাথার কাছে পড়ে থাকা একটা পোঁটলায় পাওয়া যায় নবাব মীর কাসেম হিসেবে ব্যবহৃত আমার চাপকান। তা  থেকে লোকে জানতে পারে শবটা বাংলার ভূতপূর্ব নবাব মীর কাসেম আলী খান। জানি না আমার কবর কোথায় । তবে আমিই কলকাতার জনক, কেননা আসল কলকাঠি তো আমিই নেড়েছিলুম ।

ঘনাদা : ১৮৮৬ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ট্রায়াল অব মহারাজা নন্দকুমার’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে যে, মিডলটনের পত্রালাপ দাখিল করা হলে ওয়ারেন হেস্টিংস ঘুষ নেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হতো। ওয়ারেন হেস্টিংস, তার বন্ধু ইলাইজা ইম্পের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসির আদেশ বের করেছিল। মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসি ওয়ারেন হেস্টিংসের জীবন ও কর্মকাল এবং কোলকাতার একটি বিতর্কিত অধ্যায়।মাত্র ২৩ বছর বয়সে সিরাজউদ্দৌলা ১৫ এপ্রিল ১৭৫৬ সালে নবাবী লাভ করেন। তার নবাবীর সময়কাল ছিল মাত্র ১ বছর ২ মাস ৮ দিন অর্থাৎ ৪৩৪ দিন। এ সময়ের মধ্যে নবাব সিরাজউদ্দৌলা দু’দুবার ইংরেজদের বিরুদ্ধে কলকাতা অভিযানে স্বয়ং নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং ইংরেজদের পরাজিত করেছেন। পূর্ণিয়ার যুদ্ধে শত্রুকে পরাজিত করেছেন। প্রধান সেনাপতি মীর জাফর, সেনাপতি রাজা দুর্লভরাম, উমিচাঁদ, রাজা রায়বল্লভ, ইয়ার লতিফ, জগৎ শেঠ, ঘসেটি বেগম, ইংরেজ সেনাপতি ওয়াটসন, ওয়াটস, ক্লাইভ প্রমুখ সিরাজউদ্দৌলার নবাবীর প্রথম দিন থেকে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের মাধ্যমে বিশ্বাসঘাতকতা, রাজদ্রোহ ও দেশদ্রোহিতায় লিপ্ত থেকে নবাবকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিল। তাতে একদিনের জন্য তরুণ নবাবের ব্যক্তিগত জীবনে কোনো আরাম-আয়েশ ভোগ-বিলাসের সময়-সুযোগ ছিল না। সিরাজউদ্দৌলাই প্রকৃতপক্ষে কলকাতার জনক । 

খান আবদুল হাদি :আলিবর্দীর শাসনকালের শেষ দিকে স্বার্থান্বেষী মহল কীভাবে গোটা শাসনতন্ত্রকে নিজেদের হাতের মুঠোয় পুরতে সচেষ্ট হয়ে উঠেছিল, সে সম্পর্কে সিরাজকে আমি বারবার সতর্ক করে দিয়েছিলুম। সেনাবাহিনীকে কেন্দ্র করে মীরজাফর আর খাদিম হুসেন খানের একটা বড় অঙ্কের টাকা পকেটস্থ করার বিষয়টা হাতেনাতে ধরিয়ে দিয়েছিলুম। বস্তুত এই ঘটনাবলী জানার ফলে সিরাজের ভেতরে যে অগ্নিবর্ষী একটি দৃষ্টিভঙ্গি প্রবল হয়ে উঠেছিল, তা কায়েমি স্বার্থান্বেষীদের প্রায় কোণঠাসা করে ফেলেছিল। তাই তারা সিরাজকে দুর্বিনীত, চরিত্রহীন ইত্যাদি নানা অভিধায় অভিহিত করে পলাশী যুদ্ধের পটভূমিকা নির্মাণের কাজটি বেশ জোরদারভাবেই করতে শুরু করে দিয়েছিল। সিরাজই কলকাতার জনক ।

মীর মদন : পলাশীর আমবাগানে আমি আর মোহনলাল  দুই সেনাপতি মিলে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পক্ষে আমৃত্যু লড়াই করেছিলুম। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে অন্য বিশ্বাসঘাতক সেনাপতিরা নিশ্চেষ্ট থাকলেও আমরা দুজনে ইংরেজ বাহিনীকে আক্রমণ করি।  প্রবল আক্রমণে টিকতে না পেরে ইংরেজ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভ তার সেনাবাহিনী নিয়ে আমবাগানে আশ্রয় নেয়। মীর জাফর, ইয়ার লতিফ খান, রায় দুর্লভ প্রমুখ নিস্পৃহ থাকলেও আমার গোলন্দাজ বাহিনীর প্রতাপে ইংরেজ বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। দুপুরের দিকে হঠাৎ বৃষ্টি নামলে নবাব বাহিনীর গোলাবারুদ ভিজে যায়। তবুও আমি আর মোহনলাল ইংরেজদের সাথে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলুম। কিন্তু প্রধান সেনাপতি মীর জাফর সিরাজকে বোঝালো যুদ্ধ বন্ধ রাখতে। যুদ্ধ চলার সময়ে গোলার আঘাতে আমি মারা যাই । আমার অনুগত কিছু সৈনিক আমার মৃতদেহকে গোপনে মুর্শিদাবাদের রেজিনগরের কাছে ভাগীরথী নদী তীরবর্তী ফরিদপুর গ্রামে কবর দে। এখনও ফরিদপুরে ফরিদ খানের সমাধির পাশে অবহেলায় সমাধিস্থ রয়েছি। এছাড়াও পলাশীর স্মৃতিসৌধের কাছে চাষজমির ভেতরে তিনটি অনুচ্চ স্মারক আছে, যা মীর মদন, নৌবে সিং হাজারি আর বাহাদুর খানের স্মৃতিতে তৈরি। পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্রের আমবাগান আর নেই । একসময় প্রচুর আমগাছ ছিল। তা ছিল রানি ভবানীর আমবাগান । এখন রাস্তা হয়েছে।  এখানে সমাধিস্থ করা হয় নবাবের আরও দুই বীর কমান্ডার বাহাদুর আলী খান আর ক্যাপ্টেন নৌবে সিং হাজারিকে। বন্দুকধারী ইউনিটের অধিনায়ক ছিলেন বাহাদুর আলী খান। আর গোলন্দাজ বাহিনীর ক্যাপ্টেন ছিলেন নৌবে সিং হাজারি। যুদ্ধের পরপরই এখানে গোপনে তাঁদের সমাধিস্থ করা হয়েছিল। সমাধিস্থলে যাওয়ার কোনো পাকা রাস্তা নেই। পাটখেতের আল ধরে যেতে হয়।

মোহনলাল : ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধের সময় আমি সিরাজের প্রতি অবিচল বিশ্বস্ততায় যুদ্ধ করেছিলুম। যুদ্ধক্ষেত্রে মীর মদনের মৃত্যুর পরেও আমার একক চেষ্টায় যুদ্ধের গতি সিরাজের অনুকূলে ছিল। কিন্তু নিজ অদূরদর্শিতা ও মানসিক দুর্বলতার কারণে সিরাজ,  মীর জাফর প্রমুখ বিশ্বাসঘাতকদের প্রভাবে যুদ্ধ বন্ধ রাখার আদেশ দেন। ফলত: নবাব বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় ও শোচনীয় পরাজয় ঘটে। আমি যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যাইনি।  যুদ্ধে আহত হই আর যখন জানতে পারি যে মীর জাফর আমাকে খুন করার জন্য তল্লাশি চালাচ্ছে, তখন গা ঢাকা দিই। কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তী পর্যায়ে আমার বড় ছেলে, পূর্নিয়ার নায়েব নাজিম, শ্রীমন্ত লালকে মীর মিরন খুন করেছিল। ছোট ছেলে হুক্কা লাল পালিয়ে আত্মরক্ষা করেছিল। আমার বোন ছিল সিরাজের প্রণয়িনী আর আমি তাদের বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে ময়মনসিংহে চলে যাই। তারপর আমার অজ্ঞাতবাস পর্বের নানা কিংবদন্তি ছড়িয়ে আছে বাংলায় । আমাকে একটি কলঙ্কিত চরিত্র হিসেবেই ব্রিটিশরা তুলে ধরেছিল। অথচ আমি পলাশীর যুদ্ধে সমস্ত রকমের বিরুদ্ধাচরণকে অস্বীকার করে যেভাবে দেশের হয়ে লড়েছিলুম, সে সম্পর্কে ইতিহাস প্রায় নীরব। সিরাজের কলকাতা অভিযানকালেও (১৭৫৬) আমি যে দক্ষতা আর অসমসাহসের পরিচয় রেখেছিলুম, সেই ইতিহাসও বাঙালির কাছে তুলে ধরা হয় না। পূর্ণিয়া অভিযান এবং পূর্ণিয়ার শাসনব্যবস্থার খোলনলচে বদলাতে আমার ঐতিহাসিক অবদানের কথা ব্রিটিশরা চেপে গেছে। পলাশীর পরিপ্রেক্ষিত রচনার ক্ষেত্রে চন্দননগরকে ঘিরে ফরাসি এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির টানাপোড়েনে সিরাজকে সঠিক ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে আমার আর মীরমদনদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সঠিক। ফলে জগৎ শেঠদের  মতো লোকেরা ভালোভাবেই বুঝতে পারছিল যে সিরাজ কোনো অবস্থাতেই তাদের হাতের পুতুল হবেন না। জগৎ শেঠের সঙ্গে আমার সংঘাতের স্বরূপটা বেশ ভালোভাবেই বুঝেছিল মীর জাফর। 

শওকত জঙ্গ : আমি হলুম বাংলার নবাব আলীবর্দী খান-এর নাতি আর সিরাজউদ্দৌলার পিসতুতো ভাই।আলীবর্দী খানের ছিল তিন মেয়ে। তিন মেয়েকেই উনি নিজের বড়ভাই হাজি আহমদ-এর তিন ছেলে, নোয়াজেশ মোহাম্মদের সাথে বড় মেয়ে ঘসেটি বেগমের, সৈয়দ আহমদ খান সওলত জং সাথে মেজ মেয়ে মায়মুনা বেগমের আর জয়েনউদ্দিন আহম্মদের সাথে ছোট মেয়ে আমেনা বেগমের বিয়ে দেন। তিনি ছিলেন আলীবর্দী খানের মেজ মেয়ে মায়মুনা বেগমের সন্তান। আমিও চেষ্টা করেছিলুম সিরাজকে সরিয়ে সিংহাসনে বসতে । অথচ পলাশীর পর কেউ আমাকে পাত্তা দিল না । 

শশী ঘোষ : কলকাতা বিশ্বের সব থেকে পুরনো শহরের মধ্যে অন্যতম। এমন একটা শহর যার পরতে পরতে লুকিয়ে আছে ইতিহাস। এই ইতিহাসে রয়েছে যেমন ভালবাসা ঠিক তেমনি রয়েছে রোমাঞ্চ। ধরুন আপনার কাছে একটা টাইম ট্রাভেল মেশিন আর সেই টাইম ট্রাভেলে করে এসে পৌঁছালেন পুরনো শহরে। কলকাতায় তখন ব্রিটিশ রাজ। আপনার জানার মধ্যে শুধু ধর্মতলা আর স্রেফ কয়েকটা জায়গার নাম। বাকি অংশ শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল। ধর্মতলা থেকে রাজভবন হয়ে এগোতে শুরু করলেন অফিসপাড়ার দিকে। এই জায়গা তখন শুধু নির্জন রাজপথ। কলকাতার ওয়েলেসলি প্লেস থেকে কাউন্সিল হাউজ পর্যন্ত এই রাস্তাটিকে তখন বলা হত ‘ফ্যান্সি লেন’।মনে হতেই পারে ব্রিটিশ আমলের কোনও ইংরেজের শখ বা শৌখিনতার সঙ্গে এর নিশ্চয় রাস্তার সম্পর্ক আছে। যার জন্যে এর নাম হয়েছে ‘ফ্যান্সি লেন’। তবে বলে রাখি আপনার এই মনে হওয়াটা একদমই ভুল। ইংরেজী শব্দ ফ্যান্সির সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই।এই ‘ফ্যান্সি’ কথাটা এসেছে ‘ফাঁসি’ শব্দ থেকে। আঁতকে উঠলেন বুঝি! ফাঁসি। তাও প্রকাশ্য দিবালোকে। ভরা রাস্তার উপর। জনসাধারণের চোখের সামনে। বীভৎস এই ঘটনার সাক্ষী থেকেছে শহর কলকাতা! সাহেবি উচ্চারণে ‘ফাঁসি’টা হয়ে গিয়েছে ফ্যান্সি, ফলে গোটা মানেটাই ঘেঁটে ঘ ! ঐতিহাসিকরা বলছেন, ইংরেজি ‘ফ্যান্সি’ (Phancy) শব্দটি যে ‘শৌখিন’ অর্থে ব্যবহৃত হয়, এই রাস্তার নামের মানে মোটেই তা নয়। কলকাতার অন্যতম পুরনো রাস্তা এটি, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু ঘটনা। একটা সময় এর পাশ দিয়ে একটা খাল বা ‘ক্রিক’ প্রবাহিত হত বলে জানা যায়। এখন অবশ্য সেটি মুছে গেছে। আর্চডিকন হাইড তাঁর ‘প্যারোকিয়াল অ্যানালস’ এবং ‘পেরিশ অব বেঙ্গল’ বই দুটিতে সেই বর্ণনা দিয়ে গেছেন— “The creek took a half turn round this battery and kept Eastwards beneath three gated bridges, until the fences turned downwards from it at Fancy Lane.” তখন খুব বেশি দিন হয়নি ইংরেজরা কলকাতায় এসেছে। জোব চার্নক তখনও জীবিত। ডালহাউসির কাছে এখন যেখানে কাউন্সিল হাউস স্ট্রিট, বিলিতি আমলে একেবারেই লালদিঘির প্রায় গা-ঘেঁষা সাহেবপাড়া। গোটা জায়গাটাই ছিল জঙ্গল। লোকজন তখন এই ধারে তেমন ঘেঁষতে সাহস পেত না। লোকজন বিশেষ ছিল না বললেই চলে।চারপাশে শুধু অজস্র গাছ, আর তাঁতে লুকিয়ে থাকতো চোর-ডাকাত। সে অন্য যুগ। অন্য জগৎ। জব চার্নকের কলকাতায় তখন নতুন রাজত্ব। সাহেবদের শৌখিনতা তখন গরিব লোকদের ফাঁসি দেওয়া। অপরাধ তখন যাই থাকুক না কেন একটাই শাস্তি ফাঁসি। ১৮০০ সালের কথা। ঢেঁড়া পিটিয়ে বেড়াচ্ছে কম্পানির লোক। কী, না ব্রজমোহনের ফাঁসী হবে। ব্রজমোহনের অপরাধ একটা মুল্যবান ঘড়ি সে চুরি করেছে। যার দাম ২৫টাকা। সে ফাঁসি হবে প্রকাশ্য স্থানে কোনও চৌমাথায়। বহু লোকের সামনে। চারদিকে থেকে পিল পিল করে লোক আসছে। ফাঁসি দেখবে। আজকের ওয়েলেসলি প্লেসে তখন অনেক বড় বড় গাছ ছিল। সেখানেই বসলো মেলা। রাস্তার মোড়ে একটি গাছের কাছে তৈরি করা হয় ফাঁসির মঞ্চ। ফাঁসি হল। সবাই ইংরেজদের এই ন্যায়পরায়ণতা দেখে ধন্যি ধন্যি করল। সেই সময় থেকেই রাস্তার মাঝখানেই এইভাবে ফাঁসি দেওয়া আরম্ভ হল। অত্যন্ত লঘু অপরাধেও অনেক সময় ফাঁসি দেওয়া হত। রাস্তার ধার ঘেঁষে সার সার ঝুলে থাকত দেহ। ফাঁসি দেওয়া রাস্তাটির নামই পরবর্তীকালে হয়ে যায় ‘ফ্যান্সি লেন’ যা বর্তমান পান্নালাল রোড। ইংরেজদের মুখে মুখে ‘ফাঁসি’ শব্দটাই বদলে হয়ে গিয়েছিল ‘ফ্যান্সি’। সেই থেকেই এই নাম। পুরনো কলকাতা নিয়ে লেখায় শ্রীপান্থ বলছেন, মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসি দেখে সবাই ফিরেছিলেন গঙ্গাস্নান করে।কারণ নন্দকুমার ছিলেন ব্রাহ্মণ। ব্রহ্মহত্যা দেখার মহাপাপ ধুয়ে ফেলতে গঙ্গাস্নানই ছিল সামাজিক বিধান। তবে সাধারণ অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট যে রাস্তা ছিল, সেখানে মহারাজ নন্দকুমারকে ফাঁসি দেওয়া হয়নি। গলিটিতেই এখন রয়েছে রাজভবনের স্টাফ কোয়ার্টার্স। আর কিছু অফিস ও দু’একটি দোকান। এবং ব্রিটিশ আমলের চিহ্ন নিয়ে ভেঙে-পড়া পুরোনো বাড়ি। পুরনো কলকাতার এই ভয়ঙ্কর ইতিহাস অনেকেরই হয়তো অজানা। সুতরাং বুঝতেই পারছেন যে নন্দকুমার ছিলেন কলকাতার জনক ।

সুপ্রীতি বর্মণ : কলকাতা শহরকে ইউরোপীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করতে ১৭৫৬ সালের জুন মাসে সিরাজ অতর্কিতে কলকাতা আক্রমণ করেন। ইতিমধ্যে কোম্পানি কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণ করে পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছিল। ২০ জুনের আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতার পতন ঘটে। ফলে ভারতীয়রা শহরের দখল নেন।এরপর সেনাপতি মানিকচাঁদের হাতে দুর্গের শাসনভার ছেড়ে দিয়ে সিরাজ-উদ-দৌলা রাজধানীতে ফিরে আসেন, ১২ জুলাই । কলকাতার নতুন নাম দেন – আলিনগর । এই নামটার একটা ধারা মেনেই – বর্তমান কলকাতার একটা অংশের নাম – আলিপুর ।

আলীবর্দী খান : ১৭৫৬ সালে কলকাতায় দুর্গনির্মাণে বিরক্ত হয়ে আমার নাতি নবাব সিরাজদ্দৌল্লা কলকাতা আক্রমণ করেছিল। কলকাতা অধিকারের পর সিরাজ এই শহরের নাম বদল করে আমার নামানুসারে ‘আলিনগর’ রেখেছিল । ১৭৫৮ সালে ইংরেজরা কলকাতা পুনরুদ্ধার করলে পুরোনো নামটা আবার বহাল হয়। তবে সিরাজের কলকাতা দখল ছিল ইংরেজদের কাছে এক দুঃস্বপ্নের সময়। এই যুদ্ধে গোবিন্দপুর, সুতানুটি, কলকাতা ও চিৎপুরের মধ্যে কেবলমাত্র ‘হোয়াইট টাউন’ নামে পরিচিত কলকাতা সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ‘ব্ল্যাক টাউন’ খুব একটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। কেবল বড়োবাজারে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল আর ইংরেজরা গোবিন্দপুর গ্রামটা জ্বালিয়ে দিয়েছিল। হুগলি নদীর চল্লিশ কিলোমিটার ভাটিতে ফলতায় ইংরেজরা পালিয়ে যায়। আলিনগর নাম থেকে প্রমাণিত যে আমিই কলকাতার জনক । 

মহারাজা নন্দকুমার : পলাশীর ষড়যন্ত্রের পর নন্দকুমারকে মীর জাফর দেওয়ান নিযুক্ত করে সব সময় তাকে নিজের কাছে রাখতেন। নন্দকুমার ভূষিত ছিল মহারাজা উপাধীতে। কিন্তু ওয়ারেন হেস্টিংস এর সাজানো মিথ্যা মামলায় আসামীর কাঠগড়ায় তার বিচার হয়। অদৃষ্টের কি নির্মম পরিহাস তাকে শেষ পর্যন্ত এই বিচারের রায়ে শেওড়াগাছে ঝুলতে হয় ফাঁসী কাষ্ঠে। মহারাজ নন্দকুমারের সাথে মীর জাফরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মীর জাফর তার শেষ জীবনে যাবতীয় কাজ কর্ম নন্দকুমারের পরামর্শনুসারে করতেন। তার অন্তিম শয্যায় নন্দকুমারই তার মুখে কিরীটেশ্বরী দেবীর চরণামৃত তুলে দিয়েছিলেন।

ধিরুভাই অম্বানি : বাঙালি বাড়ির বউরা আমার বউয়ের মতন হলে আজ পশ্চিমবাংলা অনেক ধনী রাজ্য হতো । একটা উদাহরণ দিই । দ্বারকানাথের ইংরেজ-সংসর্গ তাঁর মা বা স্ত্রী কেউই ভাল চোখে দেখেননি। দ্বারকানাথ এ ব্যাপারে স্ত্রীর মতামত অগ্রাহ্য করলে দিগম্বরী স্বামীর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতেও ইতি টানেন। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়ায় যে, দিগম্বরী হিন্দু পণ্ডিতদের ডেকে ম্লেচ্ছদের সঙ্গে একত্রে পানভোজন করা স্বামীর বিরুদ্ধে বিবাহবিচ্ছেদের বিধানও চেয়েছিলেন। পণ্ডিতেরা নিদান দেন, ‘স্বামীকে ভক্তি ও তাঁহার সেবা অবশ্য কর্তব্য, তবে তাঁহার সহিত একত্র সহবাস প্রভৃতি কার্য্য অকর্তব্য।’ স্ত্রীর সাংসারিক দায়িত্বটুকু পালন করা ছাড়া দিগম্বরী স্বামীর সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক রাখেননি। কাজের সূত্রে দ্বারকানাথের সঙ্গে যত বার কথা বলতে হত, তত বারই নাকি তিনি গঙ্গাজলে চান করতেন, এমন কথাও শোনা যায়। সুতরাং দ্বারকানাথই কলকাতার জনক।

জয়িতা ভট্টাচার্য : কলকাতায় ইংরেজরা তাদের বসতির বাইরে দুর্গপ্রাচীরের মতো প্রতিরক্ষা বেষ্টনী তৈরির চেষ্টা নিলে নবাবের নির্দেশে তা ধ্বংস করা হয়। একইভাবে ফরাসিরা প্রাচীর নির্মাণ করলেও তারা নবাবকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, এটা কোনো দুর্গ না, বরং স্থাপত্যিক কাঠামোর সংস্কার করা হচ্ছে মাত্র। নবাব ফরাসিদের কথা বিশ্বাস করলেও ইংরেজদের বিশ্বাস করতে চাননি। ফলে ফরাসিরা তাদের দুর্গপ্রাচীর টিকিয়ে রাখতে পারলেও শেষ পর্যন্ত ধ্বংস করা হয় ইংরেজদের দুর্গ। তবে এখানকার মূল বাস্তবতা হচ্ছে, ইংরেজরা যে দুর্গপ্রাচীর নির্মাণ করেছে, সেটা যতটা না নবাবের বিরুদ্ধে যায়, তার চেয়ে ঢের ফরাসিদের প্রতিরোধে কার্যকর হতো। এক্ষেত্রে তার খালা ঘষেটি বেগমের চক্রান্ত করার সুযোগ হয়ে যায়। পাশাপাশি কুশলী ইংরেজ গভর্নর রজার ডেরেক পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চাইলেন। সব মিলিয়ে যুবক সিরাজদ্দৌলার পক্ষে এ ধরনের অস্বাভাবিক ঘটনায় উপযুক্ত ও কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয়নি। ক্ষিপ্ত সিরাজদ্দৌলা এবার প্রতিটি ক্ষেত্রে ইংরেজদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করেন। তিনি মুর্শিদাবাদের কাছাকাছি কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি দখল করে কলকাতার দিকে অগ্রসর হন। ইংরেজরা প্রথম থেকেই নবাবকে প্রতিরোধ করার মতো সাহস রেখেছিল; কিন্তু তাদের সামরিক ছাউনিতে উপযুক্ত সংখ্যায় সৈন্য ছিল না। এতে তাদের মনে ত্রাস সৃষ্টি হয়। তাই তারা নবাবের বাহিনীর আগমন বুঝতে পেরে কুঠি ত্যাগ করে। গভর্নর ডেরেক সপরিবারে চেপে বসেন একটি জাহাজে। এর পর পুরো কুঠি নবাবের আনুকূল্যে চলে যায়। আর কুখ্যাত অন্ধকূপ হত্যার গাঁজাখুরি গল্প ফাঁদা  হয় ঠিক এর পর পরই। কলকাতার পতন হলে ভারতে অবস্থানরত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা নড়েচড়ে বসেন। দীর্ঘ বৈঠকের পর কলকাতা পুনরুদ্ধারের জন্য সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করার উদ্যোগ নেয়া হয়। ছয় সপ্তাহের প্রস্তুতি চলে সেন্ট ডেভিড দুর্গে। 

বাহাদুর শাহ জাফর : মূলত জোব চার্ণকের সহস্র দোষ ছিল এবং সুতানুটিতে যখন সে  ১৬৯০ সালে পৌঁছেছিল  তার তিনবছর পরই সে যৌনরোগের কারণে দেহত্যাগ করে তাই কখনই তাঁকে কলকাতা শহরের প্রতিষ্ঠাতা বলা সম্ভব নয়। এরপর ১৬৯৬সালে চার্লস আয়ার(জোব চার্ণকের জামাই) কলিকাতা কুঠীর এজেন্ট হিসাবে নিযুক্ত হয়। সেই সময় চার্লস আয়ার চক্রান্ত করে আওরঙজেবের পৌত্র পাটনা-নিবাসী আজিম উস শানের থেকে একটা সনদ নিয়ে আসে। এই সনদটি আনবার জন্য আজিম উস শানকে ষোল হাজার টাকা ঘুষ দিয়েছিল কোম্পানি । তাতে লেখা থাকে যে বাংলার সকল জমিদারদের ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে সাহায্য করতে হবে। কিন্তু সাবর্ণরা এই আদেশপত্রে সাক্ষর করতে রাজি ছিলেন না তবুও সম্রাটের আদেশ মতন বড়িশার আটচালায় চার্লস আয়ারের সাথে সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের প্রজাসত্ত্ব হস্তান্তরিত হয় বার্ষিক ১৩০০টাকা খাজনার বিনিময়ে। এই খাজনা ব্রিটিশ কোম্পানি ১৭৫৭ সাল অবধি সাবর্ণদের দিতো । সুতরাং কলকাতা কখনই বিক্রি করে দেওয়া হয়নি। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ আমলে কলকাতায় বড় বর ইমারত তৈরি হলেও প্রথম ইমারতটি তৈরি হয়েছিল জমিদার সাবর্ণ চৌধুরীদের আমলেই। সুতরাং সাবর্ণরা প্রজাসত্ত্ব হস্তান্তরিত করেছিল, জমিদারিসত্ত্ব নয়। এই প্রজাসত্ত্ব ছিল বাদশাহের অধীনস্থ তালুকদারের অধিকার। কেন না, অন্যান্য জায়গীরের মতন সুতানুটি, কলিকাতা এবং গোবিন্দপুরের জমিদারিসত্ত্ব বিক্রি করার অধিকার সাবর্ণদের ছিল না। সুতরাং এতদিন যারা এই বিক্রি করার গল্প সাজিয়েছেন তারা নিতান্তই ব্রিটিশ তোষণের জন্যই করেছেন এর কোন বাস্তবিক ভিত্তি নেই। সুতরাং কলকাতার জনক আজিম উস শান ।

 মীর মোহাম্মদ আলী খান : লোকে আমাকে মীরণ নামে এক ডাকে চেনে । আমি পলাশী ষড়যন্ত্রের পরবর্তী ঘটনাগুলোর প্রধানতম নায়ক। আমিই সিরাজের মূল হত্যাকারী, সিরাজের মাতা আমেনা বেগম, সিরাজের ভাই মির্জা মেহেদীকেও নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করেছিলুম । আমারই নির্দেশে মোহাম্মদী বেগ সিরাজকে খুন করে। শুধু খুন  নয় ; সিরাজউদ্দৌলার লাশকে আমি ক্ষত বিক্ষত করে তারই প্রিয় হাতির পিঠে  বেঁধে গোটা মুর্শিদাবাদ শহর ঘুরিয়েছিলুম যাতে সবাই এই বীভৎস দৃশ্য দেখে যেনো পরবর্তীতে বাংলার বুকে বিদ্রোহ করতে না পারে।  সিরাজের মা আমেনা বেগম তার ছেলের লাশ দেখার জন্য দৌড়ে হাতির কাছে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান আর সে’সময় মীরণের স্যাঙাতরা সিরাজের মাকে কিল, চড় ও ঘুষি মেরে আবার জেলখানায় বন্দী করে রাখে। হাতিটা কিন্তু সে সময় সিরাজের লাশ তার পিঠে নিয়ে আমেনা বেগমের সামনে বসে পড়ে। আমার মৃত্যু ঘটে বজ্রপাতে। মীর জাফর তখনও বাংলার নবাব। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতই পিতার কানে সে সংবাদ পৌঁছেছিল। তিনি মীরণের মৃত্যু শুনে বেঁহুশ হয়ে পড়েন। মুর্শিদাবাদে মীরণের লাশ, নিয়ে আসা হলো। কি বীভৎস বিকৃত পোড়ালাশ। পিতাকে না দেখতে দিয়ে লাশ দাফন করা হলো। এভাবেই মীরণের মৃত্যু। এটা আর কিছুই নয় আসল ঘটনাকে চাপা দেওয়ার একটা কৌশল মাত্র। মীরণকে খুন করে ইংরেজদের নির্দেশে মেজর ওয়ালস্। তবে  এই ঘটনাটা ধামাচাপা দেয়ার জন্য ইংরেজরা বজ্রপাতে মীরণের মৃত্যুর মিথ্যা গল্প বানিয়েছিল।

 মোহাম্মদী বেগ : আমি ছিলুম নবাব আলীবর্দী খাঁর খাস চাকর। আলীবর্দী খাঁর আমল থেকেই তাঁর পরিবারের একজন সদস্যরূপে তাঁরই স্নেহছায়ায় আমি বেড়ে উঠি। সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গেও আমার বিশেষ সখ্যতা ছিল। সিরাজউদ্দৌলাকে মীরণের নির্দেশে হত্যা করেছিলুম আমি । আমি একটা খঞ্জর দিয়ে আঘাত করে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলুম। দিনটি ছিল ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দের ৩’রা জুলাই। নবাব সিরাজ এ সময় আমার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাননি । তিনি কেবল আমার কাছ থেকে দু’রাকাত নামাজ পড়ার অনুমতি চেয়েছিলেন। বলাবাহুল্য  সিরাজের সেই অন্তিম ইচ্ছাও প্রত্যাখ্যান করেছিলুম।  সংসারের দাম্পত্য কলহে বদ্ধ উম্মাদ হয়ে গিয়েছিলুম আর একদিন কুঁয়োয় ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করি। 

 ইয়ার লতিফ খান : আমি ছিলুম নবাব সিরাজের একজন সেনাপতি।  পলাশী ষড়যন্ত্রের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলুম। পলাশীর যুদ্ধের মাঠে আমার সেনারা মীর জাফর, রায় দুর্লভের বাহিনীর মতন কাঠের পুতুল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। যুদ্ধের পরে বখরা দেবার ভয়ে ইংরেজরা আমাকে খুন করে লাশ লোপাট করে দিয়েছিল ।

মেহের উন নিসা বেগম : লোকে আমাকে ঘসেটি বেগম নামেই বেশি চেনে । আমি  নবাব আলীবর্দী খানের বড় মেয়ে। বিয়ে হয়েছিল নওয়াজিস মুহম্মদ শাহমাত জং-এর সাথে  যিনি  ঢাকার নায়েব নাজিম নিযুক্ত হয়েছিলেন। নিঃসন্তান হওয়ায় আমি আর আমার স্বামী সিরাজউদ্দৌলার ছোটো ভাই ইকরামউদ্দৌলাকে দত্তক নিয়েছিলুম। কিন্তু ইকরামউদ্দৌলা তরুণ বয়সে গুটিবসন্তে মারা যায়।  নওয়াজশ মুহম্মদ দুঃখে মারা যান। আমি উত্তরাধিকার সূত্রে  স্বামীর  প্রচুর সম্পদ পেয়েছিলুম । নবাব আলীবর্দী খান মারা যাবার পরে, আমি চেষ্টা করছিলুম দ্বিতীয় বোন মায়মুনা বেগমের ছেলে শওকত জংকে সিংহাসনে বসানোর। কিন্তু সিরাজউদ্দৌলা সিংহাসনে বসতে করতে সমর্থ হয়। শেষে, তিনি আলীবর্দী খানের সেনাপতি মীর জাফর, ব্যবসায়ী জগৎ শেঠ আর উমিচাঁদের সঙ্গে গোপনে ষড়যন্ত্র করি। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলা হেরে যাবার পর ইংরেজরা মীর জাফরকে নবাব বানায়।মীর জাফর, আমাকে ঢাকার জিনজিরা প্রাসেদে বন্দি করে রেখে ডিয়েছিল। কিন্তু আমাকে বিপদজনক শত্রু মনে করে, মীর জাফরের ছেলে  মীরন আমাকে ১৭৬০ সালে মুর্শিদাবাদ ফেরত নিয়ে আসার আদেশ দেয়। , মুর্শিদাবাদ ফেরার পথে আমাদের নৌকো খরস্রোতা বুড়ীগঙ্গা নদীতে পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক আমাকে নৌকায় তুলে বুড়ীগঙ্গা নদীতে নৌকা ডুবিয়ে মেরে ফেলে। আমার আর্তনাদ আহাজারী নদীর কিনার থেকে নিশুতি রাতে পথচারীরা শুনতে পেয়েছিল।

ওয়াটস : আমি কোম্পানির একজন আমলা । পলাশীর যুদ্ধে  ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল আমার। আমি পাল্কীতে করে বউ  সেজে মীর জাফরের বাড়িতে গিয়ে চুক্তিতে মীর জাফরের স্বাক্ষর এনেছিলুম। পলাশীর যুদ্ধের পর কোম্পানীর কাছ থেকে বরখাস্ত হয়ে মনের দুঃখে ও অনুশোচনায় ইংল্যান্ডে হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যাই।

প্রদোষচন্দ্র মিত্র : সাম্রাজ্যবাদের পূজারিরা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে জোব চার্নককে কলকাতার ‘বাবা’র আসনে বসানোর যত অপচেষ্টাই করুন না কেন, কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের এবং ভারতবর্ষের মানুষ তা প্রত্যাখ্যান করবেনই। প্রসঙ্গত শেষ বার যখন চার্নক সুতানুটিতে এসেছিলেন তখন তিনি বর্তমান বেনেটোলা আর শোভাবাজারের মধ্যবর্তী মোহন টুনির ঘাটে নেমেছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। তবে জোব চার্নক কলিকাতা বা গোবিন্দপুরে আসেননি, কারণ তিনি গুপ্তরোগে আক্রান্ত ছিলেন। এবং তাঁর অবস্থা ছিল বড়োই শোচনীয়। প্রায় দু’শো লোক তখন জ্বরে ও ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত। তার ওপর তিনিও আক্রান্ত। শেষ বয়সটা সুতানুটিতে কাটিয়ে তাঁর জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। তা হলে তাঁকে কেন কলকাতার জনক বলা হবে? তা ছাড়া কলকাতা নামের উৎপত্তি বহু প্রাচীন গ্রন্থেই পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকদের অনুমান, কলকাতা দু’ হাজার বছরের পুরোনো এক জনপদ। ‘আইন-ই-আকবরি’র রাজস্ব আদায়ের খতিয়ানে ‘কলিকাতা’ নামের উল্লেখ আছে। বিপ্রদাস পিপলাইয়ের ‘মনসাবিজয়’ কাব্যে (১৪৯৫-৯৬), কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এ কলিকাতার উল্লেখ পাওয়া যায়। ওলন্দাজ বণিক ফান ডেন ব্রুক-এর অঙ্কিত মানচিত্রেও কলকাতার উল্লেখ রয়েছে। ‘পদ্মাবতী’র রচনাকাল আনুমানিক ১৬৪৫-৫২ সাল। সেই গ্রন্থেও কলকাতা রয়েছে। তা হলে কখনোই জোব চার্নককে কলকাতার জনক বলা যায় না। তা ছাড়া চার্নক আসার বহু আগে থেকেই কলকাতা ধীরে ধীরে শহরে রূপান্তরিত হতে শুরু করে – পাকাবাড়ি, পাকা রাস্তা, বাণিজ্যনগরীর নানান কাজও শুরু হয়ে যায় চার্নক আসার বহু আগে থেকেই। তাই এ তত্ত্ব কখনোই সমর্থনযোগ্য নয় যে জোব চার্নক কলকাতার জনক ।

Posted in Uncategorized | Leave a comment

সুর্পনখা – বাল্মীকি সংবাদ

সুর্পনখা ।।

খুবই জঘন্য কাজ হয়েছে তোমার আদি কবি

এভাবে আমাকে পাঁকের মৃণ্ময়ীরূপে মহাকাব্যে

হেয় করা । তাই অনুরোধ করি আমাকে পাঠিয়ে

দাও, মহাভারতের গল্পে । ব্যাস আমাকে নিশ্চিত

আমার মনের মতো সুপুরুষ পাইয়ে দেবেন ।

বাল্মীকি ।।

কী যে বলছিস তুই স্পষ্ট করে বল সুর্পনখা ;

মহাভারতের গল্পে পাঠালে আমার রামায়ণ

টিকবে কী করে ? কেনই বা ওই ভিড়ে চাস যেতে

গল্পের ভেতরে গল্পে কেউ তোকে খুঁজেই পাবে না ।

ইতিহাসে তুই একমাত্র অসেতুসম্ভব সেতু —

ভুললি কী করে সৌন্দর্যের মূল হল অমরত্ব

তা তো পেয়েছিস তুই, আবার কিসের এঁড়ে-গোঁসা ?

সুর্পনখা ।।

ব্যাসদেব তোমার মতন উইপোকা ঢাকা পড়ে

কাটাননি জীবন । নারীর আবেগ-আকাঙ্খা উনি

অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছেন । কুতসিৎ হিড়িম্বীও

রূপসীর ভেক ধরে, কুন্তির নির্দেশে, আলিঙ্গনে

পেয়েছে ভীমকে । উলুপী তো ছিল জলের তলায়,

চিত্রাঙ্গদা ছিল দূরদেশে ; তারপর সুভদ্রার

আদরের দাবি মেটাবার জন্য গেলেন অর্জুন

তার আগে স্বয়ম্বরে জিতে এনেছেন দ্রৌপদীকে;

দ্রোপদী তো কালো চকচকে-ত্বক সৈরন্ধ্রী ছিলেন ।

একসাথে পাঁচজন পুরুষকে ভালোবেসেছেন ।

এতজন পুরুষকে-নারীকে যে ভালোবাসা যায়

তা তুমি কখনো কবি পারোনি করতে অনুমান ।

বাল্মীকি ।।

বোকার মরণ, জানিস না আমি আদি কবি কেন ?

ঘরে ঘরে আমার বইকে লোকে পুজো করে আজো

কিন্তু ঝগড়ার ভয়ে কেউই রাখে না ব্যাসদেব ।

সুর্পনখা ।।

জানি বলেই তো তাজ্জব লেগেছে । প্রেমিক পাখিকে

ব্যাধ তীরবিদ্ধ করেছিল বলে কেঁদে ফেলেছিলে,

সেই শোকে রক্তে জবজবে হল তোমার লেখনি

আর তুমি তৈরি করে ছেড়ে দিলে এমন দুজন

বনবাসী, যারা অন্যের প্রেমের ডাকে সাড়া দিতে

ভয় পায় । রাম ও লক্ষ্মণ ওরা অর্জুনের পাশে

একেবারে হালকা নিষ্প্রভ । ঘুমিয়েছে লক্ষ্মণের

উর্মিলা চোদ্দটি বৎসর । কেন ? পাছে সেও কোনো

যুবকের প্রেমে পড়ে ; তাকে তুমি মাদকের চেয়ে

কড়া ভ্রমে রেখেছ ভুলিয়ে । রামও কেমন লোক ?

রামভিতু শব্দটার জন্মে তো ওরই অবদান

অগ্নিপরীক্ষার তাপে ঠেলে দিল নিজের বউকে ।

ঘরে তাই রামায়ণ রাখে না এদেশি পরিবার–

কোথায় রামের জন্ম তাই নিয়ে চলে খুনোখুনি ।

বাল্মীকি ।।

আমার স্মৃতির কেন্দ্র তুই ও কৈকেয়ী দুইজন ;

স্মৃতি মানে ইতিহাস, চাইলেও বদলানো অসম্ভব

রাম-রাবণের মাঝে অসেতুসম্ভব-সেতু তুই ।

সুর্পনখা ।।

কী যে দোহাই পাড়ছ । স্মৃতি মুছে যায় কালক্রমে ।

আমি কি জানি না ইতিহাস বানানো কাহিনি মাত্র

যে বসে সিংহাসনে তার কথা শোনে ইতিহাস

ঘটনার চক্র থেকে খুঁটে তোলা লেখনি-বিভ্রম ।

যাই হোক আমাকে তোমার স্মৃতি থেকে মুছে ফ্যালো

আর যেতে দাও মহাভারতের মায়াবী জগতে ।

আমাকে হতশ্রী না করলে কি ইতিহাস অশুদ্ধ

হতো ? সুন্দরী হতুম যদি হরিণের পিছে নয়

আমার পিছনে ছুটে চলে আসত লক্ষ্মণ-রাম

তাহলে তোমার গল্পে যুদ্ধ ঘটাতে পারতে নাকো ।

জানি না কি বিশ্বামিত্র মেনকাকে দেখে ধ্যান ভেঙে

কী-কী করলেন ! আর পুরূরবা উর্বশীর প্রেমে

হননি কি উত্তাপে সরেস ? দেখেচ তো বিশ্বকর্মা

তিলে-তিলে গড়লেন তিলোত্তমা, যার প্রেমে শিব

আর ইন্দ্র দুজনেই লুকোতে পারেনি জ্বরতাপ ?

শিবের গজালো মাথা দশদিকে, ইন্দ্রের শরীর

জুড়ে চোখ, স্রেফ তিলোত্তমা দর্শনের অভিলাষে !

ভোল পালটিয়ে ইন্দ্র অহল্যাকে করেছে সঙ্গম !

আমি যদি ভালোবেসে থাকি তাতে দোষটা কোথায় ?

বাল্মীকি ।।

তুই হলি ত্রেতাযুগী রাক্ষসী বিধবা । অর্জুনেরা

দ্বাপর যুগের । যত যুগ এগোতে থাকবি তত

পাবি মূল্যবোধহীন লোকেদের । যদি বর্তমান

যুগে যাস তাহলে দেখবি যত কলি-কালখণ্ড

কেলেঙ্কারি । দুষ্টবুদ্ধির সঙ্গে ছিলিস তো ভালোই ;

নিতে গেল সিংহাসন, শেষে ডোবালো তোকেও ।

জানিস তো দ্বাপরেই সতীপ্রথা শুরু হয়েছিল

মহাভারতের গল্পে চিতার আগুনে পুড়তিস ।

আমার স্মৃতিতে শুধু অঙ্গহানি হয়েছিল তোর ।

সুর্পনখা ।।

ওটাও তোমার কাজ ; আমার বরের নামে দুষ্ট

যোগ করা । যাই হোক, এবার আমাকে ছাড়ো ।

যেতে দাও দ্বাপরের বিস্ময় জগতে । প্রেমিককে

পেতে হলে মূল্যবোধ নয়, প্রেম চাই, প্রেম, তা তো

ব্যাসদেব নিজে শুরুতেই করে দেখিয়ে গেছেন ।

ওসব তোমার কর্ম নয় । রামও কেমন লোক ?

সোনার হরিণ দেখে তার পিছে-পিছে ছুটে গেল

আমার প্রেমের চেয়ে কুড়ি কিলো সোনা যেন দামি !

লক্ষ্মণই বা কেমনতরো ? নারীকে বিকৃত করে ?

তুমি কুতসিৎ করে তুললেও আমার বাবা মা

আমাকে মীনাক্ষী নামে অপরূপা করে তুলেছেন

তাই মীনাক্ষী হয়েই যাবো মহাভারতের গল্পে ।

বাল্মীকি ।।

তোকে ছাড়া মুশকিল কেননা যুদ্ধের তো ওজর

দরকার । যদিও এদান্তি অকারণে খেলাচ্ছলে

বারুদ মকসো করে যুদ্ধ শুরু হয় । ঠিক আছে ।

পরবর্তি সংস্করণে স্মৃতিকে শুধরে নিতে হবে ;

তবে আমি হলেও বা রাজি, রামভক্ত লোকজন

চটে যেতে পারে এই ভেবে যে অমরত্বের লোভে

একটা গল্পের নারী অন্য ইতিহাসে ঢুকে গেল ।

রাম তো যুদ্ধের পর বাড়ি ফিরে গেছে । অতএব

আমার স্মৃতিতে তোর দরকার নেই সুর্পনখা–

লক্ষ্মণের কাটা অঙ্গ আমার কুটিরে রেখে আয়

দেখি যদি অন্য কোনো চরিত্রের কাজে যায় লেগে ।

সুর্পনখা ।।

তোমার কাহিনি বৌদ্ধ জৈন থাই ব্রহ্মদেশে গিয়ে

পাঠান্তর নিয়েছিল । কৃত্তিবাস তোমার ছায়ায়

তুলসীদাস রামচরিতমানসের কাহিনিতে

নিরক্ষর মগজের লোকেদের ভুল বোঝালেন

আমাকে সবার কাছে চরিত্রহীন করে দিয়ে ।

তাই চাই মহাভারতের গল্পে গিয়ে, অর্জুনকে

প্রেম নিবেদন করি মীনাক্ষীর আসক্ত আঙ্গিকে ।

বাল্মীকি ।।

তবে তাই কর । আমার স্মৃতিতে যেমন হঠাৎ

তুই গল্প থেকে চলে গিয়েছিলি, রা কাড়েনি কেউ

তেমনি ওখানে গিয়ে কুরুক্ষেত্র শেষে তোকে নিয়ে

চিন্তার সময় কারোরই থাকবে না । সেসময়ে

এসে তোর কাটা অঙ্গগুলো নিয়ে যাস যদি চাস ।

সুর্পনখা ।।

না আমার প্রয়োজন নেই । যেটুকু নারীত্ব আছে

তাই নিয়ে যুগে-যুগে আসব প্রেমের কবিতায়

গল্পে-নাটকে-নভেলে । জানবে সবাই, কুতসিৎ

মেয়েরাও প্রেম নিবেদন করে প্রেমিককে পায় ;

হলেই বা পাঁকের মৃণ্ময়ী, কোলে কালি ছোটো-চোখ

পেছন থেকেও বুক দেখা যায় বলে লোকে হাসে

নিমপাতা মাখা গন্ধে মাছিরা বাসর পাতে দেহে

চুলও উকুনে রুক্ষ পূতিগন্ধময় পুরু ঠোঁট–

কিন্তু জানি যেকোনো পুরুষ যদু বাহুবদ্ধ করি

তরল বিদ্যুৎ বয়ে যাবে তার উত্তপ্ত শিরায়

প্রেম যে কীভাবে দেহে খেলা করে তুমি তা জানো না ।

তার জন্য কবিকে প্রথমে প্রেমে প্লুত হতে হবে ।

Posted in অতিবাস্তব, অধিবাস্তব, মহাভারত, রামায়ণ | Tagged , , , | Leave a comment

ভালোবাসার উৎসব

পরিদৃশ্য

পায়রোটেকনিকে তোলা রঙিন ঝড় ( গাঢ় লাল, কমলা, হলুদ, সবুজ, নীল, বেগুনি এবং গোলাপি । রঙগুলো প্রতিটি নারীর ভাবকল্প ) । সাত রঙের ঝোড়ো আলো ( যে রসায়নে আলো গড়ে উঠেছে : লিথিয়াম ক্লোরাইড, ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড, সোডিয়াম ক্লোরাইড, কপার সালফেট, কপার ক্লোরাইড, পটাশিয়াম সালফেট এবং পটাশিয়াম ক্লোরাইড)।

পাত্রপাত্রী

১. কুলসুম বানু ( ১৪ বছর, কালো, মোটা, সলমা-সিতারার কাজকরা গাঢ় লাল সস্তা চুড়িদার ), ২. নন্দিতা সিনহা (১৯ বছরের তরুণী, ফর্সা, সুন্দরী, ঢ্যাঙা, অভিমানী, কমলা রঙের কটন শাড়ি ), ৩. ভূবনমনমোহিনী রাণা ( ২১ বছরের নেপালি যুবতী, সুশিক্ষিতা, হলুদ কাঞ্জিভরম ), ৪. চিত্রাঙ্গদা বসু ( ৩৫ বছরের বাঙালি যুবতী, যৌনকর্মী, সবুজ সিনথেটিক শাড়ি ), ৫. ক্যারল নোভাক ( ২৬ বচরের মার্কিন যুবতী, মাদকাসক্ত, নীল টপ ও ফেডেড জিন্স ), ৬. অবন্তিকা রায় ( ৩০ বছরের বাঙালি যুবতী, প্রেমে উন্মাদ, বেগুনি কল্কার জামদানি শাড়ি ), ৭. শ্রীমন্তিনী সেনগুপ্ত ( ২৭ বছরের বাঙালি যুবতী, হলুদ টপ ও জিন্সপরা, পিঠে ছড়ানো কালো চুল ), ৮. চারজন বৃদ্ধের দল ( ধুতি ও গেরুয়া পাঞ্জাবি পরা ; পায়ে কথ্থক নাচের ঘুঙুর এবং প্রতি সংলাপে কথ্থকনাচের ভঙ্গীতে পাক খান ও গোড়ালি ঠোকেন । দৃশ্যকেন্দ্রে তাঁরা শবের দান দিকে সার বেঁধে দাঁড়ান ), ৯. চারজন বৃদ্ধার দল ( লাল পেড়ে শাড়ি ও ব্লাউজ । প্রতি সংলাপে ভারতনাট্যমের মুদ্রায় হাত নাচান; সেসময়ে মৃদঙ্গ বাজে । দৃশ্যকেন্দ্রে তাঁরা শবের বাঁদিকে সার বেঁধে দাঁড়ান । ), ১০. একজন টাকমাথা আউলবাবু ( প্যান্টশার্ট পরা, কাঁধে ঝোলা, কথা বলার সময়ে হিপহপ নাচেন ; হিপহপ নাচের সময়ে নেপথ্যে বাজতে শোনা যায় গিটার, ভায়োলিন, পিয়ানো, বাস ওড্রাম ), ১১. একজন যোদ্ধা ।

[ ধুলিকণাদের নিয়ে ঝড় ওঠে, প্রতিটি রঙিন

বালু, তাদের সাতটি আলোকণা একযোগে দৃশ্যকেন্দ্রে ছুটে

যায়, ঘূর্ণিকেন্দ্রে গিয়ে মানব আকার মেলে ধরে

উলঙ্গ যোদ্ধার, অবিন্যস্ত চুল তার, শ্বেতশুভ্র দাড়িগোঁফ,

ঋজু-ফর্সা । আচমকা চারিদিক থেকে ছয়জন

কিশোরী-তরুণী আবির্ভূত হন, ঘিরে ধরে বৃদ্ধটিকে খুন

করে ছোরাছুরি তরোয়াল দিয়ে আর

উধাও একইভাবে হন । তারপর চারিদিকে শব্দহীন ঝিঁঝিডাক ।

যোদ্ধাটির শব পড়ে থাকে বহুক্ষণ । মৃতদেহ থেকে ওঠে

ছয়রঙা ধোঁয়া ; কিছিক্ষণ পর নারীর আকার পায় তারা—

সেই নারীদের, যারা লোকটিকে খুন করে চলে গিয়েছিল ।

এ-সময়টুকুতে সরোদে রাগ দুর্গার আরোহ শোনা যায় । ]

কুলসুম ( উবু হয়ে যোদ্ধার হাত নিজের দুহাতে নিয়ে ) ।।

আমি এই বালকের হাতদুটি কেটে নিয়ে যাব

আমিই দিয়েছি একে প্রথম ছোঁয়ার নিরাময়

এই দুটি হাত দিয়ে আমার তাপিত তাড়নায়

শান্তি দিয়েছিল এ-বালক, অন্ধকারে হাঁস ও মুর্গির মাঝে

যখন দুজনে মিলে নিজেদের কৌতূহলী-উমে শিখিয়েছি

কীভাবে প্রেম পেলে দুধখোর প্রাণীর জন্ম হয় ।

এর হাত আমারই দ্বারা প্রভাবিত ।

এর হাত কখনো কচলায়নি গিয়ে নন্দনের বনানীতে

এতই ভার্জিন এর হস্তরেখাগুলো । ( চপার দিয়ে

বাঁ হাত কাটতে উদ্যোগী হয় । বৃদ্ধদলের প্রবেশ )

বৃদ্ধদল ( কোরাস , কুলসুমের দিকে তাকিয়ে ) ।।

নিচ্ছ যদি ছোঁয়াচ নিও

শুধুই নিজের ছোঁয়াচ নিও

অন্য নারীর ছোঁয়াচগুলো

হাতেই রেখে যেমন ছিল

তোমার তাতে নেই অধিকার

তাদের নিও যারা তোমার

গোপন-গলি চরতে এলো

প্রভাব নিয়ে গুলে খেলো !

[ নাচতে-নাচতে ঢোকে আউলবাবু নামে এক লোক ।

লাশের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে কাঁধের ঝোলা থেকে

পেন ও ডায়রি সঙ্গোপনে বের করে  ]

আউলবাবু ( স্বগতসংলাপ, নাচতে-নাচতে ) ।।

প্রশ্ন হল  এ কি যুদ্ধক্ষেত্র ধেকে পালিয়ে এসেছে ?

যতদূর জানি ব্যাটা তো মেটিং গেমের ওস্তাদ

সব্দে-শব্দে মেটিং করে বাক্যে-বাক্যে মেটিং করায়;

অথচ ছিল না এর বেঘো-মা বাপ-হেলিকোপ্টারি !

[ বৃদ্ধলের প্রস্হান ও বৃদ্ধাদলের প্রবেশ ]

বৃদ্ধাদল ( কোরাস, কুলসুমের দিকে তাকিয়ে ) ।।

তারপর তুই যাদের ছুঁলি

তারা কেন বঞ্চিত রে

তাদের হকে দেয়াল তুলে

একলষেঁড়ে বায়না ধরে

বাসি প্রেমের টাটকা বুলি

ঝাড়িস কিসের জন্য রে ?

আউলবাবু ( স্বগতসংলাপ, নাচতে-নাচতে ) ।।

তবে বুঝতে পারছি যোদ্ধা ছিল অতীব অশ্লীল !

নয়তো এমন ল্যাংটো পড়ে থাকে কেউ ?

পার্টি-অ্যানিমাল ছিল দলছুট বাঙালি-পুঙ্গব ।

[ বৃদ্ধাদলের প্রস্হান ]

কুলসুম ( চলে যেতে-থাকা বৃদ্ধাদলের উদ্দেশে ) ।।

কী হবে ওসব শুনে ? কাঁচা কৌমার্যের আরক্তিম

যা ছিল প্রথম রঙ তা তো আমারই অবদান

তাই আমি হাত দুটো নেবো ; বলুক যার যা ইচ্ছা

এর হাত আমার দ্বারাই প্রভাবিত ।

[ বৃদ্ধদল ও বৃদ্ধাদলের প্রবেশ । ]

বৃদ্ধদল ( কোরাস, বৃদ্ধাদলের উদ্দেশে ) ।।

তা না হয় হল, কিন্তু কী হল শেষকালে ?

আউলবাবু ( স্বগতসংলাপ, নাচতে-নাচতে ) ।।

কিন্তু যোদ্ধা লোকটা কি দ্রোহী না বিপ্লবী ?

রাষ্ট্রের মালিকদের জানিয়ে রাখার প্রয়োজন

বলা তো যায় না ; শবেরাও আইনশৃঙ্খলা ভাঙে এইদেশে ।

বৃদ্ধাদল ( কোরাস, বৃদ্ধদলের উদ্দেশে ) ।।

তা না হয় হল, কিন্তু কী হবে শেষকালে ?

আউলবাবু ( স্বগতসংলাপ, নাচতে-নাচতে ) ।।

বদনাম লড়াকুর পচা লাশ নেবে কি দেশের ইতিহাস ?

হতেই পারে না ; সামলাবে আমাদের পোষা খাদিম-মুন্সিরা ;

জলজ্যান্ত মাটিতে পোঁতার আগে টেঁসে গেল শালা ।

[বৃদ্ধদল ও বৃদ্ধাদলের প্রস্হান ]

নন্দিতা ( ১৪ বছরের কিশোরীটির দিকে তাকিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে

আর চপারসুদ্ধ হাত ধরে তাকে দাঁড় করায় ) ।।

কে রে তুই কচিখুকি ? এ আবার বালক কোথায় ?

মৃত তবু কত লোভনীয়-দেহ তরতাজা টাটকা যুবক ।

নিজের চেহারা দ্যাক আর এ পুরুষ্টু লোকটাকে

কোথাও কি কোনো মিল আছে ? ছোটোলোকি

কালো মোটা বদগন্ধ বেঢপ আদল তোর ! এই

সুপুরুষ যুবা ককখনো ভুলেও ছোঁবে না তোর

টোপ-ফেলা গোপন নোংরামি । শুধু দুটি হাত নয়

এর দুটি ঠোঁটও আমার । স্বাদও দিয়েছি

আমি, বুকের সুগন্ধী গামে বনপ্রান্তে মাদুরের

গ্রীষ্মাবকাশের ঘাসে , আমারই অধিকার এর

নোনতা অধরে ; রক্তহীন কেটে নিচ্ছি

এর ঠোঁট আমারই দ্বারা প্রভাবিত;

আজ অব্দি যে কথা বলেছে সব আমারই প্রভাবে ।

[ ছুরি বের করে কাটতে ঝোঁকে । বৃদ্ধদলের প্রবেশ । ]

বৃদ্ধদল ( কোরাস, নন্দিতার উদ্দেশে ) ।।

নিচ্ছ যদি চুমুই নিও

ওই ঠোঁটে তো আরও অনেক

নারীর মোহের কান্না-হিসেব

গরিব-ধনী গৌরী-শ্যামা

ঘূনপোকাদের দেখা খোয়াব

বাঁচিয়ে নিজের হিসসা নিও ।

আউলবাবু ( স্বগতসংলাপ, নাচতে-নাচতে ) ।।

এ-ব্যাটা জিততো যদি আমাদের চাকরি খেয়ে নিতো !

ভাগ্যিস এমন লোক বারবার আসে বটে তবে মারা পড়ে

এদের সাকিন-নাম বাসি নথি-খাতা ছাড়া কোথাও থাকে না ।

আকাশের মেঘ খেতো ডায়নোসর তারাও আজকে হাপিস ।

[বৃদ্ধদলের প্রস্হান ও বৃদ্ধাদলের প্রবেশ ]

বৃদ্ধাদল ( কোরাস, নন্দিতার উদ্দেশে ) ।।

তারপরে তুই চুমলি যাদের

ভুললি কেন তাদের ছুঁড়ি

কোথায় সেসব ঠোঁট রেখেছিস

একেই কেন চাইরে বুড়ি

এর ভেতরে কী পেয়েছিস

মাঞ্জা-দেয়া উড়োন-ঘুড়ি ?

আউলবাবু ( স্বগতসংলাপ, নাচতে-নাচতে ) ।।

তবে এই লাশটাকে কোটালের হেপাজতে দেয়াটাই ঠিক

ভ্যান রিকশায় তুলে ফেলবে ভাগাড়ে নিয়ে গিয়ে ;

সেজেছিল প্রেমিক লড়াকু বানচোত

জানতো না প্রেম আর বিরোধিতা জলে তেলে মেশার মতন ।

[ বৃদ্ধাদলের প্রস্হান ]

নন্দিতা ( চলে যেতে থাকা বৃদ্ধাদলের উদ্দেশে ) ।।

ঋতুর গোপন গন্ধে মহিষের চেয়ে দৃঢ়-ঋজু এ-যুবক

খুরের ধুলোব গুঁড়িয়েছে ভুতগ্রস্ত প্রতিদ্বন্দ্বীদের বাধা

তারপর যা ঘটেছে ইতিহাসে লেখা যাবেনাকো

শিং-ভাঙা পুং-ছাগলেরা পড়ে আছে প্রতিষ্ঠানের হাড়িকাঠে

তাই আমি নিতে চাই যা আমার যা দিয়ে তৈরি করেছি একে ।

কখনও দুটিঠোঁট শিশুর মতন ইনি রাখতেন বুকে

কিংবা হাঙরের ঢঙে দুই ঠোঁট মেলেছে দেহের অলিগলি

কত কাতুকুতু জমে আছে শরীরের স্মৃতি-বিজড়িত ঘরে ।

এর ঠোঁট আমারই দ্বারা প্রভাবিত ।

[ বৃদ্ধদল ও বৃদ্ধাদলের প্রবেশ ]

বৃদ্ধদল ( কোরাস, বৃদ্ধাদলের উদ্দেশে ) ।।

তা না হয় হল, কিন্তু শেষকালে কী হল ?

বৃদ্ধাদল ( কোরাস, বৃদ্ধদলের উদ্দেশে ) ।।

তা না হয় হল, কিন্তু শেষকালে কী হল ?

[ বৃদ্ধদল ও বৃদ্ধাদলের প্রস্হান ]

আউলবাবু ( স্বগতসংলাপ, নাচতে-নাচতে ) ।।

যোদ্ধাদের কাজ হল টেঁসে যাওয়া, সেকাজ করেছে লোকটা,

হেঁ হেঁ, প্রেমপন্হা ভাঙবেন ইনি ? গানডুটা চেনেনি রাষ্ট্রকে–

যে-লোকই বসুক চেয়ারে তার মগজে বদল ঘটবেই ।

ভূবনমোহিনী ( কুলসুম ও নন্দিতার মাঝে দাঁড়িয়ে ) ।।

কী করছ কী বলছ যাতা তোমরা দুজনে মিলে,

দাঁড়াও, সবার আগে আমি জিভটুকু কেটে নিই

লেহন করেছে কতদিন নেকড়ের

ঢঙে, যে-অঙ্গে চেয়েছি হসটেলে সঙ্গে ছিল মিহিন সঙ্গীত যা আমার

দেহে আজো ঝিরিঝিরি রিমিজিমি বেজেই চলেছে ;

এর জিভ আমারই দ্বারা প্রভাবিত ।

শব্দ বলো বাক্য বলো যে-কোনো অভিধা, আমার প্রভাব তাতে

ব্যকরণে বিন্যাসে বিশেষ্যে বিশেষণে আমার প্রভাব পাবে ।

[ জিভ কাটতে ঝোঁকে । বৃদ্ধদলের প্রবেশ ]

বৃদ্ধদল ( কোরাস, ভূবনমোহিনীর দিকে তাকিয়ে ) ।।

নিচ্ছ যদি স্বাদই নিও,

স্পর্শ নয় গন্ধ নয়

শ্বাসে ভিজে গানও নয়,

তুই তো দেখি ছিলিস-মার্কা

জিভখানা এর ইলিশ-মার্কা,

কেমন করে মিল যে হয় !

আউলবাবু ( স্বগতসংলাপ, নাচতে-নাচতে ) ।।

কিন্তু এ সত্যই যুদ্ধ করেছিল কিনা তার কী প্রমাণ আছে ?

প্রমাণ থাকেও যদি ক্ষতি নেই আমাদের লোক আছে সর্বত্র ছড়ানো

লড়ায়ের ইতিহাস মিথ্যামঙ্গল লিখব তো আমরাই

সরকারি অনুদানে প্রকাশিত পড়বে খোকারা ইশকুলে ।

[ বৃদ্ধদলের প্রস্হান ও বৃদ্ধাদলের প্রবেশ ]

বৃদ্ধাদল ( কোরাস, ভূবনমোহিনীর দিকে তাকিয়ে ) ।।

তারপরে এ চাটলো যাদের

সকাল সন্ধে বিকেল দুপুর

মরল শেষে বিষে তাদের

আদর-খেকো মুখের মুকুর

জানিস সেসব দীর্ঘশ্বাসই

আটকে আছে এনার লাশে ?

আউলবাবু ( স্বগতসংলাপ, নাচতে-নাচতে ) ।।

তবে একটা খটকা আছে কোথায় এনার ঢাল-তরোয়াল !

না হয় লোকটা যুদ্ধে গিয়ে মরল লড়ে, ওপড়ালো কী বাল ?

[ বৃদ্ধাদলের প্রস্হান ]

ভূবনমোহিনী ( চলে যেতে থাকা বৃদ্ধাদলের উদ্দেশে ) ।।

জঙ্গল-নেকড়ে ছিলেন না ইনি ; বিশ্ববিদ্যালয়ে

সিংহীদের পাল এক গর্জনে এনার আওতায় আসলেও

আমিই ছিলুম এঁর নিজস্ব সিংহিনী, কথাটা রিপিট করি–

এখনো আমার লোমে আছে এঁর প্রেমসিক্ত লালা

তাহলে পাব না কেন জিভটুকু আমি ?

এঁর জিভ আমারই দ্বারা প্রভাবিত ।

[ বৃদ্ধদল ও বৃদ্ধাদলের প্রবেশ ]

বৃদ্ধদল ( কোরাস, বৃদ্ধাদলের উদ্দেশে ) ।।

তা না হয় হল কিন্তু শেষকালে কী হল ?

বৃদ্ধাদল ( কোরাস, বৃদ্ধদলের উদ্দেশে ) ।।

তা না হয় হল কিন্তু শেষকালে কী হল ?

আউলবাবু ( স্বগতসংলাপ, নাচতে-নাচতে ) ।।

অনেক করেও একে জালে-ফাঁদে ফাঁসানো গেল না !

মেয়েরা ফাঁসালো একে, তার কোনো রুলবুক হয়তো বা হবে ;

এরকম রুলবুক তৈরি করতে পারত হেডকোয়ার্টার ।

[ বৃদ্ধদল ও বৃদ্ধাদলের প্রস্হান ]

চিত্রাঙ্গদা ( সবায়ের দিকে এক-এক করে তাকিয়ে ) ।।

যখনই দুঃখ গ্লানি ক্ষোভ দ্বেষে যুঝেছে লোকটা

এসেছে আমার কাছে, আমাদের কাছে ; চিত্রাঙ্গদা নাম নিয়ে

যে গেছে এনার কাছে ইনি তাকে হাতির তরল মস্তিসহ

রাতভর ডলেমলেছেন । আমি এঁর লিঙ্গটুকু নিতে চাই ।

আমাদের প্রেমের চত্ত্বরে ঠাঁই হবে ; পূজার্চনা দেব রোজ ।

এঁর লিঙ্গ আমারই দ্বারা প্রভাবিত ।

[ লিঙ্গ কাটতে ঝোঁকে । বৃদ্ধদলের প্রবেশ ]

বৃদ্ধদল ( কোরাস, চিত্রাঙ্গদার উদ্দেশে ) ।।

নিচ্ছ যদি বীর্য নিও

ঘাম পাবে না নাম পাবে না

অন্য বাবুর সঙ্গে মিশেল

করলে কিন্তু ভাগ পাবে না

এর বীর্য তুলনাহীন

বংশবিহীন দুকূলহীন ।

[ নিজেরা আপসে ফিসফিস আলোচনা করেন বৃদ্ধেরা ]

বলেছিল বটে এর কথা মহাকরণের সেই ভৌগলিক

সাতবাষ্টে তেলচিটে টাকার বাণ্ডিল নিতে-নিতে ।

আউলবাবু ( বৃদ্ধদলের উদ্দেশে, নাচতে-নাচতে ) ।।

মোটেই আমরা ভেড়ুয়া নই আমরা হলাম সেবকদেশি

বইপত্র দেয়াললিখন দেখতে পারেন আমরা কেমন

গুরুবাবা চিন্তা করেন ভাবের ঘরে লাগিয়ে এসি

মাঙনা আমরা কাজ করি না যখন যিনি তখন তেমন ।

[বৃদ্ধদলের প্রস্হান । বৃদ্ধাদলের প্রবেশ ]

বৃদ্ধাদল ( কোরাস, চিত্রাঙ্গদার উদ্দেশে ) ।।

ভিনশহরে দেশ-বিদেশে

ভাষার বীর্য ভাষায় মিশে

লিঙ্গ এনার একলেকটিক

চলবে না তা পুজোর ঘরে

দশক-দশক ওসব ক্লিশে

বাক-তাড়ুয়ার ঠিক-বেঠিক ।

আউলবাবু ( স্বগতসংলাপ, নাচতে-নাচতে ) ।।

সন্দেহ যে বুকের পাটা কি এর পেটালোহা যুদ্ধার মতন ?

দেখলে তো মনে হয় রোদে পোড়া খ্যাংরাটে চাষি

লাশটাকে দেখেও তো মনে হচ্ছে ছাতাপড়া বাসি ।

[ বৃদ্ধাদলের প্রস্হান ]

চিত্রাঙ্গদা ( সকলের উদ্দেশে ) ।।

আরে ছাড়ো তোমাদের তর্ক । মনে হয়

জোয়ান উন্মত্ত হাতি রসে এলে কতটা উন্মাদ

হতে পারে, কোনোই ধারনা নেই তার

কেবল যোনির শান্তি তাকে প্রভাবিত করে দেবে ;

আমরাও ওভাবেই প্রভাবিত করেছি এনাকে ।

এঁর লিঙ্গ আমাদের দ্বারা প্রভাবিত ।

[ বৃদ্ধদল ও বৃদ্ধাদলের প্রবেশ ]

বৃদ্ধদল ( কোরাস, বৃদ্ধাদলের উদ্দেশে ) ।।

তা না হয় হল কিন্তু শেষকালে কী হল ?

বৃদ্ধাদল ( কোরাস, বৃদ্ধদলের উদ্দেশে ) ।।

তা না হয় হল কিন্তু শেষকালে কী হল ?

আউলবাবু ( স্বগতসংলাপ, নাচতে-নাচতে ) ।।

চুলোয়-যাওয়া মানুষটা কি সত্যিকারে যোদ্ধা ?

অর্জুন প্রতাপাদিত্য নাকি সেই পোর্তুগিজ রোদ্দা ?

প্রতাপাদিত্যের মতো মরে গেল খাঁচায় সফরে দরবারে ;

ভাবতে পারিনি হবে লাশটার দাবিদার এতজন নারী !

[ বৃদ্ধদল ও বৃদ্ধাদলের প্রস্হান ]

ক্যারল নোভাক ( ক্রুদ্ধভাবে মাথার সোনালি চুল ঝাঁকিয়ে ) ।।

তোমরা ভেবেছ বুঝি আমার কোনও দাবি নেই !

আমি এঁকে মাদকের যৌনতার যাবতীয় নিষিদ্ধের সাথে

করিয়েছি পরিচয় ; যাকে ইনি পতনের পাঁক ভেবে ছিলেন চিন্তিত

আমি ওঁকে সেই স্বর্গে নিয়ে গেছি । অন্ত্র পাকস্হলি ফুসফুস

আমার সংগ্রহে নিয়ে যেতে চাই ; নীলকন্ঠ থাকবে বয়ামে

অতিথিরা এলে দেখবেন অচেনাকে ভালোবাসা কাকে বলে

বিদেশি প্রভাবে আমি প্রভাবিত করেছি এনাকে ।

বিশ্বাস না হয় যদি আউলবাবুর কাছে জেনে নিতে পারো ।

বৃদ্ধদল ( কোরাস, ক্যারলের উদ্দেশে ) ।।

পাঁক নিবি তো পাঁকই নে না

নিষেধগুলো পতনগুলো

চাইলে কি হয় লেনা-দেনা

আঠা তো সব পোস্ত কুঁড়ির

তোর তাতে কী বল অবদান ?

নোস তো তুই রেডিন্ডিয়ান !

আউলবাবু ( স্বগতসংলাপ, নাচতে-নাচতে ) ।।

না বাবা না, আমি ওনার ওসব জিনিস দেখতে যাব কেন ?

শুধুই খপর দেয়া আমার কাজের মধ্যে পড়ে ।

মনে হয় এইবার মানেমানে কেটে পড়াটাই ঠিক হবে ।

[ বৃদ্ধদলের প্রস্হান । বৃদ্ধাদলের প্রবেশ । ]

বৃদ্ধাদল ( কোরাস, ক্যারলের উদ্দেশে ) ।।

ববাম গো তোর বহুজাতিক;

যা ভাসবে তার পতন কোথায়

জোড় বাঁধলে স্বর্গ দেখিস

মাদক নেবার মজায় বোধ হয়

বড্ডো তোদের পতন নিয়ে

চুল-গামানো ফোকাস-বাতিক ।

আউলবাবু ( স্বগতসংলাপ, নাচতে নাচতে ) ।।

যুদ্ধ করে মরবে লোকে এ-কথা তো সবাই জানে !

চোকার যা তা চুকেই গেছে, এখন একে লোপাট করো দিকি

আস্ত কিংবা টুকরো করে সরাও একে আঁস্তাকুড়ে

তারপর তো গপ্পো বুনে নথিবাবা লিখবে পুঁথি ।

ক্যারল নোভাক ( সবায়ের উদ্দেশে ) ।।

জিরাফের উঁচু-মাথা, সাদা ভাল্লিকের তুষারের শুভ্রতায়

একা-একা গর্বোদ্ধত শিকারের খেলা

গোরিলার আদিগন্ধ বুক থাবড়ানো

তোমাদের রাজনীতি-সংস্কৃতির নয়

স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে নেশাগ্রস্ত আমিই দিয়েছি

সেসব বিদেশি আরণ্যকতার হাল-হকিকত

বিশ্বাস না হলে এঁকে লাশকাটা ঘরে ফেলে কেটেকুটে দ্যাখো

এঁর অন্ত্র আমারই দ্বারা প্রভাবিত

ফুসফুসে আমারই ঘনিষ্ঠ প্রভাব

পাকস্হলিতেও পাবে প্রভাব আমার ।

[ বৃদ্ধদল ও বৃদ্ধাদলের প্রবেশ ]

বৃদ্ধদল ( কোরাস, বৃদ্ধাদলের উদ্দেশে ) ।।

তা না হয় হল কিন্তু শেষকালে কী হল ?

বৃদ্ধাদল ( কোরাস, বৃদ্ধদলের উদ্দেশে ) ।।

তা না হয় হল কিন্তু শেষকালে কী হল ?

আউলবাবু ( স্বগতসংলাপ, নাচতে-নাচতে ) ।।

কী করে শিখল যুদ্ধ প্রেমিক প্রবর পচামড়া ?

মেটিং কলও দেখি হয়ে গেল যুদ্ধ-হুঙ্কার !

[ বৃদ্ধদল ও বৃদ্ধাদলের প্রস্হান । ]

অবন্তিকা ( শান্ত কন্ঠে ) ।।

তোমাদের যার যা নেবার কেটেকুটে নিয়ে যাও

অবশেষ যা থাকবে তা আমার, কেননা এ-যুবা চিরকাল

ঠকিয়েছে ভুলভাল কথা বলে অস্তি-নাস্তি করেছে ভণ্ডুল–

শেয়াল শকুন কিংবা হাঙরের মুখে এর অবশেষ দিলে

তবেই সোয়াস্তি পাবে হাড়কাটা গলি ।

[ বৃদ্ধদলের প্রবেশ । ]

বৃদ্ধদল ( কোরাস, অবন্তিকার উদ্দেশে ) ।।

কে বললে তুই শান্তি পাবি

অস্তি-নাস্তি ঘূর্ণিতে

পাবার হলে আগেই পেতিস

যখন প্রেমের দাম নিতে

ঝাঁপাই ঝুড়ে গুণছ খাবি

শরৎ বর্ষা আর শীতে ।

[  বৃদ্ধদলের প্রস্হান ও বৃদ্ধাদলের প্রবেশ । ]

বৃদ্ধাদল ( কোরাস, অবন্তিকার উদ্দেশে ) ।।

কেন এঁটো লাশ নেবে শেয়াল-শকুন

ফেলে গেছে যাকে বেওয়ারিশ

তোদের ভাষার চামুকুন,

হতেই পারে না এ হাঙরের ডিশ

দ্যাখ যুদ্ধক্ষেত্র চেড়ে বেপাত্তা সবাই

রাজার কোঁচড়ে কিংবা রানির আঁচলে

ব্যাঙরা এ-দল ছেড়ে গিয়েছে ও-দলে,

ইংরেজের হাতে-গড়া ব্যাঙ ওরা

টিভি দপতরে গিয়ে বাতেলা ঝাড়ছে ঘাড় নেড়ে ।

আউলবাবু ( স্বগতসংলাপ, নাচতে-নাচতে ) ।।

এ তো দেখছি কিংবদন্তি মেতিং গেম থেকে ফিরে

আলফা পুরুষ টেসটোসটেরনে টানে যদিও জানতুম

যাই বাবা কেটে পড়ি নথিবাবাদের দপতরে ।

( কলম ও ডায়রি ঝোলায় পুরে দৌড়ে পালায় আউলবাবু, নাচতে-নাচতে । )

[ ধুলিকণাদের ঝড় ফিরে আসে আরো বেগে ; পুরুষের শবটিকে ঘিরে

রঙিন ঘূর্ণির নৃত্যে সমবেত যুবতীকে চোখ ঢাকা দিতে বাধ্য করে ।

শবটির চারিধারে বসে পড়ে তারা । ঝড় থামে ।

যুবতীরা চোখ খোলে ঝিরিঝিরি নম্র বাজনায় । সকলেই ঝুঁকে পড়ে

চিৎকার কোরে পুরুষের নির্ধারিত অঙ্গগুলো দেখতে না পেয়ে

ওপরে দুহাত তুলে যুবতীরা হাহুতাশ করে…

নেপথ্যে সরোদে তিলক কামোদ রাগে অবরোহ শোনা যায় ]

কুলসুম  ( উঠে দাঁড়ায় )।।

এ কি ? কে এই পুরুষ ? হাত দেখছি না ! নিশ্চই নিয়েছ কেউ ।

নন্দিতা ( উঠে দাঁড়ায় ) ।।

সত্যি তো ! ঠোঁট দেখছি না ? ওফ কী বিভৎস মুখ !

কী হবে তাহলে ? গর্ভে ওর কুলবীজ থেকে গেল–

পরের প্রজন্মগুলো চলে গেল ওর আওতায় !

ভূবনমোহিনী  ( উঠে দাঁড়ায় )।।

হাঁ-মুখে জিভও নেই ; দুর্গন্ধিত পোকারা চলছে !

আমারও জরায়ুতে ওর ধাতুরস গড়ছে সন্তান জানি ।

চিত্রাঙ্গদা ( উঠে দাঁড়ায় )।।

এ-সব লুচ্চা প্রেমিকদের শেষকালে এই দশা কতোই দেখেছি,

সে-কথা ভেবেই আমি ওর জনন-ইন্দ্রিয় ভাবলুম পাবো ; কে জানতো

ওই মাংসখণ্ডটাও জালজোচ্চুরির বীজে ভরা !

প্রভাবের বীজ ফেলে চলে গেছে সবকটি প্রেমিকার দেহে ।

ক্যারল নোভাক ( উঠে দাঁড়ায় )।।

ফুসফুস পাকস্হলি অন্ত্র বৃক্ক কিছুই তো নেই ; বুক থেকে তলপেট

খাঁ-খাঁ করছে দেখছি । সন্দেহে ভুগছি এই ভেবে, ছিল কি কখনও

নাকি সব মাদকের ভ্রমে গড়া ছবিগুলো ভেঙেছে লোকটা চুপিসাড়ে

আমাদের সবাইকে নিজের নাস্তিকজালে ফেলে রেখে সটকে পড়েছে !

উল্টে আমাকেই প্রভাবিত করে গেল

গর্ভে রেখে চলে গেল নিজের বিজয়ী ঝলকানি ।

অবন্তিকা ( উঠে দাঁড়ায় )।।

জানতুম, জানতুম, মরেও ঠকাবে এই লোক ;

পুরো প্রকৃতিকে, মেঘ রোদ ঝড় রঙসুদ্ধ দখল করেছে

ভাষাকে লাগাতো কাজে যখন তরুণ আর ডাকাবুকো ছিল

শব্দ-বাক্যে ফাঁদ পেতে আমাদের অযৌক্তিক আত্মীয় করেছে

হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক, ইরর‌্যাশানাল সম্পর্কের মনোমুগ্ধকর টোপ

উফ যা উপেক্ষা করা ছিল অসম্ভব ।

প্রভাব রেখে গেল শরীরে আমাদের । অক্ষরের সন্তানেরা,

তারা নিশ্চয় এর যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে আঘাত হানবে মনোমত ।

[ অসহায় তরুণীরা মৃতদেহ ঘিরে বসে পড়ে । ঠিক তখনিই ঝড়

পুনর্বার আগুনের ধুলো নিয়ে দৃশ্যকেন্দ্রে আবির্ভূত হয় ;

টের পাওয়া যায় না কী ঘটছে লাশটিকে ঘিরে,

ছেয়ে যায় চারিদিক দুচোখ ধাঁধানো ঘন নীলাভ আলোয় ;

দৃশ্যকেন্দ্রে শ্রীমন্তিনী আবির্ভূত হন, হলুদ টপ ও জিন্স-পরা । ]

শ্রীমন্তিনী ।।

কিছুই পাইনি আমি এই পুরুষের কাছ থেকে

যদিও আমিও তোমাদের মত এর ভালোবাসা পেতে কত

দিন রাত্রি সপ্তাহ বছর মাস চেষ্টা করে গেছি

তবে জানি আমি এঁর মস্তিষ্কের প্রত্যেকটি কোষে

শব্দ-বাক্য চিহ্ণ-ছবি হয়ে আছি রেমব্রাঁর ইহুদি দম্পতি

যেভাবে রয়েছি আমি অজন্তার মোহিনী  ম্যুরালে

কোণারক খাজুরাহো মহাবলিপুরমের সম্ভ্রান্ত অর্জুনে

চিনের পোড়ানো মাটি-যোদ্ধাদের রহস্যতে মিশে

সান্তো দোমিঙ্গোর সিংহে ইরানের আর্দাবেল জাজিম-বুনোটে

জ্যাকসন পোলকের একত্রিশে আর ভ্যান গঘের কেদারায় ।

দেখতে পাচ্ছ না ? তোমাদের সবকিচু দিয়ে দিয়েছেন ;

কী করবে মৃতদেহ থেকে মাত্র তোমার প্রণয়ে তৃপ্ত অঙ্গখানা নিয়ে ?

ঠিক করে চেয়ে দ্যাখো প্রতিটি অঙ্গই এঁর দেহে বর্তমান ।

এনার শবটি নিয়ে আমরা সবাই মিলে চলো এক উৎসব করি

জীবনের যাপনের বিজয়ের মহা-উৎসব ।

কুলসুম ।।

ঠিকই বলেছ তুমি ; ভালোবাসাবাসি নিয়ে উৎসব করি ।

চিত্রাঙ্গদা ।।

মনে হয় আমরাও উৎসবে মাতি সকলেই ।

ক্যারল নোভাক ।।

চলুন তাহলে । মৃতদেহ ঘিরে সমবেত উৎসব হোক ।

[ আরেকবার ঝড় ওঠে, এইবার সাতরঙা ঝড় । যুবতীরা

সকলে একত্রে শবদেহটিকে তুলে অন্তরালে চলে যান ।

আড়ালে বাজতে থাকে মৃদু ইগর স্ত্রাভিন্সকির কনচের্তো বেহালায় ;

শোনা যায় যুবতীগণের উল্লাস—

দৃশ্যকেন্দ্রে আরো বেশি আলোকিত হয়ে ওঠে রঙের মিশ্রণ । ]

( রচনাকাল : সেপ্টেম্বর-নভেম্বর ২০১২ )

Posted in হাইপাররিয়াল পদ্যনাটিকা | Tagged | Leave a comment

যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের

পাত্রপাত্রী :

১. কাশ্যপ ফিকির ; বৃদ্ধ : শবের বাগানের কেয়ারটেকার । ২. বদ্যিনাথ ; যুবক : কাশ্যপ ফিকিরের ছেলে । ৩.বিভূতিসুন্দর ; প্রৌঢ় : ষষ্ঠ শতকের সম্রাট হর্ষবর্ধনের গুপ্তচর । ৪. দেবযানী :  আঠারো শতকের যুবতী ।  ৫. চিনু হাঁসদা ; প্রৌঢ় ; নীলচাষি : ১৮৬০ এর বিদ্রোহে নিহত । ৬. হাঁদু লস্কর ; যুবা ; নীলচাষি : ১৮৬০ এর বিদ্রোহে নিহত। ৭. পাঁচটি শেয়াল ; ২১ শতকের রাজনৈতিক দলচারী । ৮. তিনটি শুয়োর ; ১২ শতকের রাজদরবারের কর্মী। ৯. খুনির দল ; বর্তমান যুগের ভাড়াটে গুণ্ডা ।

মঞ্চদৃশ্য :

[ বিঠোফেনকৃত ওড টু জয় সঙ্গীতে

ছেয়ে আছে পরিদৃশ্য শবের বাগান ।

গাছপালা ঝোপঝাড়ে ঘেরা অন্ধকার

গোরস্তান । লোপাটের জন্য নির্ধারিত

এটি ; শাসকের দ্বারা যারা কুচিহ্ণিত

এবং যাদের মেরে ফ্যালা হয়েছিল

আর সেই সাথে এ-হুকুম ছিল, এরা

মাটির তলায় জ্যান্ত লাশ হয়ে পোঁতা

থাক চিরকাল ; টিকে থাক অবহেলা

ভুগে । শশাঙ্কের দিনকাল থেকে এই

গোরস্তান দেখাশোনা করছে ফিকির

বংশের প্রথম ছেলে পরম্পরা মেনে ।

হয়তো সম্রাট অশোকের হত্যাকৃত

ভাইরাও আছে এই শবের বাগানে ।

এখন যে কেয়ারটেকার তার নাম

কাশ্যপ ফিকির । সন্ধ্যা হতে ভোর ওব্দি

দেখাশোনা কোরে বাড়ি ফেরে সূর্যোদয়ে ।

আজ তার সাথে যুবা ছেলে বদ্যিনাথ

এসেছে বাবার কাছে । কজন মানুষ

প্রতিরাতে কবরের পাথরটা তুলে

কেমন বেরিয়ে আসে দেখতে চাইছে ।

প্রতিটি কবরে আছে নামের ফলক ;

পালি ব্রাহ্মি নাগরি বাংলায় নাম লেখা ।

যুগ অনুযায়ী গোরেতে গ্রাফিতি আঁকা । ]

কাশ্যপ ।।

কাল ঝড় হয়ে গেছে অথচ বৃষ্টির

দেখা নেই ; যতই বা পরিষ্কার করি

চির-গোরস্তান ; সত্যি চিরকেলে এই

মড়াদের জমায়েত মাটির তলায় ;

অনেকে বিভ্রম ছাড়া দিব্বি বেঁচে থাকে ।

শসাঙ্ক রাজার দিনকাল থেকে বা তারও

আগে থেকে বেঁচে আছে লোপাটের লাশ ;

শুনেছে কি কেউ অন্য সমাজে বা দেশে

মরার পরও জলচল চলবে না

এরকম রীতি ? শুধুই এ পোড়ামুখো

লোকগুলোদের তৈরি সমাজে রয়েছে ;

এদেশ শাসন করে কাকতাড়ুয়ারা ।

কত ঝড় বয়ে গেল কত রাজা এলো

আর চলে গেলো, অথচ এ-গোরস্তানে

বেঁচে আছে সেইসব মানুষেরা যারা

অকারণে মরে যেতে বাধ্য হয়েছিল ;

মহারাজ অশোকের ভাইয়েরা আছে–

কেবল মৃতের থাকে বিভ্রমী বাস্তব ।

বদ্যিনাথ ।।

মৃত্যু তো কারোর বাসি স্মৃতির ছত্রাক ;

আমার মস্তিষ্কে কেন একজন নারী

বারবার মৃত্যুর ওপার থেকে ডাকে,

সে কোন রহস্যময়ী আছে এইখানে

যে আমার শরীরের গন্ধে জেগে ওঠে ?

কাশ্যপ ।।

কী ভাবে মরণ এলো সেটা জীবিতের

বাঁচার সমস্যা ; মরার সময়ে ওটা

অবান্তর প্রশ্ন বলে আমি মনে করি;

জন্মাবার মতো মৃত্যুর পথেও ভিড়।

বদ্যিনাথ ।।

কিন্তুবাবা ছোটোবেলা থেকে গোরস্তানে

দেখছি চাকরি করে রোজগার করো,

এখানে না এলে তোমার মনটা কষ্ট

পায় বলে প্রতিরাতে ঝড়বৃষ্টি অনাছিস্টি

যা-ই হোক আসা চাই দেখি ; কী যে কাজ

তাও তো বুঝি না, শুধু পরিষ্কার রাখা,

কতটুকু সময় বা লাগে, বড়োজোর

এক থেকে দেঢ় ঘন্টা, তবু সারারাত

কাটাও এখানে ! কারা এরা ? মরে বেঁচে

রয়েছে তোমার চোখে, এদের আত্মীয়

ধারেকাছে আসে না এখানে কোনোদিন ?

হয়তো এখানে পাবো স্বপ্নে-দেখা নারী

যে আমার পপতিতি প্রশ্বাসে উচ্চারিত ।

কাশ্যপ ।।

ঘৃণাকে অর্জন সকলের কম্মো নয় ।

গুণ্ডা-লেঠেলরা শাসকের কথা মেনে

গুমখুন করে লাশ পুঁতেছে এখানে ;

এদের বাড়ির লোক কাঁদেনিকো তবু ।

পাতালে রয়েছে জেনে চুপ মেরে গেছে ।

লাশেদের চিনি আমি, দাদুর সময়

থেকে দেখছি এদের, তবে দূর থেকে,

আড়ালে নিজেকে ঢেকে । দেখবি কেমন

এক-এক করে কেউ-কেউ বের হবে

আর নিজেদের মধ্যে কইবে কত যে

কথা, তার ঠিক নেই । তার আগে আয়

তাড়িতে ভিজিয়ে রুটি আর মাংস খাই ।

মাটির তলায় গিয়ে সকলেই বাংলা

কথা বলে, ঠিক যেন আজকের লোক ।

পোঁদে বাঁশ না খেলে সত্য অজানা থাকে

একমাত্র মড়ারাই জানে মরে গেলে ।

[ কাঁধের তাড়ির হাঁড়ি ঘাসের ওপর

রেখে, বাপ আর ছেলে তাড়িতে চুবিয়ে

এক মনে রুটি খায় । এত গাছপালা,

চাঁদের রুপালি আলো ঢুকতে চায় না ।

রাত ঘন হলে গাছের আড়ালে গিয়ে

বসে দুইজনে । বহুক্ষণ চুপচাপ ।

একটি কবর থেকে হর্ষবর্ধনের

চর, বিভূতিসুন্দর , শশাঙ্কের বিষে

মরেছিল, বেরোয় জরির মেরজাই

পরে, আর আড়মোড়া ভাঙে । আরেকটি

কবরের চাপা তুলে বেরোয় সুন্দরী

প্রাক-আধুনিকা, শরীরে সেকেলে শাড়ি,

কোমর পর্যন্ত চুল ; রাজধর্ষণের

পর, সামন্ত-চামচাদের গতি-করা । ]

কাশ্যপ ।।

লোকটার নাম নাকি বিভূতিসুন্দর,

গুপ্তচর ছিল রাজা হর্ষবর্ধনের ।

মেয়েতাকে দেখছিস, নাম দেবযানী,

কোনো এক প্রেমিকের জন্য বসে থাকে ।

ওই দ্যাখ বেরোলো দুজন জাতচাষি,

নীলকর সায়েবরা দে-মার দে-মার

দিয়ে, সপরিবারে পুঁতেছে থ্যাঁতা লাশ ।

আওয়াজ করিসনি যেন একেবারে

নয়তো সবাই এরা ধোঁয়ার কুণ্ডলী

হয়ে ঢুকে যাবে যে-যার চিহ্ণিত গোরে ;

চুপচাপ শোন, মৃত্যু কেমন মজার,

শুনে আটখানা হবি এদের কথায় ;

শবের সমস্যা হল তার গান নেই ।

বিভূতিসুন্দর ।।

কি গো দেবকন্যা, এখনো কি দেহজুড়ে

মর্ষকামী শাকসের দুর্গন্ধ রয়েছে

তোর দেহে ? জানলুম শশাঙ্কের দেশ

দুরাচারী মিথ্যাচারী অসাধু মানুষে

ছেয়ে গেছে, কয়েক শতাব্দী কেটে গেল

আরো অবনতি হয়েই চলেছে দেখি ।

বেড়ে গেছে হায়নাগুলোর অত্যাচার ;

গরিবের সংখ্যা দেখি বেড়েই চলেছে,

অথচ হামবড়াই শুনি বিপ্লবের–

গোরের ভেতরে শুয়ে, বড়-বড় কথা

রাজনেতাদের কন্ঠে, কী যে আহামরি,

চিৎকার চেঁচামেচি কুচুটে শ্লোগানে ।

একদা অশোক নাকি অহিংসার বাণী

লিখেছিল কুঁদে-কুঁদে পাথরে-শিলায়,

সে-সব লোপাট হয়ে যাদিঘরে রাখা ।

তারপর, তোর কথা বল । কই তোর

যুবা সে-পুরুষ এলো না তো আজকেও !

দেবযানী ।।

প্রতিদিন অপেক্ষায় থাকি পথ চেয়ে ;

কিছুই যায় না ভোলা । হত্যাকারীদের

স্মৃতিগন্ধ দেহ থেকে যাবে না কখনো ।

কর্তা যায় কর্তা আসে, ভ্রষ্টগণ থাকে

এদেশি সমাজে, চেহারা বদল করে,

কেননা খুনিরা ছাড়া চলে না শাসন ;

নাঋই হয়ে নারী থাকা সবচে কঠিন

আজকের দিনে ; বহু নারী গোরস্তানে

এনে পুঁতে দিচ্ছে শাসকের পেয়াদারা ;

কোনোই বদল তো এদেশে দেখছি না ;

গর্ধভেরা চিরকাল শাসক হয়েছে ।         

নীলচাষি চিনু হাঁসদা ।।

নীলচাষ হয়নাকো আর শুনি বটে

কেবল হত্যার চাষ হয় আজকাল ;

সবচে উত্তম শিল্প শবকে সাজানো ।

ফোঁপানি-মাখানো গান ভেসে-ভেসে আসে

কবরের নিরিবিলি শান্তিভঙ্গ কোরে ।

মরেও নিস্তার নেই এই পোড়া দেশে ।

দেবযানী তোমার প্রেমিক এলোনা তো ?

নীলচাষি হাঁদু লস্কর ।।

শাসকের মোসাহেব নিকৃষ্ট লোকেরা

শাসকের দিকে যারা তারা জল্লাদের

দিকে থাকে, তাছাড়া উপায়-পথ নেই ।

যে যুদ্ধ গোষণা করে সে নিজে মরে না ।

দেবযানী তোমার পুরুষ এলোনা তো ?

কাশ্যপ ।।

ওই দ্যাখ তিনটে শুয়োর বের হল,

কুকাজ করেছিল রাজার আমলে

তাই হুকুম-বরদারের গনগনে

লোহার শাবল পেটে নিয়ে মরেছিল ।

আসলে তখন ওরা শুয়োর ছিল না ;

কবরের মধ্যে ঢুকে শুয়োর হয়েছে

জানিনাকো কোন জাদুমন্তরের বলে !

এ এক আজব মাটি ; কখনো শুয়োর

পায় মানুষের রূপ, আবার কখনো

মানুষেরা শুয়োরের মাথা পেয়ে যায় ।

বদ্যিনাথ ।।

আমরা কুমাংস খাচ্চি হবে না তো কিছু ?

কাশ্যপ ।।

কুকাজ কুকথা বলে আর কিছু নেই,

গণিত-বর্জিত দেশে বৃত্ত গোল নয়–

তথ্য বলে কিছু নেই, শুধুই ঘটনা;

এখন তো যা ইচ্ছে খাবার দিনকাল

যা ইচ্ছে করার বলবার পচাযুগ,

কয়েকটা লাশ আসে প্রতিদিন গোরে

যেকানে জায়গা পাই ঠুসে দিই মড়া

আদিতে যারই নাম কবরে থাকুক

তাছাড়া উপায় নেই, বড্ডো স্হানাভাব;

দিনের বেলায় তাই বোবা সেজে থাকি ।

বদ্যিনাথ ।।

তোমার তুলনা নেই, বাপ বটে তুমি ।

দেবযানী নামে ওই যুবতিকে দেবে ?

লাস তো তোমার কেয়ারে চিরকাল ।

একবার ভালোবাসা যথেষ্টের বেশি ;

আমার নামটা ওর মুখের ভেতরে

ফেলে, দেখবো কী হয় শবে মেয়েটির !

আমি যে আমিই তার প্রমাণ তো পাবো ।

মনে হয় বহুযুগ ওই নারীটির

অপেক্ষায়, কাটিয়ে এসেছি আজ এই

শবতীর্থে ; এখানে মিলব দুইজনে ।

হয়তো আমিই ওর প্রেমিক ছিলুম !

কাশ্যপ ।।

মাথামুণ্ডু নেই তোর ভাবনা-চিন্তার ।

কেউই বাস্তব নয়, অন্য জগতের ।

এলাকার মানুষেরা এটাকে নরক

বলে মনে কোরে আড়চোখে চলে যায় ;

আমাকেও ভুত ভাবে, দেখেছিস নিজে ।

অবাস্তব ও জগতে কেবল মড়ারা

বেঁচে থাকে । তুই তো বাস্তবে রয়েছিস ।

তোর চেয়ে তিনশত বছরের বড়ো ।

ভালোবাসা হয়নাকো আঘাতবিহীন,

রক্ত না ঝরলে প্রেম অসম্পূর্ণ থাকে ;

মেয়েটি কুমারী নয় বলে রাখি তোকে ।

বদ্যিনাথ।।

বাস্তব জগতে আছি আধপেটা খেয়ে,

বেকার যুবক আমি । তুমি মরে গেলে

এ-চাকরি পাবো , যা আমার ভাল্লাগে না ।

ওই মেয়েটিকে বড়ো ভালো লেগে গেছে

ওকেই বিবাহ করে বাড়ি নিয়ে যাব,

নয়তো সংসার পাতি ওরই কবরে

ঢুকে, থেকে যাব চিরকাল ওর সাথে ।

যাকে তুমি ভালোবাসো আর যে তোমাকে

ভালোবাসে, জানি তারা সতত পৃথক ।

কী হবে কৌমার্য নিয়ে ? চাই তো প্রেমিকা !

কাশ্যপ ।।

বিপথে হারিয়ে গেলে ছুটে যেতে হবে ।

যদি প্রত্যাখ্যাত হোস নষ্ট হয়ে যাবি ।

বদ্যিনাথ ।।

বিপথে না গেলে রাস্তা খোঁজা অসম্ভব ।

প্রেম নিবেদন কোরে প্রত্যাখ্যাত হবো ।

কাশ্যপ ।।

দরবারি দলচারী দেবে তোকে জেলে ।

বদ্যিনাথ।।

পালাবো সেকান থেকে । কয়েদিরা জানে

জেল মাত্রে পলায়নকারীদের স্বর্গ ।

প্রেমিককে বেঁধে রাখা জেনি অসম্ভব ।

কাশ্যপ ।।

মেবেতি বিধর্মী হতে পারে বলে রাখি ।

বদ্যিনাথ।।

নারীর হয় না ধর্ম । ওটা পুরুষেরা

নিজেদের জননাঙ্গ ঘিরে বানিয়েছে ।

তাছাড়া মৃত্যুর কোনো ধর্মাধর্ম নেই ।

প্রেমেরও কোনো ধর্মাধর্ম হয়নাকো ।

মৃতদেহ দেখে কে বোঝে কী গল্প ছিল ?

কাশ্যপ ।।

সৌন্দর্য দুর্বল করে । বেশ ক্ষতিকর ।

বদ্যিনাথ ।।

ভালোবাসা পেয়ে নারী সুন্দরী হয়েছে ।

কাশ্যপ ।।

সৌন্দর্য যে সন্ত্রাস তা জানিস কি তুই ?

বদ্যিনাথ ।।

সৌন্দর্য মাংসে নেই । অনপনেয় তবু ;

সুন্দরীর ভালো-মন্দ বলে কিছু নেই ।।

ওকে ভালোবেসে আমি মরে যেতে পারি ।

কাশ্যপ ।।

তাড়ি টেনে মগজের মধ্যে তোর যম

ডাকছে বোধয় । যা চাই তা কর গিয়ে,

কেয়ারটেকারি বংশ ধুচবে অন্তত,

অন্য লোকেদের পাপে ভুগতে হবে না ;

হতে পারে তোরই অপেক্ষা করে আছে

আবেগকে খেয়ে ফেলা সবচেয়ে ভালো ।

মৃতেরা যৌনতা হীন মনে থাকে যেন ।

বদ্যিনাথ ।।

যৌনতা কী বস্তু ? উঁচুনিচু মাপজোক

প্রতিরাতে পা ছড়িয়ে মিনিট কয়েক

প্রেম কি পায়ের ফাঁকে মিনিট পনেরো

মাংসে-মাংসে তরলতা আদান-প্রদান ?

[ একটি কবর থেকে পাঁচটা শেয়াল

পতাকা উঁচিয়ে বের হয়ে চিৎকার

ধ্বনিতে জানায়, “গোরস্তান মুর্দাবাদ ;

নয়তো মানুষজন্ম ফিরে দিতে হবে,

চাকুরি-বঞ্চিত হয়ে আর থাকব না ।”

তাদের চেঁচানি শুনে অন্যেরা কবরে

ঢুকে পড়ে তাড়াতাড়ি । নিঃশব্দ কবরে

বাজে বব ডিলানের ‘ব্লাড অন ট্র্যাক্স’ ।

শুয়োরেরা শেয়ালেরা গোরে ঢুকে যায় । ]

কাশ্যপ ।।

ওরা সব রাজনীতি-করিয়ের ঝাঁক,

জানিনাকো কোন দলে ছিল, রোজ দেখি

আজকে এ-চেঁচানি, কালকে অন্য কথা ।

আজকে শেয়াল বটে কাল হবে কাক

তারপর দেখা দেবে হায়েনার রূপে

অথবা হয়তো হবে বুড়োটে শকুন ।

এদেশে প্রেমের আর স্হান নেই কোনো ।

বদ্যিনাথ ।।

যারা রাজনীতি করে প্রেমিক হয় না ।

পাগল উন্মাদ যত নচ্ছার বজ্জাত

ব্যাটারা মরেও পালটায়নি দেখছি,

এদেরই জন্যে দেশ রসাতলে গেল ।

নীল শেয়ালেতে আজ ছেয়ে গেছে দেশ ।

নীল শেয়ালেরা লাল রঙে পালটায়

অথবা সবুজ রঙ নিয়ে শাসকের

সিংহাসন ঘিরে ল্যাজ দুবেলা নাড়ায় ।

কেন যে এদের রক্তে ভালোবাসা নেই ;

শবেদের ওব্দি এরা কলুষে মুড়েছে ।

তাই তো চাইছি ওই সুন্দরীর পায়ে

পড়ে বলি, ‘নিন না আমাকে, আপনার

নাম লেখা গোরে দুজনে বাঁধব জুটি

স্বর্গ-নরকের ; আমি এই নরকের

নর, আপনি স্বর্গের লাশরূপী হুরি ।

কাশ্যপ ।।

তার চেয়ে তুই চেষ্টা কর যাতে মেয়ে

জ্যান্ত হয়ে ফিরে আসে আমাদের মাঝে ;

লাশ থেকে নারী হয়ে স্বর্গ হতে নামে ।

কী করে সম্ভব হবে তা জানি না, তবু

প্রয়াস করতে ক্ষতি নেই ; একজন

মানুষীকে বাঁচার সুযোগ করে দেয়া

যাবে, হলেই বা দেশটা মরার পথে

এগিয়ে চলেছে, তার মধ্যে বেঁচে নেয়া,

যতটুকু সুখ মেলে নরকে থেকেও ।

[ আবার কবর থেকে বের হয় হাঁদু,

চিনু চাষি, বিভূতিসুন্দর, দেবযানী । ]

বিভূতিসুন্দর ।।

সাহসিনী নারী, প্রতিশোধ নিতে হবে

তোমাকে আমাকে, গুমখুনে মৃত যারা

কাটাচ্ছি সময় এই মাটির তলায় ।

ভিন্নরূপে মানব-সমাজে যেতে হবে ।

হয়তো তোমার প্রেমিককে পেয়ে যাবে ।

চাষি হাঁদু লস্কর ।।

কিন্তু সায়েবসুবোরা চলে গেছে শুনি

নিজেদের দেশে গিয়ে খাবার জোটে না

লুটের উপায় পালটে যুদ্ধ লড়ে মরে ।

সত্যি কি প্রেমিক আছে মানব-সংসারে ?

চাষি চিনু হাঁসদা ।।

উপায় পাল্টায় শুধু । ভবিরা ভোলে না ।

প্রতিশোধ নিতে হলে শত্রু পেতে হবে

না্লে মাস্তানি ঢঙে করো খুনোখুনি

আত্মীয়-স্বজনদের কচুকাটা করো ।

তার চেয়ে ভালো গোরে আরামে কাটাও ।

মনে হয় প্রেমিকেরা পৃথিবীতে নেই ।

চাষি হাঁদু লস্কর ।।

গন্ধ পাচ্ছি মনে হল কীরকম যেন

কুমাংস খাবার, হাড় চেবানোর শব্দ ।

জীবিতেরা রক্তমজ্জা চুষে দেশটাকে

ওঠালো বোধয় লাটে, তার শব্দ পাই ।

দেবযানী ।।

মাংস নয়, জীবিত মানুষ কেউ আছে

কাছেপিঠে, তারই শ্বাসের সুরাভাস

থেকে মোদো মরদের গন্ধ ছড়িয়েছে ;

তবে তারা হত্যাকারী নয় মনে করি

কেননা খুনির ঘাম-গন্ধ আমি চিনি ।

বিভূতিসুন্দর ।।

তা্লে কি গন্ধ পাল্টাপাল্টি হয়ে গেছে

জীবন-মৃত্যুর ? গোরস্তানে জীবিতেরা !

সমাজের মাঝে মরা লাশগুলো আজ !

চাষি হাঁদু লস্কর ।।

আমাদের কালে কোনো সমাজ ছিল না ;

মোড়লেরা ছিল, হয়তো এখনো আছে

তাদের মোড়ুলি, ভিন্ন চেহারায় সেজে ;

পোশাক তো দেখি আর সেরকম নেই;

কবরে ঢুকেও বকবক থামেনাকো ।

বিভূতিসুন্দর ।।

হয়তো তোমার কথা ঠিক । প্রতিদিন

যারা আসে, অশ্লীল পোশাক পরে ঢোকে ।

হয়তো সেজন্য তারা শুয়োর শেয়াল

হয়ে রূপ বদলায় মাটির তলায় ।

চাষি চিনু হাঁসদা ।।

আমার তো মনে হয় গুমখুন করা

বলে, শবাচার ঘটেনিকো, তাই ওরা

অমন পোশাক পরে গোরে গিয়ে ঢোকে ।

কিন্তু জীবিতে গন্ধ আছে কাছেপিঠে,

সেই গন্ধ কবরের বুড়োটার নয়,

যে-বুড়োটা প্রতিরাতে ঝাড়পোঁছ করে ।

দেবযানী ।।

আমিও তোমার সঙ্গে একমত । তার

দেহ গতানুগতিক শ্রমে ভিজে থাকে ।

এ-গন্ধ পুরুষ্টু যুবকের তা নিশ্চিত

বলে দিতে পারি; ভয় করে এই গন্ধ ।

এই গন্ধ আমার প্রেমিক প্রতিরাতে

নিজের ঘর্মাক্ত দেহে আনতো লুকিয়ে ।

আমাদের দুজনকে কোটালের চর

খুঁজে বের কোরে, আমাকে ধর্ষণ আর

আমার যুবক প্রেমিককে খুন কোরে

তার দেহ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ভাসিয়েছে

রূপনারাণের স্রোতে বহু যুগ আগে ।

কাশ্যপ ।।

ওফ ! অবিস্মরণীয় দুর্ঘটনা ! আমি তোকে

রূপনারাণের তীরে কুড়িয়ে পেয়েছি

বদ্যিনাথ । ওরে আমি অপৌরুষ লোক,

বংশলিপ হয়ে যাবে ভেবে নদী থেকে

তোকে তুলে এনেছি আমার পরিবারে ;

বিবাহ করিনি তাই তোর মুখ চেয়ে ।

যা নারীকে আনতুম সে তো চলে যেতো

জেনে আমি অপৌরুষ বীর্যথলিহীন ।

যা তুই, চলে যা, শবরূপী প্রেমিকার

কাছে, মুক্তি পাক অন্ধকার দেহ থেকে ।

নিয়ার ফেরত ওকে পৃথিবীর ঘামে,

সংগ্রাম সংঘর্ষে ঘেরা জর্জরিত দেশে ।

অন্তত মৃত্যুর চেয়ে শ্রেয় বেঁচে থাকা

জগতের কুবাতাসে নোংরা দ্বন্দ্ব দ্বেষে ।

বদ্যিনাথ ।।

তুমি যদি বীর্যহীন, গণিকার ঘরে

যাও কেন ? কী করো তাদের বাড়ি গিয়ে ?

কাশ্যপ ।।

যন্ত্রণা সংঘর্ষ পরাজয় মেনে নিতে

জীবিতের শরীরের তাপ পেতে যাই ।

নাঋ-সঙ্গমের জন্য যাই না সেখানে ।

নারীটির বুকে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকি,

জানিস কখন ? হা-হা, দিবা দ্বিপ্রহরে

পা গুটিয়ে শিশুর মতন, দুধহীন

গণিকার স্তন থেকে স্নেহসুধা খাই ।

এবার সমাপ্তি চাই এই জীবনের ।

শব-সমাজের থেকে মুক্তি পেতে চাই ।

তুই যা নিয়ায় গিয়ে মেয়েটিকে ঘরে

বা২চিয়ে আনতে যদি পারা যায় ভালো ;

অন্তত একটি প্রাণী ফিরবে জীবনে

নতুবা এদেশ যাবে শবের কবরে ।

ওর গর্ভ ধেকে যদি নতুন মানুষ

জন্ম নেয়, তাহলে বাঁচাবে দেশটাকে ।

নতুবা কবরে ঢুকে আত্মহত্যা কর ;

হরপ্পা-হরফে লেখ মৃত্যু চিরকুট,

মৃত্যুর বয়ান মৃত ভাষাতেই ভালো ।

বদ্যিনাথ ।।

তাই সই, আত্মহত্যা করি, মেয়েতির

পায়ে সঁপে এ-জীবন যা প্রেমে বঞ্চিত ;

উন্মাদ কবিত্ব থাকে মৃত্যুর হৃদয়ে,

জানি না কী হবে তার ফল ; দেবযানী

যদি প্রত্যাখ্যান করে তবু মেনে নেবো ।

কিছুই নিশ্চিত নয়, না জন্ম, না মৃত্যু,

পঁচাত্তর বচরের বুড়োর দুঠোঁট

দেখে, কেউ বোঝে কি সে খেয়েছিল চুমু ?

[ বদ্যিনাথ ছুটে গিয়ে মেবেতির দেহ

দুহাতে জড়িয়ে ধরে । ফলে হতবাক

দেবযানী ছাড়া অন্যান্য সবাই নিজ

আদল পালটে ফেলে ধোঁয়ার কুন্ডলি

হয়ে যা যার কবরে ঢুকে যায় । মৃদু

‘ব্লাড অন ট্র্যাক্স’-এর স্হানে বেজে চলে

বিঠোফেনকৃত ‘ওড টু জয়’ সঙ্গীত । ]

দেবযানী ।।

জানতুম একদিন আসবেই তুমি,

আমার প্রেমের ডাকে ফিরে । আছো

এখানেই আমি জানতে পারছিলুম

তোমার দেহের সেই পরিচিত গন্ধে ।

মনে আছে ? সেই সন্ধ্যা ? রূপনারাণের

তীরে ? আদান-প্রদান করতুম ছোঁয়া ?

বালির ওপরে শুয়ে বিকেলের প্রেম ?

বদ্যিনাথ ।।

ভালোবাসি, ব্যাস এতটুকু আমি জানি

তিনশ বছর ধরে তাই হেথা-সেথা

খুঁজেছি তোমায় দেবযানী প্রিয়তমা ।

যদি বলো তোমার কবরে বাসা বাঁধি

দুইজনে ; নতুবা আমার সঙ্গে চলো

মাটির কুটিরে গিয়ে সংসার পাতি ।

দেবযানী ।।

কত কথা বলা বাকি আছে বদ্যিনাথ

তিনশ বছর একা ভাবতে কি পারো

স্যাঁতসেঁতে অন্ধকারে অপেক্ষায় আমি

চুপচাপ শুয়ে আছি আলিঙ্গনহীন

পুরুষের ছোঁয়া ও আদরহীন দেহে ?

বদ্যিনাথ ।।

জানি সব জানি আমি যুবতি আমার

তাইতো এসেছি নিয়ে যেতে কুঁড়েঘরে

বাঁধব দুজনে বাসা স্বপ্নের সংসার ।

[ বদ্যিনাথ চুমু খায় উন্মদের ঢঙে

ক্রমশ শাড়ির পাক খুলে চুমু খায়

দেহের সর্বত্র যা অপেক্ষা করে ছিল । ]

দেবযানী ।।

যে-সঙ্গম অসম্পূর্ণ ছিল, এসো আজ

তাকে পরিপূর্ণ করি প্রিয় বদ্যিনাথ ।

[ দেবযানী-বদ্যিনাথ ঘাসে আলিঙ্গনে

পরস্পর মগ্ন যখন, ওদের ঘিরে

ফ্যালে জনাকয় লেঠেল-মাস্তান-খুনি । ]

খুনির দল ।।

মার-মার মেরে ফ্যাল মেরে ফ্যাল মার

মেরে ফ্যাল মার-মার মেরে ফ্যাল মার

মার-মার মার-মার মেরে ফ্যাল মার ।

[ তারা কেউ কবরের ডালা খুলে

আবার কেউবা নিকটের গ্রাম থেকে

একযোগে মর্ত্য-পাতালের লোক মিলে

ছোরাছুরি তরোয়াল নিয়ে আক্রমণ

করে ; প্রেমিক ও প্রেমিকার ছিন্নভিন্ন

দেহ ঘাসের ওপরে ফেলে অট্টহাস্যে

গাছে-বসা পাখিদের ওড়ায় আকাশে ।

অর্ধেক কবরে ঢোকে বাদবাকি লোক

নাচতে-নাচতে অন্ধকারে মিসে যায় ।

পুনরায় শোনা যায় ‘ব্লাড অন ট্র্যাক্স’ ।

কাশ্যপ দাঁড়ায় গিয়ে সদ্য খুন-করা

ছেলে আর যুবতীর শবের নিকটে । ]

কাশ্যপ ।।

সঙ্গম করার কালে মৃত্যুর মতন

স্বর্গীয় সুষমা নেই, তাও গোরস্তানে ।

নেশা কোরে সত্য বলেছিল বদ্যিনাথ :

মৃত্যুর হৃদয়ে থাকে উন্মাদ প্রেমিক ।

[ ভোর হয়ে আসে আর মৃদু বাজনায়

শোনা যায় পুনরায় বিঠোফেনকৃত

‘ওড টু জয়’ । প্রেমিক-প্রেমিকার দেহ

ধোঁয়ার নীলাভ আলো হয়ে উড়ে যায় । ]

Posted in অতিবাস্তব, অধিবাস্তব, মৃত্যুরঙ্গ | Tagged , , | Leave a comment

ভরসন্ধ্যা

কদমগাছ : ভরসন্ধ্যা

কদমগাছ : ভরসন্ধ্যা

[ একটি কদমগাছ ছেয়ে আছে ফুলে ;

গাছটির চারিপাশে উবু হয়ে বসে

উনত্রিশজন বুড়োবুড়ি আর জনা

ছয় যুবক-যুবতী । সকলেই তারা

ওপরে তাকিয়ে আছে কদমগাছের

পানে ; বোঝা যায় তারা অপেক্ষা করছে

গাছটির অন্ধকার থেকে একজন

অতিমানুষের আগমন । লোকগুলো

এসেছে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এ-আশায়

কদম গাছটি নাকি সেই গল্পতরু

যার গন্ধে লুকিয়ে আছেন অবতার–

নেমে আসবেন মর্ত্যে নেতৃত্ব দেবেন ।

লোকগুলোদের দেশে নেতা নেই বলে

কদম গাছের কাছে ভিক্ষা চাইছেন

যাতে একজন অতি-আধুনিক কেউ

মানুষের মঙ্গলের জন্যে আবির্ভূত

হন । অথচ গাছটি নিরুত্তর আজো । ]

বুড়োবুড়ি ( কোরাস ) ।।

কবে থেকে বসে আছি হাপিত্তেশ করে

কদমের গাছ ওগো দাওনা পাঠিয়ে

কোনো লোক, যাকে কাঁধে তুলে আমাদের

মসনদে বসাবো সকলের ভালোর

জন্য। উচিত মানুষ নেই কবে থেকে ।

অন্য জগৎ চাইছি, ভিন্ন ইতিহাস ।

বদল মানে কি স্রেফ নাচের আঙ্গিক ?

পাড়াতুতো নেতা-নেতি দেশটাকে ছিঁড়ে

সোনাদানা রাখছে বিদেশে নিয়ে গিয়ে ;

নয়তো নিজেরা নিজেদের ছিঁড়েফেড়ে

নাচন-কোদন করে জুয়া খেলছেন ।

কারো মুখ যেন লাল বাঁদরের পাছা

আবার কারোর ঘাড়ে শুয়োরের মাথা

কেউ ঝোলে ডালে ল্যাজ ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে

অনেকের জন্ম তো গুয়েরই আঁতুড়ে

পথই নজরে আসছে না আমাদের

কীভাবে পাল্টাবো এই বেজন্মাগুলোকে

যেনাদের কথা থেকে মানেরা লোপাট !

যুবকেরা ( কোরাস ) ।।

খুবই খারাপ যাচ্ছে দিনকাল ; শান্তি

নেই, কোনো দিশা-নির্দেশটুকুও নেই

লেগে আছে খুনোখুনি ধর্ষণ ডাকাতি

রাহাজানি বোমাবাজি কিশোরী পাচার

আর এই সবেতেই যারা দায়ি তারা

দখল করেছে মসনদ কোষাগার

আমাদের সার্কাসে আছে চক্রী ভাঁড়েরা,

বড়ই অভাব এক সৎ মানুষের ।

ভয়ে কেউ স্বপ্ন দেখতেও চাইছে না

সব ডানা রয়ে গেছে ডিমের ভেতরে

বাধ্য হয়ে বাছাই করতে হচ্ছে ভাঁড় ;

উপায় না খুঁজে পেয়ে জঙ্গলে ঢুকেছে

রেগে গিয়ে অনেকেই ধরেছে বন্দুক ।

বানচোতে বানচোতে ভরে গেছে দেশ ।

যুবতীরা ( কোরাস ) ।।

আমরা আরও গন্দা গাল দিতে চাই ;

মনে হয় মাসিকের কানি গুঁজে দিই

ধরে ধরে ওগুলোর মুখের ভেতরে ।

তাই চাই একজন বিশুদ্ধ মানুষ ।

এই সব লুচ্চা-লাফাঙ্গায় ছেয়ে থাকা

বৈভবী বাছাই থেকে মুক্ত হতে চাই ।

কদমগাছ ( নারীকন্ঠে কোরাস ) ।।

রয়েছে আমার স্টকে পাঁচ মহাজন

একে একে গুণাগুণ শোনো ওনাদের

তারপর ভেবেচিন্তে নির্ণয় নেবার

পালা তোমাদের ; নিয়ে যেও যাকে চাও ।

অনেকেই সৎ নয় কেউ কেউ চোর

সকলেই কচু নয় কেউ কেউ ওল

অনেকেই স্নব নয় কেউ কেউ খুনি

সকলেই সাপ নয় কেউ কেউ ব্যাঙ

অনেকেই বোকা নয় কেউ কেউ ছুঁচো

সমস্যা হল যে তারা সবাই মানুষ ।

[ হাততালি বাজালেন কদমের গাছ ।

খচ্চর খুরের ধ্বনি শোনা যায়, কেউ

আসছে মিউলে চেপে এইদিক পানে ।

ভিড়ের ভেতরে এসে ঘোড়া থেকে নেমে

তাকায় সবার দিকে ; বেঁটে-ঘোড়া বাঁধে

কদম গাছেতে । লোকটির খালি গায়ে

চামড়ার শায়া, হাতে বর্শা পিঠে তীর

একটা শুয়োর মরা কাঁধের ওপর ;

তার আগমনে দুর্গন্ধ ছড়ায় এত

সকলেই বাধ্য হয় নাক চাপা দিতে ।

লোকটি নিজের পরিচয় নিজে দেয় ;

একই পোশাকে ঢোকে সাঙ্গপাঙ্গদল । ]

আত্তিলা ।।

আমি হুন আৎতিলা, দেবতার হাতে

গড়া, শান্তি-শৃঙ্খলার ভয়াল মানুষ

দেখছ আমাকে ? বহু দেশ জয় করে

সেখানের লোকেদের কবজায় আনা

কঠিন ছিল না । ছুটিয়েছি সেনাদের

তাদের ওপর দিয়ে থেঁতলে গুঁড়িয়ে

জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে । মেয়েদের

তুলে এনে বিলিয়েছি সেনাদের মাঝে ।

রা কাড়েনি কেউ । ইতিহাস দেখে নাও ।

যে যেমন আছে তেমন থাকায় রপ্ত

হয়েছে সবাই রোম থেকে দানিয়ুব

থেকে বালটিক সমুদ্রের নোনাঢেউ–

আসেনিকো আমার মতন বারোয়ারি ।

সোনাদানা কিছুই আমরা নিয়ে গিয়ে

রাখিনি বিদেশি ব্যাঙ্কে অথবা বাড়িতে ;

বাড়ি-ফাড়ি নেই আমাদের, যেথা ইচ্ছা

সেখানেই ডেরা বাঁধি, আর সে-জায়গা

হয়ে ওঠে আমাদের থাকার স্বদেশ ।

নিষ্ঠুর হিংস্রতা ছাড়া আনন্দ ঘটে না:

হৃদয়ী নায়কমাত্রে ঘোর ইডিয়ট

কেননা পাবলিক হল নির্মিত প্রাণী ।

সাঙ্গপাঙ্গদল ।।

আত্তিলা মাস্তান জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ

পাবলিক মানেই তো ভেড়াদের পাল

জন্মসিদ্ধ অধিকার কান্নাকাটি করা ।

আত্তিলার খচ্চর ( নারীকন্ঠে ) ।।

চলুন সম্রাট এটা হাঘরের গ্রাম

ঘাসও তো দেখতে পাচ্ছি না কোনোখানে

উঁহু, পুং ঘোড়াদের দেশ এটা নয়

এখানে বুকনিই পায় বক্তাকে খুঁজে

বর্তমান এলে লোকে অতীতকে খায়

স্মৃতির জোচ্চুরি নিয়ে সমাজটা চলে

ভাবছে ম্যাজিক হবে হাপিত্তেশ করে ।

কদমগাছ ( পুরুষকন্ঠে কোরাস ) ।।

সত্য বলছে আত্তিলা, কিন্তু মনে রেখো

উনি আর ওনার লোকেরা কাঁচা মাংস

খেতে ভালোবাসে । স্নান করবার প্রথা

এমনকী গরমেও ছোঁচাবার প্রথা

ওনার রাজত্বে নেই । জলের অভাব

আছে তোমাদের দেশে ; তার সমাধান

এতে হবে । খাবার সুরাহা হবে । বিয়ে

দিতে হবেনাকো মেয়েদের । পোশাকের

খরচ বাঁচবে । জনসংখ্যা কমে যাবে ।

এনার শিরায় বয় কংসের পুঁজ ।

আত্তিলা ।।

পারছ বুঝতে তো আমার খচ্চরও

তোমাদের চেয়ে কত জ্ঞানী ও বিদ্বান !

বুড়োরা ( কোরাস ) ।।

উঁহু চলবে না ; অমন জোকারচাঁদ

আছে আমাদের ভূঁয়ে প্রদেশে-প্রদেশে ;

তাদের সামনে খোকা তুমি চুনোপুঁটি ।

তারাও ধর্ষণ রাহাজানি লুটপাট

করতে ওস্তাদ বলে আমরা বিরক্ত ;

তাছাড়া সবাই ওরা সংবিধান মেনে

তাবৎ জোকারি করে দিব্বি পার পায়

রাসকেলে ঘুষখোরে ডান-বাম নেই

ঘাপলার অন্ত নেই, কোটি-কোটি টাকা

নামিদামিদের পেনটিং সোনাদানা

সুইজারল্যাণ্ডে ভল্টে লুকিয়ে রেখেছে ।

ফুসলিয়ে মেয়েদের বাজারে চালান করে ।

তুমি চাপো ঘোড়ার ওপরে । তারা চাপে

দেঁতো হেসে সরকারি মোটরগাড়িতে

এই যা তফাত, তাছাড়া সবই এক

প্রতিদ্বন্দ্বী খচ্চরে-গুণ্ডায় দেশ ছয়লাপ ।

আত্তিলা ।।

ওরা সব আমারই দত্তক সন্তান ;

আনন্দ পেলাম শুনে করে খাচ্ছে ওরা ।

যাই, আরো গণতন্ত্রে আছে আমন্ত্রণ ।

[ ঘোড়ার পিঠেতে চেপে উধাও হলেন

মাতিতে থুতুর দলা ফেলে আৎতিলা ।

সাঙ্গপাঙ্গদল তাঁর পেছন-পেছন

তামাকের পিচ কদমের গাছে ফেলে ।

হাততালি বাজালেন কদমের গাছ ;

বেজে ওঠে পাঙ্ক রক শীৎকারসহ ।

আবির্ভূত হল রোমের সম্রাট বুড়ো

ক্যালিগুলা নাচতে-নাচতে শিস দিয়ে

সঙ্গে তাঁর বুকখোলা যুবতীর দল

আর দুটি চেনে-বাঁধা কালো জাগুয়ার । ]

ক্যালিগুলা ।।

কী বলছিল আত্তিলা ব্যাটা নরাধম ?

আমার রাজত্বে গিয়ে জেনে নিতে পারো

সেখানে আমার মূর্তি হারকিউলিস

অ্যাপোলো মার্কুরি রূপে পুজো করে লোকে ।

সবাইকে চোখ বুজে দেখি, এমনকী

আমার ঘোড়াকে রাজদূত মর্যাদায়

প্রোমোট করেছি । ভাইবোন ভেদাভেদ

নেই বলে নিজের বোনের সঙ্গে শুতে

কোনো বাধা নেই । অজাচার অনাচার

আইনসঙ্গত কেননা যে আইনই

আমি । টুসকি বাজালে গলা কাটা যায়,

জেলে দিই আমার কার্টুন যদি আঁকে ।

তা এমন শান্তিস্বস্তি  কেউ পারবে না

দিতে তোমাদের । আমি মহা-ধুরন্ধর ।

পাবলিক ব্যাপারটা স্রেফ জুয়াচুরি ।

জাগুয়ারজোড়া ( পুরুষকন্ঠে ) ।।

পাবলিক ব্যাপারটা স্রেফ পাঁয়তাড়া ;

জীবের জগত মুছে ফেলবার ট্রিক

অপরাধহীন কোনো রাজনীতি নেই

আবিষ্কার করতে শেখাও মহাভয়

বাঁচবে কী করে প্রাণী কুবলে না খেলে !

কদমগাছ ( নারীকন্ঠে কোরাস ) ।।

সত্য বলছেন উনি কিন্তু মনে রেখো

ক্যালিগুলা মগজবিহীন কালজয়ী ;

ওনার রাজত্বে যদি অশান্তির খোঁজ

করো, তা তোমরা পাবেনাকো । একেবারে

যাকে বলে শ্মশানের শান্তি সারাক্ষণ

অলিখিত সংবিধান ওনার জিভেতে

যে জিভ চোবানো থাকে যোনিতে মাদকে ;

অন্যের বউকে এনে ধর্ষণ করার

বিশ্ব রেকর্ড রয়েছে এই শাসকের ;

ওর হাঁ-এ বক্রাসুরী বাঁকা দাঁত আছে ।

ক্যালিগুলা ।।

কারেক্ট বলেছে কদমের গাছ । আমি

যা বলি তা সংবিধান । তাই সমস্যাই

নেই কোনো আমার রাজত্বে । যোনি-লিঙ্গে

বসিয়েছি সারভিস ট্যাক্স । ইতিহাস

লেখকরা ওব্দি জানে না আমার গল্প

এত রকমের চর দরবারে আছে ;

দলের কাজের লোক তারা ফি-প্রহর

কেননা আমিই দল আমি সংবিধান

বানাই যখন ইচ্ছা কিংবা পালটাই ;

তোমাদের মতো জাতিপ্রথা-মার্কা নয় ।

মিডিয়া আমার থুতু চেটে মজা পায়

ভয়ে নাগরিকগুলো টুঁশব্দ করে না ।

এই তো দেখতে পাচ্ছ কত যুবতীরা

আমার নেশায় থাকে পুরো দিলখুশ ।

পাবলিক জিনিসটা চরসের ধোঁয়া ।

জাগুয়ারজোড়া ( নারীকন্ঠে ) ।।

আমরা এদের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান

এদের নিয়তি হল হাপিত্তেশে মরা ।

কদমগাছ ( পুরুষকন্ঠে কোরাস ) ।।

সঙ্গে নিয়ে যেতে পারো তোমরা ওনাকে

অন্য কোনো প্রতিযোগী নেতা থাকবে না

ছিঁচকে চামচা-নেতা দেবে দে-চম্পট ।

কনেদের জন্যে বর খুঁজতে হবে না ।

বুড়িরা ( কোরাস ) ।।

না মা, অমন নেতার কোনো প্রয়োজন

নেই । আমরা অতিষ্ঠ তেএঁটে পাগলে,

মা-বোনের সঙ্গে শোয় এইসব নেতা

পেয়ে । খুনি ধর্ষক ডাকাত দাঙ্গাবাজ

ওরাই তো মসনদে বসে কলকাঠি

নাড়ে, দু-চারটে প্রদেশে । পাথর-মূর্তি

নিজের ও চোদ্দপুরুষের মোড়ে-পার্কে

পাঁচতলা বাড়ির সমান কাটাউট

বসিয়ে তারাও অন্ন ধ্বংস করে যাচ্ছে ;

শ্বশুর ধর্ষণ করে ছেলের বউকে

পুলিশ ধর্ষণ করে লকাপে ঢুকিয়ে

যার ফলে হারামি বিয়োয় ফি-বছর ।

সেসব হারামি একজন আরেকের

পোঁদে বাঁশ কোরে, কুকুর-কুরি ঢঙে

ঘেউ-ঘেউ চিৎকারে সমাবেশ করে

কখনো রাস্তার মোড়ে গেটে ময়দানে ।

আমরা তো শান্তি চাই, দুইবেলা পেট

ভরে খেয়ে-পরে আরাম শৃঙ্খলা চাই ।

ক্যালিগুলা ।।

ওরা সব আমারই জারজ সন্তান ;

আনন্দ পেলাম শুনে করে খাচ্ছে ওরা ।

চলি, আরো গণতম্ত্রে বহু কাজ আছে ।

[ নাচতে-নাচতে শিস দিয়ে হাফ-ল্যাংটো

মেয়েদের কোমর জড়িয়ে অন্তর্ধান

করলেন ক্যালিগুলা । কদমের গাছ

হাততালি দিলেন এবার জোরে-জোরে ।

গলায় খুলির মালা পরে কয়েকটা

হাড়গিলে মানুষকে হাতকড়া বেঁধে

প্রবেশ করল পলপট, জলপাই

রঙের পোশাকে । সামরিক বাজনার

জগঝম্প হইচই ওঠে চারিদিকে । ]

পলপট ।।

দেখলুম ক্যালিগুলা উন্মাদ কাঁহিকা

গেল ওইদিকে কোনো মাগির ধান্দায় ;

তা তোমরা খুঁজছ এমন একজন

যে কিনা শৃঙ্খলা শান্তি সুখ এনে দেবে ।

আমি জোকার-সন্তান । সমাজের তলা

থেকে উঠে গরিব ভাগাও অন্দোলন

করে শহরের সবকটা মানুষকে

লাগিয়েছি ধান চাষে । গ্রাম-শহরের

পালটা-পালটি হয়ে গেছে, যেকারণে

কারোর মনেই কোনো ঈর্ষা-দ্বেষ নেই ;

প্রতিটি শহর দ্যাখো হয়ে গেছে গ্রাম,

ধানশীষে মধু হয় গোরু দ্যায় ডিম

গোবরের পোকা খেয়ে সোনা হাগে লোকে

সকলেই ভাই-ভাই নয়তো যে-যার

নিজের কবর খুঁড়ে মাটির তলায়

রাতেও সবাই খাটে বলে পাবলিক

বাড়বার কোনো সুযোগ-সুলুক নেই

মিছিল-মিটিঙ করা নিষিদ্ধ করেছি

কেরানিরা দিন-রাত চাষ করে মাঠে

খবরের পত্রিকা ছাপতে দিইনাকো

সুতরাং কোনো গুলতানি উঠবে না ।

আমার রাজত্বে পাবলিক বলে কিছু নেই ;

মাটিই মানুষ তাই মানুষও মাটি ।

জমির মালিক জমি নিজে, বুঝলে হে

পরিবার ব্যাপারটা লোপাট করেছি

কেননা আমিই সকলের পরিবার ।

কদমগাছ ( নারীকন্ঠে কোরাস ) ।।

হ্যাঁ, ইনি ইস্কুলে বারবার ফেল-করা

মহাসাম্যবাদী । প্রজারা এনাকে বলে

এক নম্বরের দাদা । কারোর তুলনা

এঁর সঙ্গে করা চলবে না ; তা সে ইদি

চেঙ্গিজ পিনোশে যে-ই হোন । করলেই

ধড়টা লোপাট । অতএব পল পট

যদি তোমাদের নেতা হন, পড়াশোনা

করতে হবে না বলে বাবা-মা-সন্তান

সবাই চাষের কাজে খেতচাষি হবে ;

শিল্পের ধান্দায় দেশ হবে না বিনষ্ট

অসাম্য লোপাট হবে সর্বত্র সমাজে ।

মাত্র তিনটি বছরে উনি কুড়ি লক্ষ

পাবলিক কমিয়ে ছিলেন । তোমাদের

দেশ জনসংখ্যা বৃদ্ধি থেকে মুক্ত হবে

জমির স্বামীত্ব নিয়ে গোল বাধবে না ।

প্রতিবাদ করার হবে না দরকার ।

যুবকেরা ( কোরাস ) ।।

আরে ওরকম ফেলমারা গানডুতে

আমাদের রাজনীতি পচে একাকার ।

এদেশেও জনগণ বলে কিছু নেই ।

কর্তারা যখন যাকে ইচ্ছে তুলে নিয়ে

বেমালুম মাটিতে মেশাতে এক্সপার্ট ।

জঙ্গল দখল কোরে আদিবাসীদের

তাড়িয়ে মাটির তলা থেকে খেয়ে নিচ্ছে

সোনাদানা লোহাতামা ম্যাংগানিজ ধাতু ।

ভিখারিরা ধনী হল রাজনীতি করে

কেরানিরা পার্টিবাজি করে জমিদার ।

পলপট ।।

ওরা সব আমারই বেজন্মা সন্তান

আনন্দ পেলুম শুনে করে খাচ্ছে ওরা ।

টাটা বাই, অন্য কোনো গণতন্ত্রে যাই ।

[ পলপট কয়েদিরা বিদায় নিলেন ।

কদমের গাছ পুনরায় হাততালি

দিতে, ট্যাপডান্সে কুচকাওয়াজ কোরে

মুঠোর সেলামসহ ঢোকে হিটলার

সঙ্গের দেহরক্ষীরা নাচতেই থাকে

ট্যাপডান্স । কদমের গাছ হাততালি

দিলে বন্ধ হয় সবায়ের নাচানাচি । ]

হিটলার ।।

দেখলুম, কেটে পড়ল অনার্যগুলো

আরে ওরা আমার চুলের যুগ্যি নয়

নেতা হতে হলে চাই বিশুদ্ধ মা-বাবা ;

এমন দানব যার কথা আত্মহারা

করে দেবে সবাইকে খোকা থেকে বুড়ো

সমাজ চলবে শুধু নেতার কথায় ;

যত বেশি মতামত ততো গণ্ডোগোল

তাকিয়ে দেখলে টের পাবে, অশান্তির

প্রধান কারণ চারিদিকে, স্বাধীনতা

পেয়ে কাজকর্ম করতে চায় না কেউ ।

দেশকে টাইট দিতে হবে সারাক্ষণ

যাতে কেউ একটুও একান্ত নিজের

সময় না পায় । জনগণ ব্যাপারটা

চটকে মিশিয়ে দিলে ব্যাস কেল্লা ফতে ।

ভিন্নমত দেখলেই পোড়াও বিষাক্ত

গ্যাসে, তাদের নিশ্চিহ্ণ করো একেবারে ।

আমার টোটকা হল লেবেনস্রাউম,

জবরদখল করে ঝাণ্ডা পুঁতে দাও ।

যুবতীরা ( কোরাস ) ।।

আরে দাদু, অমন ভেড়ুয়া মাসতান

রয়েছে প্রতিটি রাজনীতিকের স্টকে

যাদের কাজই হল সকাল-বিকাল

একে-তাকে পোঁদে বাঁশ করে টাকা তোলা ;

অন্য মত শুনতে পেলেই পুঁতে দেবে

জলজ্যান্ত মাটির একশো হাত নিচে ।

আপনারি ঢঙে সেলাম ঠুকতে হয়

পাড়ার সিনডিকেট মাথারা এলেই ;

দেয়ালের পোস্টারের কথাও ফতোয়া ।

পোঁদেতে পার্টির ছাপ পেলেই সে নেতা ।

লেবেনস্রাউম ছাড়া কিছুই বোঝে না

আমাদের পার্টিবাজ জোকার বংশজ ।

দেয়াল দখল শুধু নয়, বউ-মেয়ে

বাড়িও দখল হচ্ছে দিনের আলোয় ।

কদমগাছ ( পুরুষকন্ঠে কোরাস ) ।।

আরেকবার ভেবে দ্যাখো, এনার মতন

দিগ্বিজয়ী দানব আসেনি কখনও ;

ইনি হ্যামেলিনের সেই বাঁশিওয়ালা

মানুষকে ইঁদুরে পালটে দিতে ওঁর

জুড়ি জন্মায়নি এখনও কোনো দেশে ।

অসন্তোষ থেকে উনি পৌঁছোন পোগ্রোমে ।

শত্রু মার্কা দিয়ে করেন নিকেশ উনি ;

ফলে নিমেষেই সারা দেশ শত্রুহীন

তারপর শ্বাসরোধী শান্তির ফোয়ারা ।

বুড়োরা ( কোরাস ) ।।

আরে নানা । সবকটা দলেই তো আছে

এই টাইপের অতিবজ্জাত জোকার

যারা জবরদখল করে দেশটাকে

উইপোকা হয়ে কুরে শেষ করে দিল ;

জনগণ ভয়ে মুখ খুলতে চায় না ।

কখন যে কোন লোক ইঁদুরে পালটে

যাবে, কারো জানা নেই । তাইতো চাইছি

আসুক এমন কোনো বিশুদ্ধ মানুষ

যার গায়ে গুয়ের কসমেটিক নেই—

মসনদটাকে সে ময়লা করবে না ।

হিটলার ।।

কারেক্ট বলেছে গাছ কদমের । যদি

ইঁদুরে পালটে যাও তাহলে সহজে

দেশে হবে মহামৌলবাদী জমপেশ

অন্যদের ঘৃণা করে কাটবে সময় ;

নিজেদের দুঃখ কষ্ট ভাবতে হবে না ।

যে তোমার মতাদর্শে নেই তাকে মারো

মৃত্যুর নেশায় থাকো মশগুল হয়ে

আত্মাহুতি দিয়ে সব ধ্বংস করে দাও ।

কদমগাছ ( নারীকন্ঠে কোরাস ) ।।

ওঁর মন্ত্রে তোমরা সবাই এককাট্টা

হয়ে, ভুলে যাবে যাবতীয় দুঃখ কষ্ট

একে আরেকের দিকে নজর ঘুরিয়ে

আড়চোখে চরগিরি করতে পারবে ;

সময় আপনা থেকে হু-হু কেটে যাবে

মৌলবাদ বড়ই মধুর সেঁকো বিষ

যত মজে থাকা যায় তত তার মজা ।

যুবকেরা ( কোরাস ) ।।

মৌলবাদীদের হাতে ধাতানি-প্যাঁদানি

খেয়ে আমরা রক্তাক্ত বোবা আধমরা–

চাই না একলষেঁড়ে ওরকম জ্ঞান ।

ওই রাজনীতি করিয়েতে ছেয়ে গেছে

যারা শুধু চায় তাদের কথাই মানো

এমনকী শিশুদের দুধে তা মেশাও ।

চলবে না আত্মঘাতী বিশ্ববীক্ষা বিষ ;

পৃথিবীর কুষ্ঠরোগ ওই লোকগুলো

মৌলবাদীদের চেয়ে ক্ষতিকর নেই ।

হিটলার ।।

ওরা সব আমারই ঔরসে জন্মেছে

আনন্দ পেলুম শুনে করে খাচ্ছে ওরা ।

ওরাই গেস্টাপো হয়ে আসে বারবার ।

[ বডিগার্ড নিয়ে হিটলার ট্যাপডান্স

করতে-করতে চলে যায় । হাততালি

দেন কদমের গাছ । শিকারি ব্রিচেসে

কোমরে টাইট বেল্ট দু-হাতে চাবুক

মাথায় কোঁকড়াচুল দোহারা মহিলা

প্রবেশ করেন ; চাবুক পটকে তিনি

দাঁড়ান পা ফাঁক করে । কদমের গাছ

এইভাবে মেয়েটির পরিচয় দেয় । ]

কদমগাছ ( পুরুষকন্ঠে কোরাস ) ।।

ইনি হান্টারওয়ালি ; হিন্দি সিনেমার

বিখ্যাত নায়িকা । যেখানে বজ্জাত পান

দেশের ভিলেনদের একা সামলান ;

দু-হাতে রিভলভার চালাতে-চালাতে

শত্রুহীন করে দেন গ্রাম ও শহর–

ফুল পাখি নদী চাঁদ ওঁর গান গায় ।

তোমাদের আর পরবর্তী প্রজন্মকে

হান্টার চালিয়ে উনি রক্ষা করবেন ।

সিনেমা-নায়িকা বলে উনি তো অমর

পোঁদেতে চাবুক মেরে ঠান্ডা করবেন

বেয়াড়াগুলোকে, যারা টাকা গেঁড়িয়েছে,

রেখেছে বিদেশে কোনো গোপন লকারে ;

মাটি থেকে ধাতু তুলে পাচার করছে

ছাপছে নকল টাকা চালাচ্ছে ধর্ষণ ;

একা হাতে সামলান হান্টারওয়ালি ।

বুড়িরা ( কোরাস ) ।।

আরে ! সেই মাদারি মামণি বাতেলানি !

হা কপাল, শেষে এই ফিলমি নায়িকা !

জীবনকে সিনেমায় আটক করার

শিল্প-শিল্প খেলা খেলে বুদ্ধিজীবিগণ–

নিজেরা তো বোকা সেজেছেন , আমাদেরো

বুঝিয়েছিলেন, সমাজ পালটে যাবে

কবিতা সিনেমা গল্প আঁকাআঁকি দিয়ে

নাচের নাটক গেয়ে বাজনা বাজিয়ে

দেশের দশের আয় বেড়ে শতগুণ !

সবই ফালতু প্রমাণিত হয়ে গেছে ।

আমরা বাস্তব চাই প্রকৃত বাস্তব ।

ধোঁয়াটে সুন্দরী দিয়ে কাজ চলবে না ।

হান্টারওয়ালি ।।

বাস্তব জগতে বাস করো বলে ভোগো

তোমরা সবাই । বিভ্রমনিবাসী হও

সারাক্ষণ কুয়াশায় বুঁদ হতে শেখো

মনে-মনে নিজেদের সুখি ভেবে নাও–

টানো নয়তো কোকেন চরস গঞ্জিকা ল

স্বপনে মিলতে পারে উদ্ধারের নেতা ।

যাক আমি চললাম, শুটিঙ রয়েছে ।

কদমগাছ ( নারীকন্ঠে কোরাস ) ।।

আমার স্টকের সব মহাজন শেষ ।

গাছে আর কতই বা অবতার ফলে !

[ দেখা যায় মোষের ওপরে চেপে

নীলদেহ যমরাজ আসরে এলেন

সঙ্গে হালখাতা হাতে চিত্রগুপ্ত-বুড়ো ;

আগে-পিছে দুইজন বাঁটকুল চাষি । ]

চিত্রগুপ্ত ।।

এঁদের কারোর তো হয়নি ডিউ ডেট !

এত ভিড়ভাড় কেন ? কিসের জটলা ?

প্রবলেম যে কী তা-ই তো টের পাচ্ছি না ।

সকলেই দিব্বি সুস্হ তবু মনমরা !

তা মনখারাপ থাকলেই ডিউ ডেট

দিই না কখনো । মন ভালো করবার

যে যার তোমাদের নিজেদের দায়িত্ব ।

কদমগাছ ( পুরুষকন্ঠে কোরাস ) ।।

এনাদের দেশে কোনো সৎ নেতা নেই

চাইছেন কাউকে পাঠিয়ে দিই আমি

অন্ধকার গন্ধ থেকে চাগিয়ে উঠুক

সৎ ও সুজন দেশ-রক্ষাকারী লোক

যমরাজের মোষ ( শিশুকন্ঠে )

তোমরা যা চাইছ তা বাতুলে বোকামি ।

সমাজ বদল করে গুবরে পোকারা–

নেতারা গোবর ভেবে ঠেলে নিয়ে যাও

গড়িয়ে-গড়িয়ে সেই তাল বড়ো হলে

আপনা থেকেই পাবে মহা-জননেতা

ইতিহাসে চিরকাল এমনই ঘটে

গোবর খসলে তার রূপ ধরা পড়ে

ঠিক যেরকম দেখা গেল এতক্ষণ

ওরা মহাজন হয়ে মসনদে ছিল

হেগেমুতে স্বদেশকে নষ্ট করে গেছে ।

কদমগাছ ( নারীকন্ঠে কোরাস ) ।।

অতএব ফিরা যাও যে যার মুলুকে

যেমন চলছে সব তেমন চলুক

তোমাদের মুরোদের বড়ই অভাব

ক্রোধ ছাড়া আস্ফালন গোসাপের বিষ ।

তবে, বার্তাহীন ক্রোধে বদল আসে না–

সুখ শান্তি পেতে হলে বিপদকে ডাকো

সাহস তো মানুষের বাঁচার আঙ্গিক

মসনদ কোনোকালে নিজেই পড়ে না ।

চিত্রগুপ্ত ।।

ফিরে যাও তারপর উঠেপড়ে লাগো ।

কোনো নেতা বদল ঘটাতে আসবে না ;

নিজেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে মসনদ ভাঙো ।

প্রিপন করতে পারি কয়েকটা ডেট

বড়োজোর । বাকি সব কাজ তোমাদের ।

[ সমবেত বুড়োবুড়ি যুবক-যুবতি

সবাই দাঁড়িয়ে উঠে চিৎকার করে

তারা সব নানাদিকে ছুটে চলে যায় । ]

————++++————–

Posted in অতিবাস্তব, অধিবাস্তব, প্রহসন | Tagged , , | Leave a comment